একটানা এতক্ষণ কথা বলে আদিনাথ চক্রবর্তী একটু থামলেন। বর্ষণমুখর রাত্রির জলভেজা বাতাস ক্রমাগত দুলিয়ে চলেছে ঝুলন্ত লণ্ঠনটা, সেইসঙ্গে দেয়ালে নড়ছে ঘরে বসে থাকা মানুষদের ছায়া। আড্ডায় মাঝে মাঝে একটা সময় আসে যখন হঠাৎ সবাই একসঙ্গে চুপ হয়ে যায়। জমাট গল্পেরও একটা মহিমা আছে। সে গল্প সত্য, মিথ্যা বা অবিশ্বাস্য যাই হোক না কেন, ভাল করে বলতে পারলে শ্রোতারা মুগ্ধ হয়। আদিনাথ কথক হিসেবে প্রথম শ্রেণীর, নিতান্ত তুচ্ছ বিষয়কেও বলার গুণে মনোমুগ্ধকর করে তুলতে পারেন। আজ রাতের পরিবেশ আর তার গল্প এমন খাপ খেয়ে গেল যে, আচ্ছাধারীরা কেউ কোনো তর্ক তুলল না। কেবল সরসী চাটুজ্জে বললেন-আপনার ঠাকুমার মৃত্যুবিষয়ে ওই ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যাওয়াটা অবশ্য আমি খুব আশ্চর্য কিছু বলে মনে করছি না, কারণ এই কথাটা বাড়ির কেউ নিশ্চয় তাঁকে মুখ ফসকে বলে ফেলে থাকবে। ফলে আপনার ঠাকুমা মনের দিক দিয়ে পনেরোই ফায়ুন তারিখের প্রসঙ্গে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। বয়েস অনেক হয়েছিল, কাজেই ওই বিশেষ তারিখে হয়ত মানসিক উত্তেজনা সামলাতে পারেন নি। তার মনই তাকে নির্দেশ দিয়েছিল দেহরক্ষা করতে। এমন হয়, আমি শুনেছি। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া বিষ্ণুমূর্তি ফিরে পাওয়াটা ব্যাখ্যা করা কঠিন। তাছাড়া সবকিছুর যে ব্যাখ্যা থাকতেই হবে তার কী মানে আছে। কিছু কিছু আবছা আড়াল থাক না, তাতে জীবন সরস হয়ে ওঠে।
রাম গাঙ্গুলি বললেন—সব জিনিসের ব্যাখ্যা হয় না। আমার আপন ভায়রাভাই। তার মামাবাড়ির গ্রামে নিজের চোখে আঁতুড়ের ছেলেকে হেঁটে বেড়াতে দেখেছে, জানো? সে অত্যন্ত সাত্ত্বিক প্রকৃতির মানুষ, অকারণে মিথ্যে কথা বলবে না। সদ্যোজাত ছেলে—সবে নাড়ি কাটা হয়েছে—সে হাঁটছে আর খিলখিল করে হাসছে। আচ্ছা। ভায়রাভাইয়ের কথা না হয় বাদই দাও, আমার ছোটবেলায় আমি এমন একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখেছি যা শুনলে তোমরা বিশ্বাসই করবে না।
পতিরাম মজুমদার আদিনাথের কাহিনী শেষ হলে পরিত্রাণের আশা করেছিলেন, এবং সম্প্রতি বাড়ি ফেরবার উদ্যোগ হিসেবে চাদর কাঁধে ফেলে লাঠির খোঁজ করছিলেন। আর একটা অপ্রাকৃত গল্প শুরু হতে চলেছে দেখে তিনি কাতর স্বরে বললেন—আর নয়, আজ আর নয়! এবার সবাই উঠে পড়া যাক, চল। পথ তো কম নয়, আমায় যেতে হবে সেই পশ্চিমপাড়া। তাছাড়া সরসীভায়ারও তো খাওয়াদাওয়া আছে।
সরসী চাটুজ্জে হেসে বললেন—আমার খাওয়ার এখনো ঢের দেরি। শোনাই যাক না গল্পটা। বাকিদের কী মত?
সকলে বললেন-গল্প হোক! গল্প হোক!
‘ওমাঃ!’ বলে হতাশ ভঙ্গিতে পতিরাম দেয়ালে ভর দিয়ে এলিয়ে বসলেন।
রাম গাঙ্গুলি বললেন—আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা বলছি। তখন আমার বয়েস আর কত হবে, ধর কুড়ি কী বাইশ। সে বয়েসে আমি যে কী ডানপিটে ছিলাম, যারা আমাকে এখন দেখছ তারা ধারণাও করতে পারবে না। পেটের গোলমাল আর হাঁটুর বাত আমাকে অকেজো করে দিয়েছে, নইলে আট-দশ বছর আগেও আমি নিমগাছে উঠে দাঁতন পেড়েছি। যাই হোক ঘটনাটা বলি। আমার কৈশোরের বেশ কয়েকবছর আমাকে মামাবাড়িতে কাটাতে হয়েছিল। দাদামশায় ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ, পণ্ডিত মানুষ। মামারাও সবাই লেখাপড়া জানা। আমার বাবা তখন জরিপ বিভাগে কাজের সূত্রে তরাইয়ের জঙ্গলে কর্মরত। বাড়ির কাছে কোনো ভাল স্কুল নেই, বাবা বছরে দু-একবার ছুটি নিয়ে বাড়ি আসেন। এমন অবস্থায় আমার পড়াশুনো হওয়া কঠিন দেখে মা আমাকে মামাবাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। দাদুর কাছে আমার লেখাপড়ার শুরু। ইংরিজি জানিনে বটে, কিন্তু ব্যাকরণ আর বেদান্তে আমি অল্পবয়েসেই কিছুটা অধিকার অর্জন করেছিলাম। যে বছর পড়া সাঙ্গ করে বাড়ি ফিরে আসি, সে বছর কালীপূজোর সময় আমার এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
মামাবাড়ির গ্রামের উত্তরে ছিল পুঁটি নদী। নদীর খাত চওড়া, কিন্তু পলি পড়ে তার স্রোত ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। দক্ষিণ আর পশ্চিমে বিশাল এক জলাভূমি গ্রামটাকে বাইরের জগৎ থেকে পৃথক করে রেখেছে। প্রায় দ্বীপের মত এই গ্রাম থেকে বাইরে যাবার একমাত্র ভাল রাস্তা পূবদিক দিয়ে। আর একটা পথ জলার ভেতর দিয়ে অনেক ঘুরেফিরে মহকুমা শহরে যাবার পাকা সড়কে পড়েছে বটে, কিন্তু সে পথ বিশেষ কেউ ব্যবহার করে না। নানান ভৌতিক কাহিনীর গুজব চালু ছিল জলাভূমিটা সম্বন্ধে। নরম কাদা, নলখাগড়ার বন, উলুঘাসের আর হোগলার জঙ্গল আর মাঝে মাঝে এক একটা জায়গায় একটু ঘাসজমি, তাতে একটা-দুটো বড় গাছ, এই নিয়ে সে জলাভূমির বিস্তার। আমি আর আমার প্রাণের বন্ধু তিনকড়ি—সেও ছিল আমারই মত ডানপিটে আর নির্ভীক—এই জলাভূমির মধ্যে বেড়িয়ে বেড়াতাম। সেসব দিনের কথা মনে এলে এখন বুকের মধ্যেটা কেমন করে ওঠে। মাথায় কোনো চিন্তার ভার নেই, কারো সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ নেই, মনে কেবল নির্মল আনন্দ, চোখে অল্পবয়েসের স্বপ্ন। অমন সব দিন আর আসবে না।
সে বছর কালীপূজো পড়েছিল বেশ দেরি করে, কার্তিকের মাঝখান পেরিয়ে। বাতাসে হিমের ছোঁয়া লেগেছে, বিকেলের পড়ন্ত বরাদুরে সোনার রঙ। সন্ধে নামছে সূর্যাস্তের পরেই। এই পরিবেশে আমাদের দুই বন্ধুর জলাভূমির ভেতর ঘুরে বেড়াতে খুব ভাল লাগত। অনেকসময় দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে বেরিয়ে পড়তাম, ফিরতাম রাতের প্রথম প্রহর পার করে। ছোট ছোট ঘাসজমিগুলোতে সরু আলের মত পথ বেয়ে গিয়ে গাছের তলায় শুয়ে বসে গল্প করতাম। সবগুলোতে যাওয়া যেত না, কোনো কোনোটায় যাবার পথ ছিল। ঠিক পথ বলা যায় না, বুড়ো আঙুলে ভর করে ডিঙি মেরে মেরে চলে যেতাম কোনোভাবে। সমস্ত জলাটা আমাদের নখদর্পণে ছিল। বিশেষ মজা হত চাদনি রাত্তিরে। ওই জলাজমি, নলখাগড়া আর উলুঘাসের বন, হালকা জ্যোৎস্নায় বড় বড় গাছের ছায়া—সব মিলিয়ে রূপকথার রাজ্য তৈরি করত। আর ওই বয়েস—বুঝতেই পারছ, জীবনে তা একবারই আসে। যেন মেঘের ওপর ভেসে বেড়াতাম তখন।
কালীপূজোর ঠিক আগের দিন, সেদিন ভূতচতুর্দশী, তিনকড়ি সকালের দিকে আমাকে এসে বলল—রাম, চল আজ বিকেলে জলার ভেতর বেড়াতে যাই। একেবারে সন্ধের পর একটু রাত্তির করে ফিরব। আজই রাত্তিরে অমাবস্যা লাগবে, এত অন্ধকারে কখনো ওখানে বেড়াই নি। পথঘাট তো সবই আমাদের চেনা। যাবি?
সত্যিই, পুরো জলাভূমিটা আমরা নিজেদের হাতের তালুর মত চিনতাম। সন্ধে হয়ে গেলেও অসুবিধের কোনো কারণ নেই। আমি রাজি হয়ে গেলাম।
একটু পড়ন্ত বেলায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম। গ্রাম ছাড়িয়ে আরো মাইলখানেক হেঁটে এসে পড়লাম জলাভূমির প্রান্তে। তখন সূর্য অস্ত গিয়েছে, দিনের আলো মিলিয়ে গিয়ে নামছে আবছায়া অন্ধকার। তিনকড়িকে বললাম—হারে ভেতরে ঢুকবি? নাকি এইখানে বসে কিছুক্ষণ গল্প করে ফিরে যাই চল–
তিনকড়ি হেসে বলল-কেন, ভয় করছে বুঝি?
—যাঃ, ভয় কীসের? আজ অমাবস্যা পড়ছে, একেবারে অন্ধকার হয়ে যাবে কিন্তু–
—তার মানেই তো ভয় পাচ্ছিস। দূর, চল দেখি। অন্ধকারেই তো মজা। আয়—
এরপর না গিয়ে উপায় থাকে না। ঢুকলাম জলার ভেতরে। চারদিকে প্রায় মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে হোগলার ঝোপ। বোধহয় সেইজন্যই সেখানে অন্ধকার নামছে একটু : তাড়াতাড়ি। হালকা ধোঁয়ার মত একটা অস্পষ্ট কুয়াশা ঘনাচ্ছে। হেমন্তকালের শুরু, এই সময়ে সন্ধেবেলা বাতাস বয় না, কিন্তু লম্বা ঝোপগুলোর মধ্যে বাতাস বয়ে যাওয়ার মত একটা শী শী আওয়াজ হচ্ছে। সেটা অবশ্য আমার মনের ভুলও হতে পারে। খুব নির্জন জায়গায় কানের ভেতর রক্ত চলাচলের শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যায়, মনে হয় শব্দটা যেন বাইরে থেকে আসছে।
ভয় ঠিক করছিল না, কিন্তু অন্যদিন জলার ভেতরে ঘুরে বেড়াবার সময় মনে যে সহজ ফুর্তির ভাব থাকে সেটা অনুভব করছিলাম না। পরিবেশে কেমন যেন বিষণ্ণ ভাব, কী একটা যেন ঘটতে চলেছে, সমস্ত জায়গাটা তার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। মনে পড়ল আজ ভূতচতুর্দশী, দুপুরে চোদ্দশাক ভাজা দিয়ে ভাত খেয়েছি। এতক্ষণে বাড়িতে দিদিমা চোদ্দ পিদিম দেবার জন্য প্রদীপ গোছাচ্ছেন, সলতে পাকাচ্ছেন। দিদিমা বলতেন-ভূতচতুর্দশীর দিন সন্ধের পর চোদ্দজন ভূত বাতাসে ভর করে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়, তাদের খপ্পরে পড়লে ভারি মুশকিল। এদিন অন্ধকার নামার পর আর কোথাও যাবিনে, ঘরে থাকবি। ভূতেদের নামও বলতেন—আরমুই, ছারমুই, পোড়ামুই, অন্তাই, দন্তাই, খন্তাই, বরী, ঠরী—আরো কী কী যেন, সবগুলো মনে পড়ছে না। বাড়িতে বসে এসব শুনলে হাসি পায়, এখানে গা ছমছম করে।
কিছুদূর হাঁটবার পর বাঁদিকে একটা সরু পথ ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে ঢুকেছে। দুদিকে জল-কাদা আর নরম ভদ্ভসে জমি, মাঝখানে আট-দশ আঙুল চওড়া একটু পথ জেগে রয়েছে। জলার মধ্যে কয়েকটা ঘাসে হাওয়া জমির টুকরো দ্বীপের মত জেগে আছে তা তো আগেই বলেছি। এই পথটা তেমন একটা দ্বীপে গিয়ে শেষ হয়েছে। আমরা সাবধানে পা ফেলে ঘাসজমিটায় গিয়ে হাজির হলাম। তখন দিনের আলো পুরোপুরি নিভে রাত্তির নেমেছে।
দ্বীপটা লম্বায় কুড়ি হাত, চওড়ায় পনেরো হাত মত হবে। মাঝখানে একটা বড় গাছ ঠেলে উঠেছে ওপরদিকে। তার মোটা গুড়িতে হেলান দিয়ে তিনকড়ি বসল, আমি বসলাম মুখোমুখি। অমাবস্যার রাত্তিরেও নক্ষত্রদের থেকে চুইয়ে আসা ক্ষীণ একটু আলোর আভাস থাকে, সে আলো অন্ধকার দূর করে না, পরিবেশকে আরো রহস্যময় করে তোলে।
তিনকড়ি বলল—আয়, নিধুবাবুর একখানা গান ধরা যাক। সেই যে গানটা যে খাতনা যতনে, আমার মনই জানে। গাইবি? নে, শুরু কর
আমার গাইতে ইচ্ছে করছিল না। তিনকড়ি বেশ ভাল গান জানত, সে একাই গান ধরল। হঠাৎ আমার মনে হল তিনকড়ি আসলে ভয় পেয়েছে। প্রথমে সাহস দেখিয়ে এখন সে ভয়টা স্বীকার করতে লজ্জা পাচ্ছে। গান গাওয়াটা প্রকৃতপক্ষে তার ভয় কাটানোর চেষ্টা। কিন্তু কেন ভয় পেল তিনকড়ি? পরিবেশের অদ্ভুত বিষণ্ণতা আর দমচাপা ভাবটা কি সে ধরতে পেরেছে?
দু-একলাইন গাইবার পর তিনকড়ি থেমে গিয়ে আমাকে বলল—গতকাল এই জলার দিকে অনেক রাত্তিরে একরকম আশ্চর্য আলো দেখতে পাওয়া গিয়েছে, জানিস?
—আলো? কী রকম আলো? এতক্ষণ বলিসনি তো
—এমনিই বলিনি। আমাদের গ্রামের অনেকেই দেখেছে। আজ সকালে মধু মিত্তির, হারাধন মজুমদার আর বিশু খুড়ো আলোচনা করছিল পথে দাঁড়িয়ে, তাই শুনছিলাম।
—কী বলছিল? নিজেরা দেখেছে?
—মধু মিত্তির আর বিশু খুড়ো দেখেছে। নীলচে মত আলো, আকাশ থেকে গোলার মত নেমে এসে মাটির কাছে দপ্ করে জ্বলে উঠে অনেকখানি জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। হারাধন মজুমদার বলছিল কাল রাতে এই জলায় ডাইনিদের চাতর বসেছিল
-সে আবার কী?
-চাতর মানে আসর। দূর দূর দেশ থেকে ডাইনিরা গাছ চালিয়ে উড়ে আসে। তারপর সারারাত ধরে তাদের সভা চলে। ওই সভাকেই বলে চাতর। গাছ-চালা কাকে বলে জানিস তো? কোনো বড় গাছের ডালে বসে ডাইনিরা হুকুম করে–অমুক জায়গায় চল। অমনি সে গাছ আকাশে উড়ে সেই জায়গায় গিয়ে হাজির হয়। উড়তে উড়তে গাছ যখন মাটির কাছে নেমে এসে লেগে বসে, তখন ওইরকম দ করে নীল আলো জ্বলে ওঠে। আমি অবশ্য এসব বিশ্বাস করি না-ওরা বলছিল, আমি শুনলাম—এই আর কী। বিশু খুড়ো আবার সন্ধের পর আফিং খায়। বুঝতেই পারছিস–
কথা বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে তিনকড়ি একবার ওপরদিকে তাকাল, কী একটা জিনিস যেন তার মনে পড়ে গিয়েছে। তারপর সোজা হয়ে বসে পেছন ফিরে সে গাছটায় হেলান দিয়ে দিল, তার মোটা গুড়িতে একবার হাত বোলালো। এবার সে ঘুরে আমার দিকে যখন তাকাল, সেই অল্প আলোতেও দেখলাম তার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে, ভয় পেলে মানুষের যেমন হয়।
বললাম—কী রে, কী হল তোর? নিজের গল্পে নিজেই ভয় পেলি নাকি?
ফিসফিস করার মত গলায় তিনকড়ি বলল—রাম, এই গাছটা কোথা থেকে এল? এটা তো আগে কখনো দেখিনি। তাছাড়া কী গাছ এটা?
এবার আমিও অবাক হয়ে গাছটার দিকে তাকালাম। সত্যিই তো, এই জমির টুকরোটায় মোটামুটি বড় গাছ বলতে একটা গাব আর একটা মাঝারি তেঁতুল গাছ বরাবর দেখে এসেছি। সে দুটো তো ওই যথাস্থানে দেখা যাচ্ছে। তাহলে বাড়তি এটা আবার কোথা থেকে এল? গাছটাই বা কী জাতের? আমরা গ্রামের ছেলে, সবরকম গাছই চিনি। বড় বড় শালগাছের মত পাতাওয়ালা এটা কোন গাছ? মাটি থেকে বিরাট মোটা গুঁড়ি সোজা আকাশের দিকে উঠেছে, বিশেষ জটিল ডালপালা নেই। অনেকটা ওপরে কিছু শাখাপ্রশাখা এদিক-ওদিক ছড়িয়েছে, তাতে থালার মত বড় বড় গোল গোল পাতা। দেখলেই মনে হয়—এ বাংলাদেশের গাছ নয়!
তিনকড়ি একইরকম ভয় পাওয়া গলায় বললভেবে দেখ, দিনসাতেক আগেও এখানে বসে আমরা আড্ডা দিয়ে গিয়েছি, এই গাছটা তো দেখিনি। এখানে কেন, গ্রামের ত্রিসীমানায় এমন গাছ দেখেছিস কখনো? এ হল ভিনদেশের গাছ–
তারপর কাপাকাপা গলায় বলল-রাম, বিশু খুড়োরা ঠিকই দেখেছিল। এখানে ডাইনির চাতর হয়েছে কাল। এই গাছ তারাই উড়িয়ে এনেছে। চল, আমরা এখান থেকে চলে যাই—
কী করে যে ফিরে এলাম তা আর তোমাদের কী বলব! চেনা জায়গা, ছোটবেলা থেকে খেলা করে মানুষ হয়েছি ওই জায়গায়, কিন্তু সেদিন যেন কেবলই পথ হারিয়ে ফেলতে লাগলাম। যেদিকেই যাই, দেখি বেরুবার পথ নেই। রাস্তা আবার ঘুরে একই বিন্দুতে এসে হাজির হয়েছে। রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, বুঝলে? অত্যন্ত আবছা তারার আলো, লম্বা ঘাসের জঙ্গল, একটু পা ফেলতে ভুল হলেই কোমর পর্যন্ত কাদায় গেঁথে যাবার সম্ভাবনা, তার সঙ্গে হেমন্তকালের অস্বচ্ছ কুয়াশার পাক খাওয়া—সব মিলিয়ে যেন একটা ভয়ের স্বপ্ন। কোনোরকমে জলাভূমির বাইরে শক্ত জমিতে এসে যখন পা দিলাম তখন। আমরা দুজনেই ঘামছি।
হন্হন্ করে হেঁটে প্রায় যখন গ্রামে পৌঁছে গিয়েছি, একবার কেন যেন তিনকড়ি পেছন ফিরে তাকাল। তারপরেই থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে আমাকে বলল দেখ রাম, দেখ! কী কাণ্ড!
তাকিয়ে দেখলাম সেদিকে আকাশটা অদ্ভুত নীল রঙে ভরে গিয়েছে। তীব্র আলো নয়, মৃদু জ্যোৎস্নার মত আভা। আর তার মধ্যে দিয়ে কী একটা জিনিস যেন জলার ভেতর থেকে উঠে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। ভাল করে বুঝতে না বুঝতে জিনিসটা আলোর পরিধির বাইরে চলে গেল। আমরা দুজন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আলোটাও একটু একটু করে ম্লান হয়ে শেষে মিলিয়ে গেল।
গ্রামে ঢুকে দেখলাম বেশ হই চই শুরু হয়ে গিয়েছে, অনেক মানুষ বেরিয়ে এসেছে বাইরে। কে যেন গাড় হাতে মাঠে যাবার সময় দক্ষিণ-পশ্চিম দিগন্তে নীল আলোটা দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে লোজন ডাকে। একেবারে মিলিয়ে যাবার আগে অন্তত সাতআটজন মানুষ দেখেছে আলোটা। যারা পরে বেরিয়েছে, তারা এখন প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে বিবরণ শুনছে। বিশু ভটচাজ বলছেন—পরপর দুদিন! আর নিশ্চয় তোমরা অবিশ্বাস করবে না—এখন তো নিজের চোখে দেখলে? কালকেই তোমরা বলেছিলে আমি আফিঙের ঝেকে খেয়াল দেখেছি। আজ নিশ্চয় আর তা বলবে না? আগামীকাল কালীপূজা, রক্ষেকালীর মন্দিরে ভাল করে পূজো দাও সবাই। এসব ভাল লক্ষণ নয়—
রঘু চৌধুরী বললেন–ঠিকই। আজ হচ্ছে ভূতচতুর্দশী-ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি আজ সন্ধের পর থেকে প্রেতের দল বাতাসে মিশে ঘুরে বেড়ায়। তোমরা তো কেউ আজকাল কিছু মানো না, আধুনিক যুগ এসেছে, শহরে শুনছি তেলের বদলে গ্যাসের আলো জ্বলছে রাস্তায়। এখন বুঝে দেখ বুড়োদের কথা সত্যি না মিথ্যে।
এই গোলমালে কেউ খেয়াল করেনি আমরা বাইরে থেকে এসে গ্রামে ঢুকেছি। নইলে বকাঝকা খেয়ে মরতে হত। পরের দিন কালীপূজো, কথা রইল তিনকড়ি আর আমি বিকেল তিনটে নাগাদ রক্ষাকালীর মন্দিরের সামনে দেখা করব।
পরের দিন যথাসময়ে মন্দিরের সামনে গিয়ে দেখি তিনকড়ি আমার আগেই এসে হাজির হয়েছে। মন্দিরে আজ সারারাত ধরে পূজো হবে, তার প্রস্তুতি চলেছে পুরোদমে। তিনকড়ি আমাকে একদিকে টেনে নিয়ে গিলে বলল-রাম, চল আমরা জলার দিকটা। আজ একবার ঘুরে আসি। দিনের বেলা তো কোনো ভয় নেই। কাল কী দেখতে কী দেখেছি
—নীল আলোটা তো সত্যি। আমরা ছাড়াও গ্রামের কত লোকে দেখেছে—
একটু ভেবে তিনকড়ি বলল—তবু চল যাই। বেলা থাকতে থাকতে ফিরে আসব।
গতকাল অত ভয় পেয়েছিলাম, আজই আবার সেখানে রওনা হলাম দুজন মিলে। সেই বয়েসে সবই সম্ভব ছিল। তাছাড়া ঝকঝকে সূর্যের আলোয় অপ্রাকৃত ভয় থাকে না। জলার ভেতরে ঢুকে আজ প্রথমেই যেটা অনুভব করলাম তা হ’ল কাল রাত্তিরের সেই দমবন্ধ-করা ভয়ের পরিবেশটা আর নেই। কেবল দিনের আলো রয়েছে বলে নয়, অমঙ্গলের প্রভাবটাই ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। বাঁদিকের সরু পথটা দিয়ে হোগলাবনে ঢুকে ঘাসজমির দ্বীপে পৌঁছে আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
বড় গাছটা সেখানে নেই।
নেই মানে একেবারেই নেই। আমরা এগিয়ে গিয়ে জমি পরীক্ষা করে দেখলাম। বড় একটা গাছ উপড়ে ফেললে তো সেখানে তার চিহ্ন থাকবে, মাটিতে তার গর্ত থাকবে—কিছু নেই। দিব্যি সমান ঘাসে ছাওয়া জমি। গেল কোথায় অত বড় গাছটা? যেভাবে এসেছিল সেভাবেই কি ফিরে গিয়েছে? ওই গাছটাকেই কি কাল রাত্তিরে আমরা আকাশে উঠে যেতে দেখেছিলাম?
বললাম–তিনু, কাল আমরা আলো-আঁধারিতে ভুল দেখিনি তো? হয়ত গাছ-টাছ কিছু ছিল না, সবটাই আমাদের চোখের ভুল। হতে পারে তো, তাই না?
তিনকড়ি দৃঢ় গলায় বললনা, হতে পারে না। কারণ আমি গাছটায় হেলান দিয়ে বসেছিলাম। জিনিসটার বাস্তব ছোঁয়া পেয়েছি। তাছাড়া
শার্টের পকেট থেকে একটা সবুজরঙের ভাজকরা কী জিনিস বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল—তাছাড়া এইটে। এইটে তো আর মিথ্যে নয়, চোখের ভুল নয়—
গতকাল রাত্তিরে দেখা ভূতুড়ে গাছের একখানা পাতা।
তিনকড়ি বলল—কী ভেবে একখানা পাতা পকেটে রেখে দিয়েছিলাম। নিচেই পড়ে ছিল।
আমরা দুজনে মিলে অনেক খুঁজলাম। নাঃ, আর একটাও পাতা পড়ে নেই। সমস্ত চিহ্ন নিয়ে গাছটা মিলিয়ে গিয়েছে? কেবল তিনকড়ির রেখে দেওয়া পাতাটা ছাড়া। গ্রামে ফিরে এসে অনেককে পাতাটা দেখিয়েছিলাম, কেউ চিনতে পারেনি। বহুবছর বাদে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম ওটা কী গাছের পাতা। কাশী গিয়েছিলাম বিশ্বনাথ দর্শন করতে। একদিন সেখান থেকে দেবী মহাকালীর পূজো দিতে গিয়ে পাহাড়ের কোলে জঙ্গলের মধ্যে ওই গাছ দেখি। যে পাণ্ডা আমাদের সঙ্গে ছিল, তাকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল—ওই বড় গাছটা? ওর নাম বাবু বুদ্ধ নারিকেল। বিহার আর উত্তরপ্রদেশের জঙ্গলে দেখা যায়–
বললাম-বাংলাদেশে হয় না?
—না বাবু। শুকনো পাথুরে মাটি ছাড়া বুদ্ধ নারিকেল জন্মায় না।
পরে অনেককে জিজ্ঞাসা করে জেনেছি সত্যিই ওই গাছ বাংলায় হয় না। পাণ্ডার কথা শুনে আমার মনে পড়ে গেল ফেলে আসা প্রথম যৌবনের স্মৃতি। সেই মামাবাড়ির গ্রাম, ভূতচতুর্দশীর নিকষ কালো রাত, বন্ধু তিনকড়ি। সব কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে। মামারা কেউ আর বেঁচে নেই, তাদের ছেলেপুলেরাও একজন ছাড়া সবাই জীবিকার সন্ধানে ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন জায়গায়। আর কখনো সে গ্রামে যাইনি। তিনকড়িও এখন কোথায় আছে কে জানে। অনেকদিন তার সঙ্গে যোগাযোগ নেই।
রাম গাঙ্গুলির গল্প শেষ হতে সবাই কিছুক্ষণ চুপ, তারপর পতিরাম মজুমদার বললেন–সরসী ভায়া, এবার কিন্তু আমাকে উঠতেই হবে। কিন্তু এরপর তো আর একা যেতে পারব না, গা ছমছম করবে। তুমি বলেছিলে তোমার লোক সঙ্গে যাবে, তাই একজন কাউকে দাও। ঠাট্টা করলে কর ভাই, আমি অপারগ—
সরসী চাটুজ্জে বললেন-কেউ ঠাট্টা করছে না, তোক দিচ্ছি সঙ্গে।
আদিনাথ চক্রবর্তী বললেন—ওঠবার আগে আমার কাহিনীর শেষটা বলি—
পতিরাম বললেন—এখনো শেষটা বাকি।
—ভয় নেই, দুটো কথা মাত্র। অমর বিষ্ণুমূর্তি খুঁজে দিয়ে গিয়েছিল, ঠাকুমার মৃত্যুর পর তার ভবিষ্যৎবাণী যে সত্যি সে কথা জানান দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার তৃতীয় ভবিষ্যৎবাণীটাও যে সত্যি, সেটা বুঝতে পেরেছিলাম অনেক পরে। সে বলেছিল আমাদের বংশে একজন অদ্ভুত চরিত্রের উদাসীন সাধকের জন্ম হবে। সংসারী হয়েও সে বৈষয়িক হবে না। কবে, কোথায় কার ঘরে তার জন্ম হবে সেটাই কেবল সে বলেনি। শুধু বলেছিল এই শিশুর জন্মের মুহূর্তে আশ্চর্য এক নীল উল্কাপাত হবে আকাশে। তা দেখলে আমরা বুঝতে পারব।
বহুদিন পরে, তখন ছোটবেলার এ কাহিনী প্রায় ভুলেই গিয়েছি, আমার তৃতীয় ছেলের জন্মের সময় আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত এক বিশাল নীল রঙের আলো ছড়ানো উল্কা ছুটে গেল। একজন দাই আঁতুড়ঘর থেকে উঠোন পেরিয়ে গরমজল আনতে যাচ্ছিল ভেতরবাড়িতে, তার চিৎকারে সকলে উঠোনে বেরিয়ে এসে দৃশ্যটা দেখলাম। সচরাচর অতক্ষণ ধরে উল্কা জ্বলতে জ্বলতে অতটা আকাশ পার হয় না। সেই আলো মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার ছেলের জন্ম। তার নাম তারানাথ। তারানাথ চক্রবর্তী।
আদিনাথের এক ছেলে ছোটবেলা থেকেই সংসারত্যাগী। মাঝে মাঝে বাড়ি আসে, আবার কোথায় চলে যায়। এটা তার জীবনের গভীর ব্যথার জায়গা। আড্ডাধারীরা সেকথা জানেন বলে চুপ করেই রইলেন। আদিনাথ বললেন—এখন তার বয়েস বাইশ কী তেইশ। কোথায় আছে কে জানে। বছরখানেক আগে একবার সাতদিনের জন্য এসেছিল, তারপর আবার নিরুদ্দেশ। ছেলে আমার খুবই ভাল, চমৎকার সংস্কৃত জানে, পণ্ডিতেরা তার সঙ্গে পেরে ওঠে না। কোথা থেকে শিখল সে এক রহস্য। স্কুল-কলেজে তো কখনো পড়েনি। দোষের মধ্যে ওই এক বাড়িতে মন বসে না। জানি না আবার কবে তার দেখা পাব।
আড্ডাধারীরা তারানাথকে দেখেছেন। আট-দশ বছর আগে সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। তার আগে অবধি এই গ্রামেই সে মানুষ হয়েছে। সমবেদনাসূচক নীরবতা পালন করা ছাড়া তাদের কিছু করবার নেই।
আদিনাথ বললেন—যাক, আমার ভাগ্য। আপনারা আশীর্বাদ করুন, সেখানেই থাকুক, সে যেন ভাল থাকে।