০৩. এরকম একটা দিনের কথা

এরকম একটা দিনের কথা অনেককাল ভুলতে পারবে না দীপাবলী। সন্ধের মুখে জিপগুলো যখন চলে গেল শহরের দিকে তখন মাটির রাস্তায় একা সে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এখন জিপের আরোহীদের অবস্থান বদল হয়েছে। সে নেমে যাওয়ার পরে মন্ত্রীমশাইয়ের জিপে শুধু অর্জুন নায়েক ছাড়া আর কেউ নেই। ডি এম, এস ডি ও এবং মন্ত্রীর পি এ অর্জুন নায়েকের জিপে উঠেছিল মন্ত্রীর ইঙ্গিতে। সমস্তটা পথ মন্ত্ৰী অৰ্জুনের সঙ্গে কি কথা আলোচনা করবে তা তিনিই জানেন। আর মন্ত্রীর কাছে এমন গুরুত্ব পাওয়া মানে এস ডি ও-ডি এমের সন্ত্রম আদায় করা একথা বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয় কারো।

দীপাবলীর অফিসে সাতোড়াতাড়ি ছুটে এসেও সতীশবাবু যা করতে পারতেন না অর্জুন তা করে দিল অনায়াসে। প্রত্যেকের জন্যে ভাল খাবার, ঠাণ্ডা পানীয়, মন্ত্রীকে সারা সময় হাওয়া করার জন্যে একজন সেবক থেকে শুরু করে যা কিছু তা দীপাবলীর পক্ষে এখানে ব্যবস্থা করা অসম্ভব ছিল। অফিসের অন্য কর্মচারীরা মন্ত্রী এসেছেন শুনে মাথায় সূর্য নিয়ে ছুটে এসেছিল কিন্তু ঘরে ঢুকতে পারেনি। বাইরের ঘরে ডি এম এবং এস ডি ও বসেছিলেন। মন্ত্রীমশাই দীপাবলীর অফিসঘরে। অর্জুন নায়েক একবার হাতজোড় করে প্রস্তাব দিয়েছিল যে ওখান থেকে তার বাড়ির দূরত্ব খুব বেশি নয়, মন্ত্ৰীমহাশয় যদি অনুগ্রহ করে রাজি হন তাহলে সেখানে বেশ আরামে বিশ্রাম করতে পারবেন। মন্ত্রীমশাই রাজি হননি। বলেছেন, কাজে এসেছি, বিশ্রাম করব কি? এই যে মেয়ে, শোন এদিকে। দীপাবলীকে ডেকেছিলেন তিনি, ওসব দোকানের খাবার ওদের দিতে বল। তোমার জন্য বাসায় ভাত হয়নি?

হয়েছে। দীপাবলী জবাব দিয়েছিল।

তাহলে সেটাই দুজনে ভাগাভাগি করে খাই চল।

দীপাবলী মুখ নিচু করেছিল। আপনি খেতে পারবেন না।

কেন? পারব না কেন? মন্ত্রী অবাক হয়েছিলেন।

খুব সামান্য খাবার। এখানে রোজ সবকিছু পাওয়া যায় না।

হো হো করে হেসেছিলেন ভদ্রলোক, পাঁচ বছর ইংরেজের জেলে কাটিয়েছি হে, সেখানে কি রাজভোগ খেতে দিত? তাছাড়া বাইরে যখন থাকতাম তখন কি রোজ খাওয়া জুটত। পোস্ত আছে বাড়িতে?

দরজার ওপাশে দাঁড়িয়েছিল তিরি। কথা বলতে নিষেধ করা সত্ত্বেও সে বলে উঠেছিল, আজ তো পোস্ত আর ডিমের ঝোল হয়েছে।

বাঃ। চমৎকার! তাই দাও। ভাগে তোমার কম পড়লে আর কি করা যাবে।

মন্ত্রীমশাই ভেতরের ঘরে গিয়ে তার সঙ্গে খেলেন। তরকারি বেশি ছিল কিছু কিন্তু তিরির ভাগ্যে আজ ডিম জোটেনি। মেয়েটাও যেন চুপসে গিয়েছিল। দণ্ডমুণ্ডের কর্তা এসেছেন এবং তিনি যখন অর্জুন নায়েকের নিয়ে আসা খাবার খাননি তখন তাঁকে ভাল ভাবে যত্ন করা অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু সেইসময় দীপাবলী মন্ত্রীমশাইয়ের ব্যবহারে আপ্লুত হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের পূর্ণমন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা হিসেবে যাঁর বেশ নামডাক, তিনি তার সামনে বসে প্রফুল্ল মুখে অতি সাধারণ খাবার খেয়ে বললেন, রামাটি তো জব্বর হে। এতে শ্ৰদ্ধা না বেড়ে যাওয়ার কোন কারণ নেই।

খাওয়দাওয়ার পর দীপাবলীর অফিসঘরে তিনি তিনজনকে নিয়ে বসলেন। তখনও অৰ্জুন নায়েক ওঁর কাছে ঘেঁষতে পারেনি। বাইরের ঘরে পুলিশ এবং পি. এর সঙ্গে বসেছিল। মন্ত্রীমশাই একটি কাগজ কলম টেনে নিয়ে দীপাবলীকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী নাম যেন বললে তখন? ও হো, নেখালি। নেখালির মত আর কটা গ্রাম আছে এদিকে?

দীপাবলী কিছু বলার আগে এস ডি ও বললেন, আমার সাব-ডিভিসনে প্রায় সমস্ত গ্রামের দশা একইরকম স্যার।

একথা আজকের মিটিং-এ বলেননি কেন? মন্ত্রীমশাই কড়া গলায় জানতে চাইলেন।

এস ডি ও মাথা নিচু করলেন। মন্ত্রীমশাই দীপাবলীর দিকে তাকালেন, ঠিক কটা গভীর নলকূপ অথবা কুয়ো খোঁড়া দরকার বলে।

আমি শুধু নেখালি নিয়ে ভেবেছি স্যার। দীপাবলী জবাব দিল।

ভেরি ব্যাড। একই এলাকার অন্য গ্রামগুলোর অবস্থা আলাদা হতে পারে না।

দীপাবলীর মনে পড়ল সতীশবাবু বলেছিলেন অন্তত আটটি গ্রাম একইরকম খরায় পুড়ছে। সে বলল, অন্তত চব্বিশটা দরকার।

মন্ত্রী সেটি লিখলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, কাছাকাছি নদীগুলোয় তো এসময় একফোঁটা জল থাকে না। আপনারা একটা কিছু ভাবুন যাতে এই অঞ্চলে জল স্টোর করা যায়। আপাতত এই চব্বিশটার ব্যবস্থা আমি করছি। সেইসঙ্গে মাসখানেকের জন্যে ওদের চাল যাতে দেওয়া যায়। তার বেশী দেবার সামর্থ্য আমার হাতে নেই। আমি মনে করি না শুধু সরকারি সাহায্যের ওপর নির্ভর করে এতগুলো গ্রামের মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। ওদের রোজগারের ব্যবস্থা হয় এমন কোন প্রকল্প তৈরি করে আমার কাছে পাঠান, আমি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব!

রোদের তেজ কমে গেলে তিনটে জিপ রওনা হয়েছিল নেখালরি দিকে। এবার সঙ্গে ছিলেন সতীশবাবু। তিনি অবশ্য দুপুরেই খবর পাঠিয়েছিলেন গ্রামে। রাস্তা থেকেই দেখা। গেল গ্রামসুদ্ধ লোক ভিড় জমিয়েছে সামনে। ওদের দেখতে পেয়ে ডি এম বলেছিলেন, বিক্ষোভ হতে পারে। পুলিশদের তৈরি থাকতে বলুন।

কিন্তু কেউ একটা শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করল না। জিপগুলো ঢুকে গেল গ্রামের মাঝখানে। জিপ থেকে নামামাত্র দীপাবলী হতভম্ব। মন্ত্রীমশাই জিজ্ঞাসা করলেন, ওখানে কি হচ্ছে?

সতীশবাবু ততক্ষণে ছুটে গিয়েছেন গ্রামের মানুষদের কাছে যারা খানিক দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসে তিনি দীপাবলীকে নিচু গলায় কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু মন্ত্রীমশাই ধমক দিলেন, আঃ, যা বলার জোরে বলুন।

সতীশবাবু দুই হাত জোড় করে বললেন, আজ্ঞে, কুয়ো হচ্ছে। দুটো।

কুয়ো? মন্ত্রীমশাই দীপাবলীর দিকে তাকালেন, কি ব্যাপার?

সতীশবাবু বললেন, আজ্ঞে, ওরা বলল অৰ্জুনবাবু আজ সকালে লোক পাঠিয়েছেন কুয়ো খোঁড়ার জন্যে। এ বাবদ যে টাকা কেটেছিলেন তাও ফেরত দিয়েছেন।

অৰ্জুনবাবুটি কে? মন্ত্রীমশাই জানতে চাইলেন।

দুটো হাত বুকের ওপর জড়ো করে এগিয়ে এল অর্জুন, স্যার, আমার নাম অৰ্জুন।

ও আপনি। দুপুর থেকে দেখা লোকটিকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করলেন মন্ত্রীমশাই, আপনি নিজের পয়সায় এখানে কুয়ো খুঁড়ে দিচ্ছেন?

হাত কচলালে অর্জুন, আজ্ঞে, এরা খুব কষ্টে আছে, জল পায় না, তা উনি আমাকে সেকথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। হাত বাড়িয়ে দীপাবলীকে দেখাল, আমার মনে হল জীবনে তো অনেক রোজগার করব কিন্তু কাউকে যদি জীবন ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করি সেটাই পুণ্য। জলের আর এক নাম তো জীবন।

বাঃ, খুব ভাল! আপনাদের মত ব্যবসায়ীরা যদি নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে এভাবে গরিব মানুষের সেবার জন্যে এগিয়ে আসেন তাহলে সরকারের কাজ সহজ হয়ে যায়।

স্যার, একেবারে নিঃস্বার্থ বলবেন না।

মানে? এদের জল পাইয়ে দিয়ে আপনার কি লাভ হবে?

হবে স্যার, আমার ব্যবসায় বিভিন্ন কাজে আমি ওদের নিয়োগ করি, মাইনে দিই। জলের অভাবে ওদের যদি শরীর দুর্বল হয়ে যায় তাহলে কাজ করতে পারবে না, আমারও ক্ষতি হবে। হাত কচলে যাচ্ছিল অর্জুন।

আপনি ওদের কাজ দেন?

হ্যাঁ স্যার। আমার লোকের প্রয়োজন আর এদের রোজগারের।

গুড। কিন্তু কটা মালিকের এমন মানসিকতা থাকে। তারা গরিবকে শোষণ করে  বড়লোক হয়। যে কাজ করতে পারবে না তাকে বরখাস্ত করে অন্য লোক নেয়। খুব ভাল লাগল আপনার মত একজন উদার যুবককে দেখে। তারপর দীপাবলীর দিকে ঘুরে বললেন, তুমি ঠিক লোককে বলেছ হে। চল, এবার একটু ঘুরে দেখি।

মন্ত্রী এবং দলবল গ্রামের কিছুটা ঘুরে দেখলেন। মানুষের বেঁচে থাকা যেখানে উপহাস ছাড়া কিছু নয় সেখানে বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা খুব মুশকিল। মন্ত্রীমশায়েরও ভাল লাগল না। তবু তিনি একটি প্রৌঢ়কে ডাকলেন। লোকটি কাছে আসতেই চাইছিল না। সতীশবাবু ধমকে কাছে নিয়ে এলেন।

মন্ত্রী তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনটে কুয়ো হয়ে গেলে তোমাদের সুবিধে হবে?

লোকটি মাথা নাড়ল, কুয়ো হবে কিন্তু জল থাকবে না। আর জল থাকলেও পেট ভরবে না। যদি জলে পেট ভরে যায় তো জল খেয়ে মানুষ কদিন বাঁচবে?

লোকটা চেঁচিয়ে কথাগুলো বললো। সুতরাং, দূরে দাঁড়ানো গ্রামের মানুষজন তা শুনতে পেল। তৎক্ষণাৎ বক্তব্যের সমর্থনে গুঞ্জন উঠল।

মন্ত্রীমশাই সবিস্ময়ে লোকটিকে দেখে বললেন, পাগল নাকি হে।

সঙ্গে সঙ্গে লোকটি বলে উঠল, পাগল হলে তো ভাল হত। আপনি দেশের মন্ত্রী, আপনি আমাদের পাগল তো বলবেনই। কুয়ো খোঁড়া হচ্ছে কিন্তু পেটে ভাত নেই।

মন্ত্রীমশাই অৰ্জুন নায়েকের দিকে তাকালেন, এ আপনার ওখানে কাজ করে না?

করত স্যার। কিন্তু এত ফাঁকি মারত আর অন্যদের ক্ষ্যাপাত যে বাধ্য হয়েছি ছাড়িয়ে দিতে। অর্জুনের কথা শেষ হওয়ামাত্ৰ লোকটি ক্ষিপ্ত হয়ে তেড়ে যেতে চাইল দুর্বল শরীরে। সঙ্গে সঙ্গে দুজন পুলিশ তাকে ধরে ফেলে প্রায় চ্যাংদোলা করে সরিয়ে নিয়ে গেল সামনে থেকে। লোকটা সমানে চেঁচিয়ে গালমন্দ করে যাচ্ছিল কিন্তু গ্রামের মানুষরা নির্বাক। রইল। মন্ত্রীমশাই বিড় বিড় করলেন, এসব গ্রামে কম্যুনিস্টরা আসাযাওয়া শুরু করেছে নাকি!

অৰ্জুন বলল, হাঁ স্যার। দু-একজন সন্দেহজনক, শহুরে বাবু আসে।

মন্ত্রীমশাই বললেন, ডি এমের দিকে তাকিয়ে, ব্যাপারটা লক্ষ্য রাখুন। এমন হলে কোন। ভাল কাজ এরা করতে দেবে না। দারোগা কোথায়? তাকে বলুন নজর রাখতে।

ডি এম অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন, স্যার, ডেমোক্রেটিক কান্ট্রিতে কোন দলকে তোত কাজ থেকে কারণ না দেখিয়ে নিরস্ত করা যায় না। এই তো মুশকিল।

হুম। তাহলে এদের বলুন যারা মন্ত্রণা দিতে আসে তাদের দিয়ে কুয়ো খুঁড়িয়ে নিক। তারাই খাবারের ব্যবস্থা করবে। চলুন, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। মন্ত্রীমশাই হন হন করে। জিপের দিকে এগিয়ে গেলেন। ডি এম এবং এস ডি ও তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন। জিপের সামনে দাঁড়িয়ে মন্ত্রীমশাই একটু ভাবলেন। তিনি না উঠলে বাকিরা উঠতে পারছিলেন না। হঠাৎ মন্ত্রীমশাই অৰ্জুন নায়েককে আঙুল তুলে কাছে ডাকলেন, আপনি আমার গাড়িতে। চলুন। এলাকার কিছু ব্যাপার নিয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা আছে। তারপর ডি এমকে বললেন, বাকি দুটো জিপে আপনাদের যেতে নিশ্চয়ই খুব অসুবিধে হবে না?

ডি এম বললেন, ন্যা স্যার, অসুবিধে কিসের!

মন্ত্রীমশাই সামনে বসলেন, অর্জুন পেছনে। এবার দীপাবলীর দিকে নজর পড়ল মন্ত্রীমশাইয়ের। তিনি বললেন, তুমি এখানে এসো। তিন মিনিটেই তো তোমাকে পৌঁছে দিতে পারব, তারপর কথা বলা যাবে ওর সঙ্গে।

দীপাবলী আপত্তি করতে যাচ্ছিল, আমি এটুকু পথ হেঁটেই–।

আঃ, ঝামেলা কোনো না তো! মন্ত্রীমশাই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, যা বলছি তাই করো।

অগত্যা দীপাবলীকে উঠতে হল। চুপচাপ পথটুকু পার হয়ে মোড়ের মাথায় তাকে প্রায় নিঃশব্দে নামিয়ে দিয়ে তিনটে জিপ চলে গেল।

আপনি এখানে দাঁড়িয়ে?

সতীশবাবুর গলা কানে আসতে চমক ভাঙল দীপাবলীর। পাতলা অন্ধকার চুঁইয়ে নামছে । পৃথিবীতে। পথটুকু ঘেঁটে এসেছেন সতীশবাবু। সে সহজ হবার চেষ্টা করল, এমনি।

এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক না ম্যাডাম। আর কিছু না হোক, অন্ধকারে সাপ বেরিয়ে আসে মাটি থেকে। দিনেরবেলায় তাপ থেকে বাঁচতে ওরা মাটির নিচে লুকিয়ে থাকে। অন্ধকারে ওদের গায়ে পা পড়ে গেলে।

সাপে চিরকালই দীপাবলীর ভয়। ছবি দেখলেই গা ঘিনঘিন করে। সে প্রায় বাচ্চা মেয়ের মত সতীশবাবুকে বলল, আপনি একটু আমার সঙ্গে যাবেন?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। সতীশবাবু আগে আগে হাঁটতে লাগলেন। হাঁটতে হাঁটতেই দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, সতীশবাবু, আজ সব দেখে কি মনে হল?

ছোট মুখে বড় কথা বলা ঠিক হবে না ম্যাডাম।

নেখালির লোকগুলো উপকৃত হবে?

হবে। কুয়ো তো খোঁড়া হচ্ছে ম্যাডাম।

এটা ভাবতে পারিনি আমি। অর্জুন নায়েককে গতকাল আমি খুব রেগে গিয়ে যেসব কথা বলেছিলাম ও যে আজ সকালে তাই করবে কে জানত। তিরির কাছে ওর সম্পর্কে যা শুনেছি তাতে এমন ব্যাপার ভাবা যায় না।

ম্যাডাম, আমিও অবাক হয়েছি। কিন্তু দেখুন কাজটা করেছিল বলে মন্ত্রী ওকে নিজের জিপে ডেকে নিলেন। দেখবেন পাঁচ শো টাকা খরচ করে ও পাঁচ হাজার টাকা রোজগারের ব্যবস্থা করে নিল। ভগবান সবসময় ধান্দাবাজদের সাহায্য করেন।

হুম। অর্জুন নায়েককে এস ডি ও পর্যন্ত খাতির করেন কেন?

এসব প্রশ্ন আমাকে করবেন না ম্যাডাম। তবে আমি একটা কথা বলি, ওকে এড়িয়ে চলাই ভাল। লোকটা সাপের মতন।

শরীর ঘিন ঘিন করে উঠল সাপ শব্দটি শুনে। দীপাবলী দাঁতে দাঁত চাপল। না, এড়িয়ে চলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এস ডি ও কিংবা ডি এম অর্জুনকে যে কারণে হাতে রাখতে চান তার সেটার কোন প্রয়োজন নেই। লোকটা যদি কোন অন্যায় করে সে প্রতিবাদ করবে। দরকার হলে আইনসঙ্গত ব্যবস্থাও। চাকরিসূত্রে সে কিছু অধিকার পেয়েছে। সাপকে তোয়াজ করলে ছোবল খেতে হবেই। কিন্তু তার মাজা ভেঙে দিলে নিজের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব।

অফিসের সামনে এসে সতীশবাবু বললেন, ম্যাডাম, একটা কথা বলব?

বলুন।

আগামীকাল সন্ধের পর কি আপনার একটু সময় হবে?

কেন বলুন তো? আমার বড় মেয়ে এসেছে। নাতনির মুখেভাত কাল। সেই উপলক্ষে কয়েকজনকে খেতে বলেছি। যদি আপনি অনুগ্রহ করে–।

নিশ্চয়ই। এত কুণ্ঠা করছেন কেন আপনি? নিশ্চয়ই যাব। তাহলে তো কাল অফিসে আসছেন না, বাড়িতে যখন কাজ রয়েছে।

না, না, অফিসে আসব। দশটায় ফিরে গিয়ে ওসব হবে।

না, সতীশবাবু। আমার বাবা যদি নাতনির জন্মদিনে অফিসে যেতেন তাহলে আমার ভাল লাগত না। আপনি কাল ছুটি নিন।

অনেক ধন্যবাদ ম্যাডাম। আমি কামাই করলে আপনি কিছু যদি মনে করেন তাই আসতে চেয়েছিলাম। জানেন, আমার মেয়ের বিয়ের দিনেও আমাকে অফিস করতে হয়েছিল। আচ্ছা, আসি আজকে। সতীশবাবু নমস্কার করে বিদায় নিলেন।

দীপাবলী চারপাশ তাকাল। অন্ধকার যেন কিছুটা পাতলা। চাঁদ উঠবে নাকি। ফালি চাঁদের আসার সময় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনও গরম নিঃশ্বাস মিলিয়ে যায়নি। সে দরজায় আওয়াজ করতে তিরির গলা ভেসে এল, কে?

আমি, খোল।

দরজা খুলল তিরি হাতে হ্যারিকেন নিয়ে, সবাই চলে গিয়েছে?

হ্যাঁ। তোদের গ্রামে কুয়ো খোঁড়া হচ্ছে। এখানে আর কেউ তোকে বিরক্ত করতে আসবে না। দীপাবলী নিজেই দরজা বন্ধ করল।

তিরি বলল, নিচুগলায়, একটা লোক এসেছিল।

কে? অবাক হল দীপাবলী।

কি জানি  ঠোঁট উল্টালে তিরি, হাতে ব্যাগ ছিল। তুমি নেই শুনেও দাঁড়িয়েছিল। আমি দরজা খুলিনি। তখন বলল ঘুরে আসছে।

তিরি সঠিক কাজই করেছে। অজানা উটকো লোককে ঘরে ঢুকতে না দেওয়ার নির্দেশ ছিল। হাতমুখ ধুয়ে দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, কুয়োয় জল জমেছিল?

পাঁচ বালতি তুলে রেখেছি। তিরি জিজ্ঞাসা করল, চা খাবে তো এখন? আমি জল গরম করেই রেখেছি!

খাব। আচ্ছা, লোকটাকে দেখতে কেমন রে?

লম্বা, পাজামা পাঞ্জাবি পরা চেহারা। তিরি চলে গেল। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ভেবে কোন কূল পেল না দীপাবলী।

শমিত কেন এখানে এল? ওর তো এখানে, তার কাছে আসার কথা নয়। বুকের ভেতর একটা উত্তেজনা শিবিদ্ধ শুয়োরের মত ছটফট করতে লাগল। সে নিজেকে বোঝাতে চাইল। অসম্ভব, শমিত তার কাছে আসতে পারে না। ওর আত্মমর্যাদা আছে। না, অসম্ভব।

তিরি চা নিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে তোমার?

মাথা নাড়ল দীপাবলী, চা রেখে যা।

কিন্তু তুমি ঘামছ?

বললাম তো চা রেখে যা। গলা ওপরে উঠল দীপাবলীর।

খাটের পাশে টেবিলের ওপর কাপ রেখে তিরি চলে গেল। সময় লাগল নিজেকে শান্ত করতে। প্রায় অসাড়েই চায়ের কাপ টেনে নিয়ে চুমুক দিল সে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল ঠোঁট। জিভ যেন পুড়ে গেল। চটপট কাপ নামিয়ে রেখে মুখে শব্দ করল দীপাবলী। চা যে গরম থাকবে সেটুকুও মনে ছিল না।

দুটো বছর একা মানুষের জীবনে কতখানি তা ফেলে আসার অনেক পরে যেভাবে টের পাওয়া যায় তা যদি আগে বোঝা যেত? কোন এক পণ্ডিত বলেছিলেন, পৃথিবীতে একটি মানুষের জীবনে ধনরত্ন সম্পত্তির থেকেও মূল্যবান হল সময়। অথচ ঈশ্বর মানুষকে এমন মূর্খ করে রেখে দেন যে সে সেটা চলে যাওয়ার আগে বুঝতেই পারে না কি হারাচ্ছে। এখন মাঝে মাঝে মনে হয় একটা জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তেও মানুষ বুঝতে পারে না ঠিক কতটা সময় অপচয় করল সে।

কিন্তু বেঁচে থাকা মানেই যদি অভিজ্ঞ হওয়া তাহলে অপচয়ের নিশ্চয়ই একটা আলাদা মূল্য রয়েছে। সেই দৃষ্টিকোণে জীবনটাকে দেখার চেষ্টা করলে আর কোন আফসোস থাকে। না। ওয়ার্কিং গার্লস হোস্টলের জীবনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে সেই দুটো বছর তার খুব খারাপ কাটেনি। অন্তত অভিজ্ঞ হয়েছে।

পরীক্ষা পর্যন্ত কোন ঘটনা ঘটেনি যা দীপাবলীকে বিচলিত করতে পারত। জলপাইগুড়ির সম্পত্তির ব্যাপারে অমলকুমার সেখানকার বিখ্যাত উকিল, জীবনগতি রায়মহাশয়ের সঙ্গে থেকে সুরাহা করে দিয়েছিল যা দুটি বিখ্যাত সেবাপ্রতিষ্ঠানের নামে লিখে দিয়ে সমস্ত দায় থেকে মুক্ত হয়েছিল দীপাবলী। এবং এই ঘটনাটির জন্যে যাবতীয় আত্মীয়স্বজনের বিরাগভাজন হওয়াটাকে সে একটুও আমল দেয়নি। পরীক্ষার পর দীপাবলী একই সঙ্গে আই এ এস এবং ডর বি সি এস পরীক্ষায় বসেছিল। আই এ এস পরীক্ষা দিয়েই সে বুঝতে পেরেছিল তার পক্ষে কৃতকার্য হওয়া সম্ভব নয়। পরীক্ষা খুবই খারাপ হয়েছিল। কিন্তু ডব্লু বি সি এস পরীক্ষার দিন আচমকা সর্দিজ্বরে পড়ে গিয়েছিল। জ্বর গায়েই পরীক্ষা দেয় কিন্তু মনে হয়েছিল ফল খুব খারাপ হবে না।

পরীক্ষার পর অখণ্ড অবসর। মায়ার সঙ্গে যোগাযোগ ছিলই। সে মায়াকে বলেছিল শমিতকে খবর দিতে দেখা করার জন্যে। তখন শমিত আসত কালেভদ্রে। তার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসা শমিতের একদম পছন্দ ছিল না। শমিত দেখা হলেই জোর করত নাটকের দলে যোগ দিতে। তার ধারণা নাটকে অভিনয় করলে দীপাবলী অনেক ওপরে পৌঁছাতে পারবে। যে মেয়ে অল্প রিহার্সাল দিয়ে জীবনে নাটক সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকা সত্ত্বেও অত ভাল অভিনয় করতে পারে তার একমাত্র কাজের জায়গা এখানেই হওয়া উচিত। দীপাবলী একমত হয়নি কখনও। সে ইচ্ছে করেই ওর নাটকের দলে যেত না। একধরনের অস্বস্তি হত।

মায়াকে খবর দেওয়া সত্ত্বেও শমিত দেখা করতে এল না। এমনটা সাধারণত হয় না। বেশ কিছুদিন আগে শমিত দীপাবলীকে বলেছিল সে যদি ইচ্ছে করে তবে তার স্কুলে ডেপুটেশন ভ্যাকেন্সিতে কাজ করতে পারে। পরে তার মনে হয়েছিল শমিত আলাপের সময় বলেছিল সে নিজেই ডেপুটেশন ভ্যাকান্সিতে আছে। হয়তো স্কুলের নিয়মিত শিক্ষক না হওয়ায় কর্তৃত্ব তৈরি হয়নি বলে পরে এ নিয়ে আর কথা বলেনি। চাকরি বাকরি পাওয়ার আগে যদি স্কুলে সাময়িক পড়ানোর কাজ পাওয়া যায় মন্দ কি। টিউশনি এবং ব্যাঙ্কের সামান্য সুদে তার মোটামুটি চলে যাচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে চারটের বেশি ভাল শাড়ি নেই তার। আটপৌরে ধরলে বড়জোর দশটা হবে। দুটোর রঙ উঠে গেছে অনেকটা। শাড়ির ওপর তার কখনই আকর্ষণ ছিল না, নেই, কিন্তু একজন মহিলাকে বাইরে বের হতে গেলে রুচিসম্পন্ন পোশাক দরকার হয়।

এক রবিবার দুপরে খাওয়াদাওয়ার পর হোস্টেল থেকে বের হল সে। মায়ার কাছ থেকে শমিতের ঠিকানা পেয়েছিল কদিন আগে। শ্যামবাজারের মোড়ে গিয়ে বাস ধরে যখন সে শমিতের পাড়ায় গিয়ে পৌঁছল তখন রাস্তাঘাট ফাঁকা, রোদুর কড়কড়ে। জায়গাটা দেখলে কলকাতা বলে মনেই হয় না। একটা মুদির দোকান খোলা ছিল। সেখানে জিজ্ঞাসা করে শমিতের বাড়িতে পৌঁছাল সে। একতলা সাদামাটা বাড়ি। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। হঠাৎ মনে হল এমন না ভেবে চলে আসা ঠিক হয়নি। শমিতের বাড়ির লোকজন কিছু মনে করতেও পারে। কিন্তু চলে আসার পর ফিরে যাওয়ার কোন মানে হয় না। সে দরজায় শব্দ করল।

ভেতর থেকে শমিতের গলা ভেসে এল, কে?

দীপাবলী চুপ করে রইল। কয়েক সেকেন্ড বাদে দরজা খুলল শমিত। তার চোখ বিস্ফারিত। আরে, তুমি? কি আশ্চর্য ঘটনা। কি ব্যাপার?

দীপাবলী হাসল। বাইরে দাঁড়িয়ে উত্তর দেব?

না, না। সরি। এসো, ভেতরে এসো!

দীপাবলী ঘরে ঢুকল। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘর। দেওয়ালে দুটো ছবি টাঙানো। একটি উইলিয়াম শেক্সপীয়ারের। অন্য ছবিটি সে কখনও দ্যাখেনি। সেটা লক্ষ্য করেশমিত বলল, উনি শিশিরকুমার ভাদুড়ি। আধুনিক বাংলা নাটকের জনক।

দীপাবলী ছবি থেকে চোখ সরিয়ে বলল, এইসব নাম আমি বইয়ে পড়েছি।

শমিত মাথা নাড়ল, আমিও। তবে অনেকেই ওঁর অভিনয় দেখেছেন অনেকবার। ওঁর। সঙ্গে অভিনয় করা মানুষের অভাব নেই শহরে। বসো।

তিনটে বেতের চেয়ারের মাঝখানে ছোট টেবিল। দীপাবলী বসল। উল্টোদিকে শমিত। দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, বাড়িতে কেউ নেই?

নাঃ। মা গিয়েছে তার বোনের বাড়িতে। চা-ফা খাওয়াতে পারব না।

শমিতের এইরকম কথা বলা ভাল লাগে দীপাবলীর। সে হাসল, আমার চায়ের নেশা এখনও তীব্র নয়। আমি কিন্তু অন্য প্রয়োজনে এসেছি।

শোনা যাক। প্রয়োজন ছাড়া আজকাল কেউ কারো কাছে আসে না।

সে কি! আপনি যে আমার জন্যে এত করলেন, এতবার গেলেন তার পেছনে কোন প্রয়োজন ছিল বলে তো মনে হয়নি।

ছিল। প্রথমতঃ, তোমাকে আমাদের নাটকের দলে টানতে চেয়েছিলাম।

ও, শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে যাওয়া বন্ধ করলেন?

তা ঠিক নয়। প্রথমত বললেন যখন তখন দ্বিতীয় কোনো ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে!

শমিত হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল, তোমার উচিত আইন পড়া। চমক্কার প্র্যাকটিস করতে পারবে তাহলে! বল, প্রয়োজনটা কি?

মুখ গম্ভীর হল দীপাবলীর। তারপর বলে ফেলল, আমার একটা চাকরি চাই। আপনি বলেছিলেন স্কুলে ডেপুটেশন ভ্যাকেন্সিতে কাজ করা যাবে।

সে কি। তোমার তো বড় বড় আইডিয়া। আই এ এস, ডব্লু বি সি এস!

আইডিয়াগুলো মরে যায়নি বলেই পার্মানেন্ট পোস্ট চাইছি না!

ঠিক আছে, চেষ্টা করব। স্কুলে গিয়ে কথা বলতে হবে। শমিত চোখ বন্ধ করল, তিন চার মাস কিন্তু।

তাতেই হবে। তবু তো একটা কাজ করা যাবে!

হোস্টেল কেমন চলছে?

ঠিক আছে। বৃষ্টির জল পুকুরে পড়লে পুকুরের জল হয়ে যায়।

বাঃ। দারুণ। শমিত উঠল, বসো।

কোথায় যাচ্ছেন?

বাড়িতে অতিথি এল, কিছু যোগাড় করি!

দীপাবলী ঝটপট উঠে দাঁড়াল, না, না, আমি কিছু খাবো না, আপনি একদম ব্যস্ত হবেন না। আমার খারাপ লাগছে।

হঠাৎ চোখ স্থির হল শমিতের, দীপা!

দীপাবলী অবাক হয়ে তাকাল। চোখ না সরিয়ে শমিত বলল, তুমি কি সত্যি কখনো আমাকে তুমি বলতে পারবে না? আমি কি এতই অযোগ্য?

হঠাৎ একথা?

জিজ্ঞাসা করছি।

যোগ্যতা বা অযোগ্যতার কথা নয়। আপনি বা তুমি বলার মধ্যে পার্থক্য করছেন কেন?

হঠাৎ সামনে এগিয়ে এসেই নিজেকে সংযত করল, শমিত, না, ঠিক আছে, শোন, আমি তোমাকে আমার জীবনে চাই। পেতে পারি কি?

ঠিক এইরকম কিছু আন্দাজ আসছিল কিছুক্ষণ। মুখ ফেরাল দীপাবলী।

আমি তোমাকে স্পর্শ করব না, কোন জোরজবরদস্তি করব না, তুমি নির্দ্বিধায় না বলতে পার। আমি কিছু মনে করব না।

দীপাবলী কোন কথা বলতে পারছিল না। তার গলা আচমকা শুকিয়ে যাচ্ছিল, গালে রক্ত জমছিল। শমিত সেটা লক্ষ করল। সে বলল, তুমি কি কখনও আমার মনের কথা বোঝনি? আমি যে বারেবারে তোমার কাছে ছুটে গিয়েছি তা কি শুধু নাটকের প্রয়োজনে!

তাই তো বললেন একটু আগে। দীপাবলী মৃদুস্বরে বলল মুখ ফিরিয়ে।

সেটা অবশ্যই সত্যি। কিন্তু শেষ সত্যি নয়। দ্বিতীয় প্রয়োজনটা যখন তোমাকে বলতে পারিনি। হ্যাঁ, আমি আমার জন্যে গিয়েছিলাম।

আপনি তো আমার সব কথা জানেন। জানি। তুমি বিধবা না কুমারী তাতে আমার কিছু এসে যায় না। শমিত আরও এগিয়ে এল, আমি তোমার ভালবাসা চাই।

সমস্ত শরীরে কাঁটা ফুটল দীপাবলীর, আমি একটু ভাবব।

ভালবাসা ভেবে আসে না।

না ভেবেও তো আসেনি।

আমার জন্যে তোমার ভালবাসা আসেনি?

দীপাবলী জবাব দিল না। শমিত তার দিকে উদ্বেগে তাকিয়ে আছে। সে বলল, আমি এখন যেতে পারি?

হঠাৎ শমিত অদ্ভুতভাবে ডুকরে উঠল। তারপর ছুটে গেল ভেতরের ঘরে। বাইরের ঘরে দাঁড়িয়েই দীপাবলী ওর কান্নার শব্দ শুনতে পেল। নাটকের দলে বা বাইরে যে বেপরোয়া অথচ ব্যক্তিত্বপূর্ণ শমিতকে সে দেখেছে তার গলায় ওই শব্দ এই কান্না কিছুতেই মানায় না। ইচ্ছে সত্ত্বেও শুধু এই কারণে বাইরের দরজা খুলে রাস্তায় নামতে পারল না। দীপাবলী। পায়ে পায়ে ভেতরের ঘরে ঢুকে একটি আটপৌরে শাওয়ার ঘর দেখতে পেল। খাটের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে শমিত। কান্নার শব্দ ছিটকে উঠছে চাপা মুখ থেকে, পিঠ ওঠানামা করছে। একমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে দীপাবলী খাটের একপাশে বসে ওর পিঠে হাত দিতেই শরীর স্থির হল। দীপাবলী বলল, এমন করবেন না।

হঠাৎ ঘুরে উঠে বসল শমিত। তারপর দীপাবলী কিছু বুঝে ওঠার আগেই দু-হাত বাড়িয়ে তাকে বুকে টেনে নিয়ে পাগলের মতো চুমু খেতে লাগল। আচমকা প্রবল বর্ষণে বট গাছের পাতারাও যেমন কেঁপে কেঁপে ওঠে তেমনি টালমাটাল হল দীপাবলী। প্রতিরোধ করার চেষ্টা তীক্ষ্ণ হবার আগেই যেন তার শরীর শক্তিশূন্য হয়ে গেল। ততক্ষণে তার ঠোঁট খুঁজে পেয়েছে শমিত। সেই ঠোঁটে ঠোঁট চেপে সে ফিসফিস করল, বল, তুমি আমাকে ভালবাস না?

না। দীপাবলী কোন রকমে ঠোঁট সরাল।

কেন? আচমকা সমস্ত আক্রমণ গুটিয়ে গেল, শমিত যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। অন্তত ওই মুহূর্তে এমন উত্তর সে আশাই করেনি।

মুক্ত দীপাবলী সরে বলল, আপনি ভুলে যাচ্ছেন মায়া আপনাকে ভালবাসে।

মায়া? আমাকে! স্তম্ভিত হয়ে গেল শমিত।

আপনি জানেন না?

না! তোমাকে বলেছে একথা?

মেয়েরা বুঝতে পারে, বলতে হয় না।

যা তা বকো না। মায়া আমার বন্ধু, জাস্ট বন্ধু, তার বেশি আর কিছু নয়।

আমি বিশ্বাস করি না।

তুমি কি মনে করছ মায়ার সঙ্গে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও আমি তোমাকে এসব কথা বলছি? তুমি আমাকে কি মনে করছ?

কিছু না। কিন্তু মায়াকে আমি কষ্ট দিতে পারব না। আপনার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব নষ্ট হবে না। শুধু আজকের এই ঘটনাটা আমি যেমন ভুলে যেতে চাইব আপনিও যদি ভুলে যান তাহলে দুজনেরই ভাল হবে। চুপচাপ বেরিয়ে এসেছিল দীপাবলী। শমিত ওঠেনি খাট থেকে।

তুমি চা খেলে না? তিরির মুখে প্রশ্নটা উচ্চারিত হতেই দীপাবলী চায়ের কাপের দিকে তাকাল। ইতিমধ্যে সর পড়ে গিয়েছে ওপরে। হাত বাড়িয়ে কাপটাকে ধরতেই বুঝল ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। এখনও চায়ের নেশা তাকে তেমনভাবে পাকড়াও করেনি। সে বলল, নিয়ে যা। খাবো না।

আর তখনই বাইরের দরজায় শব্দ হল। তিরি বল ওই লোকটা বোধহয় এসেছে। সে বাইরের ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু দীপাবলী পিছু ডাকল, দাঁড়া, তোকে যেতে হবে না। আমি যাচ্ছি।

ভারী পা নিয়ে বাইরের ঘরে এসে কোন প্রশ্ন না করে সে দরজা খুলল। খুলতেই চমকে উঠল সে, আপনি?

পেছনের দরজায় অন্ধকার আলোয় দাঁড়ানো তিরি দৌড়ে ভেতরে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *