কেউ মনে রাখেনি, কেউ মনে রাখে না!
সিনেমায় যেমন হয়, যেভাবে হয়!
রাজপথ দিয়ে আঠারো-উনিশের যুবক দৌড়চ্ছে মরিয়া। ধাওয়া করছে পুলিশ। যুবকের হাতে উদ্যত রিভলভার। মাঝেমাঝেই পিছন ফিরে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে হুংকার দিচ্ছে, ‘খবরদার!’
হুমকিতে অবশ্য কাজ হচ্ছে না বিশেষ। পুলিশ পিছু হঠার কোনও লক্ষণ দেখাচ্ছে না। উর্দিধারীদের নেতৃত্বে থাকা অফিসার বুঝতে পারছেন বিলক্ষণ, যুবককে ধরে ফেলা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। কতক্ষণ দৌড়বে এভাবে? আর দৌড়ে পালাবেই বা কোথায়? দেখাই তো যাচ্ছে, হাঁফাচ্ছে।
জানুয়ারির কলকাতায় সন্ধে জাঁকিয়ে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন। ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা ছাড়িয়ে সাড়ে পাঁচের দোরগোড়ায়। অফিসফেরতা মানুষের ভিড় থমকে গেছে আচমকাই, স্তব্ধ হয়ে দেখছে রিভলভার হাতে ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড় যুবকের। যার সঙ্গে ব্যবধান দ্রুত কমে আসছে তাড়া করে আসা পুলিশবাহিনীর।
দম তো ফুরিয়ে আসছেই। মাথাও আর কাজ করছে না যুবকের। পুলিশ ধরে ফেলল বলে! কী করবে এখন? কী করা উচিত? আরে, উলটোদিক থেকেও তো দু’জন ছুটে আসছে। গায়ে উর্দি, মানে পুলিশ! এবার?
‘দাদা’-র কথা মনে পড়ে যুবকের। ‘ইংরেজদের হাতে ধরা দেওয়ার থেকে মৃত্যু ভাল,’ প্রায়ই বলে থাকেন ‘দাদা’। ঠিকই! ধরে ফেললে পুলিশ দগ্ধে দগ্ধে মারবে। তার চেয়ে ঢের ভাল, নিজেই নিজেকে শেষ করে দেওয়া। রিভলভার তো আছেই সঙ্গে। একটা বুলেট নিজের মাথায়, ব্যস, খেল খতম!
.
বলে কী ছোকরা!
স্তম্ভিত বললে কমই বলা হয়, একেবারে বাক্রুদ্ধ হয়ে যান আলিপুর আদালতের দীর্ঘদিনের কর্মী। এইসব বিপ্লবী ছেলেপুলের কাজকারবার সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা আছে তাঁর। প্রায়ই পুলিশ এদের কাঠগড়ায় তোলে রাষ্ট্রদ্রোহের নানান মামলায়। ভয়ডর এদের বিশেষ নেই, জেনে গিয়েছেন এতদিনে। কিন্তু তা বলে এই! ঘণ্টাখানেক পরে বিচারক রায় শোনাবেন। ফাঁসির হুকুম হতে যাচ্ছে নিশ্চিত। সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র হেলদোল তো নেই-ই, উলটে আবদার করছে একগাল হেসে!
—স্যার, খুব খিদে পেয়ে গেছে। জেলের একঘেয়ে খাবার তো রোজই খাই, ফিরে গিয়ে সেটাই জুটবে। আজ কচুরি-শিঙাড়া খেতে খুব ইচ্ছে করছে, দিন না একটু ব্যবস্থা করে কোর্টের ক্যান্টিন থেকে…
এজলাসে উপস্থিত পুলিশ-উকিল-মোক্তারদের হতচকিত মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেন যুবক। কোর্ট লক-আপের ভিতরে দাঁড়িয়ে ফের আর্জি জানান ভালমন্দ খাওয়ার।
—জানি স্যার, নিয়ম নেই। কিন্তু একদিন না হয় একটু নিয়ম ভাঙলেন। অস্ত্রশস্ত্র তো আর চাইছি না, সামান্য কচুরি-শিঙাড়া। আর হ্যাঁ, কয়েকটা রসগোল্লা হলে ভাল হয়। শেষে একটু মিষ্টিমুখ আর কী…
মিষ্টিমুখ? কচুরি-শিঙাড়া? এজলাসে, খুনের আসামিকে? কেউ কখনও শুনেছে? এমন পরিস্থিতিতে কস্মিনকালেও পড়েনি পুলিশ। অফিসাররা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেন খানিক। আসামির বিচিত্র দাবির কথা জানিয়ে ফোন গেল লালবাজারে। স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা চার্লস টেগার্টের নির্দেশ পৌঁছল, ‘Fair enough. He will be sent to the gallows anyway in about a month’s time. ফাঁসি তো হবেই ওর। যা খেতে চাইছে, দাও। খুশি থাকুক, ওকে একটু দরকারও আছে আমাদের।’
আদালতে যখন মধ্যাহ্নভোজের বিরতি, প্লেটে করে কচুরি-শিঙাড়া-রসগোল্লা সাজিয়ে দেওয়া হল আসামির সামনে। দিব্যি গুছিয়ে বসলেন যুবক, খেলেন পেটপুরে এবং বিরতির পর ফের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে পড়লেন নিয়মরক্ষার দণ্ডাদেশ শুনতে। নিয়মরক্ষা ছাড়া কী? জানাই তো আছে, কী সাজা ঘোষণা করবেন বিচারক।
.
—একে তোরা গুরু মানিস? এই লোকটাকে?
ইংরেজি খবরের কাগজের একটা পাতা যুবকের চোখের সামনে মেলে ধরেন পুলিশ অফিসার। প্রতিটি শব্দে ঠিকরে বেরোয় বিদ্রুপ।
—কী রে… দ্যাখ ভাল করে… স্বরূপ দ্যাখ লোকটার… আর একে তোরা গুরু মানিস… ‘দাদা’ বলিস… এর এক কথায় তোর মতো ছেলেপুলেরা হাসতে হাসতে প্রাণ দিতে রাজি হয়ে যাস!
জেলের কুঠুরিতে যুবক তখন স্তব্ধবাক্। একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন খবরের কাগজের পাতার দিকে। ছবিটার দিকে। অফিসারের কথাগুলো কানে বিঁধতে থাকে তিরের মতো।
—দ্যাখ ছবিটা, পড় খবরটা… কী হল? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিস না তো?
নিজের চোখকে অবিশ্বাস করতে সত্যিই ভারী ইচ্ছে হয় উনিশ বছরের বিপ্লবীর। এ কী করে সম্ভব? হতেই পারে না! ‘দাদা’ এমন কাজ করতেই পারেন না! কিন্তু খবরটা? ছাপার অক্ষর? সেটাই বা কী করে মিথ্যে হয়? স্পষ্ট লেখা আছে, খুনের মামলায় তার বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে ‘দাদা’ সাহায্য করেছেন পুলিশকে, জবানবন্দি দিয়েছেন। সঙ্গের ছবিটায় ‘দাদা’র পরিচিত দৃপ্ত চেহারাটা। ভাবনায় ছেদ পড়ে অফিসারের বক্রোক্তিতে।
—আমি তোকে আগেই বলেছিলাম, এই ‘দাদা’-ই তোদের মতো বাচ্চা ছেলেদের সর্বনাশ করছে। আর তোরাও আগুপিছু না ভেবে বোকার মতো ফাঁসিতে ঝোলার জন্য রেডি হয়ে যাচ্ছিস। লালবাজারের বড়কর্তাদের সঙ্গে তোদের ‘দাদা’-র যে গোপনে দহরম মহরম আছে, সে-কথা জানিস? ওর দেখবি কিস্যু হবে না। বড়জোর দু’-এক বছরের জেল। আর তোর? প্রাণটাই চলে যাচ্ছে ক’দিন পরে। ভেবে দ্যাখ, তোর ফাঁসির সাজা তো আর বদলাবে না, কিন্তু তোদের ‘দাদা’ নাটের গুরু হয়েও বারবার পার পেয়ে যাবে আর তোরা ফাঁসবি, এটা মেনে নিবি?
যুবক শুনতে থাকেন দু’হাতে মুখ ঢেকে। অফিসার বলেই চলেন।
—তুই ধরা পড়ার দিন থেকেই জানি আমরা, খুনটা যদিও তুই করেছিস, কিন্তু প্ল্যানটা ‘দাদা’-র। ওর কথাতেই করেছিস যা করার। অথচ শুরুর দিন থেকে তোতাপাখির মতো বলে আসছিস, ‘যা করেছি একাই করেছি, কারও নির্দেশে নয়।’ এখনও সময় আছে, সত্যিটা বল। তুই শাস্তি পেলে ওরও পাওয়া উচিত। লোকটার স্বরূপ তো জেনেই গেলি, এবার অন্তত বল!
যুবক মাথা তোলেন। চোখেমুখে অভিমান-হতাশা-রাগের ত্রিকোণমিতি। ভুল তো কিছু বলছেন না অফিসার। যে ‘দাদা’-র নির্দেশে চোখকান বুজে জান কবুল করা, তিনিই হাত মেলালেন পুলিশের সঙ্গে? তা হলে আর সত্যিটা গোপন করে কী লাভ? মনস্থির করে ফেলেন বেদনাহত যুবক।
—বলছি স্যার। পুরোটাই ‘দাদা’-র কথায় করেছি। আমাকে বলেছিল…
অফিসার বেরিয়ে আসেন কুঠুরি থেকে, উত্তেজনা যথাসম্ভব চেপে রেখে। দ্রুত খবর পাঠান লালবাজারে, ‘Mission accomplished. কনফেস করেছে। আমরা যেমন ভেবেছিলাম, তা-ই। অ্যাকশনটা ছেলেটা করেছে, কিন্তু আসল কলকাঠি নেড়েছে ওদের ‘‘দাদা’’… বাঘা যতীন! ছবি আর খবরটা দেখে ফাইনালি ছোকরা ভেঙে পড়েছে।’
এক মুহূর্তও দেরি করেন না চার্লস টেগার্ট। হাতে সময় কম। সদলবলে রওনা দেন লালবাজার থেকে। গন্তব্য, আলিপুর জেলের সেই কুঠুরি, যেখানে ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত এক যুবক কেঁদে চলেছেন অঝোরে।
.
‘তুমি সরকারের শ্যাম আমাদের শূল
(কবে) তোমার ভিটেয় চরবে ঘুঘু
দেখবে চোখে সরষে-ফুল।’
ছড়াটা তখন মুখে মুখে ফিরত বাংলার বিপ্লবীদের। বানানো হয়েছিল সিআইডি-র এক ডাকসাইটে ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পুলিশ-কে নিয়ে। সামসুল আলম।
১৯১০ সালের কথা লিখছি। বহুচর্চিত আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলার রায় বেরিয়েছে ১৯০৯-এর ৬ মে। প্রধান অভিযুক্ত অরবিন্দ ঘোষ মুক্তি পেয়েছেন। বারীন ঘোষ এবং উল্লাসকর দত্তের ফাঁসির সাজা হয়েছে। হেমচন্দ্র দাস সহ দশজনের শাস্তি হয়েছে দ্বীপান্তরের। চারজনের সাজা হয়েছে দশ বছরের কারাবাসের। তিনজনের সাত বছর। রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেছেন সাজাপ্রাপ্তরা। সেই আবেদনের শুনানি চলছে তখন।
এই মামলায় পুলিশের তরফে সরকারি কৌঁসুলি মিস্টার নর্টনের ডান হাত ছিলেন সিআইডি-র ডিএসপি সামসুল আলম। অভিজ্ঞ অফিসার, ব্রিটিশ সরকারের চোখের মণি বললেও এতটুকু অত্যুক্তি হয় না। খোদ টেগার্টেরও প্রিয়পাত্র ছিলেন।
কারণও ছিল ব্রিটিশরাজের নেকনজরে পড়ার। শুধু আলিপুর মামলায় নয়, রাষ্ট্রদ্রোহের যে-কোনও মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ঘুঁটি সাজানোয় বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল সামসুল সাহেবের। খারাপ কাজগুলো খুব ভাল করে করতে পারতেন। মিথ্যে সাক্ষী জোগাড় করায় যেমন করিতকর্মা, তেমনই পটু কচিকাঁচাদের মগজধোলাই করে ‘রাজসাক্ষী’ হতে রাজি করানোয়।
আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’-তে পরিণত হয়েছে তখন। গ্রেফতার হওয়া বিপ্লবীদের শাস্তিবিধানের জন্য প্রবল সক্রিয় লালবাজার।
হাইকোর্টের শুনানিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ আরও ঠাসবুনোট করার কাজ চলছে জোরকদমে। যে কাজের অন্যতম প্রধান কুশীলব ডিএসপি সামসুল। যিনি বুঝে গিয়েছেন, ওই মামলায় সরকারের মুখ রাখতে পারলে কেরিয়ারে উত্তরোত্তর শৃঙ্গ আরোহণ অবধারিত। সারাদিন পড়ে থাকতেন মামলার নথিপত্র নিয়ে। ঘাঁটতেন আইনের বইপত্র, খুঁটিয়ে জরিপ করতেন জবানবন্দি। নর্টন সাহেবের সঙ্গে হাইকোর্টে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত আলোচনায়।
এহেন পুলিশ অফিসার যে দ্রুত বিপ্লবীদের খতমতালিকায় ঢুকে পড়বেন, স্বাভাবিকই। বিপ্লবীরা জানতেন, সামসুলকে সরিয়ে দেওয়া মানে মামলার খুঁড়িয়ে চলা। এত খেটেখুটে কেসের নথিপত্র তৈরি করার মতো অফিসার কই আর তেমন? ‘সরকারের শ্যাম’ এবং বিপ্লবীদের ‘শূল’ সামসুলকে ‘চোখে সরষে-ফুল’ দেখানোর ছক কষা শুরু হয়ে গেল।
বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে বিপ্লবীদের নানা গোষ্ঠীর যে বিবিধ দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডে সে-সময় ব্যতিব্যস্ত ব্রিটিশ প্রশাসন, তার অলিখিত সর্বাধিনায়ক তখন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। অগ্রজদের কাছে ‘যতীন’, অনুজ সহচরদের কাছে ‘দাদা’। এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর কথায় হেলায় জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত তরুণ তুর্কি অনুগামীরা। এবং যাঁকে ছলে-বলে-কৌশলে দীর্ঘ কারাবাসে বাধ্য করতে তুমুল আগ্রাসী পুলিশবাহিনী। স্ট্র্যাটেজি পরিষ্কার, সেনাপতিকে খতম করতে পারলে ভাল, না পারলে অন্তত জেলবন্দি রাখো বহু বছর। নেতৃত্বহীন সৈন্যদল এমনিতেই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়বে।
সামসুল-হত্যার দায়িত্ব বাঘা যতীন দিলেন তাঁর বিশেষ স্নেহভাজন যুবক বীরেনকে। বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত। ঢাকার বিক্রমপুরে জন্ম। পাথরে কোঁদা চেহারা। উজ্জ্বল চোখদুটি নজর কাড়ে প্রথম দর্শনেই। কিশোরবেলা থেকেই একাধিক বিপ্লবী গোষ্ঠীর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ, দেশকে স্বাধীন করার ব্রতে উদ্বুদ্ধ হওয়া। বিডন স্ট্রিটের জ্ঞানেন্দ্রনাথ মিত্র ছিলেন যতীনের অত্যন্ত আস্থাভাজন। জ্ঞানেন্দ্রর মাধ্যমেই যতীনের সংস্পর্শে আসেন যুবক বীরেন।
দুর্দমনীয় সাহস ছিল উনিশ ছুঁইছুঁই বীরেনের। ছিল একরোখা আবেগ। বাঘা যতীন যখন সামসুল-নিধনের জন্য তাঁকে বেছে নিলেন, আনন্দে বীরেন প্রায় আত্মহারা। কত শত ছেলে তো ‘দাদা’-র আশেপাশে থাকে, এতজনের মধ্যে তাঁর উপরই দায়িত্ব পড়েছে ওই পাষণ্ড পুলিশ অফিসারকে খুনের, এ তো পরম সৌভাগ্য!
সামসুলের সম্ভাব্য আততায়ী হিসাবে বীরেনকে বেছে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল নিধন-প্রস্তুতি। খুনের সিদ্ধান্ত নিলেই তো হল না, রূপায়ণের রসায়ন নিখুঁত হওয়া জরুরি। সামসুল শুধু দাপুটে অফিসারই ছিলেন না, বুদ্ধিও ধরতেন যথেষ্ট। জানতেন, বিপ্লবীরা তাঁকে ব্যঙ্গ করে ছড়া বেঁধেছেন, পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার সুযোগও খুঁজছেন। চলাফেরায় সদাসতর্ক থাকতেন। সঙ্গে সশস্ত্র দেহরক্ষী থাকত। নিজেও সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র রাখতেন অষ্টপ্রহর। বাড়ি থেকে অফিস যেতেন যে রাস্তা দিয়ে, অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেন সম্পূর্ণ অন্য রাস্তা দিয়ে। নির্দিষ্ট রুটিন মেনে কিছু করতেন না। না কর্মক্ষেত্রে, না পারিবারিক জীবনে।
বীরেনের ভাল করে চেনা দরকার সামসুলকে, বাঘা যতীনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সতীশচন্দ্র সরকারের উপর দায়িত্ব পড়ল। সতীশ সব চিনিয়ে দিলেন বীরেনকে। ডিএসপি সাহেবের বাড়ি-অফিস তো বটেই, আলিপুর কোর্ট এবং হাইকোর্ট চত্বরও, যেখানে ইদানীং নর্টন সাহেবের সঙ্গে দিনের অনেকটা সময় কাটান সামসুল।
চেনা তো হল, কিন্তু অস্ত্রের ব্যবস্থা? যতীন বন্দোবস্ত করলেন। সুরেশচন্দ্র মজুমদার (আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা, ডাকনাম ছিল পরান) পরিচিত ছিলেন যতীনের। তিনি একটি ছ’ঘরার রিভলভার দিয়েছিলেন যতীনকে। আগ্নেয়াস্ত্রটি সুরেশ সরিয়েছিলেন বছর পাঁচেক আগে, ১৯০৫-এর ডিসেম্বরে। পূর্বপরিচিত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট রায়বাহাদুর পি সি মৌলিকের হেফাজত থেকে। সুরেশের সঙ্গে যতীনের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন যতীনেরই এক মামা, ললিত চ্যাটার্জী। যিনি ছিলেন পেশায় আইনজীবী এবং আদ্যন্ত দেশপ্রেমিক। ললিতবাবুর আর একটি পরিচয়, সম্পর্কে অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দাদু।
১৯১১ সালে সিআইডি-র বড়কর্তা Mr. F C Daly তাঁর রিপোর্টে লিখেছিলেন, ‘The weapon with which the murder was committed belonged to a Deputy Magistrate of Cuttack District, who had lost it when he visited Calcutta and which was stolen by a youth named Suresh Mazumdar@Poran. Poran later made it over to Jatin Mukherjee who had employed Biren Dutta Gupta to commit the deed.’
.
প্রথম চেষ্টা চৌরঙ্গিতে। জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহের শুরুর দিকে। হাইকোর্ট থেকে বেরিয়ে সামসুল অন্য একটি মামলার তদন্ত-তদারকিতে গিয়েছিলেন। পিছু নিয়েছিলেন বীরেন। ভাবেননি, স্থানীয় থানার এত পুলিশ থাকবে ডিএসপি সাহেবের সঙ্গে। গুলি করা তো দূরের কথা, কাছেপিঠে ঘেঁষাই যথেষ্ট কঠিন ছিল। কার্যসিদ্ধি হল না সেদিন।
হল ১৯১০-এর ২৪ জানুয়ারি।
সামসুল সাহেব দুপুরের একটু পরে এসেছেন হাইকোর্টে। নর্টন সাহেবের ঘরে বসেছেন অন্যদিনের মতোই। সঙ্গে এনেছেন একগুচ্ছ ফাইলপত্র, যাতে গচ্ছিত রয়েছে আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলার গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র। আলোচনা শেষ হল বিকেল পাঁচটা নাগাদ। দেহরক্ষীকে প্রস্তুত হতে বললেন সামসুল।
—বেরব এবার। গাড়ি রেডি আছে তো?
গাড়ি ‘রেডি’ ছিল। ‘রেডি’ ছিলেন বীরেনও। সতীশচন্দ্র সরকারের সঙ্গে দুপুরে কর্নওয়ালিস স্কোয়ারে মিলিত হয়েছেন। হাতবদল হয়েছে লোডেড রিভলভার এবং একটি ছুরি। সতীশ কোর্ট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন বীরেনকে।
সামসুলের দৈনন্দিন গতিবিধি সপ্তাহদুয়েক খুঁটিয়ে দেখার পর বীরেন ঠিক করে নিয়েছিলেন, মারলে হাইকোর্ট থেকে বেরনোর সময়ই মারবেন। কোর্ট বলে কথা, পুলিশ-টুলিশ থাকবে অনেক। ঝুঁকিও প্রচুর, কিন্তু এ ছাড়া উপায় নেই। বাকি সময় গাড়িতেই যাতায়াত সামসুলের, আর সিআইডি-র অফিসের আনাচেকানাচে ঢের বেশি পুলিশি নজরদারি। যখন বেরবেন কোর্ট থেকে, সেটাই মাহেন্দ্রক্ষণ।
সামসুল বেরলেন সরকারি কৌঁসুলির ঘর থেকে। সামনে হাঁটছেন অ্যাডভোকেট জেনারেল, যিনিও নর্টন সাহেবের ঘরে আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন। পিছনে সশস্ত্র দেহরক্ষী। পূর্ব দিকের সিঁড়িতে প্রথম পা রাখতে যাবেন, সাক্ষাৎ যমদূতের মতো মুখোমুখি হাজির হলেন বীরেন।
অল্পবয়সি আগন্তুকের এভাবে পথ আটকে দাঁড়ানোয় ক্ষণিকের জন্য অপ্রস্তুত সামসুল। দেহরক্ষী ততক্ষণে দেখে ফেলেছেন, যুবক পরনের ফতুয়ার মধ্য থেকে বার করছেন রিভলভার। বাধা দেওয়ার আগেই ‘দ্রাম’! করমর্দনের দূরত্ব থেকে গুলি চালিয়ে দিয়েছেন বীরেন। সামসুলের বক্ষস্থল ভেদ করল বুলেট, শেষ নিশ্বাস ফেলার আগে শুধু অস্ফুটে বলতে পেরেছিলেন, ‘পাকড়ো!’
পাকড়াতে ধাওয়া করল পুলিশ। আদালত চত্বর এবং আশেপাশের এলাকায় তখন ত্রাহি ত্রাহি রব। সামসুলের গুলিবিদ্ধ প্রাণহীন দেহকে ঘিরে যেমন ভিড় জমে গেছে, তেমনই চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে বাইরে। ‘খুন! খুন!’ চিৎকারে আতঙ্ক গ্রাস করেছে হাইকোর্টের বাইরের রাস্তাকে। যেখানে চকিত ক্ষিপ্রতায় নেমে এসেছেন বীরেন। দৌড়ে পালাচ্ছেন।
কিন্তু ওই জনাকীর্ণ এলাকায় পালাবেন কোথায়? এক অশ্বারোহী পুলিশ তাড়া করল পিছনে, আটকে গেল কোর্ট এবং অফিসফেরত জনতার ভিড়ে। কোনও ভয়ংকর অপরাধ হয়েছে বুঝি, এই ভেবে কিছু পথচারীও তাড়া করলেন বীরেনকে। শূন্যে গুলি ছুড়তে বাধ্য হলেন বীরেন। জনতা পিছু হঠল, পুলিশ নয়। সদলবলে তাড়া করলেন আদালত চত্বরে ডিউটিতে থাকা এক অফিসার। খবর পৌঁছল লালবাজারে, ‘DSP Samsul Alam shot dead in High Court by unknown youth.’ পড়িমরি করে রওনা দিল রিজার্ভে থাকা সশস্ত্র বাহিনী। কতটুকুই বা দূরত্ব হাইকোর্ট থেকে লালবাজারের?
হাইকোর্টের পাশের ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিট ধরে ছুটতে ছুটতে যখন বীরেন পৌঁছলেন হেস্টিংস স্ট্রিটে (বর্তমানের কিরণশংকর রায় রোড), দম ফুরিয়ে এসেছে। মাথা কাজ করছে না আর। পিছনে যারা তাড়া করছে, তাদের সঙ্গে ব্যবধান তো কমে এসেছেই, উলটোদিক থেকেও দেখতে পাচ্ছেন কয়েকজন পুলিশকে দৌড়ে আসতে। এবার?
মুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন বীরেন। দ্বিধা কাটিয়ে যখন স্থির করলেন, আত্মহত্যাই শ্রেয়, ততক্ষণে একজন সার্জেন্ট উলটোদিক থেকে প্রায় মুখোমুখি চলে এসেছেন। রিভলভার মাথায় ঠেকানোর আগেই যিনি বীরেনের হাত চেপে ধরলেন। পিছনের পুলিশবাহিনীও ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সুযোগ পেলেন না বীরেন। ধরা দিতে হল। রিভলভার, কার্তুজ এবং ছোরা, বাজেয়াপ্ত হল সব।
সামসুল-হত্যার নেপথ্যের চক্রীদের পরিচয় জানতে বিরামহীন নির্যাতন চলল বীরেনের উপর। জিজ্ঞাসাবাদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করলেন সিআইডি এবং স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের পোড়-খাওয়া অফিসাররা। বৃথা চেষ্টা, বীরেন মুখ খুললেন না। বাজিয়ে গেলেন একই কাটা রেকর্ড, ‘ডিএসপি সাহেবের উপর রাগ ছিল, উনি বিপ্লবীদের গ্রেফতার করে অত্যাচার করেন বলে। যা করেছি, একাই করেছি। কারও নির্দেশে নয়। প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম, নিয়েছি।’
অভিযুক্ত দোষ কবুল করে নিয়েছে। জানিয়ে দিয়েছে, আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছুই বলার নেই। বিচারপর্ব সাঙ্গ হল দ্রুত। মৃত্যুদণ্ডের আদেশ শোনালেন বিচারক, ফাঁসির দিন নির্ধারিত হল ১৯১০-এর ২১ ফেব্রুয়ারি। অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করার পর বিচারক যখন গেলেন মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে, রায় দান বিকেলের জন্য মুলতুবি রেখে, নির্বিকার বীরেন সহাস্য আবদার করে বসলেন কোর্ট লক-আপেই।
—আজ কচুরি-শিঙাড়া খেতে খুব ইচ্ছে করছে, দিন না একটু ব্যবস্থা করে কোর্টের ক্যান্টিন থেকে…
নির্দেশ এল লালবাজার থেকে।
—যা খেতে চাইছে দাও। খুশি থাকুক, ওকে একটু দরকারও আছে আমাদের।
‘দরকার’ বলতে বাঘা যতীনকে জেলবন্দি করে রাখার ছক। খুনের মামলায় জড়িয়ে ফাঁসিকাঠ পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা। সামসুল-হত্যার কিছুদিন আগে হাওড়ায় কয়েকটি দুঃসাহসিক ডাকাতি হয়েছিল। সেই ডাকাতিগুলির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে যতীন গ্রেফতার হয়েছিলেন ১৯১০-এর ২৭ জানুয়ারি, ২৭৫ আপার চিৎপুর রোড থেকে। ললিতকে একই মামলায় পুলিশ গ্রেফতার করে কৃষ্ণনগর থেকে, সুরেশ মজুমদারকে কলকাতা থেকে। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪০০ ধারায় মামলা রুজু হয়, যে মামলা ‘Howrah gang case’ নামে খ্যাত। অভিযুক্তদের ঠাঁই হয় হাওড়ার জেলে।
টেগার্ট হীনতম অপকর্ম করলেন সামসুল-নিধন মামলায় বাঘা যতীনকে জড়াতে। বীরেন হাজার জেরাতেও যখন মুখ খুলছেন না কিছুতেই, ইংরেজি খবরের কাগজের একটি পাতা ছাপালেন। এবং কাজটা করলেন এত নিখুঁত এবং বিশ্বাসযোগ্যভাবে, সন্দেহ হওয়ার প্রশ্নই নেই কোনও। সেই পাতায় ফলাও করে খবর ছাপলেন, বাঘা যতীন সামসুল-মামলায় বীরেনের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে সাহায্য করেছেন। খবরের সঙ্গে যতীনের ছবি। যে পাতাটি পুলিশ বীরেনকে দেখাল ১৯ ফেব্রুয়ারির সাতসকালে, আবেগমিশ্রিত উস্কানি চলল লাগাতার।
—লালবাজারের বড়কর্তাদের সঙ্গে তোদের ‘দাদা’-র যে গোপন দহরম মহরম আছে, সে কথা জানিস? ওর দেখবি কিস্যু হবে না। বড়জোর দু’-এক বছরের জেল। আর তোর? প্রাণটাই চলে যাচ্ছে দু’দিন পরে। একে তোরা গুরু মানিস?
মানসিক চাপ একটা পর্যায়ের পর অসহনীয় হয়ে উঠল। বীরেন ভেঙে পড়লেন, ‘বলছি স্যার। পুরোটাই ‘দাদা’-র কথায় করেছি। আমাকে বলেছিল…’
টেগার্ট সহ অফিসাররা ছুটলেন আলিপুর জেলে। হাতে সময় কম, কাল বাদে পরশু বীরেনের ফাঁসি। যুদ্ধকালীন দ্রুততায় বীরেনের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ হল। সামসুল হত্যামামলায় নাম ঢুকল বাঘা যতীনের। হাওড়া জেল থেকে যতীনকে তড়িঘড়ি নিয়ে আসা হল আলিপুর জেলে, যেখানে পুলিশের বিশেষ আবেদনে রাতারাতি বসে গেল চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাস।
যতীনের কৌঁসুলি পালটা চাল চাললেন। সাফ জানালেন, তিনি বীরেনকে ‘cross-examine’ করতে অপারগ, কারণ নিজের মক্কেলের সঙ্গে মামলার ব্যাপারে কথা বলার ন্যূনতম সময়টুকুও পাননি।
পুলিশকর্তারা ছুটলেন ছোটলাটের কাছে। বীরেনের ফাঁসির দিন পিছিয়ে দেওয়ার আর্জি নিয়ে। দিনটা সপ্তাহখানেক পিছিয়ে গেলে যতীনের কৌঁসুলির সময়াভাবের যুক্তি আর ধোপে টিকবে না। আর্জি নাকচ হয়ে গেল। ফাঁসির দিন বদলাল না। ২১ ফেব্রুয়ারি হওয়ার কথা, সেদিনই হবে। সেদিনই হয়েছিল।
ব্রিটিশ সরকার তবু শেষ চেষ্টা করেছিল বীরেনের ফাঁসির পরেও। আদালতে পেশ করা হয়েছিল যুক্তি, খোদ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যখন নথিভুক্ত হয়েছে বীরেনের জবানবন্দি, যতীনের কৌঁসুলি বীরেনকে জেরা করতে না পারলেও সেই জবানবন্দি গ্রাহ্য হওয়া উচিত খুনের মামলায়। যে যুক্তি নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতি।
ফাঁসির আগের দিন তীব্র মনোকষ্টে ছিলেন বীরেন। দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি কখনও, ‘দাদা’-র বিরুদ্ধে জবানবন্দি দিতে হবে। কোথাও কি কোনও ভুল হয়ে গেল?
‘ভুল’ যে হয়েছে, সেটা বীরেনকে সেই রাতেই জানিয়ে দিয়েছিলেন জেলে কর্তব্যরত এক সহৃদয় পুলিশ অফিসার। যাঁর মায়া হয়েছিল বীরেনের উদ্ভ্রান্ত দশা দেখে, যিনি চাননি একটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা মনে পুষে রেখে ফাঁসির মঞ্চে উঠুন যুবক। ইংরেজদের নকল খবরের কাগজ ছাপানোর বিবরণ শুনে তীব্র অনুশোচনা গ্রাস করেছিল বীরেনকে। ওই অফিসারকেই জানিয়েছিলেন কাতর আর্তি, যতীনের কাছে যেন বার্তা পাঠানো হয় তাঁর ক্ষমাভিক্ষার।
সে বার্তা বীরেনের ফাঁসির পর পৌঁছেছিল বাঘা যতীনের কাছে। না পৌঁছলেও চলত অবশ্য। যতীন নিশ্চিত জানতেন, কোনও ভাবে চরম বিভ্রান্ত না হলে বীরেন তাঁর নাম মুখে আনতেনই না।
.
প্রায় একশো আট বছর হয়ে গেল বীরেন দত্তগুপ্তের মৃত্যুর। বাংলার অগ্নিযুগ-বিষয়ক ইতিহাসবিদ বা গবেষকরা জানবেন বীরেনের নাম, কিন্তু আমার-আপনার মতো গড়পড়তা সাধারণেরা? শুনেছি আদৌ বীরেনের নাম, মনে রেখেছি ত্যাগের খতিয়ান?
প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা!