০৩. উকুফা
সকাল ১০টা ২০ মিনিট।
হুলুহুলুই-আমফলোজি গেম প্রিজার্ভ
জুলুল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা।
কোপেনহ্যাগেন থেকে ছয় হাজার মাইল দূরে, একটি ভোলা জিপ আফ্রিকার বুনো পথ মাড়িয়ে এগোচ্ছে।
গরমে গলদঘর্ম অবস্থা, আফ্রিকার উষ্ণ উদোম প্রান্তরে মরীচিকা ঝিকমিক করছে। রিয়্যার ভিউ আয়নায় দেখা যাচ্ছে, সূর্যের তাপে দারুণভাবে সেদ্ধ হচ্ছে সমতল ভূমি। তবে সূর্যের এই মহৎ কাজে মাঝে মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাটাঅলা ঝোঁপ-ঝাড় আর হালকা লাল কাঠের গাছপালা। জিপের সামনে দুম করে একটি ছোট ঢিবির উদয় হলো। বাবলাজাতীয় গাছের কাণ্ড, গুলা পাতার পুরু স্তরে ঢাকা ওটা।
‘ভক্টর, এটাই কী সেই জায়গা?’ শুকনো নদীর ওপর দিয়ে ঝাঁকি খেয়ে স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে খামিশি টেইলর জানতে চাইল। জিপের পেছনে মোরগের লেজের মতো ধূলো উড়ছে। পাশে থাকা নারীর দিকে তাকাল সে।
যাত্রী সিটে ড. মারসিয়া ফেয়ারফিল্ড প্রায় দাঁড়িয়ে আছে। ঝাঁকি সামাল দিতে এক হাত দিয়ে উইন্ডশিল্ডের কিনারা ধরে আছে ও। আরেক হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘পশ্চিম দিকে। ওখানে একটা গভীর গহ্বর আছে।’
খামিশি গিয়ার নামিয়ে ডান দিকে গাড়ি চালাল। হুলুহুলুই-আমলোজি গেম প্রিজার্ভের বর্তমান গেম ওয়ার্ডেন (প্ররক্ষক) হিসেবে তাকে কিছু নিয়ম-নীতি মেনে চলতেই হয়। বেআইনিভাবে পশু-পাখি শিকার করা দণ্ডনীয় অপরাধ, তবুও শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে পার্কের নির্জন অংশে।
এমনকি ওর নিজের লোকজন, কিছু জুলু উপজাতির বাসিন্দারাও মাঝে মাঝে তাদের ঐতিহ্য চর্চা করতে গিয়ে পশু-পাখি মেরে ফেলে। এই কাজ করার জন্য ওকে ওর দাদার বয়স্ক বন্ধুদেরকেও জরিমানা করতে হয়েছে। ওরা খামিশির নাম পড়িয়ে “ফ্যাট বয়”। উপহাসের সুরেই এই নামে ডাকেন তারা। খামিশি বুঝতে পারে ওনারা ওকে এখনও পছন্দ করে উঠতে পারেননি। ওকে এখনও একজন সাদা চামড়াধারী লোকের চাকরি করার যোগ্য বলে মানেন না তারা। খামিশি এখনও এখানে বেশ পরিচিত। ওর যখন ১২ বছর বয়স তখন বাবা ওকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে গিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার উত্তর উপকূলে ডারউইন শহরের বাইরে জীবনের একটি অংশ দারুণভাবে কাটিয়ে এসেছে ও। ওখান থেকে ফিরে এসে গেম ওয়ার্ডেন পদে চাকরি নিশ্চিত করে এখানে থিতু হয়েছে।
“ফ্যাট বয়” উপাধি বাগিয়ে নিয়েছে শিকারিদের শান্তি নষ্ট করে।
‘আরেকটু জোরে যাওয়া যাবে? ওর যাত্রী তাড়া দিল।
ড. মারসিয়া ফেয়ারফিল্ড ক্যামব্রিজ থেকে পাস করা জীববিজ্ঞানী। গণ্ডার সম্পর্কিত অপারেশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানিত অংশ হিসেবে সে কাজ করছে। মারসিয়ার সাথে কাজ করতে খামিশির বেশ ভালই লাগে। ড. মারসিয়া খুব সাদামাটাভাবে চলা ফেরা করে, পরনে খাকি সাফারি জ্যাকেট, মাথার রুপোলি ধূসর চুলগুলো মাথার পেছনে গোছা করে বেঁধে রেখে দিব্যি ঘুরছে ও। কোনো ছলনা নেই, ভনিতা নেই। হয়তো এই কারণেই খামিশি তাকে পছন্দ করে।
কিংবা হয়তো মারসিয়ার পছন্দের বিষয়ের জন্য।
‘বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে যদি মা গণ্ডার মারা যায় তাহলে বাচ্চাটি হয়তো বাঁচবে কিন্তু সেটা কতক্ষণ?’ উইন্ডশিন্ডের কিনারায় থাবা মারল ড.। ‘ওদের দুজনকে হারানো চলবে না।
গেম ওয়ার্ডেন হিসেবে মারসিয়ার কথার মর্মার্থ বুঝতে পারল খামিশি। ১৯৭০ সাল থেকে কালো রাইনো (গণ্ডার) এর সংখ্যা আফ্রিকা থেকে ৯৬% কমে গেছে। কালো রাইনোর এই বিলুপ্তি রোধ করার চেষ্টা করছে হুলুহুলুই-আমলোজি। এখানে সাদা রাইনো আছে। এই পার্কের অন্যতম প্রধান চেষ্টা হলো কালো রাইনোর বিলুপ্তি বন্ধ করা।
প্রত্যেকটি কালো রাইনো গুরুত্বপূর্ণ।
‘ট্রাকিং ইমপ্ল্যান্ট (কারও অবস্থান জানার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র) ব্যবহারের কারণে আমরা ওর অবস্থান জানতে পেরেছি, নইলে এটা সম্ভব হতো না। বলল ড. ফেয়ারফিল্ড। হেলিকপ্টার দিয়ে ওকে দেখলাম ঠিকই কিন্তু যদি বাচ্চার জন্ম দিয়ে দেয় তাহলে তো সেই বাচ্চার আর হদিস জানার উপায় থাকবে না।’
‘কেন, মায়ের সাথেই তো বাচ্চার থাকার কথা, তাই না? খামিশি জানতে চাইল। এর আগে এরকম ঘটনা সে নিজে দেখেছে। দুই বছর আগের কথা, এক জোড়া সিংহের বাচ্চা ওদের মায়ের ঠাণ্ডা পেটের কাছে গাদাগাদি করে বসেছিল। ওদের মা মারা গিয়েছিল শৌখিন শিকারির গুলিতে।
‘এতিমদের কপালে কী জোটে তা তো জানেন। শিকারি প্রাণীগুলো হামলে পড়বে। যদি বাচ্চাটি ইতোমধ্যে ভূমিষ্ঠ হয়ে রক্তমাখা শরীর নিয়ে…
খামিশি মাথা নাড়ল। গ্যাস পেডালে চাপ দিয়ে জিপকে খাড়া পাথুরে ঢালে লাফিয়ে নিয়ে গেল ও। এলোমলো অবস্থায় কিছু নুড়ি-পাথর পড়ে রয়েছে, ও সেগুলোর তোয়াক্কা করল না।
পাহাড় পেরিয়ে সামনে এগিয়ে দেখা গেল ওদের সামনের মি গভীর উপত্যকায় দুই ভাগ হয়ে গেছে। এই দুই ভাগ করার কাজটি করে দিয়েছে নদীর ক্ষীণকায় জলধারা। এখানে গাছপালার পরিমাণ বেশি ডুমুর, মেহগনি ও নায়লা গাছ রয়েছে। এই পার্কের অন্যতম “ভেজা” অঞ্চল এটি। সাধারণত পর্যটকরা যেদিক দিয়ে চলাচল করে সেখান থেকে এই জায়গাটির অবস্থান বেশ দূরে, একটু তফাতে। এখানে অনুমতিপ্রাপ্ত স্বল্প সংখ্যক কিছু লোক প্রবেশ করতে পারে এবং সেই প্রবেশেরও সময়সীমা বেঁধে দেয়া আছে। যেমন : দিনের আলোতে আসা যাবে, কোনোভাবেই রাত কাটানো যাবে না ইত্যাদি। পার্কের পশ্চিম সীমান্ত ঘেঁষে এই অঞ্চলের অবস্থান।
খাড়া ঢাল থেকে জিপ নামানোর সময় দিগন্তে চোখ বুলাল খামিশি। মাইল খানিক দূরে, গেম ফেন্সিং (বেড়া) ভেঙ্গে গেছে। দশ ফুট উঁচু এই বেড়াটি পার্শ্ববর্তী সংরক্ষিত ব্যক্তিগত এলাকা থেকে আলাদা করেছে পার্ককে। এরকম সংরক্ষিত এলাকায় সব সময় পার্কের সীমানা থাকে যাতে পর্যটকরা পার্কের বন্য পরিবেশকে একদম কাছ থেকে উপভোগ করতে পারে।
কিন্তু এটা কোনো সাধারণ সংরক্ষিত এলাকা নয়।
১৮৯৫ সালে হুলুহুলুই-আমলোজি পার্ক স্থাপন করা হয়। পুরো আফ্রিকার সবচেয়ে পুরোনো অভয়ারণ্য এটা। এর পাশে থাকা সংরক্ষিত এলাকাটি এর চেয়েও পুরোনো। জমির মালিক ওয়ালেনবার্গ, এরা একদম খাঁটি বোয়্যার পরিবার। সাউথ আফ্রিকার রাজবংশের লোক বলা যায় এদের, সেই সতেরশ শতাব্দী থেকে এদের প্রজন্ম চলে আসছে। পার্ক স্থাপনের আগে থেকেই এই জমির মালিক তাঁরা। পার্কের আকারের চার ভাগের তিন ভাগ হলো এই সংরক্ষিত এলাকা। এখানে প্রচুর পরিমাণে বন্য প্রাণী আছে। হাতি, গণ্ডার, চিতা, সিংহ ও কেইপ মহিষই নয় বিভিন্ন প্রজাতির শিকারি প্রাণীও আছে এখানে : নাইল কুমির, জলহস্তি, চিতা, হায়েনা, হরিণ, শিয়াল, জিরাফ, জেব্রা, কুতু, ওয়াটারবাক, রিডবাক, শুয়োর, বেবুন ইত্যাদি। বলা হয়ে থাকে এখানে নাকি মালিকদের অজান্তে বেশকিছু দুর্লভ ওকাপি (আফ্রিকার রোমন্থক প্রাণী) বাস করছে। ১৯০১ সালে জিরাফের আত্মীয়র কাতারে পড়া এই প্রাণী আবিষ্কৃত হয়।
ওয়ালেনবার্গের এই সংরক্ষিত এলাকা নিয়ে বরাবরই বিভিন্ন গুজব চালু রয়েছে। পার্কে ছোট প্লেন কিংবা হেলিকপ্টার নিয়ে প্রবেশ করা যায়। বনে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অবশ্য রাস্তা ধরেই এগোনো সম্ভব। আর এখানকার দর্শনার্থীরা মামুলি কেউ নন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা আসেন এখানে। কথিত আছে, টেডি রুজভেল্ট এখানে এসে শিকার করে যাওয়ার পর আমেরিকার ন্যাশনাল পার্কের সিস্টেম গড়ে ছিলেন।
এই পার্কে একটি দিন কাটানোর জন্য খামিশি ওর সামনের দুটো দাঁত দিতেও রাজি!
কিন্তু হুলুহুলুই-এর প্রধান ওয়ার্ডেন-ই শুধু সেটা করার অধিকার রাখেন। ওয়ালেনবার্গ স্টেটে একবার ঘুরে এসে এই পার্কের বিভিন্ন গোপনীয়তা জানার ভীষণ কৌতূহল জেগেছে খামিশির। ও আশা করে, একদিন নিজের কৌতূহল মেটাতে পারবে।
কিন্তু আশা করলেই তো সব আশা পূরণ হয় না।
ওর এই কালো চামড়ায় তো নয়-ই।
জুলু বংশের লোক আর শিক্ষাগত যোগ্যতা ওকে হয়তো এই চাকরি পাওয়া পর্যন্ত সাহায্য করতে পেরেছে কিন্তু ওর সীমানা এপর্যন্তই। যদিও এখানে আর আগের মতো বর্ণবৈষম্য নেই। তবে ঐতিহ্য মেনে এগোতে গেলে চামড়া কালো হোক বা সাদা কঠিন পথ পাড়ি দিতেই হবে। তার ওপর খামিশির বর্তমান পদটি খুব একটা শক্ত-পোক্ত নয়। এখানকার বিভিন্ন স্থানীয় গোত্রের বাচ্চাদেরকে সাধারণত অল্প শিক্ষা কিংবা অশিক্ষিত করে গড়ে তোলা হয়। শিক্ষার এরকম দশা হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ আছে। যেমন : উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, অর্থ সঙ্কট, পৃথককরণ ও অস্থিরতা ইত্যাদি। সংক্ষেপে বললে, এই প্রজন্মের তেমন কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাই খামিশি ওর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। নিজে শিক্ষিত হয়েছে এবং পরবর্তী প্রজন্মের সুবিধার জন্য যতদূর সম্ভব সুযোগ-সুবিধা করে দিয়ে যেতে চায় সে।
ফ্যাট বয় হিসেবে থাকতে ওর কোনো আপত্তি নেই, যদি এভাবে থেকে ওর উদ্দেশ্য হাসিল হয়…
‘ওই যে!’ ৬, ফেয়ারফিল্ড চিৎকার করে উঠল। খামিশির পেছনে থাকা প্যাচানো রাস্তার দিকে নির্দেশ করে বলল, বাওবাব গাছের বাঁ দিক দিয়ে পাহাড়টির নিচে চলুন
প্রাগৈতিহাসিক বিরাটাকার গাছটি চোখে পড়ল খামিশির। গাছটির প্রত্যেকটি শাখা-প্রশাখা থেকে বড় বড় সাদা ফুল ফুটে রয়েছে। গোলাকার বাটি আকৃতির রাস্তা নেমে গেছে গাছের বাম দিক দিয়ে। পানিতে যেন চিকচিক করে উঠল, খেয়াল করল খামিশি।
ডোবা।
পুরো পার্কে এরকম ডোবা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কোনোটা প্রাকৃতিক আবার কোনোটা কৃত্রিম। বুনো জীবজন্তু দেখার সেরা জায়গা হলো ওই জলাধারগুলো তবে পায়ে হেঁটে গেলে ব্যাপারটা অনেক বিপজ্জনক।
‘আমাদেরকে তো এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে। গাছের কাছে গিয়ে একটু গলা চড়িয়েই বলল খামিশি।
ড, মাথা নাড়ল। রাইফেল তুলে নিল দু’জন। ওরা দুজনই বন্য প্রাণী রক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য কাজ করলেও দক্ষিণ আফ্রিকার বুনো পরিবেশে কীরকম বিপদ ওঁত পেতে থাকে সে সম্পর্কে জানে।
জিপ থেকে নেমে একটি বড়-বোর ডাবল রাইফেল .৪৬৫ নিট্রো হল্যান্ড অ্যান্ড হল্যান্ড রয়্যাল নিজের কাঁধে ঝোলাল খামিশি। তেড়ে আসা পাগলা হাতিকে থামানোর ক্ষমতা রাখে এই অস্ত্র। বুনো পরিবেশে এরকম করিৎকর্মা রাইফেল খামিশির বেশি পছন্দ।
ঝোঁপ-ঝাড় ও ঘাস মাড়িয়ে ঢাল বেয়ে ওরা নামতে শুরু করল। ওদের মাথার ওপরে একটি গাছের ডাল-পালা সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা করলেও গভীর ছায়া তৈরি করল নিচে। সামনে এগোতে এগোতে খামিশি খেয়াল করল চারিদিক বেশ নিশ্চুপ। কোনো পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে না। বানরের চেঁচামেচি নেই। কিছু পোকামাকড়ের ঝিঁঝি আওয়াজ ছাড়া কোনো শব্দ নেই এখানে। এরকম নীরবতা দেখে দাঁতে দাঁত পিষল খামিশি।
ওর পাশে, ড. মারশিয়া তার জিপিএস ট্রাকার চেক করছে।
এক হাত উঁচিয়ে নির্দেশ করল ড.। একটি কর্দমাক্ত ডোবার পাশ নির্দেশ করা হয়েছে। খামিশি নল-খাগড়ার ভেতর গিয়ে এগোতেই পচা মাংসের দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা মারল। এরকম উৎকট দুর্গন্ধের উৎস খুঁজে বের করতে খুব একটা সময় লাগল না।
কালো গণ্ডারটির ওজন হবে প্রায় তিন হাজার পাউন্ড। রীতিমত দানবাকৃতির।
‘ওহ ঈশ্বর, নাকে-মুখে রুমাল চেপে বিস্ময় প্রকাশ করল ড. মারশিয়া। ‘হেলিকপ্টার থেকে যখন রবার্টো দেহের অবশিষ্টাংশ দেখিয়েছিল…’।
‘সবসময় মাঠে নামলে দেখা যায় অবস্থা আরও জঘন্য,’ বলল খামিশি।
ফুলে ওঠা দেহাবশেষের দিকে এগোল ও। বাঁ কাত হয়ে পড়ে রয়েছে ওটা। ওরা এগোতেই মাছি কালো মেঘ তৈরি করে উড়াল দিল। গণ্ডারটির পেট চিড়ে দেয়া হয়েছে। পাকস্থলী থেকে মলদ্বার পর্যন্ত খাদ্যনালীর নিচের অংশ বেরিয়ে এসেছে, গ্যাসে ফুলে উঠেছে। ফুলে যাওয়ায় এইসব কিছু গারটির পেটে কীভাবে ছিল, কীভাবে জায়গা করে নিয়েছিল ভাবতে অসম্ভব মনে হচ্ছে। দেহের অন্যান্য অঙ্গ গড়াগড়ি খাচ্ছে ধূলোয়। রক্তের দাগ দেখে মনে হচ্ছে পাশে থাকা জঙ্গলের ভেতরে এখান থেকে কিছু একটা টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
মাছিগুলো উড়াউড়ি বন্ধ করে আবার যে যার জায়গায় বসে পড়ল।
কামড়ে খাওয়া লাল কলিজার কাছে এগোল খামিশি। গণ্ডারটির পেছনের অংশ দেখে মনে হচ্ছে উরুর অংশ থেকে রীতিমতো ফেড়ে ফেলা হয়েছে। চোয়ালে কতটা শক্তি থাকলে এরকম কাজ করা সম্ভব…।
এমনকী একটি প্রাপ্তবয়স্ক সিংহের পক্ষেও এরকম অবস্থা করা কঠিন।
গণ্ডারের মাথার কাছে যাওয়ার আগ পর্যন্ত খামিশি ঘুরে ঘুরে দেখল খামিশি।
গণ্ডারের খাটো-মোটা গোছের একটি কান কামড়ে ছিঁড়ে নেয়া হয়েছে। গলা চিরে দেয়া হয়েছে নৃশংসভাবে। প্রাণহীন কালো চোখ দুটো নিথর তাকিয়ে রয়েছে খামিশির দিকে। আতঙ্কে চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে। ভয়ে কিংবা যন্ত্রণায় ঠোঁট দুটো উঠে গেছে পেছন দিকে। মুখ থেকে চওড়া জিহ্বা বেরিয়ে এসেছে, শরীরের নিচে যেন রক্তের পুকুর। কিন্তু এগুলোর কিছুই তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।
খামিশি জানে, ওকে কী পরীক্ষা করতে হবে।
ফেনা ও ছোট ঘোট ফুটকিঅলা নাকের ওপরে থাকা গণ্ডারের শিংটি একদম অক্ষত অবস্থায় আছে।
‘একাজ কোনো শিকারি করেনি, নিশ্চিত।’ বলল খামিশি।
শিকারির কাজ হলে এই শিং আর থাকতো না। এই শিং-এর কারণেই গণ্ডারের সংখ্যা এখনও আশংকাজনক হারে কমছে। এশিয়ার বাজারে এই শিঙের গুড়োকে পুরুষাঙ্গের বলবর্ধক হিসেবে বিক্রি করা হয়ে থাকে। গণ্ডারের একটি শিঙের দাম নেহাত কম নয়।
খামিশি সোজা হয়ে দাঁড়াল।
গণ্ডার দেহের অন্য পাশে গিয়ে বসল ড. মারশিয়া। শরীরের সাথে ঠেস দিয়ে রাইফেলটিকে দাঁড় করিয়ে রেখে হাতে প্লাস্টিকের গ্লোবস পরে নিয়েছে ও। গণ্ডারটা কোনো বাচ্চা প্রসব করেছে বলে তো মনে হচ্ছে না।
‘তাহলে কোনো বাচ্চাও এতিম হচ্ছে না।
জীববিজ্ঞানী মারশিয়া দেহাবশেষের গর্ভের কাছে আবার এগিয়ে গেল। সামনে ঝুঁকে কোনো সংকোচ না করে ফেড়ে দেয়া গর্ভের এক অংশ খুলে ভেতরে হাত দিল।
অন্যদিকে ঘুরল খামিশি।
“শকুন কিংবা অন্য কোনো প্রাণী এখনও এই দেহাবশেষ চেটে-পুটে খায়নি কেন? কাজ করতে করতে প্রশ্ন করল মারশিয়া।
‘গণ্ডারের মাংস তো আর কম নয়, খামিশি বিড়বিড় করল। পেছনে গোল হয়ে হাঁটছে ও। এখানকার এরকম সুনসান নীরবতা ওর অস্বস্তি হচ্ছে। ওপর থেকে সূর্যের তাপ যেন ঠেসে ধরেছে ওদের।
মারশিয়া তার পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। ‘উঁহু, আমার তা মনে হয় না। গতরাত থেকে এই লাশ এখানে পড়ে আছে। কাছেই জলাধার। আর কিছু না হোক, গণ্ডারের ভেতরের সবকিছু তো শিয়ালেরই পরিষ্কার করে ফেলার কথা।’
দেহাবশেষের উপর আবার চোখ বুলাল খামিশি। পেছনে ছেঁড়া পা আর ফেড়ে যাওয়া গলা দেখল ও। বড় কোনো প্রাণী গণ্ডারটিকে কাবু করেছিল এবং সেটা করেছিল খুব দ্রুত।
ওর গলার পেছনে কেমন যেন এক খচখচানি শুরু হলো। ‘
মরা দেহ খাওয়ার প্রাণীগুলো ছিল কোথায়?
এই রহস্যের গভীরে চিন্তা করার আগেই ড. খামিশিকে বলল ‘বাচ্চা নেই। চলে গেছে।’
‘কী?’ এদিকে ঘুরে দাঁড়াল খামিশি। আপনি না বললেন গণ্ডার কোনো বাচ্চা জন্ম দেয়নি।
ড. মারশিয়া উঠে দাঁড়িয়ে হাত থেকে গ্লোভস খুলে রাইফেল তুলে নিল। ভূমিতে চোখ রেখে গণ্ডারের লাশের কাছ থেকে সরে যেতে লাগল ও।
খামিশি খেয়াল করল ড. রক্তের সেই দাগ অনুসরণ করছে। আয়েশ করে খাওয়া জন্য গণ্ডারের পেট থেকে কিছু একটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওদিক দিয়ে।
ওহ, ঈশ্বর…
মারশিয়ার পিছু নিল ও।
ঝোঁপ-ঝাড়ের কাছে গেল ড. ফেয়ারফিল্ড। ওর রাইফেলের ডগা দিয়ে কিছু খাটো ডালপালা সরিয়ে দেখতে পেল, পেট থেকে কী বের করে আনা হয়েছে।
একটি গণ্ডারের বাচ্চা।
হাড্ডিসার শরীরটিকে বিভিন্ন অংশে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছে, দেখে মনে হয়েছে এর সাথে কেউ রীতিমতো কুস্তি লড়েছে।
‘আমার মনে হয়, মায়ের পেট থেকে যখন বাচ্চাটিকে বের করা হচ্ছিল ওখনও জীবিত ছিল বাচ্চাটি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রক্তের দাগের দিকে ইঙ্গিত করে বলল ড. ফেয়ারফিল্ড, বেচারা।’
পিছু হটল খামিশি। মারশিয়ার করা শেষ প্রশ্নটি ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। দেহাবশেষটুকু বিভিন্ন মাংসভোজী প্রাণীরা খেয়ে শেষ করল না কেন? শকুন, শিয়াল, হায়েনা, এমনকী সিংহ; এদের কেউ-ই কেন গণ্ডারের দেহাবশেষ খেয়ে শেষ করল না? ড. মারশিয়ার প্রশ্নটি একদম যৌক্তিক। এত মাংস তো মাছি আর লার্ভার জন্য পড়ে থাকার কথা নয়।
কেন এমন হলো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
যদি না…
খামিশির বুকে ধুকপুকানি বেড়ে গেল।
যদি না সেই প্রাণীটি এখনও এখানে থাকে। প্রাণীটি যদি এখানে এখনও থেকে থাকে তাহলে অন্য কেউ এদিকে আসার সাহস না-ও পেতে পারে। নিজের রাইফেল উঁচু করে ধরল খামিশি। ও লক্ষ করল, ছায়া ভরা ঝোঁপ-ঝাড়ের ভেতরে এখনও সুনসান নীরবতা। গণ্ডারটিকে যে প্রাণী মেরে থাকুক, মনে হচ্ছে পুরো জঙ্গল সেটার ভয়ে সিটিয়ে রয়েছে।
বাতাসে ঘ্রাণ খুঁকে, কান পেতে আর তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করল খামিশি। ওর চারপাশের ছায়া যেন ধীরে ধীরে আর গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে।
সাউথ আফ্রিকায় নিজের ছোটবেলা কাটানোর ফলে খামিশি এক জঙ্গল থেকে আরেক জঙ্গলে দাপিয়ে বেড়ানো বিভিন্ন অলৌকিক ধারণা, দানবের ফিসফিসানি সম্পর্কে ওর জানাশোনা আছে। দ্য ndalaw০, উগান্ডার জঙ্গলের গর্জন করা এক নরখাদক; দ্য mbilinto, কঙ্গোর হাতির মতো বিরাটাকার জলহস্তী; দ্য mngwa, সমুদ্রতীরের নারিকেল বাগানে ওঁত পেতে থাকা লোমশ দানব ইত্যাদি।
কিন্তু আফ্রিকায় কখনও কখনও পৌরাণিক কাহিনিগুলো বাস্তবে হাজির হয়ে যায়। যেমন: nsui-fisi, রোডেশিয়ার নরখাদক, যার গায়ে ছোরা কাটা দাগ আছে। সাদা চামড়ার লোকদের মুখ থেকে ওটার নানান শোনা কাহিনি থেকে জানা যায়। তবে তার এক দশক পর আবিষ্কার হলো ওটা ছিল চিতার একটি নতুন জাত চিতার শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী ওটাকে Acinonyx rex গোত্রে ফেলা হয়েছে।
জঙ্গলে চোখ বুলাতে বুলাতে আরেকটি কিংবদন্তি দানবের কথা মনে পড়ল খামিশির। পুরো আফ্রিকা জুড়ে পরিচিতি ছিল তার। নানান রকম নাম ছিল : দ্য dubu, দ্য lumbwa, দ্য kerit, দ্য getet ইত্যাদি। স্থানীয় লোকজনদের মনে এই নামগুলো ত্রাসের সৃষ্টি করতো। গরিলার মতো বিরাটাকৃতির দানবটি ছিল দ্রুতগামী, ভীষণ চালাক এবং হিংস্র। সাক্ষাৎ যমদূত বলতে যা বোঝায় আরকী! প্রায় এক শতাব্দী জুড়ে বিভিন্ন সময় সাদা ও কালো চামড়ার নানান লোক দাবি করেছে, ওই দানবকে এক নজর হলেও দেখেছে তারা। এখানকার সব বাচ্চাদেরকে ওই দানবের বিশেষ গর্জন সম্পর্কে শিক্ষা দিয়ে বড় করা হয়ে থাকে। এই জুলু সম্প্রদায়ও সেটার ব্যতিক্রম নয়।
‘উকুফা…’ বিড়বিড় করল খামিশি।
‘কিছু বললেন?’ ড. মারশিয়া জিজ্ঞেস করল। গণ্ডারের মৃত বাচ্চার পাশে বসে রয়েছে সে।
জুলু সম্প্রদায় ওই দানবকে এই নামে ডেকে থাকে।
উকুফা।
মৃত্যু।
ওই দানবের কথা খামিশির এই মুহূর্তে মনে পড়ার একটি কারণ আছে। পাঁচ মাস আগে, উপজাতির এক বুড়ো বলেছিল সে নাকি এইখানে কোথাও একটি উকুফা দেখেছে। অর্ধেক পশু, অর্ধেক ভূত, চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছিল ওটার, কোনোমতে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরতে পেরেছিল সে।
কিন্তু আজ এখানে এই গভীর ছায়ার ভেতরে…
‘আমাদের চলে যাওয়া উচিত,’ বলল খামিশি।
“কিন্তু আমরা তো এখনও জানি না গণ্ডারটাকে কীসে মেরে ফেলেছিল?
‘কোনো শিকারির কাজ নয় এটা।’ এই মুহূর্তে খামিশির এরচেয়ে বেশি জানার কোনো প্রয়োজন নেই। জিপের দিকে রাইফেল তাক করল ও। প্রধান ওয়ার্ডেনকে রেডিওতে পুরো বিষয়টি জানিয়ে দিতে পারে খামিশি। বুনো জানোয়ারের আক্রমণে মৃত্যু, কোনো শিকারির কাজ নয়। আর এই দেহাবশেষকে বিভিন্ন প্রাণীর খাবার হিসেবে রেখে গেলেই ল্যাঠা চুকে যায়। তাতে খাদ্যশৃঙ্খল বজায় থাকে। বুনো জীবন তো এভাবেই চলে আসছে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল ড. ফেয়ারফিল্ড।
ছায়ায় ঢাকা জঙ্গলের বুক চিরে ঠিক ওদের ডান দিক থেকে উঁচু লয়ের বুনো চিৎকার —হুঁউউ ইইইই ওওওও–ভেসে এলো।
নিজের জায়গায় দাঁড়ানো অবস্থায় টলে উঠল খামিশি। এই চিৎকার ওর চেনা। শুধু স্মৃতিশক্তি কিংবা মগজ দিয়ে নয় মেরুদণ্ডের শিরশিরে অনুভূতি দিয়েও চেনে এই চিৎকার। গভীর রাতে করা ক্যাম্পফায়ার, রক্ত আর ভয়ের গল্প কিংবা আদিকালের কাহিনিতেও এই চিৎকার শোনা যায়।
উকুফা।
মৃত্যু।
চিৎকার ধীরে ধীরে বাতাসে মিলিয়ে যেতেই আবার নীরবতা নেমে এলো।
মনে মনে ওদের দুজনের কাছ থেকে জিপের দূরত্ব আন্দাজ করল খামিশি। ওদের এখান থেকে কেটে পড়তে হবে তবে সেটা তাড়াহুড়ো করে নয়। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পালাতে গেলে দানবের রক্ততৃষ্ণা বাড়বে, কাজের কাজ কিছুই হবে না।
জঙ্গলের বাইরে আরেকটি চিৎকার শোনা গেল।
তারপর আরও একটি।
আরেকটি।
সব ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে আসছে।
পরমুহূর্তেই খামিশি বুঝতে পারল মাত্র একটি সুযোগ আছে ওদের হাতে। ‘দৌড় দিন।’
.
সকাল ৯ টা ৩১ মিনিট।
কোপেনহ্যাগেন, ডেনমার্ক।
ছাদের টাইলসের ওপর পেটে ভর দিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে গ্রে। মাথা নিচু করে ফিওনাকে ধরতে ব্যর্থ হওয়ার স্থানে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে ও। মেয়েটির হাদের কিনারা দিয়ে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য বারবার ওর মানসপটে ভেসে উঠছে। বুকের ভেতর লাফাচ্ছে হৃদপিণ্ডটা।
ওহ, খোদা… এ কী করলাম আমি…?
ওর কাঁধের ওপরে চিলেকোঠা দিয়ে আগুনের নতুন লেলিহান শিখার বিস্ফোরণ হলো। উপরি হিসেবে ধেয়ে এলো ধোঁয়া আর তপ্ত হাওয়া। হতাশা সরিয়ে রেখে নড়তে হলো ওর।
কনুইতে ভর দিয়ে উঠতে শুরু করল গ্রে। একটু পর পর আগুন যেখান দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ওদিকে ঝুঁকল ও। পিছু হটল একটু পরেই। নিচ থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। লুকোচুরি করে তাগাদা দিচ্ছে কণ্ঠগুলো। গ্রে’র একদম কাছে… একটু গোঙানি শোনা গেল। ছাদের ঠিক নিচেই।
ফিওনা…?
গ্রে আবার নিজের পেটের ওপর ভর দিল। ছাদের কিনারা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত গতিতে পিছলে নামল ও। নিচের জানালাগুলো থেকে ভকভক করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। গ্রে এই ধোয়ার চাদরকে নিজের আড়াল হিসেবে ব্যবহার করল। ছাদ থেকে পানি গড়ানোর পাইপের কাছে পৌঁছে নিচে তাকাল ও।
ঠিক ওর নিচেই একটি লোহার বারান্দা… না ঠিক বারান্দা নয়। এটা সিঁড়িতে নামার একটি জায়গা। ফিওনা বলেছিল বিল্ডিঙের বাইরে একটি সিঁড়ি আছে, এই হলো সেই সিঁড়ি।
সিঁড়ির ল্যান্ডিঙের ওপর একটি মেয়ে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে।
দ্বিতীয়বারের মতো গুঙিয়ে রেলিং ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল ফিওনা।
অন্যরা ওর নড়াচড়া লক্ষ করছে।
নিচের উঠোনে গ্রে দুজনকে দেখতে পেল। তাদের একজন ফুটপাতের মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে, কাঁধে রাইফেল। আয়েশ করে গুলি করার সুযোগ খুঁজছে সে। অ্যাপার্টমেন্টের ভাঙ্গা জানালা থেকে বেরুনো কালো ধোয়া ফিওনাকে আড়াল করে রেখেছে। রেলিঙের ওপরে ফিওনার মাথা ওঠার জন্য অপেক্ষা করছে অস্ত্রধারী।
নিচু হয়ে থাকো, ফিসফিস করে ফিওনাকে বলল গ্রে।
ওপর দিকে তাকাল ফিওনা। ওর কপালের ওপর দিয়ে তাজা রক্ত গড়াচ্ছে।
দ্বিতীয় অস্ত্রধারী ঘুরে দাঁড়াল। কালো পিস্তল লোড করে সিঁড়ির দিকে তাক করল সে। ওর মতলব হলো এই বিল্ডিং থেকে পালানোর সব রাস্তা বন্ধ করা।
গ্রে ফিওনাকে ইশারা করে বলল, ও যেন নিচু হয়ে থাকে। তারপর গ্রে ছাদের কিনারা ঘেঁষে নিজের শরীর গড়িয়ে দিল। পৌঁছে গেল দ্বিতীয় অস্ত্রধারীর ওপরে। ধোয়ার চাদর এখনও ওকে আড়াল দিয়ে যাচ্ছে। সিঁড়ির দিকেই অস্ত্রধারীর মনোযোগ বেশি। নিজের পজিশনে থেকে অপেক্ষা করল গ্রে। ওপর থেকে গড়িয়ে নামার সময় ফিওনার ধাক্কায় আলগা হয়ে যাওয়া ছাদের একটি টাইল ডান হাতে তুলে নিল ও।
আঘাত করার জন্য হয়তো মাত্র একবারই সুযোগ পাবে।
নিচে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি হাতের পিস্তল দিয়ে সিঁড়িতে আগত যেকোনো লোককে পরপারে পাঠানোর জন্য একদম তৈরি হয়ে আছে।
ছাদের কিনারায় গিয়ে কুঁকল গ্রে, হাত উঁচু করে রেখেছে।
শিস বাজাল তীক্ষ্ণ শব্দে।
ওপরে তাকাল অস্ত্রধারী, হাতের অস্ত্র ঘুরিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল সে; চোখ ধাঁধানো দ্রুতগতিতে…
কিন্তু মাধ্যাকর্ষণের গতি তার চেয়ে বেশি।
হাতে থাকা টাইল ছুঁড়ে মারল গ্রে। কুড়ালের মতো বাতাস কেটে একদম অস্ত্রধারীর চেহারায় গিয়ে আঘাত হানল ওটা। ছিটকে রক্ত বেরুল লোকটির নাক দিয়ে। ঠাস করে ফুটপাতে আছড়ে পড়ল সে। রাস্তার ওপর ওর মাখা ড্রপ খেল। শেষ, আর কোনো নড়াচড়া নেই।
ফিওনার কাছে ফিরল গ্রে।
চিৎকার করে উঠল আরেক অস্ত্রধারী।
গ্রে তার ওপর দৃষ্টি রাখল। গ্রে ভেবেছিল সহযোগীকে লুটিয়ে পড়তে দেখে এই ব্যাটা বোধহয় সাহায্য করতে এগিয়ে যাবে কিন্তু কপাল খারাপ। অস্ত্রধারী বিপরীত দিকে দৌড় দিল। ডাস্টবিনের আড়ালে নিজেকে লুকোনোর চেষ্টা করলেও গ্রে’র আক্রমণ করার রাস্তা এখনও খোলা আছে। ওর পজিশন হলো পুড়ে দোকানের পেছনের অংশে। এবার পাশের জানালা থেকে বেরিয়ে আসা ধোয়ার সুবিধে পাচ্ছে ও।
ফিওনার দিকে ফিরে নিচু হয়ে থাকার জন্য আবারও ইশারা করল গ্রে। ফিওনাকে ওপরে উঠিয়ে আনতে গেলে মৃত্যু ঝুঁকি নিতে হবে ওদের। বেশ কিছুক্ষণ ওদেরকে উক্ত অবস্থায় থাকতে হবে।
মাত্র একটি উপায় আছে।
ছাদের পানি গড়ানোর পাইপ ধরে সিঁড়ির ল্যান্ডিঙে নামল গ্রে। লোহার ল্যান্ডিঙে নামমাত্র টং করে শব্দ হলো। নিচু হলো গ্রে।
ওর মাথার ওপরে থাকা একটি ইটের দফারফা হয়ে গেল।
রাইফেল থেকে গুলি করা হয়েছে।
পায়ের গোড়ালিতে হাত দিয়ে ছোরা বের করে নিল গ্রে।
ফিওনা দেখে বলল, “আমরা কী করতে…’
‘তুমি এখানেই থাকবে,’ গ্রে আদেশ করল।
রেলিঙের ওপর হাত রাখল গ্রে। প্রতিপক্ষকে চমকে দিতে চাচ্ছে। কোনো ঢাল বা আমার নেই, অস্ত্রও নেই। আছে শুধু একটি ছোরা।
‘আমি যখন বলব তখন দৌড় দেবে,’ বলল গ্রে। সোজা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে পাশের বাড়ির বেড়া ডিঙিয়ে পালাবে। তারপর পুলিশ কিংবা ফায়ার সার্ভিসের কাউকে খুঁজে বের করবে, পারবে তো?’
ফিওনা গ্রে’র চোখের দিকে তাকাল। দেখে মনে হলো ফিওনা আপত্তি করবে কিন্তু। চোখ-মুখ শক্ত করে হা-সূচক মাথা নাড়ল।
লক্ষ্মী মেয়ে।
হাতে ছোরা নিয়ে ভারসাম্য ঠিক করে নিল গ্রে। আবার মাত্র একটা সুযোগ পাওয়া যাবে। বড় করে শ্বাস নিল ও। রেলিঙে লাফিয়ে উঠে নিচে ঝাঁপ দিল। ফুটপাতে ল্যান্ডিং করার আগে শূন্যে থাকা অবস্থায় একই সময়ে দুটো কাজ করল গ্রে।
‘দৌড়াও!’ চিৎকার করে বলল সে। একই সাথে লুকিয়ে থাকা অস্ত্রধারীকে তাক করে ছোরা ছুঁড়ে মারল। খুন করে ফেলার ইচ্ছে নেই, স্রেফ মনোযোগ ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা। এরকম কঠিন পরিস্থিতে একজন লোক রাইফেল তাক করে থাকলে কেমন যেন লাগে।
ভূমিতে অতরণ করে দুটো জিনিস লক্ষ করল ও।
একটি ভাল, অন্যটি মন্দ।
গ্রে ধাতব সিঁড়ি দিয়ে ফিওনার দৌড়ে যাওয়ার আওয়াজ পেল।
মেয়ে পালাচ্ছে।
ভাল।
অন্যদিকে গ্রে’র ছুঁড়ে দেয়া ছোঁড়াটি ধোয়ার চাদরের ভেতর দিয়ে গিয়ে ডাস্টবিনের গায়ে আঘাত হেনে ছিটকে পড়েছে। কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি।
খারাপ কথা।
ঘাপটি মেরে থাকা লোকটি নিজের রাইফেল তুলে নিয়ে সোজা গ্রে’র বুক বরাবর তাক করল।
‘না!’ সিঁড়ির নিচে পৌঁছে চিৎকার করল ফিওনা।‘
ট্রিগার টানার সময় অস্ত্রধারী লোকটা হাসল না পর্যন্ত।
.
সকাল ১১টা ৫ মিনিট।
হুলহুলুই-আমলোজি গেম প্রিজার্ভ।
জুলুল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা।
‘দৌড় দিন!’ খামিশি আবার তাড়া দিল।
ড. মারশিয়াকে আর তাড়া দেয়ার প্রয়োজন ছিল না। জিপের দিকে ছুটে চলেছে ওরা দুজন। জলাধারের কাছে পৌঁছে গেছে ওরা। ড. মারশিয়াকে আগে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ইশারা করল খামিশি। নল-খাগড়ার ভেতরে ঢুকল মারশিয়া, তবে তার আগে খামিশির চোখে চোখ পড়ল ওর। দু’জনের চোখেই আতঙ্ক।
জঙ্গলের ভেতরে যে প্রাণী চিৎকার জুড়ে দিয়েছিলে ওটা বোধহয় বেশ বড়সড় হবে। শব্দে তো সেরকমই মনে হলো। আর সম্প্রতি খুন করে ওটা বোধহয় আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে রয়েছে। পেছন ফিরে গণ্ডারের দেহাবশেষের দিকে তাকাল খামিশি। দানব আসছে কি-না, এই তথ্য ছাড়া এই বনের আর কোনো তথ্য আপাতত তার কোনো প্রয়োজন নেই।
চারিদিক দেখে নিয়ে জীববিজ্ঞানীকে অনুসরণ করে এগোচ্ছে খামিশি।
একটু পর পর নিজের কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাচ্ছে, কান খুলে রেখেছে, কেউ ধাওয়া করছে কি-না সেটা জানার জন্য। পাশের জলাশয়ে কিছু একটা ঝপাৎ করে পড়ল। খামিশি ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিল না। পানিতে ঝপাৎ করে পড়ার শব্দটা বেশ কমই ছিল। ওটাকে আমলে না নিলেও চলে। পোকামাকড়ের ঝি ঝি শব্দ আর নল-খাগড়া ভাঙ্গা শব্দগুলোকে এড়িয়ে গেল ও। তবে প্রকৃত বিপদ সংকেত সম্পর্কে সজাগ রয়েছে। খামিশির বয়স যখন ৬ বছর তখন ওর বাবা ওকে শিকার করা শিখিয়েছে। গাছপালার ভেতর দিয়ে কীভাবে শিকারকে খুঁজে নিতে হয় সেসব শিখিয়েছে ছিল ওর বাবা।
কিন্তু এখন ও শিকারি নয়, শিকার।
আতঙ্কিত হয়ে ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ ওর চোখ ও কান দুটোরই মনোযোগ আকর্ষণ করল।
একটু নড়াচড়া।
আকাশে।
শ্ৰাইক নামের একটি পাখি ডানা মেলেছে।
কিছু একটা ভয় পাইয়ে দিয়েছে ওকে।
কিছু একটা নড়ছে, এগোচ্ছে।
নল-খাগড়া পেরিয়ে আসার পর ড. মারশিয়ার সাথে নিজের দূরত্ব কমিয়ে নিল খামিশি। ‘জলদি।’ ক্লান্তিতে ফিসফিস করে বলল ও।
রাইফেল লাফিয়ে উঠতেই নিজের ঘাড় টান দিল ড. মারশিয়া। ওর চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, শ্বাস নিচ্ছে কষ্ট করে। ড.-কে পেরিয়ে সামনে তাকাল খামিশি। ওদের জিপ ঢালু অংশের ওপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাওবাব গাছের ছায়ায় পার্ক করা হয়েছিল ওটাকে। নিচে নামার সময় ঢালটিকে এত বড় আর খাড়া মনে হয়নি এখন যতটা মনে হচ্ছে।
‘এগোতে থাকুন।’ খামিশি তাড়া দিল।
ও পেছনে তাকিয়ে দেখল তামাটে রঙের একটি হরিণ বড় বড় লাফ দিয়ে জঙ্গলের কিনারা দিয়ে ধূলো উড়িয়ে গায়েব হয়ে গেল।
হরিণকে দেখে ওদের দুজনের পালানো শেখা উচিত।
ঢাল বেয়ে উঠছে ড. মারশিয়া। তার পাশে পাশে এগোচ্ছে খামিশি। পেছনে থাকা জঙ্গলের দিকে দোনলা রাইফেল তাক করে রেখেছে।
‘খাওয়ার জন্য খুন করেনি ওরা,’ সামনে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ড. মারশিয়া।
গভীর জঙ্গলের দিকে খামিশি আবার ফিরে তাকাল। ড, ঠিক বলছে কি-না সেটা ও কীভাবে বুঝবে?
‘ক্ষুধা ওদেরকে হিংস্র করেনি,’ জীববিজ্ঞানী বলে যাচ্ছে। কথা বলে নিজের আতঙ্ক একটু কমানোর চেষ্টা হয়তো। ‘গণ্ডারের তেমন কিছুই খায়নি। দেখে মনে হলো, ওরা আনন্দের জন্য খুন করেছে। বাড়ির বিড়াল যেভাবে ইঁদুর শিকার করে, অনেকটা সেরকম।
অনেক জানোয়ারের সাথে পরিচয় আছে খামিশির। জানোয়াররা তো এরকম আচরণ করে না। সিংহরা খাওয়ার পর কালেভদ্রে ভয় দেখায়। সাধারণত খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে ওরা আরাম করে। তখন ওদের বেশ কাছেও যাওয়া যায়। তবে সেটা একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত। একটি পরিতৃপ্ত প্রাণী কখনই স্রেফ আনন্দের জন্য এরকম একটা গণ্ডারকে ফেড়ে ফেলে না, পেট থেকে ওটার বাচ্চাকে টেনে বের করে নেয় না।
ড. ফেয়ারফিল্ড তার ভাষণ দিয়েই যাচ্ছে। বর্তমান বিপদটি যেন একটি ধাঁধা, ভেবে চিন্তে এটার সমাধান করতে হবে। বাড়িতে থাকা বিড়ালকে বেশ ভাল খাবার দাবার দেয়া হয়ে থাকে। তারপরও ওরা কিন্তু ইঁদুর ধরে। ইঁদুর ধরার খেলা খেলার জন্য যথেষ্ট শক্তি ও সময়ও থাকে বিড়ালগুলোর।
খেলা?
খামিশির ঠিক বিশ্বাস হলো না।
‘সামনে এগোন তো,’ বলল ও। মারশিয়ার ভাষণ আর শুনতে চায় না।
ড, মাথা নাড়ল কিন্তু শব্দগুলো ঘুরঘুর করতে লাগল খামিশির মাথায়। কোন ধরনের প্রাণী এভাবে খুন করে থাকে স্রেফ আনন্দের জন্য? উত্তর একটাই।
মানুষ।
কিন্তু গণ্ডারের যা হাল, ওটা তো কোনো মানুষের কাজ হতে পারে না।
কিছু একটা নড়াচড়া আবার খামিশির দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এক মুহূর্তের মধ্যে একটি ধূসর অবয়ব জঙ্গলের কিনারার পেছনে গেল। চোখের কোণা দিয়ে বিষয়টা খেয়াল করল ও। সেদিকে ভাল করে তাকাতেই দেখা গেল সাদা ধোয়ার মতো বাতাসে মিলিয়ে গেছে ওটা।
সেই জুলু বৃদ্ধের কথাগুলো মনে পড়ল ওর।
অর্ধেক পশু, অর্ধেক ভূত…
এত গরমের ভেতরেও খামিশির শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। গতি বাড়িয়ে দিল সে। সামনে থাকা জীববিজ্ঞানীর প্রায় বরাবর চলে এল খামিশি। আলগা ধূলো-বালু উড়ল ওর দৌড়ের চোটে। প্রায় উপরে উঠে এসেছে ওরা। জিপ আর মাত্র ত্রিশ মিটার দূরে।
হঠাৎ ভারসাম্য হারাল ড. মারশিয়া।
হাঁটুর ওপর আছড়ে পেছনে খামিশির সাথে ধাক্কা লাগল তার।
হকচকিয়ে যাওয়ায় খামিশিও নিজের ভারসাম্য হারিয়ে পেছনে আছড়ে পড়ল। ঢালের খাড়া ঢালু অংশ নিচের দিকে গড়িয়ে নিয়ে চলল ওকে। প্রায় অর্ধেক পথ এভাবে গড়িয়ে যাওয়ার পর রাইফেল বাট ও পায়ের সাহায্যে খামিশি নিজের পতনরোধ করল।
অবশ্য ড. মারশিয়া গড়াগড়ি খায়নি। সে যেখানে পড়েছিল ওখানেই আছে। উঠে বসেছে। বড় বড় চোখ করে নিচ দিকে তাকিয়ে আছে ও।
উঁহু, খামিশি নয়।
ওর দৃষ্টি জঙ্গলের দিকে।
খামিশি হাঁটুর ওপর ভর করে উঠতে যেতেই ওর গোড়ালিতে ব্যথা অনুভব করল। মচকে গেছে কিংবা ভেঙ্গে গেছে। সে-ও তাকাল কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। তবে রাইফেল উঁচিয়ে ধরেছে।
‘যান!’ চিৎকার করল খামিশি। জিপে চাবি রেখেই এসেছে ও। ‘যান আপনি!
নরম মাটির দলা মাড়িয়ে ড. মারশিয়া উঠে দাঁড়াল।
আবার সেই চিৎকার শোনা গেল জঙ্গলের কিনারা থেকে।
কিছু না দেখেই ট্রিগার টেনে দিল খামিশি রাইফেলের শব্দে যেন এলাকা কেঁপে উঠল। চমকে উঠে ড. মারশিয়া চিৎকার করে উঠল। খামিশি আশা করল, রাইফেলের আওয়াজ ওই জানোয়ারকেও চমকে দেবে।
‘জিপে উঠে পড়ুন!’ নিচ থেকে চিৎকার করল খামিশি। ‘চলে যান! সময় নষ্ট করবেন না!’ উঠে দাঁড়াল ও। আহত গোড়ালির ওপরে ভর কম দিল। রাইফেল দিয়ে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করছে। পুরো বন আবার সুনসান হয়ে গেছে।
ঢালের ওপরে পৌঁছে ড. মারশিয়া ডাকল, ‘খামিশি…’
‘জিপে উঠুন!
কাঁধের ওপর দিয়ে নিজের পেছনে ঝুঁকি নিয়ে তাকাল ও।
ঢাল ওঠা শেষ করে ড. ফেয়ারফিল্ড জিপের দিকে এগোচ্ছে। তার ওপরে থাকা বাওবাব গাছের ডাল খামিশির দৃষ্টি আকর্ষণ করল। গাছের কয়েকটি সাদা ফুল আস্তে করে দুলে উঠল।
অথচ এখানে কোনো বাতাস নেই।
‘মারশিয়া!’ গলা ফাটাল খামিশি। ‘না…!
খামিশির পেছনে হঠাৎ করে বুনো চিৎকার হলো। মারশিয়ার উদ্দেশে করা সতর্কবার্তা ঢাকা পড়ে গেল সেই চিৎকারের আড়ালে। তবে ড. ফেয়ারফিল্ড ঠিকই ওর দিকে এক পা বাড়িয়ে ছিল।
না…
বিশাল গাছের গভীর ছায়া থেকে ওটা লাফিয়ে নামল, অস্পষ্ট ফ্যাকাসে একটি অবয়ব। জীববিজ্ঞানীকে ধরে নিয়ে ওটা খামিশির চোখের আড়ালে চলে গেল। রক্ত হিম করা আর্তনাদ করে উঠল মারশিয়া, কিন্তু দুম করেই যেন সেটাকে থামিয়ে দেয়া হলো।
চারিদিকে আবার সুনসান নীরবতা।
জঙ্গলের দিকে তাকাল খামিশি।
ওপরেও মরণ, নিচেও মরণ।
খামিশির হাতে রাস্তা একটাই।
গোড়ালির ব্যথা উপেক্ষা করে দৌড় দিল ও।
খামিশি ঢালের নিচু অংশের দিকে নেমে যাচ্ছে।
মাধ্যাকর্ষণের ওপর নিজের শরীরের ভার তুলে নিয়ে গড়গড় করে নেমে গেল ও। তবে ব্যাপারটি এত সহজ নয়। ওকে সোজা করে রাখতে পা দুটো রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছে। নিচে পৌঁছুতে পৌঁছুতে জঙ্গলের দিকে তাক করে দ্বিতীয় বারের মতো ওর ডাবল ব্যারেল থেকে গুলি ছুড়ল খামিশি।
বুম।
শিকার করা ওর লক্ষ্য নয়। ও স্রেফ নিজের জীবনের জন্য বাড়তি কিছু সময় জোগাড় করার চেষ্টা করছে। গুলির ফলে রাইফেলের পেছন দিকে ধাক্কা দেয়, সেই ধাক্কায় ওর বরং উপকারই হলো। না হলে হয়তো মুখ থুবড়ে পড়ত খামিশি! ওর গোড়ালিতে যেন আগুন ধরে গেছে, হৃদপিণ্ডটা লাফাচ্ছে তবুও দৌড় বন্ধ করল না।
জঙ্গলের প্রান্তে বেশ বড় কিছুর নড়াচড়া দেখল কিংবা অনুভব করল খামিশি। ফ্যাকাসে ধাচের ছায়া।
অর্ধেক জানোয়ার, অর্ধেক ভূত…
না দেখেও, সত্য জানতে ও।
উকুফা।
মৃত্যু।
আজ যেন ওটা না হয়… প্রার্থনা করল খামিশি… আজ যেন না হয়।
নল-খাগড়ার ভেতরে সেঁধে গেল ও…
… মাথা সামনে দিয়ে জলাধারে ঝাঁপ দিল।
.
সকাল ৯টা ৩২ মিনিট।
কোপেনহ্যাগেন, ডেনমার্ক।
ফিওনার চিৎকার অস্ত্রধারীর রাইফেল থেকে গুলি ছোঁড়ার কাজে একটু বাধা সৃষ্টি করল।
নিজেকে বাঁকিয়ে ফেলল গ্রে, মরণঘাতী আঘাত থেকে বাঁচার চেষ্টা আরকি। ও ঘুরতেই দোকানের ধোয়াময় জানালা ভেঙ্গে বড় একটা কিছু নামল বাইরে।
অস্ত্রধারীর চোখেও ব্যাপারটি ধরা পড়েছে তবে সেটা গ্রে দেখার আগেই। আর সেজন্য একটু হলেও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে সে।
বাঁ হাতের নিচ দিয়ে গরম বুলেট যাওয়ার তাপ অনুভব করল গ্রে।
ও একদম পয়েন্ট-ব্ল্যাংক রেঞ্জে ছিল, এরকম বিপজ্জনক অবস্থান থেকে নিজেকে বাঁচাতে আরও পাক খেল ও।
জানালা থেকে লাফ দেয়া অবয়বটি অবতরণ করল ডাস্টবিনের ওপর। সেখান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল অস্ত্রধারীর দিকে।
‘বারটেল!’ চিৎকার করল ফিওনা।
বুড়ো কুকুরটির চামড়া ভিজে গেছে। দাঁত দিয়ে অস্ত্রধারীর হাতের নিচের অংশ কামড়ে ধরেছে ও। এরকম আচমকা আক্রমণে লোকটি হকচকিয়ে গেল। ডাস্টবিনের পাশে তৈরি হওয়া ছায়ায় আছড়ে পড়ল সে। পাথুরে ফুটপাতে ঠকাস শব্দে তার রাইফেল পড়ে গেল।
অস্ত্রটি বাগানোর জন্য সামনে ঝুঁকল গ্রে।
একদম কাছেই কুকুর গোঙানির আওয়াজ হলো। গ্রে কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনেক উঁচুতে লাফিয়ে উঠল আক্রমণকারী। গ্রে’র কাঁধে বুটের তলা দিয়ে লাথি মেরে একেবারে রাস্তায় ফেলে দিল। পালাল সে।
হাতে রাইফেল তুলে নিয়ে পলায়নরত লোকটির দিকে লক্ষ্য স্থির করল গ্রে। কিন্তু আক্রমণকারী হরিণের মতো দ্রুত গতিতে দৌড়ে একটি বাগানের বেড়া ডিঙিয়ে পগার পার হয়ে গেল। তার পরনে ছিল একটি কালো ট্রেঞ্চ কোট, দৌড়ানোর সময় উড়ছিল ওটা। গলি ধরে পালিয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেল গ্রে।
‘হারামজাদা…’
গ্রে’র দিকে ফিওনা দৌড়ে এলো। ওর হাতে একটি পিস্তল। অন্য লোকটি…’ নিজের পেছন দিক নির্দেশ করল ও। আমার মনে হয় সে মরে গেছে।
রাইফেল কাঁধে ঝুলিয়ে ফিওনার হাত থেকে পিস্তল নিল গ্রে। মেয়েটি কোনো আপত্তি করল না। ওর মনোযোগ অন্যদিকে।
‘বারটেল…’।
বেরিয়ে এলো কুকুরটি, খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে, বেশ দুর্বল, একপাশ আগুনের তাপে ঝলসে গেছে ওর।
পুড়তে থাকা দোকানের দিকে তাকাল গ্রে। এই কুকুর ওখান থেকে বেঁচে বেরোল কীভাবে? সর্বশেষ কুকুরটিকে কী অবস্থায় দেখেছিল গ্রে সেটা মনে করার চেষ্টা করল : বিস্ফোরণের ধাক্কায় পেছনের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল বারটেল।
ফিওনা আহত ভেজা কুকুরটিকে জড়িয়ে ধরল।
কুকুরটি নিশ্চয়ই কোনো অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের নিচে পড়েছিল। তাই ভিজে গেছে।
কুকুরটির মুখ ধরে মুখোমুখি হলো ফিওনা। ‘লক্ষ্মী।
গ্রে-ও একমত হলো। ও বারটেলের কাছে ঋণী। যা খেতে চাও পাবে, বন্ধু, খুশি হয়ে বলল ও।
বারটেলের শরীর কাঁপতে লাগল। টলে পড়ল পাথুরে ফুটপাতের ওপর। শক্তি যা একটু বাকি ছিল সেটাও ফুরিয়ে গেছে বেচারার।
ওদের বাঁ দিক থেকে ড্যানিশ ভাষায় গলা ফাটানো আওয়াজ এলো। দ্রুতগতির পানির ফোয়ারা ছুটল ওপর দিকে। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন দোকানের অন্যপাশের আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে।
গ্রে আর এখানে থাকতে পারবে না।
‘আমাকে যেতে হবে।’
ফিওনা উঠে দাঁড়াল। একবার গ্রে আরেকবার কুকুরের দিকে তাকাল ও।
‘তুমি বারটেলের সাথে থাকো,’ এক কদম পিছিয়ে গিয়ে গ্রে বলল।‘ ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও।
চোখ-মুখ শক্ত করে তাকাল ফিওনা। ‘তুমি চলে যাচ্ছ…’
‘আমি দুঃখিত।’ একটু আগে যেসব ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে গেছে সেগুলোর পর এরকম “দুঃখিত” বলা কেমন যেন খেলো শোনায়। ফিওনার নানুর খুন হয়ে যাওয়া, দোকান পুড়ে যাওয়া, কোনমতে জীবন বাঁচানো। কিন্তু “দুঃখিত” ছাড়া আর কী বলবে গ্রে সেটা খুঁজে পেল না। এছাড়া বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার মতো সময়ও নেই ওর।
পেছনে থাকা বাগানের বেড়ার দিকে এগোল গ্রে।
‘হ্যাঁ, যাও, যাও, ভাগো!’ ফিওনা চিৎকার করল।
বেড়া ডিঙালো গ্রে। ওর মুখমণ্ডল জ্বালা করছে।
‘দাঁড়াও!’
গ্ৰে দাঁড়াল না। দ্রুত সরু গলিতে নেমে গেল। ফিওনাকে ওভাবে রেখে আসতে ওর ভাল লাগছিল না… কিন্তু আর কোনো উপায় নেই। ওকে একা রেখে আসাই ভাল হয়েছে। ওখানে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের লোকদের সাথে ও নিরাপদে থাকবে, আশ্রয় পাবে। গ্রে এখন যে জায়গায় যাচ্ছে ওখানে ১৫ বছর বয়সি মেয়ের কোনো স্থান নেই। এখনও গ্রের মুখ জ্বালাপোড়া করছে। যতই অজুহাত দিক না কেন, মনের গভীরে স্বার্থপরতার আঁচ পাচ্ছে ও। মেয়েটিকে একা রেখে আসতে পেরে ভার মুক্ত হয়েছে। বেঁচে গেছে দায়িত্ব নেয়া থেকে।
যা-ই হোক… যা হওয়ার হয়েছে।
সরু গলি দিয়ে দ্রুত এগোল ও। কোমরে পিস্তল গুঁজে রাইফেল থেকে সব গুলি বের করে ফেলল। তারপর রাইফেলটিকে একটা করাতকলের পেছনে ফেলে দিল গ্রে। এই অস্ত্র সাথে রাখা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এগোতে এগোতে সোয়েটার খুলে নিল ও। হোটেল ছেড়ে দিয়ে নিজের পরিচয় বদলে ফেলতে হবে। এখানে ঘটে যাওয়া খুনোখুনির তদন্ত হবে সেটা বলাই বাহুল্য। “ড. সয়্যার”-এর জীবনের এখানে সমাপ্তি।
তবে তার আগে আরও একটি কাজ করতে হবে।
পেছনের পকেট থেকে সেল ফোন বের করে সেন্ট্রাল কমান্ডে ডায়াল করল গ্রে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে লাইনে পেল লোগান গ্রেগরিকে। গ্রেগরি ওর এই মিশনের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
‘সমস্যা হয়েছে।’ বলল গ্রে।
‘কী সমস্যা?
‘আমরা যা ভেবেছিলাম তারচেয়েও অনেক বড় কিছু হতে যাচ্ছে। খুনোখুনি হওয়ার মতো বড়। সকালের ঘটনাটুকু বর্ণনা করল গ্রে।
লম্বা নীরবতা।
অবশেষে মুখ খুললেন লোগান। তার কণ্ঠে উদ্বেগ। ‘তাহলে মাঠপর্যায়ে আরও তথ্য ও জনবল না পাওয়া পর্যন্ত এই মিশন আপাতত স্থগিত রাখা হোক। সেটাই ভাল হবে।’
‘ব্যাকআপের জন্য অপেক্ষা করলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। নিলাম শুরু হয়ে যাবে আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে।
‘তোমার কভার ভেস্তে গেছে, ছদ্মবেশ ফাঁস হয়ে গেছে, কমান্ডার পিয়ার্স।
‘কভার ভেস্তে গেছে কি-না সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। এখানে আমি একজন আমেরিকান ক্রেতা, অনেক প্রশ্ন করে বেড়াচ্ছি, এই তো। ওরা এসব নিয়ে ঘাটবে বলে মনে হয় না। নিলাম অনুষ্ঠানে অনেক লোকজন আসবে, কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে ওখানে। তবে আমি এখন হয়তো ওই জায়গাটুকু ভাল করে ঘুরে দেখে কে বা কারা এত বড় ঘটনা ঘটাচ্ছে সে-সম্পর্কে কোনো সূত্র পেয়ে যেতে পারি। তারপর নাহয় ব্যাকআপ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করব।’
অন্যান্যের মতো গ্রে’র নিজেরও ওই বাইবেলটিকে হাতে নেয়ার অনেক ইচ্ছে আছে। অবশ্য শুধু পরীক্ষা করার জন্য, অন্য কিছু নয়।
‘আমার মনে হয়, ওতে খুব একটা ভাল হবে। সম্ভাব্য অর্জনের চেয়ে সম্ভাব্য ঝুঁকি বেশি হয়ে যায়। বিশেষ করে এরকম একা একা মিশনে থাকার ব্যাপারটা।’ বললেন লোগান।
উত্তেজিত হয়ে গেল গ্রে। ‘এই হারামজাদারা আমাকে এভাবে হেনস্থা করল… আর আপনি বলছেন আমি যাতে চুপ করে বসে থাকি?
‘কমান্ডার।
গ্রে’র আঙুলগুলো ফোনের গায়ে শক্ত করে চেপে বসল। সিগমায় কাগজপত্র চালাচালির কাজ অনেকদিন ধরে করে আসছেন লোগান। যে-কোনো রিসার্চ মিশনের জন্য লোগান একজন ভাল লিডার… কিন্তু এরকম একটি ঘটনা সংক্রান্ত মিশনে ততটা নয়। সিগমা ফোর্সের অপারেশন শাখার মান-সম্মানের প্রশ্ন এখানে। প্রয়োজন হলে গ্রে এই লোগানের চেয়েও যোগ্য লোকের নেতৃত্ব চাইবে।
‘আমাদের হয়তো ডিরেক্টর ক্রো’কে বিষয়টা জানানো উচিত। বলেই ফেলল গ্রে।
আবার নীরবতা। সম্ভবত কথাটা বলা ঠিক হয়নি। উপরন্তরের লোকের সাথে যোগাযোগ করতে চেয়ে ও কিন্তু আসলে লোগানকে অপমান করতে চায়নি। কিন্তু মাঝে মাঝে পরিস্থিতি এরকম আচরণ করতে বাধ্য করে।
‘এমুহূর্তে সেটা অসম্ভব বলে মনে করি, কমান্ডার পিয়ার্স।
‘কেন?
‘ডিরেক্টর ক্রো এখন নেপালে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছেন।
ভ্রু কুঁচকালো গ্রে। ‘নেপালে? তিনি নেপালে কী করছেন?
‘কমান্ডার, তাঁকে তুমিই পাঠিয়েছ।
‘কী?
গ্রে এবার বুঝতে পারল।
এক পুরোনো বন্ধুর কাছ থেকে ফোন এসেছিল সপ্তাহখানেক আগে।
অতীতে ডুব দিল গ্রে। সিগমা ফোর্সে ওর প্রথম দিকের দিনগুলোর কথা মনে পড়ল। অন্য সিগমা এজেন্টের মতো গ্রে’রও স্পেশাল ফোর্স ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল। ১৮ বছর বয়সে আর্মিতে যোগ দেয়া, ২১ বছরে কমান্ডো হওয়া। কিন্তু ঊর্ধ্বতন অফিসারের সাথে গণ্ডগোল করায় কোর্ট-মার্শাল হয়েছিল ওর। তারপর ওখান থেকে সিগমা ফোর্সে যোগ দেয়। তবে এখনও আড় চোখে দেখা হয় ওকে। কিন্তু সেই অফিসারকে আঘাত করার পেছনে উপযুক্ত কারণ ছিল। অফিসারের অযোগ্যতার ফলে সে-বার বসনিয়ায় অযথা অনেক লোকের মৃত্যু হয়েছিল, অনেক শিশু মারা পড়েছিল। তবে গ্রে’র রাগের কারণ ছিল আরও গভীরে। যা-ই হোক, কর্তৃপক্ষের সাথে এই বিষয় নিয়ে সমস্যা হওয়ায় বাবার কাছে ফিরে গিয়েছিল গ্রে। অনেকদিন হয়ে যাওয়ার পরও যখন সমস্যার সমাধান হলো না যখন এক জ্ঞানী ব্যক্তি গ্রে’কে পথ বাতলে দিয়েছিলেন।
সেই ব্যক্তির নাম আং গেলু।
‘আপনি বলতে চাচ্ছেন, আমার বন্ধু বুদ্ধ সন্ন্যাসীর জন্য ডিরেক্টর ক্রো নেপালে গিয়েছেন?”
‘পেইন্টার ক্রো জানতেন বুদ্ধ সন্ন্যাসী তোমার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।’
হাঁটা বন্ধ করে ছায়ায় দাঁড়াল গ্রে।
সিগমার ট্রেইনিঙের পাশাপাশি আং গেলুর সাথে নেপালে চার মাস দীক্ষা নিয়েছিল ও। আং গেলুর মাধ্যমেই গ্রে ওর নিজের পড়ার জন্য দারুণ এক সিলেবাস তৈরি করে নিয়েছিল। জীবজিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যা, দুটো ডিগ্রি একসাথে নিয়েছিল গ্রে। ওকে মানসিক দীক্ষা দিয়েছিলেন আং গেলু। সবকিছুর মধ্যে ভারসাম্য খোঁজা শিখিয়ে ছিলেন তিনি। বিপরীত দুটো জিনিসের মধ্যকার মিল, দ্য Taoist yin অ্যান্ড yang, শূন্য ও এক ইত্যাদি।
এধরনের অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন জ্ঞান গ্রে’র অতীতকে মোকাবেলা করার জন্য সাহায্য করেছিল।
বয়স বাড়তে বাড়তে গ্ৰে বুঝতে পারল সে সবসময় বিপরীত জিনিসের মধ্যে আটকে যাচ্ছে। ওর মা এক ক্যাথলিক স্কুলে পড়াতেন। সেখান থেকে গ্রে’র জীবনে ধীরে ধীরে আধ্যাত্মিক বিশ্বাস গভীরভাবে শেকড় গেড়েছিল। জীববিজ্ঞানেও দখল ছিল ওর মা’র। ধর্মপ্রাণ মহিলা ছিলেন তিনি। বিবর্তনবাদও মানতেন। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে তিনি যতটা মন থেকে বিশ্বাস করতে ভক্তি করতেন, ধর্মকেও সেরকম ভক্তি করতেন।
অন্যদিকে গ্রে’র বাবা থাকতেন টেক্সাসে। পেশায় তেলকর্মী, স্বভাবে ঘাড় ত্যাড়া। মাঝ বয়সে এসে অচল হয়ে পড়েন তিনি। যার ফলে গৃহিণীর মতো ঘরে থাকতে হলো তাকে। আর এরকম একজন পুরুষ হয়ে ঘরে থাকতে গিয়ে তার মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেল।
যেমন বাবা, তেমন ছেলে।
তবে ছেলে বদলে যায় আং গেলুর সংস্পর্শে আসার পর।
দুই বিপরীতের মধ্যে থাকা একটি পথ বাতলে দিয়েছিলেন তিনি। এ পথ ঘোট নয়। অতীত ও ভবিষ্যৎ দুদিকের মতো এই পথও বিশাল। গ্রে এখনও এই পথ বুঝে ওঠার জন্য সংগ্রাম করছে।
তবে আং গেলু গ্রে’কে এই পথে চলার জন্য প্রথম কয়েকটি পদক্ষেপ রাখতে সাহায্য করেছিলেন। এজন্য বুদ্ধ সন্ন্যাসীর কাছেও ঋণী। তাই এক সপ্তাহ আগে যখন ওর কাছে সাহায্য চেয়ে একটি ফোন এলো তখন সেটাকে অবজ্ঞা করতে পারল না গ্রে। আং গেলু জানিয়ে ছিলেন, চীন সীমান্তের কাছে অদ্ভুতভাবে মানুষ গায়েব হচ্ছে, অচেনা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।
এই ব্যাপারগুলো কাকে জানালে ভাল হবে সেটা বুঝে উঠতে পারছিলেন না আং গেলু। তাঁর দেশের সরকার মাওবাদী বিদ্রোহীদের নিয়ে বেশি ব্যস্ত। আং গেলু জানতেন গ্রে একটি গোপন সংস্থার অপারেশন ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। তাই ওর কাছেই সাহায্য চেয়ে ছিলেন। কিন্তু গ্রে বর্তমান মিশনে আগে থেকেই ব্যস্ত থাকায় আং গেলুর ডাকে সাড়া দিয়ে নেপালে আসা সম্ভব ছিল না। তাই ব্যাপারটা তখন পেইন্টার ক্রো’কে জানিয়েছিল ও।
ফাইল চালাচালির মতো হয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটা…।
‘পেইন্টার ক্রো’কে জানিয়েছিলাম যাতে উনি একজন জুনিয়র এজেন্টকে পাঠিয়ে দেন,’ আমতা আমতা করল গ্রে। ‘নেপালে আসলে কী হচ্ছে সেটা…’
লোগান বাধা দিলেন। এখানে স্লো ছিল।
একটু গুঙিয়ে উঠল গ্রে। লোগানের সাংকেতিক ভাষা ও বুঝতে পেরেছে। গ্রে যেরকম বিশ্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে এরকম কিছুর পেছনে লেগে ডেনমার্কে চলে এসেছে তেমনি অন্য এজেন্টরাও বিভিন্ন জায়গায় ব্যস্ত আছে।
‘তাই বলে ক্রো নিজেই চলে গেলেন।
‘তুমি তো ডিরেক্টরকে চেনোই। হাতেনাতে কাজ করার জন্য মুখিয়ে থাকেন তিনি’। রেগে দীর্ঘশ্বাস ফেলল লোগান। ‘এখন সমস্যা হয়ে গেছে। ঝড়ের কারণে গত কয়েকদিন যাবত তার সাথে আমাদের যোগাযোগ বন্ধ। তখন থেকে এখন পর্যন্ত ডিরেক্টরের কাছ থেকে একটি আপডেটও পাইনি আমরা। তবে আমরা বিভিন্ন উৎস থেকে গুজব শুনতে পেরেছি। তোমার সন্ন্যাসী বন্ধুটির বলা কাহিনির সাথে মিল আছে ওগুলোর। অসুস্থতা, প্লেগ, মৃত্যু, বিদ্রোহীদের সম্ভাব্য হামলা ইত্যাদি। গুজব বেড়েই যাচ্ছে।’
লোগানের কণ্ঠের থমথমে ভাবটা কেন ছিল সেটা এবার বুঝতে পারল গ্রে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, শুধু গ্রে’র মিশনই ভজকট হয়নি, অন্য মিশনও বেগতিক অবস্থায় পড়েছে।
বিপদ যখন আসে, সবদিক থেকেই আসে।
আমি তোমার কাছে মনককে পাঠাতে পারি,’ বললেন লোগান। সে আর ক্যাপ্টেন ব্রায়ান্ট রওনা হয়ে গেছে। আগামী ১০ ঘণ্টার মধ্যে মনক মাঠে নামবে। ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি শান্ত থাকো।
‘কিন্তু নিলাম তো শেষ হয়ে যাবে…’।
‘কমান্ডার পিয়ার্স, তোমাকে যা অর্ডার দেয়ার দেয়া হয়ে গেছে।
দ্রুত বলতে শুরু করল গ্রে, ওর কণ্ঠস্বর কঠিন, রূঢ়। “স্যার, আমি ইতোমধ্যে প্রবেশ-বাইর হওয়ার পথে ঘোট বোতাম ক্যামেরা বসিয়ে দিয়ে এসেছি। এখন যদি সরে যাই তাহলে ওগুলোকে অপচয় করা হবে।’
‘ঠিক আছে। নিরাপদ স্থান থেকে ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ করো। রেকর্ড করো সবকিছু। কিন্তু এর বেশি কিছু নয়। বোঝা গেছে, কমান্ডার?
রাগ হচ্ছে গ্রে’র, কিন্তু লোগানের আর কিছু করার নেই। ভেরি গুড, স্যার। সৌজন্যবশত বলল ও।
‘নিলামের শেষে রিপোর্ট করবে।’ লোগান বললেন।
“জ্বী, স্যার।
সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
কোপেনহ্যাগেনের রাস্তা ধরে আবার এগোতে শুরু করল গ্রে। চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। কিন্তু ওর মনে দুশ্চিন্তা খচ খচ করছে।
পেইন্টারের জন্য, আং গেলুর জন্য…
নেপালে হচ্ছেটা কী?