তৃতীয় অধ্যায় – উত্তর ভারতে সাম্রাজ্যের লড়াই : হুমায়ুন ও আফগান
বাবরের উত্তরাধিকারী হুমায়ুন মাত্র ২৩ বছর বয়সে শাসনভার গ্রহণ করেই একাধিক গুরুতর সমস্যার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন, কিছু সমস্যা ছিল বাবরের । রেখে যাওয়া, আর কিছু সমস্যা ছিল বাবরের মৃত্যু-পরবর্তী সময়ের (ডিসেম্বর, ১৫৩০-এ) স্ব-উৎসারিত। একটা বড়ো সমস্যা ছিল বাবরের ফেলে যাওয়া টালমাটাল প্রশাসন এবং নিজেদের অধিকার নিয়ে সরব বেগদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা। আফগানরা দুর্বল হয়ে গেলেও স্বাধীন আফগান রাজ্য গড়ে মুঘলদের ভারত থেকে বিতাড়িত করার বাসনা তখনও তাদের মধ্যে থিতিয়ে যায়নি। হুমায়ুনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা সহ অনেক তৈমুরীয় রাজপুরুষই একসময় বাবরের ছত্রছায়ায় নিজেদের গুটিয়ে রাখলেও, এবার। তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে উঠেপড়ে লাগতে শুরু করে। আর ছিলেন গুজরাটের শাসক বাহাদুর শাহ, যিনি মালব নিজের দখলে আনার পর রাজস্থানে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিলেন। ফলে স্বভাবতই ক্রমবিকশিত মুঘল সাম্রাজ্যের সামনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ।
ভারতে একটি নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে বাবরের খুব একটা আগ্রহ যেমন ছিল না,তেমনই পরিকল্পনা করার সময়েরও অভাব ছিল। আফগানিস্তান হোক বা ভারত সব জায়গাতেই তিনি পূর্বের প্রচলিত ব্যবস্থাকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাই বিশাল বিশাল এলাকা বেগদের দায়িত্বে অর্পণ করে (wajh (ওয়াজ)]। সেখানকার প্রতিদিনের প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা, ভূমি রাজস্ব আদায় ও সাম্রাজ্যের সেবায় নিয়োজিত সেনাবাহিনীর ভরণপোষণের কাজ তাঁদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। যদিও কিছু এলাকা বা রাজস্বের কিছু অংশ সম্রাটের জন্যে সংরক্ষিত থাকত। তবে লোদিদের পরাজিত করে পাওয়া সম্পদ বাবর ব্যয় করে ফেলায় তার রাজত্বের শেষের দিকে তাকে বেশ আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়তে হয়েছিল। তখন বাবর সকলকে তাদের ওয়াজ-এর আয় থেকে ত্রিশ শতাংশ অবশ্যই রাজকোষে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই নির্দেশ শেষমেশ কতদূর কার্যকর হয়েছিল তা জানা না গেলেও এটা বোঝাই যাচ্ছিল যে, সিংহাসনে অধিষ্ঠানের সময়ে হুমায়ুনের সাম্রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি বেশ সঙ্গীন ছিল।
বেগদের ক্ষমতালোভী উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলি ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছিল এক অদ্ভুত চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে যা নাকি বাবরের শাসনের শেষের দিক থেকেই সংগঠিত হতে শুরু করেছিল বলে মনে করা হয়। আকবরের আমলে দুই প্রথম সারির ঐতিহাসিক আবুল ফজল এবং নিজামুদ্দিন উভয়েই জানিয়েছিলেন যে, বাবরের ওয়াকিল (wakil) তথা তার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র খালিফা নিজামুদ্দিন বাবরের মৃত্যুর পর হুমায়ুন ও তার ভ্রাতাদের সিংহাসনে আসীন হওয়া রদ করতে বিশিষ্ট পরিবারের সন্তান ও বাবরের জ্যেষ্ঠ ভগিনী খানজাদা বেগমের স্বামী মেহদী খাজাকে পরবর্তী মুঘল সম্রাট বানাতে চেয়েছিলেন। এটা স্পষ্ট যে এর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে খালিফা নিজামুদ্দিনই সব ক্ষমতা নিজের হাতে রাখার অভিসন্ধি করেছিলেন। কিন্তু এই অভিসন্ধি সফল হওয়ার সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ, কারণ মেহদী খাজা তৈমুরীয় বংশজাত ছিলেন না এবং বাকি বেগরাও কোনো অ-তৈমুরীয়কে সম্রাট হিসাবে গ্রহণ করে নেবেন এমন সম্ভাবনাও ছিল প্রায় অসম্ভব। অনেক আধুনিক ঐতিহাসিক এরকম যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন যে, নিজামুদ্দিনের অভিসন্ধি নয়, আসলে বাবরই হুমায়ুনের শেষ সমরখন্দ অভিযানের ব্যর্থতা ও কোনো খবর না দিয়ে বাদাখশান থেকে আগ্রা চলে আসার ঘটনায় প্রবল ভাবে হতাশ হয়ে নিজেই এইরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে এ-যুক্তি মানা যায় না। যদি বাবর হুমায়ুনের ওপর হতাশ হয়েই থাকেন, তাহলেও তিনি এই সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না, কারণ তাঁর আরও অনেক সন্তান ছিল, তাদের ওপর তো তিনি হতাশ ছিলেন না। এই ঐতিহাসিকরা আবার এটাও বলেন যে, হুমায়ুন ফিরে আসার পরে। বাবরের সঙ্গে সমঝোতা করে নিয়েছিলেন এবং বাবর তাকে সম্ভলে পাঠিয়েছিলেন। আর তারপরেই তার নাম উত্তরসূরি হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। তাই যত যুক্তিই থাকুক না কেন এটা পরিষ্কার যে মেহদী খাজাকে সিংহাসনে বসানোর ঘৃণ্য চক্রান্তের পশ্চাতে বাবরের ইচ্ছা নয়, বরং তার বিশ্বস্ত বেগদের মধ্যে অনেকের ক্ষমতা দখলের অভিলাষই কাজ করেছিল। যাই হোক, এত চক্রান্ত সত্ত্বেও খালিফা নিজামুদ্দিন কিন্তু হুমায়ুনের অভিষেকের পর তার কাছে প্রিয়পাত্র হয়ে থেকে গিয়েছিলেন, যেমনটা ছিলেন বাবরের কাছে।
এর থেকেও আরও গুরুত্ব চক্রান্তের জাল বুনেছিলেন বাবরের ভাইয়েরা আর কয়েকজন তৈমুরীয় রাজপুরুষ, যাদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতে বাবরের সাম্রাজ্য ভাগ করে সেখানে একটা অংশে মধ্য-এশীয় তৈমুরীয় ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করা। বাবর নিজেও সমরখন্দ জয় করার পরে এই রকম এক চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন, যখন তার এক বেগ তার এক সৎ ভাই জাহাঙ্গির মির্জাকে ফারগানার দায়িত্ব অর্পণ করে দিয়েছিলেন। আর বাবর সমরখন্দ থেকে পরাজিত হবার পর একদিকে সমরখন্দ ও অন্যদিকে ফারগানা–দুই রাজ্য হারিয়ে একেবারে সাম্রাজ্যহীন হয়ে গিয়েছিলেন। বাবরের মৃত্যুর সময়ে হুমায়ুনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা কামরান কাবুল ও কান্দাহারের দায়িত্বে ছিলেন আর বাদাখশান ছিল সুলেমান মির্জার নিয়ন্ত্রণে। তাই যখন হুমায়ুন আগ্রার উত্তরাধিকারী মনোনীত হলেন তখন কাবুল ও কান্দাহারে কামরান নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবেন এটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কামরান শুধু কাবুল ও কান্দাহার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চাইলেন না, তিনি লাহোর আক্রমণ করলেন ও ছলে-বলে-কৌশলে সেখানকার দূর্গ কবজা করে শতদ্রু নদী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ পাঞ্জাব অঞ্চলকে নিজের অধিকারে আনলেন। তারপরে তিনি হুমায়ুনের কাছে দূত প্রেরণ করে নব অধিকৃত পাঞ্জাবকেও তার নিজ সাম্রাজ্য বলে মান্যতা দেবার দাবি জানালেন। হুমায়ুন পড়লেন মহাবিপদে। উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে আফগানরা ইতিমধ্যেই আবার সক্রিয় হতে শুরু করে দেওয়ায় এবং গুজরাটের বাহাদুর শাহ তার দিল্লি আক্রমণের সম্ভাবনাকে ক্রমশ উজ্জ্বল করে। তোলায় হুমায়ুনের পক্ষে আর কোনোভাবে কামরানকে চটানো সম্ভব ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই পাঞ্জাবের ওপর কামরানের অধিকারকে হুমায়ুন মান্যতা দিলেন এবং সেইসঙ্গে জায়গির হিসাবে হিসার-ফিরুজাও দান করলেন। কামরানও প্রতিদানে হুমায়ুনকে। বাইরে থেকে মুঘল সম্রাট হিসাবে স্বীকার করে তাঁর নামে খুবা পাঠ ও সিক্কা প্রচলন করলেন। হুমায়ুনের এই পদক্ষেপকে আবুল ফজল বলেছিলেন বদান্যতা এবং ভ্রাতাদের প্রতি সর্বদা সদয় থাকার যে উপদেশ বাবর দিয়ে গিয়েছিলেন, তা যথাযোগ্যভাবে পালনের সদিচ্ছা। সত্যিই কি তাই? বাবর তার লেখা এক পত্রে হুমায়ুনকে বলেছিলেন, ‘তুমি তো জানো, এ-শাসনের ছয় অংশ, যার পঞ্চমটি ছিল কামরানের কাছে।’ এর অর্থ এই নয় যে বাবর তার পুত্রদের মধ্যে তাঁর সাম্রাজ্যের বিভাজনকে মেনে নিয়েছিলেন। আসলে বাবরের এই পত্রটি রাজপুরুষদের মধ্যে জায়গির বণ্টন-সংক্রান্ত বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা হয়েছিল। আর এই পত্রেই আর এক জায়গায় বাবর হুমায়ুনকে তার কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের ও বেগদের প্রত্যহ দু’বার করে বাদশার সামনে উপস্থিত হওয়ার জন্যে তলব করতে উপদেশ দিয়েছিলেন। ফলে এটা বোঝাই যাচ্ছে হুমায়ুনের অন্য ভাইদের প্রতি বিশেষ কোনো মহানুভবতা ছিল না, বরং তারা বাকি বেগদের মতোই রাজশক্তির কাছে আনুগত্য প্রদর্শন করবে এমনটাই ছিল কাম্য।
এটা বলা হয়ে থাকে যে, কামরানের হাতে আফগানিস্তান ও পাঞ্জাবের মতো দুই প্রধান সেনাবাহিনী সরবরাহকারী অঞ্চল ছেড়ে দিয়ে হুমায়ুন নিজেই নিজেকে কর্মদক্ষ ও বিশ্বস্ত সেনা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। তবে এই যুক্তি সম্পূর্ণভাবে মেনে নেওয়া যায় না, কারণ সে যুগে কোনো শাসকই সেভাবে সেনা ও সাধারণ মানুষের এক রাজ্য ছেড়ে আর-এক রাজ্যে যাওয়ার ব্যাপারে বাধা দিতেন না। ১৫৩৯ সালে শের শাহের কাছে চৌসার যুদ্ধে পরাজিত হবার পরেও হুমায়ুনের শিবিরে প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর কোনো ঘাটতি নজরে পড়েনি। অন্যদিকে আফগানিস্তান ও পাঞ্জাবে– কামরানের নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকায় হুমায়ুনকে পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার বিশেষ করে কান্দাহার ও বাদাখশানের সমস্যা মোকাবিলা করার দরকার পড়েনি। দু-দু’বার ইরানীয় শাহ কর্তৃক কান্দাহার আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল এই সময় যা অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে সামলে নিয়েছিলেন কামরান।
এসব থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, কামরানের কাজকর্ম ও ক্ষমতা বৃদ্ধি ক্রমশ মুঘল সাম্রাজ্যের অবশ্যম্ভাবী বিভাজন সৃষ্টি করার ব্যাপারে ছিল অনুকূল এবং কামরানের প্রতি হুমায়ুনের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা কোনোমতেই ভ্রাতার প্রতি মহানুভবতা বা বদান্যতা ছিল না, বরং তা কোথাও-না-কোথাও ছিল দুর্বলতা ও দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের অভাব। এই ব্যাপারটাই হুমায়ুনের অন্য দুই ভ্রাতা–আসকারি ও হিন্দাল, যাদেরকে সম্বল ও মেওয়াট জায়গির হিসাবে দান করা হয়েছিল তাদের মনে এবার সুযোগ বুঝে নিজেদের অধিকার আদায়ের দাবি প্রকাশ করার প্রেরণা জাগাল শুধু এরাই নন, উজবেকদের দ্বারা উৎখাত হয়ে বাবরের শিবিরে একদা যোগদান করা তৈমুরীয় রাজপুরুষরাও এবার নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে রীতিমতো হুমায়ুনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ল। এদের মধ্যে সবথেকে সাংঘাতিক ছিলেন মহম্মদ জামান মির্জা ও সুলতান হুসেন বৈকারার পৌত্র মহম্মদ সুলতান মির্জা। এরা বাবরের হয়ে অনেক জায়গায় কাজ করেছিলেন এবং বিহারের প্রাদেশিক শাসক পদ আলোকিত করা থেকে শুরু করে বহু গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পদেও আসীন ছিলেন। এদের দুজনের বোনকেই বাবর বিবাহ করেছিলেন। এরকম দুই সম্রাট-ঘনিষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ তৈমুরীয় রাজপুরুষের মুঘল সাম্রাজ্যকে ভেঙে পৃথক সাম্রাজ্য গড়ার দাবি করার ঘটনা অন্য অভিজাতদের মনে হুমায়ুনের বিরুদ্ধাচরণ করার সাহস বাড়িয়ে দিয়েছিল। পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে গিয়েছিল এ-সময়, যা দেখে এটাই মনে হচ্ছিল যে তখনও যে মুঘল সাম্রাজ্য ভারতের মাটিতে কোনো শিকড়ই বিস্তার করতে পারেনি, সেই সাম্রাজ্যের একাধিক বিষয়ে বিরোধিতা করার রসদ খুঁজে নিয়েছিল সকল শ্রেণির সুবিধাবাদী মানুষ।
হুমায়ুনের সামনে এসব অভ্যন্তরীণ সমস্যা ছাড়াও বাইরে ছিল দুটি মহাবিপদ। একটি ছিল বিহার ও উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে আফগানদের ক্ষমতা বৃদ্ধি আর অপরটি ছিল গুজরাটের বাহাদুর শাহের ক্রমাগত চোখ রাঙানি। যদি হুমায়ুন এই দুটি চ্যালেঞ্জ সফল ভাবে প্রতিহত করতে পারতেন, তাহলে পূর্বে উল্লেখিত অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলি সমাধান করার ব্যপারে তিনি অনেক বেশি সুবিধাজনক জায়গায় থাকতে পারতেন।
হুমায়ুনের শাসনকাল–কিছু ব্যাখ্যা
যে প্রতিবন্ধকতাগুলোর কথা আমরা উপরে উল্লেখ করলাম, সেগুলো কীভাবে হুমায়ুন মোকাবিলা করেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রবল। বিভ্রান্তি ও মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার একটা কারণ অবশ্যই ছিল। হুমায়ুনের সময়ের ও তার কাজকর্মের কোনো বিশ্বাসযোগ্য ঘটনাপঞ্জি (chronol ogy) লিপিবদ্ধ না থাকা। ফলে ইতিহাসের অনেকটা সময় জুড়ে আমরা হুমায়ুনকে প্রশাসনিক প্রয়োজনে কোনো কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে বা সক্রিয় থাকতে দেখি না। এই কারণেই কয়েকজন ঐতিহাসিক, বিশেষ করে প্রথম দিককার ব্রিটিশ ঐতিহাসিকগণ হুমায়ুনকে একজন আফিম আসক্ত নেশাতুর মানুষ হিসাবে বর্ণনা করে গিয়েছিলেন অনেকদিন। আর এর প্রমাণ হিসাবে তাঁদের কাছে ছিল মুঘলিস্তানের সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক অভিজাত ও কামরান কর্তৃক নিযুক্ত লাহোরের শাসক মির্জা হায়দার দুঘলৎ-এর লেখা এক গ্রন্থ, যার নাম ‘তারিখ-ই-রশিদি’। সেখানে তিনি লিখেছেন যে, কয়েকজন শয়তান ও লম্পট মানুষের পাল্লায় পড়ে হুমায়ুন কিছু কুঅভ্যাসে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন, যার মধ্যে আফিম সেবন ছিল অন্যতম আর এর ফলেই তার পতন সূচিত হয়েছিল। অনেকেই এই মত মেনে নিতে পারেননি। কারণ। সে সময় মধ্য এশিয়ায় আফিম ও সুরা পান ছিল বহুল প্রচলিত। বাবর নিজে অনেকবার তার ও তার বাহু বেগদের জমিয়ে আফিম সেবন ও সুরা পান করার কথা। অকপটে উল্লেখ করেছিলেন। এসব কখনোই বাবর বা তার বেগদের সামরিক অভিযান চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেনি। তাছাড়া হুমায়ুনকে বাবরের মতো এত বাধা বিপত্তির মধ্য দিয়ে বড়ো হতে হয়নি। তাই মুঘল সাম্রাজ্যের শাহজাদা হিসাবে তার পক্ষে যুদ্ধ-অবসরে ভোগ বিলাসিতায় মেতে থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।
সে সময়ের ঘটনাপরম্পরা পর্যায়ক্রমে বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে যে ইতিহাসে হুমায়ুনের নিষ্ক্রিয়তার পর্বটা যতটা না বাস্তবে ছিল তার থেকে অনেক বড়ো করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কেন এক শ্রেণির ঐতিহাসিকরা এটা করলেন? কেন তারা ঘটনার কয়েকটা দিককেই বেশি করে তুলে ধরলেন আর কেনই-বা আর এক শ্রেণির ঐতিহাসিক জোর দিলেন ঘটনার অন্য কিছু দিকের ওপর? এসব প্রশ্নের উত্তর বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করার পরিসর এখানে নেই। তবে এটা বলতে হবে যে একই সময়ের ইতিহাস নিয়ে এ-ধরনের বহু মতের বিভ্রান্তি ঘটার মূলে অনেকটাই দায়ি ছিল সে-সময়ের এক-এক রকমের কালপঞ্জি রচনা। আবুল ফজল এক ধরনের কালপঞ্জি অবলম্বন করে লিখেছিলেন আবার তার সমসাময়িক নিজামুদ্দিন আহমেদ আর-এক রকম ভাবে সে-সময়ের কালপঞ্জিকে দেখেছিলেন যা অনুকরণ করা হয়েছিল ‘ফেরিস্তা’তে। নিজামুদ্দিন আহমেদ, যার পিতা ছিলেন বাবরের দরবারের গুরুত্বপূর্ণ একজন অমাত্য, তার ‘তবাকত-ই-আকবরি’ নামক গ্রন্থটি রচনা শেষ হয় আবুল ফজলের ‘আকবরনামা’ রচনার অনেক পরে এবং তিনি তাঁর গ্রন্থ রচনার সময় আবুল ফজলের গ্রন্থের সাহায্যও নিয়েছিলেন। ফলে তাঁর রচনা আবুল ফজলের রচনার থেকে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার কথা। কিন্তু নিজামুদ্দিন আহমেদের গ্রন্থ শুধু যে আবুল ফজলের গ্রন্থের তুলনায় অনেক সংক্ষিপ্ত ছিল তাই নয়, কালপঞ্জি অবলম্বনের ক্ষেত্রেও ছিল বেশ ত্রুটিপূর্ণ। এটা সর্বজনবিদিত যে আকবর তার শাসনের ৩২তম বর্ষে যাঁরা বাবর ও হুমায়ুন বা তার আমলের প্রথম দিকে বেঁচে ছিলেন, তাঁদের সেই সময়ের স্মৃতিগ্রন্থ রচনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে আদেশ যথাযথ ভাবে আবুল ফজল পালন করলেও নিজামুদ্দিন আহমেদ পালন করতে পারেননি।
তাই এখানে আমরা যে ঘটনাপঞ্জি অবলম্বন করব সেটা সাধারণত আবুল ফজলের। রচনাকে নির্ভর করে–যদি না সেখানে কিছু গুরুতর বিচ্যুতির কোনো কারণ থাকে।
হুমায়ুনের প্রথম পর্বের কার্যকলাপ এবং বাহাদুর শাহের সঙ্গে সংঘাত
সিংহাসনে অধিষ্ঠানের ছয় মাস পর হুমায়ুন বুন্দেলখণ্ডের কালিঞ্জর দুর্গ আক্রমণ করেছিলেন। এই দুর্গটি বায়ানা, গোয়ালিয়র ও ঢোলপুর দুর্গের সঙ্গে একযোগে দক্ষিণ দিক থেকে আগ্রা শহরকে নিরাপত্তা প্রদান করত। ফলে এই দুর্গগুলির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন সময়ে দিল্লির পূর্ববর্তী একাধিক শাসক উদ্যোগী হয়েছিলেন ও দখলও করেছিলেন। চন্দেলা শাসকদের বীরত্বের কাহিনি খুব প্রচলিত ছিল কিন্তু অতি সহজেই তাদেরকে আমরা কালিঞ্জর দুর্গটি টানা একমাস ধরে মুঘল সেনা কর্তৃক অবরুদ্ধ থাকার পর হুমায়ুনের হাতে ছেড়ে দিতে দেখি। হুমায়ুনের বশ্যতা স্বীকার করে নেবার ও ১২ মণ সোনা নজরানা দেবার প্রতিদানে চন্দেলাদের ওই দুর্গের ওপর অধিকার বজায় রাখার সুযোগ দেওয়া হয় ঠিকই, কিন্তু এই ঘটনায় হুমায়ুনের খ্যাতি প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। শুধু তাই নয়, হুমায়ুন কর্তৃক কালিঞ্জর অধিকারের অর্থ ছিল গুজরাটে বাহাদুর শাহের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ জানানো। বাহাদুর শাহ ইতিমধ্যেই মাণ্ডু দখল করে নিয়ে (১৫৩১) এগিয়ে আসছিলেন।
এ সময় হুমায়ুনকে মূলত উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশের ও বিহারের আফগানদের দ্বারা সৃষ্ট সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। হুমায়ুন খবর পেয়েছিলেন যে শের খান নামে এক আফগান সর্দার যিনি পূর্বে বাবরের হয়ে কাজ করতেন, তিনি ইদানীং চুনারের শক্তিশালী দুর্গের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়েছেন। বিহারের প্রবেশদ্বার হিসাবে পরিচিত এই চুনার দুর্গের ওপর পূর্বে লোদি সুলতানদের অধিকার ছিল। তাই লোদিদের পরাজিত করার সুবাদে তাদের অধিকৃত অঞ্চলের ওপর মুঘলদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এই ভাবনা নিয়েই চুনার দুর্গের দখল নিতে হুমায়ুন কালিঞ্জর থেকে সোজা চুনার অভিযান করলেন ও দুর্গটি অবরোধ করলেন। সুযোগ বুঝে শের খান। তার পুত্র জালাল খানের (যিনি পরে ইসলাম খান নামে পরিচিত হন) হাতে দুর্গের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে সরে পড়লেন। কিছুদিন অবরোধের পর দুই পক্ষের মধ্যে আপোস মীমাংসা শুরু হয়। শের খান প্রস্তাব দিলেন মুঘল সম্রাটের হয়ে কাজ করবেন এবং চুনার দুর্গের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহারও করবেন যদি তার আর-এক পুত্ৰ কুতুব খানের হাতে ৫০০ সেনা নিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া হয়। এছাড়াও তিনি তিন মণ সোনা পেশকাশ হিসাবে দিতে ও সম্রাটের প্রতি অনুগত থাকতেও রাজি হয়ে যান। হুমায়ুন শের খানের সব প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন কারণ সেই মুহূর্তে তিনি বিহার আক্রমণ করার কোনো চিন্তাভাবনা করছিলেন না। তাছাড়া শের খানের মতো ছোটো আফগান সর্দারকে তিনি কোনোরকম ভাবে বিপজ্জনক বলে মনেই করেননি। যদিও পরবর্তী কিছু ঘটনা হুমায়ুনের এই ভাবনাকে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করেছিল। তবে ভবিষ্যতে শের খানের ব্যাপক উত্থান ঘটবে এটা সেই সময় দাঁড়িয়ে কারও পক্ষেই ভাবা সম্ভব ছিল না। শের খানের প্রস্তাব মেনে নেওয়ায় হুমায়ুনের যে সুবিধাটা হয়েছিল তা হল শের খান উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে দৃঢ়ভাবে নিজেদের অবস্থানকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে উদ্যত বিপজ্জনক আফগান নেতা বিবন ও বায়াজিদদের পক্ষ নেননি। কিন্তু পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, কামরানের লাহোর আক্রমণের সময় ও পূর্ব দিকে চুনারে শের খানের সঙ্গে দুর্গ অধিকারের মীমাংসা করার সময় উভয় ক্ষেত্রেই হুমায়ুনের সমঝোতা করার ইচ্ছা কোথাও-না-কোথাও তার চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষমতার ছবি তুলে ধরে। আর এটাই বাহাদুর শাহকে তার উচ্চকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে ও মুঘলদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আক্রমণ শানাতে উদ্বুদ্ধ। করে তোলে।
চুনারে অভিযানের পরে হুমায়ুন প্রায় এক বছর আগ্রায় কাটান ও পরিস্থিতির ওপর নজর রাখেন। এই সময় তিনি অদ্ভুতভাবে তাঁর শাসনব্যবস্থা ও দরবারি কাঠমোকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। তিনি দরবারি কাঠামোকে শাসনতান্ত্রিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক এই তিনভাগে বিভক্ত করেন। এই বিভাগগুলির মধ্যে পদ-পরম্পরা সৃষ্টির জন্যে একাধিক লোকজনকে বিভিন্ন গুণ ও সংখ্যার ভিত্তিতে পুরস্কৃত করা হয়। একাধিক অভিজাত ও অন্যান্য ব্যক্তিদের ভুরি ভুরি পুরস্কার ও উপাধি প্রদান করে তাঁদের নতুন সাম্রাজ্যের সঙ্গে আরও একাত্ম করে রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এছাড়া সম্রাট এ সময় কিছু স্থাপত্য নির্মাণের পরিকল্পনা করার ও নতুন কিছু উদ্যোগকে অনুমোদন। দেবারও সময় পেয়েছিলেন। এসময় প্রতিষ্ঠিত তাঁর ‘তবল-ই-আদল’ বা বিচারের ডঙ্কা (Drum of Justice) ব্যবস্থা যেভাবে মানুষের অভাব অভিযোগকে সম্রাটের দৃষ্টিগোচরে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে নতুন মুঘল রাষ্ট্রের তরফে গণসমর্থন আদায়ের জন্যে নেওয়া প্রথম সদর্থক পদক্ষেপ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এছাড়াও অস্পষ্টভাবে অনেক জায়গায় বলা হয়ে থাকে যে তিনি নাকি এ-সময় গ্রামাঞ্চলের কৃষক ও সাধারণ মানুষ, কারিগর ও বণিকদের ওপর থেকে করের চাপ কমাতে চেয়েছিলেন এবং বিদেশি বণিকদের ব্যবসার ওপর থেকে তমঘা ও অন্যান্য কর হ্রাস করে তাদের সহায়তা প্রদান করেছিলেন। তাই আবুল ফজলের ভাষায়, তিনি মানুষের জন্যে শুল্ক সংরক্ষণের ধ্বজা উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। এগুলো সুশাসনের সংকেত ছিল ঠিকই কিন্তু এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবার পর তার কী প্রভাব পড়েছিল তা জানতে আমাদের আরও অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
ইতিমধ্যে বিবন ও বায়াজিদের নেতৃত্বে আফগানরা মুঘল প্রাদেশিক প্রতিনিধি জুনায়েদ বারলাসকে জৌনপুর থেকে বিতাড়িত করে সেখানে নিজেদের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়ে যায়। আফগানদের প্রতিহত করতে এবার হুমায়ুন বিশাল সেনাবাহিনী সহযোগে গঙ্গা অতিক্রম করে অভিযান চালান। গোমতী নদীর তীরে দাদরাহ নাম একটি জায়গায় তিনি আফগানদের মুখোমুখি হন এবং যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে আফগানদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে এবং শেখ বায়াজিদকে হত্যা করা হয়। ফলে আফগান শক্তির শিরদাঁড়াটাই কার্যত ভেঙে যায়। আফগান প্রধান সুলতান মেহমুদ ভাট্টাতে (রেওয়া) পালিয়ে আসেন। শের খান উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশের আফগানদের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দেননি, যার ফলে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন– এমন অভিযোগও তোলা হয়ে থাকে। ওদিকে আবার মুঘলদের বিরুদ্ধে পরবর্তীকালে সাফল্য পাবার ক্ষীণ আশায় কয়েকজন আফগান সর্দার বাহাদুর শাহের শরণে গিয়ে হাজির হন। এসব ঘটনা ঘটেছিল ১৫৩২ সালের শেষ পর্যায়ে।
এইভাবে নিজ কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করার মধ্য দিয়ে হুমায়ুন তার শাসনের প্রথম দুই বছর অতিবাহিত করলেন। এরপর তিনি মালব, পূর্ব রাজস্থান এবং বাহাদুর শাহ যেখানে থেকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ জানিয়ে উঠে আসছিলেন সেই গুজরাটের সমস্যাগুলো নিয়ে ভাববার পূর্ণ অবসর পেলেন।
এবার আসা যাক বাহাদুর শাহের কথায়। তিনি ছিলেন গুজরাটের শাসক দ্বিতীয় মুজফফর শাহের সন্তান ও হুমায়ুনের প্রায় সমবয়সি। তিনি ইব্রাহিম লোদি ও বাবর–উভয়ের সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় কয়েক বছর ঘুরে অবশেষে ১৫২৬ সালে। মালবের সিংহাসন দখল করতে সক্ষম হন। পানিপথের যুদ্ধের পর বাহাদুর শাহকে কয়েকজন আফগান নেতা জৌনপুরের শাসক হবারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। আহমেদাবাদে তাঁর পিতার সহসা মৃত্যু ও গুজরাটের পরবর্তী উত্তরসূরি সিকান্দারকে তার উজির ইমাদুল মুলক কর্তৃক চক্রান্ত করে হত্যা করার ঘটনা গুজরাটের রাজনৈতিক ভবিষ্যতকে এক জটিল পরিস্থিতির সামনে এনে দাঁড় করায়। তখন একদল অভিজাত বাহাদুর শাহকে গুজরাটের সিংহাসনে আরোহণের জন্যে আমন্ত্রণ জানায়। বাহাদুর শাহ ইতিমধ্যেই নিজেকে একাধারে নির্মম অথচ যোগ্য ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী শাসকে পরিণত করে ফেলেছিলেন। তিনি তার অবশিষ্ট ছয় ভাইকে একের-পর-এক হত্যা করতে একটুও দ্বিধা করেননি, শুধু একজন বেঁচে গিয়েছিলেন মালবের শাসকের কাছে আশ্রয় নেবার ফলে। আর এটাই বাহাদুর শাহকে মালব আক্রমণ ও অধিকার করার অজুহাত এনে দিয়েছিল। মালব জয়ের আগেই তিনি আহমেদনগর আক্রমণ করে সেখানকার শাহী নিজামকে বশ্যতা স্বীকারে ও তাঁর নামে খুৎবা পাঠ করতে বাধ্য করেছিলেন।
বাহদুর শাহ পানিপথ ও খানুয়ার যুদ্ধে বাবরের বাহিনীর দুর্দান্ত জয়লাভ দেখেছিলেন, তাই প্রথম দিকে মুঘলদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে অবতীর্ণ হবার পরিকল্পনা তিনি যে-কোনো উপায়ে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্রমে তার এই জড়তা কেটে যেতে থাকে। কারণ, একের-পর-এক সাফল্য লাভ করে তিনি অনেকটাই আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে উঠেছিলেন। তাছাড়া যেভাবে আফগান সর্দাররা ও কয়েকজন তৈমুরীয় অভিজাতবর্গ যারা বাহুদুর শাহের শরণে এসে ঠাঁই নিয়েছিলেন এ-সময়, তারাও এটা বোঝাতে কোনো কসুর করেননি যে এই মুঘল বাহিনী আর সেই আগের মতো বিধ্বংসী নয়, বরং তা অনেকটাই নমনীয় ও সমঝোতা বিলাসী হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে আমরা আর-একটি তথ্য যোগ করতে পারি যা বাহাদুর শাহের শিবিরের আত্মবিশ্বাসকে মজবুত করেছিল বলে মনে হয়। তা হল, দুই তুখোড় অটোমান বন্দুকবাজ আমির মুস্তাফা বা রুমি খান ও খাজাসফর-এর নিযুক্তি। এদের সাহায্য নিয়ে বাহাদুর শাহ খুব দ্রুত একটি শক্তিশালী গোলন্দাজ বাহিনী সংগঠিত করে ফেলেছিলেন। এরা আবার তাঁকে যুদ্ধের অটোমান প্রতিরক্ষা পদ্ধতিও শিখিয়ে দিয়েছিলেন। যেমন, যেখানে কামান ও বন্দুকের গোলাগুলি বর্ষণ হবে তার ঠিক পিছনে যুদ্ধযানগুলিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে সারিবদ্ধ রাখা। এইভাবে সামরিক কলাকৌশল ও আফগান-তৈমুরীয় জোটের সাহায্য লাভ করে বাহাদুর শাহ যেভাবে মুঘল শক্তির সমক্ষে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাতে এটা মনে হচ্ছিল যে তিনি খুব সহজেই হুমায়ুনকে ছাপিয়ে যাবেন। অন্তত তিনি এটা বিশ্বাস করতে শুরু করে দিয়েছিলেন যে হুমায়ুনের মতো অদক্ষ ও অকার্যকর সম্রাট তাঁর সামনে কিছুই নন। হুমায়ুনকে পরবর্তীকালে লেখা এক পত্রে তিনি ঠিক এই সুরেই বলেছিলেন যে, কৃতিত্বের বিচারে হুমায়ুন তার থেকে শত যোজন দূরে, তাই যুদ্ধে কেবল কয়েকজন আফগান সর্দারকে সামলাতেই তাকে হিমশিম খেতে হয়েছিল।
বাহদুর শাহ যদি নিজে মুঘলদের আক্রমণ করার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী নাও হতেন, তাহলেও মুঘল শক্তি ও পশ্চিম ভারত-কেন্দ্রিক কোনো শক্তির মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধার পরিস্থিতি এমনিতেই তৈরি হয়ে যেত এ-সময়। কারণ সুলতানি আমলের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এটাই বলে যে কোনো শক্তি ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমিতে নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে সক্ষম হলে সে অবশ্যই মালবের মতো উর্বর ও সমৃদ্ধ অঞ্চল এবং গুজরাটের মতো উন্নত সামুদ্রিক বন্দর ও সম্পদে ঠাসা এলাকার ওপরে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার চেষ্টা করত। রাজস্থান ছিল গুজরাট ও মালবের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগকারী মাধ্যম এবং সেই সঙ্গে একটি সমৃদ্ধশালী উত্তর-ভারতীয় পাললিক সমভূমি অঞ্চল। লোদিদের আমলেও আমরা দেখেছি যে তারা জৌনপুর জয় ও গাঙ্গেয় উপত্যকায় নিজেদের অবস্থা সুসংঘবদ্ধ করার পর মালব ও পূর্ব রাজস্থান দখল করা নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল।
যদিও এটা মনে হচ্ছিল যে এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে হুমায়ুন বাহাদুর শাহের সঙ্গে। সংঘাতে যেতে কোনোভাবেই ইচ্ছুক ছিলেন না, তথাপি বাহাদুর শাহই প্রকৃতপক্ষে হুমায়ুনকে তা করতে প্ররোচিত করেছিলেন বারবার। প্রথম প্ররোচনামূলক পদক্ষেপ ছিল বাহাদুর শাহের ১৫৩২ সালে হুমায়ুনের সহযোগী রানাকে শায়েস্তা করতে চিতোর দুর্গ অবরোধ ও পূর্ব মালবের অন্যতম শক্তিশালী সর্দার সালহাদিকে সাহায্য করে হুমায়ুনকে বিরক্ত করা। হুমায়ুন এ-ব্যাপারে অবগত ছিলেন যে পূর্ব রাজস্থানে বাহাদুর শাহের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে তা আগ্রা ও দিল্লিতে মুঘল কর্তৃত্বের সামনে তাৎক্ষণিক বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই প্রাথমিক ভাবে বাহাদুর শাহকে সাবধান করে দিতে তিনি গোয়ালিয়র অভিযান করেছিলেন (ফেব্রুয়ারি, ১৫৩৩)। সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগের এক রাজস্থান সূত্র থেকে জানা যায় যে, সেখানকার রানার জননী রানি কর্ণাবতী তার হাতের বালা হুমায়ুনকে রাখী হিসাবে পাঠিয়েছিলেন ফলে হুমায়ুন নাকি বীরের মতো তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। যেহেতু এখনও পর্যন্ত আর কোনো সমকালীন সূত্রে এই ঘটনার উল্লেখ মেলেনি, সেহেতু এই গল্পের সারবত্তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। যাই হোক, গোয়ালিয়রে হুমায়ুনের উপস্থিতি বাহাদুর শাহকে বিচলিত করে তোলে এবং তিনি দ্রুত রানার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে উদ্যত হন। রানাকে মালবের একটা অংশ যা তিনি একদা বাহাদুর শাহের মালব আক্রমণের সময় মেবারের সমর্থনের পুরস্কারস্বরূপ লাভ করেছিলেন, তা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এছাড়া রানাকে প্রচুর পরিমাণে ক্ষতিপূরণও দিতে হয়েছিল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল খলজি সুলতানদের থেকে রানা সঙ্গ কর্তৃক ছিনিয়ে নেওয়া অলঙ্কারখচিত রাজমুকুট ও কোমরবন্ধ যার গৌরবান্বিত মূল্য ছিল বিশাল।
যদিও এই চুক্তি বাহাদুর শাহের প্রভাব ও প্রতিপত্তি অনেকটাই বৃদ্ধি করেছিল, তবুও তাঁর চিতোর অধিকারের পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় হুমায়ুন যেন কিছুটা স্বস্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। তাই তিনি এরপর দিল্লি ফিরে যান এবং এক বছর সেখানে থেকে যমুনা নদীর তীরে ‘দিন পানাহ’ নামে এক নতুন রাজধানী নির্মাণে মনোনিবেশ করেন। এই সময় হুমায়ুনের এই নতুন শহর নির্মাণের উদ্দেশ্য নিয়ে একাধিক প্রশ্ন তোলাই যায়। আফগান সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসাবে আগ্রা ইতিমধ্যেই স্বীকৃত, দিল্লি যেভাবে দীর্ঘদিন, ধরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কেন্দ্র রূপে প্রতিষ্ঠিত এবং দিল্লি থেকে শাসন পরিচালনা করা যেখানে যে-কোনো শাসকের কাছেই প্রভূত সম্মানের ও প্রতিপত্তির বিষয়, সেখানে হুমায়ুনের নতুন রাজধানী নির্মাণের সিদ্ধান্ত যে এক ‘অসুস্থ কল্পনা’র ফসল ছিল, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। হুমায়ুন এ-সময় বাহাদুর শাহের উত্থান দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন বলে যদি ধরে নিই এবং আগ্রা বাহাদুর শাহের দখলে চলে গেলে প্রতিরক্ষার দ্বিতীয় বিকল্প হিসাবে তিনি যদি এই শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা করে থাকেন, তাহলে তার থেকে বড়ো মূর্খামি আর কিছুই হতে পারে না। না হলে ঠিক এক বছর পর বাহাদুর শাহ দিন পানাহ নির্মাণ সম্পন্ন করার জন্যে হুমায়ুনকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠাতেন না। বাহাদুর শাহের এই বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে মজে হুমায়ুন প্রতিদানে তাঁকে দূত প্রেরণ করে অনুরোধ করেছিলেন যে দিল্লি থেকে যেন আর কাউকে তার দরবারে আশ্রয় না দেওয়া হয়। আসলে হুমায়ুনের ইঙ্গিত ছিল সেই সকল আফগান অভিজাতের প্রতি যারা দীর্ঘদিন মুঘল ছত্রছায়ায় দিন কাটিয়ে সুযোগ বুঝে এবার বাহাদুর শাহের শিবিরে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সিকান্দার লোদির ভাই আলম খান, যিনি বাবরের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করলেও কিছুদিন আগেই বাহাদুর শাহের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এইভাবে বাহাদুর শাহের কাছে একাধিক দূত প্রেরণ, বার্তালাপ ইত্যাদির মাধ্যমে হুমায়ুন যেন সেই সবকিছুকেই স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছিলেন যা বাহাদুর শাহ মালব জয়ের মাধ্যমে লাভ করেছিলেন। এর পশ্চাতে উদ্দেশ্য হয়তো একটাই ছিল যে তার মস্তিষ্ক থেকে মুঘল বিরোধিতার ভাবনা যে কোনোভাবে দূর করা। আমার মনে হয়, হুমায়ুনের এই সমঝোতার ইচ্ছাকেই বাহাদুর শাহ তার দুর্বলতার লক্ষণ হিসাবে পরিগণিত করেছিলেন।
এরপর বাহাদুর শাহ এমন কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা মুঘলদের সঙ্গে তার সংঘাতের সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করে তোলে। ১৫৩৪ সালের শেষের দিকে তিনি দ্বিতীয় বারের জন্য চিতোর অভিযান করেন। এবার তিনি প্রভূত সম্মানের সঙ্গে সেখানে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এবং গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জায়গির মহম্মদ জামান মির্জা নামে এক প্রভাবশালী তৈমুরীয় রাজপুরুষের হাতে প্রদান করেন। এই মহম্মদ জামান মির্জা বাবরের অত্যন্ত প্রিয় অভিজাত ছিলেন ঠিকই কিন্তু শুরু থেকেই তিনি হুমায়ুনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারেন এমন আশঙ্কা করে হুমায়ুন তড়িঘড়ি মহম্মদ জামান মির্জাকে যুদ্ধে পরাজিত করেন ও বন্দি করে বায়ানার কারাগারে প্রেরণ করেন। আদেশ ছিল তাকে অন্ধ করে দেবার কিন্তু কারারক্ষীর সঙ্গে গোপন আঁতাত করে তিনি কারাগার থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। চিতোরে এসে বাহাদুর শাহ এই মহম্মদ জামান মির্জাকে সাদরে নিজের শিবিরে আহ্বান জানান। লক্ষ্য ছিল মুঘল শিবিরে বিভাজন ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে তাকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা।
বাহাদুর শাহ বিশাল অঙ্কের অর্থ প্রেরণ করে শের শাহকে মুঘলদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্ররোচিত করতে শুরু করেন। অবশেষে কয়েকজন শক্তিশালী যোদ্ধার নেতৃত্বে বাহাদুরশাহ মুঘলদের বিরুদ্ধে ত্রিমুখী সাঁড়াশি আক্রমণ হানেন। একটা আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন আলম খানের পুত্র তাতার খান, যিনি পরিচিত ছিলেন তাঁর সাহসিকতার জন্যে। বাহাদুর শাহ তাকে কুড়ি কোটি টঙ্কা অর্থ দিয়েছিলেন বিশাল ভাড়াটে বাহিনী সংগঠিত করার জন্যে। এই আক্রমণটা ছিল আগ্রার দিকে। আর-একটি বাহিনী বুন্দেলখণ্ডের কালিঞ্জরের দিক থেকে আক্রমণ শানিয়েছিল। আর তৃতীয় আক্রমণটা সরাসরি পাঞ্জাবে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে দিল্লি অভিমুখে অভিযান চালিয়েছিল। তাতার খান ৪০,০০০ সেনা জোগাড় করে যুদ্ধে নেমেছিলেন এবং বায়ানা দখল করে নিয়েছিলেন। কিন্তু মির্জা আসকারি ও হিন্দালের নেতৃত্বে মুঘল বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে পড়ে আফগান বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, তাতার খান শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যান এবং অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে তখনই মুঘলদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে বাহাদুর শাহের আগমনের অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল। এটা একটা ভুল ছিল যার ফলে অন্য দুই দিকের আক্রমণও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
বাহাদুর শাহের পক্ষে এই মুঘল-বিরোধী পদক্ষেপগুলো থেকে সরে আসা আর সম্ভব ছিল না। হুমায়ুনও আর চুপ করে বসে রইলেন না। তিনি বাহাদুর শাহকে শায়েস্তা করতে ও গুজরাট জয় করতে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
হুমায়ুনের গুজরাট অভিযান
কিছু বকেয়া সামরিক প্রস্তুতি সেরে নিয়ে হুমায়ুন ১৫৩৫-এর গোড়ার দিকে আগ্রা থেকে অভিযান শুরু করলেন। যদিও বাহাদুর শাহ কর্তৃক অবরোধ করে রাখা চিতোর দুর্গের অভিমুখে না গিয়ে তিনি রাইসেন ও সরঙ্গপুর হয়ে উজ্জয়নের দিকে পাড়ি দিলেন। এই পথেই তিনি পূর্ব মালবকে নিজের দখলে আনলেন এবং সেখানে নিজেকে এমন একটি কৌশলগত সুবিধাজনক অবস্থায় প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হলেন যেখান থেকে বাহাদুর শাহ যদি মালবের মাণ্ড অথবা রাজধানী আহমেদাবাদ থেকেও আক্রমণ হানেন, তাহলে তিনি তাকে যোগ্য জবাব দিতে পারবেন। হুমায়ুনের এই পদক্ষেপ বাহাদুর শাহের শিবিরে ভীতির সঞ্চার করলেও তার তুখোড় বন্দুকবাজ রুমি খান কিন্তু বিরোধীপক্ষকে তার শক্তিশালী বন্দুকের আঘাতে অচিরেই আত্মসমর্পণে বাধ্য করার ব্যাপারে প্রবল আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। বাহাদুর শাহের কয়েকজন উপদেষ্টা এই যুক্তিও দিয়েছিলেন যে, কাফেরদের বিরুদ্ধে এতদিন ধরে যুদ্ধে রত একজন মুসলমান শাসকের (বাহাদুর শাহ) বিরুদ্ধে আর-এক মুসলিম সম্রাটের (হুমায়ুন) এভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করা একেবারেই সমীচীন নয়, তাও যদি হুমায়ুন সেটা করেন তাহলে একজন খাঁটি মুসলিম শাসক হিসাবে বাহাদুর শাহও বাধ্য হবেন তার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে। সমকালীন বেশ কয়েকজন মুঘল ঐতিহাসিক হুমায়ুনের সেখানে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থাকার দিকটিকে সেভাবে গুরুত্ব না দিয়ে বাহাদুর শাহের কাফেরের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার হুঁশিয়ারির পরেও তার উজ্জয়নীতে অবস্থান করে থাকাকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে একপ্রকার অনিচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ বলে ব্যাখ্যা করেছেন।
রাজপুতরা এ-সময় যেভাবে মুঘল শক্তির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে অদম্য প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিলেন তা রুমি খানের আক্রমণকে প্রত্যাশার থেকেও অনেক বেশি প্রখর করে তুলেছিল। দু’মাস পরে যখন দুর্গের পতন ঘটল (মার্চ, ১৫৩৪) বাহাদুর শাহ প্রথমে এগিয়ে এলেন এবং উত্তর উজ্জয়নের ৮০ মাইল উত্তরে মান্দাসোরের কাছে হুমায়ুনের মুখোমুখি হলেন। তার কয়েকজন অভিজাত তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে যেভাবে তার পদাতিক বাহিনী সাফল্যের একের-পর-এক শিখর জয় করে রীতিমতো আত্মবিশ্বাসী, তাতে বুদ্ধিমানের কাজ হবে এখনই হুমায়ুনকে আক্রমণ করে পরাস্ত করা। কিন্তু নিজ গোলন্দাজ বাহিনীর ওপর প্রবলভাবে গর্বিত রুমি খান বলেছিলেন যে, যখন আমাদের কাছে অনেক বেশি শক্তিশালী অস্ত্র কামান রয়েছে তখন নিছক পদাতিক বাহিনী দিয়ে হুমায়ুনকে আক্রমণ করে তরবারি ও বল্লম খরচ করার কোনো প্রয়োজন নেই। রুমি খানের উপদেশ মেনে বাহাদুর শাহ অটোমান রণকৌশল গ্রহণ করে তার বাহিনীর অগ্রভাগ ও পার্শ্বদেশ যুদ্ধযান ও পরিখা দিয়ে ঘিরে একটা নিচ্ছিদ্র সুরক্ষা বলয় নির্মাণ করেন যাতে সেই সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে থেকে গোলন্দাজ বাহিনী নিরাপদে গোলাগুলি নিক্ষেপ করতে পারে। অন্যদিকে ছিল একট বৃহৎ হ্রদ যা বাহাদুর শাহের রক্ষণাত্মক তথা আক্রমণাত্মক রণকৌশলকে দৃঢ়তা প্রদান করেছিল। এইভাবে নেওয়া বাহাদুর শাহের রণকৌশল অনেকটাই পানিপথ যুদ্ধের সময় বাবরের নেওয়া রণকৌশলের মতো ছিল। যদিও রুমি খান এটা ভুল গিয়েছিলেন যে হুমায়ুন কোনো আফগান সামরিক প্রধান ছিলেন না যিনি ইব্রাহিম লোদির মতো অভিনব অটোমান। রণকৌশল দেখে ঘাবড়ে যাবেন। অত্যন্ত শক্তিশালী রক্ষণভাগ নিয়েই হুমায়ুন কৌশলে বাহাদুর শাহের শিবিরের আক্রমণ প্রতিহত করার পরিকল্পনা করেন। শত্রুপক্ষের প্রাথমিক বেশ কিছু আঘাতে হুমায়ুনের বাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ঠিকই কিন্তু তারপর হুমায়ুন তার বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, বেশি না এগিয়ে বাহাদুর শাহের শিবিরে খাদ্য সরবরাহকারী সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিতে। এই পদক্ষেপ এতটাই ফলপ্রসূ হয়েছিল যে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই বাহাদুর শাহের শিবিরের ঘোড়াগুলি প্রবল খাদ্যাভাবে মরতে শুরু করে এবং সেনাবাহিনীও ব্যাপক খাদ্যসংকটের মধ্যে পড়ে। এইভাবে রুমি খানের রক্ষণাত্মক অথচ আক্ৰমাণত্মক রণকৌশল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল।
বিপদে পড়ে এবার বাহাদুর শাহ তাঁর সবথেকে শক্তিশালী বন্দুকগুলো দাগার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং কয়েকজন অনুগামীকে সঙ্গে নিয়ে অত্যন্ত সন্তর্পণে ঘুরপথে মার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। বাহাদুর শাহের অস্ত্রশস্ত্রে ঠাসা সামরিক শিবির সমস্তটাই হুমায়নের দখলে চলে আসে এবং সেনাবাহিনীকেও সম্পূর্ণভাবে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয় (এপ্রিল, ১৫৩৫)। হুমায়ুনের নেতৃত্বেও লঘু অস্ত্রে সজ্জিত প্রায় ৩০,০০০ সেনা সোজা পথে মা এসে পৌঁছায় বাহাদুর শাহের আগেই। আসলে ইতিমধ্যেই বাহাদুর শাহের অনেক সহযোগী অভিজাতকেই হুমায়ুন নিজের কাজে নিযুক্ত করে নিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন খুদওয়া খান যিনি গুজরাট অভিযানের সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার সভাসদের ও উপদেষ্টার ভূমিকায় কাজ করেছিলেন। পরে রুমি খানও হুমায়ুনের শিবিরে যুক্ত হয়েছিলেন কারণ তিনি ছিলেন নিছকই একজন পেশাদার ভাড়াটে যোদ্ধা যিনি ভালো বরাত পেলে যে-কোনো শিবিরের হয়েই যুদ্ধ করতে কুণ্ঠা। বোধ করতেন না। তাছাড়া চিতোর দখলের পর সেখানের সামরিক প্রধানের দায়িত্বে। নিযুক্ত না করায় রুমি খান বাহাদুর শাহের ওপর অসন্তুষ্টও ছিলেন। তাই এভাবে রুমি খানের শেষ বেলায় এসে বিশ্বাঘাকতকতা করে শিবির বদল করার ঘটনা হুমায়ুনের বিরুদ্ধে বাহাদুর শাহের ব্যর্থতার অন্যতম একটা হিসাবে বিবেচিত হয়।
কিছু সময় পরে মাণ্ডু পৌঁছে বাহাদুর শাহ আর কোনো পথ খোলা না থাকায় হুমায়ুনের সঙ্গে সমঝোতায় বসতে বাধ্য হন। তিনি চিতোর ও গুজরাটের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার প্রতিদানে হুমায়ুনকে মালব অঞ্চলে ছেড়ে দেবার প্রস্তাব দেন। ডঃ ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, প্রস্তাবটি প্রাথমিক ভাবে গ্রহণ করা হলেও কোনো প্রথা মতো চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়নি। উভয় পক্ষের সেনাই ধীরে ধীরে একে অপরের দিকে অগ্রসর হয়ে প্রবেশদ্বার খুলে দেয়। বাইরে থাকা মুঘল বাহিনী এবার অতর্কিতে সদলবলে প্রবেশ করে মাণ্ডুতে। তুমুল হই-হট্টগোলের সুযোগ নিয়ে বাহাদুর শাহ কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে পালিয়ে চম্পানিরের দুর্গে গিয়ে আশ্রয় নেন। টানা তিন। দিন ধরে হুমায়ুনের বাহিনী মাণ্ডু শহরটিকে লুঠ করে আর তারপর চম্পানিরের। উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে।
জঙ্গলে ঘেরা চম্পানিরের দুর্গটি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী একটি আস্তানা। এই দুর্গটি ছিল এমন একটি নিরাপদ জায়গা যেখান থেকে বাহাদুর শাহ দীর্ঘ সময় ধরে হুমায়ুনকে প্রতিরোধ করে রাখতে পারতেন। কিন্তু বাহাদুর শাহের আর হুমায়ুনের সঙ্গে লড়াই করার সাহস ও ক্ষমতা ছিল না। তাই পরিবারের সদস্যদের ও দুর্গে জমিয়ে রাখা তার অবশিষ্ট সম্পদ দিউ শহরে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুগামীকে সঙ্গে নিয়ে চম্পানিরের দুর্গ ত্যাগ করেন। দুর্গ ত্যাগ করার সময় হুমায়ুন এত ক্ষিপ্রতায়। বাহাদুর শাহকে তাড়া করেছিলেন যে তিনি ক্যাম্বের (খাম্বাত) এক প্রান্তরে দ্বার দিয়ে বেরোনোর সঙ্গেই হুমায়ুন অন্য দ্বার দিয়ে সেখানে প্রবেশ করেছিলেন। বাহাদুর শাহ এবার পর্তুগিজ নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন দিউ শহরের দিকে যাত্রা শুরু করেন। এভাবেই। হুমায়ুন বাহাদুরকে গুজরাট ছাড়া করে ছেড়েছিলেন।
ক্যাম্বে থেকে এরপর হুমায়ুন চম্পানিরে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং সেখানকার দুর্গটি দখল নিতে কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন। কিছুদিনের মধ্যেই মুঘল কারিগররা দুর্গে খাদ্য সরবরাহের জন্যে একটি গোপন পথ নির্মাণ করে ফেলে। এরপর প্রাচীরে, আরোহণ করে মুঘল বাহিনী দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করে এবং ৪১তম ব্যক্তি হিসেবে হুমায়ুন চম্পানিরের দুর্গের দখল নেন (অগাস্ট, ১৫৩৫) যা আমাদের সকলেরই জানা। দুর্গ দখল করে মুঘলরা এত বিশাল সম্পদ লাভ করেছিলেন যে এই অভিযানে যুক্ত থাকা প্রত্যেক সৈন্যকেই প্রচুর সোনা ও অলংকার দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। তাছাড়া ইতিমধ্যেই হুমায়ুন গুজরাটের বিরোধী শিবিরের বহু অভিজাতদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন যার ফলে এবার অনেকেই মুঘল শিবিরে যোগদান করতে শুরু করেন।
এইভাবে চম্পানির দুর্গ দখলের মধ্য দিয়ে মুঘলদের দক্ষিণ গুজরাট জয় সম্পন্ন হল। কিন্তু আহমেদাবাদ ও পাটন সহ সমগ্র উত্তর গুজরাট তখনও বাহাদুর শাহের লোকজনদের দখলে ছিল। হুমায়ুন বর্ষার দিনগুলো চম্পানিরে অতিবাহিত করার সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার বেশ কয়েকটি উৎসব উপভোগ করেন, আর তারপরেই তিনি মনোনিবেশ করেন উত্তর গুজরাট আক্রমণের দিকে। এর মধ্যে মুঘলদের ভূমি রাজস্ব আদায়ের প্রক্রিয়ায় কেউ বাধা দেয়নি। কিন্তু বাহাদুর শাহ নিজে তাঁর এক দক্ষ দাস ইমাদ-উল-মুলককে সমগ্র গুজরাট, বিশেষ করে উত্তর গুজরাট থেকে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব অর্পণ করে গিয়েছিলেন। ফলে যে অর্থ ইমাদ-উল-মুলক সংগ্রহ করেছিলেন তার বলে বলীয়ান হয়ে এবং সেখানকার সামগ্রিক মুঘল-বিরোধী মনোভাবকে কাজে– লাগিয়ে তিনি প্রায় ১০,০০০ সেনা জোগাড় করে ফেলেছিলেন যা অচিরেই বেড়ে হয়েছিল ৩০,০০০। একজন রাজস্ব কর্মচারীর এহেন শক্তিবৃদ্ধিতে বিচলিত হয়ে পড়েন হুমায়ুন। অতঃপর আহমেদাবাদের কাছে মেহমুদাবাদে হুমায়ুনের নেতৃত্বাধীন মুঘল বাহিনীর সঙ্গে ইমাদ-উল-মুলকের এই বাহিনীর সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রবল লড়াইয়ের। পর মুঘল বাহিনী জয়লাভ করে। আহমেদাবাদ এবার তাদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং কিছুদিনের মধ্যেই তা দখল করে নেন হুমায়ুন (অক্টোবর, ১৫৩৫)।
আগ্রা ত্যাগ করার দশ মাসের মধ্যেই হুমায়ুন মালব ও গুজরাটের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় তিনি দীপ্ত নেতৃত্ব, অসীম দৃঢ়তা, ও অদম্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন এবং একথা স্বীকার করতেই হবে যে, সম্পূর্ণ নিজের কৃতিত্বে তিনি এই সাফল্য অর্জন করেছিলন।
তবে গুজরাট নিয়ে এরপর তিনি কী করবেন তা তখন ঠিক করে উঠতে পারেননি হুমায়ুন। তার অভিজাত গোষ্ঠীও এ ব্যাপারে বিভ্রান্তিতে ভুগছিল। এদের মধ্যে অনেকেই বাবর যখন হিন্দুস্থানে স্থায়ীভাবে থাকবেন ঠিক করেছিলেন তখন আফগানিস্তান থেকে দিল্লি-আগ্রা অঞ্চলে চলে এসেছিলেন পরিবার পরিজন ছেড়ে। ফলে পুনরায় দিল্লি-আগ্রা ছেড়ে গুজরাটেই থেকে যাওয়ার আদেশ এলে তা মেনে নিতে তারা একেবারেই ইচ্ছুক ছিলেন না। কিন্তু যেভাঘে বাহাদুর শাহকে পরাজিত করা হয়েছিল ও তার সম্পদ ভাণ্ডারের বণ্টন করা হচ্ছিল তাতে তারা এটা বুঝতেই পারছিলেন যে গুজরাটে মুঘল প্রশাসনের সম্প্রসারণ করার দিকেই এগোচ্ছেন হুমায়ুন। এ সময় এক হিন্দু বেগ ও কয়েকজন প্রথম সারির অভিজাত হুমায়ুনকে উপদেশ দিয়েছিলেন যে, সেনাবাহিনীকে এক বা দুই বছরের আগাম বেতন দিয়ে ও কিছু ধনসম্পদ নিজেদের কাছে রেখে গুজরাটের রাজ্যপাট বাহাদুর শাহকেই ফিরিয়ে দেওয়া হোক। তাতে ক্ষতি নেই কারণ বাহাদুর শাহের পুনরায় হুমায়ুনের সঙ্গে যুদ্ধ করার কোনো ক্ষমতাই ছিল না। ঠিক পানিপথের যুদ্ধে জয়লাভের পর বাবরের মতো হুমায়ুনও এই যুক্তি দিয়েছিলেন যে ‘তরবারির শক্তি দিয়ে যে সাম্রাজ্য জয় করা হয় তাকে হেলায় ছুঁড়ে ফেলতে নেই। তাকে যথাযথভাবে সংগঠিত করতে ও দিল্লির সরাসরি প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে যাবতীয় ব্যবস্থা করতে হয়।’ তাই হুমায়ুন আসকারিকে গুজরাটের সামগ্রিক দায়িত্ব দিলেন এবং ঠিক হয় হিন্দু বেগ ৫০০০ সেনা সহযোগে তার সহকারী হিসাবে কাজ করবেন। গুজরাটের বাকি অংশ পাঁচ ভাগে বিভক্ত করে প্রত্যেক বিভাগের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় এক-একজন বিশিষ্ট অভিজাতের ওপর। এই ব্যবস্থা ছিল। আসলে বাবরের দোয়াব অঞ্চলে নেওয়া প্রশাসনিক ব্যবস্থার মডেলের অনুকরণ যেখানে বিস্তীর্ণ অঞ্চল বা ইক্তার দায়িত্ব বেগদের অধীনে বণ্টন করে দেওয়া হয়েছিল। যারা সেখানকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষা ও রাজস্ব আদায়ের কাজ করত। আদায়ীকৃত রাজস্বের একটা অংশ তারা দিল্লির রাজকোষে প্রেরণ করত। এই রাজস্ব আদায়ের জন্যেই হয়তো হুমায়ুন গুজরাটের কোনো অঞ্চলকেই খালিসা জমি হিসাবে সংরক্ষণ করেননি।
এসব ব্যবস্থা করার পর হুমায়ুন ধীরে ধীরে নিজেকে মাণ্ডুতে স্থানান্তরিত করেন কারণ সেখানকার স্বাস্থ্যকর আবহাওয়া ও মোটামুটিভাবে কেন্দ্রস্থলে অবস্থানের জন্যে। তা তাঁর কার্যকলাপের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। মাণ্ড থেকে তিনি সহজেই গুজরাট ও উত্তর ভারত উভয় দিকেই একসঙ্গে নজর রাখতে পারতেন। তিনি তার হারেমের সঙ্গিনীদের এ সময় মাণ্ডুতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন যা থেকে এটা মনে হয়। যে তিনি হয়তো এখানে দীর্ঘদিন থাকার একটা বাসনা পোষণ করেছিলেন। কিন্তু গুজরাট ত্যাগ করার এক মাসের মধ্যেই দেখা যায় সেখানকার প্রশাসনিক যে ব্যবস্থা তিনি প্রচলন করে এসেছিলেন তা ভেঙে পড়েছে। আসলে আসকারির ওপর যে। গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তার জন্য তিনি যোগ্যই ছিলেন না। বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিজাতদের সঙ্গে কোনোরকমে সহযোগিতার পরিবেশ তিনি গড়ে তুলতেই পারেননি। তবে এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মূল কারণটা ছিল যাদের ওপর, হুমায়ুন নির্ভর করেছিলেন সেই অভিজাতগোষ্ঠীর গুজরাটে থাকতে না চাওয়া। তারা গুজরাটকে একটা বিদেশভূমি ও নিজেদের সেখানে নিছকই বিদেশির চেয়ে বেশি কিছু ভাবতেই পারেনি। সেইসঙ্গে এ-সময় গুজরাটের মানুষজনদের মধ্যে দেখা দেয় প্রবল আঞ্চলিক স্বাধীনতার চেতনা এবং বাহাদুর শাহের ক্ষমতার পুনরুত্থান। ডামাডোলের মধ্যে বীতশ্রদ্ধ হিন্দু বেগ প্রস্তাব দেন যে এ-সময় আসকারির নিজেকে স্বাধীন শাসক হিসাবে ঘোষণা করে দেওয়া উচিত কারণ তিনি সহজেই সেখানকার অভিজাতবর্গ ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতা পেয়ে যাবেন আর স্থানীয় সমর্থনও পেতে তার কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু বিশ্বস্ত আসকারি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও এমন একটা গুজব চারিদিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল যে তিনি নিজেকে রাজা হিসাবে ঘোষণা করেছেন। আর এটাই পরবর্তীকালে মুঘল অভিজাততন্ত্রে ব্যাপক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছিল।
একমাত্র হুমায়ুনের কঠোর হস্তক্ষেপই পারত এই পরিস্থিতি কাটিয়ে তুলতে, কিন্তু তাঁকে সে সময় কোনোরকম সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি, কোনো নির্দেশও তিনি জারি করেননি। হয়তো তার প্রচলিত ব্যবস্থার ওপর প্রবল আত্মবিশ্বাস ছিল নয়তো চরম অবসাদে ভুগে চুপ করে ছিলেন। তবে এর মধ্যে বাহাদুর শাহ কিন্তু চুপ করে বসে থাকেননি। তিনি তার সুরাটে অবস্থিত কার্যকলাপের মূল ঘাঁটি থেকে অভিযান চালিয়ে দ্রুত ক্যাম্বে ও ব্রোচ পুনর্দখল করে নিয়েছিলেন এবং আহমেদাবাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এই চ্যালেঞ্জ আসকারি ও হিন্দু বেগ-এর পক্ষে সহজেই প্রতিহত করা সম্ভব ছিল কারণ বাহাদুর শাহের শিবিরে খুব বেশি সেনা ছিল না। কিন্তু দ্বিধাবিভক্ত মন্ত্রণা শিবিরের বিভ্রান্তি ও চাপ সামলাতে না পারার কারণে আসকারি চম্পানিরে সরে আসতে বাধ্য হন। তাও যদি মুঘলরা এ-সময় ঐক্যবদ্ধ থাকত তাহলেও কিন্তু চম্পানিরকে কেন্দ্র করে বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে তারা প্রতি-আক্রমণ শানাতে পারত। কিন্তু আসকারি স্বাধীন হবার স্বপ্ন দেখছেন এই আশঙ্কা করে চম্পানির দুর্গের সেনাপ্রধান তারদি বেগ তাঁদের দুর্গে প্রবেশের অনুমতি দেননি। এবং সরাসরি হুমায়ুনের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে কোনোরকম আর্থিক সহায়তা করতেও অস্বীকার করেন। তারদি বেগের এই সিদ্ধান্তটা ঠিক ছিল না ভুল তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে ঠিকই কিন্তু আমরা যখন এটা জানি যে সে সময়ের পারস্পরিক সন্দিগ্ধ পরিবেশে কারোর পক্ষেই মাথা ঠান্ডা রেখে ও সবদিক বিচার বিবেচনা করে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা সহজ ছিল না। তখন এসব বিতর্কের কোনো যৌক্তিকতাই আর থাকে না। প্রচণ্ড রাগে এরপর আসকারি আগ্রার দিকে অগ্রসর হন। বেশিরভাগ মুঘল বাহিনীকেই গুজরাট থেকে অপসরণ করে নেওয়া হয় এবং তারাও আসকারিকে অনুসরণ করে চলতে থাকে। এটা দেখে হুমায়ুনের আশঙ্কা হয় যে আসকারি হয়তো পরিকল্পনা করেই আগ্রায় নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করতে এগিয়ে আসছে। ফলে তড়িঘড়ি তাকে আটকাতে হুমায়ুন ছুটে যান। দু’পক্ষ চিতোরে একে অপরের মুখোমুখি হয় এবং ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটে। কিন্তু বিভ্রান্তির মাঝে মালবও মুঘলদের হাত ছাড়া হয়ে যায় (ফেব্রুয়ারি, ১৫৩৭)।
শেষের দিকে হুমায়ুনের মর্যাদা হানিকর এই ধাক্কাগুলো সত্ত্বেও তার সামগ্রিক গুজরাট অভিযান যে পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছিল এমনটা কিন্তু বলা যাবে না। এই অভিযান থেকে আমরা শুধু যে একজন সাহসী নেতা ও বলিষ্ঠ সেনাধিপতি হিসাবে হুমায়ুনকে আবিষ্কার করেছিলাম তা নয়, এই অভিযান মুঘল শিবির থেকে বাহাদুর শাহের আতঙ্ক একেবারেই ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিয়েছিল। যেটুকু বিপদ অবশিষ্ট ছিল। তাও কেটে যায় পর্তুগিজদের সঙ্গে ঝামেলার ফলে তাদের হাতে বাহাদুর শাহের হত্যার মধ্য দিয়ে। এবার হুমায়ুন বিহারের আফগান নেতা শের খান যে সমস্যা তৈরি করছিল সেদিকে সম্পূর্ণভাবে নজর দিতে সময় পেয়ে যান।
তবে যদি আমরা হুমায়ুনের গুজরাট অভিযানের পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখব যে এখানে তিনি বাহাদুর শাহের সঙ্গে এলাকা ছেড়ে দেবার সমঝোতায় যাননি, বরং গুজরাটে সরাসরি মুঘল প্রশাসনিক ব্যবস্থা বলবৎ করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। অবশ্যই তিনি যদি আরও কিছুটা সময় আহমেদাবাদে অতিবাহিত করে সেখানকার স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে বোঝাপড়া বাড়াতেন তাহলে হয়তো সেটা তার আরও বেশি সুকৌশলী রাজনৈতিক পদক্ষেপ হত। তিনি এটা করতেই পারতেন কারণ সে সময় মালব বা পূর্ব ভারতে যেখানে শের খান সক্রিয় ছিলেন সেখানে এমন কোনো গুরুতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি যার জন্যে হুমায়ুনকে তড়িঘড়ি সেখানে গিয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে হত। অন্তত যেভাবে তিনি মাণ্ডু থেকে ফিরে শের খানের বিরুদ্ধে পূর্ব ভারতে অভিযানে যাওয়ার আগে প্রায় বছর খানেক আগ্রাতে সময় কাটিয়েছিলেন তা থেকে এটা স্পষ্ট যে ওই সময় শের খানের বিপদটা অতটা গুরুতর মনে করেননি তিনি।
হুমায়ুনের ব্যর্থতা যেটা ছিল তা হল, গুজরাট জয় করার পরে সেখানকার কৌশলগত পরিস্থিতি ও বাস্তব অবস্থাকে বুঝতে না পারা। সেইসঙ্গে তাঁর প্রথম সারির অভিজাতদের মনও তিনি ঠিক করে বুঝতে পারেননি, বিশেষ করে আসকারিকে তো একেবারেই নয়। প্রথমদিকে তার ক্ষমতা সম্পর্কে হুমায়ুন অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলেন আর পরের দিকে তাঁর ওপর হয়ে পড়েছিলেন অতিমাত্রায় সন্দিহান। তাছাড়া কোনো অঞ্চলে শাসন কায়েম করার সময় সেখানকার আঞ্চলিক গৌরব ও জনগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কোনোরকম ধোঁয়াশায় বেশিদিন থাকা উচিত নয়। কিন্তু হুমায়ুন বোধ হয় সে ধোঁয়াশা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। মুঘলদের গুজরাট জয়ের সময় সেভাবে কোনো আঞ্চলিক জনগোষ্ঠীর বিক্ষোভ দেখা যায়নি। ক্যাম্বেতে হুমায়ুনের বিরুদ্ধে কোলি ও গ্রামবাসীদের (গাওয়ারন) বিদ্রোহ ঘোষণা নিছকই সম্পদের লোভে লুঠপাট করতে চাওয়া ছাড়া বেশি কিছু ছিল না। তাই তার বদলা নিতে হুমায়ুনের ক্যাম্বে জুড়ে লুণ্ঠন চালানোর কোনো দরকার ছিল না। এর ফল কিন্তু তাঁকে ভোগ করতে হয়েছিল।
এইভাবে বৃহৎ সাম্রাজ্যের আধিপত্যের আগ্রাসন এবং আঞ্চলিক স্বাধীনতা রক্ষার
মরিয়া প্রচেষ্টার মধ্যে সংঘাত যা ছিল ভারতের ইতিহাসের স্থায়ী বৈশিষ্ট্য তা আরও একবার সামনে চলে এসেছিল।
হুমায়ুনের বাংলা অভিযান ও শের খানের সঙ্গে সংঘাত
গুজরাট অভিযান শেষ করে ফেরার পর হুমায়ুন ভবিষ্যতে ঠিক কি করবেন তা ভেবে উঠতে পারছিলেন না। আবুল ফজলের মতে, এ-সময় হুমায়ুন গুজরাটের বিরুদ্ধে আর-একটা অভিযান চালাবেন বলে মনঃস্থির করেছিলেন এবং এর ব্যবস্থাপনা তাদের উপরেই অর্পণ করতে চেয়েছিলেন যাঁরা প্রশাসনে দক্ষ ও বিবেচনা ও প্রকৃতিগত দিক থেকে পরিবর্তনশীল হতবুদ্ধির শিকার হন না। ওই রাজ্যের সম্পর্কে ব্যবস্থা নিয়ে তিনি নিশ্চিত মনে ফিরে আসবেন এটাই ছিল তার ভাবনা। কিন্তু যখন তিনি তার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময়ে ভারতের পূর্ব দিকে শের খানের ক্ষমতা বৃদ্ধির খবর আসে যার ফলে হুমায়ুন বাংলা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। বাংলা জয় করার উদ্যোগ তিনি গুজরাট অভিযানের আগে থেকেই নিয়েছিলেন এবং কল্পি পর্যন্ত এগিয়েও গিয়েছিলেন কিন্তু বাহাদুর শাহের বাড়বাড়ন্ত শুরু হওয়ায় তাকে মাঝপথেই আগ্রায় ফিরে আসতে হয়েছিল। তাই এবার ‘ঠিক করা হয় যে শের খানকে দমন করে বাংলাকে নিজেদের অধিকারে নেওয়া হবে’, এমনটাই লিখেছেন আবুল ফজল।
এটা মনে করা হয় যে হুমায়ুনের পূর্ব ভারত অভিযানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল বাংলা জয় করা, শের খানকে শায়েস্তা করা নয়। কিন্তু এই যুক্তি মেনে নিলে এই পরিপ্রেক্ষিতে হুমায়ুনের নেওয়া একাধিক পদক্ষেপ সম্পর্কে বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। তাই সেদিকে না গিয়ে আমরা যদি কেবল হুমায়ুনের অভিযানের দিকে তাকাই তাহলে দেখব যে, ১৫৩৭-এর জুলাই মাসে ঘোর বর্ষাকালে হুমায়ুন আগ্রা ত্যাগ করে কোনোরকম তাড়াহুড়ো না দেখিয়ে ধীরে ধীরে শক্তিশালী চুনার দুর্গের উপান্তে এসে উপস্থিত হলেন। বেনারসে কিছুদিন অতিবাহিত করার পর হুমায়ুন ঠিক করলেন চুনার দুর্গটি দখল করবেন, কারণ এই দুর্গ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে তাকে কোনোভাবেই শত্রুপক্ষের হাতে পড়তে দেওয়া ঠিক হত না। তাছাড়া এই দুর্গের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে বাংলা অভিমুখে অগ্রসর হবার সময় পিছন দিক থেকে শত্রুদের আক্রমণের আশঙ্কাও অনেকটা কমে যায়। যদিও সেরা বন্দুকবাজ রুমি খানের তৎপরতা সত্ত্বেও চুনার দুর্গ দখল করতে হুমায়ুনের প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই সময় লেগেছিল। ঠিক এই দুর্গ দখলের সময়েই (জুন, ১৫৩৮) শের খান বাংলার রাজধানী গৌড় অধিকার করে নিয়েছিলেন। চুনার জয়ের পর হুমায়ুন শের খানকে আত্মসমর্পণ করা এবং বাংলার শাসকের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া রাজকীয় ছত্র ও অন্যান্য রাজকীয় প্রতীক ফিরিয়ে দেওয়া তথা বাংলা জয়ের বাসনা ত্যাগ করার প্রতিদানে তাকে চুনার, জৌনপুর বা অন্য কোথাও পছন্দমতো জায়গির দান করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বস্তুত এই প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে বাংলা জয় করা সত্ত্বেও শের খানকে হুমায়ুন নিছকই একজন প্রথম সারির জায়গির-ভোগী আফগান সর্দার হিসাবেই দেখেছিলেন। পরবর্তীকালের আফগান ঐতিহাসিকদের মতকে যদি মানা যায়, তাহলে বলতেই হবে যে এ-সময় শের খান ভারতের মাটি থেকে মুঘলদের উৎখাত করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে আফগানদের তাঁর ছত্রছায়ায় একত্রিত করতে শুরু করে দিয়েছিলেন।
আমাদের কাছে যা তথ্যপ্রমাণ রয়েছে তার ভিত্তিতে এটা মনে হয় যে চুনার বা বিহার নয় বরং বাংলাই ছিল শের খান ও হুমায়ুনের বিবাদের মূল কারণ। শের খান কেন বাংলা জয় করতে চেয়েছিলেন তা আমাদের কাছে স্পষ্ট। বিহার ও বাংলার শাসকের মধ্যে প্রায়শই সংঘর্ষ চলত। আগেই দেখেছি, বাংলার শাসক নুসরত শাহ বাবরের আগমনের প্রাক্কালে বিহার ও উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশের কিছু জায়গার ওপর একবার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিহারের ওপর কর্তৃত্ব কায়েম করে শের খানকেও। একাধিকবার বাংলার সামরিক অনুপ্রবেশ সামলাতে হয়েছিল। নুসরত খানের মৃত্যুর। পরবর্তীকালে বাংলার সিংহাসন ক্ষমতাবলে দখল করা সুলতান আহমেদ শাহের আমলেও শের খান বাংলার সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন। তাই শের খানের পরিকল্পনা ছিল সরাসরি মুঘল বিরোধিতায় না গিয়ে বাংলা জয় করার মধ্য দিয়ে নিজ শক্তি ও প্রতিপত্তিকে বৃদ্ধি করা। কিন্তু এমন সময়ে হুমায়ুনের তরফ থেকে তাঁর কাছে বাংলা জয়ের বাসনা ত্যাগ করার প্রস্তাব আসায় তিনি কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলেন এবং জবাবে পরিষ্কার করেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে বাংলা জয়ের স্বপ্ন ত্যাগ করার মতো পরিস্থিতি এখনও আসেনি, এখনও তার অনেক ঘাম-রক্ত ঝরানোর বাকি আছে। বরং তিনি বিহার হুমায়ুনকে ছেড়ে দেবার ও বাংলার ওপর অধিকার কায়েম নিশ্চিত হলে। বাৎসরিক দশ লক্ষ টঙ্কা পেশকাশ প্রদানের পালটা প্রস্তাব দিলেন যা হুমায়ুন মেনে। নিয়েছিলেন।
এই সমঝোতার ধরন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল শের খান আর নিজেকে হুমায়ুনের অধীনস্থ হিসাবে নয় বরং স্বাধীন শাসক হিসাবেই দেখতে চাইছিলেন। যদিও তাঁর স্বাধীন হওয়ার ইচ্ছা আগে থেকেই প্রকাশ পাচ্ছিল। বিহার থেকে তাকে উচ্ছেদ করতে নুসরত খানের নেতৃত্বে আসা বাংলার সেনাকে সুরজগড়ের যুদ্ধে পরাজিত করে (১৫৩৪) শের খান নিজেকে ‘হজরত-ই-আলা’ হিসাবে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। হুমায়ুনের গুজরাট অভিযানের সময় তাঁর হয়ে ৫০০ ঘোড়সওয়ার নিয়ে যুদ্ধ করতে যাওয়া শের খানের পুত্র কুতুব খান ফিরে এসেও এই বার্তাই বোধ হয় দিতে চেয়েছিলেন যে আর তারা হুমায়ুনের অধীনে থাকতে ইচ্ছুক নয়। এমনকি পূর্বে চুনারে সম্পাদিত হওয়া হুমায়ুনের সঙ্গে চুক্তিকে শের খান বাতিল বলে ঘোষণা করে দিতেও দ্বিধা করেননি।
শের খানের বাংলার বদলে বিহার ছেড়ে দেবার প্রস্তাব হুমায়ুন গ্রহণ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু অচিরেই পরাজিত বাংলার শাসক মেহমুদ শাহ হুমায়ুনের কাছে গিয়ে তাকে বাংলা আক্রমণ অব্যাহত রাখার আবেদন জানান-কারণ গৌড় শের খানের হাতে চলে গেলেও অবশিষ্ট বাংলা তখনও শের খানের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে প্রস্তুত ছিল। আবুল ফজলের ভাষায়, হুমায়ুনের সামনে বাংলা আক্রমণ করার এটা একটা অতিরিক্ত অজুহাত এনে দিয়েছিল। বাংলার শাসক হুমায়ুনকে এটাও জানিয়েছিলেন যে বাংলায় এত বিশাল ধনসম্পদের ভাণ্ডার রয়েছে যা তার হাতে এলে তা দিয়ে সমস্ত দুনিয়ার ‘খারাজ’ কর পূরণ করা যাবে।
তাই রাজকোষের ধনসম্পদ আত্মসাৎ হুমায়ুনের বাংলা আক্রমণ পরিকল্পনার একটি অতিরিক্ত কারণ হিসাবে কাজ করেছিল বলে মনে হয়। তবে কয়েকজন আধুনিক ঐতিহাসিকের মতে, বাংলার শাসকের প্রস্তাব অনুযায়ী অর্থের বিনিময়ে তাকে তার সিংহাসন ফিরিয়ে দেওয়া নয়, বরং যেভাবেই হোক বাংলা দখল করাই ছিল হুমায়ুনের আসল উদ্দেশ্য। কারণ যাই থাকুক, হুমায়ুন বাংলায় প্রবেশ করার আগেই বাংলার শাসকের মৃত্যু হয়। এদিকে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে বাংলার শাসক মেহমুদ শাহ তাঁর ভ্রাতুস্পুত্ৰ তথা নুসরত শাহের সন্তানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বাংলার মসনদে বসেছিলেন। তাই তাকে অনেকেই বাংলার অবৈধ শাসক বলে মনে করত। এই কারণেই হয়তো হুমায়ুনের বাংলা আক্রমণকালে তার বিরুদ্ধে তেমন। কোনো স্থানীয় প্রতিরোধ ধেয়ে আসেনি।
এখানে প্রশ্ন জাগে, বাংলা যখন দীর্ঘদিন ধরে একটি স্বতন্ত্র সাম্রাজ্য হিসাবে নিজের অস্তিত্ব ধরে রেখেছে ও সেখানে একটি স্বাধীন শাসক রয়েছেন, তখন কেন হঠাৎ বাংলাকেই অধিকার করার জন্যে হুমায়ুন এত ব্যর্থ হয়ে উঠলেন? বিপুল ধনসম্পদ আত্মসাতের অভিসন্ধিকে বাদ দিলে এ-প্রশ্নের আর একটিমাত্র উত্তরই হতে পারে, তা হল–সচেতনভাবে হোক বা অসচেতনভাবে হুমায়ুন মুঘল সাম্রাজ্যের পরিধিকে বাংলা থেকে উত্তর-পশ্চিম ও একেবারে পশ্চিমে আরব সাগরের তীর পর্যন্ত প্রসারিত করে তাকে দিল্লি সুলতানির পরিধির সমতুল্য করে তুলতে চেয়েছিলেন। তবে এখানে একটা সংশয় ছিলই। যদি কোনোভাবে হুমায়ুন বাংলা জয় করতে সফল হয়েও যান, তাহলেও গুজরাট ও মালব পুনর্বার জয় করে তার সাম্রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধির স্বপ্ন পূরণ করা মোটেই খুব একটা সহজ কাজ হবে না।
সুতরাং, এ-সময় হুমায়ুন ও শের খানের মধ্যে যে সংঘাত অবধারিত হয়ে উঠেছিল তা নিছক দুই শাসকের এলাকা দখলের সংঘাত ছিল না, বরং তা পরিণত হয়েছিল এক সাম্রাজ্যের ছত্রছায়ায় উত্তর ও দক্ষিণ ভারতকে সংযুক্ত করার স্বপ্ন দেখা দুই উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষের সংঘাতে। কিন্তু কে হাসবে শেষ হাসি? কোন সাম্রাজ্যের অধীনে বিন্ধ্য পর্বতের দুই প্রান্তের ভারত এক হয়ে যাবে? মুঘলদের অধীনে না আফগানদের অধীনে?
বাংলায় প্রবেশের মুখে সিক্রিগলিতে শের খান হুমায়ুনকে আটকাতে সফল হলেও ততদিনে হুমায়ুন বাংলা থেকে প্রচুর পরিমাণে ধনসম্পদ আত্মসাৎ করে তাঁর নতুন। আস্তানা রোটাস দুর্গতে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। তার ওপর গৌড়ে প্রবেশের একটা সহজ রাস্তাও তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন। ফলে বেশিদিন তাকে আটকে রাখা যায়নি। কিন্তু এই যে তিনি বাংলায় প্রবেশের মুখেই বাধা পেলেন, এর মধ্য দিয়েই শুরু হল। তার পরবর্তীকালের একের-পর-এক সমস্যা। আগে গুজরাটের মতো এখানেও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে বলবৎ করা ও তার ব্যবস্থাপনা নিয়ে হুমায়ুন বিভ্রান্তিতে পড়েছিলেন। আবার তার পূর্বের গুজরাট মডেল থেকে বেরিয়ে তিনি প্রশাসনে স্থিরতা আনতে বাংলায় কিছু সময় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যেটা নিয়েও বিভ্রান্তির শেষ ছিল না। ঐতিহাসিক মহলে আবার হুমায়ুন ঠিক কতদিন বাংলায় থেকেছিলেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন তিন মাস ছিলেন, আবার কারও কারও মতে নয় মাস, কি এক বছর। তবে ঘটনাক্রম দেখে যেটা মনে হয় তা হল তিনি বর্ষকাল পার করে ১৫৩৮-এর সেপ্টেম্বর নাগাদ গৌড়ে পৌঁছেছিলেন এবং পরের বছরের শুরুর দিকে গৌড় ত্যাগ করেছিলেন। যতদিন তিনি বাংলায় ছিলেন ততদিন তাকে একেবারেই নিষ্ক্রিয় দেখা গিয়েছিল বলে যে অভিযোগ করা হয় সেটাও বোধ হয় পুরোটা সঠিক নয়। তিনি এ-সময় বিদেশি দূতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং আগ্রায় হিন্দাল বিদ্রোহ করেছেন শুনে সেখানে শেখ বাহলোলকে পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করারও চেষ্টা করেছিলেন। আর বাকিটা সময় তার কেটেছিল বাংলার বিভিন্ন উৎসব উপভোগ করে। গুজরাটের মতো এখানে কিন্তু হুমায়ুনকে কোনো স্থানীয় প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হয়নি। তবে বাংলাতে থাকাকালীন হুমায়ুন গুজরাটের মতো যে মূলগত সমস্যাটির সমাধান করতে পারেননি তা হল মুঘল অভিজাতদের দিল্লি ছেড়ে এত দূরে থাকতে না চাওয়ার প্রবণতা। গুজরাটের মতো তারা বাংলাকে নিছক একটি বিদেশভূমি হিসাবে মনে করতেন। ফলে এখানকার প্রশাসনিক ব্যবস্থা পরিচালনা করার কোনো মানসিকতাই তাদের ছিল না। আবুল ফজল জানিয়েছেন, বিশাল বিশাল এলাকার দায়িত্বে নিযুক্ত প্রথম সারির সব মুঘল আধিকারিক এখান থেকে তাদের যা কিছু মনোরঞ্জন ও তৃপ্তির উপাদান সঞ্চয় করে নিয়ে্’তাদের জীবনের সামনে খুলে দিতেন অবজ্ঞা ও অবহেলার দ্বার। সার্বভৌম শক্তির স্তম্ভ হিসাবে পরিচিত এই আধিকারিকরা প্রশাসনের দিকে একেবারেই নজরই দিতেন না।’ বোধ হয় নরম স্বভাবের জন্য না হয় বিশৃঙ্খলা এড়ানোর জন্য হুমায়ুন এদের কিছুই বলতেন না। এই আশকারা প্রদানের মাত্রা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে যখন হুমায়ুন আগ্রায় হিন্দালের বিদ্রোহ সংগঠিত করার খবর আসায় তড়িঘড়ি বাংলা ত্যাগ করে আগ্রা যাবার জন্যে বাংলার শাসনভার সাময়িকভাবে তার এক পুরোনো কর্মচারী জিহাদ বেগকে অর্পণ করতে চেয়েছিলেন, তখন জিহাদ বেগ জবাবে রীতিমতো ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, ‘আমায় হত্যা করার জন্যে বাংলার দায়িত্ব দেবার থেকে কি আর ভালো কোনো রাস্তা পাওয়া গেল না?’ এ-কথায় হুমায়ুন প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন। ঠিকই কিন্তু কিছু করার সাহস দেখাতে পারেননি বরং জিহাদ বেগের সঙ্গে বাংলায় সাময়িক দায়িত্ব নিতে বলা আরও দুই সহকারী কর্মচারী হাজি মহম্মদ ও দিনদার বেগকেও আগ্রায় পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন তিনি।
এত সমস্যা নিয়েও বাংলায় মুঘল প্রশাসনিক ব্যবস্থা বলবৎ করে শান্তিতে থাকতে। পারেন নি হুমায়ুন। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে বাংলা ছেড়ে চলে যাবার প্রস্তুতি শুরু করতে হয়–কারণ এখানকার প্রতিকূল আবহাওয়ায় তার অশ্বারোহী বাহিনীর অনেক ঘোড়াই মারা যাচ্ছিল। এভাবে বাংলায় হুমায়ুন হাজারো সমস্যায় যখন জর্জরিত তখন শের খান ঠান্ডা মাথায় বেনারস দখল করে চুনার ও জৌনপুর দুর্গ অবরোধ করে এবং কনৌজ ও সম্ভল পর্যন্ত মুঘল কর্তৃত্বকে বিনষ্ট করে দিয়ে মুঘল শক্তির সামনে বিরাট বিপদ ডেকে এনেছিলেন। শের খান মুঙ্গের এলাকাটিও দখল করে নিয়েছিলেন যাতে হুমায়ুন আগ্রার সঙ্গে সহজে যোগযোগ করতে না পারেন।
আগ্রায় হুমায়ুনের অনুপস্থিতিতে সেখানে তার ভাইদের সঙ্গে তার বিবাদকে আরও একবার সামনে এনে দিয়েছিল। আসকারি ও হিন্দাল দুজনেই অনেকদিন ধরে হুমায়ুনের অধীনে অনুগত থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। বাংলায় আসার পূর্বে হুমায়ুন হিন্দালকে ত্রিহুত ও পুর্ণিয়া জায়গির হিসাবে দান করে সেখানে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করতে বলেছিলেন। কিন্তু হুমায়ুন বাংলায় চলে আসার পর কোনোরকম অনুমতি ছাড়াই হিন্দাল আগ্রা দখল করে নিয়েছিলেন। বাংলা থেকে অনেক বীতশ্রদ্ধ মুঘল অভিজাতও এ-সময় আগ্রায় এসে হিন্দালের শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন। এরপর হিন্দাল নিজেকে স্বাধীন শাসক হিসাবে ঘোষণা করে নিজ নামে ‘খুৎবা’ পাঠ করেন ও দিল্লির অভিমুখে রওনা দেন। কিন্তু দিল্লির দুর্গের সেনাপ্রধান তাকে দিল্লিতে প্রবেশে বাধা দেন এবং বাধ্য করেন তাঁকে আগ্রায় ফিরে আসতে।
হিন্দালের এই বিদ্রোহের খবর শুনে হুমায়ুনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা কামরান লাহোর থেকে। এসে হিন্দালকে পরাজিত করেন এবং তার স্বাধীন হবার স্বপ্ন ভেস্তে দেন। এর মধ্যে হুমায়ুনও বিহার ও এখনকার উত্তরপ্রদেশের সীমান্তবর্তী চৌসা অঞ্চলে তার সেনাবাহিনী নিয়ে চলে আসেন। যেভাবে আফগানদের ক্রমাগত আক্রমণ সামলে মনোবল হারিয়ে ফেলা সেনাবাহিনীকে হুমায়ুন বাংলা ও বিহার থেকে প্রায় অক্ষত অবস্থায় বের করে। এনেছিলেন তা নিঃসন্দেহে তার একক প্রশংসনীয় সাফল্য ছাড়া আর কিছু ছিল না।
তবে সামগ্রিকভাবে হুমায়ুনের বাংলা অভিযান ছিল একেবারেই নিলা। তার উচিত ছিল বাবরের আমলে মুঘল সাম্রাজ্য পূর্ব ভারতের যতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ততদূরেই ধরে রাখা। তা না করে চুনার ছাড়িয়ে বিহার নগরী বা তার থেকেও আরও দূরে এগিয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি, কারণ ভারতে সে সময় মুঘল শক্তি অতটা শক্তিশালী ছিল না বা তার অভিজাতবর্গের আনুগত্য ও নিয়মানুবর্তিতাও সেই মাত্রায় শক্তিশালী ছিল না যাতে করে দিল্লি থেকে এতদূরে কোনো এলাকায় শাসনব্যবস্থা পরিচালনা ও। নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাদের এদেশে শিকড়টাও সেভাবে তখনও জমে ওঠেনি, তারা স্থানীয় মানুষের সমর্থন লাভ করেনি বা তা আদায় করার কথা ভাবেও নি। তবে এই পরিস্থিতিতে হুমায়ুন যেটা ভালো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা হল দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে বিশেষ করে গুজরাট, মালব, বাংলা প্রভৃতি এলাকার শাসনভার সেখানকার সেই সমস্ত স্থানীয় শাসকদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন যারা মুঘল সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করেছিল এবং আনুগত্য ও সমর্থন দিতে সম্মত হয়েছিল। যাই হোক, হুমায়ুন মুঘল সাম্রাজ্যের গরিমায় এতটাই মত্ত ছিলেন ও ছন্নছাড়া বাহিনী নিয়ে কোনোরকমে চৌসায় পৌঁছতে সক্ষম হওয়ায় তিনি তার আফগান শত্রুদের এতটাই দুর্বল ভাবতে শুরু করেছিলেন যে এইবার তিনি আগ্রা প্রত্যাবর্তন করে সেখান থেকে আফগানদের। প্রতিহত করবার ব্যাপারে ছিলেন একেবারেই নিশ্চিত। এইভাবে যে তার বাংলা ত্যাগ করে আগ্রা চলে যাওয়ার পরিকল্পনা, তাতেই সাধারণত ঐতিহাসিকরা এটা ভেবে নিয়েছিলেন যে হুমায়ুন বিহার লাভ ও শের শাহের আনুগত্যের প্রতিশ্রুতির প্রতিদানে তাঁকে বাংলা, চুনার দুর্গ ও অন্যান্য জায়গির এলাকা ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে বাংলা জয় করে এভাবে তা ছেড়ে চলে যাওয়া হুমায়ুনের পরাজয় স্বীকার করারই নামান্তর। বলা চলে।
শীঘ্রই হুমায়ুন শের খানের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালালেন এবং চৌসার কাছে দুই শিবিরের তুলুম যুদ্ধ শুরু হয় (২৬শে জুন, ১৫৩৯)। এই যুদ্ধে হুমায়ুন রীতিমতো ভ্রান্ত কৌশল নিয়ে নিকটবর্তী কর্মনাশা নদীকে পিছনের দিকে রেখে এগিয়ে গিয়েছিলেন–যার ফলে তার বাহিনীকে পশ্চাদপসরণের ক্ষেত্রে তৈরি হয় চরম বিপত্তি। এত বাজে ভাবে তিনি তার সেনাবাহিনীকে সাজিয়েছিলেন এই যুদ্ধে যে খুব সহজেই শের খান অতর্কিত আক্রমণ করার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন। ফলে হুমায়ুনের পরাজয় ছিল অনিবার্য। চৌসার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি আগ্রায় সরে আসতে বাধ্য হন। কামরানের কাছে। ১০,০০০-এর মতো সেনা ছিল যা এ সময় হুমায়ুনকে সাহায্য করবার পক্ষে যথেষ্ট ছিল, কিন্তু হুমায়ুনের সামরিক শক্তি বহনের ক্ষমতার প্রতি খুব একটা আস্থা রাখতে না পেরে কামরান সে বাহিনী পাঠাতে রাজি হননি। আগেও একবার তিনি চৌসায় সেনা পাঠানোর জন্যে হুমায়ুনের জরুরি তলব উপেক্ষা করে গিয়েছিলেন এই কারণে যে যদি সেই প্রেরিত বাহিনী সহযোগে হুমায়ুন সাফল্য লাভ করেন তাহলে তার রাজনৈতিক ও সামরিক প্রাসঙ্গিকতা কোথাও-না-কোথাও হারিয়ে যাবে। বিশেষ করে লাহোরে আফগানদের কাছে পরাজিত হবার পর সেখান থেকে হুমায়ুন তাকে অনায়াসে উৎখাত করে দিতে পারেন–এমন আশঙ্কায় তো কামরান ভুগছিলেনই।
কামরানের এই নিষ্ক্রিয়তার পর কার্যত তাকে অসুস্থতার অজুহাতে আগ্রা থেকে লাহোরে সরিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনা পুনরায় শের খানের সঙ্গে যুদ্ধের আগে হুমায়ুনের শিবিরকে অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছিল। তাই কনৌজের যুদ্ধে (১৭ই মে, ১৫৪০) হুমায়ুন এত বাজে ভাবে পরাজিত হলেন যে তার লজ্জার আর শেষ থাকল না।
শের খান পরপর দুটি যুদ্ধে হুমায়ুনকে পরাজিত করে দেবার পর তার সামনে এবার ভারতের মাটি থেকে মুঘলদের চিরতরে বিতাড়িত করার স্বপ্নটা আরও একবার উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তিনি এখন হুমায়ুনের উত্তর ভারতকে একটি সাম্রাজ্যের অধীনে ঐক্যবদ্ধ করার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার ব্যাপারে অনেকটাই সুবিধাজনক জায়গায় চলে এসেছিলেন।
এটা পরিষ্কার যে হুমায়ুন কখনোই আফগান চ্যালেঞ্জের প্রকৃতিটা বুঝতে পারেননি। তাই দিনের-পর-দিন শের খানের ক্ষমতাকে ছোটো করে দেখে গিয়েছেন। সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে আফগান জনজাতির যোদ্ধা বাহিনীর উপস্থিতি ছিল যা পরবর্তীকালের কোনো এক লেখকের হিসেব অনুযায়ী প্রায় ৫০০,০০০ পরিবারের মতো। এরা খুব সহজেই একজন যোগ্য নেতার অধীনে ঐকবদ্ধ হয়ে যেতে পারত, আর তাই এদের দিক থেকে আক্রমণ ধেয়ে আসার সম্ভাবনা ছিল সব সময়েই। ওদিকে মুঘল অভিজাততন্ত্র ছিল দ্বিধাবিভক্ত, এরা দিল্লি-আগ্রা অঞ্চল ছেড়ে দূরবর্তী কোনো এলাকায় কাজ করতে যাওয়ার ব্যাপারে ছিল প্রবল অনিচ্ছুক। এই দুটি কারণেই মূলত হুমায়ুন গুজরাটে ও শের খানের বিরুদ্ধে ব্যর্থ হয়েছিলেন। হুমায়ুনের ভ্রাতাদের বিরোধিতা এবং তার চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাবকে সাধারণত এক্ষেত্রে একটু ফুলিয়ে ফাপিয়ে দেখানো হয়েছে। ঠিকই কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেখলে বাংলা অভিযান পর্যন্ত তার দুই ভ্রাতা আসকারি ও হিন্দাল যথেষ্ট আনুগত্য রেখেই সহযোগিতা করেছিলেন। কামরান তো হিন্দালের বিদ্রোহের সময় তাঁকে দমনও করেছিলেন। কিন্তু চৌসার যুদ্ধে পরাজয়ের পরেই হুমায়ুনের ওপর থেকেই তাঁর ভাইদের আস্থা ও বিশ্বাস যেন উঠে গিয়েছিল। তাই তারা হাল ছেড়ে দিয়ে হুমায়ুনের কাজকর্ম থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিলেন। এমনকি বিরোধিতা কিংবা হত্যা করতেও চেয়েছিলেন। তবে এটা বলতেই হবে যে যতদিন পর্যন্ত হুমায়ুন শের খানের সম্মুখীন হননি ততদিন সাহসী যোদ্ধা ও শক্তিশালী নেতা হিসাবে নিজেকে প্রমাণ দিয়েছিলেন। কিন্তু শের খানের সামনে হুমায়ুনের উজ্জ্বলতা অনেকটাই ম্লান হয়ে গিয়েছিল, কারণ রণকৌশল ও দক্ষতার বিচারে শের খান তার থেকে অনেক বড়ো সেনাপ্রধান ছিলেন। কোথাও হয়তো হুমায়ুন তাঁর সময়ের প্রেক্ষিতে কিছুটা আধুনিক ছিলেন। তার শাসনের ছত্রছায়ায় সমগ্র উত্তর ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করার ভাবনাটা সীমিত শাসনযন্ত্র এবং এদেশের গভীরে শিকড় প্রতিস্থাপনে তখনও অপারগ একটি সাম্রাজ্যের প্রধান হিসাবে অনেকটাই বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল বলে মনে হয়। কিন্তু এধরনের স্বপ্নও যে দেখা যায় সেটা আমাদের বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন হুমায়ুন।
শেষ কথা
যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হুমায়ুন ও তার ভাইয়েরা আগ্রা ছেড়ে লাহোরে চলে গিয়েছিলেন এবং কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না যে কীভাবে শের খানকে সামলাবেন। কামরান পাঞ্জাবে হেরে গিয়ে শের খানের সঙ্গে সমঝোতা করতে চাইলেও তার পাখির চোখ ছিল কাবুল। হুমায়ুন তখন ঠিক করলেন সিন্ধু অঞ্চলে সরে গিয়ে সেখান থেকে গুজরাট জয় করবেন, তারপর গুজরাট থেকে শের খানের বিরুদ্ধে নতুন করে আক্রমণের খুঁটি সাজাবেন। প্রায় আড়াই বছর ধরে সিন্ধু অঞ্চলে ঘুরেও তিনি না পারলেন এ-বিষয়ে সিন্ধু প্রদেশের শাসকের সাহায্য লাভ করতে–আর না পারলেন। মারোয়াড়ের শক্তিশালী রাজা মালদেওকে এ-ব্যাপারে কোনোভাবে পাশে পেতে। মালদেও হুমায়ুনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, কিন্তু তার ক্ষুদ্র-সংখ্যক অনুগামী দেখে শীঘ্রই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। অনেক ঘোরার পর অবশেষে হুমায়ুন ইরানের শাসক শাহ তহমাসপ-এর কাছে আশ্রয় পান এবং তার সাহায্যেই তিনি কান্দাহার ও কাবুল পুনরায় দখল করতে সমর্থ হন।
এই সাম্রাজ্যহীন অবস্থায় ঘোরার সময়েই হুমায়ুনের প্রকৃত চরিত্র ঠিক কী ছিল তা আমরা বুঝতে পারি। এমনকি আফগানিস্তানে শাসন করার সময়েও তাকে তার। বিশ্বাসঘাতক ভাইদের প্রতি কোনো প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি, বরং কামরানের একের-পর-এক বিদ্রোহের পর তার অভিজাতবর্গের চাপে বাধ্য হয়েই শাস্তি হিসাবে তাকে অন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল হুমায়ুনকে।
যাই হোক, শূর সাম্রাজ্যের বিশৃঙ্খলাকে কাজে লাগিয়ে হুমায়ুন পুনরায় দিল্লি দখল করেছিলেন ১৫৫৫ সালে। কিন্তু তিনি এরপর খুব বেশিদিন জীবিত থাকেননি। তার পাঠাগারের ওপর তলা থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয় হুমায়ুনের। হুমায়ুনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মুঘল ইতিহাসের প্রথম পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় পর্বের মুঘল সাম্রাজ্যের।
কাল-নির্ঘণ্ট (CHRONOLOGY)
হুমায়ুনের অভিষেক – ৩০-এ ডিসেম্বর, ১৫৩০
বাহাদুর শাহের মালব জয় – মার্চ, ১৫৩১
হুমায়ুনের কালিঞ্জর দুর্গ অবরোধ – জুলাই, ১৫৩১
হুমায়ুনের প্রথম চুনার আক্রমণ – আগস্ট-সেপ্টেম্বর, ১৫৩১
হুমায়ুন আগ্রায় ফিরে আসেন – অক্টোবর, ১৫৩১-সেপ্টেম্বর, ১৫৩২
দাদরাহের যুদ্ধ – অক্টোবর, ১৫৩২
বাহাদুর শাহের প্রথম চিতোর আক্রমণ – নভেম্বর-ডিসেম্বর, ১৫৩২
গোয়ালিয়রে হুমায়ুন – ফেব্রুয়ারি-মার্চ, ১৫৩৩
বাহাদুর শাহের চিতোর অবরোধ প্রত্যাহার – মার্চ, ১৫৩৩
দিল্লিতে হুমায়ুন, দিন পানাহ নির্মাণ – জুলাই, ১৫৩৩-জুলাই, ১৫৩৪
হুমায়ুনের কল্পি যাত্রা – সেপ্টেম্বর, ১৫৩৪
হুমায়ুনের আগ্রায় প্রত্যাবর্তন – নভেম্বর, ১৫৩৪
বাহাদুর শাহের দ্বিতীয়বার চিতোর আক্রমণ – নভেম্বর, ১৫৩৪
তাতার খানের পরাজয় – নভেম্বর, ১৫৩৪
মালবের সরঙ্গপুরের উদ্দেশ্যে হুমায়ুনের আগ্রা ত্যাগ – জানুয়ারি, ১৫৩৫
চিতোর দুর্গের পতন – মার্চ, ১৫৩৫
মন্দসৌরে বাহাদুর শাহের পরাজয় – এপ্রিল, ১৫৩৫
মাণ্ডু দুর্গের পতন – জুন, ১৫৩৫
চম্পানির দখল – আগস্ট, ১৫৩৫
আহমেদাবাদ দখল – অক্টোবর, ১৫৩৫
হুমায়ুনের মাণ্ডু আগমন – ১৫৩৬-এর মাঝামাঝি
গুজরাটে মুঘলবিরোধী বিদ্রোহ – নভেম্বর, ১৫৩৬
হুমায়ুনের আগ্রা প্রত্যাবর্তন – ফেব্রুয়ারি, ১৫৩৭
পূর্ব ভারতের উদ্দেশ্যে হুমায়ুনের যাত্রা – জুলাই, ১৫৩৭
চুনার অবরোধ – জানুয়ারি-জুন, ১৫৩৮
গৌড়ে হুমায়ুন – অক্টোবর, ১৫৩৮
হুমায়ুনের গৌড় ত্যাগ – জানুয়ারি, ১৫৩৯
চৌসার যুদ্ধ – জুন, ১৫৩৯
কনৌজের যুগ্ধ – মে, ১৫৪০
—
১. সেই সময় এক মণ ছিল প্রায় ১৬ সের সমান।
২. নিজামুদ্দিন আহমেদের মতে দাদরাহের বা দাউরাহের যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল হুমায়ুনের শাসনের প্রথম বর্ষে (১৫৩১)। এর ওপর নির্ভর করে কয়েকজন ঐতিহাসিক চুনার অবরোধের ঘটনাটি দাদরাহের যুদ্ধের পরের বছরেই (১৫৩২) ঘটেছিল বলে মত দেন। নিজামুদ্দিন কিন্তু চুনার দুর্গ অবরোধের কোনো উল্লেখ করেননি। এমনকি আমরা যদি নিজামুদ্দিন প্রদত্ত ঘটনাপঞ্জী মেনেও নিই তাহলে আমাদের এসময় হুমায়ুনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে খুব একটা অসুবিধা হয় না যে তিনি উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশের আফগানদের বিধ্বস্ত করে উক্ত অঞ্চলে নিজ প্রাধান্য বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়েছিলেন এবং এই পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই বিহারে অভিযান চালানোর পক্ষপাতী ছিলেন না। তাই চুনার দুর্গ দখল বা শের খানের সঙ্গে বোঝাপড়া করার বিষয়টি সে সময়ে তিনি অতটা অগ্রাধিকার দিয়ে ভাবেননি।