০৩. কণার নামটি বোজন

০৩. কণার নামটি বোজন

পদার্থবিজ্ঞানের আলো-আঁধারি জগৎ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জন্ম প্রক্রিয়া শুরু হয় 1900 সালে যখন ম্যাক্স প্লাংক আলো বিকীরণ সংক্রান্ত একটা বিষয় ব্যাখ্যা করার জন্যে আলোকে বিচ্ছিন্ন কণা হিসেবে অনুমান করে নিলেন। এর আগে পর্যন্ত সবাই নিশ্চিতভাবে জানত আলো হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন তরঙ্গ–কাজেই ম্যাক্স প্লাংকের এই ঘোষণা পদার্থবিজ্ঞানের জগতে খুব বড় একটা আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। কিছুদিনের ভিতরেই বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ফটো ইলেকট্রিক এফেক্ট ব্যাখ্যা করার জন্যে আলোর কণা তত্ত্ব ব্যবহার করে নোবেল পুরস্কার পেলেন। (তার আরও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ছিল থিওরি অব রিলেটিভিটি কিন্তু সেটা এমনই বিচিত্র একটা বিষয় ছিল যে নোবেল কমিটির জন্যে সেটা হজম করা কঠিন ব্যাপার ছিল!) অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও নানা ধরনের পরীক্ষায় আলোর কণা তত্ত্ব স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলেন এবং পৃথিবীতে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো নূতন করে লিখতে বাধ্য হলেন। ম্যাক্স প্লাংক জগদ্বিখ্যাত একজন পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিলেন!

পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আলোকে কণা হিসেবে দেখা গেছে সত্যি কিন্তু পৃথিবীর বড় বড় বিজ্ঞানীদের সবার মনের ভেতরে একটা বিষয় খচখচ করছিল কারণ ম্যাক্স প্লাংক যেভাবে তার বিকীরণ সূত্রটি বের করেছিলেন সেখানে তার ব্যবহার করা যুক্তিতে একটা বড় গরমিল ছিল । পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের সাথে মিলে যায় বলে কেউ সেটা ফেলেও দিতে পারেন না কিন্তু যুক্তির গরমিলটা মেনেও নিতে পারেন না–সবার ভেতরেই এক ধরনের অস্বস্তি। ঠিক এই সময়ে একজন তরুণ বিজ্ঞানী পুরো তত্ত্বটিকে সঠিক যুক্তির উপর দাঁড় করিয়ে সকল বিভ্রান্তি দূর করে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে নিলেন–এই তরুণ বিজ্ঞানী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক একজন বাঙালি–তার নাম সত্যেন্দ্রনাথ বসু। স্নেহভরে আমরা শর্টকাট করে বলি সত্যেন বোস ।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু বা সত্যেন বোস কত বড় বিজ্ঞানী সেটা অনুমান করাও কঠিন তবে তার একটা ধারণা দেয়ার জন্যে বলা যায় এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল কিছু তৈরি হয়েছে যে সকল কণা দিয়ে সেই কণাগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। দুই ভাগের এক ভাগের নাম ফারমিওন–ইতালীয় বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির নামে এই নামকরণ। অন্য ভাগের নাম আমাদের সত্যেন বোসের নামানুসারে রাখা হয়েছে বোজন (Boson)। ফারমিওন এবং বোজনের বিশেষ ধর্ম রয়েছে–খুব সহজ ভাষায় বলা যায় ফারমিওন কণাগুলো যেন একটু ঝগড়াটে ধরনের, একই ধরনের কণা হলে এক জায়গায় থাকতে পারে না ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়। সেই তুলনায় বোজন হচ্ছে খুব সামাজিক টাইপের কণা, একই ধরনের বোজন এক জায়গায় থাকতে কোনো সমস্যা হয় না–তারা সেটা পছন্দই করে। আমাদের পরিচিত কণা দিয়ে উদাহরণ দিতে হলে বলতে হয় আলো আর ইলেকট্রনের কথা। আলো হচ্ছে বোজন আর ইলেকট্রন হচ্ছে। ফারমিওন। ফারমিওনের জন্যে এক ধরনের পরিসংখ্যানের সূত্র গড়ে উঠেছে, সেটা ফারমি ডিরাক স্ট্যাটিস্টিক্স নামে পরিচিত। বোজনের পরিসংখ্যানের সূত্রকে বলা হয় বোস আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স। কেউ যদি এই দুটো তত্ত্বের সাথে জড়িত বিজ্ঞানীদের নামগুলোর দিকে লক্ষ্য করে তাহলে আবিষ্কার করবে সত্যেন বোস ছাড়া অন্য সবাই তাদের কাজের জন্যে

নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন! আমাদের সত্যেন বোস যদি এত বড় বিজ্ঞানী না হতেন তাহলে কেন তাকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হলো না সেটা চিন্তা করে আমাদের ক্ষুব্ধ হবার কারণ হতো। এখন ব্যাপারটা হয়ে গেছে উল্টো–আমরা সবাই জানি তাকে নোবেল পুরস্কার দিতে পারলে নোবেল কমিটিই ধন্য হতে পারত!

সত্যেন বোস কেমন করে তার জগদ্বিখ্যাত বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স বের করলেন সেটা নিয়ে নানা রকম গল্প আছে। বলা হয়ে থাকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের ম্যাক্স প্লাংকের বিকীরণের সূত্রটি পড়ানোর সময় সেখানে যৌক্তিক গরমিলটি দেখানোর চেষ্টা করছিলেন। তিনি তার মতো করে যেভাবে বিষয়টা ব্যাখ্যা করছিলেন তার কারণে হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন সেই গরমিলটি আর নেই–পুরো বিষয়টি একটা যৌক্তিক কাঠামোর মাঝে দাঁড়িয়ে গেছে। তিনি তখন টের পেলেন পদার্থবিজ্ঞানের অনেক বড় একটি সমস্যার সমাধান করে ফেলেছেন।

সময়টা ছিল 1924 সালের প্রথম দিকে। তখন সত্যেন বোসের বয়স মাত্র ত্রিশ। খুব উৎসাহ নিয়ে সত্যেন বোস তার যুগান্তকারী আবিষ্কারটি লিখে সেই সময়কার গুরুত্বপূর্ণ জার্নাল “ফিলোসফিকেল ম্যাগাজিন”-এ পাঠিয়ে দিলেন। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু ফিলোসফিকেল ম্যাগাজিন তার প্রবন্ধটি ছাপানোর অনুপযুক্ত বিবেচনা করে তার কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিল! এর পরে সত্যেন বোস যে কাজটি করলেন সেটা আরও অবিশ্বাস্য–তিনি তার প্রবন্ধটি পাঠালেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কাছে, সাথে একটা চিঠি। সেই চিঠিতে তার অনুরোধটি ছিল অকল্পনীয়। তিনি আইনস্টাইনকে লিখলেন এই প্রবন্ধটি পড়ে তার যদি মনে হয় এটা প্রকাশ করার উপযোগী তাহলে তিনি যেন জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে সেটাকে সাইটশিফট ফুয়ার ফিজিক (Zeitschrift Fur Physik) জার্নালে ছাপানোর ব্যবস্থা করে দেন! যে কোনো হিসেবেই এটা এক ধরনের দুঃসাহস কিন্তু সত্যেন বোস এই দুঃসাহস করতে দ্বিধা করেন নি। তিনি খোলামেলাভাবে লিখলেন, যদিও তিনি আইনস্টাইনের কাছে একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত তবু তিনি এটা লিখছেন কারণ সবাই আইনস্টাইনকে তাদের শিক্ষক মনে করে–এবং সে জন্যে সবাই তার ছাত্র। সত্যেন বোস আইনস্টাইনকে চিঠির শেষে মনে করিয়ে দিলেন, “আমার ঠিক জানা নেই আপনার মনে আছে। কী না–কিছুদিন আগে কোলকাতা থেকে একজন আপনার রিলেটিভিটির উপর প্রবন্ধগুলো ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করার অনুমতি চেয়েছিল। আপনি অনুমতি দিয়েছিলেন এবং সেটা অনুবাদ করে বই হিসেবে বের করা হয়ে গেছে এবং আমি হচ্ছি সেই ব্যক্তি যে জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির উপর সেই প্রবন্ধগুলো অনুবাদ করেছি!”

সত্যেন বোস চিঠিতে লিখেন নি কিন্তু আইনস্টাইনের কাছে প্রবন্ধটি পাঠানোর এবং সেটা অনুবাদ করে জার্নালে ছাপানোর অনুরোধ করার পিছনে আরো একটি কারণ ছিল। তখন সারা পৃথিবীতে সম্ভবত আইনস্টাইনই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন যিনি সত্যেন বোসের আবিষ্কারের গুরুত্বটা বুঝতে পারতেন। হলোও তাই, আইনস্টাইন প্রবন্ধটি পাওয়া মাত্র বসে বসে সেটাকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে সত্যেন বোসের বলে দেয়া জার্নালে পাঠিয়ে দিলেন। নিচে তিনি শুধুমাত্র একটা ফুটনোট জুড়ে দিয়ে সেখানে লিখলেন, বোসের এই কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র এই ফুটনোটের জন্যে বিশ্বখ্যাত এই পরিসংখ্যান সূত্রটিতে আইনস্টাইনের নাম ঢুকে গেছে–এটাকে কেউ বোস স্ট্যাটিস্টিক্স বলে না–সবাই এটাকে বলে বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স! পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে এরকম উদাহরণ খুব বেশি নেই যেখানে একটি প্রবন্ধ অনুবাদ করার জন্যে একটি সূত্র অনুবাদকের নামেও পরিচিত হতে শুরু করেছে। তবে ব্যাপারটি নিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন তুলে নি কারণ এখানে অনুবাদক হচ্ছেন স্বয়ং আইনস্টাইন!

সত্যেন বোসের প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে আইনস্টাইন নিজেই সেটা নিয়ে কাজ শুরু করে দিলেন এবং সেখান থেকে বের হয়ে এলো জগদ্বিখ্যাত বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেশন নামের একটি নূতন ধারণা! এই ধারণার উপর কাজ করার জন্যে 2001 সালে তিনজন পদার্থবিজ্ঞানীকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে! মজার ব্যাপার হচ্ছে সত্যেন বোস নোবেল পুরস্কার পান নি কিন্তু তার কাজের উপর কাজ করে অনেকেই নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেছেন!

সত্যেন বোস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে 1921 সালে রিডার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তখন তার বেতন ছিল মাত্র 400 টাকা (যদিও সে যুগে সেটাকে যথেষ্ট ভালো বেতন হিসেবেই বিবেচনা করা হতো!) দুই বছর অনেক পরিশ্রম করার পর তার বেতন মাত্র একশ টাকা বাড়িয়ে আরো দুই বছরের জন্যে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। সত্যেন বোস ঠিক তখন তার বিখ্যাত বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স নিয়ে কাজ করছেন–তখন তার ইচ্ছে হলো ইউরোপে পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীদের সাথে সময় কাটানোর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছরের জন্যে ছুটির আবেদন করলেন। তার ছুটি মঞ্জুর হলো। তিনি ইউরোপে গেলেন দুই বছরের জন্যে। ইউরোপ থেকে ফিরে এসে 1927 সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর এবং বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দিলেন!

সত্যেন বোস সুদীর্ঘ 24 বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছেন। তার আগ্রহ ছিল বহুমাত্রিক, বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের নানা ধরনের যন্ত্রপাতিও গড়ে তুলেছিলেন। আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন কার্জন হলের বিভিন্ন কোনায় পুরানো যন্ত্রপাতি পড়ে থাকতে দেখেছি, পুরানো মানুষদের জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছি সেগুলো নাকি সত্যেন বোসের হাতে তৈরি নানা এক্সপেরিমেন্টের অংশ।

অসাধারণ প্রতিভাময় এই মানুষটি দেশ বিভাগের ঠিক আগে আগে কলকাতা ফিরে গিয়েছিলেন। তার কর্মময় জীবনের একটা অংশে তিনি শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর উপাচার্যের দায়িত্বও পালন করেছেন। শুধু বিজ্ঞানচর্চা নয় বিজ্ঞানের শিক্ষার জন্যেও তিনি অনেক কাজ করেছেন। 1974 সালে ফেব্রুয়ারির 4 তারিখ এই কর্মময় মানুষের জীবনাবসান হয়।

আমরা যখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ভবনের সাথে সাথে পদার্থবিজ্ঞান ভবনের নাম করেছিলাম সত্যেন বোস ভবন–তখন সেটা যেন আমরা না করতে পারি সে জন্যে সিলেট শহরের সকল ধর্মান্ধ শক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ করে রেখেছিল।

ভাগ্যিস সত্যেন বোস ততদিনে মারা গেছেন–তাকে এই ঘটনাটি নিজের কানে শুনতে হয় নি!

1 Comment
Collapse Comments
দেলোয়ার চাঁদ August 2, 2023 at 4:23 am

জগৎ এর যত অসুন্দর আছে, সব আছে ধর্মান্ধদের মনে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *