কিন্তু গফুর কলুর ওপর রাগ করে কি আবিতনের কথার ঝাঁঝ মোছা যায়? ডোবার ধার থেকে উঠে ঘরের দিকে যেতে যেতে মাটিতে কুলসুমের পা পড়ে দরকারের তুলনায় অনেক বেশি জোরে। এতোগুলো ভারি কদমে আবিতনের পাছায় লাথি ছুঁড়ে মারা হয়। না। বরং পায়ের ভেতর দিয়ে মাগীর চোপা কুলসুমের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ঢুকে তার সারা শরীরে কোলাহল তুলতে থাকে। ভাতারের ভাত-না-খাওয়া মাগীর ওপর যতোই রাগ হোক, গ্রামের আর দশটা বৌঝিদের মতো সেই রাগ ঝাড়ার ক্ষমতা কুলসুমের নাই। তার বাপ নাই এবং কোনোদিনই ছিলো না বলে বাপের বাড়ির অভাব অনটনের খোটা। দিলে সে মুখ ঝামটা দিয়ে জবাব দেয় কোন মুখে? সে যখন এতোটুকু, হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছে কি করে নি, তখনি এক চৈত্র কি বৈশাখের পূর্ণিমা রাতে ভেদবমি করতে করতে মারা যায় ওই অপরিচিত বাপটা। তারপর, কততদিন পর মনে নাই, যমুনার পুবপাড়ের এক চাষার হাত ধরে ও তাকে কোলে করে মা তার চলে যায় যমুনার পুবেরই কোনো চরে, সেই চরের নাম কুলসুম এখন পর্যন্ত জানে না। তারপর মায়ের। কোল থেকে নামবার অল্প দিনের মধ্যেই কুলসুম ঘুরতে থাকে দাদার আঙুল ধরে ধরে। চেরাগ আলি ফকির তো গান করতে করতে নানান দেশে ঘোরে, হয়তো যমুনার ওই চরে মরা ছেলের বৌয়ের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গিয়েছিলো, কুলসুমের মা-ই হয়তো সবুজ শাড়ির ময়লা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে কুলসুমকে তুলে দিয়েছিলো তার প্রথম পক্ষের শ্বশুরের হাতে। দাদার সঙ্গে এ-গাঁও ও-গাঁও নিয়ে কিন্তু মানুষ এভাবে কথা বলে নি। কয়েকটা ঘরে তো খয়রাত তার একরকম বাধাই ছিলো, শুক্রবার জুম্মার আগে। যে-কোনো সময় একবার গেলেই বেতের ছোটো টালার আধখানা ভরে চাল ঢেলে দিতো তার ঝোলায়। ঈদে বকরিলে কোনো না কোনো বাড়ি থেকে নতুন হোক পুরনো হোক লুঙি একটা ঠিকই পাওয়া গেছে। মিলাদে ফকিরকে যেতে হতো একলাই, কিন্তু কারো জেয়াফতে নাতনিকে সঙ্গে নেওয়ার এজিন না পেলে চেরাগ আলি দাওয়াত কবুলই করতো না। একবার মনে আছে, মাদারিপাড়ার পশ্চিমে খাল পেরিয়ে চন্দনদহের আকন্দবাড়ির হাফিজ দারোগার মা মহরমের চাঁদের এক ভোররাতে স্বপ্নে হাফিজের বাপকে গোরুর গোশত দিয়ে ভাত খেতে দেখে তিনজন ফকিরকে গোরুর। গোশত দিয়ে ভাত খাওয়াবার নিয়ত করে। তিন ফকিরের এক ফকির চেরাগ আলি। চেরাগের সাথে কুলসুমকে দেখে আকন্দের পুরনো বাদি হোচ্চার মা গজরগজর করে, দেখো, সাথ সাথ লাতনিক লিয়া আসিছে। ও ফকিরের বেটা, তোমার লাতনিক জেয়াফত দেওয়া হছে? চাকরানি মাগীর ভাঙা মোেটা গলার আওয়াজে উঠানের পাশে মস্ত রান্নাঘর থেকে ছোলার ডাল দিয়ে গোরুর গোশত রান্নার গন্ধ শুকনা কাটা হয়ে কুলসুমের পেটে গলায় বুকে চিরে চিরে যায় : না খেয়েই যদি ফিরে যেতে হয়! তা। হলে? কিন্তু তার দাদা চেরাগ আলি ফকির কি কাউকে পরোয়া করার মানুষ? তাঁর কথা সরাসরি বাড়ির গিন্নির সাথে, হাফিজ দারোগার মাকে লক্ষ করে সে বলে, মা, হামার। সাথে হামার লাতনি আছে গো। হামরা মাদারি ফকির, মানষের বাড়িত একলা। জেয়াফত কবুল করা হামাগোরে মানা আছে মা। একলা খাই তো হামাগোরে দোয়া। কবুল হয় না। আর একটা কথা কি, মাদারিপাড়ায় যতোদিন ছিলো, শুকুরবার দিন দুপুরবেলা খেতে বসে কথা বলা ছিলো ফকিরের জন্যে মকর, তাকে থাকতে হতো চুপচাপ। পাতে তার কখন ভাত লাগবে, গোশতের টুকরা চেয়ে নেওয়া কি এক হাতা ডাল ঢেলে দিতে বলা, দৈ দিলে আরেকটু গুড় চেয়ে নেওয়া,দাদার হয়ে এসব দায়িত্ব পালন করেছে কুলসুম। মানুষের নিয়ত বলো, মানত বলল, ফকির খাওয়ানো বলল, এমন কি খতনা, কুলখানি, জেয়াফত সাধারণত জুম্মার দিনেই আসে বেশি। নাতনিকে সঙ্গে না রাখলে চেরাগ আলির খাওয়া ভালো হবে কী করে? মাদারিপাড়ার খালটা পেরিয়ে চন্দনদহ, শিমুলতলা, শাকদা, গোসাইবাড়ি, ভবানীহাট, দরগতিলা-এসব গ্রামে বড়ো বড়ো গেরস্থের বাস। এক চন্দনদহেই তো খালি টিনের ঘর আর টিনের ঘর। শিমুলতলায় তালুকদারদের মস্ত দরদালান, ভবানীহাটে সরকারবাড়িও পাকা দালান। এসব জায়গায় আকিকা, খতনা, কুলখানি, চেহলাম, বিয়েশাদি, মানত একটা না একটা লেগেই থাকতো। দরগাতলায় শাহসাহেবের দরগাশরিফ, সেটা তো চেরাগ। আলির একরকম বাড়িঘরই বলা চলে। সেখানে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পা দিলে আর কিছু হোক, আটার খোরমা কিংবা চালগুড়ের পাতলা শিরনি জুটতোই।
আগরবাতির ধোঁয়ার সঙ্গে গুড়ের গন্ধে দরগাশরিফ সবসময় ম ম করে। ফকিরের বেটি বলে ওখানে কেউ তাকে কখনো হেলা করে নি।–না-কি করেছে? কী জানি?–হেলা যদিও করে থাকে তবু শিরনি পেতে তো অসুবিধা হয় নি।
কষ্টে কাটতো বর্ষাকালটা। বাইরে যাওয়া মুশকিল, আবার ভাদ্র মাসে আউশ কাটার আগে পর্যন্ত মানুষ সহজে ভিক্ষা দিতে চায় না। ঐ সময়টা মানুষ খোয়াবও দেখে না। ধান উঠলে ঐ এলাকার মানুষের খোয়াব দেখার ধুম পড়ে গেছে। খোয়াবে খারাপ কিছু দেখলেই চেরাগ আলির কাছে ছুটে এসেছে মানুষ, ও ফকির, কও তো, পাছারাতে দেখলাম, আমাগোরে কুয়ার পানি ক্যামা গরম ঠেকিছে। বালটি দিয়া তুল্যা গাও থোমা, পিঠোত পানি ঢালিচ্ছি, তামান পিঠ বলে পুড়্যা গেলো গো। এই খাবের মাজেজা কী, কও তো বাপু। ঝোলা থেকে একমাত্র বইটা বার করে চেরাগ আলি আস্তে আস্তে পাতা ওলটাতো। প্রতিটি পৃষ্ঠা ওলটাবার সঙ্গে জিভে আঙুল ছুঁয়ে বলতো, স্বপন তুমি কখন দেখিছো কও তো। ঠিক লগ্নটি বলতে স্বপন-দেখা মানুষটা আমতা আমতা করলে তাকে করা হতো পরবর্তী প্রশ্ন, পাছারাতোত তুমি শুছিলা কোন কাত হয়? পাশে বই রেখে বইয়ের পাতায় চোখ রেখেই ঘরের সাসনে ছোটো উঠানে কাঠি দিয়ে চৌকো চৌকো দাগ দিতে দিতে সে এরকম প্রশ্ন করেই যেত এবং অন্তত পঁচিশটা প্রশ্ন করে তার অর্ধেকেরও জবাব না পেয়েও স্বপ্নের মাজেজা বলে দিতো। কুয়ার পানি স্বপ্নে গরম হলে তার ভাগ্যে অর্থপ্রাপ্তি নিশ্চিত,-এই খবর দিয়ে না হলেও দুটো পয়সা সে কামাতোই। কিন্তু বর্ষা আর কার্তিক অগ্রহায়ণে মানুষের স্বপ্ন দেখা বন্ধ। কার্তিকের। অভাব আর কাটে না। কিন্তু অভাবের সাধ্য কি যে চেরাগ আলিকে কাবু করে? পেটে কিছু পড়ুক আর নাই পড়ুক, তার কথার তেজ যদি এতোটুকু কমে। কার্তিক হয়ে যায় তার কাছে পোয়াতি মাস। কেমন?–
ছাওয়া লে গর্ভেতে ধরি শুকায় পোয়াতি।
মাতার লোহুতে পুত্র বাড়ে দিবারাতি।।
খালি পেটে এসব শুনতে কুলসুমের ভালো লাগতো না, খালি হাবিজাবি কথা কও!
হাবিজাবি লয় রে ছুঁড়ি, বুঝ্যা দ্যাখ। চেরাগ আলি তার শোলোক ব্যাখ্যা করে, মাটি এখন গভভো ধারণ করিছে। তার গভভে দুটা মাস, এক কাত্তিক আর এক। আঘুন। পোয়াতি হলে মেয়ামানুষের শরীল শুকায়, এক প্যাট ছাড়া পোয়াতির ব্যামাক অক্ত তার খায়া ফালায় প্যাটের ছাওয়াল। পৌষ মাসে পোয়াতি বিয়ালে তার কোনো দুষ্ণু থাকে না। বলতে বলতে দাদার মুখ থেকে ব্যাজার ভাব কেটে যায়, কার্তিক মাসের অভাব যে সচ্ছলতার প্রস্তুতি ছাড়া কিছুই নয় এই আশ্বাসে সে মহা খুশি। কিন্তু ঘরে বসে আনন্দ অপচয় করার বান্দা চেরাগ আলি নয়, হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে ঝোলাটা টেনে নিয়ে বলে, চল বুবু, বেড়াকুড়া আসি। একটা বেলার খোরাক তো পামু। বেড়াকুড়া আসা মানে ভিক্ষা করা, মাদারিপাড়ার লোকজন এভাবেই বলতো। ওখানকার কেউ তার এই পেশায় দোষের কিছু দেখেনি। ছোট খাটো বিপদ আপদ, বালা মুসিবত হলে পরামর্শ নিতে কি স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন দেখলে তার তাবির জানতে তারা বরং ফকিরের কাছেই আসতো। কলিকাল,আখেরাতের আর বাকি নাই, পরামর্শ শুনে বেশি পয়সা দেওয়ার মানুষ কমে গেছে, ফকির তাই বেড়াকুড়া খায়। এতে হেলা করার কী আছে?–না-কি ভেতরে ভেতরে সবাই তাদের একটু ছোটো নজরেই দেখেছে? কী জানি?–চেরাগ আলি ওদিকে সবার কাছে ফকিরের বেটা। ফকিরের বেটা চলেছে। আগে আগে, তার মাথায় কালো রঙের কাপড়ের টুপি, আলখেল্লাটির রঙ এককালে হয়তো কালোই ছিলো, পরে নানা রঙের কাপড়ের তালি লাগার ফলে আসল রঙ খুঁজে পাওয়া দায়। কাঁধে রঙ-জ্বলা চটের ঝোলা, এর ভেতরে তার বই। আবার গেরস্তের ঘরের চাল, বাজারে হাটে দোকানদাররা আলু পেঁয়াজ, পটল, বেগুন, মরিচ, সময়ের আমটা কলাটা যে যা দেয় নেওয়ার জন্যে সে এটা সামনে এগিয়ে দেয়। পয়সা নেওয়ার জন্যে কুলসুমের হাতে একটা টিনের থালা। ফকির হাটে তড়বড় করে। সরু দুটো পা যেন দুটো রণপা। হাতের ছড়িটাকে কখনো কখনো ভুল হতো চেরাগ আলির আরেকটি পা বলে। দাদার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কুলসুমের জোরে হাঁটার অভ্যাস হয়েছে, এখন চেষ্টা করেও পায়ের গতি সামলাতে পারে না। তা মাদারিপাড়ায় থাকতে কুলসুমের হাঁটার দোষ কেউ ধরে নি।—ধরতো কি? কী জানি?—এখানে আসার পর, বিশেষ করে তমিজের বাপের সংসার করতে শুরু করার পর থেকে মাঝিপাড়ার বৌঝিরা তার যেসব। খুঁত ধরে বেড়ায় তারই কোনো কোনোটি সে গুলিয়ে ফেলে মাদারিপাড়ার মানুষের কথাবার্তার সঙ্গে। আবার এমনও হতে পারে, মাদারিপাড়ায় থাকতে দাদার বেড়াকুড়ার সাথী হয়ে এ-গাঁও ও-গাঁও ঘুরতে ঘুরতে মানুষের যেসব খোটা শুনেছে তাই সে আরোপ করে বসে গিরিরডাঙা আর নিজিগিরিরডাঙার বৌঝিদের মুখে। মাদারিপাড়ার কি আর সব ভালো? ওই গায়ে কারো অবস্থাই ভালো লয় গো! ওখানে বারো মাসই আকাল, বারো মাস টানাটানি। একটা দিন খাল পেরিয়ে না ঘুরলে ওখানে ভাত জোটে নি। ছোটো গাম, ঘর মোটে কয়েকটা, সবাই ফকিরের জ্ঞাতিগুষ্টি। পুবদিকে এক ক্রোশ চাষের জমির পর যমুনা, এর মধ্যে কয়েক বিঘা বাদ দিলে সবটাই চন্দনদহের আকন্দদের, শিমুলতলার তালুকদারদের, রৌহাদহের খাদের আর গোঁসাইবাড়ির মণ্ডলদের জমি। মাদারিপাড়ার ফকিরদের বেশিরভাগ মানুষ ওখানে বর্গা করে নয়তো কামলা খাটে। কয়েক বিঘা পতিত জমির মালিক ছিলো ফকিররা, তাই নিয়ে তাদের দেমাক কতো! অতো দেমাকের কী আছে? যেখানে পুরনো আমলের গোরস্থান। একটা মস্ত শিরীষ গাছ, কয়েকটা পিতরাজের গাছ আর দুটো শ্যাওড়া গাছ। জিন আর ভূতের আস্তানা। ফকিরগুষ্টির কেউ মরলে গোর দেওয়া হতো ওখানেই; কিন্তু দাফন সেরেই জ্যান্ত মানুষগুলো তড়িঘড়ি করে ঘরে ফিরতো। পরে গোর জিয়ারত করতে যাবার সাহসও কারো হয় নি। এখন তো ওসবের চিহ্নমাত্র নাই।
নদীর ভাঙন শুরু হওয়ার আগে মাদারিপাড়া থেকে যমুনার মূলবাড়ি ঘাটে যেতে হাঁটতে হয়েছে এক ক্রোশের ওপর। চেরাগ আলি বলতো তার পরদাদার পরদাদার আমল ওখানে নাকি নদীই ছিলো না, যমুনা ছিলো ছিপছিপে লাজুক একটি খাল মাত্র। গোরা নাসারাদের সঙ্গে লড়াই করার সময় মাদারিরা নাকি যখন তখন ঘোড়ায় চড়েই। এপার ওপার করেছে। শেষকালে গোরারা জিতে গেলে প্রায় পঞ্চাশ ষাট বছর পর এই। গোরস্থান থেকেই মাদারিদের কোন সর্দার ফকির না-কি পীর না পয়গম্বর অভিশাপ দিলে ভূমিকম্প হয়, সাংঘাতিক ভূমিকম্প, তাইতে খালটা পায় নদীর সুরত। কে অভিশাপ দিলো, কী দোষে এই অভিশাপ কিংবা কাকে অভিশাপ দেওয়া হলো-এসব নিয়ে পরিষ্কার করে চেরাগ আলি কখনো বলে নি। কুলসুম জানতে চাইলে গুনগুন করে শোলোক ধরতো,
তানার লানতে মাটি ফাটিয়া চৌচির।
নবস্রোত তালাশিয়া দরিয়া অস্থির।।
সেইমতো ব্রহ্মপুত্র বহে যমুনায়।
করতোয়া হইল ক্ষীণতোয়া শীর্ণকায়।।
আহা রে কুলীন নদী আবিল পঙ্কিলে।
ফকিরে ঠিকানা পায় মহামীন বিলে।।
তা ওই নদীতে-পরিণত খাল পশ্চিম তীর ভাঙতে শুরু করলে চেরাগ আলি হুঙ্কার ছাড়লো, শালী নদী আসুক, মাদারিপাড়ার দিকে আসুক। তখন শালীক দেখা যাবি। নদীর গতি তবু স্তিমিত না হলে সে হুঁশিয়ার করে দেয়, যার অভিশাপে খাল পরিণত হয়েছে নদীতে, তার মুরিদ সাগরেদ, আত্মীয় স্বজন, জ্ঞাতিগুষ্টির কবর আছে না তাদের গোরস্থানে? এই গোরস্থান ডিঙিয়ে নদী এক পা এগোয় তো চেরাগ আলি নিজের নাম পাল্টে এই নাম দেবে কোনো নেড়ি কুত্তাকে। কিন্তু শিরীষ আর পিতরাজ আর শ্যাওড়া গাছের জিন আর ভূত আর কবরে কবরে চেরাগ আলির সব পূর্বপুরুষ আর চেনাজানা আত্মীয়স্বজনের হাড়গোড়শুদ্ধ গোরস্থান গিলে ফেলার পরও যমুনার আয়তন কমে না। চেরাগ আলির নামের মহিমা বরণ করার নেড়িকুত্তাও সব সাফ হলো। তবে হ্যাঁ, নদী এসে থমকে দাঁড়ালো মাদারিপাড়ার ঠিক ধারে এসে। সবাই বোঝে, এতো খাবার পর যমুনা একটু জিরিয়ে নিচ্ছে, গতরটা একটু ঝরঝরে হলেই শালী ফের গিলতে শুরু করবে। তাই মাদারিপাড়ার লোকজন আগেভাগে এদিক-ওদিক সরে পড়তে লাগলো। কিন্তু চেরাগ আলিকে নড়াবে কে? তার ওপর যেন ওহি নাজেল হয়েছে, যমুনার খিদে সম্পূর্ণ মিটে গেছে, আর এক ছটাক মাটি গিললে যমুনা পেটের অসুখেই মারা পড়বে। মাদারিপাড়া হজম করার সাধ্যি শালীর কোনোদিন হবে না। কিন্তু চেরাগ আলির এই জ্যাঠতুতো ভাইয়ের বেটা সামাদ ফকির ভোররাতের স্বপ্নে যমুনার ঘোলা পানিতে নিজের ড়ুবে যাবার স্বপ্ন দেখে তার মাজেজা জানতে এলে চেরাগ আলি ধন্দে পড়ে। ঘোলা পানি দেখা তো ভালো কথা নয়। এ তো রোগের ইশারা বাবা। রোগ বিমারি, বালামুসিবত, এমনকি কারাবাস পর্যন্ত হতে পারে। তবে সামাদ তো ভালো সাঁতার জানে, স্বপ্নেই বা পানিতে কেন ড়ুববে সে? পানিতে ডোবার স্বপ্নের তাবির খুব খারাপ। সামাদের স্বপ্নের তাবির ঠেকাতে চেরাগ আলি যাকে পায় তাকেই ধরে ধরে শোনায়, মাদারিপাড়া গাঁও ছোটো হলে কী হয়, এই গাঁয়ের মাটি বহুত পুরানা। হামাগোরে পরদাদার পরদাদারা দরগাশরিফের ইজ্জত রাখার জন্যে গোরা নাসারা কোম্পানির সাথে নড়াই করিছে। ওই ময়মুরুব্বির দোয়া কায়েম হয়া আছে এই গাঁওত। দোয়ার রকত আছে না? নদী আর সাহস পাবি না, দেখো! পূর্বপুরুষের দোয়া, ভোররাতে ডান কাত হয়ে ঘুমিয়ে তার নিজের দেখা শুভ স্বপ্ন এবং তার সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী নস্যাৎ করে দিয়ে এক বছরেরও কম জিরিয়ে নিয়ে নদী এক বর্ষার মাঝামাঝি ছোবল দিলো মাদারিপাড়ার পুবপাড়া। কয়েকদিনের মধ্যে দক্ষিণ ও উত্তরের মাটি হজম করে পশ্চিম দিক গিলে যমুনা এসে ঠেকলো খালপাড় পর্যন্ত। চেরাগ আলির চাচাতো ভাইয়ের তিন মাসের একটি ছেলে, সামাদ ফকিরের বকনা বাছুরটা, ভুলু ফকিরের সদ্য-ফোঁটা এক পাল হাঁসের বাচ্চা এবং ল্যাংড়া লইমুদ্দির এক ধামা ধান শেষ পর্যন্ত আর বাঁচানো গেলো না। এ ছাড়া আর সবাই থালাবাসন, ঘরের বাঁশের খুঁটি ও বেড়া, বালিশ ও কাঁথা, বদনা প্রভৃতি সম্পত্তি নিয়ে খাল পেরিয়ে খালের পশ্চিম তীরে আকন্দদের জমিতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে করতে যমুনার ভোজনের বহরটা দেখলো। একটু দেরিতে তৎপর হওয়ায় বাঁশের ঘরটা চেরাগ আলি রক্ষা করতে পারে নি। কিন্তু তার মাথার কালো টুপি, রঙবেরঙের ছোপলাগা আলখাল্লা, ছড়ি, গলা থেকে বুক পর্যন্ত ঝোলানো লোহার শেকল, দোতারা, কেতাবশুদ্ধ ঝোলা এবং ঝোলার বাইরে কুলসুম-এগুলোর কিছুই। খোয়া যায় নি। এসব নিয়ে কয়েকটা দিন তার কাটলো আকন্দদের জমিতে, হাফেজ দারোগার মায়ের তুলে দেওয়া চালের নিচে। এরপর এক নাগাড়ে মেলা দিন তার কাটে দরগাতলায় দরগা শরিফে। সেখানে নতুন খাদেম জুটেছিলো তখন কয়েকজন, তারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে এবং দরগাকে পরিণত করেছে মসজিদে। তারা মিলাদ পর্যন্ত করতে দেবে না। মাদারি তরিকার ফকির চেরাগ আলি, এসব শরিয়তি বিধিনিষেধের মধ্যে গেলে তার আর থাকে কী? কুলসুম অবশ্য বোঝে, দাদার ওসব তরিকার জেদ টেদ কিছু নয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, রোজা করা, মওলানাদের ওয়াজ শোনা-এসব করতে গেলে দাদাজানের টোঁ টোঁ ঘোরাটা বন্ধ হয়, তার রোজগারই বা হয় কোত্থেকে? নইলে বর্ষার দিনে ঐ দরগাশরিফের টিনের ছাদের নিচে পাকা বারান্দায় শোবার সুযোগ ছেড়ে দাদা মরতে আসে এই গিরিরডাঙা গ্রামের কালাম মাঝির বাঁশঝাড়ে পাটখড়িঘেরা ছনের ছাপরায়?
বুড়া এখানে কী মধু যে পেলো তা বুড়াই জানে। এটা কি একটা গ্রাম হলো? প্রথম দিকে দাদার সঙ্গে কোথাও খেতে বসে একটু বেশি ভাত চাইলেই এতোকোনো ছুঁড়ির প্যাটখান কতো বড় গো! কিংবা অদ্যাখলা হুঁড়ি! এবং কারো সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটি হলেই ফকিরের বেটি, ফকিরের লাতনি,-এইসব কথা শুনতে হয়েছে। ঠিক আছে, দরগায় সুবিধা হলো না, মাদারিপাড়ার সবাই তো চন্দনদহে আকন্দদের জমিতেই মুখ গুঁজে রইলো কয়েকটা মাস, চেরাগ আলি কি সেখানে থাকতে পারতো না? কয়েক মাসের মধ্যে তার জ্ঞাতিগুষ্টি চলে গেলো যমুনার অনেক ভেতরে গোবিন্দপুর চরে, কেউ কেউ ধারাবর্ষায়, কেউ যমুনার পুবপাড়ে মাদারগঞ্জে, সরিষাবাড়িতে। তাদের সাথে সাথে থাকতে পারলেও চাষ করার জমি তো অন্তত কয়েক বছরের জন্যে পাওয়া যায়। যমুনাতীরের মানুষ, যমুনার কোলেকঁখে থাকাই ভালো। কে শোনে কার কথা? চরে যাবার কথা তুললেই চেরাগ আলির ফুটানির কথা, হামরা কি চরুয়া আছিলাম কোনোদিন? বির এলাকার মানুষ চরে যামু কোন দুষ্কে? এসব ছিলো বুড়ার ছলের কথা। আলসের হাড়ি, চাষের কামে কোনোদিন হাত লাগালো না, খালি শোলোক গেয়ে গেয়ে ভিক্ষা করার অছিলা! কালাম মাঝির বাঁশঝাড়ে ঠাঁই পেয়ে খুশিতে দাদা কয়েকটা দিন বুঁদ হয়ে রইলো। বর্ষাকাল, বৃষ্টি লেগেই থাকে, এরই মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে কয়েকদিন বুড়া খালি পুরোনো শোলোকগুলি ঝালাই করে নিলো। এখানকার কাৎলাহার বিল, তার সিথানে কোন জিন না দেও থাকে, সে কি তার বাপ না সম্বুন্দি কী হয়, চেরাগ আলি তার সারা জীবনের শোলোক মনে হয় বকশা করে দিলো তাকেই।।
কুলসুমের তখন কিছুই ভালো ঠেকে না। এখানে মাঝিপাড়ার মানুষ তেমন খয়রাত দিতে চায় না, মিলাদ পড়ায় কম, ছেলেদের খতনা করে কি-না কে জানে। আর এদের মরা ময়মুরুব্বির পাষাণ হিয়া, ছেলেমেয়েদের খোয়বে এসে দেখাও দেয় না। গোলাবাড়ির হাট বসে সপ্তাহে দুই দিন, জোড়গাছায় এক দিন। এই তিন দিনে ঐসব হাটে গিয়ে দাদায় নাতনিতে প্রাণপণে চাঁচালেও পয়সা যা মেলে তাতে রেজেক হয় কয় দিনের? পেট প্রায় খালিই থাকে। এর ওপর রাতে বাতাস উঠলেই মাথার ওপর বাঁশে বাঁশে ঠোকাঠুকি। মাদারিপাড়ায় যখন ছিলো, রাত্রিবেলা দাদা বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে হাঁটে নি পর্যন্ত। রাত হলেই প্রত্যেকটা বাঁশ হলো তেনাদের একেকজনের আসন। আর এখানে বাঁশঝাড় হলো তেনাদের স্থায়ী ঘরবাড়ি। কিন্তু এসব নিয়ে কিছু বললেই শুরু হতো ফকিরের ভাষণ, এই জায়গার বরকত দেখিছিস? হামাগোরে পরদাদারা এটি অ্যাসা আস্তানা লিছিলো। জ্ঞাতিগুষ্টির কতোজন এটি চোখ মুঞ্জিছে, তানাগোরে রুহ এখনো এটিই ঘোরাঘুরি করে রে বুবু, এই জায়গা যি সি জায়গা লয়।
মাদারিপাড়াত না তোমার দাদা পরদাদা ব্যামাক মানুষের গোর আছে। একোজন মানুষের কব্বর হয় কয় জায়গাত?
হয় না? তাও হয়। চেরাগ আলি নজির দেয়, সেরপুরে এক পীরের দুই মোকাম, দুই মাজার। একটা শিরমোকাম, সেটি গোর দিছে পীর সাহেবের কাল্লাখানা। আরেকটা ধড়মোকাম, সেটি আছে তেনার শরীলটা। দুষমনে পীর সাহেবকে কাটিছে দুই ছাও করা। গোরও হচ্ছে দুই জায়গাত। এক কোশ তফাত।
তোমার পরদাদারা কি সোগলি মরার পর দুই তিনখানা করা ভাগ হছে?
এ রকম নিষ্ঠুর উক্তিতে চেরাগ আলির মন খারাপ করতো, গলা নিচু করে বলতো, আস্তে বুবু, আস্তে। ময়মুরুব্বি সবই শুনিচ্ছে। তবে মন ভালো করার কায়দাও চেরাগ আলির ভালো করেই জানা, সঙ্গে সঙ্গেই তা প্রয়োগ করে,
সিথানে পাকুড়গাছ মুনসির বসতি।
তলায় গজার মাছ অতি হিংস্রমতি।
এটিকার বিল দেখ্যা, তুমি এই শোলোক নতুন বান্দিছো।
অবোধ বালিকার সন্দেহে চেরাগ আলি হাসে, কোনো শোলোক বাঁধবার ক্ষমতা কি তার আছে? কতো কিসিমের আওয়াজ মানুষের বুকে থাকে। কোনোটা বেরিয়ে আসে কষ্ট পেলে, কোনোটা বেরোয় মানুষ হঠাৎ ভয় পেলে। শোক হলে মানুষের আওয়াজ একরকম, আবার খুশির আওয়াজ আলাদা। এইভাবে কতো শোলোক যে জন্ম থেকে তার বুকে থরে থরে জমা হয়ে আছে, তার দাদা পরদাদার রক্তের সঙ্গে এইসব গান তার শরীরে ভাটি বয়ে এসেছে, কখন সে কোনটা গাইবে তা কি তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে? কুলসুম বোঝে, দাদার কথাই ঠিক, এতো এতো শোলোক দাদা বাঁধবে কী করে? এসব হলো তার পাওনা-শোলোক। শুনতে শুনতে কুলসুমের অনেকগুলো মুখস্থ হয়ে গেছে। রাস্তার মোড়ে, হাটে, বাজারে, মেলায় দোতারা বাজাতে বাজাতে চেরাগ আলি এইগুলো গায়, গাইতে গাইতে চরণের মাঝখানে হঠাৎ তার মুখ বন্ধ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে বাকি কথাগুলো সুর করে গাইতে হয় কুলসুমকে। দাদার শোলোক থেকে মাঝে মাঝে পুরনো কথা ঝরে পড়ে, অন্য কোনো শোলোকের চরণ এসে ঢুকে পড়ে সুড়ুত করে, কুলসুম ঠিক ধরে ফেলে। ওদের মাদারিপাড়া দরগাতলায় এসব গান জানে। মেলা মানুষ। এদিকে কখনো কখনো কাউকে কাউকে পাওয়া যায় যারা শোলোকের শুরুতে কয়েকটা চরণ গুণগুণ করে গলা মেলাতে পারে। গোলাবাড়ি হাটের বৈকুণ্ঠ, সেই কেবল কয়েকটা গানের পুরোটাই জানে, আর আর শোলোকের কোনোটা আদ্দেক, কোনোটা সিকিভাগ। গোলাবাড়ি হাটে কালাম মাঝির দোকানে এদের নিয়ে তুললো তো সে-ই। তারই উস্কানিতে কালাম মাঝি তাদের দাদা নাতনিকে নিজের বাঁশঝাড়ে ছাপরা করে থাকার সুযোগ করে দিয়েছিলো। তখন ছোটো থাকলে কী হবে, কুলসুমের সব স্পষ্ট মনে আছে। এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে হিন্দুটা তার কী সর্বনাশই না করে দিয়েছে। শরাফত মণ্ডলের বেটার সঙ্গে সভা করে করে গফুর কলু যে আজকাল বলে, হিন্দুরা এক জাত, মোসলমান আরেক জাত-কথাটা ঠিকই। না হলে চেরাগ আলি ফকিরের গান শোনার মতলবে বৈকুণ্ঠ কি চিরটা কাল তাদের এখানে রাখার ব্যবস্থা করে কুলসুমের এতো বড়ো সর্বনাশ করতে পারে?
বুলু মাঝির ভাতারের ভাত-না-খাওয়া বৌ আবিতন এতোক্ষণে চলে গিয়েছে। কতো দূর, কিন্তু গিরিরডাঙার মানুষের ওপর, জলবায়ুর ওপর কুলসুমের রাগ আর যায় না। শাড়ির ময়লা আঁচলে সে মুখটা মুছছে তো মুছছেই। এই মোছামুছিতে নাকের ডগা তার একটু একটু ব্যথা করে এবং ঘষায় ঘষায় ডোবার ঘাসপাতাশ্যাওলা ও গুগোবরমাটির গন্ধ এবং বেলে পুঁটি খলসে শোলের আঁশটে গন্ধ ফিকে হয়ে আসে, ফিকে হতে হতে মিলিয়ে যায়। এই সুযোগে বৈকুণ্ঠের মুখের পানজার সুবাস তার মাথায় ঢুকলে মাথা ঝিমঝিম করে। নেশা-ধরা ঐ গন্ধের সঙ্গতে চেরাগ আলি ফকিরের দোতারার টুংটাং বোল কুলসুমের ডানদিকে বাঁদিকে এবং সামনে ও পেছনে, এমন কি মাথার ওপরেও টক টক মেঘ জমিয়ে তোলে। ওই বাসি গন্ধ ও বাসি আওয়াজেই বৃষ্টি নামে তার গোটা মাথা জুড়ে। বহুদিন আগে এই বৃষ্টির মধ্যেই ছুটতে ছুটতে তারা উঠেছিলো কালাম মাঝির দোকানে। গোলাবাড়ির হাটে সেদিন হাটবার, এর মধ্যে সন্ধেবেলা কী ঝমঝম বৃষ্টি! বৈকুণ্ঠের ডাকে তার দাদা আর দাদার হাত ধরে সে একবার মুকুন্দ সাহার দোকানে, একবার কালাম মাঝির দোকানে ছোটাছুটি করলো। মাথার ওপরে ঝমঝম বৃষ্টি। লক্ষণ তো কোনো দিক থেকেই ভালো ছিলো না। দাদা তার এতো জানে, আর এটুকু কি বুঝতে পারলো না যে, ঐ ঝড় বাদলে আর ঐ অন্ধকার রাতে ঘরের বাইরে থাকার কিংবা নতুন ঘরে ওঠার কোনো ইশারাই নাই? কেন, মাদারিপাড়া থাকতে কোনো কোনো মেঘলা সকালে এমন হয়েছে, ঘরে চাল নাই, মাটিতে উপুড় হয়ে বসে দোতারায় টুংটাং করতে করতে চেরাগ আলি কুলসুমকে পাঠাতে চেয়েছে পড়শির ঘরে, যা তো বুবু, সামাদের মায়ের ঘরত যা, এক টালা চাল চায়া আন। আজ আর বারালাম না। মানুষের মুখঝামটা আর কতো খাওয়া যায়? বৃষ্টির মধ্যেই সে বরং খালের ওপারে চন্দনদহে আকন্দবাড়ির যাবার আবদার ধরলে চেরাগ আলি বলেছে, পানি হলে ঘরত থাকা লাগে রে। পানসে বৃষ্টি তার গলা থেকে ঝরাতো আঠালো গাঢ় স্বর,
আসমানে সাজিল মেঘ হাতির হাওদা।
ঘরেতে বসিল মজনু জপে আল্লা খোদা।
সাগরেদ না বাহিরিও মাস দুই কাল।
পানির বেগানা পথে নসিব কাঙাল।।
তা বাপু আল্লাখোদাই যদি করতো তো চেরাগ আলিকে কি আর দরগার পাকা বারান্দা থেকে ওভাবে উৎখাত হতে হয়? নতুন খাদেম প্রথম থেকেই তার বেদাত কামকাজে অসন্তুষ্ট। এর ওপর সঙ্গে মসজিদ হলো। ওখানে কোনোরকম বেদাত কাম। সহ্য করা হবে না। তা নামাজ বন্দেগি করে পাকা বারান্দায় ঠাঁই পাওয়া গেলে চেরাগ আলি কি তাই করলে ভালো করতো না? কিন্তু মসজিদের ইমাম মেয়েছেলেকে দরগায় থাকতে দেবে না। তবে চেরাগ আলি কি তার নাতনিকে ভাসিয়ে দেবে? চেরাগ আলি অবশ্য বড়ো গলা করে বলতো, শালা ভিন্ন তরিকার মানুষ রে, শালারা হামাগোরে দরগা দখল করিছে। হামার পাও ধরলেও হামি এটি থাকিচ্ছি না। আমরা আজকার ফকির লয়, মাদারি ফকির হামরা, বেড়াকুড়া না খালে দাদা পরদাদারা শাপমন্যি দিবি। এসব গলাবাজি তার ছিলো নতুন খাদেম কিংবা ইমামের আড়ালে, এমন কি দরগার চৌহদ্দির বাইরে, রাস্তায়, যখন কুলসুম ছাড়া তার পাশে আর কেউ নাই। তা খাদেমকে বুড়া যতোই ভয় করুক, ইমামের ভয়ে সে যতোই দরগা ছাড়ুক, এই কথাগুলো বলতে বলতেই তার গলায় গান ফুটতো। তার দোতারার টুংটাং রোল এতোকাল পরেও কুলসুমের মাথায় এতোটাই জোরে বাজে যে মগজের জর্দার নেশা এবং চোখের সামনে তমিজের বাপের চিৎপটাং গতর কোথায় হারিয়ে যায়। মাচা থেকে রান্নার চাল নিতে নিতে তার গলা থেকে বেরিয়ে আসে শোলোক, বেরিয়ে আসে দাদার দোতারার বোলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে।