০৩. গাড়ি যখন খিদিরপুর ব্রিজের কাছাকাছি

গাড়ি যখন খিদিরপুর ব্রিজের কাছাকাছি এসেছে, চঞ্চল জিগ্যেস করলে, “বাড়ি ফিরবেন?”
বিজয়বাবু ক্লান্ত স্বরে বললেন, “ব্যাপরটা বড়ই গোলমাল ঠেকছে। কী করব ভেবে পাচ্ছি না।”
চঞ্চল বললে, “সত্যি যদি কোনো গুণ্ডামি সন্দেহ করেন, তাহলে পুলিশে খবর দেওয়া উচিত। তার আগে হাসপাতালগুলোতে একবার খবর নেওয়া ভালো – যদি কোনো অ্যকসিডেন্ট হয়েই থাকে!”
“বেশ।”
চঞ্চল গাড়ির মুখ ঘোরাতে বললে। কলকাতার সবকটা হাসপাতালে খবর নেওয়া হল। কোনো হদিশ মিলল না। আর যাই হোক, পরীক্ষিৎবাবু গাড়ি চাপা পড়েন নি।

রাত তখন প্রায় দুটো। এরপরে থানায় খবর দেওয়া শুধু বাকি। হঠাৎ চঞ্চলের মনে হল, মহিমবাবু এখনও হয়তো তা জন্য জেগে বসে আছেন। সে তাড়াতাড়ি বললে, “ আমাকে এখন একবার মহিমবাবুর বাড়ি যেতে হচ্ছে। তিনি পরীক্ষিৎবাবুর খবরের জন্য ব্যস্ত হয়ে অপেক্ষা করছেন। আমাকে টেলিফোনে বলেছিলেন, যত রাতেই হোক, ত্মাকে একবার জানিয়ে যাই যেন।”
“বেশ তো, চল, আমিও যচ্ছি তাঁর কাছে। পুলিশে খবর দেবর আগে তাঁর পরামর্শটাও নেওয়া যাবে।”

মহিমবাবুর বাসা বাগবাজারে। গাড়ি বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই চঞ্চল লক্ষ করল, নীচে মহিমবাবুর আপিস ঘরে আলো জ্বলছে। যা ভেবেছিল – তিনি অপেক্ষা করছেন। আস্তে তোকা দিতেই দরজা খুলে দিলেন মহিমবাবু স্বয়ং। খোলা গায়ে সাদা পৈতেটি ঝুলছে, চোখে চশমা, দাড়িগোঁফ কামানো সৌম্য প্রৌঢ় মুখ। তাকে দেখেই বললেন, “এস। বিজয়ও এসেছ? এস, ঘরে এস।”

উপরিঅলাকে কেউ সাধারণত দেখতে পরে না, কিন্তু চঞ্চল মহিমবাবুকে ভারি পছন্দ করে। চমৎকার মানুষটি। অসাধারণ পরিশ্রমী, আলাপে মধুর, ভদ্রতায় ত্রুটি নেই। সবই ভালো, কিন্তু – চঞ্চলের ধারণা – বুদ্ধি তাঁর একটু কম, তাই এত গুণ নিয়েও ব্যবসায়ে কৃতী হতে পারেন না। অথচ ব্যবসার দিকে ঝোঁক তাঁর বরাবরই। এম. এ. পাশ করে প্রফেসারিতে ঢোকেন, কিন্তু নন কো অপারেশনের হুজুগে চাকরি ছেড়ে দিয়ে কংগ্রেসের দলে ভেড়েন, তারপর হুজুগ যখন কমে এল, “চ্যাটার্জি ব্যাঙ্ক” নাম দিয়ে একটি ব্যাঙ্ক স্থাপন করেন। দশ বছর দিব্যি চলবার পর ব্যাঙ্কটি হঠাৎ একদিন ফেল পড়ে; কে একজন জাল শেয়ার বেচে তিন লাখ টাকা সরিয়ে নেয়। তারপর কিছুদিন তাঁর দারুণ দুরবস্থায় কাটে – কিন্তু দমে যাবার পাত্র মহিম চাটুয্যে নন। আবার ঘোরাঘুরি করে টাকাকড়ি যোগাড় করে ‘কলকাতা হরকরা’ বার করলেন, সে আজ বছর চারেক হল। কাগজটির যে আরও তাড়াতাড়ি এবং আরও বেশি উন্নতি হচ্ছে না, তারও কারণ চঞ্চল ভেবে দেখেছে – আর কিছুই নয়; মহিমবাবুর অতিরিক্ত ভালোমানুষি, অর্থাৎ তীক্ষ্ণ ব্যবসাবুদ্ধির অভাব।

তাদের ঘরে বসিয়ে মহিমবাবু প্রথম কথা বললেন, “দু জনেরই চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, একটু চা দরকার।”

বিজয়কৃষ্ণ ক্ষীণ আপত্তি করলেন, কিন্তু তার আগেই মহিমবাবু গিয়ে ইলেকট্রিক কেৎলিতে জল চাপিয়ে দিয়েছেন। তাঁর এই ঘরটি বেশ বড়। মাঝখানে বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিল, চামড়ায় মোড়া খুব চওড়া কয়েকটি চেয়ার, দেয়ালে লাগানো আলমারিগুলো মোটা মোটা বইয়ে ঠাসা, এক কোণে একটি ছোট টেবিলে ইলেকট্রিক কেৎলি আর চায়ের সরঞ্জাম। অনেক সময়ে তিনি এ ঘরে দরজা বন্ধ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করেন, দরকার মতো নিজেই চা তৈরি করে খন, চাকর ডাকেন না। ঘরটিতে এমন আরাম আর একটি লেখাপড়ার আবহাওয়া যে, চঞ্চলের ভারী ভালো লাগে। সে ভেবে রেখেছে যে, কোনোদিন যদি তার পয়সা হয়, তাহলে ঠিক এরকম একটি ঘরে সে থাকবে।

চমৎকার গরম চা আর কয়েকখানা বিলেতি বিস্কুট তাদের সামনে রেখে মহিমবাবু বললেন, “খাও।”

চঞ্চল বেশ সাগ্রহেই খেল। তার রাত্তিরের খাওয়া আজ হয়নি, রীতিমতো খিদে পেয়ে গিয়েছিল। বিজয়কৃষ্ণও শব্দ করে করে সবটুকু চা খেলেন, বিস্কুট ছুঁলেন না। বোঝা গেল চা খেতে তাঁর অভ্যেস নেই; এই উত্তেজনার সময়ে চাঙ্গা হয়ে ওঠবার আশায় খেলেন।

চা খাওয়া হয়ে গেলে মহিমবাবুই নিজের হাতে পেয়ালাগুলো সরিয়ে নিয়ে গেলেন। তারপর বললেন, “কী খবর?”
চঞ্চল সমস্ত ঘটনা সবিস্তারে বললে। শুনে মহিমবাবু অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে গেলেন। বিজয়কৃষ্ণ ক্ষীণস্বরে বললেন, “ আপনার কী মনে হয়?”
“কিছু তো বুঝতে পারছিনে, তবে গোলমেলে মনে হচ্ছে! কী করবে?”
বিজয়কৃষ্ণ বললেন, “পুলিশে খবর দিতে চাই।”
“হ্যাঁ, তাছাড়া আর উপায় কি? দেখি কার্ডটা!”
বিজয়কৃষ্ণ সযত্নরক্ষিত কার্ডটি বের করে মহিমবাবুর হাতে দিলেন। মহিমবাবু কার্ডটি একটু নেড়ে চেড়ে কপাল কুঁচকে বললেন, “ঠিক দেখেছিলাম। আমার কক্ষণো ভুল হয়নি।”
“ এখন একবার শেষ আশা। পুলিশে খবর দেবর আগে বাড়িতে একবার ফোন কর, বিজয়।”

কথাটা শুনে হঠাৎ চঞ্চলের মনে হল হয়তো এ সব কিছুই নয়, হয়তো পরীক্ষিৎবাবু এখন বাড়ির বিছানায় শুয়ে আরামে ঘুমুচ্ছেন।
ফোন ধরল পরীক্ষিৎবাবুর পুরোনো প্রিয় চাকর নিমাই। সে জেগেই বসে ছিল। বাবুকে কী তবে পাওয়া গেল না? কী উপায় হবে আমাদের? টেলিফোনেই সে প্রায় হাউ মাউ করে কেঁদে ফ্যালে আর কি!

তখন মহিমবাবু বললেন, “চঞ্চল, তুমি আপিসে চলে যাও। এই খবরটা আজকের মেন নিউজ হবে। পরীক্ষিৎ মহুমদারের অন্তর্ধান। উঃ, কাল সকালে কলকাতার লোক কী একটা শক পাবে।”
চঞ্চল জিগ্যেস করলে, “এ বিষয়ে কোনো প্যারাগ্রাফ – “
“না – না – এখন কোনো কমেন্ট নয়। শুধু খবরটা খুব বড় করে দিয়ে দাওগে। একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিও মোড় থেকে।”
চঞ্চল চলে গেলে বিজয়কৃষ্ণ বললেন, “তাহলে পুলিশে -”
“হ্যাঁ, এক্ষুণি খবর দিয়ে দিচ্ছি” – বলে তিনি নিজেই ফোন করলেন লাল্বাজারে।
ফোন নামিয়ে রেখে বললেন, “সাতটার সময়ে ইন্সপেক্টর যাবে তোমাদের বাড়িতে এনকোয়ারি করতে। এখন তুমি এখানেই বিশ্রাম কর। আমি ঠিক সময়ে জাগিয়ে দেব।”
ঘরের এক পাশে একটি পার্টিশন, তার আড়ালে একটি কৌচ, মহিমবাবু দরকার মতো সেখানে বিশ্রাম Kরেন। বিজয়বাবুকে সেটি দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “একটু শুয়ে নাও। কিছু ভেব না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”

এই আশ্বাস বাণী শুনে বিজয়কৃষ্ণের মনটা তখনকার মতো যেন একটু হালকা হয়ে গেল। কুশানে মাথা রেখে তিনি শুয়ে পড়লেন, এবং ঘুমিয়ে পড়তে এক মিনিটও দেরি হল না। নীল ঢাকনা দেওয়া টেবল ল্যাম্প জ্বেলে মহিমবাবু কী একটা লেখার কাজ করতে লাগলেন।

ঘরের দেয়াল ঘড়িতে হঠাৎ তিনটার ঘণ্টা বাজতেই বিজয়কৃষ্ণ একবার চমকে জেগে উঠলেন। ঘুমটা তাঁর তখনও কাঁচা ছিল। আবার চোখ কচলিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, মহিমবাবু তখনও একমনে কি যেন লিখে যাচ্ছেন।
তারপরই বিজয়কৃষ্ণ আবার গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে গেলেন। তাঁর আর কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *