পনেরো দিন হল কালো যাদুকর মবিন উদ্দিনের বাড়িতে আছে। এক বুধবার এসেছিল, মাঝখানে এক বুধবার গিয়েছে, আজ আরেক বুধবার। এর মধ্যে তার নাম বদল হয়েছে। তাকে ডাকা হয় বাবলু নামে। সুরমা অবশ্যি মাঝে মাঝে ভুল করে টুনু ডেকে ফেলেন। সে বসার ঘরে থাকে। বসার ঘরে একটা সিঙ্গেল খাট আছে। খাটে ঘুমোয়। বাকি সময়টা খাটে বসেই জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে। প্রথম কয়েকদিন বসার ঘরেই তাকে খাবার দেয়া হত। এখন সুরমা ভাত খাবার সময় তাকে ভেতরে ডেকে নেন। ছেলেটার সঙ্গে কথাবার্তা বলার চেষ্টা করেন। সে বেশির ভাগ সময়ই হ্যাঁ না করে উত্তর দেয়। কথা বলার সময় চোখের দিকে চোখ তুলে তাকায় না। সুরমা অনেক চেস্টা করেও তার কাছ থেকে তেমন কিছু জানতে পারেননি। অতি সাধারণ প্রশ্নের উত্তরেও সে এমন সব কথা বলে যার কোন অর্থ হয় না। যেমন সেদিন জিজ্ঞেস করলেন, তোমার দেশ কোথায়? সে ভাত ডাল দিয়ে মাখতে মাখতে তার দিকে তাকিয়ে হাসল, উত্তর দিল না। তিনি আবার বললেন, তোমার দেশ কোথায়? গ্রামের বাড়ি?
সে চোখ না তুলেই বলল, নাম মনে নেই।
নাম মনে নেই তার মানে কী? নাম ভুলে গেছ?
হুঁ।
কোন জেলা সেটা মনে আছে?
জ্বি না।
নেত্রকোনা থেকে জায়গটা কত দূরে?
দূরে।
সুরমা বললেন, দূরে তো বুঝলাম। কত দূরে?
অনেক দূরে।
অনেক দূরেরও তো একটা হিসাব আছে। সেই হিসাবে বল কত মাইল দূরে?
জানি না।
জানি না কেমন কথা?
বাবলু তার উত্তরে এমন ভাবে হাসছে যেন সুরমা অত্যন্তু বোকার মতো একটা প্রশ্ন করেছেন। এই প্রশ্নের জবাব দেবার দরকার নেই। সুরমার মনে নানান রকম সন্দেহ হয়, যেমন ছেলেটা পাগল নাতো? ভদ্র পাগল। হৈ চৈ করে না। চুপচাপ বসে থাকে। অনেক রকম পাগলই তো সংসারে থাকে এও এক ধরনের পাগল। পাগল হোক ছাগল হোক ছেলেটার উপর তাঁর মায়া পড়ে গেছে। মায়া পড়ার প্রধান কারণ হলো ছেলেটা দেখতে অবিকল তার মৃত ছেলের মতো। দ্বিতীয় কারণ, ছেলেটা অতি ভদ্র। আজকালকার ছেলেরা এত ভদ্র হয় না, বেয়াড়া ধরনের হয়। এ বেয়াড়া নয়। লাজুক এবং মুখচোরা। এরকম মুখচোরা লাজুক স্বভাবের ছেলে ম্যাজিক দেখায় কী করে সে এক রহস্য।
ম্যাজিকের ব্যাপারে সুরমার তেমন উৎসাহ নেই। ম্যাজিক হচ্ছে ছেলে ছোকরার বিষয়। ছেলেটার ম্যাজিক একবারই তিনি দেখেছেন। তাঁর কাছে এমন কিছু আহামরি মনে হয়নি। সে একটা কাগজ টেবিলের উপর রেখেছে। দেখতে দেখতে কাগজটায় আপনা আপনি আগুন ধরে গেল। চোখের সামনে পুড়ে ছাই। এটা এমন কোন ম্যাজিক না। কাগজে গোপনে কিছু দিয়ে রেখেছিল—এ্যাসিড ফ্যাসিড জাতীয় কিছু। ভাল ম্যাজিক, তবে এরচে ভাল ম্যাজিক তিনি ছোটবেলায় অনেক দেখেছেন। একজন যাদুকর শূন্য থেকে ডিম তৈরী করলেন। একটা ডিম থেকে দু’টা ডিম হল, তিনটা ডিম হল আবার মিলিয়ে গেল।
এই ছেলেটা ভাল ম্যাজিক দেখায় বলেই যে তাকে এখানে রাখা হয়েছে তা না। তার উপর মায়া পড়ে গেছে বলেই সে এখনো আছে। যেদিন মায়া কেটে যাবে তাকে চলে যেতে বলা হবে।
সংসারে একটা বাড়তি মানুষ পোষা সহজ ব্যাপার না। যে দিনকাল পড়েছে—নিজের আত্মীয় স্বজনদেরই কেউ জায়গা দেয় না আর এ-হল বাইরের অজানা অচেনা একজন মানুষ। এই যুগে অচেনা একজনকে বিশ্বাস করাও ঠিক না।
রাতে ঘুমোতে যাবার সময় সুরমার প্রায়ই মনে হয় ছেলেটা জ্বীন ভূত না-তো! মানুষের সংসারে জ্বীন এসে বাস করে এরকম গল্পতো প্রায়ই শোনা যায়। একটা গল্প আছে—মাদ্রাসার হোস্টেলে থেকে একটা জ্বীনের ছেলে পড়ে। পড়াশোনায় খুব ভাল। মাদ্রাসার সুপার একরাতে ছেলেটার ঘরের পাশ দিয়ে। যাচ্ছিলেন হঠাৎ তিনি কী মনে করে যেন ছেলেটার ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিলেন। দেখলেন—ছেলেটা বিছানায় শুয়ে আছে! শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে। হঠাৎ সে হাতের বইটা রেখে বইয়ের শেলফের দিকে হাত বাড়াল। বইয়ের শেলফটা ঘরের অন্য প্রান্তে, অনেকটা দূরে। তিনি স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন ছেলেটার হাত লম্বা হচ্ছে–লম্বা হচ্ছে তো হচ্ছেই। সাপের মতো হয়ে যাচ্ছে। মাদ্রাসার সুপার এই দৃশ্য দেখে ভয়ে বিকট চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। এরপর থেকে ছেলেটাকে আর দেখা গেল না।
হতেও তো পারে টুনু নামের এই ছেলেটা আসলে একটা জ্বীন। মানুষের বেশ ধরে তাদের সঙ্গে আছে। সুরমা এক রাতে ছেলেটার সম্পর্কে তাঁর এই ভীতির কথা মবিন উদ্দিনকে বলেছিলেন। মবিন উদ্দিন বিরক্ত গলায় বলেছেন, তোমার কি ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে গেল? সুরমা আমতা আমতা করে বললেন, কথার কথা বলছি। জগতে কত রহস্যময় ব্যাপার ঘটে। মবিন উদ্দিন বলেছেন, জগতে কোন রহস্যময় ব্যাপার ঘটে না। একটি দরিদ্র ছেলে ম্যাজিক ফ্যাজিক দেখায়। থাকার জায়গা নেই, কয়েক দিন এখানে আছে। তোমার যদি পছন্দ না হয় বলে দাও চলে যাবে। তাও তো বলছ না। রোজ রান্না করে খাওয়া। বেশ আদর করেই তো খাওয়াচ্ছ।
ছেলেটা ওর নিজের সম্পর্কে কিছুই তো বলছে না। দেশ কোথায় এইটাই এখন বলেনি।
কোনো কারণে হয়ত বলতে চায় না।
বলতে চাইবে না কেন? এটা সন্দেহজনক না? তুমি একদিন ভাল মতো জিজ্ঞেস কর না কেন?
করব। জিজ্ঞেস করব। এখন ঘুমাও তো। ঘ্যান ঘ্যান করবে না।
আমি ঘ্যান ঘ্যান করছি?
হ্যাঁ করছ। তুমি হচ্ছ এমন একজন মহিলা যার চিন্তার সঙ্গে কর্মের কোন মিল নেই। তুমি কাজ কর উত্তরে, চিন্তা কর দক্ষিণে।
তার মানে কী?
মানে বুঝতে পারব না। সব কিছুর মানে বুঝতে পারলে তো কাজই হয়েছিল। রাত হয়েছে এখন ঘুমাও।
মবিন উদ্দিন পাশ ফিরে শুলেন। স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। আজ দুপুরেই তিনি সুরমাকে দেখেছেন ম্যাজিশিয়ন ছেলেটির সঙ্গে অদিখ্যেতা করছে। তাকে খেতে দেয়া হয়েছে। ছেলেটা বলল, সে সজনে ডাঁটা খাবে না। সুরমা অবাক হয়ে বলল, এ কী সজনে ডাঁটা খাবে না কেন? খুবই পুষ্টির জিনিস। খাও বললাম। না খেলে আমি খুবই রাগ করব। আমার রাগ কী জিনিস তুমি জান না।
অচেনা অজানা একটা ছেলে, সে সজনে ডাঁটা না খেলে না খাবে। এত কেন সাধাসাধি?
খাবার পর টক দৈ-এর বাটি বের হল। মবিন উদ্দিন জানেন টক দৈ ছেলেটার জন্যে আনা হয়েছে। তিনি বা সুপ্তি কেউই টক দৈ খায় না। ম্যাজিশিয়ান ছেলেটা অত্যন্ত পছন্দ করে খায়। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে তার ছেলে টুনুও টক দৈ পছন্দ করে খেত। রোজ খাওয়া শেষ করে বলত, মা টক দৈ আছে?
হ্যাঁ ম্যাজিশিয়ান ছেলেটার মধ্যে কিছু রহস্যময় ব্যাপার আছে। সুযোগ-সুবিধা মতো তিনি দু একটা কথা হয়ত তাকে জিজ্ঞেস করবেন। তবে ছেলেটা এমন কোন অপরাধ করেনি যে উকিল হয়ে প্রশ্ন করে তাকে নাজেহাল করতে হবে।
বাবার নাম কি?
মায়ের নাম কি?
দেশের বাড়ি কোথায়?
মামার বাড়ি কোথায়?
কোন জেলা, কোন গ্রাম?
পড়াশোনা কী?
যত ফালতু ব্যাপার। একটা দরিদ্র ছেলে বিপদে পড়ে কয়েক দিন আছে। যথাসময়ে চলে যাবে। নিজে থেকে যদি না যায় তিনিই চলে যেতে বলবেন। খুব ভদ্রভাবে বলবেন। যাতে বেচারা মনে কষ্ট না পায়। তিনি নিজে দরিদ্র মানুষ তাঁর পক্ষে যত দিন সম্ভব হয়েছে তিনি সাহায্য করেছেন। এখন আর পারছেন না।
মবিন উদ্দিন খুব ভাল করে জানেন সুরমা বা সুপ্তি কেউই ম্যাজিশিয়ান ছেলেটিকে চলে যেতে বলতে পারবে না। তারা ছেলেটাকে অসম্ভব পছন্দ করে। তার কাছে মনে হয় এটাও ঠিক না। কোন কিছুর বাড়াবাড়িই ভাল না। কাউকে পছন্দ করা ভাল, কিন্তু সেই পছন্দ বাড়াবাড়ি পর্যায়ের হওয়াটা ভাল না। তাঁর ধারণ সুরমা ও সুরমার কন্যা স্বাভাবিকভাবে কিছু করতে পারে না। সবকিছুকেই তারা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে নিয়ে যায়। ছেলেটাকে তিনি পছন্দ করেন তবে সেই পছন্দের মধ্যে কিন্তু আছে। বেশ বড় ধরনের কিন্তু। তার ধারণা ছেলেটা মনের কথা বুঝতে পারে। এরকম মনে করার পেছনে কারণ আছে।
গত পরশু দুপুরে তিনি খাওয়া দাওয়া করে শুয়েছেন। শীতকালের দুপুরে লেপের ভেতর ঢুকলে ঘুম আসবেই। তাঁরও ঘুম আসছে চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন, হঠাৎ মনে হল জর্দা দিয়ে একটা পান খেতে পারলো ভাল হত। ঘরে পানের চল নেই। পান যেতে হলে কাউকে দোকানে পাঠাতে হয়। বাবলু আছে, তাকে বলতেই হয়, বলতে ইচ্ছা করল না। সুরমা নানান ভেজাল করবে। হেন তেন শতেক প্রশ্নে মাথা ধরিয়ে দেবে।
পান আনাচ্ছ কেন?
জর্দা দিয়ে পান আবার কবে ধরলে?
একটা কোন নেশা ছাড়া থাকতে পার না না?
সিগারেট, পান, বাকি রইল কী? মদটা ধরে ফেল, তাহলে কেউ আর বলতে পারবে না যে একটা নেশা বাকি আছে।
শত প্রশ্নের জবাব দেবার চেয়ে শুয়ে থাকা ভাল। সন্ধ্যাবেলায় যখন বের হবেন তখন দোকান থেকে একটা পান কিনে নিলেই হবে। মবিন উদ্দিন ঘুমোবার আয়োজন করলেন, কিন্তু ঘুম এল না, মাথার মধ্যে পান ঘুরতে লাগল।
কয়েক বছর আগে ঢাকা শহরে স্টেডিয়ামে বরফ দিয়ে ঠাণ্ডা করা পান খেয়েছিলেন, সেই স্থানের দ্বাদ এখন মুখে লেগে রয়েছে। তিনি ঠিক করলেন, বইয়ের চালান আনতে এবার যখন ঢাকা যাবেন গোটা দশেক পান নিয়ে আসবেন। দোকানে রেখে দেবেন যে ক’দিন খাওয়া যায় খাবেন।
মনের এই অবস্থায় সুপ্তি ঢুকল। তাঁকে হতভম্ব করে দিয়ে বলল, বাবা এই নাও তোমার জর্দা পান।
তিনি বললেন, জর্দা পান মানে? পান কী জন্যে?
খাবার জন্যে আবার কী জন্যে।
কে এনেছে?
ম্যাজিশিয়ান ভাইয়া এনেছে।
সে শুধু শুধু পান আনবে কেন? তাকি কি মাই পান আনতে বলেছি?
বলেছ নিশ্চয়ই ভুলে গেছ। ইস বাবা তুমি সামান্য ব্যাপার নিয়ে এত কথা যে বলতে পার। আশ্চর্য। কথা বাড়িও না পান নাও আমি হোম ওয়ার্ক করছি।
মবিন উদ্দিন পান নিলেন। তবে তার মনে বিরাট এক কিন্তু ঢুকে গেল। ব্যাপারটা কী? ছেলেটা যত বড় ম্যাজিশিয়ানই হোক পিসি সরকার তো না। পিসি সরকারও মনের কথা বলতে পারতেন না। এ বলছে কীভাবে? সাধু-সন্ন্যাসী পীর ফকিরদের এই সব ক্ষমতা থাকে। এই ছেলে সাধু-সন্নাসীও না পীর-ফকিরও না। এত শখের জর্দা দেয়া পান তার কাছে ঘাসের মতো লাগতে লাগল।
আরেক দিনের কথা তিনি বিরস মুখে দোকানে বসে আছেন।
বিক্রি-বাটা কিছুই নেই। কাস্টমার তো দূরের কথা মাছিও উড়ছে না। বিকেলের দিকে একজন কাস্টমার এসে একটা জ্যামিতি বাক্স নাড়াচাড়া করল। দাম জিজ্ঞেস করল কিনল না। মবিন উদ্দিন তার দোকানে বই ছাড়াও খাতা, পেন্সিল, জ্যামিতি বাক্স এই সব রাখেন। যাতে অফ সিজনে পুরোপুরি বসে থাকতে না হয়। কোনই লাভ নেই। যখন বই বিক্রি হয় না তখন অন্য কিছুও বিক্রি হয় না। মবিন উদ্দিনের ধারণা হল আজ বোধ হয় মঙ্গলবার। মঙ্গলবারটা তাঁর জন্যে খারাপ। আজ কী বার তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন। আশ্চর্য মনে করতে পারলেন না। একবার মনে হচ্ছে সোমবার আরেকবার মনে হচ্ছে মঙ্গলবার। ঘরে একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছে। তারিখ জানা থাকলে বারটা বের করা যেত। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন, তারিখটাও তার মনে নেই। নিজের উপর যখন খুবই রাগ লাগছে তখন বাবলু বলল, স্যার আজ বুধবার।
তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, আজ কী বার তা কি আমি তোমার কাছে জানতে চেয়েছি?
ছেলেটা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, জি না।
তাহলে শুধু শুধু বললে কেন আজ বুধবার? অকারণে কথা বলবে না। অকারণে কথা আমি নিজে বলি না। অন্য কেউ বললেও আমার ভাল লাগে না। এটা মনে রাখবে। অধিক কথা বলা মানে অকারণে আয়ুক্ষয়।
জ্বি আচ্ছা মনে রাখব।
ছেলেটার এই সব রহস্য তার ভাল লাগে না। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছা করে ডেকে বলেন, ঠিক করে বল তো তোমার ব্যাপারটা কী। ঝেড়ে কাশ। তুমি কি মনের কথা বুঝতে পার? পারলে বল হ্যাঁ, না পারলে বল, না। নো হাংকি পাংকি। আমি যেমন অধিক কথা বলা পছন্দ করি না, তেমনি হাংকি পাংকিও পছন্দ করি না।
ছেলেটা যদি স্বীকার করে সে মনের কথা বলতে পারে তাহলে তিনি তাকে দুটা কথা শুনিয়ে দেবেন। কঠিন ভাবে বলবেন, মনের কথা বলার এই বিদ্যা শিখলে কোথায়? এটা তো ভাল বিদ্যা না। এটা খারাপ বিদ্যা। যে বিদ্যায় মানুষের উপকারের চেয়ে অপকার বেশি হয় সেই বিদ্যা খারাপ বিদ্যা। সেই বিদ্যার চর্চা করাও পাপ। কথাগুলি দেরি না করে বলে ফেলা দরকার। মবিন উদ্দিন রোজই একবার ভাবেন আজ বলবেন, শেষ পর্যন্ত জার বলা হয় না। তারপর এমন এক ঘটনা ঘটল যে মবিন উদ্দিন মনস্থির করলেন, ব্যাপারটা আজই ফয়সালা করবেন।
ঘটনাটা এরকম, মাঝরাত। তিনি ঘুমুচ্ছেন। প্রচণ্ড শীত পরেছে, তিনি লেপের নীচে ঢুকে আছেন। শীতের জন্যেই তার ঘুম হঠাৎ ভেঙ্গে গেল। জানালা ভাল মতো বন্ধ হয়নি হুহু করে তীব্র ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। তাঁর মনে হল বসার ঘরে কে যেন হাঁটাহাঁটি করছে। জিনিস পত্র নাড়াচাড়া করছে। চোর নাতো? কৃষ্ণপক্ষের শীতের রাতগুলি চোরদের জন্যে খুবই আনন্দের। গায়ে তেল মেখে মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়ে চুরি করতে যায়। খুট খাট শব্দ যতই হোক গৃহস্থ জাগবে না। শীতের রাতের সুখের ঘুম ঘুমাবে। ঘর কবরের মতো অন্ধকার। ট্রান্সফরমার বাস্ট করেছে বলে সাতদিন ধরে ইলেকট্রিসিটি নেই। ট্রান্সফরমার ঠিক করারও কিছু হচ্ছে না। শহরের একটা অংশ অন্ধকারে পরে আছে। অদ্ভুত দেশ। মেঝেতে যে হারিকেন জ্বালানো ছিল সেটি কী কারণে যেন নিভে গেছে। মবিন উদ্দিন দেয়াশলাইয়ের খোঁজে বালিশের নীচে হাত দিলেন। যা ভেবেছিলেন, দেয়াশলাই নেই। সুরমার দেয়াশলাই ভীতি আছে। বালিশের নীচে বা তোষকের নীচে দেয়াশলাই দেখলেই সে সরাবে। তার ধারণা প্রায়ই আপনা-আপনি বোম ফাটার মতো দেয়াশলাইয়ের বাক্স ফেটে উঠে বিরাট অগ্নিকাণ্ড হয়। নেহায়েত ভঁর সাবধানতার জন্যে এ বাড়িতে কিছু হচ্ছে না। মবিন উদ্দিন সাবধানে খাট থেকে নামলেন। অন্ধকারে দরজা খুলে বসার ঘরে এলেন। চোর বাড়িতে থাকলেও দরজা খোলার শব্দে এতক্ষণে পালিয়ে যাবার কথা। তারপরেও ঘরে হাঁটাহাটির শব্দ হচ্ছে। বিস্মিত মবিন উদ্দিন বললেন, কে?
ছেলেটা বলল, জ্বি আমি।
এত রাতে জেগে আছ?
জ্বি।
কী করছ?
বই পড়ছি।
বই পড়ছি মানে। অন্ধকারে বই পড়ছ কীভাবে?
ছেলেটা কোন জবাব দিল না। মবিন উদ্দিন বললেন, কী বই পড়ছ?
সুপ্তির ইতিহাস বইটা একটু দেখছিলাম।
তুমি কী অন্ধকারে দেখতে পাও?
জ্বি।
কীভাবে দেখ? ম্যাজিকের সাহায্যে?
বাবলু জবাব দিল না। মবিন উদ্দিন বললেন, আমি গায়ে কি পরেছি তুমি বলতে পারবে?
আপনি হলুদ রং এর একটা গেঞ্জি পরে আছেন।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি ইতিহাস বই পড়, আমি কাল সকালে তোমার সঙ্গে কথা বলব।
জ্বি আচ্ছা।
ভাল কথা তুমি কি বলতে পারবে আমার দেয়াশলাইটা কোথায়? বলতে পারলে বল। হারিকেনটা জ্বালিয়ে রাখি। শীতের রাতে চোরের উপদ্রব হয়।
দেয়াশলাইটা আপনার বালিশের নীচেই আছে।
আচ্ছা ঠিক আছে। কাল সকালে তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।
মবিন উদ্দিন বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগলেন, একী যন্ত্রণা। খাল কেটে কুমীর আনেননি তো? মনে হয় এনেছেন। কুমীরের চেয়েও ভয়াবহ কিছু নিয়ে এসেছেন। অক্টোপাস নিয়ে এসেছেন। ব্যাপারটা নিয়ে তিনি সুরমার সঙ্গে আলাপ করতে চান না। জটিল ব্যাপার থেকে মেয়েদের দূরে রাখাই নিয়ম। সমস্যার শুরুতে মেয়েদের জানানো মানে সমস্যা আরও জট পাকিয়ে ফেলা। নিয়ম হচ্ছে সমস্যা শেষ হলে যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে মেয়েদের জানানো।
সারা রাত মবিন উদ্দিনের ঘুম হল না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে ফজরের আজান শুনলেন। পাখ পাখালির ডাক শুনলেন। দেখলেন–সুরমা বিছানা থেকে নামছে। অজু করতে যাচ্ছে, তারও ওঠা উচিত। এম্নি নামাজ কাজা করা এক জিনিস আর আজান শুনে কাজা করা ভিন্ন জিনিস। তিনি বিছানা থেকে উঠতে পারলেন না। প্রবল ঘুমে তলিয়ে গেলেন। ঘুমের মধ্যেই বিচিত্র একটা স্বপ্ন দেখলেন। যাদুকর এবং তিনি হাটছেন। বনের ভেতরের পায়েচলা পথে হাঁটছেন। ঘন বন, তবে খুব পরিচ্ছন্ন। বনের নীচে ঝোপ ঝাড় নেই। কার্পেটের মতো দুর্বা ঘাস। বনটা খানিকটা রহস্যময়, কারণ কোন শব্দ নেই। চারদিক সুনসান নীরবতা। বাতাসে গাছের পাতা নাড়ছে না। পাখি ডাকছে না, কিছু না। তারা দু’জন যে হাঁটছেন সেই হাঁটাও নিঃশব্দ হাঁটা।
মবিন উদ্দিন প্রথম প্রশ্ন করলেন, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
ছেলেটা বলল, আমরা কোথাও যাচ্ছি না তো। আপনি আমাকে কিছু জরুরি প্রশ্ন করবেন বলেছিলেন, সেই জন্যে নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে এসেছি। আপনার কি মনে হচ্ছে না জায়গাটা খুব নিরিবিলি?
তুমি কে?
আমি একটা গাছ?
কী বললে! গাছ?
জ্বি।
তুমি মানুষ না?
জ্বি না।
তুমি গাছ?
জ্বি আমি গাছ।
কী গাছ? আম না কাঁঠাল? নাকি সাধারণ জঙ্গলা গাছ?
আমি একটা গাছ সেটাই বড় কথা, কী গাছ সেটা বড় কথা না। কেউ যদি বলে সে মানুষ তাহলে তো সব বলা হয়ে যায়। মানুষের বেলায় কি আলাদা করে পরিচয় দেবার দরকার পড়ে? তাহলে গাছের বেলায় দরকার হবে কেন?
একটা গাছ মানুষ সেজে আমার বাড়িতে আছে এটা খুবই আশ্চর্য ব্যাপার না?
না খুব আশ্চর্য ব্যাপার কিন্তু না। অনেক গাছই মানুষ সেজে থাকে। কেউ তাদের ধরতে পারে না। অনেকে আবার জানেও না যে তারা মানুষ না তারা পাছ।
ও আচ্ছা।
আপনি কি আর কিছু জানতে চান?
তুমি মানুষের মনের কথা বলতে পার?
তা পারি। গাছদের অনেক ক্ষমতা।
গাছদের অনেক ক্ষমতা?
জ্বি। যাদের ক্ষমতা বেশি থাকে তারাই কখনো অন্যকে সেই ক্ষমতা দেখায়। ক্ষমতা যত অল্প হয় সেই ক্ষমতা প্রদর্শনের ইচ্ছও তত বেশি হয়।
তোমার আর কী ক্ষমতা আছে?
আপনাকে বলতে চাচ্ছি না।
বলতে চাচ্ছ না কেন?
আমি আপনার মাথা এলোমেলো করে দিতে চাচ্ছি না। এম্নিতেই আপনার মাখা যথেষ্ট এলোমেলো হয়ে আছে।
স্বপ্নের এই পর্যায়ে হঠাৎ ঝড় শুরু হল। প্রবল ঝড়। বাতাসের ঝাপটা আসছে আর প্রকাণ্ড সব গাছ নুয়ে নুয়ে পড়ছে। আকাশ যদিও দেখা যাচ্ছে না, মবিন উদ্দিন বুঝতে পারছেন আকাশ ঘন-কালো। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এতক্ষণ যে বন নিঃশব্দ ছিল এখন তা শব্দময়। তারম্বরে পাখি ডাকছে। মট মট শব্দে গাছের ডাল ভাঙ্গছে। ভয়াবহ অবস্থা। ঝড়ের সঙ্গে শুরু হল বর্ষণ ঘন বর্ষণ। এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। তিনি ছুটতে শুরু করেছেন। ছুটে কোথায় যাবেন? যেদিকেই যান সেদিকেই বন। তিনি একী মহা বিপদে পড়লেন? এর মধ্যে মেয়েকণ্ঠে হাসির শব্দ শোনা গেল। এই ভয়াবহ দূর্যোগে কে হাসে। কার এত আনন্দ?
মবিন উদ্দিনের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনি শুনলেন সুপ্তি হাসছে। হাসতে হাসতে ভেঙ্গে পড়ছে। তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। সুপ্তি ঘরে ঢুকল, এখন তার মুখে হাসি।
বাবা কী মজার একটা কাণ্ড যে হচ্ছে, ম্যাজিশিয়ান ভাইয়া উঠোনে বসে দাঁত মাজছিল। হঠাৎ কোথেকে একটা কাক এসে তার মাথায় করে দিয়েছে। হি হি হি।
সুপ্তির হাসি আর থামেই না। মকিন উদ্দিন মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার স্বপ্নের ঘোর এখনও কাটেনি, নিজের মেয়েটাকেও অচেনা লাগছে। এই বিচিত্র স্বপ্ন দেখার মানে কী?
.
স্বপ্ন স্বপ্নই। স্বপ্ন নিয়ে মাথা ঘামাতে নেই। মানুষ তার এক জীবনে কত বিচিত্র স্বপ্নই না দেখে। ছোটবেলায় তিনি একবার স্বপ্নে দেখেছিলেন শেয়ালের মত সুঁচালো মুখের কী একটা প্রাণী খুব গম্ভীর ভঙ্গিতে তার সঙ্গে কথা বলছে। কথা বলা শেষ করে সেই প্রাণীটা হাই তুলতে লাগল। তখন এই প্রাণীটার মা এসে বলল, এই তুই কিছু না খেয়েই ঘুমুতে শুরু করেছিস। কিছু খেয়ে নে। ওমি প্রাণীটা তার উরুতে কামড় দিয়ে একদলা গোশত তুলে নিল। প্রচণ্ড ব্যথায় তিনি জেগে উঠলেন। উরুতে কামরের দাগ-টগ কিছু ছিল না। কিন্তু অনেক দিন ব্যথা ছিল।
ছোটবেলার স্বপ্নটা যেমন অর্থহীন ছিল গত রাতের স্বপ্নও তেমন অর্থহীন। স্বপ্ন নিয়ে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার কিছু নেই।
ছেলেটা অন্ধকারে দেখতে পারে এই খটকা অবশ্যি থেকেই যায়। তা সেটাও কোন বড় ব্যাপার না ম্যাজিকের কোন কৌশল হবে। ভাল ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিকের অনেক কৌশল জানে। সেও জানে। শুধু শুধু এত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার কিছু নেই।
আজ ছুটির দিন—দোকান খুলতে হবে না। মবিন উদ্দিন বিশ্রাম করতে পারেন। শরীরটা তেমন ভাল যাচ্ছে না। শরীরের চেয়ে মন বেশি খারাপ ব্যবসাপাতি হচ্ছে না। দোকান বিক্রি করে অন্য কিছু করবেন? এই বয়সে অন্য কিছু করার কথা চিন্তা করাও কষ্টের। ছেলেটা বেঁচে থাকলে হত না। এই বয়সটা নৌকায় চড়ে চারদিকের শোভা দেখার বয়স। হাল ধরার বয়স না।
মবিন উদ্দিন নাস্তা করলেন। কিছুক্ষণ রোদে বসে রইলেন। আজ ঠাণ্ডা অন্যদিনের চেয়ে কম। তারপরেও রোদে বসে থাকতে ভাল লাগছে।
সুপ্তি বাবার পাশে এসে দাঁড়াল। মনি উদ্দিন মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, কিছু বলবি?
সুপ্তি বলল, না। আচ্ছা বাবা তোমার কি মন খারাপ?
উহুঁ।
তোমার গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে তোমার মন খারাপ।
আমার মন খারাপ নারে মা, আমার মন ভাল। বেশ ভাল। তুই কি আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে দিতে পারবি?
সুপ্তি বিস্মিত হয়ে বলল, অবশই পারব।
সুপ্তি জানে তার বাবা চা খান না। এক সময় খুব খেতেন। বিশেষ একটা ঘটনার পর চা ছেড়ে দিলেন। সেই বিশেষ ঘটনাও সে জানে। আজ হঠাৎ বাবার চা খেতে চাইবার ব্যাপারটা সে বুঝতে পারছে না। তার বাবা কি বদলে যাচ্ছেন? শুধু তার বাবা না—তারা সবাই কি একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে না?
মবিন উদ্দিন বললেন, বাবলু কোথায়?
মা বাজারে পাঠিয়েছেন।
তোর মাকে বলিস আমি দুপুরে খাব না।
কোন খাবে না?
রাহেলা আজ দুপুরে তার ওখানে খেতে বলেছে। মেয়ের বিয়ে নিয়ে কি কথাবার্তাও নাকি আছে। তুই কি যাবি আমার সঙ্গে?
সুপ্তি বলল, না।
না কেন? চল যাই।
ফুপুর বাড়িতে আমার যেতে ইচ্ছে করে না। তুমি এক কাজ কর–বাবা ম্যাজিক ভাইয়াকে নিয়ে যাও। সে ভালমন্দ কিছু খেয়ে আসুক। দিনের পর দিন বেচারা আজে বাজে খাবার খাচ্ছে।
মবিন উদ্দিন কিছু বললেন না। সংসারের চিন্তাটা আবার তাঁর মাথায় ঢুকে গেল। পোস্টাপিসের পাস বই এ তাঁর আর অল্প কিছু টাকা অবশিষ্ট আছে। এই টাকা শেষ হলে সব শেষ। তিনি কীভাবে সামলাবেন।
বাবা তোমার মন কি খারাপ?
না মন খারাপ না।
আমি প্রায়ই দেখি তুমি খুব মন খারাপ করে থাক। কোন একটা ব্যাপার নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তা কর। ব্যাপারটা কী?
কিছু না রে মা।
আমি যে ফুপুর বাসায় যেতে চাচ্ছি না এই জন্যে মন খারাপ করছ? বাবা শোন ঐ বাড়িতে যেতে আমার ভাল লাগে না। তারা এত বড়লোক—আমরা গরীব। ফুপু ঠিকমত আমাদের সঙ্গে কথাও বলেন না। তুমি বলতে গেলে প্রতি সপ্তাহে ঐ বাড়িতে যাও। ফুপু কখনো আসেন না। আমার মনে হয় তোমারও এত ঘন ঘন যাওয়া উচিত না।
ভাই বোনের বাড়িতে যাবে না! কী বলিস তুই। মনে কর তোর খুব টাকাওয়ালা বাড়িতে বিয়ে হল। টুনু হয়ে গেল গরীব। সেই গরীব টু কি তোর বাড়িতে যাবে না!
সুপ্তি বলল, অবশ্যই যাবে। এবং তুমিও যাবে। আর শোন বাবা তুমি আমার কথায় কিছু মনে করো না। আমারতো আসলে বুদ্ধি বেশি না। আমি খুবই বাচ্চা মেয়ে।
মবিন উদ্দিন হাসলেন। তার ধারণা তাঁর এই মেয়ের খুবই বুদ্ধি। শান্ত বুদ্ধি। মেয়েদের এত বুদ্ধি থাকাটা অবশ্যি ঠিক না। বেশি বুদ্ধির মেয়েদের সংসারে শান্তি থাকে না। বোকা টাইপ মেয়েগুলি সুখে ঘর সংসার করে। কে জানে তার এই মেয়ের কপালে সুখের ঘর আছে কি-না। থাকার অবশ্যি কোন কারণ নেই। কার দায় পড়েছে অন্ধ মেয়ে বিয়ে করার?
.
রাহেলাদের বাড়িতে মবিন উদ্দিন দুপুরের আগেই পৌঁছুলেন। দোতলা পাকা দালান। সামনে বাগান আছে। বাড়ির পেছনে বাঁধানো পুকুর। গত বছর পোনা ছেড়েছিল—এখন সেই পোনা বড় হয়েছে। আজ জাল ফেলে মাছ ধরা হচ্ছে। সবাই ভিড় করে আছে পুকুর পাড়ে। মবিন উদ্দিনও গেলেন। রাহেলা ভাইকে দেখে এগিয়ে এল। রাহেলার মুখ ভর্তি পান। সুখী সুখী চেহারা।
ভাইজান আপনার সঙ্গে খুবই জরুরি কিছু কথা আছে।
বল কী কথা।
ঐ দিকে চলে যাই। এইসব কথা কারোর না শোনাই ভাল।
মবিন উদ্দিন শংকিত ভঙ্গিতে এগিয়ে গেলেন। তার সম্পর্কে এমন কি কথা আছে যে কেউ শুনলে অসুবিধা হবে। তিনি নিতান্তই নিরামিষ মানুষ। কারো কোন সমস্যার মধ্যে নেই।
কী কথা বলতো?
তোমাদের বাড়িতে না-কি একটা ছেলে থাকে?
ও আচ্ছা ম্যাজিশিয়ান ছেলেটার কথা বলছিস?
হ্যাঁ তার কথাই বলছি। পথে ম্যাজিক দেখাতো, তুমি নাকি তাকে বাড়িতে নিয়ে তুলেছে। সেই ছেলে সবার সঙ্গে খাচ্ছে দাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মবিন উদ্দিন কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। রাহেলা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ভাবীর যে তালের ঠিক নাই সেটাতো আমরা সবাই জানি। আপনি কেন এরকম হবেন। আপনার কেন মাথা আউলা হবে? চেনা নাই পরিচয় নাই, বাইরের একটা ছেলে পথেঘাটে ম্যাজিক দেখায় সে কি-না ভেতর বাড়িতে ঘুরঘুর করে।
ছেলেটা ভাল।
কী করে বুঝলেন ছেলেটা ভাল? ভাল ফ্যামিলির ছেলে পথেঘাটে যাদু দেখায়? আপনার বাড়িতে বড় একটা মেয়ে আছে। আছে না?
বড় কোথায়। সুপ্তি বাচ্চা মেয়ে।
ক্লাস এইটে পড়ে মেয়ে বাচ্চা? শুনেন ভাইজান আমার বিয়ে হয়েছিল ক্লাস এইটে পড়ার সময়।
ও।
ভাইজান ঘটনা শুনে আমি খুবই বিরক্ত হয়েছি। ছিঃ ছিঃ কী কান্ড! পথের একটা ছেলে ভেতর বাড়িতে ঘুরঘুর করছে। একটা বদনাম যদি রটে যায় উপায় আছে? আপনি আজই ছেলেকে বিদায় করবেন।
আচ্ছা দেখি।
দেখিটেখি না ভাইজান। আপনি বাড়িতে যাবেন, ছেলেকে বলবেন, পথ দেখ। আর লক্ষ্য রাখবেন সে যেন আর ফিরে না আসে। ছেলে যে সারাদিন ভেতরের বাড়িতে বসে থাকে–সে করে কী? ভাবীকে ম্যাজিক শেখায়?
সারাদিন ভেতরের বাড়িতে থাকে না। আমার সঙ্গে দোকানে গিয়ে বসে।
তাহলে তো ঘটনা ঘটছে। আপনার দোকানের পয়সা-কড়ি নিশ্চয়ই মেরে সাফ করছে। আপনি যে রকম মানুষ কিছুই বুঝতে পারছেন না। আপনার চোখের সামনে দিয়ে হাতি গেলেওতো আপনি দেখেন না।
তুই যতটা অস্থির হচ্ছিস তত অস্থির হবার মতো কিছু না। বাইরের একটা ছেলেওতো ঘরের ছেলের মতো হতে পারে। পারে না?
ভাইজান শুনেন তিন দিন ঘরে থেকে যদি কেউ ঘরের মানুষ হয়ে যায় তখন বুঝতে হবে সমস্যা আছে বিরাট সমস্যা। আপনি আজই ঐ ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। আপনি নিজে বলতে না পারেন– আমি বকুলের বাবাকে বলে দিচ্ছি সে সন্ধ্যার পর যাবে ঐ হারামজাদাকে কানে ধরে বের করে দেবে।
তার দরকার নেই।
আপনি নিজে যদি তাকে বের না করেন, আমি অবশ্যই বকুলের বাবাকে পাঠাব।
মবিন উদ্দিন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। রাহেলা মনে হচ্ছে এই সামান্য ব্যাপারে নিয়ে ভাল ঝামেলা করবে। বকুলের বাবা আব্দুল মজিদ মানুষটা ছোটখাট এবং অত্যন্ত মিষ্টভাষী হলেও কঠিন লোক। তিনি নিজে তাকে খুবই অপছন্দ করেন। মাঝে মাঝে তার মনে হয় রাহেলার যদি এই মানুষটার সঙ্গে বিয়ে না হত তার জীবনটা অনেক সুখের হত। বস্তা বস্তা টাকা থাকলে কিছু হয় না। টাকার প্রয়োজন অবশ্যই আছে কিন্তু বস্তা বস্তা টাকার দরকার নেই।
ভাইজান!
বল।
বকুলের বাবা তোমাকে কী যেন বলবে, যাবার আগে শুনে যেও।
আচ্ছা।
মবিন উদ্দিনের অস্বস্তি লাগছে। আব্দুল মজিদের সঙ্গে কথা বলে তিনি কখনোই স্বস্তিবোধ করেন না। যদিও আব্দুল মজিদের ভদ্রতা এবং বিনয় তুলনাহীন। সেই বিনয় এবং ভদ্রতার পেছনে কিছু একটা থাকে যা অসহনীয়।
আব্দুল মজিদ মবিন উদ্দিনকে দেখেই পা ছুঁয়ে সালাম করল। হাসি মুখে বলল, ভাইজান ভাল আছেন?
মবিন উদ্দিন শুকনো গলায় বললেন, ভাল।
আপনার স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে ভাইজান। স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়া দরকার। জোয়ান বয়সে স্বাস্থ্য ভাঙ্গলে সামাল দেয়া যায় শেষ বয়সে স্বাস্থ্য ভাঙ্গলে আর সামাল দেয়া যায় না।
তা ঠিক। তুমি নাকি কী বলবে আমাকে?
আব্দুল মজিদ বিনয়ে প্রায় ছোট হয়ে গিয়ে বলল, মেয়ের বিয়েতো ভাইজান একটু অসুবিধার মধ্যে পড়ে গেছি। তিন চারটা বিল আটকা। আপনার টাকাটা যদি পেতাম খুবই ভাল হত।
মবিন উদ্দিন মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। বছর চারেক আগে দোকান কেনার সময় তিনি আব্দুল মজিদের কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা ধার নিয়েছিলেন। এই ধার শোধ করতে পারেননি।
আপনাকে বলতেও লজ্জা লাগছে। কী যে অসুবিধায় পড়েছি। এতদিন ধরে কনট্রাকটারী করছি এমন অসুবিধায় পড়িনি। আগামী বুধবার নাগাদ কি টাকাটা পাওয়া যাবে ভাইজান?
মবিন উদ্দিন চুপ করে রইলেন। আব্দুল মজিদ বলল, আপাতত আপনি টাকাটা দেন পরে প্রয়োজন বোধে আবার নিবেন। আমার কোন উপায় নেই ভাইজান টাকার ব্যবস্থা আপনাকে করাই লাগবে।
মবিন উদ্দিন নিজের অজান্তেই বললেন, আচ্ছা।
আব্দুল মজিদ বলল, রাহেলার কাছে শুনেছি কী একটা ছেলে নাকি আপনার বাড়িতে ঢুকে পরেছে। দরকার মনে করলে আমাকে বলবেন—শুয়োরের বাচ্চাকে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলব। ফাজলামীর জায়গা পায় না।
শুধু শুধু তাকে মেরে তক্তা বানাবে কেন? এটা কি ধরণের কথা।
ঝামেলা করলে একটু বলবেন। না মেরেও অনেক কিছু করা যায়।
তোমাকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমিই করব।
ঠিক আছে ভাইজান। অসুবিধা হলে আমাকে খবর দিবেন। আর ভাইজান বুধবারে টাকাটার জন্য আমি নিজেই আসব। সন্ধ্যার দিকে আসব। গরজটা আমার। আপনার কাছে চাইতে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। না চেয়েও উপায় নেই।
মবিন উদ্দিন খুবই মন খারাপ করে ফিরলেন। খালি হাতে ফিরলেন না, আব্দুল মজিদ পুকুর থেকে মার দু’টা সিলভার কার্প মাছ সঙ্গে দিয়ে দিয়েছে।