তৃতীয় পরিচ্ছেদ
আশ্রয় লাভ
খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম পাদের শেষ বৎসরে, ভাদ্র মাসে, প্রশস্ত গঙ্গাবক্ষে একখানি দীর্ঘাকার নাতিপ্রশস্ত নৌকা দ্রুতবেগে দক্ষিণাভিমুখে যাইতেছিল। সন্ধ্যা আগতপ্রায়; ভাগীরথীর উভয় কূল ধূসরবর্ণ ছায়ায় আবৃত হইয়া আসিতেছে; প্রথম সন্ধ্যায় আলো অাঁধারে নৌকার নাবিকগণ সম্মুখে একখানি ক্ষুদ্র নৌকা দেখিতে পাইয়া তাহা দূরে লইয়া যাইতে কহিল; কিন্তু ক্ষুদ্র নৌকার আরোহী বা নাবিক শুনিতে পাইল না, অথবা গ্রাহ্য করিল না। দেখিতে দেখিতে দ্রুতগামী নৌকাখানি ক্ষুদ্র নৌকার পার্শ্বে আসিয়া পড়িল। নাবিকগণ দেখিতে পাইল যে, ক্ষুদ্র নৌকা কর্ণধারবিহীন, স্রোতের মুখে ভাসিয়া যাইতেছে, নৌকার গর্ভে একটি মনুষ্য দেহ-পড়িয়া রহিয়াছে। সহসা বৃহদাকার নৌকার গতি পরিবর্ত্তিত হইল, তাহা ফিরিয়া আসিয়া ক্ষুদ্র নৌকার পার্শ্বে আসিয়া লাগিল, দুই তিন জন নাবিক ক্ষুদ্র নৌকায় উঠিয়া আরোহীর দেহ পরীক্ষা করিয়া দেখিল যে, সে তখনও জীবিত আছে, কিন্তু রক্তস্রাবে অত্যন্ত ক্ষীণ হইয়া পড়িয়াছে। নাবিকগণ তাহাকে নিজ নৌকায় উঠাইয়া ক্ষুদ্র, নৌকা ভাসাইয়া দিল। বৃহৎ নৌকা পুনরায় দক্ষিণাভিমুখে চলিতে আরম্ভ করিল। নৌকারোহিগণের শুশ্রূষায় আহত ব্যক্তির চেতনা ফিরিলে, নাবিকগণ তাহার থরিচয় জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু সে পরিচয় না দিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তোমরা কোথায় যাইবে?” নাবিকগণ কহিল,—“আমরা সপ্তগ্রামে যাইব।” “পথে আর কোন নৌকা দেখিয়াছ?” “না।” “তুমি আহত হইলে কিরূপে?” “ফিরিঙ্গীর সহিত যুদ্ধে।” “ফিরিঙ্গীর সহিত যুদ্ধে? কেমন করিয়া বিবাদ বাধিল? কোথায় যুদ্ধ হইল?” “মকসুসাবাদের নিকটে গৌরীপুরে।” “ফিরিঙ্গী কি তোমার নৌকা মারিয়াছিল?” “না, আমার এক আত্মীয়াকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।”
এই কথা শুনিয়া একজন নাবিক নৌকার কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল এবং ক্ষণকাল পরে জনৈক প্রৌঢ় ব্যক্তির সহিত ফিরিয়া আসিল। প্রৌঢ় যুবকের কাহিনী শুনিয়া তাহাকে পরিচয় দিতে অনুরোধ করিল, কিন্তু যুবক কিছুতেই পরিচয় দিল না। তখন প্রৌঢ় কহিল, “যুবক, তুমি বীর, অস্ত্র ধরিতে জান, বন্দুক ধরিতে শিখিয়াছ কি?” “এমন কোন অস্ত্র নাই যাহা ধরিতে শিখি নাই।” “তুমি কি জাতি?” “আমি ব্রাহ্মণ। অন্য কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না; আপনি জীবনদাতা, আপনার আদেশ অমান্য করিতে হইলে সংকোচ বোধ হয়।”
যুবক ব্রাহ্মণবংশজাত শুনিয়া প্রৌঢ় তাহাকে প্রণাম করিয়া পদধূলি গ্রহণ করিলেন এবং কহিলেন, “ঠাকুর, আপনি ভিতরে অসুন।” নৌকায় একটি মাত্র কক্ষ ছিল, তাহার মধ্যে বহুমূল্য শয্যায় অনিন্দ্যসুন্দরকান্তি এক যুবা বসিয়া ছিল। প্রৌঢ় কক্ষে প্রবেশ করিয়া তাহাকে কহিলেন—“গোষ্ঠ, আমাদের অতিথি ব্রাহ্মণ, প্রণাম কর।” যুবা উঠিয়া অতিথিকে প্রণাম করিল। তখন প্রৌঢ় পুনরায় কহিলেন, “গোষ্ঠ, আমাদের খাস বন্দুকগুলি বাহির করিয়া আন।” যুবক কক্ষের নিম্নে নৌকাগর্ভ হইতে সাত আটটি বহুমূল্য বন্দুক বাহির করিল। প্রৌঢ় ময়ূখকে কহিলেন, “ঠাকুর, ভাল দেখিয়া একটি বন্দুক বাছিয়া লউন।” ময়ূখ একটি ক্ষুদ্র বন্দুক বাছিয়া লইলেন। গোষ্ঠ নৌকার ছাদ হইতে থলিয়া ভরা বারুদ ও গুলি বাহির করিল এবং তাহা ময়ূখের হস্তে প্রদান করিল। তখন প্রৌঢ় জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঠাকুর, আপনি কি ক্লান্ত হইয়াছেন?” ময়ূখ কহিল “না।” “তবে বাহিরে আসুন, নিশাযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইয়া থাকি।” “মাঝি মাল্লারা কি বন্দুক ধরিতে জানে?” “ঠাকুর, মাল্লারা কেহই ধীবর নহে, তাহারা শিক্ষিত সেনা, আবশ্যক মত নাবিকের কার্য্য করিয়া থাকে।” “কতজন মাল্লা আছে?” “দেড় শত, সকলের নিকটেই বন্দুক আছে।” “সেগুলি ভরিয়া রাখিলে হয় না?” “চলুন, বাহিরে যাই।”
তিন জনে কক্ষের বাহিরে অসিলেন। তখন শুক্লা নবমীর জ্যোৎস্না চারিদিকে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে, অন্ধকার কূলে কূলে বিটপিরাজির আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। প্রৌঢ় কর্ণধারকে ডাকিলেন, সে একজন নাবিকের হস্তে হাল দিয়া তাঁহার নিকটে আসিল। প্রৌঢ় কহিলেন, “কেনারাম, প্রস্তুত হও, বোধ হইতেছে রাত্রিতে লড়াই করিতে হইবে।”
কেনারাম কিছুমাত্র বিস্মিত না হইয়া কহিল, “কাহার সহিত হুজুর?” “ফিরিঙ্গি হারমাদের সহিত।” “এখানেও ফিরিঙ্গি? আমরা ভাবিয়াছিলাম যে, সারা বাঙ্গলা মুলুকে একমাত্র সাতগাঁই জ্বলিয়া খাক হইয়া গেল। তবে তোপ দুইটা বাহির করি?” “কর। বারুদের অভাব হইবে না ত?” “হুজুর, যথেষ্ট বারুদ আছে। অভাব হইবে লোকের, এত বড় ছিপ লইয়া লড়াই করিতে হইলে তিন শত লোকের প্রয়োজন, দুই শত নৌকা বাহিবে, আর এক শত লড়াই করিবে।” “তোমাদের বন্দুকগুলি ভরিয়া রাখিতে বল।” “সমস্ত বন্দুক প্রস্তুত আছে, কেবল তোপ দুইটী ভরিয়া রাখিতে হইবে।” “শীঘ্র ভরিয়া লও।”
কর্ণধারের আদেশে দশ পনর জন মাল্লা নৌকাগর্ভ হইতে দুইটী তোপ তুলিয়া তাহা নৌকার উপরে সাজাইল এবং কর্ণধারের নির্দ্দেশ অনুসারে তাহা নৌকার উপরে বসাইয়া বারুদ ও গোলা ভরিয়া রাখিল। তখন সকলে মিলিয়া নৌকা বাহিতে আরম্ভ করিল, নৌকা নক্ষত্র বেগে ছুটিল।
রজনীর দ্বিতীয় যাম অতিবাহিত হইলে, ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে তীব্র আলোক দৃষ্ট হইল। তাহা দেখিয়া প্রৌঢ় কর্ণধারকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—“কিনু, কিসের আলো?” “কোনও গ্রামে আগুন লাগিয়াছে বোধ হয়।” “আলো বড়ই জোর, দুই এক খানি ঘরে আগুন লাগিলে এত আলো হইত না।” দেখিতে দেখিতে নৌকা আলোকের নিকটবর্ত্তী হইল, সকলে দেখিতে পাইলেন যে, একখানি বৃহৎ গ্রাম অগ্নিতে জ্বলিয়া উঠিয়াছে; তখন প্রৌঢ় কহিলেন, “এত বড় গ্রাম এক সঙ্গে জ্বলিয়া উঠিল কি করিয়া?” কেনারাম কহিল, “হুজুর, বোধ হয়, কেহ ইচ্ছা করিয়া আগুন লাগাইয়া দিয়াছে।” “ফিরিঙ্গি নহে ত?” “ভগবান্ জানেন, হুজুর, অনুমতি হইলে ছিপ কিনারায় লাগাই। ছায়ায় ছায়ায় চলিলে বিপদের সম্ভাবনা অল্প।” “তবে তাহাই কর।” ছিপ ফিরিল এবং ভাগীরথীর পশ্চিম কূলের নিম্নে চলিতে আরম্ভ করিল। সহসা কর্ণধার দীর্ঘাকার কোশা দেখিতে পাইয়া একটি ক্ষুদ্র খালের মধ্যে ছিপ চালাইয়া দিল। বৃক্ষতলের অন্ধকারে ছিপ বাঁধিয়া সকলে তীরে নামিল, কেবল পঁচিশ জন নাবিক পাহারায় রহিল। তীরে নামিয়া প্রৌঢ় জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঠাকুর, এ গ্রাম কি আপনার পরিচিত?” ময়ূখ কহিলেন, “না, গ্রামের ভিতরে প্রবেশ না করিয়া গঙ্গাতীরের পথে চলুন, তাহা হইলে নৌকা ও দস্যুদলের মধ্যে গিয়া পড়িব।” প্রৌঢ় কহিলেন, “উত্তম কথা; ঠাকুর, তুমি যুদ্ধ ব্যবসায় পারদর্শী দেখিতেছি। সকলে নদীকূলের উচ্চ ভূমির আশ্রয়ে ধীরে ধীরে চল।”
প্রৌঢ়, গোষ্ঠ, ময়ূখ, নাবিকগণের অগ্রে অগ্রে চলিতে লাগিলেন। কিয়দ্দূর অগ্রসর হইয়া, ময়ূখ কহিলেন, “দেখুন, নাবিকগণকে দুই ভাগে ভাগ করিয়া লই, একদল নাবিক গ্রামবাসিগণের রক্ষায় যাউক, দ্বিতীয়দল তাহাদের প্রত্যাবর্ত্তনের পথরোধ করুক।” “উত্তম কথা, কে কোন্ পথে যাইবে?” “আমি গ্রাম রক্ষায় যাইতেছি, আপনারা পিতাপুত্রে অগ্রসর হউন।”
সপ্ততি জন নাবিক ময়ূখের সহিত গ্রামের দিকে যাত্রা করিল; অবশিষ্ট নাবিকগণকে লইয়া প্রৌঢ় ও গোষ্ঠ নৌকার দিকে অগ্রসর হইলেন। ক্ষণকাল পরে গ্রামমধ্যে ক্রমাগত বন্দুকের শব্দ হইতে লাগিল; এবং মুহূর্ত্তপরে একজন নাবিক ফিরিয়া আসিয়া প্রৌঢ়কে কহিল, “আমাদের দেখিয়া দস্যুরা পলাইতেছে, তাহাদিগের নৌকা কোথায়?” প্রৌঢ় কহিলেন,— “নৌকা ত খুঁজিয়া পাই নাই, দস্যুরা কি ফিরিঙ্গি?” “হয় মগ্ না হয় ফিরিঙ্গি।”
এই সময়ে ফিরিঙ্গিদিগের কোশার মত একখানি বড় নৌকা আর একটি খালের ভিতর হইতে বাহির হইয়া গঙ্গায় পড়িল, তাহা দেখিয়া প্রৌঢ় নাবিককে কহিলেন, “বোধ হয়, ঐ দস্যুদিগের নৌকা, তুমি ঠাকুরকে গিয়া বল যে আর গ্রামে বিলম্ব করিবার প্রয়োজন নাই, দস্যুরা নৌকায় উঠিয়া পলাইয়াছে। যত শীঘ্র সম্ভব নৌকায় ফিরিয়া আসিও।”
নাবিক চলিয়া গেল, প্রৌঢ় নৌকায় ফিরিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে ময়ূখ ও অন্যান্য নাবিকগণ নৌকায় ফিরিয়া আসিলেন। নৌকা তৎক্ষণাৎ দক্ষিণাভিমুখে যাত্রা করিল। কক্ষে বসিয়া প্রৌঢ় ময়ূখকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঠাকুর, আর দুই দিনে সপ্তগ্রাম পৌঁছিব। আপনি সপ্তগ্রামে কোথায় যাইবেন?” “ফৌজদার কলিমুল্লা খাঁর নিকটে।”
“একদিনেই কি ফৌজদারের সাক্ষাৎ পাইবেন? সপ্তগ্রামে কি আপনার কোন পরিচিত লোক আছে?” “কেহ না, তবে আমার পিতার দুই একজন বন্ধু আছেন।” “তাঁহারা কি আপনাকে জানেন?”
“আমার নাম শুনিয়াছেন, কিন্তু কখনও আমাকে চক্ষে দেখেন নাই।” “তবে আশ্রয় লইবেন কোথায়?” “যদি কেহ চিনিতেই না পারেন, তাহা হইলে অতিথিশালায় আশ্রয় লইব।” “যদি অনুগ্রহ করিয়া সপ্তগ্রামে আমার কুটীরে বাস করেন, তাহা হইলে চরিতার্থ হইব।”
“আপনি জীবনদাতা, যখন যাহা আদেশ করিবেন আমি সানন্দে তাহাই সম্পাদন করিব। আমি সপ্তগ্রামে অপরিচিত, কর্পদ্দকশূন্য ভিখারী; আপনি দয়া করিয়া দ্বিতীয়বার আমাকে আশ্রয় দিতে চাহিয়াছেন, ইহাই আমার পরম সৌভাগ্য—”
সহসা গুড়ুম করিয়া তোপের আওয়াজ হইল, সঙ্গে সঙ্গে ছিপ কাঁপিয়া উঠিল, প্রৌঢ় কক্ষের দীপ নিবাইয়া ত্রস্ত পদে বাহিরে আসিলেন এবং দেখিলেন যে, দূরে কোশার ন্যায় এক খানি বৃহৎ নৌকা অন্ধকারে দাঁড়াইয়া আছে। তাঁহাকে বাহির হইতে দেখিয়া কেনারাম তাঁহার নিকটে আসিল এবং কহিল, “হুজুর, ফিরিঙ্গি হার্মাদ বোধ হয় পিছু লইয়াছে, গোলা লাগিয়া একজন মাল্লা মরিয়াছে।”
প্রৌঢ় কহিলেন,—“আমাদের তোপ প্রস্তুত আছে ত?”
“আছে, কিন্তু তাহার গোলা অতদূর পৌঁছিবে না।” “তবে শীঘ্র নৌকা ফিরাও।” মুহূর্ত্ত মধ্যে ছিপ ফিরিল এবং উত্তরাভিমুখে চলিতে আরম্ভ করিল। তখন প্রৌঢ় ময়ূখকে কহিলেন, “ঠাকুর, এ অত্যাচার আর সহ্য হয় না,—এইবার আমি স্বয়ং অস্ত্র ধরিব।” ময়ূখ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—“আপনার উপরে কে অত্যাচার করিয়াছে?” পর্ত্তুগীজ বণিক্ অথবা দস্যু।“ “পর্ত্তুগীজ বণিক্ কি দস্যু?” “ইহারা যখন সুবিধা পায় তখন বাণিজ্য করে এবং যখন অবসর বুঝে তখন লুঠ তরাজ করে।” “ফৌজদার ইহাদিগকে শাসন করেন না কেন?” “পারেন না বলিয়া।” “সুবাদার কি এ সকল কথা জানেন না?” “ভিতরে আসুন বলিতেছি।”