০৩. ক্লান্তি থেকে বাঁচার উপায়
একটা আশ্চর্যজনক আর উল্লেখজনক ব্যাপার জানাচ্ছি–শুধুমাত্র মানসিক পরিশ্রম আপনাকে ক্লান্ত করতে পারে না। শুনলে অসম্ভব বলেই মনে হবে। তবে কয়েক বছর আগে বিজ্ঞানীরা বের করতে চেষ্টা করছিলেন মানুষের মস্তিষ্ক পরিশ্রান্ত না হয়ে কতখানি কাজ করে যেতে পারে–যার বৈজ্ঞানিক নাম হল অবসাদ বা ক্লান্তি। এইসব বিজ্ঞানীরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেছেন যে সতেজ মস্তিষ্কের মধ্য দিয়ে রক্ত চলাচলের সময় কোনো অবসাদের চিহ্ন দেখা যায় না। আপনি যদি কোনো রোজ খেটে খাওয়া শ্রমিকের শিরা থেকে এক ফোঁটা রক্তা তার কর্মরত অবস্থায় বের করে আনেন, তাহলে দেখতে পাবেন সে রক্ত প্রচুর ক্লান্তিময় টক্সিনে ভর্তি। কিন্তু আপনি যদি অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের এক ফোঁটা রক্ত নিতেন তাহলে দেখতে পেতেন তাতে কিন্তু ক্লান্তির নেই টক্সিনের ছিটেফোঁটাও নেই।
মস্তিষ্কের কথা বলতে গেলে দেখা যাবে মস্তিষ্ক কাজ শুরু করার গোড়াতেও যেরকম চলে আট বা বারো ঘণ্টা পরেও সেই রকমই কর্মক্ষম থাকে। মস্তিষ্ক হল সম্পূর্ণভাবে ক্লান্তিবিহীন কিছু…তাহলে আপনার ক্লান্তির কারণ কী?
মনোবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে, আমাদের অবসাদ বা ক্লান্তির প্রধান উৎস হল আমাদের মানসিক আর ভাবাবেগময় হাবভাব। ইংল্যান্ডের জনৈক খ্যাতনামা মনোসমীক্ষক জে, এ. ব্যাকফিল্ড তাঁর ‘সাইকোলজি অব পাওয়ার’ নামক গ্রন্থে বলেছেন : যে ক্লান্তিতে আমরা বেশিরভাগ ভুগি তার বেশিরভাগই জন্ম নেয় মন থেকে। আসলে শুধুমাত্র দৈহিক কারণে অবসাদ প্রায় দেখাই যায় না।
আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন মনোবিজ্ঞানী ড. এ. এ. ব্রিল আরো একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মত হল : যারা বসে কাজ করে থাকেন তাদের মতো সুস্থ মানুষের শতকরা একশ’ ভাগ অবসাদের কারণ হল মনস্তাত্ত্বিক কারণ, এর মানে হল আবেগজনিত কারণ।
কি ধরনের আবেগজনিত কারণে (বা বসে থাকা) কর্মী ক্লান্ত হয়ে থাকেন? আনন্দের আতিশয্যে? মনের খুশিতে? না! কক্ষনো তা নয়! একঘেঁয়েমি, বিরক্তি, যোগ্য সমাদরের অভাব, তুচ্ছতাবোধ, তাড়াহুড়ো, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা-এইগুলোই সেই আবেগজনিত কারণ, যাতে বসে কাজ করা মানুষ অবসাদগ্রস্ত হয় এবং এর ফলেই সে মাথার যন্ত্রণায় আক্রান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে। হ্যাঁ, জেনে রাখুন আমরা ক্লান্ত হই কারণ আমাদের আবেগই আমাদের শরীরে স্নায়বিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
মেট্রোপলিটান জীবন বীমা কোম্পানি অবসাদের উপর একটা পুস্তিকায় বলেছিলেন এই কয়টি কথা : কঠিন পরিশ্রম কখনই কদাচিত ক্লান্তি বা অবসাদ আনতে পারে, যে অবসাদ ভালো নিদ্রা বা বিশ্রামে দূর হয় না…দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ আর আবেগজনিত গণ্ডগোলই ক্লান্তি বা অবসাদের প্রধান তিনটি কারণ। যখন শারীরিক বা মানসিক কাজের ফলেই এটা হয় তখন এদেরই দোষের কারণ বলা হয়…মনে রাখবেন, টানটান কোনো মাংসপেশীই হল কার্যকর মাংসপেশী। অতএব, সহজ হয়ে উঠুন এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য শক্তি জমিয়ে রাখুন।
এবারে যেমন অবস্থায় আছেন সেই অবস্থায় থেকে, আপনি নিজেকে একবার পরীক্ষা করে নিন। এই লাইনগুলো পড়তে বইটার দিকে কুটি করছেন না তো? দুচোখের মাঝখানে কোনো মানসিক চাপ বোধ করছেন না তো? আপনার চেয়ারে বেশ আরাম করে বসে আছেন তো? নাকি কাধ কুঁচকে রয়েছেন? আপনার মুখের পেশীগুলি কি টানটান হয়ে আছে? এই মুহূর্তে যদি আপনার সারা শরীর তুলোর পুতুলের মতো সরল আর ঢিলেঢালা না থাকে, তাহলে কোন সন্দেহ নেই এই মুহূর্তে আপনি স্নায়বিক উত্তেজনা আর পেশীর উত্তেজনায় আক্রান্ত। আপনি স্নায়বিক অবসাদ তৈরি করে চলেছেন।
মানসিক কাজ করতে গিয়ে আমরা কেন এই অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা তৈরি করি? জোসেলিন বলেন : ‘আমি লক্ষ্য করেছি যে প্রধান বাধা হল সার্বজনীন এই বিশ্বাস যে কঠিন কাজ করার জন্য চাই চেষ্টার এক চিন্তা, না হলে কাজটি ঠিকমতো হতে চায় না। আর এই কারণেই আমরা মনোযোগ দেয়ার সময় ভুরু কুঁচকে তাকাই। আমরা কাঁধ সঙ্কুচিত করি। আমরা আমাদের পেশীকে আমাদের চেষ্টার মধ্যে গতি আনতে বলি, কিন্তু এসব আমাদের মস্তিষ্ককে কোনোভাবেই আর কাজে সাহায্য করে না।
এখানে আশ্চর্যজনক আর বিয়োগান্ত একটা সত্য উদ্ধৃত করছি : কোটি কোটি মানুষ যারা তাদের টাকা নষ্ট করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না তারাই আবার উচ্ছলতার মধ্য দিয়ে সেই টাকা আর তাদের শক্তি নাবিকদের মতো উন্মত্ততার মধ্য দিয়ে উড়িয়ে চলে।
এই স্নায়বিক অবসাদের উত্তর কি রকম? বিশ্রাম! বিশ্রাম! বিশ্রাম! কাজ করে চলার অবসরে বিশ্রাম গ্রহণ করার কৌশল আয়ত্ত করুন।
ব্যাপারটা সহজ! মোটেই না। এটা করতে গেলে আপনাকে হয়তো আপনার সারা জীবনের অভ্যাসকে উল্টোপথে চালনা করতে হতে পারে। তবে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে, কারণ এর ফলে আপনার জীবনে হয়তো বা বিপ্লব ঘটে যেতে পারে। উইলিয়াম জেমস তার ‘দি গসপেল অব রিল্যাক্সেশান’ প্রবন্ধে বলেছেন : আমেরিকান জীবনে মাত্রাতিরিক্ত উদ্বেগ, ঝাঁকুনি আর সন্ত্রস্ততা
এবং তারই সঙ্গে প্রকাশের ব্যথা আর তীব্রতা…এর মূল হল আর কিছুই না-খারাপ অভ্যাস।
উদ্বেগ একটা অভ্যাস। বিশ্রামও একটা অভ্যাস। খারাপ অভ্যাস যেমন দূর করা যায়, ভালো অভ্যাস তেমন গড়ে তোলা সম্ভব।
আপনি বিশ্রাম নেন কেমন করে? আপনার মন থেকেই শুরু করেননা স্নায়ু দিয়ে শুরু করেন? আসলে এ দুটোর কোনোটাই দিয়ে তা করেন না। সবসময়েই আপনি আপনার পেশীকে বিশ্রাম দিতে শুরু করুন।
আসুন, একটু চেষ্টা করে দেখি। কী করে এটা হয় দেখাতে গেলে আসুন আপনার চোখ দিয়েই শুরু করা যাক। এই অংশটা ভালো করে পড়ুন, তারপর শেষ প্রান্তে পৌঁছানোর পর একটু হেলান দিয়ে বসে চোখ দুটো বন্ধ করে আপনার চোখকে আস্তে আস্তে বলতে থাকুন, ‘যেতে দাও যেতে দাও। জোর করে কিছু দেখবার দরকার নেই, কুটি করো না। যেতে দাও, যেতে দাও। আরো এক মিনিট আস্তে আস্তে এই রকম করুন…।
আপনি লক্ষ করে দেখেছেন কি কয়েক সেকেন্ড পরেই চোখের পেশীগুলো হুকুম তামিল করতে শুরু করেছেন? আপনার কি মনে হয় নি যেন কোনো অদৃশ্য হাতের স্পর্শে আপনার অবসাদ দূর হতে শুরু করেছে? যাই হোক, আসল রহস্য হল ওই একটা মিনিটের মধ্যেই আপনি বিশ্রাম বা বিনোদনের গোপন রহস্যটা জেনে ফেলেছেন। এটাই মূলকথা। এই সকল একই জিনিস আপনি করতে পারেন আপনার চোয়াল দিয়ে, বা মুখের পেশী, ঘাড় বা কাঁধ দিয়ে, মোটকথা সারা শরীর দিয়ে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বস্তুটি হল ওই চোখ। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের : এডমন্ড জ্যাকসন তো এমন কি বলেই ফেলেছেন যে, আপনি যদি চোখের পেশীগুলোকে সম্পূর্ণ নমনীয় করে ফেলতে পারেন তাহলে সমস্ত রকম জ্বালা-যন্ত্রণার কথা একেবারেই ভুলে যেতে পারেন! চোখ যে কোনো স্নায়বিক উদ্বেগ দূর করার কাজে এত গুরুত্বপূর্ণ, রিল্যাক্সেই সঙ্গে প্রকাশ্যে বিশ্রাম তার কারণ হল তারা শরীরের গ্রহণীয় সমস্ত ক্ষমতায় এক-চতুর্থাংশ খরচ করে ফেলে। আর এই কারণেই বহু মানুষ, যাদের দৃষ্টিশক্তি চমৎকার, তাঁরা চোখের টাটানিতে ভোগেন।
বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ভিকি ব্রাউন বলেন যে তিনি যখন ছোট ছিলেন তখন কোনো-এক বৃদ্ধের সঙ্গে তাঁর দেখা হলে তিনি তাকে এমন একটা জিনিস শিখিয়ে দেন, যার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তিনি আর শোনেন নি। পড়ে গিয়ে আর হাঁটু ছিঁড়ে গিয়েছিল আর কব্জিতেও আঘাত লেগেছিল। বৃদ্ধ লোকটি তাঁকে তুলে ধরেছিলেন, তিনি এককালে সার্কাসের ক্লাউন ছিলেন। তার পোশাকের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বৃদ্ধ বলেছিলেন : পড়ে গিয়ে তোমার আঘাত লাগার কারণ হল তুমি জানো না কেমন করে নমনীয় হতে হয়। তোমার ভাব দেখাতে হবে যেন তুমি পুরনো দলা পাকানো মোজার মতই নড়বড়ে আর নরম। এসো, তোমায় শিখিয়ে দিচ্ছি কেমন করে সেটা করতে হয়।’
সেই বৃদ্ধ এরপর শিশু ভিকিকে আর অন্যান্য বাচ্চাদের শিখিয়ে দেন কি করে পড়ে যেতে হয় আর কেমন করে গড়িয়ে গিয়ে ডিগবাজি খেতে হয়। বৃদ্ধ বারবার বলেছিলেন, একটা কথা সবসময় মনে রাখবে তুমি হচ্ছো পুরনো দলা পাকানো মোজা। তারপরই তোমায় নমনীয় হতে হবে।
আপনিও যখন-তখন যে-কোনো মুহূর্তেই এই বিশ্রাম নিতে পারেন। শুধু বিশ্রাম নেয়ার কোন চেষ্টা করবেন না। বিশ্রাম হল সমস্ত রকম উদ্বেগ আর প্রচেষ্টার অনুপস্থিতি। সহজভাবে ভাববে চেয়ে বিশ্রাম নিন। এটা শুরু করবেন আপনার চোখের আর মুখের পেশী নমনীয় করতে চেয়ে, সঙ্গে বারবার বলতে থাকবেন সব চলে যাক…চলে যাক,…বিশ্রাম চাই। আপনার মুখের পেশী বেয়ে অনুরণকে শরীরের অভ্যন্তরে থামতে অনুভব করতে থাকুন। শিশুর মতো সবরকম উদ্বেগমুক্ত বলে নিজেকে ভাবতে থাকুন।
ঠিক এই রকমই করতেন বিখ্যাত গায়িকা গ্যাল্লি কুর্চি। হেলেন জেপসন নামে একজন মহিলা আমাকে একবার বলেছিলেন যে তিনি কোনো অনুষ্ঠানের ঠিক আগে গ্যাল্লি কুর্চিকে একটা চেয়ারে সমস্ত পেশী এলিয়ে দিয়ে বসে থাকতে দেখেছেন। তার চোয়াল প্রায় মুখে পড়ত তখন। ভারি চমৎকার অভ্যাস এটা-এটা তাঁকে মঞ্চে প্রবেশের আগে সব উদ্বেগ আর স্নায়বিক দুর্বলতা মুক্ত করে দিত, এটা তার অবসাদও দূর করত।
শরীরে শিথিলতা এনে বিশ্রাম করার জন্য নিচের পাঁচটি উপদেশ মেনে চলতে পারেন :
এক. এ বিষয়ে কিছু ভালো বই পড়তে পারেন, যেমন : ডেভিড হ্যারল্ড ফিঙ্কের স্নায়বিক উদ্বেগ থেকে মুক্তি। এছাড়াও আছে ড্যানিয়েল ডব্লিউ. জোসেলিনের লেখা ‘কেন ক্লান্ত হন’ বইখানা।
দুই. যখন-তখন বিশ্রাম নিতে চেষ্টা করুন। পুরনো মোজার মতো নিজেকে শিথিল করে ফেলুন। আমি আমার কাজের টেবিলে মনে করিয়ে দেয়ার জন্য একটা পুরনো মোজা রেখে দিই। এছাড়া বিড়ালের কথাটাও মনে রাখবেন। ঘুমন্ত বিড়ালছানা কখনো হাতে নিয়ে দেখেছেন? তুলে নিয়ে দেখবেন কেমন তুলোর বস্তার মতো লাগে। যোগীরাও বলেন, বিশ্রামের কৌশল আয়ত্ত করতে হলে বিড়ালের চালচলন লক্ষ্য করবেন। আমি কোনোদিন অবসাদে ভেঙে পড়া বিড়াল দেখি নি।
তিন. বেশ আরাম করে বসে যতটা পারেন কাজ করবেন। মনে রাখবেন, শরীরে উদ্বেগ থাকলে কাঁধ ব্যথা হয় আর অবসাদ আসে।
চার দিনের মধ্যে চার কি পাঁচ বার নিজেকে পরীক্ষা করুন আর নিজেকে প্রশ্ন করুন : ‘আমি কি বেশি পরিশ্রম করছি? যে কাজে পেশীর প্রয়োজন নেই তাতে কি তাই কাজে লাগাচ্ছি?’ এটা আপনাকে বিশ্রামের কৌশল আয়ত্ত করতে শেখাবে।
পাঁচ. এরপর দিনের শেষে নিজেকে আবার প্রশ্ন করুন : ‘আমি কতখানি ক্লান্ত? আমি যদি ক্লান্ত হই সেটা আমার মানসিক কাজের বা পরিশ্রমের জন্য নয়, বরং আমি যেভাবে করেছি সেইজন্যেই। ড্যানিয়েল ডব্লিউ. জোসেলিন বলেন : ‘আমি দিনের শেষে নিজেকে প্রশ্ন করি না আমি কতখানি ক্লান্ত বরং জানতে চাই আমি কতটা ক্লান্ত নই। আমি যখন দিনের শেষে কোনোভাবে অবসাদগ্রস্ত বলে নিজেকে ভাবি বা কোনোরকম বিরক্তি আসে আর বুঝি আমার স্নায়ু ক্লান্ত, তখন বুঝতে পারি ভালোভাবেই কাজটা বেশি করেই করেছি, যোগ্যতারও অভাব ছিল। ব্যবসাদারদের প্রত্যেকে যদি এটা খেয়াল রাখতেন তাহলে হয়তো উচ্চ রক্তচাপের ফলে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমে আসত। এছাড়াও স্যানাটোরিয়াম আর উন্মদাশ্রমে মানুষের সংখ্যাও কম হত।