০৩. করিম সাহেবের কেবিনের নম্বর

করিম সাহেবের কেবিনের নম্বর হচ্ছে এগার।

সাধারণত মরণাপন্ন রুগীর কেবিনের সামনে একটা জটলা লেগে থাকে। এখানে তা নেই। কেবিনের সামনের জায়গাটি একেবারে ফাঁকা। ভিড় দেখা যাচ্ছে ১৬ নম্বর কেবিনের সামনে। অত্যন্ত চমৎকার সব পোশাক পরা একদল মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে কেউ-কেউ কাঁদছে। যারা কাঁদছে তাদের মধ্যে একজন বিদেশিনীও আছে। স্কার্ট পরা বিদেশিনী, বাঙালি মেয়েদের মতোই শব্দ করে কাঁদছে।

আহসান এগার নম্বরের কেবিনের দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে যে—মেয়েটি মাথা বের করল সে মহল।

আসেন। ভেতরে আসেন। আবা, প্রফেসর সাহেব এসেছেন।

বিছানায় সাদা চাদরে ঢাকা মানুষটি নড়ে উঠল।

কেমন আছেন করিম সাহেব?

ভালো আছি। ভালো আছি। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।

আহসান বড় রকমের একটা ধাক্কা খেল। বিছানায় যে পড়ে আছে সে একজন মৃত ব্যক্তি। কোন একটি অসম্ভব অলৌকিক উপায়ে সে কথা বলছে। এরকম একটি মানুষের কথা বলতে পারার কোনো কারণ নেই।

মহল, প্রফেসর সাহেবকে বসতে দে।

আপনি কথা বলবেন না। চুপ করে থাকুন।

আপনি দেখতে এসেছেন বড় ভালো লাগছে প্রফেসর সাব। আমি এদের বলতেছিলাম প্রফেসর সাব আসবে। না এসে পারে না। মানুষ তো আমি চিনি। ব্যবসা করি, মানুষ চরাইয়া খাই। মানুষ না চিনলে চলে?

প্লিজ কথা বলবেন না।

প্রথম বাড়ি ভাড়া নিতে যখন আসলেন আমি বেগমের মার বললামখাটি লোক একটা। বেগমের মা বলল, বড় বড় মেয়ে ঘরে আমি বললাম, এ ফেরেশতা লোক, তোমার মেয়েগুলোর দিকে কোনদিন চোখ পড়বে না। কি কথা ঠিক হইল।

করিম সাহেব বিজয়ীর মত তাকালেন স্ত্রীর দিকে। বেঁটেখাটো মলিন মুখের মহিলাকে ঘিরে তাঁর মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রমহিলা বসে আছেন। সবচেয়ে ছোটো মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছে। মেঝেতে জায়নামাজ বিছিয়ে বেগমের দূর সম্পর্কের ফুপু খুব নিচু গলায় কোরান শরীফ পড়ছেন।

প্রফেসর সাব।

জ্বি বলুন।

বোধ হয় বাঁচব না। আমার মাকে গত রাতে বিছানার পাশে বসে থাকতে দেখলাম। পরিষ্কার দেখলাম কোন ভুল নাই। মরবার আগে আত্মীয়স্বজনের রুহ। দেখা যায়।

আপনি ভালো হয়ে উঠবেন শুধু-শুধু ভয় পাচ্ছেন। ভয় আমি পাচ্ছি না প্রফেসর সাব। মরণের খামাকা ভয় পাব কেন বলেন? মরণ তো আছেই। ভয় পাইতেছি অন্য জিনিসে। সেইটা আপনারে বলতে চাই।

আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন তারপর বলবেন।

জ্বি না, এখনই বলতে হবে। আমার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। বড় বড় লোকসান দিয়ে শেষ হয়ে গেছি। বাজারে বিরাট দেনা। দশ-বার লাখ টাকা দেন। মরে গেলে মেয়েগুলোর আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে। একটু দেখবেন। খোঁজ রাখবেন। দেখাশোনা করবে সেই রকম আত্মীয় স্বজন আমার কেউ নাই।

করিম সাহেব, ঐসব নিয়ে চিন্তার সময় এখনো হয় নি।

হয়েছে, সময় হয়ে গেছে। কাউরে না বললে শান্তি হবে না। আমার মেয়েগুলো বোকা তার ওপর মূখ। মাথার ওপর কেউ না থাকলে ভেসে যাবে।

আপনি শান্ত হয়ে বিশ্রাম নিন। আমার যতদূর দেখার আমি দেখব।

করিম সাহেব চুপ করে গেলেন। চোখ বন্ধ করে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন। মনে হল তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। আরো খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আহসান উঠে দাঁড়াল। লোকটির ঘুম না ভাঙিয়ে চলে যেতে হবে।

প্রফেসর সাব।

জ্বি!

চলে যাচ্ছেন?

ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়েছেন।

না ঘুমাই নাই। ঘুম হয় না। তার মতো হয়।

করিম সাহেব আবার কাশতে লাগলেন। দম নেবার মতো শক্তি সঞ্চয়ের পর তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা সব একটু বাইরে যাও আমি একটা কথা প্রফেসর সাবকে বলব। দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও না।

খুব অনিচ্ছার সঙ্গে সবাই বেরুল। করিম সাহেব বললেন, প্রফেসর সাব একটু কাছে আসেন একটা কথা বলব। আহসান এগিয়ে গেল।

আমার তিন নম্বর মেয়েটা যে আছে মহল—শুনছি তারে আপনি খুব স্নেহ করেন। দেখা হলে কথাটথা বলেন। মেয়েগুলো বোকা। পেটে কথা রাখতে পারে না। যা হয় সব তাদের মাকে বলে। তার মা বলে আমারে।

আহসান অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। করিম সাহেবের চোখ বন্ধ তবে তিনি কথা বলছেন বেশ পরিষ্কার গলায়।

বুঝলেন প্রফেসর সাব, তাঁর মার কাছ থেকে শুনলাম। একদিন নাকি মহলের কাছে আচার চেয়ে খেয়েছেন। মেয়েটা সব তার মাকে বলেছে। মেয়েটাকে যদি আপনার পছন্দ হয় — আমার মেয়েগুলো বোকা কিন্তু ভালো। মন্দ কিছু আর এদের মধ্যে নাই। আপনারে দিল থেকে কথাগুলো বললাম। দোষ হইলে মাফ কইরা দিবেন। আচ্ছা তাহলে এখন যান।

কথা শেষ হবার আগেই নার্স এবং হাসপাতালের এ্যাটেনডেন্ট ঢুকল। করিম সাহেবকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাবে। অল্প বয়স্ক একজন ডাক্তার নার্ভাস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। আহসান তাঁকে একপাশে নিয়ে নিচু গলায় বলল, অবস্থা কি খুব বেশি খারাপ?

তাই তো মনে হচ্ছে। মাথার আঘাতটা তেমন গুরুতর না, তবে লাংসে জখম আছে। অপারেশনের আগে বলা যাবে না।

সারভাইভালের সম্ভাবনা কেমন? বাঁচামরার ব্যাপারে তো স্ট্যাটিসটিকস চলে না।

আহসান নিদারুণ অস্বস্তি নিয়ে বের হল। অপারেশনের সময় এখানে থাকা উচিত। কিন্তু থাকতে ইচ্ছে করছে না। মেয়েগুলি এমন করে কাঁদছে যে সহ্য করা মুশকিল।

হাসপাতালের গেটে দেখা হল ড্রাইভার জলিল মিয়ার সঙ্গে। তার বগুড়া না কোথায় যেন যাবার কথা ছিল ট্রাক নিয়ে। বোধ হয় যায় নি। বিরস মুখে পান চিবুচ্ছে। আহসানকে দেখে এগিয়ে এল।

প্ৰবেসার সাব, সালাস্লামালিকুম।

ওয়ালাইকুম সালাম।

দেখে আসছেন?

হ্যাঁ।

ভালো করছেন। আপনার কথা খুব বলতেছিল। মরবার সময় মাথায় কিছু ঢুকলে ঐটা নিয়ে শুধু প্যাচাল পাড়ে। আপনার সাথে কথা বলনের শখ ছিল। শখ মিটল। আপনি কি এখন বাড়ি যান?

হুঁ।

আসেন রিকশা করে দিই।

রিকশা করে দিতে হবে না।

চলেন যাই। আপনার সাথে একটা ছোট কথাও আছে প্ৰবেসার সাব।

কি কথা?

মনে রাগ কিন্তুক নিবেন না।

না রাগ নেব না।

কাইল রাইতে কি আপনার ঘরে একটা মেয়েছেলে ছিল? সকালে দেখি গেইট দিয়া বাইর হয়। আমি আটকাইলাম। চোর না কি কে জানে? শেষে বুঝলাম অন্য ব্যাপার।

আহসান সিগারেট ধরাল। জলিল মিয়া বেশ শব্দ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার তার বক্তব্য শুরু করল, করিম সাবের মেয়ে তিনটা খুব মন খারাপ করছে। মেয়ে তিনটার মন খুব নরম। আপনারে খুব মানে। হেই কারণে মনে খুব কষ্ট পাইছে। মহল মেয়েটা তো কানতেছিল।

আহসান কিছুই বলল না। জলিল মিয়া পানের পিক ফেলে বলল, এই সব ছোট কাজ করব আমার মতো মানুষ, আপনে হইলেন–। জলিল মিয়া কথা শেষ করল না। মাঝপথে থেমে গেল। আহসান বলল, মহল খুব কাঁদছিল?

জ্বি। বয়স কম মেয়ে। দুনিয়ার হালচাল তো জানে না। এরা ভাবে এক রকম দুনিয়া চলে অন্য রকম। প্ৰবেসার সাব রিকশা নিয়া তাড়াতাড়ি যান গিয়া। আকাশের অবস্থা খারাপ।

আহসান রিকশা নিল না। হাঁটতে শুরু করল। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। ঘন-ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। জোর বৃষ্টি হবে। হোক। পৃথিবী ভাসিয়ে নিয়ে যাক। ভিজতে ইচ্ছে। করছে। কি যেন সেই গানটা—এসো কর স্নান নবধারা জলে, এসো নীপবনে।

 

জেরিন দরজা খুলল। খুশি-খুশি গলায় বলল, সত্যি তাহলে এলেন? আমার মনে হচ্ছিল—শেষ পর্যন্ত বোধ হয় আসবেন না।

বলে গিয়েছিলাম তো আসব।

তা বলে গিয়েছিলেন। পুরোপুরি বিশ্বাস করি নি। মনে হচ্ছিল পালাতে চাচ্ছেন বলে একটা অজুহাত তৈরি করেছেন।

পালাতে চাইলেও সবসময় পালানো যায় না।

ভালোই বলেছেন। যারা পালাতে চায় না তারাই শুধু পালাতে পারে। যেমন তারিন আপা। আপনার রুগী কেমন?

ভালো না। বাঁচবে বলে মনে হচ্ছে না।

আপনাকে তার জন্যে খুব একটা দুঃখিত মনে হচ্ছে না।

দুঃখিত মনে হওয়ার কারণও নেই। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মরছে।

খাবার দিতে বলি। হাত-মুখ ধোবেন তো?

হ্যাঁ ধোব।

জেরিন এবং আহসান খেতে বসল। অপরিচিত একটা কাজের মেয়ে শুধু খাবারদাবার এগিয়ে দিচ্ছে। এই বাড়িতে কোনো কাজের লোকই বেশি দিন টেকে না। জেরিন লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, বাবা শুয়ে পড়েছেন। বাবার তো সব ঘড়ি ধরা, সাড়েদ দশটা বাজতেই বাতি নিভিয়ে নিদ্রা। মার মাথা ধরেছে। কাজেই খাবার সাজিয়ে একমাত্র আমিই আপনার জন্য জেগে আছি।

থ্যাংকস।

আপনি যা-যা পছন্দ করেন সবই জোগাড় করার চেষ্টা করেছি। নিধুর মা তুমি চলে যাও। তোমাকে আর লাগবে না। খাওয়া শেষ হলে বলব, তখন টেবিল গোছাবে।

নিধুর মা চলে গেল। আহসানের খেতে ভালো লাগছে না। টেবিলে প্রচুর আয়োজন। প্রতিটি পদই চেখে দেখতে হবে ভেবেও বিরক্তি লাগছে।

খেতে কেমন হয়েছে?

ভালো।

আপনি যে তরকারিতে খুব ঝাল খান তা মনে ছিল না। সব তরকারিই বোধ হয় আপনার কাছে মিষ্টি-মিষ্টি লাগছে।

তুমি বেঁধেছ?

কেন আমি কি রাঁধতে জানি না?

রাতদিন পড়াশোনা নিয়ে থাক, তাই বলছি।

দুলাভাই, আপনি কিন্তু কিছু খাচ্ছেন না।

শরীরটা ভালো নেই জেরিন। কিছু মুখে দিতে ইচ্ছে করছে না। তুমি খাও আমি বসে-বসে দেখি।

জেরিন একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। মৃদু স্বরে বলল, বাবাকে আপনি চমৎকার একটা মিথ্যা কথা বললেন। শ্বশুরকে খুশি করে দিলেন।

মিথ্যা নাও তো হতে পারে। কোনো দিন দ্বিতীয় একটি মেয়েকে বিয়ে করব না এমন প্রতিজ্ঞা ছিল না।

আমার মনে হয় আপনি বাবাকে মিথ্যা বলেছেন। আজকের রাতটা আপনার জন্য খুব একটা বিশেষ রাত। এই রাতে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ের প্রসঙ্গ আপনি তুলতেই পারেন না। তুলেছেন কারণ আপনি বাবাকে নিশ্চিত করতে চেয়েছেন।

ঠিকই ধরেছ।

দুলাভাই, আপনার সঙ্গে আমি রূঢ় আচরণ করেছি। আপনি কিছু মনে করবেন না। আমি ভালো করেই জানি ঐ চিঠি আপনার বাবা নিজে থেকেই লিখেছেন। সেখানে আপনার কোনো ভূমিকা নেই।

জানতে যখন তখন এ কথাগুলো বললে কেন?

খুব রাগ হচ্ছিল বলে বলেছিলাম। রাগের সময় আমরা অনেক অন্যায় কথা বলি। বলি না?

তা অবশ্যি বলি।

দুলাভাই আপনি কি আমাকে খুব অপছন্দ করেন?

অপছন্দ করব কেন?

আমার মনে হয় করেন। আপার সঙ্গে আমার কোনো মিল নেই এই কারণেই করেন।

আহসান হেসে ফেলল। জেরিন গম্ভীর গলায় বলল, কেউ আমাকে অপছন্দ করলে আমার খুব খারাপ লাগে। আমার সব সময় ইচ্ছা করে আমাকে সবাই ভালবাসুক।

তোমার একার না। এরকম ইচ্ছে আমাদের সবারই করে।

আমার একটু বেশি করে। আশ্চর্য কাণ্ড কি জানেন, আমার তেইশ বছর বয়স হল এখন কেউ আমাকে ভালবাসার কথা বলে নি।

এখনো তো সময় সামনে আছে-ভবিষ্যতে বলবে।

যদি বলে তাহলে হয়ত তার মুখের ওপর হেসে ফেলব।

হ্যাঁ সেই সম্ভাবনাও আছে।

আহসান উঠে পড়ল। হাত ধুতে-ধুতে বলল, এখন বাসার দিকে রওনা হব। তুমি আমার জন্যে যে মমতা দেখিয়েছ তা আমি অনেক দিন মনে রাখব। সো নাইস অব ইউ।

জেরিন বিস্মিত হয়ে বলল, যাবেন মানে? কোথায় যাবেন?

বাসায় যাব। কাল ক্লাস আছে। পড়া তৈরি করব। মাস্টারদের ছাত্রদের মতো পড়া তৈরি করতে হয়।

আপনাদের পুরনো বাসরঘর এত কষ্ট করে সাজিয়ে রাখলাম আর আপনি চলে যাবেন?

ঐসব ছেলেমানুষির বয়স কি এখন আছে? গল্প-উপন্যাসে এ-সব মানায়। শূন্য বাসরঘরে নায়ক ঢুকবে পুরানো স্মৃতি মনে পড়বে। সবই আছে শুধু সে নেই। বালিশের পাশে বাসি ফুলের মালা। বিছানায় স্মৃতিময় চুলের কাঁটা।

দুলাভাই আপনি কিন্তু যেতে পারবেন না। আপনি চলে গেলে আমার খারাপ লাগবে। খুবই খারাপ লাগবে।

খারাপ লাগবে কেন?

দুপুরে আপনার সঙ্গে জঘন্য ব্যবহার করেছি। এই জন্যেই খারাপ লাগবে।

এ-সব নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না জেরিন।

আমি জানি আপনি মাথা ঘামাচ্ছেন না। কারণ আমাকে আপনি খুবই তুচ্ছ জ্ঞান। করেন। আমি একটা মন্দ কথা বললেও আপনার কিছু যায়-আসে না।

এক জিনিস নিয়ে তর্ক করতে ভালো লাগছে না। ঠিক আছে তুমি খুবই তুচ্ছ। দয়া করে এক কাপ চা দাও। খেয়ে চলে যাব। ঝড়-বৃষ্টি হবে।

জেরিন গম্ভীর মুখে চা বানিয়ে আনল। এবং খুবই হালকা গলায় বলল, আপনি আপনার বাড়িওয়ালার যে মেয়েটিকে বিয়ে করবেন বলে ঠিক করেছিলেন তার নাম কি মহল?

আহসান চমকে উঠে বলল, ওদের নাম জান তুমি?

হ্যাঁ জানি।

কী করে জান?

আপনার খোঁজে একবার গিয়েছিলাম। তখন আলাপ হয়েছে।

কই আমি তো কিছু জানি না। ওরা তো আমাকে কিছু বলে নি। অবশ্যি এমনিতেও ওদের সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয় না। মেয়েগুলো খুব লাজুক।

লাজুক কিনা জানি না তবে মাথায় ছিট আছে। একদিন নিউ মার্কেটে ওদের সঙ্গে দেখা। তিন বোন একসঙ্গে ওজনের যন্ত্রে দাঁড়িয়ে ওজন নিচ্ছে। তিন জন একসঙ্গে ওজন নেবার পেছনে যুক্তিটা কি বলুন তো?

আহসান শব্দ করে হেসে উঠল। জেরিন বলল, আপনি কি জানেন এই মেয়ে তিনটি আপনাকে খুব পছন্দ করে। বিশেষ করে মহল মেয়েটি।

কি করে বুঝলে?

ওর বড় দু বোন আমার সামনেই এসব নিয়ে মহলকে ক্ষেপাতে লাগল। শেষে সেই মেয়ে কেঁদে-টেদে অস্থির। আচ্ছা দুলাভাই, আপার সঙ্গে কি মহল মেয়েটির কোনো মিল আছে?

না কোনোই মিল নেই।

তাহলে ঐ মেয়েটিকে এত পছন্দ করেন আর আমাকে এত অপছন্দ করেন কেন? আমার সঙ্গে তো আপার খুব মিল আছে। ভালো করে দেখুন আমি কি দেখতে অবিকল আপার মতো না?

না।

আপার মত হলে বোধ হয় এখানে থেকে যেতে রাজি হতেন।

বোধ হয়। উঠি জেরিন। তুমি কি আমাকে একটা ছাতা এনে দিতে পার?

মনে হয় পারি।

জেরিন ছাতা এনে দিল। অস্বাভাবিক কোমল স্বরে বলল, দুপুরের ঘটনার জন্যে আমি খুবই লজ্জিত। কিছু মনে করবেন না।

আমি কিছুই মনে করি নি।

যাবার আগে শুধু একটা কথা বলে যান-আপার কোন জিনিসটা আপনার কাছে খারাপ লাগত। আগেও প্রশ্ন করেছিলাম, জবাব দেন নি।

তোমার আপার সঙ্গে মাত্র তের মাস একসঙ্গে কাটিয়েছি। প্রচণ্ড একটা সুখের মধ্যে সময় কেটে গেছে। খারাপ কিছু চোখে পড়বে কীভাবে?

আপা খুব ভাগ্যবতী।

বিয়ের তের মাসের মাথায় মরে গেল এই জন্যে?

হ্যাঁ। আমিও ঠিক করে রেখেছি বিয়ের তিন মাসের মাথায় বিষ খেয়ে মরে যাব।

একবার তো শুনেছিলাম সারা জীবন বিয়ে করবে না। মত পাল্টেছ?

না। কথার কথা বলছি। ঠাট্টা করছি।

জেরিন গেট পর্যন্ত এল। ক্লান্ত গলায় বলল, অনেকক্ষণ বক-বক করেছি, কিছু মনে করবেন না। দুপুর বেলার ঘটনার জন্য আমি লজ্জিত।

কি মুশকিল, এককথা কবার বলবে?

ঠিক আছে আর বলব না।

জেরিন একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল, কেন ফেলল আহসান বুঝতে পারল না। খুব জটিল ব্যাপার আমরা অনেক সময় চট করে বুঝে ফেলি, আবার খুব সহজ জিনিস বুঝতে পারি না।

 

রিকশাওয়ালা রোগা।

কিন্তু রিকশা চালাচ্ছে ঝড়ের বেগে। বৃষ্টি নামবার আগেই বাড়ি ফেরার ইচ্ছে। কিংবা রিকশা জমা দেবার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। আহসান বলল, রিকশা কোন জায়গার?

মিরপুর।

থাক কোথায়? মিরপুর?

হুঁ। মিরপুর এক নম্বর।

ছেলে-মেয়ে আছে?

হুঁ।

কজন?

রিকশাওয়ালা জবাব দিল না। আহসান লক্ষ করেছে কোনো রিকশাওয়ালাই ব্যক্তিগত প্রশ্নের জবাব দিতে আগ্রহ বোধ করে না বরং বিরক্ত হয়। এই রিকশাওয়ালাটি যেমন হচ্ছে।

রিকশায় উঠে লম্বা আলাপ জুড়ে দেবার স্বভাবও আহসানের নয়। এই বদ অভ্যাসটি রিনের। অচেনা, অজানা যে-কোনো মানুষের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেবে। একদিন আহসান বলেই বসল, কি বিশ্রী স্বভাব। অচেনা একজন মানুষের সঙ্গে কি আলাপ শুরু করলে? এটা খুবই বদ অভ্যাস। তারিন হাসতে হাসতে বলেছে, বদ অভ্যাসটা ছিল বলেই তোমার সঙ্গে পরিচয় হল। নয়ত তোমার সঙ্গে পরিচয় হত না। কি ঠিক বলছি না।

তাই বলে রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে আলাপ জুড়বে?

আলাপ কোথায়? দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করি।

জিজ্ঞেস করে তো ঝামেলার সৃষ্টি কর।

না-হয় হলই খানিকটা ঝামেলা।

খানিকটা না, মাঝে-মাঝে বেশ বড় রকমের ঝামেলা হয়। একজন বলে বসল। তার মেয়ের বিয়ে। সবকিছু যোগাড় হয়েছে শুধু জামাইয়ের জন্যে পাঞ্জাবি যোগাড় হয়। নি। এখন যদি পাঞ্জাবির দামটা দেন। সবটা দিতে হবে না। তিরিশ টাকা তার কাছে। আছে। তারিন বলল, আর কত টাকা হলে পাঞ্জাবি হয়?

পঞ্চাশ টেকা আম্মা। পঞ্চাশ হইলেই হয়।

আহসান এই সময়ে ইংরেজিতে বলল, একটা কথাও বিশ্বাস করবে না। ডাহা মিথ্যা কথা বলছে।

সত্যিও তো হতে পারে। বেনিফিট অব ডাউট বলে একটা কথা আছে।

ওটা হচ্ছে আদালতের কথা। এটা আদালত না।

আদালত না হলেও আমার মনে হয় লোকটা সত্যি বলেছে।

আমি এক হাজার টাকা বাজি রাখতে পারি লেকটা মিথ্যা কথা বলেছে।

তারিন কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলেছে, এক কাজ করলে কেমন হয়? চল রিকশাওয়ালাকে বলি আমাদের তার বাড়িতে নিয়ে যেতে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যাক সত্যি-সত্যি তার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে কিনা।

তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি?

পাগলের কি আছে। একটা এ্যাডভেঞ্চার।

অসম্ভব। তারচেয়ে তুমি ওকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দাও। ঝামেলা চুকে যাক।

না না চল ওর বাসায় যাই।

ইংরেজি কথাবার্তা বন্ধ করে তারিন এবার পরিষ্কার বাংলায় বলল, এই রিকশা চল তোমার বাড়ি যাব। দেখব তোমার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে কি-না।

রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে রিকশা থামাল। নিচু গলায় বলল, সত্যি যাইবেন।

হ্যাঁ, কোথায় তোমার বাসা?

সোবানবাগ।

চল সোবহানবাগে।

সত্যি যাইবেন?

হ্যাঁ, যাব।

আহসান বলল, ফর গডস শেক এখন আমরা একটা কাজে যাচ্ছি তারিন।

তেমন কোনো জরুরি কাজ না। ঘন্টা খানেক পরে গেলেও ক্ষতি হবে না। এই রিকশা চল।

রিকশাওয়ালা গামছা দিয়ে গায়ের ঘাম মুছতে লাগল। আহসান বলল, এই দেখ সে যেতে চাচ্ছে না। তার মানে পুরো ব্যাপারটাই বানানো। ও বিয়েই করে নিওর মেয়ে আসবে কোত্থেকে।

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার বিয়ে সত্যি-সত্যি হচ্ছিল। তের-চৌদ্দ বছরের একটা মেয়ে সেজেগুজে বসে আছে। কাগজের চেইন দিয়ে ঘর সাজান। দুটি কলাগাছ পুঁতে গেট।

শুধু পাঞ্জাবির টাকা নয়, মেয়েটির জন্যে একটি শাড়ি। মাইক ভাড়া করবার জন্যে দুশ টাকা দিয়ে তারিন ঘোষণা করল বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত সে এখানে থাকবে। আহসান রাগী গলায় বলল, তার কোন দরকার আছে?

আছে। এই লোকটিকে আমি অন্যায়ভাবে সন্দেহ করেছি। আমার খুব খারাপ লাগছে। তাছাড়া বেচারা তার মেয়ের বিয়ের দিনও রিকশা চালাচ্ছে, আমার মনটা ভেঙে গেছে। আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে। তুমি বুঝতে পারবে না। ছোটখাট জিনিস আমাকে খুব কষ্ট দেয়।

সত্যি-সত্যি তুমি থাকবে?

হ্যাঁ থাকব? তুমি এক কাজ কর না কেন? তুমি চলে যাও।

আহসান যেতে পারে নি। সে থেকে গেল এবং অবাক হয়ে লক্ষ করল মেয়ে বিদায়ের সময় যখন চারদিকে কান্নাকাটির মাতম উঠল তখন তারিন আড়ালে সরে গেল কারণ তার চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়ছে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে যেন কেউ দেখে না ফেলে।

অনেকদিন পর ঐ রিকশাওয়ালাটির সঙ্গে আহসানের দেখা হয়েছিল। আহসান চিনতে পারে নি। লোকটির চেহারা বদলে গেছে। দাড়ি রেখেছে। শরীর হয়েছে আরো দুর্বল। রিকশা এখন প্রায় টানতেই পারে না। সে ক্লান্ত গলায় বলল, স্যার, ভালো আছেন? আমারে চিনছেন?

না।

আমার মাইয়ার বিয়া দিলেন আপনারা।

ও আচ্ছা। তোমার মেয়ে ভালো আছে?

জ্বি না। মাইয়াটা মারা গেছে।

আহসান চুপ করে গেল। রিকশাওয়ালা বলল, আম্মা কেমন আছেন?

আমার স্ত্রীর কথা বলছ? সেও মারা গেছে। বাচ্চা হতে গিয়ে মারা গেছে। বেশিদিন হয় নি। মাস ছয় হল।

রিকশাওয়ালা রাস্তার পাশে রিকশা থামায়। তারপর সমস্ত পথচারীদের সচকিত করে হাট-মাউ করে কাঁদতে শুরু করল। এই তীব্র আবেগের ভগ্নাংশ হয়ত তারিনের জন্যে বাকি সবটা তার কন্যার শোক।

তারিনের মৃত্যুর পর একবারও আহসান কাঁদে নি। চোখ ভিজে ওঠে নি কখনো। মানুষ বড় আশ্চর্য প্রাণী। তারিনের কথা আজ কাল মনেও পড়ে না। চোখ বন্ধ করে চেহারা মনে করতে চাইলেও লাভ হয় না। চেহারা মনে পড়ে না। ফর্সা, রোগা, লম্বা একটি মেয়ে যে বেশিরভাগ সময়ই চুল ছাড়া রাখে এবং সেই চুলে দু চোখের খানিকটা ঢাকা পড়ে থাকে তার সত্যিকার চেহারাটা কেমন? ছবির সঙ্গেও তার চেহারাটা ঠিক মিলানো যায় না। সবসময় মনে হয় তারিন অন্যরকম ছিল। ছবিতে চেহারা আসে নি।

হাসপাতালে যাবার আগে হঠাৎ একদিন বলল, কেন জানি মনে হচ্ছে হাসপাতাল থেকে আর ফিরে আসব না। ইট ইজ এ ওয়ান ওয়ে জার্নি।

আহসান হাসতে হাসতে বলেছে, প্রতিটি গেনেন্ট মেয়ে যখন হাসপাতালে যায় তখন তার এই কথা মনে হয়। সে ঠিকই ফিরে আসে।

ধর যদি না আসি তখন কী হবে?

কি হবে বলতে কী মিন করছ?

তোমার খুব নিঃসঙ্গ লাগবে না?

লাগারই তো কথা।

বিয়ে তো করবেই। করবে না।

এখন কী করে বলি? সময় আসুক।

বিপত্নীক মানুষ খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করে। ওরা নিঃসঙ্গ বোধ করে সেই জন্যেই করে। এতে ওদের কোনো দোষ নেই।

আমি বিয়ে করলে তোমার আপত্তি হবে না।

তারিন সহজ স্বরে বলল, না আপত্তি হবে কেন? তবে একটা কথা বলি মন দিয়ে শোন। তোমার ভালোর জন্যেই বলছি। কিছুদিন অপেক্ষা করবে।

কীসের জন্যে অপেক্ষা?

মনে কর চট করে তুমি বিয়ে করে ফেললে। নতুন একটি মেয়ে এল অথচ তখনো আমার কথা তোমার পুরোপুরি মনে আছে। তুমি সারাক্ষণ আমার সঙ্গে মেয়েটির তুলনা করবে। নিজে কষ্ট পাবে মেয়েটিকেও কষ্ট দেবে। কাজেই তোমার উচিত হবে। বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করা।

আহসান হাসতে হাসতে বলল, কতদিন?

তুমি চোখ বন্ধ করে আমার মুখ কল্পনা করার চেষ্টা করবে। যেদিন দেখবে আর কল্পনা করতে পারছ না সেদিন তোমার মুক্তি।

তারিনের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর আহসান তার মুখ কল্পনা করতে চেষ্টা করল। পারল না। অসহ্য কষ্টে সারা রাত জেগে রইল। মানুষ বড় বিচিত্র প্রাণী। তারিন শুধু নিজেই চলে যায় নি সবকিছু সঙ্গে নিয়ে গেছে। এমন করল কেন সে?

তারিন মারা গিয়েছিল রক্তক্ষরণজনিত কারণে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান রক্তপাত বন্ধের জন্যে কিছুই করতে পারল না। তিন দিনে সাত বার রক্ত দেওয়া হল। অষ্টমবারের বার তারিন বলল, আর না। বাদ দিন। আমার ছেলেকে আমার পাশে শুইয়ে দিন। আর ছেলের বাবাকে একটু আসতে বলুন।

আহসান পাশে এসে বসল। তারিন মৃদু গলায় বলল, কি হচ্ছে বুঝতে পারছ?

কিছু হচ্ছে না। তুমি সুস্থ হয়ে বাসায় যাবে।

যেতে পারলে মন্দ হত না। তুমি এখন আর আমার সামনে থেকে নড়বে না। হাত ধরে বসে থাক। লজ্জা লাগছে না তো আবার?

না লজ্জা লাগছে না।

তারিন ফিসফিস করে বলল, Since there is no help come let us kiss and say good bye.

কি-সব আজেবাজে কথা বলছ?

ঠাট্টা করছি। মরতে বসেছি বলে কি ঠাট্টাও করতে পারব না? তোমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছি।

তারিন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের মতো খিল-খিল করে হেসে উঠল। সতেজ প্রাণময় হাসি। সে মারা গেল তার মাত্র চার ঘন্টা পর। মৃত্যুর সময় তার জ্ঞান ছিল না। থাকলে হয়ত তখনো মজার কিছু বলার চেষ্টা করত। বেঁচে থাকাটা তার জন্যে খুব সুখের ব্যাপার ছিল বলেই বোধ হয় সে বেঁচে থাকতে পারল না।

রিকশা আদাবর পর্যন্ত ঠিক করা কিন্তু আহসান শ্যামলীতে নেমে পড়ল। সাত টাকা ভাড়া ঠিক করা ছিল সে দিল দশ টাকা। কোমল স্বরে বলল, ভাঙতি ফেরত দিতে হবে না। রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। আহসান বলল, বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে।

জ্বি স্যার।

তোমার রিকশার জমার টাইম হয়ে গেছে বোধ হয়।

জ্বি স্যার।

যাও তাহলে আর দেরি করবে না। দেরি করলে ঝড় বৃষ্টির মধ্যে পড়ে যাবে।

রিকশাওয়ালা থেমে থেমে বলল, আপনে আমার ছেলেপুলে কয়জন জিগাইছিলেন–আমার দুই পুলা।

ভালো, খুব ভালো।

বড় পুলারে ইস্কুলে দিছি।

খুব ভালো করেছ।

তাইলে স্যার যাই। স্লামালিকুম।

ওয়ালাইকুম সালাম।

রিকশাওয়ালা চলে যেতেই আহসানের ইচ্ছে করল রেবা বা পারুল নামের ঐ মেয়েটিকে খুঁজে বের করতে। যে মেয়েটি দেখতে তারিনের মতো। তাকে কিছু টাকা-পয়সা দিতে ইচ্ছে করছে। আজকের রাতে সে যেন নিজের ঘরে গিয়ে আরাম করে ঘুমুতে পারে। আজ যেন কেউ তাকে বিরক্ত না করে। হয়ত এই মেয়েটির ঘরে পঙ্গু স্বামী আছে, শিশুপুত্র আছে। আজ রাতটি সে তার স্বামীর পাশে শুয়ে থাকুক। একটি হাত রাখুক স্বামীর গায়ে।

আহসান এগিয়ে গেল সিগারেটের দোকানের দিকে। এরা গভীর রাত পর্যন্ত ছোট দোকান সাজিয়ে বসে থাকে। নিশিকন্যাদের খবর এরাই সবচেয়ে ভালো জানবে।

একটা রোগামতো ফর্সা মেয়ে। বাজে টাইপের মেয়ে এদিকেই থাকে। তুমি দেখেছ তাকে? রেবা কিংবা পারুল নাম।

দোকানদার রাগী চোখে তাকিয়ে রইল। আহসান বলল, তুমি তাকে দেখ নি কোনো দিন।

দেখছি। দেখমু না কেন? আল্লায় চউখ দিছে দেখনের লাগিন।

আজ দেখেছ?

না। তয় বাস স্ট্যান্ডের কাছে গিয়ে দেখেন। রাইত বেশি হইলে ঐখানে দাঁড়াইয়া কাস্টমার খুঁজে।

রেবা বা পারুল নামের মেয়েটিকে পাওয়া গেল। পুরোপুরি নির্জন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আজ তার হাতে চটের একটা ব্যাগ। আহসানকে দেখে সে একটুও চমকাল না বা অবাক হল না। বিস্মিত হবার ক্ষমতা সম্ভবত এ-জাতীয় মেয়েদের নষ্ট হয়ে যায়। পৃথিবীর কোনো কিছুই তাদেরকে আর অভিভূত করতে পারে না।

কেমন আছ পারুল।

মেয়েটি জবাব দিল না। চোখ বড়-বড় করে তাকাল।

অন্য স্যাডেলটি খুঁজে পেয়েছিলে?

না।

এস আমার সঙ্গে। আমি দেখেছি কোথায় আছে।

পারুল নিঃশব্দে এগিয়ে এল।

তোমার হাতে ব্যাগ কেন? ব্যাগে কি আছে?

সদাই।

ঐ দিন কিছু না বলে চলে গেলে আমি তোমাকে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলাম।

খামাখা টেকা দিবেন কেন?

খামাখা নয়। কারণ আছে।

আহসান আশা করছিল মেয়েটি বলবেকি কারণ? কিন্তু সে বলল না। নিঃশব্দে পেছনে-পেছনে আসতে লাগল।

ঐ যে দেখ তোমার স্যান্ডেল।

মেয়েটি গভীর মমতায় স্যান্ডেলটি তুলল। আহসান অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, তুমি কি এখানে ফুলের গন্ধ পাচ্ছ? এই জায়গাটার একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। মাঝে-মাঝে ফুলের গন্ধ পাওয়া যায় অথচ আশেপাশে কোনো ফুলের গাছ নেই।

ফুলের গন্ধ না। আগরবাতির গন্ধ।

আগরবাতির গন্ধ?

হুঁ পীর সাবের একটা মাজার আছে দোকানের পিছনে। এরা আগরবাত্তি জ্বালায়।

ও আচ্ছা। হ্যাঁ তাই। এখন মনে হচ্ছে আগরবাতিরই গন্ধ। এই জিনিসটি নিয়ে। আমি অনেকদিন ভেবেছি বুঝলে? কারণটা বের করতে পারি নি।

মেয়েটি হাসছে। সরল সহজ হাসি। পৃথিবীর কোনো মালিন্য সেই হাসিকে স্পর্শ করে নি।

পারুল।

জ্বি।

এস আমার সঙ্গে।

মেয়েটি ছোট-ছোট পা ফেলতে লাগল। আহসান বলল, তোমার যখন টাকা-পয়সার দরকার হবে আসবে আমার কাছে, কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে না। আমার স্ত্রীর চেহারার সঙ্গে তোমার খুব মিল আছে এই জন্যেই একথা বলছি।

কতদিন আপনে আর আমারে টেকা দিবেন? আমার দুইটা মাইয়া আছে। না খাইয়া সারা দিন বইসা থাকে। দুনিয়াডা খুব খারাপ জায়গা ভাইজান।

হ্যাঁ খুবই খারাপ। দি উইন্টার অব ডিসকনটেন্ট।

পারুল দাঁড়িয়ে পড়ল। শান্তস্বরে বলল, আপনের কাছ থাইক্যা টেকা নিতাম না।

কেন?

ঝড় বৃষ্টি আইতাছে ঘরে যামু।

হেঁটে হেঁটে যাবে?

জ্বি।

চল তোমাকে খানিকটা এগিয়ে দিই।

না। আপনে ঘরে যান।

মেয়েটি ঘুরে দাঁড়াল। পরক্ষণেই দ্রুত পা ফেলতে লাগল।

বাতাস বইতে শুরু করেছে। শিগগিরই বৃষ্টি নামবে। মেয়েটি কি পারবে বৃষ্টির আগে আগে ফিরে যেতে হয়ত পারবে হয়ত পারবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *