কার্তিক মাসের সকাল।
সিদ্দিকুর রহমানের গায়ে ঘিয়া রঙের চাদর। ঘন হয়ে কুয়াশা পড়েছে। তিনি কুয়াশার ভেতর দাঁড়িয়ে আছেন। তার দৃষ্টিতে একধরনের মুগ্ধতা আছে। মুগ্ধতার কারণ এই বছর শিউলি গাছে ফুল ফুটেছে। হাজার হাজার ফুল। গত বছর এবং আগের বছর গাছে কোনো ফুল ফুটে নি। শিউলি গাছ মাঝেমধ্যে ফুল দেয়া বন্ধ করে এটা তার জানা ছিল না। ফল গাছের ক্ষেত্রে এরকম দেখা যায়। সব আমগাছে প্রতিবছর মুকুল আসে না। ফুল গাছের ক্ষেত্রে এই ব্যাপার কখনো ঘটে না। ফুল ফুটানো তাদের জন্যে বাধ্যতামূলক।
সিদ্দিকুর রহমান দাঁড়িয়ে আছেন শহরবাড়ির সামনে। এই বাংলো ধরনের বাড়ি তার দাদা খান বাহাদুর হামিদুর রহমান বানিয়েছিলেন। বাড়ির নাম দিয়েছিলেন ফুলার কটেজ। পূর্ববঙ্গ ও আসামের প্রথম লে. গভর্নর ফুলার সাহেবের নামে বাড়ি। বাড়ির ডিজাইন করা হয়েছিল গভর্নর সাহেবের ইংল্যান্ডের বাড়ির ছবি দেখে। বাড়ির সামনে তিনি চেরিগাছও লাগিয়েছিলেন। গাছগুলি বাঁচে নাই।
হামিদুর রহমানের ধারণা ছিল বাড়ি দেখে ফুলার সাহেব মুগ্ধ হবেন। শুধু তার এক রাত থাকার জন্যে কেউ এত আয়োজন করবে। এটা নিশ্চয়ই তিনি ধারণা করে বসে ছিলেন না। ফুলার সাহেবের ময়মনসিংহের নেত্রকোনার অতি প্রত্যন্ত অঞ্চলে আসতে চাওয়ার পেছনের কারণ পাখি শিকার। সাহেব নিরামিষাশী হলেও পাখি শিকারের প্রচণ্ড নেশা ছিল। রাজকার্যের বাইরে তিনি পাখি শিকারের জন্যে অনেক সময় বের করতে পারতেন।
খান বাহাদুর হামিদুর রহমান গভর্নর সাহেবের পাখি শিকারের জন্যে বিপুল আয়োজন করিয়েছিলেন। এই উপলক্ষে তিনি সুসং দূর্গাপুরের মহারাজার কাছ থেকে নান্দিনা নামের একটা মাদি হাতি কিনে নেন। গভর্নর সাহেব হাতির পিঠে চড়ে শিকারে যাবেন। তার জৌলুসাই আলাদা। জামালপুর থেকে কারিগর। এনে দুটা পালকি বানানো হয়। যে-সব জায়গায় হাতি যাবে না সে-সব জায়গায় পালকি যাবে। মুন্সিগঞ্জ থেকে একটা বজরা কিনে আনেন। নদীতে বজরা বাধা থাকবে। বজরায় পান ভোজনের ব্যবস্থা। বরফকলের বরফ, স্কচ হুইস্কি। সাহেবরা মদ্যপান ছাড়া কোনোরকম খেলাধুলাই করতে পারেন না। বাঙালির যেমন পান-সুপারি সাহেবদের সেরকম বরফ-মদ।
গভর্নর সাহেবের পছন্দের খানা তৈরির জন্যে কোলকাতার আলীপুর থেকে একজন ফিরিঙ্গি বাবুর্চি আনা হয়। বাবুর্চির নাম হর্নথন।
লেফটেনেন্ট গভর্নর ফুলার শেষ পর্যন্ত এই অঞ্চলে পাখি শিকারে আসেন নি। তিনি স্বদেশী আন্দোলনকে কঠিন হাতে দমন করতে গিয়ে কংগ্রেসী নেতাদের সঙ্গে ঝামেলা পাকিয়ে ফেলেন। তাকে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করতে হয়। লর্ড মিন্টো ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন।
গভর্নর সাহেবের পদত্যাগে ভারতবর্ষে যে মানুষটি সবচে বেশি দুঃখ পেয়েছিলেন তিনি সম্ভবত খান বাহাদুর হামিদুর রহমান। অনেকের ধারণা লাট সাহেব তাঁর বাড়িতে আসেন নি এই শোকে সেই বছরই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর একমাত্ৰ সন্তান হাসানুর রহমানের বয়স তখন মাত্র দশ। অতি দ্রুত পরিবারটি ধ্বংসের মুখোমুখি এসে পড়ে। নানান পাওনাদার এসে জুটে। একজন এসে জোর করে হাতি নিয়ে চলে যায়। একজন নিয়ে যায় বজরা। জমিজমা নিয়েও দূর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজনরা মামলা শুরু করে দেন।
বিস্ময়কর ঘটনা হলো বালক হাসানুর রহমানের পাশে সে সময় যে মানুষটি এসে দাঁড়ায় সে ফিরিঙ্গি বাবুর্চি হর্নথন। তার মুখে একটাই বুলি— I will kill all the bastards বন্দুকসে গোলি মারদুঙ্গা। হর্নথন এই বাড়িতেই মৃত্যু পর্যন্ত থেকে যান। গ্রামের মানুষরা তাকে ডাকত হন্টন সাহেব। হন্টনের আগে একটি বিশেষণও ব্যবহার করত— পাগলা। পাগলা হন্টন। বাড়ির নামও লোকজন পাল্টে দিল। বাংলো বাড়ির নাম হয়ে গেল— শহরবাড়ি। এই বাড়ির সামনে এসে দাড়ালে অঞ্চলটাকে শহর মনে হয়। গ্রাম মনে হয় না। কাজেই বাড়ির নাম শহরবাড়ি।
কুয়াশার ভেতর দিয়ে রোদ এসেছে। কুয়াশা ভেজা রোদ। সিদ্দিকুর রহমান চোখ বন্ধ করে রোদের দিকে মুখ ফিরালেন। পাগলা হন্টন শেষ বয়সে এই কাজটা করতি–ঘণ্টার পর ঘণ্টা চোখ বন্ধ করে রোদের দিকে তাকিয়ে থাকত। সিদ্দিকুর রহমানের শৈশবের একটা বড় অংশ কেটেছে এই মানুষটার আশেপাশে। সে হড়বড় করে সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে যেত। বালক সিদ্দিকুর রহমান ইংরেজি কিছুই বুঝত না কিন্তু মুগ্ধ হয়ে গল্প শুনন্ত। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে পাগলা হন্টন মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গান করত। কিছু কিছু গান সিদ্দিকুর রহমানের এখনো মনে আছে—
I adore thee
l Serve thee
Fall before thee
সিদ্দিকুর রহমান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। পাগলা হন্টন সাহেবের কথা মনে হলেই তার মন খারাপ লাগে। এও এক রহস্য। তার কত প্ৰিয়জনই তো মারা গেছেন। তাদের কথা এরকম হুটহাট করে মনে আসে না। আর মনে এলেও মন খারাপ হয় না। তিনি ডাকলেন, সুলেমান!
সুলেমান সঙ্গে সঙ্গে বলল, জি।
আজি কী বার?
বিষুদৃদবার।
আজ তো রমিলার স্নানের দিন।
জি।
নতুন সাবান আছে না?
জি।
রমিলাকে সপ্তাহে একদিন স্নান করানো হয়। এই স্নান তিনি নতুন সাবান ছাড়া করেন না। খুবই আগ্রহ করে তিনি সাবানের মোড়ক খুলেন। কিছুক্ষণ গন্ধ নেন।
রমিলার ঘরের জানালা খোলা। জানালা দিয়ে রোদ এসে খাটে পড়েছে। তিনি সাবধানে রোদে হাত রাখলেন। তার ভাবটা এরকম যেন এটা রোদ নাআগুন। আগুনে হাত রাখলে পুড়ে যাবে। তিনি আঙুল বন্ধ করছেন এবং ফাক করছেন। আঙুলের ফাঁক দিয়ে রোদ খাটের চাঁদরে পড়ছে এবং বন্ধ হচ্ছে। সুন্দর লাগছে দেখতে।
তিনি কিছুক্ষণ এই খেলা খেললেন। দূর থেকে কইতরী তাকে লক্ষ করছে। কইতরীর চোখে কৌতূহল এবং ভয়। তার সামান্য মনখারাপ হলো। কইতরী তারই মেয়ে। অথচ মায়ের ভয়ে সে অস্থির। তিনি হাত ইশারায় মেয়েকে ডাকলেন। কইতরী ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসছে। মেয়েটা তো অনেক বড় হয়েছে। সুন্দরও হয়েছে। যতই দিন যাবে। এই মেয়ে ততই সুন্দর হবে।
মাগো, তোমার ব্যাপজান কই জানো?
না।
খোঁজ নিয়া বাইর করতে পারবো?
হুঁ।
তোমার বাপজানরে বলো তালা খুঁইল্যা আমারে যেন বাইর করে। আইজ আমার মাথা ঠিক আছে।
আইচ্ছা।
তোমার বয়স কত হইছে মা?
এগার।
মাশাল্লাহ।
তার খুব ইচ্ছা করছে মেয়েকে একটা প্রশ্ন করতে। লজ্জায় করতে পারছেন না। একটা বিশেষ সময় থেকে মেয়েরা যে শারীরিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যায়— তার দুই মেয়ে কি তার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে? কোনো মা মেয়েদের এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে লজ্জা পান না। তিনি পাচ্ছেন কারণ তিনি সাধারণ মা না। তিনি পাগল মা।
কইতরী এখনো দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় মার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে। ভালো লাগলেও তার চোখ থেকে ভয় যায় নি।
তোমার ভাইন জাইতরী কই?
শহরবাড়িত।
তারেও ডাক দিয়া আনো। তোমরার দুই ভইনের মাথাত আমি তেল দিয়া দিব।
আচ্ছা।
তোমার ভাই মাসুদ কই?
জানি না।
তারেও খবর দেও। অনেক দিন তারে দেখি না।
আচ্ছা খবর দিব।
কইতরী চলে যাচ্ছে, রমিলা মুগ্ধ হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। এত মুগ্ধ হয়ে ছেলেমেয়ের দিকে তাকানো ঠিক না। নজর লেগে যায়। বাপ-মায়ের নজর–কঠিন নজর রমিলা মনে মনে বললেন, আল্লাগো মাফ করো। মাকুন্দগো আমার নজর যেন না লাগে।
তিনি নজর না লাগানোর জন্যে অন্যদিকে তাকাতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু মেয়ের উপর থেকে নজর সরাতে পারছেন না।
মেয়ে যে ফ্রকটা পরে আছে তার রঙ সুন্দর– হলুদ। হলুদ মেয়েদের রঙ। এই রঙ পুরুষের জন্যে নিষেধ। কেন নিষেধ কে জানে! ভালো মুনশি মাওলানা পেলে জিজ্ঞেস করে দেখতেন। যখন তার মাথা ঠিক থাকে তখন অনেক কিছু জানতে ইচ্ছা করে। কথা বলার মতো একজন কেউ যদি থাকত!
তিনি খাট থেকে নামলেন। তার হাঁটতে ইচ্ছা করছে। ঘরের তালা না। খোলা পর্যন্ত তিনি ঘরের ভেতরই কিছুক্ষণ হাঁটবেন বলে ঠিক করলেন। ঘরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাওয়া এবং ফিরে আসা। তার ঘরটা বেশ বড়। ঘরের একমাথা থেকে আরেক মাথায় যেতে হলে একশ তিনি কদম পা ফেলতে হয়। বেশির ভাগ সময়ই তিনি হাঁটেন চোখ বন্ধ করে। খাটটা ছাড়া এই ঘরে অন্যকোনো আসবাব নেই। কাজেই চোখ বন্ধ করে হাঁটতে অসুবিধা হয় না। বরং একটা সুবিধা হয়–চোখ বন্ধ করে হাটলে তিনি অনেক রকম গন্ধ পান। পশ্চিমের দেয়ালের কাছে গেলে কাঠ পচা গন্ধ এবং ন্যাপথিলিনের গন্ধ পান। যখন উত্তর দেয়াল ঘেঁসে হাঁটেন তখন পান আতরের গন্ধ। পূর্বদিকের জানালার কাছে এলেই নাকে আসে কাঁচা ঘাসের গন্ধ।
সিদ্দিকুর রহমান ঘরের তালা খুলতে খুলতে বললেন, ভালো আছ?
রমিলা মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে বললেন, হু।
সিনান করবে? গরম পানি দিতে বলব? আজ বিষ্যুদবার।
সিনান সইন্ধ্যাকালে করব। আজ সিনান কইরা নয়া একটা শাড়ি পরব।
সিদ্দিকুর রহমান বিস্মিত হয়ে তাকালেন। একবার ভাবলেন জিজ্ঞেস করেন— নিয়া শাড়ি কেন? জিজ্ঞেস করলেন না।
রমিলা স্বামীকে দেখেই মাথা নিচু করে ফেলেছিলেন। এখন মাথা আরো নিচু করে গুটিসুটি পাকিয়ে ফেললেন।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, রান্না করতে মন চায়? রান্নার জোগাড়যন্ত্র করে দিতে বলব?
না। মেয়ে দুটিার মাথায় তেল দিয়ে দিব।
বসবে কোথায়?
এক জায়গায় বসলেই হবে।
আমি কি থাকব। আশেপাশে?
দরকার নাই। আমার শরীর আজ ভালো।
বিশেষ কিছু কি খেতে ইচ্ছা করে? ইচ্ছা করলে বলো ব্যবস্থা করি। তোমার যখন মাথা ঠিক থাকে না তখন তো খেতে পারো না। আজ আরাম করে খাও।
সইন্ধ্যাকালে খাব।
রমিলা হাঁটতে হাঁটতে বারান্দায় চলে এসেছেন। সিদ্দিকুর রহমান তাঁর পেছনে পেছনে আসছেন। রমিলাকে তালা খুলে বের করা ঠিক হয়েছে কি না।
বুঝতে পারছেন না। রমিলা সুস্থ মানুষের মতো আচরণ করছে বলে তার কাছে মনে হচ্ছে না। বারান্দার শেষ মাথা পর্যন্ত সে এসেছে চোখ বন্ধ করে।
রমিলা!
জি।
তোমার শরীর কি আসলেই ঠিক আছে?
হুঁ।
রমিলা মাথার ঘোমটা ফেলে দিয়ে স্বামীর দিকে সরাসরি তাকালেন। ফিসফিস করে বললেন, আপনাকে একটা কথা বলব।
আইজ রাইতে একটা ঘটনা ঘটব।
কী ঘটনা?
সেইটা আপনেরে বলব না। ঘটনা ঘটনের পরে আপনের দিল খোশ হইব। এই জন্যেই আমি নয়া শাড়ি চাইছি।
নতুন শাড়ির ব্যবস্থা করতেছি। শোনো রমিলা, আমি তোমার আশেপাশেই আছি। মাথার মধ্যে উনিশ-বিশ কিছু যদি টের পাও আমারে ডাকবা।
আচ্ছা।
রমিলা খুব যত্ন করে দুই মেয়ের মাথায় তেল দিয়ে দিলেন। চুল টেনে ফিতা দিয়ে বেঁধে দিলেন। মেয়েদের বুদ্ধি পরীক্ষার জন্যে কয়েকটা সিমাসা দিলেন। কঠিন সিমাসা। বুদ্ধি থাকলে ভাঙানো যাবে। বুদ্ধি না থাকলে না।
বলো তো মা, জিনিসটা কী?
কহেন কবি কালিদাস পথে যেতে যেতে
নাই তাই খাচ্ছ, থাকলে কোথায় পেতে?
জইতরী-কইতরী দুজন একসঙ্গে বলল, পারব না।
আচ্ছা আরেকটা ধরি।
জইতরী বলল, প্রথমটা আগে ভাঙাও।
রমিলা বললেন, সবগুলা পরে একসঙ্গে ভাঙায়ে দিব। এখন আরেকটা শোনো—
আকাশে উড়ে না পক্ষী উড়ে না জঙ্গলে
এই পক্ষী উড়ে শুধু শনি মঙ্গলে।
পারব না।
তাহলে এটা ভাঙাও
মহাকবি কালিদাসের অতি আজব কথা
নয় লক্ষ তেঁতুল গাছের কয় লক্ষ পাতা?
পারব না।
দেখ এইটা পার কি-না—
তিন অক্ষরে নাম তার বৃহৎ বলে গণ্য
পেটটা তাহার কেটে দিলে হয়ে যায় অন্ন।
কইতরী আনন্দিত গলায় বলল, এইটা পারব। এটা ভারত। ভারতের পেট কাটলে হয়। ভাত।
হইছে। মা, তোমার খুব বুদ্ধি।
কইতরী বিড়বিড় করে বলল, মা, তুমি কি ভালো হয়ে গেছ?
রমিলা ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে বললেন, এখন ভালো। মন্দ হইতে কতক্ষণ!
কইতরী বলল, শহরবাড়ি যাইবা?
না।
কইতরী বলল, তেঁতুল খাইবা? গাছ পাকনা তেঁতুল।
রমিলার তেঁতুল খেতে ইচ্ছা করছিল না, তারপরেও বললেন, আনো দেখি।
দুই মেয়েই দৌড়ে চলে গেল। লোকমানকে দেখা যাচ্ছে। সে অনেকক্ষণ থেকেই আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করছে। পরপুরুষের সামনে পর্দা করা উচিত। কিন্তু লোকমান তাকে মা ডাকে। পুত্রের সামনেও কি পর্দার বিধান আছে? রমিলা মাথায় শাড়ির আঁচল তুলতে তুলতে লোকমানকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। লোকমান প্রায় ছুটে এসে পাশে দাঁড়াল।
কেমন আছ লোকমান?
আম্মা, ভালো আছি।
ঘরদোয়ার বড়ই অপরিষ্কার। ঝাড় পোছ দেও। কুটুম আসব।
কে আসব আম্মা?
রমিলা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, যখন আসব তখন জানিবা। এখন সামনে থাইকা যাও।
রমিলা চোখ বন্ধ করলেন। তার মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। ভোঁতা ধরনের চাপ ব্যথা। লক্ষণ মোটেই ভালো না। এই ব্যথা বাড়তে থাকবে। তারপর হঠাৎ করেই ব্যথা বোধ থাকবে না। শুরু হবে ভয়ঙ্কর সময়। যে সময়ের কোনো হিসেব তার কাছে থাকবে না। রমিলার উচিত অতি দ্রুত নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার ব্যবস্থা করা। তার মন খারাপ লাগছে, মেয়ে দুটি আগ্রহ করে তেঁতুল আনতে গিয়েছে। এই তেঁতুল তারা দিতে পারবে না। তিনি বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে মেয়েদের সন্ধানে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন।
এই তো তাদেরকে দেখা যাচ্ছে। মেয়ে দুটাই তো সুন্দর হয়েছে। কই তরী একটু বেশি সুন্দর। শুধু যদি চুল কালো হতো! এই মেয়ের চুল। লাল। মেয়েদের লাল চুল ভালো না।
লাল চুলের মেয়েদের দিকে জিন-পরীর নজর থাকে।
বলে আমারো যেন তালাবন্ধ করে। আমার মাথা নষ্ট হইতে শুরু করছে।
জইতরী-কইতরী মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। রুমিলা ক্লান্তগলায় বললেন, তোমরা সাজগোজ কইরা থাকবা। বাড়িতে কুটুম আসতেছে।
কইতরী বলল, কুটুম কে মা?
রমিলা বললেন, তোমাদের বড় ভইন। তার নাম লীলা। লীলাবতী।
তোমারে কে খবর দিছে মা?
কেউ খবর দেয় নাই। আমি আগে আগে কিছু কিছু জিনিস জানি। ক্যামনে জানি বলতে পারব না।
রমিলা তেঁতুল হাতে নিয়ে তাঁর ঘরের দিকে রওনা হলেন। চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসছে। আর দেরি করা ঠিক না।
লীলা ট্রেনের জানালায় মাথা রেখে বসে আছে। তার চোখে চশমা। চশমা নড়বড় করছে। মনে হচ্ছে যে-কোনো সময় আলগা হয়ে নিচে পড়ে যাবে। খাপ করে হাত বাড়িয়ে ধরার সময় পাওয়া যাবে না। কারণ তার দু’টা হাতই বন্ধ। সে মাথা রেখেছে হাতের উপর। ট্রেন ঝড়ের গতিতে চলছে। প্ৰচণ্ড বাতাস। বাতাসে লীলার চুল উড়ছে। অল্প স্বল্প বাতাসে চুল উড়ে যখন মুখের উপর পড়ে তখন তার খুব বিরক্তি লাগে। এখন বিরক্তি লাগছে না। বরং উল্টোটা হচ্ছে, খুবই ভালো লাগছে। ভালো লাগার সঙ্গে খানিকটা ভয় যুক্ত হয়েছে— মাথার উপরের জানোলা খটখট করছে। ট্রেনের ঝাকুনিতে ধুম করে যে-কোনো সময় হয়তো মাথার উপর পড়বে।
লীলার বয়স একুশ। তার মুখ লম্বাটে। গায়ের রঙ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে তাকে খুব ফরসা লাগে। আবার কখনো মনে হয় শ্যামলা। সব মানুষের চেহারায় কিছু বিশেষত্ব থাকে। লীলার বিশেষত্ব হচ্ছে, তাকে দেখেই মনে হয় সে খুব কথা বলে। আসলে ব্যাপারটা উল্টা। লীলা খুবই কম কথা বলে। তবে অন্যরা যখন কথা বলে সে সারাক্ষণই মুখ টিপে হাসতে থাকে এবং এমন আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে যে মনে হয় এ-ধরনের কথা সে আগে কখনো শোনে নি, ভবিষ্যতে শোনার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। যা শোনারএখনি শুনে নিতে হবে।
ট্রেনের বাকুনিতে লীলার ঘুম-ঘুম লাগছে। সে বেশ কষ্ট করে জেগে আছে। সামনের স্টপেজটাই নান্দাইল রোড। তাকে নামতে হবে নান্দাইল রোডে। ট্রেন সেখানে মাত্র দুমিনিটের জন্যে থামবে। এই নিয়েও কিছু সমস্যা আছে, তাকে ট্রেনের যাত্রীরা বলেছে, মেইল ট্রেন নান্দাইল রোডে থামে না। যদি সত্যি সত্যি না থামে। তাহলে বিস্ময়কর ব্যাপার হবে। সে টিকিট কেটেছে নান্দাইল রোডের। ট্রেন না থামলে টিকিট কেন দেয়া হবে?
লীলার সঙ্গে এমন কিছু মালপত্র নেই। একটা বড় সুটকেস, একটা হ্যান্ডব্যাগ। হ্যান্ডব্যাগ সে হাতে করে নামাবে। সুটকেস নামাঝে মঞ্জুমামা। মঞ্জুমামা এখন উপরের বার্থে শুয়ে হাঁ করে ঘুমুচ্ছেন। ট্রেনের গতি কমে এলে তার ঘুম ভাঙাতে হবে। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। টেনশনে তার গলার স্বর চিকন হয়ে যাবে। এমনিতে তার গলার স্বর ভারী, শুধু টেনশনের সময় গলা চিকন হয়ে যায়। লীলা ভেবেই পায় না একটা মানুষ সারাক্ষণ এত টেনশনে কী করে থাকে! তার চেয়েও আশ্চর্য কথা— এত টেনশন নিয়ে একটা মানুষ যখন-তখন কী করে ঘুমিয়ে পড়ে?
মঞ্জুমামা লীলার আপন মামা না। লীলার মায়ের খালাতো ভাই। নয়াপুরে তার একটা ফার্মেসি, একটা টি স্টল এবং রেডিও সারাই-এর দোকান আছে। কোনো দোকান থেকেই তেমন কিছু আসে না। এই নিয়ে তার মাথাব্যথাও নেই। ব্যবসা পাতির খোঁজখবর নিতে গেলে তার টেনশন হয় বলেই তিনি কোনো খোঁজখবর করেন না। দিনের বেশিরভাগ সময় তার স্কুলজীবনের বন্ধু পরেশের চায়ের দোকানে বসে থাকেন। দোকানের পেছনে চৌকির উপর শীতল পাটি পাতা থাকে। ঘুম পেলে সেখানে ঘুমিয়ে পড়েন। মগুমামার বয়স পয়তাল্লিশ। এখনো বিয়ে করেন নি, তবে বিয়ের কথা চলছে। পত্রিী নয়াপাড়া প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। মাঘ মাসের ছয় তারিখে বিয়ের কথা পাকা হয়ে আছে। তার পরও স্থানীয় মানুষজনের ধারণা, এই বিয়ে শেষ পর্যন্ত হবে না। আগেও কয়েকবার বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়েছে, শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয় নি। মঞ্জুমামাকে লীলা নিয়ে এসেছে তার চড়নদার হিসেবে। সম্পূর্ণ নতুন একটা জায়গায় যাচ্ছে, বয়স্ক একজন পুরুষমানুষ সঙ্গে থাকা দরকার। এই মানুষটাকে লীলার খুবই পছন্দ।
জানালার বাইরে বিপুল অন্ধকার। হঠাৎ-হঠাৎ দু’একটা বাতি জ্বলতে দেখা যায়। বাতিগুলিকে লীলার কাছে মনে হয়। জিনের চোখ। বাতিগুলির দিকে তাকিয়ে থাকতে তার ভালো লাগছে। বাতিগুলি স্থির না। চলন্ত ট্রেনের কারণে হঠাৎ গাছের আড়ালে পড়ে বাতি উধাও হয়ে যাচ্ছে, আবার হুট করে অন্ধকার থেকে বের হচ্ছে। আলোর রঙও একরকম না; কোনোটা গাঢ় লাল, কোনোটা হালকা হলুদ। কোনোটা আবার নীলাভ। সবগুলি বাতির রঙ এক হওয়া উচিত। সবই তো কেরোসিনের আলো। রঙের বেশ-কমটা কি দূরত্বের জন্যে হচ্ছে? পরীক্ষা করতে পারলে হতো। লীলা পরীক্ষাটা করতে পারছে না, কারণ সে চোখই মেলে রাখতে পারছে না।
লীলা নিশ্চিত, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়বে। মজার কোনো স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে। মঞ্জুমামাও উপরের বার্থে ঘুমিয়ে থাকবেন। তারা নান্দাইল রোড স্টেশন ছাড়িয়ে অনেকদূর চলে যাবে। একসময় মঞ্জুমামার ঘুম ভাঙবে। তিনি চিকন গলায় বলবেন–ধুনছে আমারে! তুলা ধুনা ধুনছে। ও লীলা, এখন করি। কী? লীলা বলবে, চলুন মামা আমরা চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ি। মঞ্জুমামা অত্যন্ত বিরক্ত গলায় বলবেন, তোর মাথায় কি কিরা ঢুকছে? ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে পড়লে তুই বাঁচবি? তোকে সঙ্গে নিয়ে বের হওয়াই ভুল হয়েছে। এইজন্যে শাস্ত্ৰে আছে পথে নারী বিবর্জিতা।
কোন শাস্ত্ৰে আছে?
কোন শাস্ত্ৰে আছে জানি না। কথা বলিস না, চুপ করে থাক। ধুনছেরে আমারে, ধুনছে। হায় খোদা এ কী বিপদ!
ট্রেনের গতি কি কমে এসেছে? ঘটাং ঘটাং শব্দ এখন হচ্ছে না। তার বদলে শো শো শব্দ হচ্ছে। লীলা বুঝতে পারছে সে ঘুমিয়ে পড়েছে, তবে কিছুটা চেতনা এখনো আছে। এক্ষুনি সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে। সে স্বপ্ন দেখছে, শুরুতে এই বোধটা থাকবে।
লীলা এখন দেখছে সে হাতির পিঠে বসে আছে। হাতিটা দুলতে দুলতে এগোচ্ছে। স্বপ্ন দেখা তাহলে শুরু হয়েছে। লীলা ইচ্ছা করলেই স্বপ্ন নষ্ট করে জেগে উঠতে পারে। স্বপ্ন নষ্ট করতে ইচ্ছা করছে না। হাতির পিঠে চড়তে ভালো লাগছে। আরো কী কাণ্ড, বাদ্য-বাজনা হচ্ছে! কারা যেন আবার পিচকিরি দিয়ে রঙ ছিটাচ্ছে। লাল-নীল রঙ চোখে-মুখে লাগছে। রঙ উঠবে তো? হাতির মাহুত লীলার দিকে তাকিয়ে বলল— তাড়াতাড়ি নামো, তুফান হচ্ছে। মাহুত শুদ্ধভাষায় কথা বলছে। গলার স্বর মঞ্জুমামার মতো। লীলা বলল, নািমব কীভাবে? একটা সিঁড়ি লাগিয়ে দিন-না! মাহুত রাগী গলায় বলল— আরে বেটি তুফান হচ্ছে। এই বলেই ধাক্কা দিয়ে সে লীলাকে ফেলে দেবার চেষ্টা করতে লাগল। লীলার ঘুম ভেঙে গেল। সে অবাক হয়ে দেখে আসলেই তুফান হচ্ছে। ট্রেন থেমে আছে। কামরায় কোনো বাতি নেই। যাত্রীরা জানালা বন্ধ করার চেষ্টা করছে। ছোট একটা বাচ্চা কাঁদছে। একজন একটা টাৰ্চলাইট জুলিয়েছে। টাৰ্চলাইটের আলো ক্ষীণ। সেই ক্ষীণ আলোও আবার কিছুক্ষণ পরপর নিভে যাচ্ছে।
লীলা বলল, মামা, আমরা কোথায়?
মঞ্জু বিরক্ত গলায় বলল, আরো গাধা— ড্রাইভার জঙ্গলের মাঝখানে ট্রেন থামিয়ে দিয়েছে। আরো ব্যাটা, তুই কোনো স্টেশনে নিয়ে গাড়ি থামা। জংলার মধ্যে ট্রেন থামালি, এখন যদি ডাকাতি হয়?
ডাকাতি হবে কেন?
দেশ ভরতি হয়ে গেছে ডাকাতে। ডাকাতি হবে না? আজকাল ট্রেন অ্যাকসিডেন্ট হলে কী হয়? আশেপাশের চার-পাঁচ গ্রামের লোক চলে আসে। সাহায্য করার বদলে তারা করে লুটপাট। সুন্দরী মেয়ে থাকলে ধরে নিয়ে যায় পাটক্ষেতে।
লীলা বলল, মামা, শুধু—শুধু টেনশন করো না তো! কিচ্ছু হবে না।
মঞ্জু বিরক্ত গলায় বলল, কিছু হবে না তুই জানিস কীভাবে?
মিটমিটি করে এতক্ষণ যে টর্চলাইট জ্বলছিল সেটিও নিভে গেল। কামরার ভেতর গাঢ় অন্ধকার। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোয় যাত্রীদের ভীত মুখ দেখা যাচ্ছে। লীলার জানালার পাশে হুড়মুড় শব্দ হলো। লীলা চমকে উঠে বলল, মামা, কী হয়েছে?
মঞ্জু বলল, গাছ ভেঙে পড়েছে, আর কী হবে! ঝড়ের মধ্যে গাধা-ড্রাইভার জঙ্গলে ট্রেন দাঁড় করিয়েছে। দেখিস পুরো জঙ্গলই ট্রেনের উপর ভেঙে পড়বে। পুরো ট্রেন পাটিসাপটা হয়ে যাবে। ভাই, আপনাদের কারো সঙ্গে দেয়াশলাই আছে? দেয়াশলাই থাকলে জ্বালান তো!
দেয়াশলাই-এর কাঠি জ্বলেই নিভে গেল। ট্রেনের জানালা বন্ধ, তার পরও হু-হু করে বাতাস ঢুকছে। যাত্রীদের মধ্যে একজন (টর্চের মালিক) মঞ্জুমামাকে লক্ষ করে বলল, আপনেরা যাইবেন কই?
মঞ্জু বলল, তা দিয়ে আপনার কী? আমাদের যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাবো।
লীলা বলল, আমরা নয়াপাড়া যাব।
কোন নয়াপাড়া? নান্দাইল নয়াপাড়া?
হুঁ।
এইখান থাইক্যা খুব কাছে। উত্তরে হাঁটা দিলে দশ মিনিটের রাস্তা। শিয়ালজানি খাল পার হইলেই…
মঞ্জু বলল, এই যে বৃদ্ধ! চুপ করে থাকেন। বুদ্ধি দিবেন না। আপনার কথা শুনে ঝড়ের মধ্যে হাটা দেই। আর ডাকাতের হাতে পড়ি!
একটা ভালো পরামর্শ দিলাম।
আপনাকে পরামর্শ দিতে হবে না। মরা ব্যাটারিওয়ালা টর্চ নিয়ে যে রওনা হয়। আমি তার পরামর্শ নেই না।
নান্দাইল রোড ইষ্টিশনে নামলে চার মাইল রাস্তা।
চার মাইল কেন, চল্লিশ মাইল হলেও নান্দাইল রোডেই নামব। আপনি চুপ করে বসে থাকেন।
জি আচ্ছা।
আপনার যদি খুব বেশি ইচ্ছা করে আপনি নিজে নেমে হাঁটা দেন।
ঝড় কমে এসেছে। এখন শুধু মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু ট্রেন নড়ছে না। মঞ্জু বলল, ব্যাপারটা কী?
লীলা বলল, মামা টেনশন কোরো না তো! সময় হলেই ট্রেন ছাড়বে।
মঞ্জু গলা নামিয়ে বলল, ড্রাইভার কাজটা ইচ্ছাকৃত করছে কি না কে জানে!
ইচ্ছাকৃত করবে কেন?
এদের যোগসাজস্য থাকে। বেকায়দা জায়গায় ট্রেন থামায়। আগে থেকে বোঝাপড়া থাকে। ডাকাত এসে সব সাফা করে দেয়।
মামা, তুমি জানালাটা খুলে দাও। এসো বৃষ্টি দেখি।
মঞ্জু বলল, বৃষ্টি দেখতে হবে না। যেভাবে বসে আছিস সেইভাবে বসে থাক। তুই রবি ঠাকুর না যে বৃষ্টি দেখতে হবে।
বাতাস আবারো বাড়তে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পরপর দমকা হাওয়া। মঞ্জু হতাশ গলায় বলল— ধুনছে আমারে। ভালো বিপদে পড়লাম দেখি! ভাই, আপনাদের মধ্যে যাদের কাছে ছাতা আছে তাদের কেউ–একজন ড্রাইভারের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে আসেন না, ঘটনা। কী।
আফনে নিজে যান।
আমি যাব। কীভাবে? আমার সাথে মেয়েছেলে আছে দেখেন না? এইটা আপনাদের কীরকম বিবেচনা!
এমন ঝড়বৃষ্টির মধ্যে ড্রাইভারের কাছে কেউ খোঁজ নিতে যাবে বলে লীলা ভাবে নি। একজন সত্যি সত্যি রওনা হলো। সে খবর যা আনল তা ভয়াবহ–লাইনের উপর বিরাট একটা গাছ পড়ে আছে। লাইনের ফিস প্লেট উঠে গেছে। ময়মনসিংহ থেকে রেসকিউ ট্রেন না। আসা পর্যন্ত এই ট্রেন নড়বে না।
কামরার ভেতর গাঢ় অন্ধকার। এক-একবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে— আলো ঝলমল করে উঠছে, সঙ্গে সঙ্গে লীলা দু’হাতে কান চেপে ধরছে। বজ্রপাতের শব্দ তার সহ্য হয় না। প্রচণ্ড ভয় লাগে। লীলার মনে হলো, আল্লাহ ভালো ব্যবস্থা করেছেন— প্রথমে আলোর সংকেত পাঠাচ্ছেন, তারপর পাঠাচ্ছেন বজের শব্দ। উল্টোটা হলে লীলার জন্যে খুব সমস্যা হতো। ঝড়বৃষ্টির সময় সারাক্ষণ দুহাতে কান চেপে ধরে রাখতে হতো।
ভইন, আপনে নয়াপাড়া কার বাড়িতে যাইবেন?
প্রশ্নটা কে করেছে। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না। লীলার ধারণা হলো টর্চওয়ালা বুড়ো। লীলা বলল, সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের বাড়িতে যাব।
উনি আপনের কে হয়?
আমার বাবা। উনাকে চেনেন?
উনারে চিনব না। আপনে কী কন? উনি অঞ্চলের বিশিষ্ট ভদ্ৰলোক। অতি বিশিষ্ট ভদ্রলোক। আপনেরে যেটা বললাম সেটা করেন— ঝড়বৃষ্টি থামলে উত্তরমুখী হাঁটা দেন। পাঁচ মিনিটের রাস্তা।
আচ্ছা আমরা তা-ই করব।
মঞ্জু বিরক্ত হয়ে বলল, হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিবি না লীলা। হুটহাট সিদ্ধান্ত আমার ভালো লাগে না। এই বুড়ো প্ৰথমবার বলেছে দশ মিনিটের রাস্তা, এখন বলছে পাঁচ মিনিট। এই বুড়ো খবরদার, তুমি আর মুখ নাড়বে না।
লীলা উত্তর দিল না। বেঞ্চে পা উঠিয়ে আরাম করে বসল। হুটহাট সিদ্ধান্ত অন্যের ভালো না লাগলেও তার ভালো লাগে। বাবাকে দেখতে আসার এই সিদ্ধান্তও হুট করে নেয়া। সিদ্দিকুর রহমান নামের মানুষটা ভয়ঙ্কর খারাপ— এই কথা জ্ঞান হবার পর থেকেই সে শুনে আসছে। এই মানুষটা তার প্রথম স্ত্রীকে ত্যাগ করেছে। অসহায় সেই মেয়ে মনের দুঃখে মরেই গেল। লোকটা কোনোদিন খোঁজ নিল না। সেই মেয়েটার ফুটফুটে একটা কন্যাসন্তান একা এক বড় হচ্ছে মামার বাড়িতে। তার খোজেও কোনোদিন এলো না। লোকটা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে। দুঃখকষ্টে সেই স্ত্রীরও মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাকে চিকিৎসাও করাচ্ছে না। ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখছে। এমন একজন মানুষকে হঠাৎ দেখতে আসার পেছনে কোনো কারণ নেই। লীলা তাকে দেখে কী বলবো? বাবা বলে বুকে ঝাপিয়ে পড়বে? এমন হাস্যকর কাজ সে কোনোদিনও করবে না। তবে কী করবে তাও জানে না। আবার বিদ্যুৎ চমকাল। লীলা দু’হাতে কান চেপে বসে আছে। বজ্রপাতের প্রতীক্ষা।
সিদ্দিকুর রহমান খাটে হেলান দিয়ে বসে আছেন। তাঁর হাতে পাঁচ-ব্যাটারির একটা টর্চ। টর্চ জ্বালালে আলো বহুদূর পর্যন্ত যায়। মাঝে মাঝে তিনি জানালার ওপাশের জামগাছে আলো ফেলছেন। ঝড় যেভাবে বাড়ছে জামগাছের ডাল ভেঙে টিনের চালে পড়বে। তবে আতঙ্কিত হবার মতো কিছু না। গাছের ডাল জানান দিয়ে ভাঙবে–বেশ কিছু সময় ধরে মড়মড় শব্দ হবে। ঘর ছেড়ে বের হবার সময় পাওয়া যাবে। সিদ্দিকুর রহমান ভয় পাচ্ছেন না। একধরনের উত্তেজনা অনুভব করছেন। তিনি এতক্ষণ পা মেলে বসে ছিলেন, এইবার পা গুটিয়ে বসলেন। চাপা গলায় ডাকলেন, লোকমান!
ডেকেছেন একজনকে, কিন্তু দুই ভাই একসঙ্গে সাড়া দিল। দুজনই চেঁচিয়ে বলল, জি। মনে হয় তারা ডাকের জন্যে অপেক্ষা করছিল। সিদ্দিকুর রহমান শান্ত গলায় বললেন, ঝড়ের গতি কেমন?
এইবার লোকমান জবাব দিল। ভীত গলায় বলল, গতিক ভালো না। টিনের বাড়িতে থাকা নিরাপদ না। চলেন পাকা দালানে যাই। শহরবাড়িতে গিয়া উঠি।
ভয় লাগতেছে?
লোকমান জবাব দিল না। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, ভয়ের কিছু নাই। কপালে মৃত্যু থাকলে মৃত্যু হবে। পাকা দালানে থাকলেও হবে, আবার মাটির ভিতরে পঞ্চাশ হাত গর্ত খুঁড়ে বসে থাকলেও হবে। ঠিক না লোকমান?
জি ঠিক।
গোয়ালঘরের গরুগুলির দড়ি খুলে দাও।
জি আচ্ছা।
সুলেমানকে বলে হুক্কা ঠিক করে দিতে। ঝড়-তুফানের রাতে হুঙ্কা টানতে আরাম।
সিদ্দিকুর রহমান হুক্কার জন্যে অপেক্ষা করছেন। হুক্কা আসতে সময় লাগবে। হুঙ্কায় পানি ভরতে হবে। টিক্কায় আগুন দিতে হবে। অপেক্ষা করতে কোনো অসুবিধা নেই। চুপচাপ অপেক্ষা করার চেয়ে কারো সঙ্গে গল্প করতে করতে অপেক্ষা করা সহজ। তার গল্প করার লোক নেই। তিনি যাদের সঙ্গে সব সময় ঘোরাফেরা করেন। তারা হ্যাঁ-নার বাইরে কোনো কথা বলে না। নিজের ছেলেমেয়েরাই বলে না। রমিলা সুস্থ থাকলে সে হয়তো কিছু গল্পটল্প করত। সিদ্দিকুর রহমান ভুরু কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করলেন, রমিলা যখন সুস্থ ছিল তার সঙ্গে গল্প করেছে কিনা। তেমন কিছু মনে পড়ছে না। হয়তো রমিলাও গল্প করত না।
লোকমান গোয়ালঘরের গরুগুলি ছেড়ে দিয়ে ফিরে এসেছে, চাপা গলায় কেশে সে তার উপস্থিতি জানান দিয়েছে।
লোকমান!
জি।
ভিতরে আসো।
লোকমান ঘরে ঢুকল। সে ভিজে চুপসে গেছে। তার গা বেয়ে পানি পড়ছে। সে অল্প অল্প কঁপিছে। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, বৃষ্টির পানি কি বেশি ঠাণ্ডা?
জি, অত্যধিক ঠাণ্ডা।
এটা খারাপ লক্ষণ, ঝড় আরো বাড়বে। বড় ঝড়ের আগে বৃষ্টির পানি অত্যধিক ঠাণ্ডা হয়।
গোয়ালঘরের গরুগুলি ছেড়ে দিয়েছ?
জি।
গরুগুলি কী করল? ঘরেই আছে, না ছুটে বের হয়ে গেছে?
বাইর হইয়া গেছে।
এটাও খারাপ লক্ষণ। পশুপাখিরা গতিক সবচে ভালো বোঝে। বাড়ের সময় গরুর গলার দড়ি খোলার পরেও সে যদি নড়াচড়া না করে তাহলে বুঝতে হবে ঝড় তেমন জোরালো হবে না। আবার যদি দড়ি খোলামাত্র ছুটে বের হয়ে যায় তাহলে মহাবিপদ।
সুলেমান হুক্কা নিয়ে এসেছে। সিদ্দিকুর রহমান নল হাতে নিয়ে আস্তে টান দিলেন। তামাকটা ভালো। অতি সুঘ্ৰাণ।
লোকমান এখনো দাঁড়িয়ে আছে। সিদ্দিকুর রহমান তাকে চলে যেতে না বলা পর্যন্ত সে যাবে না। তিনি কিছু বললেন না। একমনে তামাক টেনে যেতে লাগলেন। ঘরের টিনের চালে প্ৰচণ্ড শব্দ হচ্ছে। পেরেক উঠে গেছে বলে মনে হচ্ছে। বাতাস বড় একটা ধাক্কা দেবে। আর চাল উড়ে যাবে। খাটে বসে থেকে তিনি মাথার উপর ঝড়ের আকাশ দেখতে পাবেন।
লোকমান!
জি।
বোবাপ্ৰাণী ছাড়াও আরো এক কিসিমের মানুষ আছে যারা ঝড়-তুফানের গতিক বুঝতে পারে। তারা কারা বলো দেখি?
জানি না।
পাগল মানুষ বুঝতে পারে। ঝড়-তুফান ভূমিকম্প এইসবের খবর পাগলের কাছেও আছে। তোমার চাচিআম্মারে যদি জিজ্ঞেস করো সে বলতে পারবে। পাগল হওয়ার কিছু উপকারিতাও আছে, ঠিক না লোকমান?
লোকমান কিছু বলল না। মাটির দিকে তাকিয়ে থাকল। তার বুক এখন ধড়ফড় করা শুরু করেছে। চাচাজি অনেকক্ষণ তাকে সামনে দাড় করিয়ে রেখেছেন। এই কাজটা তিনি যখনই করেন তখন বুঝতে হয়। চাচাজি নাখোশ হয়েছেন। সিদ্দিকুর রহমান হুক্কায় লম্বা টান দিয়ে নল একপাশে রেখে খাটে পা বুলিয়ে বসলেন। তাঁর গলার স্বর হঠাৎ বদলে গেল। ভারী হয়ে গেল। তিনি বললেন–আজকে ঝড়-তুফানের রাত। আমার বড় ছেলে মাসুদ বাড়িতে নাই। সে কোথায় গেছে তুমি জানো?
জানি।
কোথায় গেছে?
কুদ্দুস মিয়ার বাড়িতে।
সেখানে সে কী করে?
মাসুদ ভাইজানের গানবাজনার শখ। ঐখানে গানবাজনা করেন।
তাহলে এই ঘটনা আজ প্রথম না। আগেও সে গিয়েছে। ঐ বাড়িতে রাত কাটিয়েছে।
জি।
তোমরা দুই ভাই এই ঘটনা জানতা, আমারে কিছু বলো নাই।
লোকমান জবাব দিল না। চুপ করে রইল। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, কুদ্দুস মিয়ার কি কোনো সেয়ানা মেয়ে আছে?
জি আছে।
মেয়ের নাম কী?
পরী। পরীবানু।
সিদ্দিকুর রহমান হুক্কার নিলে কয়েকটা টান দিয়ে শান্ত গলায় বললেন, এখন ঘটনা বোঝা গেল। আমার ছেলে গানবাজনার অজুহাতে সেয়ানা মেয়ের গায়ের গন্ধ শুঁকতে যায়। একটা বয়সের পরে সেয়ানা মেয়ের গায়ের গন্ধের জন্যে যুবক ছেলেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এটা জগতের নিয়ম। তবে সব নিয়ম সব জায়গায় চলে না। লোকমান শোনো, তোমারে একটা কাজ দিতেছি— ঝড় কমলে কুদ্দুস মিয়ার বাড়িতে যাবে। তাকে আর তার মেয়ে পরীবানুকে নিয়ে আসবে।
জি আচ্ছা।
আর আমার পুত্ৰকেও ধরে নিয়ে আসবে। গানবাজনা কী শিখছে তার একটা পরীক্ষা হবে।
জি আচ্ছা।
এখন সামনে থেকে যাও।
লোকমান হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। দ্রুত ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল।
সিদ্দিকুর রহমান খাট থেকে নামলেন। আলমিরা খুলে রমিলার ঘরের চাবি বের করলেন। তিনি খানিকটা লজ্জা পাচ্ছেন। গোয়ালঘরের গরগুলির কথা তার মনে হয়েছে। কিন্তু পাগলাস্ত্রীর কথা মনে হয় নাই। যখন গরুর গলার দড়ি খোলা হয়েছে তখন রমিলার ঘরের চাবিও খোলা উচিত ছিল।
রমিলা ঘরের এক কোনায় জড়সড় হয়ে বসেছিল। তালা খুলে সিদ্দিকুর রহমান ঢুকতেই সে উঠে দাঁড়াল। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মাথায় ঘোমটা দিল। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, কেমন আছ গো বউ?
রমিলা নিচু গলায় বলল, ভালো আছি।
বিরাট ঝড়-তুফান শুরু হয়েছে। ভয় পাইছিলা?
হুঁ।
ডাক দিলা না কেন?
রমিলা জবাব দিল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, চলো পাকা ঘরে যাই। টিনের এই ঘরের অবস্থা ভালো না। যে-কোনো সময় চাল উড়ে যাবে।
আমি এইখানেই থাকব।
এইখানে থাকবা?
জি।
কেন?
এই ঘর ছাইড়া কোনোখানে যাইতে আমার ভালো লাগে না।
ভালো লাগালাগির কিছু তো নাই বউ। ঝড়-তুফানের সময় নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হয়।
ঝড়-তুফান শেষ হয়েছে। আর হবে না।
আর হবে না?
না।
সিদ্দিকুর রহমান কান পাতালেন। আসলেই তো তাই, শো শো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। শুধুই বৃষ্টির শব্দ। রমিলা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসছে। পাগল মানুষের হাসি-কান্না কোনো ব্যাপার নয়। পাগলমানুষ কারণ ছাড়াই হাসে। কারণ ছাড়াই কাদে। তবু সিদ্দুিকুর রহমান অভ্যাসবশে জিজ্ঞেস করলেন, হাসো কেন বউ?
রমিলা হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, বাড়িতে কুটুম আসতেছে। আমার মনে আনন্দ, এইজন্যে হাসতাছি।
কুটুমটা কে?
সেটা আপনেরে বলব না।
রমিলা এখনো হাসছে। সিদ্দিকুর রহমান স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন।
খাড়াইয়া আছেন ক্যান?
সিদ্দিকুর রহমান রমিলাকে তালাবন্ধ করে চলে এলেন। রমিলা ঠিক আগের জায়গায় গুটিসুটি মেরে বসে গেল। এখন সে আর হাসছে না।
রাত চারটা বাজে। ফজরের আজানের বেশি দেরি নেই। এখন ঘুমোতে যাবার অর্থ হয় না। সিদ্দিকুর রহমান ঠিক করলেন, অজু করে বারান্দায় বসে ভোরের প্রতীক্ষা করবেন। ফজরের নামাজের পর তুফানে গ্রামের কী ক্ষয়ক্ষতি হলো তা দেখতে বের হবেন। ইতিমধ্যে মাসুদ চলে আসবে। তার বিষয়ে ব্যবস্থা কী নেয়া যায় সেটাও ভাবা দরকার।
সিদ্দিকুর রহমান বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন। তার পাশেই সুলেমান অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তুফান কি কমেছে?
সুলেমান বলল, জি।
মাঝে মাঝে বড় রকমের ঝড়-তুফান হওয়া ভালো। বন্যার সময় কী হয় দ্যাখো— জমিতে পলি পড়ে, ফসল ভালো হয়। ঝড়-তুফানেরও সেরকম উপকার আছে।
সুলেমান কিছু বলল না। যেভাবে বসে ছিল সেইভাবেই বসে রইল। সিদ্দিকুর রহমান ভেবেছিলেন সুলেমান বলবে, ঝড়-তুফানের কী উপকার আছে? তখন তিনি উপকার ব্যাখ্যা করবেন। সুলেমান কিছু জানতে চাইল না বলে তাঁরও বলা হলো না। অবিশ্যি ঝড়-তুফানের কী উপকার তিনি জানেন না। ভেবে বের করতে হতো। জটিল জিনিস নিয়ে চিন্তা করতে তার ভালো লাগে। নানান কাজ-কর্মে তিনি ব্যস্ত থাকেন। চিন্তার সময় পাওয়া যায় না। দিনের কিছুটা সময় যদি আলাদা করে রাখা যেত তাহলে ভালো হতো। এই সময় তিনি চিন্তা করবেন। আর কিছু করবেন না।
সুলেমান!
জি?
চা চানাও, চা খাব।
জি আচ্ছা।
একটা পাতলা চাদর এনে আমার গায়ে দিয়ে দাও, শীত–শীত লাগছে।
জি আচ্ছা।
চা বানিয়ে আনার পর যদি দেখ আমি ঘুমিয়ে পড়েছি, তাহলে আমাকে ডাকবে না।
জি আচ্ছা।
লোকমােন কি মাসুদকে আনতে গেছে?
জি।
পাখি কিচিরমিচির করতেছে, শুনতেছ?
জি।
তুফান শেষ হয়েছে এইজন্যে এরা আনন্দ করতেছে। এ তার গায়ে ঠোকর মারতেছে। পশুপাখিরা মারামারি কামড়াকামড়ি করে আনন্দ প্রকাশ করে। পশুপাখির জগতের নিয়মকানুন বড়ই অদ্ভুত। সুলেমান শোনো, আমার গায়ে চাদর দেয়ার দরকার নাই। শীত-শীত ভাবটা ভালো লাগতেছে।
জি আচ্ছা।
সুলেমান চা বানিয়ে এনে দেখে, সিদ্দিকুর রহমান ঘুমোচ্ছেন। ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে। সে চায়ের কাপ পাশে রেখে আগের ভঙ্গিতেই বসেই পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফজরের আজান পড়ল। সুলেমান ভেবে পেল না। সে এখন কী করবে। চাচাজিকে ডেকে তুলবে? তিনি বলেছিলেন তার ঘুম যেন ভাঙানো না হয়। সুলেমান খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল।
সিদ্দিকুর রহমানের ঘুম ভাঙল ফজরের আজানের কিছুক্ষণ পর। তিনি চোখ মেলে দেখলেন অসম্ভব রূপবতী অপরিচিত একটি তরুণী তার দিকে তাকিয়ে আছে। তরুণীর মুখ হাসিহাসি। চোখে বিস্ময়। তাকে চোখ মেলতে দেখেই তরুণী তার দিকে ঝুঁকে এসে বলল— বাবা, আমি লীলা। লীলাবতী। আপনার কি শরীর খারাপ?
সিদ্দিকুর রহমান জবাব দিলেন না। মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। লীলাবতী অসঙ্কোচে তার বুকের উপর হাত রাখল। সিদ্দিকুর রহমানের দুই চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করল। কতদিন পর নিজের মেয়েকে দেখছেন। কী সুন্দর মেয়ে! তাকে অবিকল দেখাচ্ছে কিশোরী আয়নার মতো। আবার সে আয়নাও না, অন্য কেউ। মেয়েকে কিছু বলা দরকার। কোনো কথা মনে আসছে না। আহারে! মেয়েটা খবর দিয়ে কেন এলো না! খবর দিয়ে এলে তিনি সুসং দুর্গাপুর থেকে ভাড়া করে হাতি আনতেন। স্টেশন থেকে মেয়ে আসত হাতিতে চড়ে। সঙ্গে থাকত বাদ্যবাজনা। আহারে! মেয়েটা কেন আগে খবর দিল না?
আচ্ছা এটা কি সম্ভব যে পুরো ব্যাপারটাই স্বপ্নে ঘটছে? কেউ তাঁর কাছে আসে নি। তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুমের মধ্যেই ইচ্ছাপূরণ জাতীয় একটি স্বপ্ন দেখছেন। আগেও এরকম হয়েছে। দুপুরবেলা ঘুমুচ্ছিলেন— স্বপ্নে দেখলেন, আয়না এসেছে। সে বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, জ্বর কি বেশি? তিনি বললেন, হু, কপালে হাত দিয়ে দেখো। আয়না বলল, কপালে হাত দিতে পারব না। আমি হলুদ বেটেছি, হাতে হলুদ। তারপরেও আয়না। কপালে হাত দিল। তিনি নাকে কাঁচা হলুদের গন্ধ পেলেন। তার ঘুম ভেঙে গেল। কপালে হলুদের গন্ধ কিন্তু চলে গেল না। সেই গন্ধ সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকল।
লীলা কি সত্যি এসেছে? সত্যি কি মেয়েটা তার বুকে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে? সে তার মায়ের মতো কপালে হাত রাখল না কেন?
সিদ্দিকুর রহমান বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন, তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তাদের ঘিরে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনে কোনো রকম মানসিক দুর্বলতা প্রকাশ করা ঠিক না। তিনি অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে সহজ, গলায় বললেন, পরিশ্রম করে এসেছি। ভিতরের বাড়িতে যাও, হাত-মুখ ধোও।