০৩. চার দিকে চেয়ে দেখলাম

চার দিকে চেয়ে দেখলাম। মাথার ওপর বট গাছটা মেঘের মতো অন্ধকার তৈরি করে রেখেছে। কতকগুলো ঝুরি মাটিতে নেমেছে, কতকগুলো শূন্যে ঝুলছে, বাতাস লেগে একটু একটু দুলছে, আর ডালের ভেতর দিয়ে, পাতার ফাঁক দিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া সূর্যের আলো, কেমন-একটা সবুজ রং ধরে আমাদের গায়ে এসে পড়েছ। শিরশির বাতাস বইছে।

শ্যামাদাসকাকা বিরিঞ্চিদার হাত থেকে মালাটা ছিনিয়ে নিয়ে আবার পকেটে পুরে ফেলে বলল, এসব সামান্য জিনিসে আমার কোনো লোভ নেই রে বিরিঞ্চি। ও মালা আর কী দেখাচ্ছিস? জানিস আমার ঠাকুমার গায়ে দুপুরে এক লাখ টাকার আর সন্ধ্যে বেলায় তিন লাখ টাকার গয়না থাকত। এত গয়না ছিল যে নিজেই জানতেন না কী আছে না আছে। ওঁদের বাড়িতে বাইরে থেকে গয়না পরে কেউ যদি আসত, তো মনে করতেন বুঝি ওঁরই গয়না নিয়েছে! এমনি করে কত যে শব্দুর তৈরি করেছিলেন। শেষটা তাতেই ওঁর কাল হল!

আমি বললাম, কেন, কেন, কী হয়েছিল?

শ্যামাদাসকাকা বললে, আঃ, গল্প বলবার সময় হুড়ো দিতে হয় না। কী রূপ ছিল তার তা জানিস? ওঁর পাশে যে দাঁড়াত তাকেই বাঁদরের মতো দেখাত। দুধের মতো রং, গোড়ালি পর্যন্ত কালো কোঁকড়া চুল, কান পর্যন্ত টানা চোখ, মুক্তোর সারির মতো দাঁত। তিন লাখ টাকার গয়না পরে শুতে যেতেন!

আমি বললাম, ই–স্! তারপর কী হল? নিশ্চয় খারাপ কিছু?

শ্যামাদাসকাকা বকে যেতে লাগল, একদিন সকালে উঠে দেখেন সব চুরি গেছে। শত্তুরের তো আর অভাব ছিল না। রাতারাতি কে এসে গা থেকে সমস্ত খুলে নিয়ে চলে গেছে। ঠাকুরমা টেরও পাননি। সকাল বেলা তাবিজ ঢিলে হয়ে গেছে মনে করে কনুই খামচাচ্ছেন; চেয়ে দেখেন কোথায় তাবিজ! সোনার তাবিজ নেই, হিরের রতনচূড় হাওয়া, নীলকান্ত মণি-বসানো চরণ পদ্ম, ফিরোজা-দেওয়া মুক্তোর সাতনরি, কিচ্ছু নেই। নাকছাবিটা অবধি খুঁটে তুলে নিয়ে গেছে। 

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শ্যামাদাসকাকা বলল, আমার মন বলছে এই মালাটাও সেই চুরিকরা জিনিসেরই একটা। কিছুরই ফর্দ করা তো আর ছিল না। তবে এটার কতই-বা দাম হবে? বড়ো জোর বিশ-পঁচিশ হাজার!

বিরিঞ্চিদা সামনের দিকে ঝুঁকে বলল, দ্যাখ শ্যামাদাস, তোর মনে পাপ ঢুকেছে; তুই খুব ভালো করেই জানিস এটা সেই জমিদার গিন্নির মালা। হয়তো ওই লুঙ্গিপরা লোকটার সঙ্গে তোর ষড় ছিল। দেখিস এরজন্য তোকে ঝুলতে হবে।

দেখলাম হিংসায় বিরিঞ্চিদার মুখটা সবুজ হয়ে গেছে।

শ্যামাদাসকাকাও দেখলাম দারুণ রেগে গেছে, আমি ঝুলব মানে? বাঃ বেশ বললি যা হোক! তুই আর পিসিমা–

বিরিঞ্চিদা হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে শ্যামাদাসকাকার মুখটা চেপে ধরে নাক দিয়ে আমাকে দেখিয়ে বললে, স্-স-স-স চুপ কর ভাই। বলেছি তো তোকে চীনে হোটেলে চ্যাং-ব্যাং খাওয়াব। তা ছাড়া তোর নিজেরও তো–

সবাই চুপ করল।

ঠানদিদি মোষ দেখার পর আর কথা বলেননি। এখন হঠাৎ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, হরি হে, সবই তোমারই ইচ্ছে। নইলে আমারই-বা সেজোপিসিমার মুক্তোর মালা বাক্স থেকে বেমালুম অদৃশ্য হবে কেন। ভাবতে পারিস তোরা, খাটের তলায় বাক্স, বাক্সের ওপর সের পঁচিশেকের সাঁড়াশি বারকোশ, বাক্সের মুখ মোটা ছাগলদড়ি দিয়ে বাঁধা, খাটের ওপর অষ্টপ্রহর সেজোপিসিমা শুয়ে। আমার বিয়েতে ওই দিয়ে আশীর্বাদ করবেন বলে না খেয়ে, না ঘুমিয়ে, বছরের পর বছর মালা আগলাচ্ছেন। কবে আমার বিয়ে হবে। এদিকে আমি তখনও জন্মাইনি পর্যন্ত! শেষটা একদিন দেখেন কিনা বাক্সের মুখ যেমন দড়ি দিয়ে তেমনি দড়ি দিয়েই বাঁধা; সাঁড়াশি বারকোশ যেমনকে তেমন; খালি বাক্সর মধ্যে লাল চেলির টুকরোয় বাঁধা মালাগাছি নেই। সেই শোকেই তো আমি জন্মাবার আগেই সেজোপিসিমা গেলেন! নইলে কী আর এমন বয়স হয়েছিল! মাত্র একাশি বচ্ছর। অথচ ওঁরই মা দিদিমারা হেসে-খেলে সাতানব্বই আটানব্বইটি বচ্ছর কাটিয়েছিলেন। হরি-নারায়ণ! এ মালাটা যেন অবিকল সেই। একরকম বলতে গেলে এটা আমারই মালা!

বিরিঞ্চিদাও কম যায় না। সে বললে, আমার জীবনেও কি মুক্তোর মালা নেই নাকি? জানিস, যেবার আমি প্রথম বার বি.এ. পরীক্ষা দিই, শেষদিন পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি, দেখি সামনে এক সন্ন্যিসী। কী করি ট্রামভাড়া ছাড়া হাতে একটি পয়সা নেই। তাই-ই দিয়ে দিলাম। সন্নিসী বললেন, ব্যাটা তোকে পাস করানো কারো কম্ম নয়, তবে এই জিনিসটা নে, কিছুটা শান্তি পাবি। বলে একটা ছোটো পুটলি দিলেন। বিকেলে বাড়ি গিয়ে খুলে দেখি ঠিক এইরকম একটা মুক্তোর মালা।

আমি বললাম, অ্যাঁ। তারপর সেটার কী হল?

বিরিঞ্চিদা বলল, দুঃখের কথা আর বলিস কেন। ভুলে সেটা সুদ্ধই জামাটা বোপর বাড়ি দিয়েছিলাম। তা ধোপর বাড়ি থেকে একটা পেনসিল ফেরত পাওয়া যায় না, ও কি আর ফিরে আসে! ধোপাটাও আবার পরদিন থেকে নিখোঁজ। হয়তো এসব বিশ্বাস করবি না।

আমিও এ কথা শুনে বললাম, ও হ্যাঁ, আমারও মনে পড়ছে—

ওরা তিনজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, চোপ্। ফের বানাচ্ছিস!

ঠানদিদি নিশ্বাস ফেলে বলে যেতে লাগলেন, ইস্, ভাবতে গিয়েও আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে হাঁসের গায়ের মতো হয়ে গেছে। সেবার সেই যে মেমের পালক-দেওয়া টুপি দেখে ভয় পেয়ে, চিড়িয়াখানার খাঁচা ভেঙে বাঘ বেরিয়ে এসেছিল, তোদের কারো মনে নেই? তবে মনে থাকা শক্ত, কারণ তোরা কেউ ছিলি না। সেই যে সব একতলার দরজা জানলা বন্ধ করে দোতলায় বসে থাকতে হয়। উঃ! এখনও মনে করলে হাত-পা পেটের ভেতর সেঁদোয়। তার মধ্যেও সেজোপিসিমা মালাগাছি প্রাণ দিয়ে রক্ষা করেছিলেন। শেষে কিনা– বলে ঠানদিদি চোখে আঁচল দিলেন।

শ্যামাদাসকাকা একটু যেন রাগ রাগ ভাব করে বলল, থামো দিকিনি। মনের দুঃখুগুলো এখনকার মতো চেপে রেখে, কী করা যায় তাই ভাবা যাক।

ঠানদিদি বিরক্ত হয়ে বললেন, তা শুনতে ভালো লাগবে কেন? মালাটা কি তুই সহজে হাতছাড়া করবি? বেশ, চল, যা হোক কোথাও একটা ব্যবস্থা করা যাক। ওঠ, চল।

শ্যামাদাসকাকা বলল, চল বললেই তো আর চলা যায় না। আসল কথা হল ও গাড়ি এখনকার মতো এক ইঞ্চিও চলবে না। ওর তেল ফুরিয়ে গেছে, ওর সব কটা টায়ার ফুটো হয়ে গেছে, তা ছাড়া কিছুক্ষণ ধরে ওর পেটের ভেতর থেকে কীরকম একটা গোঁ গোঁ শব্দ বেরুচ্ছে, সে আমি একেবারেই ভালো বুঝছি না।

বিরিঞ্চিদা বেজায় চটে গেল, ইয়ে, টায়ার সব ফুটো করে দিয়েছ? ওর দাম কত তা জান? আর গোঁ গোঁ শব্দও তো আগে ছিল না।

শ্যামাদাসকাকা আরও বলল, তা ছাড়া রাস্তাও তো এইখানে শেষ হয়ে গেছে, এখন উপায়টা কী হবে তাই বল।

এই বলে তিনজনেই আমার দিকে চেয়ে রইল।

আমি বললাম, কী আবার হবে? চলো, হাঁটা দেওয়া যাক। হেঁটে গিয়ে আশ্রয় খুঁজে নেওয়া যাক। সেখানে মাথা গোঁজা যাবে, ফন্দিও পাকানো যাবে।

ঠানদিদি চটে গেলেন।

ফন্দি পাকানো আবার কী? কোথায় শিখিস এসব কথা? তা ছাড়া ওই লাখ টাকার মালা হাতে নিয়ে, এই ভর সন্ধ্যে বেলা, অঘোর বনের মধ্যে হেঁটে বেড়াব? বেঘোরে অচেনা আস্তানায় আশ্রয় নেব? তোর প্রাণে কি একটুও দয়ামায়া নেই রে?

বললাম, বেশ, তা হলে হেঁটো না, গাড়িতেই বসে থাকো, হুণ্ডারে খেয়ে নিলে আমাকে বোলো! তোমাদের পেছনে না হুলিয়া লেগেছে?

এই বলে আমার দিকের দরজাটা খুলে নেমে পড়লাম।

হুলিয়ার কথা শুনেই ওরাও এ-ওর পা মাড়াতে মাড়াতে ঠেলাঠেলি করে নেমে পড়ল।

উঃ! বসে থেকে থেকে হাতে পায়ে খিল ধরে গেছিল! খানিক হাত-পা সোজা-বাঁকা করে, বাবা যেমন বলেছিলেন, সেইরকম করে খিল ছাড়ালুম। ওরা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। তার পর বিরিঞ্চিদা বলল, যত ঢঙ! নে, নে, গাড়ির কাচটাচ তোল, দরজাগুলো এঁটে দে! আমারও যখন-তখন হাতে-পায়ে খিল ধরে যায়।  

টিফিন-ক্যারিয়ারে দু-চারটে লুচি-টুচি যা পড়ে ছিল পকেটে ভরে নিলাম, তার পর পেছনের জানলা দরজা বন্ধ করলাম।

তখন শ্যামাদাসকাকা বলল, আর, হ্যাঁ, দ্যাখ, আমি যা ভুলো মানুষ, মালাটাও বরং তোর কাছেই রাখ, আমি আবার কোথায় হারিয়ে ফেলব।

বলে মালাটা একরকম জোর করে আমার হাতের মধ্যে গুঁজে দিল। বেশ একটু হাসি পেল আমার।

মালা হাতে নিয়েই জানলা তুলতে লাগলাম। তারার আলোতে মুক্তোগুলো ঝিকমিক করতে লাগল।

হঠাৎ আমার গা শিউরে উঠল, বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল! যা ঘটবার নয়, তাই ঘটে গেল।

কিন্তু কেউ কিচ্ছু খেয়াল করল না। তাই আমিও স্রেফ চেপে গেলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *