ইতিহাসের গূঢ়তত্ত্ব
আমি প্রবাসে গিয়া প্রথমেই ইতিহাস-চর্চা আমার জীবনের ব্রত বলিয়া নিৰ্ব্বাচন করি, আর নানা প্রবাসভূমিতে থাকিয়া ইতিহাস রচনা, ঐতিহাসিক তথ্যসংগ্রহ ও তদুপোযোগী নূতন ভাষাশিক্ষা এইসব কাজ আরম্ভ করি এবং শেষ প্রবাস-বাস পর্যন্ত তাহারই অনুসরণ করি। এই বহুবর্ষব্যাপী কাজের মধ্যে একটা কথা সত্যই আমার মনে জাগিত যে, ভারতের ইতিহাস লিখিতে হইলে বাঙ্গালীর পক্ষে পর-প্রদেশে বাস এবং দীর্ঘভ্রমণ যেমন উপকারী, এমন আর কিছুই নহে। এ কথা যে দিল্লী বা আগ্রা, রাজস্থান বা মহারাষ্ট্র প্রদেশের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সত্য, তাহা আপনারা সহজেই মানিয়া লইবেন। কিন্তু নিজ বাঙ্গলার ইতিহাস লিখিতে যিনি প্রবৃত্ত হইয়াছেন তাঁহার পক্ষেও বাহিরে প্রবাস ও ভ্রমণ অত্যাবশ্যক। কারণ একে তো দেবভাষা ও আর্য্য্যধর্ম্ম, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বন্ধনে সব ভারতীয় প্রদেশগুলি পরস্পরের সহিত জড়িত, তাহার উপর, অতীত যুগে কত বঙ্গাধীপ বঙ্গের বাহিরে নিজ নিজ বিজয়বাহিনী লইয়া গিয়াছিলেন, আর পর-প্রদেশীয় কত রাজা আমাদের এই বঙ্গভূমিতে নিজ অভিযান প্রেরণ করেন। আমাদের ধর্মপ্রচারকের ও আমাদের দিগ্বিজয়- আকাঙ্ক্ষী পণ্ডিতদের চক্ষে নিখিল-ভারত একই দেশ ছিল, তাঁহারা প্রাদেশিক সীমানার বেড়া ভ্রূক্ষেপ না করিয়া লঙ্ঘন করিতেন। ভারতের ভিতর আচার-ব্যবহার, শব্দ ও সাহিত্য, ধর্ম্ম ও কলার এত আদানপ্রদান হইয়া গিয়াছে যে, বঙ্গের বাহিরের ভারত না জানিলে বঙ্গের সভ্যতার ধারাও বুঝা যায় না, বঙ্গদেশের প্রকৃত সম্পূর্ণ ইতিহাস পর্যন্ত লেখা যায় না।
সুতরাং; তুলনামূলক ঐতিহাসিক চর্চ্চা অত্যাবশ্যক। এই কাজে প্রবাসী বাঙ্গালীরা একটি বড় সহজ স্বাভাবিক সুবিধা ভোগ করিতেছেন। পুরাতন ভারতের নানাবিভাগের নিদর্শন তাঁহাদের চারিদিকে; তাঁহারা শুধু চোখ খুলিয়া এগুলি দেখিবেন, এগুলি হইতে ঐতিহাসিক সত্য বাহির করিবেন, আর তথ্যগুলি সমবেত করিয়া অতীতের অবিকল ছবি অঙ্কিত করিবেন। বঙ্গে এই নিদর্শনগুলি নাই, বঙ্গে থাকিয়া আমরা এ সুযোগ পাই না।
তাহার পর ভাষার কথা। প্রাচীন ভারতের, এমন কি, মধ্যযুগীয় ভারতের প্রকৃত অবস্থা জানিতে হইলে, শুধু বাঙ্গলা ও সংস্কৃত ভাষার অভ্যাস করিলেই চলিবে না। সংস্কৃত হইতে উদ্ভূত অথচ এখন পর্যন্ত জীবিত কত কত প্রাদেশিক ভাষা ভারতে প্রাচীন শিলালেখ ও গ্রন্থের অর্থবোধে অনেক স্থানে যে সাহায্য করে, তাহা বিশুদ্ধ কালীদাসী সংস্কৃত হইতে পাওয়া যায় না। আর মধ্যযুগের ভারতকে জানিতে হইলে হিন্দী, ফার্সী ও মারাঠী ভাষায় দক্ষ না হইলে একপদও অগ্রসর হওয়া অসম্ভব। প্রবাসে কাৰ্য্য উপলক্ষে আপনারা সকলেই এ-সব প্রাদেশিক ভাষাগুলির দুই-একটি শিখিতে বাধ্য হন, সুতরাং ঐতিহাসিক উপকরণ সংগ্রহ এবং তাহার অর্থগ্রহণ আপনাদের পক্ষে কিছুমাত্র কষ্টসাধ্য নহে, যেন দৈনিক কাজের মধ্যে।
তাহার উপর প্রবাসে চারিদিকে কত কত অ-বাঙ্গালী জাতির আচার-ব্যবহার লক্ষ্য করিয়া স্থানীয় গীতি ও কথা শুনিয়া আমাদের মনের মধ্যে এক-একটি অপরিচিত নবরাজ্যের দ্বার খুলিয়া যায়– সঙ্কীর্ণতা, প্রাদেশিকতা ঘুচিয়া যায়– সত্যসন্ধানের প্রধান যন্ত্র দুইটি, অর্থাৎ উদারতা ও দীর্ঘদৃষ্টি লাভ হয়। এ সুযোগগুলি বঙ্গে আবদ্ধ বাঙ্গালীর পক্ষে দুঃসাধ্য।
তাই আমি প্রার্থনা করি যে, প্রবাসী বাঙ্গালীরা এই পরম সুযোগগুলির সদ্ব্যবহার করুন– তাঁহাদের মধ্যে ভারতের পুরাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ভাষান্তর, ধৰ্ম্মবিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে মৌলিক গবেষণা করিবার জন্য শত শত প্ৰবীণ তাঁহাদের কষ্টলব্ধ অবসর, শত শত যুবক তাঁহাদের হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা ও উদ্যম নিবেদিত করুক, যেন আমাদের মত বৃদ্ধদের তিরোধানের পর ইতিহাস-চর্চায় ইতিহাস-রচনার ধারা সদানীরা জাহ্নবীর মত প্রবাহিত হইতে থাকে, যেন ঐতিহাসিক সত্য-সন্ধানীরা “যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী” হইয়া জ্ঞানের পথ অবিরাম মুখরিত করিতে থাকেন।
এই শাখায় আগত আপনারা সকলেই ইতিহাস-সাহিত্যিক, অন্তত ইতিহাসপ্রেমী। তাই অতি বৃদ্ধ কারিগরের মত আমি আমাদের কারখানার দুটি মূলযন্ত্র আপনাদের নিকট বলা উচিত মনে করি। প্রথমটি এই যে, বৰ্ত্তমান যুগে সভ্যতার ক্রমোন্নতিতে এবং বিজ্ঞানের শক্তি সর্ব্বত্র প্রবাহিত হইবার ফলে ইতিহাস একদিক থেকে বিজ্ঞানের শাখাবিশেষে পরিণত হইয়াছে। অর্থাৎ ইতিহাসের আদি উপকরণগুলি বেশ করিয়া ঝাড়িয়া, ধুইয়া, গলাইয়া, বিশ্লেষণ করিয়া তবে আমরা তাহাকে কাজে লাগাইতে পারি, তাহা হইতে প্রকৃত তথ্য বাহির করিতে পারি। আর এ-যুগের নিয়মই এই যে, আমাদের নিজ নিজ চর্চ্চার বিশেষ বিষয়টির উপর যথাসম্ভব সবদিক হইতে আলোকপাত করিতে হইবে, সমস্ত বিভিন্ন স্থানের ও বিভিন্ন শ্রেণীর উপকরণ একত্র করিতে হইবে। ইহা অতি কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। ইহার ফলে ইউরোপে এখন আর একজন সাৰ্ব্বভৌম পণ্ডিত কোন গ্রন্থ সমগ্র একা লেখেন না, বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতদের সমষ্টি করিয়া তাঁহাদের সমবেত চেষ্টার ফলে সেই বিষয়টির জ্ঞানের ক্ষেত্র সম্পূর্ণরূপে কর্ষণ করা হয়। এক-একজন বিশেষজ্ঞ এক-একটি অধ্যায় অথবা এক-এক খণ্ড গ্রন্থমাত্র রচনা করেন। ইহাই বর্তমানে অনুসৃত ইউরোপীয় রচনাপদ্ধতি; পণ্ডিতমণ্ডলীর পরস্পর সহযোগ বিনা রচনায় এত উচ্চ উৎকর্ষ সাধিত হওয়া অসম্ভব।
কিন্তু ইতিহাসকে বিজ্ঞান বলিলে ভুল হইবে। ইতিহাস প্রণালীতে বিজ্ঞান হইলেও বাহ্যকলেবরে এবং অন্তরের উদ্দেশ্যে সাহিত্যকলা। এই সত্য না মানিলে মহা ক্ষতি হয়, ঐতিহাসিকের জীবনব্যাপী শ্রম পণ্ড হয়। ইতিহাসকে যে আর্য্যগণ ইতিকাব্য নাম দেন, সেটা বিদ্রূপের বিষয় নহে, এই নামের মধ্যে একটি নিগূঢ় মানব-সত্য নিহিত আছে। ব্যক্তিবিশেষকে ঘিরিয়া, কাল্পনিক উপকরণ লইয়া কাব্য রচিত হয়, অথচ ইতিহাসের প্রতিপাদ্য বিষয় জনসমষ্টির উত্থানপতন, দেশের উপর, দশের উপর জননায়কের প্রভাব এবং ইহার উপকরণ সত্য- মানবের চেষ্টায় যতটুকু সত্য খুঁজিয়া বাহির করিতে পারা যায়, তাহাই। কিন্তু যে আকারে ইতিহাস গ্রন্থটিকে গড়িয়া তুলিতে হইবে, তাহার যে অন্তর্নিহিত মন্ত্রটিকে বাক্যে পরিস্ফুট করিয়া দেখাইতে হইবে, তাহার কথা ভাবিলে ইতিহাস ও কাব্যকে একই শ্রেণীর সাহিত্য বলা উচিত। একজন ইংরাজ লেখক নেপোলিয়নের যুদ্ধবর্ণনা করিতে গিয়া বলিয়াছেন যে, সর্ব্বোচ্চ প্রতিভাশালী সেনাপতি ও চিত্রকরের প্রতিভা একই প্রণালীতে একই পথ দিয়া চলে, একটি বিখ্যাত অভিযান (ক্যাম্পেন) যেন একটি অতুলনীয় তৈলচিত্র। ঠিক সেইরূপ সর্ব্বোচ্চ ইতিহাস-লেখকও প্রকৃতই চিত্রকর, তিনি চিত্র আঁকেন ভাষার তুলি দিয়া- প্রকৃত মানব-মানবীর ভাব ও কর্ম তাঁহার রঙ্গের মশলা। এই চিত্ররচনার দ্বারাই ইতিহাসের অন্তরের সার পাঠককে দেখানো যায়, ইতিহাস গ্রন্থ চূড়ান্ত সফলতা লাভ করে।
কারণ ইতিহাসের প্রকৃত প্রতিপাদ্য বিষয় এটা নয় যে, কোন্ কোন্ ঘটনা ঘটিয়াছিল এবং কখন ঘটিয়াছিল। ইতিহাস দেখাইবে যে, অতীত ঘটনাগুলি কেন ঘটিয়াছিল, কিরূপে ঘটিয়াছিল। প্রাচীন গ্রীক ট্র্যাজেডীতে যেমন অদৃষ্টের অনিবাৰ্য্য প্রতাপ প্রমাণ করা হইত, আমাদের ইতিহাসও তেমনই সত্যকার জগতের কার্যকারণের অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ দেখাইয়া দেয়- মানব-সঙ্ঘের চিত্তের ভাব ও উদ্যম কোন পথে চলিয়াছিল, জাতীয় জীবনে পূর্ব্বপুরুষদের মনোবৃত্তি ও সভ্যতার প্রভাব কতদূর গিয়া দাঁড়ায়, মহাপুরুষ জননেতারা কিরূপে দেশমধ্যে বিপ্লবের সমান পরিবর্ত্তন সংঘটিত করেন নূতনকে ঝড়ের মত আনিয়া দিয়া প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিয়া জাতিকে নবীন পথে প্রচলিত করেন, এইসব মনস্তত্ত্বের কথা কাব্যের তুলিতে ইতিহাসে প্রকাশ করিতে পারিলে তবে সে ইতিহাসগ্রন্থ প্রকৃত ফলবান হইবে, অমর হইয়া থাকিবে– নচেৎ নহে।
এইজন্য ঐতিহাসিকের পক্ষেও কল্পনাশক্তির আবশ্যক। সত্যের ভিত্তিতে স্থাপিত সহস্র সহস্র তথ্যের সমাবেশের ফলে গঠিত, সংযত নিয়ন্ত্রিত কল্পনার সাহায্যে অগ্রসর, কবির মহান গঠনশক্তিতে রচিত, ভাষা ও ভাবের সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যে পুটপাক ঔষধের মত যে ইতিকাব্য, তাহাই প্রকৃত ইতিহাস নামের যোগ্য। জাতিবিশেষের দেশবিশেষের অদৃশ্য জীবনধারা এই ইতিকাব্যের ভাষায় ফুটিয়া উঠিবে, তাহার প্রাণের প্রতিক্রিয়াগুলি আর অতীতের সমাধিগর্ভে নিশ্চল হইয়া থাকিবে না, চলচ্চিত্রের মত পাঠকের সম্মুখে জীবন্ত দৃশ্যমান হইবে। ইহাই ইতিহাসের গূঢ়তত্ত্ব।*
[বুলবুল, ২য় বর্ষ, কার্তিক-পৌষ, ১৩৪১]
* ১৩৪১ সালে কলিকাতায় অনুষ্ঠিত। প্রবাসী-বঙ্গ-সাহিত্য-সম্মিলনে প্রদত্ত অভিভাষণ। শনিবারের চিঠিতে (আশ্বিন, ১৩৫৫) ইতিহাস চর্চ্চার প্রণালী’ ও ইতিহাসের গূঢ়তত্ত্ব প্রবন্ধ দু’টি একত্রে ‘ইতিহাস রচনার প্রণালী ও ইতিহাসের গূঢ়তত্ত্ব’ নামে প্রকাশিত হয়।