এর আগেও যখন কায়রো এয়ারপোর্টে কয়েক ঘণ্টা থেকে আবার বিদায় নিয়েছে, তখন তরুণ ভাবতে পারেনি পরের বার এমন পরিবর্তন দেখবে। এই কায়রো এয়ারপোর্ট! এত বড়, এত চমৎকার!
এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনটা কায়রো এয়ারপোর্টের দীর্ঘ রানওয়ে পার হতে হতেই তরুণ জানলা দিয়ে অবাক বিস্ময়ে শুধু এয়ারপোর্ট টার্মিনাল বিল্ডিংটাই দেখছিল। বিস্ময় যত বেড়েছে টার্মিনাল বিল্ডিং তত কাছে এসেছে। সুন্দর স্যান্ডস্টোনের অপূর্ব আধুনিক বিল্ডিং। লম্বায় প্রায় এসপ্লানেড-ধর্মতলার মোড় থেকে পার্ক স্ট্রিট হবে। স্ফিংকস-পিরামিডের দেশ যে এমন করে সারা দুনিয়াকে চমকে দেবে, কেউ ভাবতে পারেনি।
ইতিহাসের কাছে ভালো-মন্দ বলে কিছু নেই। মানুষের আসা-যাওয়ার কাহিনি চিরন্তন। নিত্য ঘূর্ণায়মান পৃথিবীতে কিছুই নিত্য নয়। কায়রো রওনা হবার আগে তরুণ তিন-চার সপ্তাহ হিস্টোরিক্যাল ডিভিশনে কাজ করেছে। শুধু মিশর বা নাসেরের নয়, সারা মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। স্তম্ভিত হয়ে গেছে ইতিহাসের দ্রুত পট-পরিবর্তনে। ভূমধ্য সাগরের চারপাশে পৃথিবীর অতীত ইতিহাসের চার আনা ঘটনা ঘটেছে। ধর্ম-সভ্যতা-সংস্কৃতি ছাড়াও কত রাজা-উজীরের আবির্ভাব ও বিদায়, কত শত শক্তিশালী শক্তির উত্থান-পতনের নীরব সাক্ষী এই শান্ত স্নিগ্ধ, সুন্দর ভূমধ্য সাগর। সব কিছুর পরিবর্তন হয়েছে, হয়নি শুধু মানুষের আর প্রকৃতির। আমাদের দেশে পচা ভাদ্দরের পর আশ্বিনের হাসি আর শিউলির খেলা দেখান প্রকৃতি, তেমনি লীলা আছে ভূমধ্য সাগরের চারপাশে। মৃত্যুর মতো স্তব্ধ বালুকাময় অনন্তবিস্তৃত মরুপ্রান্তরের শেষ সীমায় ভূমধ্য সাগরের কোল ঘেঁষে পাওয়া যাবে মিষ্টি মাতাল হাওয়া, গাছে গাছে আছে ফল-ফুলের নিত্য সম্ভার। কেমন, মানুষগুলো? পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরীরা তো ভূমধ্য সাগর বা নীল নদের জলে খেলা করেছেন যুগে যুগে।
মরুভূমির দেশগুলো যেন কেমন হয়! মরুপ্রান্তরে কোনো প্রাসাদই যেন চিরকালের জন্য নয়। শুধু পিরামিড আর প্রাণহীন মমিগুলোই যেন উত্তরকালের জন্য একমাত্র উপহার!
দিল্লিতে ব্রিফিং-এর সময় জয়েন্ট সেক্রেটারি মিঃ রঙ্গস্বামী বলেছিলেন, অতীত জানবে কিন্তু অতীত দিয়ে বর্তমানকে বিচার করো না সব সময়। আলিবাবার চিচিং ফাঁক আর পাবে না মিডল ইস্টে। ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি রেখে ঠিকমতো বর্তমানকে জানাই ডিপ্লোম্যাটদের প্রধান কর্তব্য।
রঙ্গস্বামী আরো বলেছিলেন দেখ তরুণ, আমাদের মতো ডিপ্লোম্যাটদের সব ভালো, কেউ খারাপ নয়। ইন্ডিয়া তো বিগ পাওয়ার নয় যে নিজেদের ভালো-মন্দ অপরের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেবে! আলখাল্লা পরা আরবদের ভালোবাসবে, প্রাণ দিয়ে ভালোবাসবে, শ্রদ্ধা কোরো ওদের অতীত ইতিহাসকে।
হিস্টোরিক্যাল ডিভিশনের একজন ডেপুটি ডাইরেক্টর বলেছিলেন, সুয়েজ খাল শুধু পশ্চিমের সঙ্গে পুবের যোগসূত্র নয়। কায়রো হচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম পীঠস্থান।
সত্যি তাই! ওই বিরাট বিরাট পিরামিডগুলো যেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির আর ঠান্ডা লড়াইয়ের সিংহদ্বার। নীল নদ পাড়ের ওই বিরাট সিংহমূর্তি যেন পাশ্চাত্য আধিপত্যের বিরুদ্ধে সতর্ক সংকেত। কিং ফারুকের ওই বিরাট দেহটা যেন অচলায়তনের জীবন্ত প্রতিমূর্তি ছিল। তিন কোটি মানুষকে পশুর মতো অবজ্ঞা করে মদির ছিলেন ক্লিওপেট্রার স্বপ্নে। নীল নদের জল যে গড়িয়ে গড়িয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে প্রাসাদের তলায় এসে পৌঁছেছিল, তা টের পাননি এই মূর্খ সম্রাট!
ইতিহাস বরদাস্ত করল না। যেমন বরদাস্ত করেনি নেপোলিয়ন বা মুসোলিনী বা হিটলারকে। মরুপ্রান্তরে ঝড় উঠল, অতীতের বেদুইনদের মতো বালির তলায় হারিয়ে গেলেন সম্রাট ফারুক।
তরুণ মুগ্ধ হয়ে দেখেছে ইতিহাসের এই নিঃশব্দ শোভাযাত্রা। যে তিন কোটি মানুষ একদিন অভুক্ত থেকেও পিঠে পাথর টেনে প্রাসাদের পর প্রাসাদ গড়েছে, তিলে তিলে মৃত্যুকে কাছে টেনে নিয়েছে, সভ্য পাশ্চাত্যের কাছে যারা উপহাসের পাত্র ছিল, আজ তারাই বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসের অন্যতম নায়ক। নীল নদের দেশের সুন্দরীদের নিয়ে যে পাচাত্যের মানুষ ছিনিমিনি খেলেছে যুগ যুগ ধরে, আজ তারাই মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের নায়িকা। ভাবলেও, দেখলেও ভালো লাগে। কায়রোয় গিয়ে বেলি ডান্স দেখাই যেন একমাত্র কাজ ছিল এই আহুত অতিথিদের। আজ কায়রোর রাস্তায় সেই পশ্চিমীরাই নায়েব-গোমস্তার মতো আরবদের মোসাহেবী করছে। দেশটাই শুধু স্বাধীন হয়নি অতীতের অত্যাচার অবিচার থেকে, মানুষগুলোও স্বাধীন হয়েছে। সভ্যতার আদিমতম সুপ্রভাত থেকে ইতিহাসের পাতায় পাতায় মিশরের উল্লেখ, কিন্তু মিশরের আরবরা এই প্রথম আত্মমর্যাদার স্বাদ পেল।
ইন্ডিয়ান এম্বাসীর কনসুলার অফিসের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যাটাচি জোসেফ রসিকতা করে বলে, ভারতবর্ষ স্বাধীন কিন্তু ভারতবাসীরা পরাধীন!
মজা করে বললেও কথাটা সত্যি। জোসেফ আবার বলে, লালকেল্লায় তেরঙ্গা চড়াবার পরই তো আমাদের দেশের মানুষ সাহেব-সুবাদের পুজো করতে শুরু করল।
আর কায়রোয়? আলখাল্লা পরা আরবদের দেখলে সাহেবের দল রাস্তা ছেড়ে দাঁড়াবে। কলকাতায় রবীন্দ্র জয়ন্তীতেও অনেক দেশের ভাইস-কন্সালকে সভাপতিত্ব করতে দেখা যাবে, আর কায়রোয় অমন অনুষ্ঠানের ইনভিটেশন পেলে অ্যাম্বাসেডরের দল আনন্দে নাচতে থাকেন।
কায়রোকে কোনোদিন ভুলবে না তরুণ। কাজ করার এমন আনন্দ খুব বেশি দেশে পাওয়া যায় না। লন্ডন-ওয়াশিংটন-প্যারিস-রোম বা টোকিওর ইন্ডিয়ান মিশনে প্রথম পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গেই অভারতীয় মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যাবে। কথায় কথায় নিজের দেশের মানুষকে অবজ্ঞা দেখানো একদল ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটের প্রায় ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পেনসেলভিনিয়া অ্যাভিনিউর ইন্ডিয়ান চান্সেরীতে সারা সপ্তাহে একজন আমেরিকানের আগমন হবে না, কিন্তু যে দু-চারজন ভারতীয় আসেন তাদের সঙ্গেও কথা বলার ফুরসৎ হয় না ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটদের। কায়রোর ইন্ডিয়ান মিশনে কালো আদমীদেরই পূজা করা হয়।
জোসেফ বলত, অল গ্লোরি টু নাসের!
ওই আড্ডাখানায় কে হঠাৎ বলে উঠত, কেন?
জোসেফ নাটকীয় ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠত, মাই ডিয়ার বেবিজ! তোমরা জান না, আমি বিয়াল্লিশ বছর বয়সে আমাদের মিনিস্ট্রির ক্যান্টিন কমিটির সেক্রেটারি পর্যন্ত হতে পারিনি, আর আমাদের ডিয়ার ডার্লিং নাসের চৌত্রিশ বছর বয়সে পৃথিবী নাচিয়ে দিল!
ডিয়ার ডার্লিং নাসেরই বটে। শুধু মিশরে নয়, সারা আরব দুনিয়ার যৌবনের প্রতিমূর্তি নাসের। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি নারী-পুরুষের হৃদয়ে তার আসন। পৃথিবীর অন্যতম ঘৃণিত মানুষদের সে যে সারা দুনিয়ার সামনে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। তাই তো আরব দেশে কালা ভারতীয়দেরও মর্যাদা।
কায়রোর কুটনৈতিক জগতে ইন্ডিয়ান মিশন সত্যি এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে। বড় বড় দেশে ইন্ডিয়ান মিশনকে থোড়াই কেয়ার করে! প্যাঁচে না পড়লে ইন্ডিয়ার সঙ্গে শলা-পরামর্শ করার প্রশ্নই ওঠে না। কায়রোয় তা নয়। সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে নাসের ভারতের সঙ্গে পরামর্শ করবেনই। আন্তর্জাতিক পরিবারের মধ্যে ভারত-মিশর পরমাত্মীয়।
কায়রোকে তরুণ ভুলতে পারে না আরো অনেক কারণে।
ইন্ডিয়ান এম্বাসির একদল ডিপ্লোম্যাট ও তাদের স্ত্রীরা সেদিন দল বেঁধে কায়রো টাওয়ার রিভলবিং রেস্তোরাঁয় ডিনার খেতে গিয়েছিলেন। মিঃ অ্যান্ড মিসেস পুরি, মিঃ অ্যান্ড মিসেস সিং, মিঃ অ্যান্ড মিসেস মিশ্র, দিল্লির নর্দান টাইমসের স্পেশ্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ ও তার স্ত্রী সুনীতা এবং আরো তিন-চারজন মিলে মহানন্দে ডিনার খাওয়া হলো। স্টিমড মিট আর জোসেফের কমেন্টারী–দুই-ই একসঙ্গে উপভোগ করলেন সবাই।
ডিনার খাওয়ার পর ইজিপসিয়ান ব্ল্যাক কফি খাবার সময় মিঃ পুরি কফির পেয়ালা তুলে। প্রপোজ করলেন, আগামী জয়েন্ট ডিনারের আগে তরুণের বিয়ে করতেই হবে, নয়তো…
জোসেফ ফোড়ন কাটল, নয়তো ইন্ডিয়ান ফরেন পলিসি বরবাদ হবেই।
রেস্তোরাঁ থেকে বেরুবার পথে মিঃ কলহান হঠাৎ একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন, হাউ আর ইউ হাসান?
ফাইন, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, হাসান উঠে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে দেয়।
সৌজন্যমূলক দুটো একটা কথা বলার পর মিঃ কলহান জিজ্ঞাসা করলেন, হাসান, হ্যাভ ইউ মেট আওয়ার নিউ কলিগ সেনগুপ্ত?
কই না তো। বাঙালির সঙ্গে দেখা করার লোভে হাসান টেবিল ছেড়ে একটু এগিয়ে এসে বলল, উনি আছেন নাকি আপনাদের দলে?
মিঃ কলহান আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, দুই বাঙালি এক হয়েছে, এবার তো তোমরা সারা দুনিয়া ভুলে যাবে। সো ক্যারি অন মাই বয়েস! গুড নাইট!
ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে বাঙালি যেমন দুর্লভ, পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে বাঙালির প্রাচুর্য ঠিক তত বেশি। এর কারণ অবশ্য পাকিস্তানের সামরিক একনায়কদের বাঙালি-প্রীতি নয়; বরং ঠিক তার উল্টোটাই সত্য। বাঙালি সিনিয়র অফিসারদের দেশে গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রাখা করাচি রাওয়ালপিন্ডির পাঠান বীরেরা খুব নিরাপদ মনে করেন না। সেজন্য পাকিস্তানের কৃষি, মৎস্য, পরিবার পরিকল্পনা বা রেডিওতে কিছু ছোট বড় বাঙালি অফিসার পাওয়া যাবে। সাব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্টও বাঙালি হতে পারে কিন্তু তারপর খবরদার! জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা এস-পি বা হোম মিনিস্ট্রির গোয়েন্দা বিভাগে বা দেশরক্ষা দপ্তরে? নো অ্যাডমিশন ফর ইস্ট পাকিস্তানিজ! তাই তো পাকিস্তানের ফরেন সার্ভিসে কিছু বাঙালিকে ভর্তি করে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছে এবং করাচি রাওয়ালপিন্ডি স্ট্যাটিসটিক্স প্রচার করে বাঙালি-প্রীতির ঢাক বাজাচ্ছে।
যাই হোক, পাকিস্তান মিশনে বাঙালি দেখা যায়। চাকরির খাতিরে যাই করুন না কেন, পশ্চিমবঙ্গের কোনো বাঙালিকে কাছে পেলে এঁরা সারা দুনিয়া ভুলে যান। রাজনীতির চাইতে পদ্মার ইলিশ মাছের বিষয় আলোচনা করাই পাকিস্তানের বাঙালি ডিপ্লোম্যাটরা বেশি পছন্দ করেন। ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে যে সব বাঙালি আছেন, তারাও এঁদের পেলে আর কাউকে চান না। তরুণও চায় না। এই তো রেঙ্গুনে আব্বাসউদ্দীন সাহেবের বাড়িতে কি আনন্দই করেছে।
সেও এক দুর্ঘটনা? রেঙ্গুন চিড়িয়াখানায় সেদিন লোকে লোকারণ্য। স্নেক-কিসিং-শঙ্খচুড় কোবরা সাপকে সাপুড়ে চুমু খাওয়ার খেলা দেখাবে বলে ভীষণ ভিড়। আমেরিকান টুরিস্টরা তো ভয়ের চোটে কাছেই এগুলো না। একদল বর্মী ছেলেমেয়ের সঙ্গে কিছু ভারতীয়, কিছু চীনা লোকই সামনের দিকে ভিড় করেছিল। সাপকে চুমু খাওয়ার খেলা দেখতে দেখতে আব্বাসউদ্দীন মুগ্ধ হয়ে নিজের অজ্ঞাতসারেই বাংলায় বলে উঠল, বাপরে বাপ!
ব্যস! ওই বাংলা শুনেই তরুণ আলাপ করেছিল আশ্বাসের সঙ্গে। আলাপের শেষে থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ বলেই তরুণকে ছেড়ে দেয়নি সে। হিড়হিড় করে টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে গিয়ে চিৎকার করে আম্মাজানকে জানিয়েছিল বাঙালি ধরে এনেছে।
ওই প্রথম দিনের পর আম্মাজানের স্নেহের আকর্ষণে তরুণ নিজেই যেত। ছুটির দিনে তরুণকে রান্না করে খেতে হয়নি কোনোদিন! আম্মাজানের হুকুম ছিল, ছুটির দিনেও যদি আমার এখানে খেতে না পার তবে আর আসতে হবে না। আমাকে আম্মাজান বলেও ডাকবে না, বুঝলে!
তরুণ মুখে কিছু উত্তর দেয়নি, মুখ নিচু করে মুচকি হেসেছিল।
বেশ কেটেছে রেঙ্গুনের দিনগুলো। কখনও কিচেনের দোরগোড়ায় চেয়ার টেনে নিয়ে আম্মাজানের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করেছে, কখনও আবার আব্বাসের লুঙ্গি পরেই সোফায় শুয়ে শুয়ে টেপ রেকর্ডারে ভাটিয়ালী গান শুনেছে।
হাসান পরিবারের সঙ্গেও তরুণের হৃদ্যতা হতে সময় লাগল না।…
দেশের কথা বলো না ভাই, শুনলে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়, প্রায় ছল ছল চোখে তরুণ হাসানকে বলতো।
মন খারাপ হবে না? ঢাকা-উয়াড়ীর অলিতে-গলিতে যে ওর জীবনের সব চাইতে স্মরণীয় স্মৃতি মিশে আছে। পোগোজ স্কুলে পড়া, পুরনো পল্টন, রমনা বা বুড়ীগঙ্গার পাড়ে বিকেলবেলা ঘুরে বেড়ান, খেলাধুলো করা, আড্ডা দেওয়ার কথা মনে পড়লে আর কিছু ভালো লাগে না। লন্ডন, মস্কো, ওয়াশিংটনও ভালো লাগে না। নাইল হিলটনের ডিনার খাবার চাইতে মণি কাকিমার হাতের নারকেলের গঙ্গাজলি বা ঢাকাই পরটা অনেক অনেক বেশি ভালো লাগত।
হাসানের স্ত্রী রাবেয়া, কারমান্নেসা স্কুলের ছাত্রী। কারমান্নেসা স্কুলের কথা মনে হলেই যে মনে পড়ে যায় আরেক জনের কথা। মুহূর্তের মধ্যে মনটা যেন পদ্মা-মেঘনা-ধলেশ্বরী- বুড়ীগঙ্গার মতো মাতলামি শুরু করে দেয়।…
উয়াড়ীর রামকৃষ্ণ মিশন রোডের প্রায় মোড়ের মাথাতেই ছিল তরুণদের বাড়ি। বুড়োরা বলতেন, বরদা উঁকিলের বাড়ি। অল্পবয়সীর দল বলতেন, কানাই উঁকিলের বাড়ি। তরুণের দাদু বরদাচরণ সেনগুপ্ত সেকালের মস্ত নামজাদা উকিল ছিলেন। ফৌজদারি মামলায় ঢাকা-ময়মনসিংয়ে বরদা সেনগুপ্তের জুড়ী ছিল না কেউ। বড় বড় মামলায় চট্টগ্রাম-সিলেট থেকেও ডাক পড়ত।
বরদাচরণের সাধ ছিল তিন ছেলেকেই ওকালতি পড়ান। তা হয়নি। বড় দুই ছেলে কোর্ট-কাছারির ধার দিয়েও গেলেন না। বড় ছেলে পোস্টাফিসে ও মেজ ছেলে রেল কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। বরদা উঁকিলের সাধ পূর্ণ করলেন ছোট ছেলে কানাইবাবু। বাপের মতো পসার বা নাম ডাকা না হলেও উয়াড়ীর মধ্যে ইনিও বেশ গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন।
বাবা কানাইবাবুর মতো তরুণও পড়ত পোগোজ স্কুলে, খেলত রমনার মাঠে। বাকি সময় কাটাত টিকাটুলির গুহবাড়িতে। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবনের সন্ধিক্ষণের মিষ্টি মধুর সোনালী দিনগুলিতে গুহবাড়িই ছিল তার প্রধান আকর্ষণ। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আছে বলেই মানুষ পৃথিবীতে আছে, নয়তো কোথায় সে চলে যেত! প্রত্যেক মানুষের জীবনেও এমনি একটা অদৃশ্য শক্তি কাজ করে-যে শক্তি তাকে প্রেরণা দেয়, শক্তি জোগায়। যার জীবনে এই অদৃশ্য শক্তির প্রেরণা নেই, সে মহাশূন্যে বিচরণ করে।
টিকাটুলির গুহবাড়ির ইন্দ্রাণীকে ঘিরেই তরুণের জীবনের সব স্বপ্ন দানা বেঁধে উঠেছিল। সে কাহিনি কেউ জানত, কেউ জানত না। কিন্তু ওরা দুজনে জানত, বিধাতাপুরুষ ওদের বিচ্ছিন্ন করবেন না, করতে পারেন না। বুড়ীগঙ্গার জল শুকিয়ে যেতে পারে কিন্তু তরুণের জীবন থেকে। ইন্দ্রাণী বিদায় নিতে পারে না বলেই সেদিন মনে হতো।
মনে তো কত কিছুই হয়। ভেবেছিল কি অমন সর্বনাশা দাঙ্গায় সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে? কোর্টে অতবড় মামলায় জেতার পর তরুণের মার জন্য অমৃতি কিনে বাড়ি ফিরছিলেন কানাইবাবু! সে অমৃতি আর খাওয়া হলো না তরুণের মার। একটা ছোরার আঘাতে সব আনন্দ চিরকালের মতো শেষ হলো তার।
সারা ঢাকা শহরটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। কত সংসারে যে আগুন লাগল, তার ইয়ত্তা নেই! কত নিরপরাধ মানুষের রক্তে যে বুড়ীগঙ্গার জল লাল হলো, সে হিসাবও কেউ রাখল না।
বাবার মৃতদেহ কোনোমতে দাহ করে বাড়ি ফিরে এসে ওই লাইব্রেরি ঘরে পাথরের মতো বসে রইল তরুণ। যখন হুশ হলো তখন সারা টিকাটুলি প্রায় শ্মশান হয়ে গেছে। পাগলের মতো চিৎকার করে সারা টিকাটুলি ঘুরেও ইন্দ্রাণীর হদিস পেল না তরুণ।…
টিকাটুলির শ্মশানের আগুন আজো তার মনের মধ্যে অহরহ জ্বলছে। মাকে হারাবার পর নিঃসঙ্গতা যত বেড়েছে ইন্দ্রাণীর কথা তত বেশি মনে পড়েছে।
হাসানের স্ত্রী রাবেয়ার কথায় তাই তো তরুণ হারিয়ে ফেলে নিজেকে। হাজার হোক ডিপ্লোম্যাট। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, দিদি ওসব কথা আর বলো না। তার চাইতে মাংসের গরম গরম পকোড়া খাওয়াও।
পকোড়ার পর কফি খেতে খেতে হাসান বলে, রাবেয়া, অন্নদাশঙ্করের কবিতা পড়েছ? রাবেয়ার উত্তর পাবার আগেই হাসান আবার বলে–
ভুল হয়ে গেছে
বিককুল
আর সব কিছু
ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয় নি কো নজরুল
অ্যান্ড হাসান অ্যান্ড তরুণ…
তরুণের মুখেও হাসি ফুটে উঠল। বলল, উঁহু! হলো না।
হাসান জিজ্ঞাসা করল, হলো না আবার কি?
হবে-নজরুল অ্যান্ড রাবেয়া অ্যান্ড…
রাবেয়া মুচকি হাসতে হাসতে হাসানকে বলল, হেরে গেলে তো আমার ডিপ্লোম্যাট দাদার কাছে।
হাসান আর হারতে পারে না। তুমি যদি অকে ডিপ্লোম্যাট কও, আমি হালা কমু।
কি আনন্দেই কেটেছে কায়রোর দিনগুলো। রাজনৈতিক-কূটনৈতিক ক্ষেত্রে অহর্নিশি ইন্ডিয়ান পাকিস্তান এম্বাসির লড়াই চলত। ভারতবর্ষে মুসলমান নির্যাতনের অলীক কাহিনি প্রচার করে পাকিস্তান এম্বাসী আরবদের মন জয় করার চেষ্টা করত। আর অতীতের পশ্চিমী আধিপত্য ও শোষণের বিরুদ্ধে আরবদের জয়যাত্রাকে প্রতি পদক্ষেপে স্বাগত জানাত ইন্ডিয়ান এম্বাসী। বোম্বে থেকে জাহাজ বোঝাই করে হজযাত্রীরা মক্কা যান। অনেক স্পেশ্যাল প্লেনও যায় বোম্বে থেকে। ওমান উপসাগরের মুখে এমনি হজযাত্রী একটা ভারতীয় জাহাজের নজরে পড়ল দূরের একটা পাকিস্তানী কার্গো জাহাজ। কার্গোর ক্রেটগুলো দেখে সন্দেহ হয়েছিল ভারতীয় জাহাজের কয়েকজন অফিসারের। ক্যাপ্টেন একটা কোড মেসেজ রেডিও মারফত পাঠিয়ে দিলেন বোম্বে। কয়েকদিন পর কাবুল রেডিওর একটা ছোট্ট খবরে সন্দেহটা আরো দৃঢ় হলো। ইতিমধ্যে আম্মান থেকে একটা ডিপ্লোম্যাটিক ডেসপ্যাঁচে জানা গেল কদিন আগে একটা ডিপ্লোম্যাটিক পার্টিতে জর্ডন ফরেন মিনিস্ট্রির একজন সিনিয়র অফিসার ইজরাইল-আরব সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করতে করতে মন্তব্য করেছেন যে বন্ধু মুসলিম রাষ্ট্রও যদি ওদের হেল্প করে তাহলে কি করা যাবে? এইসব বিন্দু বিন্দু খবর যখন এক করা হলো তখন আর সন্দেহ রইল না। এসব খবর কায়রোর ইন্ডিয়ান এম্বাসিতে পৌঁছতে দেরি হয়নি।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরব দেশে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গেল। পাকিস্তান ও পাক এম্বাসী কি ফাপরেই না পড়েছিল।
কায়রোয় ভারত-পাক এম্বাসীর মধ্যে রাজনৈতিক-কূটনৈতিক মেঘ জমে উঠেছে, কখনও গর্জন-কখনও বর্ষণ হয়েছে, তখনও বেসুরো সুরে হাসান আর তরুণ গেয়েছে–
আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি!
চিরদিন তোমার আকাশ,
তোমার বাতাস,
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশী।
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে
ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় হায় রে–
ও মা অঘ্রানে তোর
ভরা ক্ষেতে
আমি কী দেখেছি মধুর হাসি…
রাবেয়া পাশের ঘর থেকে প্রায় তেড়ে এসে বলেছে, এমন গর্দভ রাগিণীতে রবীন্দ্রসঙ্গীত হয় না…চল চল, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। সিনেমায় যাবে না?
আড্ডা দিতে দিতে হাসান আর তরুণের খেয়ালই ছিল না কায়রো প্যালেসের টিকিট কাটা আছে।
তিনজনে দল বেঁধে সিনেমায় গেছে, ওমর খৈয়ামে ডিনার খেয়েছে ও অনেক রাতে তিনজনে বাড়ি ফেরার পথেও অল-তারির স্কোয়ারে বসে গল্প করেছে।
ভোলা যায় কি সেসব স্মৃতি? তরুণ ভুলতে পারে না কায়রোকে। ভুলবে কেমন করে? কারমান্নেসা স্কুলের ছাত্রীকে দেখেই তো মনের মধ্যে অতীত দিনের ঝড় উঠেছিল। ইন্দ্রাণীর স্মৃতির আগুনে ঘৃতাহুতি পড়েছিল এই কায়রোতেই।