বেশ পরিপাটি করিয়া এক ছিলিম তামাক সাজিয়া হুঁকায় জল ফিরাইয়া পদ্ম স্বামীর আহারশেষের প্রতীক্ষা করিতেছিল। অনিরুদ্ধের খাওয়া শেষ হইতেই হাতে জল তুলিয়া দিয়া কাটি। তাহার হাতে দিয়া বলিলখাও। অনিরুদ্ধ টানিয়া বেশ গলগল করিয়া নাক-মুখ দিয়া ধোঁয়া বাহির করিয়াছে, তখন পদ্ম বলিল—আমার কথাটা ভেবে দেখ। রাগ একটু পড়েছে তো?
—রাগ! অনিরুদ্ধ মুখ তুলিয়া চাহিল—ঠোঁট দুইটা তাহার থরথর করিয়া কাঁপিতেছে।–এ রাগ আমার তুষের আগুন, জনমে নিববে না। আমার দু বিঘে বাকুড়ির ধান–
কথাটা শেষ করিতে পারিল না। কারণ তাহার চোখের জলের ছোঁয়াচে পদ্মের ডাগর চোখ দুটিও অজলে উজ্জসিত হইয়া উঠিয়াছে। এবং অনিরুদ্ধের আগেই তাহার ফোঁটা কয়েক জল টপটপ করিয়া ঝরিয়া পড়িল।
অনিরুদ্ধ চোখ মুছিয়া বলিল—কাঁদছিস কেন তুই? দু বিঘে জমির ধান গিয়েছে, যাগে। আমি তো আছিরে বাপু! আর দেখ না—কি করি আমি!
চোখ মুছিতে মুছিতে পদ্ম বলিল—কিন্তু থানা-পুলিশ কোরো না বাপু! তোমার দুটি পায়ে পড়ি আমি। ওরা সাপ হয়ে দংশায়, রোজা হয়ে ঝাড়ে। আমার বাপের ঘরে ডাকাতি হল-বাবা চিনলে এক জনকে কিন্তু পুলিশ তার গায়ে হাত দিল না। অথচ মুঠো-মুঠো টাকা খরচ হয়ে গেল বাবার। ছেলেমেয়ে গুষ্টি সমেত নিয়ে টানাটানি; একবার দারোগা আসে, একবার নেসপেকটার আসে, একবার সায়েব আসে আর দাও এজাহার। তার পরে, কজনকে কোথা হতে ধরলে, তাদিগে শনাক্ত করতে জেলখানা পর্যন্ত মেয়েছেলে নিয়ে টানাটানি। তাছাড়া গালমন্দ আর ধমক তো আছেই।
—হুঁ। চিন্তিতভাবে হুঁকায় গোটাকয়েক টান দিয়া অনিরুদ্ধ বলিল—কিন্তু এর একটা বিহিত করতে তো হবে। আজ না হয় দু বিঘে জমির ধান গেল। কাল আবার পুকুরের মাছ ধরে নেবে–পরশু ঘরে–
বাধা পড়িল অনি-ভাই ঘরে রয়েছ নাকি? অনিরুদ্ধের কথা শেষ হইবার পূর্বেই বাহির হইতে গিরিশ ডাকিয়া সাড়া দিয়া বাড়ির মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিলা পদ্ম আধঘোমটা টানিয়া, এঁটো বাসন কয়খানি তুলিয়া ঘাটের দিকে চলিয়া গেল।
অনিরুদ্ধ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল-দু বিঘে বাকুড়িয়া ধান একেবারে শেষ করে কেটে নিয়েছে, একটি শীষও পড়ে নাই।
গিরিশও একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল—শুনলাম।
—থানায় ডায়রি করব ঠিক করেছিলাম, কিন্তু বউ বারণ করছে। বলছে, ছিরু পাল চুরি করেছে—এ কথা বিশ্বাস করবে কেন? আর গায়ের লোকও আমার হয়ে কেউ সাক্ষি দেবে না।
–হ্যাঁ; কাল সন্ধেতে আবার নাকি চণ্ডীমণ্ডপে জটলা হয়েছিল। আমরা নাকি অপমান করেছি। গায়ের লোকদের। জমিদারের কাছে নালিশ করবে শুনছি।
ঠোঁটের দিক বাঁকাইয়া অনিরুদ্ধ এবার বলিয়া উঠিল—যা যা! জমিদার, জমিদার আমার কচু করবে।
কথাটা গিরিশের খুব মনঃপূত হইল না, সে বলিল—তাই বলারই বা আমাদের দরকার কি? জমিদারেরও তো বিচার আছে, তিনি বিচার করুন না কেন?
অনিরুদ্ধ বারবার ঘাড় নাড়িয়া অস্বীকার করিয়া বলিল—সঁহ, ছাই বিচা. করবে জমিদার। নিজেই আজ তিন বছর ধান দেয় নাই। জমিদার ঠিক ওদের রায়ে রায় দেবে; তুমি জান না।
বিষণ্ণভাবে গিরিশ বলিল-আমিও পাই নাই চার বছর।
অনিরুদ্ধ বলিল—এই দেখ ভাই, যখন মুখ ফুটে বলেছি কব না তা তখন আমার মরাবাবা এলেও আমাকে করাতে পারবে না; তাতে আমার ভাগ্যে যাই থাক! তুমি ভাই এখনও বুঝে দেখ।
গিরিশ বলিল—সে তুমি নিশ্চিন্দি থাক। তুমি না মিটোলে আমি মিটোব না।
অনিরুদ্ধ প্রীত হইয়া কল্কেটি তাহার হাতে দিল। গিরিশ হাতের ছাদের মধ্যে কক্িেট পুরিয়া কয়েক টান দিয়া বুলিল—এদিকে গোলমালও তোমার চরম লেগে গিয়েছে; শুধু আমরা দুজনা নই। জমিদার কজনার বিচার করবে, করুক না! নাপিত, বায়েন, দাই, চৌকিদার, নদীর ঘাটের মাঝি, মাঠ-আগলদার সবাই আমাদের ধুয়ো নিয়ে ধুয়ে ধরেছে—ওই অল্প ধান নিয়ে আমরা কাজ করতে পারব না। তারা নাপিত তো আজই বাড়ির দোরে অর্জুনতলায় খানকয়েক ইট পেতে বসেছে—বলে পয়সা আন, এনে কামিয়ে যাও।
অনিরুদ্ধ কল্কেটি ঝাড়িয়া নূতন করিয়া তামাক সাজিতে সাজিতে বলিল—তাই বৈকি! পয়সা ফেল, মোওয়া খাও; আমি কি তোমার পর?
গিরিশের কথাবার্তার মধ্যে বেশ একটি বিজ্ঞতা-প্রচারের ভঙ্গি থাকে, ইহা তাহার অভ্যাস হইয়া গিয়াছে; সে বলিল—এই কথা! আগেকার কাল তোমার এক আলাদা কথা ছিল। সস্তাগণ্ডার। বাজার ছিল—তখন ধান নিয়ে কাজ করে আমাদের পুষিয়েছে—আমরা করেছি; এখন যদি না। পোষায়?
বাহিরে রাস্তায় ঠুনঠুন করিয়া বাইসাইকেলের ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল; সঙ্গে সঙ্গে ডাক। আসিল– অনিরুদ্ধ।
ডাক্তার জগন্নাথ ঘোষ।
অনিরুদ্ধ ও গিরিশ দুজনেই বাহির হইয়া আসিল। মোটাসোটা খাটো লোকটি, মাথায় বাবরি চুল—জগন্নাথ ঘোষ বাইসাইকেল ধরিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। ডাক্তার কোথাও পড়িয়া-শুনিয়া পাস করে নাই, চিকিৎসাবিদ্যা তাহাদের তিন পুরুষের বংশগত বিদ্যা; পিতামহ ছিলেন কবিরাজ, বপ জ্যেঠা ছিলেন কবিরাজ এবং ডাক্তার একাধারে দুই। জগন্নাথ কেবল ডাক্তার, তবে সঙ্গে দু-চারটি মুষ্টিযোগের ব্যবস্থাও দেয়—তাহাতে চট্ করিয়া ফলও হয় ভাল। গ্রামের সকল লোকই তাহাকে দেখায়, কিন্তু পয়সা বড় কেহ দেয় না। ডাক্তার তাহাতে খুব গররাজি নয়, ডাকিলেই যায়, বাকির উপরে বাকিও দেয়। ভিন্ন গ্রামেও তাহাদের পুরুষানুক্ৰমিক পসার আছে—সেখানকার রোজগারেই তাহার দিন চলে। কোনোদিন শাক-ভাত, আর কোনোদিন যাহাকে বলে এক-অন্ন পঞ্চাশ-ব্যঞ্জন, যেদিন যেমন রোজগার। এককালে ঘোষেরা সম্পত্তিশালী প্রতিষ্ঠাবান লোক ছিল। ধনীর গ্রাম কঙ্কণায় পর্যন্ত যথেষ্ট সম্মান-মর্যাদা পাইত, কিন্তু ওই কঙ্কণার লক্ষপতি মুখুজ্জেদের এক হাজার টাকা ঋণ ক্ৰমে চারি হাজারে পরিণত হইয়া ঘোষেদের সমস্ত সম্পত্তি গ্ৰাস করিয়া ফেলিয়াছে। এই সম্পত্তি এবং সকলের সম্মানিত প্রবীণগণের তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের সেই সম্মান-মর্যাদাও চলিয়া গিয়াছে। জগন্নাথ অকাতরে চিকিৎসা এবং ঔষধ সাহায্য করিয়াও সে সম্মান আর ফিরিয়া পায় নাই। তাহার জন্য তাহার ক্ষোভের অন্ত নাই। সেই ক্ষোভে কাহাকেও রেয়াত করে না, রূঢ়তম ভাষায় সে উচ্চকণ্ঠে বলে—চোরের দল সব, জানোয়ার। গোপনে নয়, সাক্ষাতেই বলে। ধনী দরিদ্র যেই হোক প্রত্যেকের ক্ষুদ্রতম অন্যায়েরও অতি কঠিন প্রতিবাদ সে করিয়া থাকে। তবে স্বাভাবিকভাবে ধনীদের ওপর ক্রোধ তাহার বেশি।
অনিরুদ্ধ ও গিরিশ বাহির হইয়া আসিতেই ডাক্তার বিনা ভূমিকায় বলিল—থানায় ডায়রি করলি?
অনিরুদ্ধ বলিল-আজ্ঞে তাই–
—তাই আবা। কিসের রে বাপু? যা, ডায়রি করে আয়।
–আজ্ঞে বারণ করছে সব, বলছে—ছিরু পাল চুরি করেছে কে এ কথা বিশ্বাস করবে?
–কেন? ও বেটার টাকা আছে বলে?
–তাই তোতা সাত-পাঁচ ভাবছি ডাক্তারবাবু।
বিদ্ৰুপতীক্ষ্ণ হাসি হাসিয়া জগন্নাথ বলিলতা হলে এ সংসারে যাদের টাকা আছে তারাই সাধু—আর গরিব মাত্ৰেই অসাধু, কেমন? কে বলেছে এ কথা?
অনিরুদ্ধ এবার চুপ করিয়া রহিল। বাড়ির ভিতরে বাসনের টুংটাং শব্দ উঠিতেছে। পদ্ম ফিরিয়াছে, সব শুনিতেছে, তাহারই ইশারা দিতেছে। উত্তর দিল গিরিশ, বলিল-আজ্ঞে, ডায়রি করেই বা কি হবে ডাক্তারবাবু, ও এখুনি টাকা দিয়ে দারোগার মুখ বন্ধ করবে। তা ছাড়া থানার জমাদারের সঙ্গে ছিরু র বেশ ভাবের কথা তো জানেন! একসঙ্গে মদ-ভাং খায়—তারপর
ডাক্তার বলিল জানি। কিন্তু দারোগা টাকা খেলে—তারও উপায় আছে। তার ওপরে। কমিশনার আছে। তার ওপরে ছোট লাট, ঘোট লাটের ওপর বড় লাট আছে।
অনিরুদ্ধ বলিলতা বুঝলাম ডাক্তারবাবু, কিন্তু মেয়েছেলেকে এজাহার-ফেজাহার দিতে হবে, সেই কথা আমি ভাবছি।
—মেয়েছেলের এজাহার? ডাক্তার আশ্চর্য হইয়া গেল। মাঠে ধান চুরি হয়েছে, তাতে মেয়েছেলেকে এজাহার দিতে হবে কেন? কে বলল? এ কি মগের মুলুক নাকি?
সঙ্গে সঙ্গে অনিরুদ্ধ উঠিয়া পড়িল।—তা হলে আমি আজ্ঞে এই এখুনি চললাম।
ডাক্তার বাইসাইকেলে উঠিয়া বলিল, যা, তুই নির্ভাবনায় চলে যা। আমি ওবেলা যাব। চুরি করার জন্যে ধান কেটে নিয়েছে—এ কথা বলবি না, বলবি, আক্রোশবশে আ সার ক্ষতি করবার জন্যে করেছে।
অনিরুদ্ধ আর বাড়ির মধ্যে ঢুকি না পর্যন্ত, রওনা হইয়া গেল, পাছে পদ্ম আবার বাধা দেয়। সে ডাক্তারের গাড়ির সঙ্গে সঙ্গেই চলিতে আরম্ভ করিল; গিরিশকে বলিল—গিরিশ, কামারশালের চাবিটা নিয়ে এসো তো ভাই চেয়ে।
ওপারের জংশনের কামারশালের চাবি। গিরিশকে ভিতরে ঢুকিয়া চাহিতে হইল না, দরজার আড়াল হইতে ঝনাৎ করিয়া চাবিটা আসিয়া তাহার সম্মুখে পড়িল। গিরিশ হেঁট হইয়া চাবিটা তুলিতেছিল–পদ্ম দরজার পাশ হইতে উঁকি মারিয়া দেখিল—ডাক্তার ও অনিরুদ্ধ অনেকখানি চলিয়া গিয়াছে। সে এবার আধঘোমটা টানিয়া সামনে আসিয়া বলিল—একবার ডাক ওকে।
মুখ তুলিয়া একবার পদ্মের দিকে একবার অনিরুদ্ধের দিকে চাহিয়া গিরিশ বলিল—পেছনে ডাকলে ক্ষেপে যাবে।
–তা তো যাবে। কিন্তু ভাত? ভাত নিয়ে যাবে কে? আজ কি খেতেদেতে হবে না?
গিরিশ ও অনিরুদ্ধ সকালে উঠিয়া ওপারে যায়, তাহার পূর্বেই তাহাদের ভাত হইয়া থাকে যাইবার সময় সেই ভাত তাহারা একটা বড় কৌটায় করিয়া লইয়া যায়। সেই খাইয়াই তাহাদের দিন কাটে। রাত্রে খাওয়াটা বাড়িতে ফিরিয়া আরাম করিয়া খায়। গিরিশ বলিল–ভাতের কৌটা আমাকে দাও, আমিই নিয়ে যাই।
* * *
পদ্ম সংসারে একা মানুষ। বছর দুয়েক পূর্বে শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর হইতেই সমস্ত দিনটা তাহাকে একলাই কাটাইতে হয়। সে নিজে বন্ধ্যা, ছেলেপুলে নাই। পাড়াগাঁয়ে এমন অবস্থায় একটি মনোেহর কর্মান্তর আছে—সে হইল পাড়া বেড়ানো। কিন্তু পদ্মের স্বভাব যেন উৰ্ণনাভগৃহিণীর মত। সমস্ত দিনই সে আপনার গৃহস্থালির জাল ক্রমাগত বুনিয়া চলিয়াছে। ধান-কলাই রৌদ্রে দিতেছে, সেগুলি তুলিতেছে, মাটি ও কুড়ানো ইট দিয়া গাঁথিয়া ঘরে বেদি বাঁধিতেছে; ছাই দিয়া মাজিয়া-তোলা বাসনেরও ময়লা তুলিতেছে—শীতের লেপ-কাঁথাগুলি পাড়িয়া নতুন পাট করিতেছে। ইহা ছাড়া নিয়মিত কাজ–গোয়াল পরিষ্কার করা, জাব কাটা, ঘুঁটে দেওয়া, তিন-চারবার বাড়ি ঝট দেওয়া এসব তো আছেই।
আজ কিন্তু তাহার কোনো কাজ করিতে ইচ্ছা হইল না। সে খিড়কির ঘাটে পা ছড়াইয়া বসিল। অনিরুদ্ধকে থানায় যাইতে বারণ করিয়াছে, হাসিমুখে রহস্য করিয়া তাহাকে শান্ত করিবার জন্য চেষ্টা করিয়াছে—সে কেবল ভবিষ্যৎ অশান্তি নিবারণের জন্য। ঐ দু বিঘা বাকুড়ির ধানের জন্য তাহারও দুঃখের সীমা ছিল না। আপন মনেই সে মৃদুস্বরে ছিরু পালকে অভিসম্পাত দিতে শুরু করিল।
কানা হবেন—কানা হবেন—অন্ধ হবেন;হাতে কুষ্ঠ হবে,সর্বস্ব যাবে ভিক্ষে করে খাবেন।
সহসা যেন কোথাও প্রচণ্ড কলরব উঠিতেছে বলিয়া মনে হইল। পদ্ম কান পাতিয়া শুনিল। গোলমালটা বায়েনপাড়ায় মনে হইতেছে। প্রচণ্ড রূঢ়কণ্ঠে অশ্লীল ভাষায় কেউ তর্জন-গর্জন করিতেছে। ওই ছোঁয়াচটা যেন পদ্মকেও লাগিয়া গেল। সেও কণ্ঠ উচ্চে চড়াইয়া শাপ-শাপান্ত আরম্ভ করিল—
—জোড়া বেটা ধড়ফড় করে মরবে; এক বিছানায় একসঙ্গে। আমার জমির ধানের চালে কলেরা হবে। নিবংশ হবেন নিবংশ হবেন; নিজে মরবেন না, কানা হবেন—দুটি চোখ যাবে, হাতে কুষ্ঠ হবে। যথাসর্বস্ব উড়ে যাবে পুড়ে যাবে। পথে পথে ভিক্ষে করে বেড়াবেন।
বেশ হিসাব করিয়াছিরু পালের সহিত মিলাইয়া সে শাপ-শাপান্ত করিতেছিল। সহসা তাহার নজরে পড়িল, খিড়কির পুকুরের ওপারে রাস্তার উপর দাঁড়াইয়া ছিরু পাল তাহার গালিগালাজগুলি বেশ উপভোগ করিয়া হাসিতেছে। এইমাত্র ছিরু পাতু বায়েনকে মারপিট করিয়া ফিরিতেছিল, বায়েনপাড়ার কলরবটা তাহারই সেই বিক্রমোদ্ভূত। ফিরিবার পথে অনিরুদ্ধের স্ত্রীর শাপ-শাপান্ত শুনিয়া দাঁড়াইয়া হাসিতেছিল। সে হাসির মধ্যে বন্য একটা ক্রুর প্রবৃত্তির প্রেরণা অথবা তাড়নাও ছিল। দেখিয়া পদ্ম উঠিয়া বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। ছিরু ভাবিতেছিল, লাফ দিয়া বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িবে কি না? কিন্তু দিবালোককে তাহার বড় ভয়, সে স্পন্দিতবক্ষে দ্বিধা করিতেছিল। সহসা পদ্মের কণ্ঠস্বর শুনিয়া আবার সে ফিরিয়া চাহিল; কিন্তু কিসের একটা প্রতিবিম্বিত আলোকচ্ছটা তাহার চোখে আসিয়া পড়িতেই সে চোখ ফিরাইয়া লইল।
—ধার পরীক্ষ করতে এক কোপে দুটো পাটা কেটে আমার কাজ বাড়িয়ে গেলেন। বীরপুরুষ; রক্তের দাগ ধোঁয়া নাই—ঘরে ভরে রেখে দিয়েছেন। আমি ঘাটে বসে ঝামা ঘষি আর কি!
পদ্মের হাতে একখানা বগি দা; রোদ পড়িয়া দাখানা ঝকঝক করিতেছে। তাহারই ছটা আসিয়া চোখে পড়িতেই ছিরু পাল চোখ ফিরাইয়া লইল। পরক্ষণেই দুমদুম্ শব্দে পা ফেলিয়া আপনার বাড়ির পথ ধরিল। সঙ্গে সঙ্গে পদ্মের মুখেও নিষ্ঠুর কৌতুকের হাসি ফুটিয়া উঠিল।