০৩. একা একা বসে থাকতে

একা একা বসে থাকতে আসিফের কখনো খারাপ লাগে না।

আজ লাগছে। সোফাটায় কোনো ঝামেলা আছে কিনা কে জানে। কোনোভাবে বসেই আরাম পাওয়া যাচ্ছে না। সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে খাওয়া যাচ্ছে না। সাইন বোর্ড ঝুলছে–ধূমপান সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। চোখের সামনে এ রকম কড়া একটা সাইন বোর্ড নিয়ে সিগারেট ধরান যায় না। তা ছাড়া ঘরে ফিনাইলেন গন্ধ। এইগন্ধ নাকে এলেই কেমন যেন নিজেকে অসুস্থ মনে হয়।

আসিফ ঘড়ি দেখল, বারটা দশ। যে অপারেশন এগারোটায় হবার কথা সেটা এখন হবে রাত

একটায়। এনেসথেসিস্ট পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি নাকি কোন বিয়ে বাড়িতে গেছেন, বলে গেছেন বারোটার দিকে ফিরবেন। সেইভাবেই ব্যবস্থা হয়েছে। আসিফের বড় বোন রেহানা খুব ছটফট করছেন। একবার তিন তলায় যাচ্ছেন আবার আসছেন এক তলায়। এই ক্লিনিকটা বেশ ভাল। লিফট আছে। মাঝরাতেও লিফটম্যান আছে। রেহানা লিফটে উঠছেন না। সিঁড়ি ভেঙে ওঠা-নামা করছেন। রেহানার শরীর বিশাল, কিন্তু তাতেও তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। শুধু মুখ টকটকে লাল হয়ে আছে এবং তিনি খুব ঘামছেন।

আসিফ বলল, তুমি শান্ত হয়ে বস তো আপা। এ রকম করছি কেন?

এনেসথেসিস্ট তো এখনও এল না। অন্য কোনো ক্লিনিকে নিয়ে যাব?

এসে পড়বেন। তুমি শুধু শুধু ব্যস্ত হচ্ছি। বস আমার পাশে। তোমার নিজের হার্ট এ্যাটাক হয়ে যাবে।

রেহানা বসলেন না। ছটফটিয়ে আবার তিন তলায় রওনা হলেন। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এনেসথিসিস্ট এসে পড়ল। এক ধরনের টেনশান আসিফের মধ্যেও ছিল। এখন আর তা নেই। আশ্চর্যের ব্যাপার, সোফায় বসতেও তার আরাম লাগতে শুরু করেছে। ঘুম-ঘুমাও পাচ্ছে। এ ভাবে বসে থাকলে ঘুম এসে যেতে পারে। আসিফ বারান্দায এসে দাঁড়াল। সিগারেট ধরাবার ইচ্ছে করছে, ধরানো যাচ্ছে না। চারদিকে আত্মীয়স্বজন। ঢাকা শহরে যেখানে যে ছিল সবাই চলে এসেছে। ক্লিনিকের সামনে ছ’সাতটা গাড়ি।

আসিফদের পাঁচ বোনের চার জনই থাকে ঢাকাতে। তারা সবাই এসেছে। তাদের আত্মীয়স্বজনরা এসেছে। হুঁলস্থূল ব্যাপার। এদের প্রায় কাউকেই সে ভালমত চেনে না। কয়েকবার হয়ত দেখা হয়েছে, কি কেমন? ভাল? এই জাতীয় কথাবার্তা হয়েছে। এর বেশি কিছু না। বোনদের স্বামীর বাড়ির লোকজনদের সে যেমন চেনে না, ওরাও চেনে না। তবু কয়েকজন চকচকে চেহারার মানুষ আসিফকে বলল, কি, ভালো?

আসিফ খুবই পরিচিত ভঙ্গিতে হোসেছে। কথাবার্তা পর্ব এই পর্যন্তই।

এটা খাবুই আশ্চর্যের ব্যাপার যে গার্লস হাই স্কুলের একজন দরিদ্র এ্যাসিস্টেন্ট হেড মাস্টার তার পাঁচ মেয়েকেই খুব ভাল বিয়ে দিয়েছেন, অথচ মেয়েগুলি পড়াশোনা বা দেখতে শুনতে এমন কিছু না। আসিফ তার বাবা মার পাঁচ কন্যাব পরেব সন্তান। শুধুমাত্র এই কারণেই যতটুকু আদর তার পাওযা উচিত ছিল তার শতাংশও সে পাযনি। আসিফের বাবা সিরাজুদিন সাহেব তার সর্বশেষ সন্তানকে কঠিন হাতে মানুষ করতে শুরু করলেন। তাঁর এই ছেলে যে হীরেব টুকরো ছেলে এটা তিনি সবাইকে দেখিয়ে দিতে চান। অন্য বাচ্চাবা যখন এক দুই শিখছে, তখন তাঁর ছেলে শিখছে তিনের ঘরের নামতা। ক্লাস টুতে উঠেই সে রবীন্দ্রনাথের বীরপুরুষ কবিতা গোটাটা মুখস্থ বলে লোকজনদের চমকে দিতে শিখে গেল। সিবাজুদিন সাহেবও পুত্রের প্রতিভায় মুগ্ধ। বাড়িতে কেউ এলে আসিফকে তার প্রতিভার পরীক্ষা দিতে হয়। বীবপুরুষ কবিতা মুখস্থ বলবার পর সিরাজুদিন সাহেব নিজেই বলেন, আচ্ছা বাবা, তিন আঠারো কত বল তো?

আসিফ গম্ভীর গলায় বলে, চুয়ান্ন। অতিথি চমকে উঠে বলেন, আঠারোর ঘরের নামতা জানে নাকি! সিরাজুদিন সাহেব উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলেন, ইংরেজি জিজ্ঞেস করেন। বানান জিজ্ঞেস করেন। আচ্ছা বাবা, জিবাফ বানানটা কি বল তো?

আসিফ বানান বলে। অতিথি যত না চমৎকৃত হন, বাবা হন তারচে বেশি। গম্ভীর গলায় বলেন, সবই হচ্ছে ট্রেনিং। যত্ন নিতে হয়। প্রপার গাইডেন্স দরকার।

ক্লাস এইট পর্যন্ত আসিফ প্রতিটি পরীক্ষায় ফাস্ট হল। তারপর এক’দিন খুবই স্বাভাবিক গলায় বাবাকে এসে বলল, আমি আর পড়াশোনা করব না বাবা। সিরাজুদিন সাহেব হতভম্ব হয়ে বললেন, সে কি!

আসিফ সহজ স্বরে বলল, আমার ভাল লাগে না বাবা।

সিরাজুদ্দিন সাহেব থেমে থেমে বললেন, আজ আর কাল এই দু’দিন পড়তে হবে না। বিশ্রাম কর। মাঝে মাঝে বিশ্রামের প্রয়োজন আছে।

বিশ্রাম না বাবা। আমি আর পড়াশোনাই করব না।

টান দিয়ে কান ছিঁড়ে ফেলব হারামজাদা।

কান ছিঁড়ে ফেললেও পড়ব না।

সিরাজুদিন সাহেব অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

তখন তাঁর তৃতীয় মেয়ের বিয়ের আয়োজন চলছে। বাড়ি ভর্তি মেহমান। কিছু বলা বা শাসন করার মত মানসিক অবস্থা তার নেই। তিনি অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেলেন। আসিফের মা চির রুগ্না মহিলা। সংসারের কোনো ব্যাপারেই তার কোনো ভূমিকা নেই। তবু তিনি ক্ষীণ স্বরে বললেন, বাদ দাও। কয়েকটা দিন যাক। ছেলে মানুষ বয়সটা দেখবে না?

সিরাজুদিন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন আসিফ পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। সকালবেলা বের হয়। সারাদিন কোথায় কোথায় ঘোরে। সন্টার ড্রামাটিক ক্লাবে নাটকেও নাকি নাম-দিয়েছে। রাত আটটা নটা পর্যন্ত রিহার্সেল হয়। বিহার্সেল শেষ করে সে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাড়ি ফেরে। সিরাজুদ্দিন সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আর হতভম্ব হয়ে ভাবেন এসব কি হচ্ছে? হচ্ছেটা কি?

স্টার ড্রামাটিকে ক্লাবের এ্যানুয়েল নাটক হল জেলা স্কুলের মাঠে। বিরাট হৈচৈ। সিরাজুদ্দিন সাহেব নাটক দেখতে গেলেন। ত্রিপুরা রাজপরিবার নিয়ে জমকালো নাটক। তিন রাজকুমারের গল্প। বড় রাজকুমার, মধ্যম রাজকুমার এবং ছোট রাজকুমার। বড় এবং ছোট রাজকুমারের অত্যাচারে মধ্যম রাজকুমার জর্জরিত। এক’দিন তার দুচোখ নষ্ট করে দিয়ে দুই ভাই তাকে গভীর বনে ফেলে দিয়ে এল। ক্লান্ত শ্ৰান্ত মধ্যম রাজকুমার যে দিকে যেতে চায় গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়। কোনোমতে উঠে দাঁড়ায়, আবার ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় এবং কাঁদতে কাঁদতে বলে, কে কোথায় আছ? বন্ধু হও, শত্রু হও কাছে এস ভাই। দৃষ্টিহীন, ভাগ্যহীন, আত্মীয় বান্ধবহীন মধ্যম কুমার আজ পথের ধূলায়।

মধ্যম রাজকুমারের অভিনয় দেখে সিরাজুদ্দিন সাহেব অভিভূত হয়ে পড়লেন। তার চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়তে লাগল। বুকের মধ্যে হুঁ হুঁ করতে লাগল। চারদিকে প্রচণ্ড হাততালি পড়ছে। সেই শব্দ ছাপিয়ে তাঁর কানে বাজছে মধ্যমকুমারের হাহাকার কে কোথায় আছ? বন্ধু হও, শত্রু হও কাছে এস ভাই। দৃষ্টিহীন, ভাগ্যহীন, আত্মীয় বান্ধবহীন, মধ্যম কুমার আজ পথের ধূলায়।

গলায় একটা রুপার মেডেল ঝুলিয়ে আসিফ বাড়ি ফিরল। সিরাজুদিন সাহেব আগেই পৌঁছেছেন। একা একা অন্ধকার বারান্দার জায়নামাজে বসে আছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে গভীর চিন্তায় তিনি মগ্ন। আসিফ ঘরে ঢুকতেই তাঁর আচ্ছান্ন ভাব দূর হল। শান্ত গলায় বললেন, আয় আমার সাথে।

ছেলেকে তিনি বাসার পেছনের কুয়োতলায় নিয়ে গেলেন। সহজ গলায় বললেন, গলার মেডেলটা খুলে কুয়ার মধ্যে ফেল।

তার কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যে আসিফ কোনো কথা না বলে মেডেল ফেলে দিল। গহীন কুয়া। মনে হল যেন দীর্ঘ সময় পর পানিতে ঝাপ করে শব্দ হল।

সিরাজুদিন সাহেব বললেন, এখন বল, আর কোনোদিন অভিনয় করব না। বল, বল হারামজাদা।

আসিফ কিছু বলল না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সিরাজুদ্দিন সাহেব বললেন, বল, আর কোনোদিন অভিনয় করব না। নয়ত তোকে আজ খুন করে ফেলব। বল, হারামজাদা। বল।

আসিফ ক্ষীণ গলায় বলল, কেন বাবা?

বল তুই। বল। নয়ত খুন করে ফেলব।

সিরাজুদিন সাহেবের চোখে-মুখে উন্মাদ ভঙ্গি। তিনি ছেলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দুহাতে চুলের মুঠি ধরে মাথা ঝাকাতে ঝাকাতে বললেন, বল আর অভিনয় করব না। বল।

আসিফ যন্ত্রের মত বলল, আর অভিনয় করব না।

সিরাজুদ্দিন সাহেব ছেলের মাথা কুয়ার মুখের কাছে ধরলেন। হিসহিস করে বললেন, রল, আবার বল। তিন বার বল।

আসিফ বলল। গহীন কুয়া সেই শব্দ ফেরত পাঠাল। কুয়ার তল থেকে গমগমে অথচ শীতল একটি স্বর ফিরে এল। আমি অভিনয় করব না. অভিনয় করব না। করব না।

 

আসিফ তার কথা রেখেছিল। বাবা জীবিত থাকাকালীন সময়ে সে অভিনয় করেনি। তার জীবনের দ্বিতীয় অভিনয় সে করে বাবার মৃত্যুর এক বছর পর। গ্ৰাম্য কবিয়ালের একটা ভূমিকা। যে কথায় কথায় পদ বাঁধে। সেই পদ লোকজনদের বলে বলে শোনায় এবং গভীর আগ্রহে বলে, পদটা কেমন হইছে ভাইজান এটু কন দেহি। বুকের মইধ্যে গিয়া ধরে, ঠিক না? আহারে কি পদ বানিছি

হলুদ পাখি সোনার বরণ কালা তাহার চউখ,
ছোট্ট একটা পাখির ভিতরে কত্ত বড় দুঃখ
ও আমার সোনা পাখিরে। ও আমার ময়না পাখিরে।

গ্ৰাম্য গীতিকারের অভিনয় করে সে ময়মনসিংহ শহরে একটা হৈচৈ ফেলে দিল। অভিনয়ের শেষে স্টেজের পেছনে গ্লাসে করে চা খাচ্ছে, জেলা স্কুলের হেড মাস্টার সাহেব ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঢুকে বললেন, আসিফ একটু বাইরে আস তো, ডিসট্রিক জাজ ওয়াদুদুর রহমান সাহেব তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।

চা-টা শেষ করে আসি স্যার।

চা পরে খাবে আসি তো তুমি।

 

আসিফ বাইরে এসে দেখে ওয়াদুদুর রহমান সাহেব হাতে চুরুট নিয়ে বিমর্ষ ভঙ্গিতে টানছেন। তাঁর গা ঘেঁষে লম্বা রোগামতন একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটির মুখে দীঘির শীতল জলের মত ঠাণ্ডা একটা ভাব। মেয়েটি কিছু বলল না। ওয়াদুদুর রহমান সাহেব বললেন, ইয়াং ম্যান, তোমার অভিনয় দেখে আমার মেয়ে খুব ইমপ্রেসড। ওয়েল ডান।

আসিফ কি বলবে বুঝতে পারল না। ওয়াদুদুর রহমান সাহেব বললেন, আমার মেয়ের খুব ইচ্ছা তুমি এক’দিন আমাদের বাসায় এসে লাঞ্চ বা ডিনার কর। আমি নিজেও খুশি হব।

জি আচ্ছা, আমি যাব।

ভেরি গুড। ইয়াং ম্যান, পরে এক’দিন দেখা হবে, কেমন?

আসিফ জবাব দেবার আগেই লীনা বলল, আপনি আজই চলুন না। আমাদের সঙ্গে গাড়ি আছে। আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেবে। প্লিজ।

ওয়াদুদুর রহমান সাহেব শীতল গলায় বললেন, বেচারা অভিনয় করে ক্লান্ত হয়ে আছে। আজ থাক। কোনো একটা ছুটির দিনে বরং…।

না বাবা আজ। ভাল লাগাটা থাকতে থাকতে ওকে বাসায় নিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। আপনার কি খুব অসুবিধা হবে? প্লিজ আসুন না, প্লিজ।

আসিফ গেল। ওয়াদুদুর রহমান সাহেবের পরিবারের অন্য সবার সঙ্গে এক টেবিলে বসে ভাত খেল।

ওয়াদুদুর রহমান সাহেবের স্ত্রী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন–বাবা কি করেন? ভাই-বোন ক জন? বোনদের কোথায় বিয়ে হয়েছে? সে কি পড়ছে? ম্যাট্রিক রেজাল্ট কি?

আই. এ. তে কি রেজাল্ট?

লীনা এক সময় বিরক্ত হয়ে বলল, চুপ কর তো মা! কি শুধু উকিলের মত প্রশ্ন করছি। ওকে ভাত খেতে দাও।

মা চুপ করলেন না। প্রশ্ন করা ছাড়াও তাঁর পরিবারের সমস্ত তথ্য দিয়ে দিলেন। তার তিন মেয়ে এক ছেলে। ছেলে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট, পড়ছে নিউ জার্সি স্টেট কলেজে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। জামাই ডাক্তার। সম্প্রতি এফআরসিএস করেছে। এখন আছে পিজিতে। লীনা দ্বিতীয় মেয়ে। ম্যাট্রিকে চারটা লেটার এবং স্টার মার্ক নিয়ে ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে ফিফথ হয়েছে। আইএ তে খুব ভালো করতে পারেনি। সায়েন্স থেকে আর্টস-এ আসায় একটু অসুবিধা হয়েছে। তবু ফাস্ট ডিভিশন ছিল। এখন পড়ছে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। হলে থাকে। গরমের ছুটি কাটাতে এসেছে। ছোট মেয়েকে শান্তিনিকেতনে দিয়েছিলেন। কলাভবনের ছাত্রী। তবে ওর সেখানে থাকতে ভাল লাগছে না। গরমের সময় খুব গরম পড়ে। মেয়ের আবার গরম সহ্য হয় না।

ফেরার পথে লীনা তাকে গাড়িতে তুলে দিতে এল। নরম গলায় বলল, মা নিজেদের কথা বলতে খুব পছন্দ করেন। আপনি আবার কিছু মনে করলেন না তো?

আসিফ বলল, না। কিছু মনে করিনি।

আমি আপনার জন্যে একটা উপহার এনেছি। সবার সামনে দিতে লজ্জা লাগল। আপনি যদি এটা নেন আমি খুব খুশি হব। আপনার অভিনয় আমার কি যে ভাল লেগেছে। অনেক’দিন ধরেই আমার মনটা অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে ছিল। হঠাৎ সেখানে এক ঝলক আলো পড়ল। খুব কাব্য করে কথা বলে ফেলেছি। কিছু মনে করবেন না, এই নিন।

শাড়ির আঁচলের ভাঁজ থেকে লীনা কালো রঙের কি যেন বের করল। আসিফ বলল, এটা কি?

নটরাজের একটা মূর্তি। আমার ছোটবোন শান্তিনিকেতন থেকে আমার জন্যে এনেছিল। আমার খুব প্রিয়। আপনি নিন। আপনার টেবিলে সাজিয়ে রাখবেন। প্লিজ, প্লিজ।

তখন আসিফের বয়স ছিল অল্প। হৃদয় আবেগে পরিপূর্ণ। রাতটাও ছিল অন্য রকম। চৈত্র মাসের রহস্যময় রাত। চারদিকে উথালি পাথাল চাঁদের আলো। পাশে নটরাজের মূর্তি হাতে দেবীর মত এক তরুণী। তরুণীর কণ্ঠস্বর বড় স্নিগ্ধ। আসিফের চোখে জল এসে গেল। সেই জল গোপন করার কোনো চেষ্টা সে করল না। কেন যেন তার মনে হল, এই নারীর কাছে তার গোপন করার কিছুই নেই। এই নারী সর্বজ্ঞ ঈশ্বর।

নটরাজের মূর্তি আসিফ নিজের কাছে রাখেনি। রুপার মেডেলের মত মূর্তিটি সে কৃয়ায় ফেলে দিয়েছিল। কেন সে এটা করল? পৃথিবীর মতো, চৈত্র মাসের চাঁদের মত, গহীন অরণ্যের মত মানুষও রহস্যময়।

 

ঘুমুচ্ছিস নাকি রে আসিফ?

আসিফ চমকে উঠল। সে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল। তার বেশ লজ্জা লাগছে। ভাগ্নির এত বড় একটা অপারেশন হচ্ছে, আর সে কি না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিচেচ্ছ। রেহানা বললেন, অপারেশন হয়ে গেছে। পুতুল ভালো আছে। জ্ঞান ফিরেছে, কথা-টথা বলল।

‘বাহ চমৎকার তো! তুমি এখন রেস্ট নাও আপা। খুব ধকল গেছে।

রেহানা ক্লান্ত ভঙ্গিতে আসিফের পাশে বসল। ক্লিনিকের এই ঘরটা এখন প্ৰায় ফাঁকা। আত্মীয়স্বজন যারা এসেছিল সবাই চলে গেছে। আসিফের মেঝ বোন এখনো আছে। সে দাড়িয়ে আছে ইনটেনসিভ কেয়ার ঘরটার পাশে। তারও চলে যাবার কথা। গাড়ি গিয়েছে। একজনকে নামিয়ে দিতে। গাড়ি এলেই সেও চলে যাবে। এখানে থাকার আর কোনো মানে হয় না।

রেহানা বলল, আসিফ তুই কী করবি? থাকবি না চলে যাবি?

আমার অসুবিধা নেই, থাকতে পারি।

তোর খিদে লেগেছে বোধ হয়। রাতে তো খাসনি।

না খিদে লাগেনি।

তোর বউ কেমন আছে?

ভালই।

অনেক দিন দেখি না। তোরা আসিস না কেন?

ব্যস্ত থাকি।

নাটক নিয়ে ব্যস্ত?

হুঁ।

কে যেন বলছিল— বউকেও নামিয়েছিস। এসব কি কাণ্ড বল তো। নিজে যা করছিস তাই যথেষ্ট, তার ওপর যদি…

আসিফ কিছু বলল না। হাই তুলল। রেহানা বললেন, নাটক নাটক করে তোর লাভটা কি হয়েছে এমন তো না যে দশটা লোক তােকে চেনে। তার তো কিছুই হয়নি।

তা ঠিক।

এই জীবনের কোথাও স্থির হতে পারলি না। আজ এই চাকরি, কাল ঐ চাকরি। তোর বয়স হচ্ছে না?

হচ্ছে।

বয়স হলে মানুষের একটা সিকিউরিটির দরকার হয়। একটা বাড়ি। কিছুটাকা পয়সা… তোর আছে কি?

এইসব বাদ দাও।

‘বাদ দাও বললেই বাদ দেয়া যায়? এই যে পুতুলের অপারেশন হল – বারো-তের হাজার টাকা খরচ হয়েছে। টাকা ছিল বলে খরচ করতে পেরেছি। যদি না থাকত? তোর এই রকম কিছু হলে তুই কি করবি?

কি আর করব? হাসপাতাল যাব। বিনা পয়সায় চিকিৎসার চেষ্টা করব।

তুই হয়ত ভাবিস তোকে নিয়ে আমরা চিন্তা-ভাবনা করি না। এটা ঠিক না। প্রায়ই আমাদের বোনদের মধ্যে আলোচনা হয়। খুবই কষ্ট লাগে।

কষ্ট লাগার কি আছে?

কষ্ট লাগার কিছু নেই? কি বলছিস তুই! একটা বাড়িতে থাকিস, সেই বাড়ির রান্নাঘর অন্য একজনের সঙ্গে শেয়ার করতে হয়। এটা কেমন কথা?

সবার তো সব কিছু হয় না।

চেষ্টা করলে ঠিকই হয়। চেষ্টা না করলে হবে কিভাবে? কোনো রকম চেষ্টা নাই, বড় হবার ইচ্ছা নাই—নাটক, নাটক, নাটক।

এই সব বাদ দাও আপা, দেখি চা পাওয়া যায়। কিনা। মাথা ভার ভার লাগছে। চা খেলে ভাল লাগবে।

রাত দুপুরে চা পাবি কোথায়? চুপ করে বোস। তোর সঙ্গে দেখাই হয় না। সুযোগ পাওয়া গেল।

আসিফ সিগারেট ধরাল। তার সত্যি সত্যি ঘুম পাচ্ছে। সিগারেটের ধোঁয়া দিয়েও ঘুম তাড়ানো যাচ্ছে না। রাত জাগার জন্যই বোধ হয় প্রচণ্ড খিদেও লাগছে। খালি পেটে সিগারেট–নাভিতে পাক দিচ্ছে। মনে হচ্ছে বমি হয়ে যাবে।

আসিফ।

বল আপা।

তুই আমাকে একটা সত্যি কথা বল তো।

বেশির ভাগ সময়ই আমি সত্যি কথা বলি।

তোর কি এখন চাকরি নেই?

এই কথা বলছি কেন?

তুই তোর দুলাভাইকে বলেছিস তোর জন্যে একটা কিছু দেখে দিতে। এই থেকে অনুমান করছি। তোর কি চাকরি নেই?

না নেই।

ক’দিন ধরে নেই?

মাস দুই।

তোর বউ জানে?

জানবে না কেন? জানে।

তবু তুই নাটক কারবি? এর পরেও তোর শিক্ষা হয় না? তুই কি মানুষ না জানোয়ার?

রেহানা উঠে চলে গেলেন। আসিফ একা একা বসে রইল।

বেশিক্ষণ একা বসে থাকতে হল না। রেহানা আবার এসে ঢুকলেন। তিনি খুব কঠিন কিছু কথা বলতে এসেছিলেন… বলতে পারলেন না। আসিফের বসে থাকার ভঙ্গিটি দেখে তার খুব মায়া লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *