৩. আলোকের বেগ
অপেক্ষবাদের অধিকাংশ অদ্ভুত ব্যাপারই আলোকের বেগের সঙ্গে জড়িত। যে সমস্ত কারণে প্রাচীনতন্ত্র ভেঙে পড়েছে সে সম্পর্কে খানিকটা ধারণা থাকলে পাঠক এই গুরুত্বপুর্ণ তাত্ত্বিক পুনর্গঠনের কারণ বুঝতে পারবেন না।
আলোক নির্দিষ্ট নিশ্চিত বেগে প্রেরিত হয় এ তথ্য প্রথম প্রমাণিত হয়েছে জ্যোতিষীয় (astronomical) পর্যবেক্ষণের সাহায্যে। বৃহস্পতি গ্রহের চন্দ্রগুলিতে অনেক সময় বৃহস্পতি নিজেই গ্রহণ সৃষ্টি করে। এ ঘটনার সম্ভাব্যকাল গণনা করা সহজ। দেখা গিয়েছিল, বৃহস্পতি যখন পৃথিবীর কাছাকাছি তখন একটি চন্দ্রের গ্রহণ দেখা যাবে প্রত্যাশিত সময়ের কয়েক মিনিট আগে, আর বৃহস্পতি যখন দূরে তখন সেই গ্রহণ দেখা যাবে প্রতাশিত সময়ের কয়েক মিনিট পর। দেখা গেল, আলোকের একটি বিশেষ বেগ রয়েছে : এই অনুমানের ভিত্তিতে এই সমস্ত বিচ্যুতি ব্যাখ্যা করা যায়। অর্থাৎ বৃহস্পতিতে ঘটমান যা কিছু আমরা লক্ষ্য করি সেগুলি ঘটেছে কিছুক্ষণ আগে। বৃহস্পতি যখন কাছে তখনকার তুলনায় বৃহস্পতি যখন দূরে তখন একটু বেশি সময় আগে ঘটনাগুলি ঘটেছে। দেখা গেল সৌরতন্ত্রের অন্যান্য অংশ বিষয়ে সমরূপ ঘটনার ব্যাখ্যাও আলোকের এই বেগের সাহায্যে করা সম্ভব। সুতরাং মেনে নেওয়া হল, শূন্যস্থানে আলোক সব সময়ই একটি স্থির বেগে চলে। সে বেগ সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার (এক কিলোমিটার এক মাইলের আট ভাগের প্রায় পাঁচ ভাগ)। এ রাশি প্রায় নির্ভুল। তরঙ্গ দিয়ে আলোক গঠিত এ তথ্য যখন প্রতিষ্ঠিত হল তখন এটা ছিল ইথারের তরঙ্গ বিস্তারের বেগ। তখন অন্তত তরঙ্গ ছিল ইথারে। কিন্তু এখন ইথারকে পরিত্যাগ করা হয়েছে কিন্তু তরঙ্গ রয়ে গিয়েছে। একই বেগ বেতার তরঙ্গের (এগুলি আলোকতরঙ্গের মতো– শুধু দীর্ঘতর) এবং এক্সরে-র (এগুলি আলোকতরঙ্গের মতো তবে হ্রস্বতর)। এখনকার বিশ্বাস একই বেগে মহাকর্ষও বিস্তার লাভ করে (অপেক্ষবাদ আবিস্কারের আগে ভাবা হতো মহাকর্ষের বিস্তার তাৎক্ষণিক। কিন্তু এখন এ দৃষ্টিভঙ্গি অচল)।
এ পর্যন্ত সবটাই সহজ সরল। কিন্তু নির্ভুলতর মাপন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা সঙ্কট জমতে লাগল। অনুমান করা গিয়েছিল তরঙ্গগুলি ইথারের সুতরাং তাদের বেগও হওয়া উচিত ইথার সাপেক্ষ। কিন্তু স্পষ্টতই ইথার (যদি তার অস্তিত্ব থাকে) নভোমণ্ডলের বস্তুপিণ্ডগুলির গতিতে কোনো বাধাদান করে না। সুতরাং ইথার তাদের গতিতে অংশ গ্রহণ করে না, একথা মনে হওয়া স্বাভাবিক। একটা জাহাজকে যেরকম তার সামনে অনেকটা জল ঠেলতে হয় পৃথিবীকেও যদি সেরকম ইথার ঠেলে এগোতে হতো তাহলে জাহাজকে যেরকম জল বাধা দেয় পৃথিবীর ক্ষেত্রেও সেরকম ইথারের বাধা প্রত্যাশা করা উচিত ছিল। সুতরাং সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল : মোটা ছাদাওয়ালা ছাঁকনির ভিতর দিয়ে যেরকম বাতাস যাতায়াত করতে পারে ইথারও সেরকম বস্তুপিণ্ডগুলির ভিতর দিয়ে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। পার্থক্য শুধু : এ ক্ষমতা ইথারের বেশি। ব্যাপারটা যদি এই হয় তাহলে নিশ্চয়ই কক্ষস্থিত পৃথিবীর সঙ্গে ইথারের একটা আপেক্ষিক বেগ থাকা উচিত। এরকম যদি হতো যে, কক্ষের কোনো এক বিন্দুতে পৃথিবী নির্ভুল সমরূপে ইথারের সঙ্গে চলমান তাহলে অন্য বিন্দুতে তার চলন নিশ্চয়ই দ্রুততর হতো। আপনি যদি একটা চক্রাকার পথে ঝড়ের দিনে হাঁটেন তাহলে বাতাস যেদিক থেকেই আসুক না কেন খানিকটা পথ আপনাকে বায়ুস্রোতের বিরুদ্ধে যেতে হবে। পৃথিবী এবং ইথারের ক্ষেত্রেও এই একই নিয়ম। এর ফলস্বরূপ : আপনি যদি ছ’মাস ব্যবধানে দুটি দিন নির্ধারণ করেন তাহলে পৃথিবী তার কক্ষে একদিনের তুলনায় অন্যদিন নির্ভুল বিপরীত দিকে চলমান হবে। সুতরাং এর ভিতরে কোনো একদিন নিশ্চয়ই পৃথিবী ইথার স্রোতের বিরুদ্ধগামী হবে।
এখন এ তথ্য স্পষ্ট যে ইথারের স্রোত যদি থাকে এবং পৃথিবীতে যদি একজন পর্যবেক্ষক থাকে তাহলে তার মনে হবে স্রোতকে আড়াআড়িভাবে অতিক্রমের সময়ের চাইতে স্রোতের অভিমুখে গমনের সময় আলোক সঙ্কেতের গতি দ্রুততর আবার স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার সময়ের তুলনায় স্রোতকে আড়াআড়িভাবে অতিক্রমের সময়ে আলোকসঙ্কেতের গতি দ্রুততর মনে হবে। মিচেলসন (Michelson) এবং মর্লি (Morley) তাঁদের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় এই ব্যাপারটাই জানতে চেয়েছিলেন। তাঁরা দুটি অভিমুখে দুটি আলোকসঙ্কেত পাঠিয়েছিলেন। অভিমুখ দুটি একটি অন্যটির সমকোণে। প্রতিটি সঙ্কেতই একটা আয়না থেকে প্রতিফলিত হয়ে যেখান থেকে প্রেরিত হয়েছিল সেখানেই ফিরে আসে। পরীক্ষা কিংবা সামান্য গণিতের সাহায্যে যে কোনো লোকই যাচাই করে দেখতে পারেন। একটি নদী আড়াআড়ি পেরিয়ে ফিরে আসতে যে সময় লাগে তার চাইতে একই দূরত্ব স্রোতের বিপক্ষে গিয়ে আবার ফিরে আসতে বেশি সময় লাগে। আলোকসঙ্কেতগুলি ইথার তরঙ্গ দিয়ে গঠিত। সুতরাং ইথার প্রবাহ যদি থাকত তাহলে দুটি আলোকসঙ্কেতের ভিতরের একটির আয়না গিয়ে ফিরে আসার গড় হার (average rate) অন্যটির তুলনায় মন্থরতর হতো (slower average rate)। মিচেলসন এবং মর্লি এ পরীক্ষা করেন, বিভিন্ন অবস্থান থেকে এ পরীক্ষা করেন, পরে আবারও পরীক্ষা করেন। তাঁদের যন্ত্রপাতি যথেষ্ট নির্ভুল ছিল, ছিল দ্রুতির প্রত্যাশিত পার্থক্য কিংবা তার চাইতে কম পার্থক্য ধরতে পারার উপযুক্ত যদি অবশ্য কোনো পার্থক্য কিংবা তার চাইতে কম পার্থক্য ধরতে পারার উপযুক্ত যদি অবশ্য কোনো পার্থক্য থাকত। কিন্তু ক্ষুদ্রতম পার্থক্যও ধরা পড়েনি। এই পরীক্ষার ফল তাদের কাছে এবং সবার কাছেই ছিল একটা বিস্ময়। কিন্তু একাধিক সযত্ন পুনরাবৃত্তি করার ফলে সন্দেহ করা ছিল অসম্ভব। এ পরীক্ষা প্রথম করা হয় অনেক আগে ১৮৮১ সালে। আরো বিস্তৃত ব্যবস্থাপনা করে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করা হয় ১৮৮৭ সালে। কিন্তু এ পরীক্ষার সঠিক ব্যাখ্যা হয় বহু বছর পর।
পৃথিবী তার গতির সঙ্গে নিজ সান্নিধ্যের ইথার বহন করে অনেকগুলি কারণে এ অনুমান ছিল অসম্ভব। সুতরাং একটি যৌক্তিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল বলে মনে হয়। কতকগুলি অতীব যাদৃচ্ছিক প্রকল্পের সাহায্যে পদার্থবিদ্যাবিদরা এ অবস্থা থেকে মুক্তির চেষ্টা করেন। এগুলির ভিতরে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ছিল ফিট জারাল্ডের (Fit Zerald)। এ প্রকল্প লোরেঞ্জের (Lorentz) সাহায্যে বিকাশ লাভ করে এবং এখন লোরেঞ্জ সঙ্কোচন প্রকল্প (Lorentz Contraction Hypothesis) নামে পরিচিত।
এই প্রকল্প অনুসারে একটি বস্তুপিণ্ড যখন গতিশীল তখন গতির অভিমুখে তার সঙ্কোচন হয়। সঙ্কোচনের অনুপাত তার বেগের উপর নির্ভরশীল। সঙ্কোচনের পরিমাণ মিচেলসন-মর্লি পরীক্ষার অপরা ফল (negative result) ব্যাখা করার পক্ষে পর্যাপ্ত মাত্র। স্রোতের মুখে যাতায়াত আসলে স্রোতের আড়াআড়ি যাতায়াতের তুলনায় স্বতর ভ্রমণ এবং এই হ্রস্বতা হতো ততটুকুই যতটুকু দূরত্ব ধীরতর আলোকতরঙ্গ একই সময়ে অতিক্রম করতে পারে। এই সঙ্কোচন অবশ্য মাপনের সাহায্যে কখনোই ধরা যেত না কারণ আমাদের মাপনদণ্ডও একই সঙ্গে সঙ্কুচিত হতো। পৃথিবীর গতিরেখার অভিমুখে স্থাপিত একটি ফুটরুলের দৈর্ঘ্য গতিরেখার সমকোণে স্থাপিত একই ফুটরুলের দৈর্ঘ্যের চাইতে কম হবে। এ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ‘হোয়াইট নাইটের’ দৃষ্টিভঙ্গির যতটা সাদৃশ্য রয়েছে আর কিছুর সঙ্গে ততটা সাদৃশ্য নেই এমন ফন্দি যে, সবার গোঁফই সবুজ রঙ করা হবে কিন্তু সব সময় এত বড় একখানা পাখা চালানো হবে যে সে গোঁফ দেখা যাবে না। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল এ ফন্দিতে কাজ ভালই চলছিল, পরে যখন আইনস্টাইন তাঁর বিশিষ্ট অপেক্ষবাদ উপস্থাপন করলেন (১৯০৫) তখন দেখা গেল প্রকল্পটি একটি বিশেষ অর্থে নির্ভুল, কিন্তু শুধুমাত্র একটি বিশেষ অর্থেই। অর্থাৎ অনুমিত সঙ্কোচন কোনো ভৌত বাস্তবতা নয়, শুধু কয়েকটি মাপন রীতির ফল মাত্র। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি একবার খুঁজে পেলে দেখা যায় সে রীতি গ্রহণ করতে আমরা প্রায় বাধ্য। কিন্তু এ ধাঁধার আইনস্টাইনের করা সমাধান এখন আমি প্রকাশ করতে চাই না। আপাতত আমি শুধু চাই ধাঁধার নিজস্ব চরিত্রটা স্পষ্ট করে বলতে।
আপাতদৃষ্টিতে তদর্থক (ad hoc) প্রকল্পটি ছাড়াও মিচেলসন-মর্লি (অন্যান্য পরীক্ষার সংযোগে) দেখিয়েছেন–পৃথিবী সাপেক্ষ আলোকের গতি সবদিকেই অভিন্ন এবং সূর্য প্রদক্ষিণের সময় যদিও পৃথিবীর গতি অভিমুখ সবসময়ই পরিবর্তিত হচ্ছে তবুও বৎসরের সবসময় এ তথ্য সমভাবে সত্য। তাছাড়া দেখা গেল ব্যাপারটা শুধু পৃথিবীরই বিশেষত্ব নয়, সমস্ত বস্তুপিণ্ড সাপেক্ষই এ তথ্য সত্য। একটি বস্তুপিণ্ড থেকে যদি আলোকসঙ্কেত প্রেরিত হয় তাহলে সে বস্তুপিণ্ডটি যেভাবেই চলমান হোক না কেন সবসময়ই তার স্থিতি হবে বহির্মুখে বিস্তারমান আলোকতরঙ্গের কেন্দ্রে। অন্ততপক্ষে বস্তুপিণ্ডটির সঙ্গে চলমান পর্যবেক্ষকের সেই ধারণাই হবে। এটাই ছিল পরীক্ষাগুলির সরল এবং স্বাভাবিক অর্থ। আইনস্টাইন লাফল্যের সঙ্গে যে তত্ত্বটি আবিষ্কার করেন, সে তত্ত্ব এই তথ্যকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু প্রথমে মনে হয়েছিল এই সরল স্বাভাবিক অর্থ মেনে নেওয়া যুক্তির দিক থেকে অসম্ভব।
কয়েকটি উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে তথ্যগুলি কিরকম অদ্ভুত। কামান দাগলে গোলাটা শব্দের চাইতে আগে যায়, যাদের লক্ষ্য করে কামান দাগা হল তারা প্রথমে দেখতে পায় আলোর ঝলক, তারপর (যদি কপাল ভাল হয়) গোলাটাকে যেতে দেখে এবং সবচাইতে শেষে শুনতে পায় শব্দ। স্পষ্ট বোঝা যায়, গোলার সঙ্গে যারা যেতে পারত তারা শব্দটা কখনোই শুনতে পেত না কারণ শব্দটা গোলা অবধি আসবার আগেই গোলার বিস্ফোরণে তাদের মৃত্যু হতো। কিন্তু শব্দের কর্মপদ্ধতি যদি আলোকের মতো হতো তাহলে তারা স্থিতাবস্থায় থাকলে যেরকম শুনত, কামানের গোলার সঙ্গে চলমান অবস্থাতেও শুনত সেইভাবেই। সে ক্ষেত্রে শব্দ প্রতিধ্বনিত করার ক্ষমতাসম্পন্ন একটা পর্দা যদি কামানের গোলার সঙ্গে সংযুক্ত থাকত এবং সঙ্গে চলমান হতো–ধরুন একশ গজ সামনে–তাহলে তারা পর্দা থেকে প্রতিধ্বনিত কামানের আওয়াজ যে কাল ব্যবধানে শুনতে পেত সে ব্যবধান হতো তারা আর কামানের গোলা স্থিতাবস্থায় থাকার সময়কার কাল ব্যবধানের সমান। এ পরীক্ষা অবশ্য করা সম্ভব নয় কিন্তু সম্ভাব্য কতগুলি পরীক্ষা থেকে পার্থক্যটা বোঝা যাবে। আমরা একটা রেলপথের উপর এমন একটি স্থান জোগাড় করতে পারি যেখানে ঐ রেলপথেরই উপর দূরস্থিত একটি জায়গা থেকে প্রতিধ্বনি আসে–ধরুন এমন একটি জায়গা যেখানে রেললাইনটি একটি সুড়ঙ্গের (tunnel) ভিতর দিয়ে গিয়েছে। ট্রেনটি যখন চলমান তখন লাইনের ধার থেকে কেউ একটা বন্দুকের আওয়াজ করুক। ট্রেনের গতি যদি প্রতিধ্বনির অভিমুখী হয় তাহলে ট্রেনের আরোহীরা প্রতিধ্বনি শুনতে পাবে লাইনের পাশের লোকটির চাইতে অনেক আগে কিন্তু অভিমুখ যদি বিপরীত হয় তাহলে তারা শুনতে পাবে পরে। কিন্তু এ পরিস্থিতি ঠিক মিচেলসন-মর্লি পরীক্ষার পরিস্থিতির মতো নয়। ঐ পরীক্ষার আয়নাগুলি প্রতিধ্বনির অনুরূপ এবং আয়নাগুলি পৃথিবীর সঙ্গে চলমান, তাহলে প্রতিধ্বনিরও ট্রেনের সঙ্গে চলমান হওয়া উচিত ছিল। অনুমান করা যায়, বন্দুকের আওয়াজ করা হয়েছে গার্ডের গাড়ি থেকে এবং প্রতিধ্বনি এসেছে ইঞ্জিনের উপরের একটি পর্দা থেকে। আমাদের অনুমান হবে গার্ডের গাড়ি থেকে ইঞ্জিনের দূরত্ব, শব্দ এক সেকেন্ডে যতদূর যেতে পারে ততটা (এক মাইলের পাঁচ ভাগের এক ভাগের মতো) এবং ট্রেনের দ্রুতি শব্দের দ্রুতির বারো ভাগের এক ভাগ (ঘণ্টায় প্রায় ষাট মাইল)। এখন, এমন একটি পরীক্ষা আমাদের রয়েছে যেটা ট্রেনের আরোহীরা করতে পারে। গাড়িটা স্থিতিশীল থাকলে গার্ড দু সেকেন্ডে প্রতিধ্বনি শুনবে। এমনিতে (as it is) আসলে সময় লাগবে ২/১৪৩ সেকেন্ডে। শব্দের বেগ জানা থাকলে এই পার্থক্য থেকে বাড়ির বেগ গণনা করা সম্ভব। এমনকি, রাত যদি কুয়াশাচ্ছন্ন হয়, যদি পার দেখা না যায় তাহলেও। কিন্তু শব্দের আচরণ যদি আলোকের মতো হয় তাহলে ট্রেনের গতি যত দ্রুতই হোক না কেন গার্ড দু সেকেন্ড পরেই প্রতিধ্বনি শুনবে।
ঐতিহ্য এবং সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোকের বেগ বিষয়ক তথ্য কিরকম অসাধারণ, সেটা বুঝতে কয়েকটা দৃষ্টান্ত আমাদের সাহায্য করবে। সবাই জানে একটা এস্কালেটরে (Escalator–চলমান সিঁড়ি) উঠে হাঁটলে তাড়াতাড়ি উপরে উঠা যায়–চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে সময় বেশি লাগে কিন্তু এস্কালেটর যদি আলোকের বেগে চলে (এমনকি নিউ ইয়র্কেও এস্কালেটর এ বেগে চলে না) তাহলে আপনি হাঁটুন কিংবা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন, পৌঁছাবেন একই সময়ে। আবার : আপনি যদি একটা রাস্তা দিয়ে ঘন্টায় চার মাইল বেগে হাঁটেন, আর একটি মোটরগাড়ি যদি একই অভিমুখে ঘণ্টায় চল্লিশ মাইল বেগে পাশ দিয়ে আপনাকে ছাড়িয়ে যায় এবং আপনি এবং মোটরগাড়ির দুইই যদি চলতে থাকেন তাহলে একঘণ্টা বাদে আপনার সঙ্গে মোটরগাড়ির দূরত্ব হবে ছত্রিশ মাইল। কিন্তু আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার সময় মোটর গাড়িটা যদি বিপরীত অভিমুখে চলতে থাকত তাহলে একঘণ্টা বাদে আপনার সঙ্গে মোটরগাড়ির দূরত্ব হতো চুয়াল্লিশ মাইল। কিন্তু মোটরগাড়িটা যদি আলোকের বেগে যেত তাহলে গাড়িটার সঙ্গে আপনার দেখা হওয়া কিংবা গাড়িটা আপনাকে ছাড়িয়ে যাওয়াতে কোনো পার্থক্যই হতো না। দুটি ক্ষেত্রেই এক সেকেন্ড বাদে আপনার সঙ্গে তার দূরত্ব হতো ১,৮৬,০০০ মাইল। আগের সেকেন্ডে যদি অন্য কোনো কম দ্রুতগামী গাড়ির সঙ্গে আপনার দেখা হতো কিংবা সে গাড়ি যদি আপনাকে ছাড়িয়ে যেত তাহলে সে গাড়ির সঙ্গেও ঐ আলোকের দূরত্ব হতো ১,৮৬,০০০ মাইল। ব্যাপারটা অসম্ভব মনে হয় : গাড়িটা কি করে রাস্তার উপরে বিভিন্ন বিন্দু থেকে একই দূরত্বে থাকতে পারে?
আর একটি দৃষ্টান্ত বিচার করা যাক। একটা মাছি স্থির একটা জলাশয় স্পর্শ করলে ছোট ছোট ঢেউ সৃষ্টি করে। ঢেউগুলি ক্রমপ্রসারমান বৃত্তে বহির্মুখে যেতে থাকে। যে কোনো মুহূর্তেই বৃত্তের কেন্দ্র হবে সেই বিন্দুটি–যে বিন্দুতে মাছি জলাশয় স্পর্শ করেছিল। মাছিটা যদি জলাশয়ের উপর চলতে থাকে তাহলে সে আর ঢেউয়ের কেন্দ্রে থাকে না। কিন্তু ঢেউগুলি যদি আলোকতরঙ্গ হতো আর মাছিটা যদি কুশলী পদার্থবিদ্যাবিদ হতো তাহলে দেখতে পেত সে যতই চলাচল করুক না কেন তার অবস্থান তরঙ্গের কেন্দ্রে। এই সময় জলাশয়ের পাশে উপবিষ্ট একজন কুশলী পদার্থবিদ্যাবিদ ভাবতেন সাধারণ তরঙ্গের ক্ষেত্রের মতো কেন্দ্র এখানে মাছি নয় : জলাশয়ের যে বিন্দু মাছিটা স্পর্শ করেছিল সেটাই কেন্দ্র। আবার অন্য একটি মাছি যদি একই মুহূর্তে একই বিন্দুতে জল স্পর্শ করত তাহলে সেও দেখত প্রথম মাছিটা থেকে বহুদূরে সরে গেলেও সে তরঙ্গের কেন্দ্রেই অবস্থান করছে। মিচেলসন-মর্লি পরীক্ষার সঙ্গে ব্যাপারটার পুর্ণ সাদৃশ্য রয়েছে। জলাশয় ইথারের অনুরূপ, মাছিটি পৃথিবীর অনুরূপ, মাছি এবং জলাশয়ের সংযোগ, মিচেলসন এবং মর্লি মহাশয়েরা যে আলোকসঙ্কেত পাঠিয়েছিলেন তার অনুরূপ এবং ঢেউগুলি অনুরূপ আলোকতরঙ্গের।
প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয় এরকম ব্যাপার সম্পূর্ণ অসম্ভব। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে : মিচেলসন-মর্লি পরীক্ষা যদিও ১৮৮১ সালে হয়েছিল তবুও সে পরীক্ষার নির্ভুল ব্যাখ্যা ১৯০৫ সালের আগে হয়নি। দেখা যাক আমরা ঠিক কি বলছি। পথচারী আর মোটরগাড়ির দৃষ্টান্তটা বিচার করুন। অনুমান করা যাক রাস্তার একই বিন্দুতে কয়েকজন রয়েছে, কেউ হাঁটছে, কেউ চলেছে মোটরগাড়িতে। অনুমান করা যাক তাদের বেগের হারও বিভিন্ন, তাদের কেউ চলেছে একদিকে, কেউ চলেছে অন্যদিকে। আমি বলছি : এই মুহূর্তে যদি ওরা সবাই যেখানে আছে সেখান থেকে একটা আলোর ঝলক পাঠানো যায় তাহলে ভ্রাম্যমাণ প্রত্যেকের ঘড়ি অনুসারেই এক সেকেন্ড পরে আলোকতরঙ্গগুলি প্রত্যেকের কাছ থেকে ১,৮৬,০০০ মাইল দূরে থাকবে। অথচ ভ্রাম্যমাণ সবাই কিন্তু আর এক বিন্দুতে থাকবে না। আপনার ঘড়িতে এক সেকেন্ড হওয়ার পর আলোকতরঙ্গগুলি আপনার কাছ থেকে ১,৮৬,০০০ মাইল দূরবর্তী হবে আবার আলোকতরঙ্গ প্রেরণ করার সময় যাদের সঙ্গে আপনাদের দেখা হয়েছিল তাদের ঘড়িতে এক সেকেন্ড কাল অতিক্রান্ত হওয়ার পর ঐ তরঙ্গগুলি তাদের কাছ থেকেও ১,৮৬,০০০ মাইল দূরবর্তী হবে। এমনকি, তাদের গতি বিপরীতমুখী হলেও। অবশ্য দুটো ঘড়িই নির্ভুল এ অনুমান করলে। একরকম ব্যাপার কি করে হতে পারে?
এরকম তথ্য ব্যাখ্যা করার একটিই উপায় হল, ঘড়ির চলন গতি দ্বারা প্রভাবিত হয় : এই অনুমান করা। আমার কথার অর্থ এই নয় যে প্রভাবিত হয় এমনভাবে, যা ঘড়ির আরো নির্ভুল গঠনের সাহায্যে শোধরানো সম্ভব। আমার বক্তব্য আরো মূলগত। আমার বক্তব্য : আপনি যদি বলেন দুটি ঘটনার মধ্যে এক ঘণ্টা অতিক্রান্ত হয়েছে এবং আপনার এই সজোর বক্তব্যের ভিত্তি যদি হয় আদর্শ নির্ভুল ঘড়ির সাহায্যে আদর্শ সযত্ন মাপন, তাহলেও আপনি সাপেক্ষ দ্রুত চলমান একই রকম নির্ভুল অন্য এক ব্যক্তি বলতে পারেন ঐ কাল এক ঘণ্টার কম কিংবা বেশি ছিল। যেমন একটি ঘড়িতে যদি নিউ ইয়র্কের সময় দেখা যায় এবং আর একটি যদি গ্রিনউইচের সময় দেখায় তাহলে আপনি একটিকে ভুল এবং অন্যটিকে শুদ্ধ বলতে পারেন না, ঠিক তেমনি এক্ষেত্রেও পারেন না একজনকে ভুল এবং অপরকে শুদ্ধ বলতে। কি করে এটা হয় সে ব্যাখ্যা আমি পরের অধ্যায়ে করব।
আলোকের গতিবেগ সম্পর্কিত আরো অনেক অদ্ভুত ব্যাপার রয়েছে। একটি: যত বিশাল বল যত বেশিক্ষণ ধরে ক্রিয়া করুক না কেন, কোনো জড়পিণ্ড (mate rial body) কখনোই আলোকের মতো দ্রুত চলতে পারে না। একটা দৃষ্টান্ত হয়তো এ তথ্য স্পষ্ট করতে সাহায্য করবে। প্রদর্শনীতে অনেক সময় চক্রাকারে ঘুর্ণায়মান চলমান মঞ্চের শ্রেণী দেখা যায়। বাইরেরটা চলে ঘণ্টায় চার মাইল, তার পরেরটা ঘণ্টায় চার মাইল বেশি, পরপর এই রকম। একটা মঞ্চ থেকে আপনি পরের মঞ্চে যেতে পারেন শেষ পর্যন্ত দেখবেন আপনি বিরাট গতিতে চলেছেন। এখন, আপনি ভাবতে পারেন প্রথম মঞ্চটি যদি ঘণ্টায় চার মাইল চলে এবং দ্বিতীয়টি যদি প্রথমটির তুলনায় ঘণ্টায় চার মাইল বেশি চলে তাহলে নীচের জমি সাপেক্ষ দ্বিতীয় মঞ্চটি চলেছে ঘণ্টায় আট মাইল : এটা কিন্তু ভুল। দ্বিতীয়টি চলে একটু কম। যদিও এত কম যে, সর্বাপেক্ষা সযত্ন মাপনেও এ পার্থক্য ধরা পড়বে না। আমার বক্তব্য আমি বেশ স্পষ্ট করে বলতে চাই। অনুমান করা যাক। সকালবেলা যন্ত্রটি চলতে শুরু করার ঠিক আগে আপনি জমির উপরে একটা সাদা রেখা আঁকলেন এবং প্রথম দুটি মঞ্চের প্রতিটিতে এ দাগের মুখোমুখি (opposite) সাদা রেখা আঁকলেন। এরপর আপনি প্রথম মঞ্চের সাদা দাগের পাশে দাঁড়িয়ে মঞ্চের সঙ্গে চলতে লাগলেন। প্রথম মঞ্চ ভূমি সাপেক্ষ ঘণ্টায় চার মাইল চলে এবং দ্বিতীয় মঞ্চ প্রথম মঞ্চ সাপেক্ষ ঘণ্টায় চার মাইল চলে। ঘণ্টায় চার মাইলের অর্থ মিনিটে ৩৫২ ফুট। আপনার ঘড়ির এক মিনিট বাদে আপনি আপনার পিছনের জমিতে সাদা দাগের মুখোমুখি (opposite) মঞ্চের উপর অবস্থান চিহ্নিত করুন এবং চিহ্নিত করুন আপনার সামনে দ্বিতীয় মঞ্চের সাদা দাগের মুখোমুখি জমির উপরের এবং আপনার মঞ্চের উপরের অবস্থান। তারপর আপনি আপনার মঞ্চের উপর দুদিকে দুটি অবস্থান পর্যন্ত দূরত্ব মাপুন। আপনি দেখবেন প্রতিটি দূরত্বই ৩৫২ ফুট। এইবার আপনি প্রথম মঞ্চ থেকে মাটিতে নেমে আসুন, অন্তিমে জমির উপরে যে সাদা চিহ্ন দিয়ে আপনি শুরু করেছিলেন সেখান থেকে আরম্ভ করে এক মিনিট ভ্রমণের পর দ্বিতীয় মঞ্চের সাদা দাগের মুখোমুখি যে অবস্থান চিহ্নিত করেছিলেন সেই অবধি মাপুন। সমস্যা : তাদের দূরত্ব কত? আপনি বলবেন ৩৫২ ফুটের দ্বিগুণ অর্থাৎ ৭০৪ ফুট। আসলে মাপটা কিন্তু একটু কম হবে। কমের পরিমাণ এত ক্ষুদ্র যে বোঝাই যায় না। গরমিলের কারণ : অপেক্ষবাদ অনুসারে চিরায়ত (traditional) নিয়মে একাধিক বেগ যোগ করা যায় না। আপনার যদি এইরকম চলমান মঞ্চের দীর্ঘমালা (Series) থাকত, প্রতিটি মঞ্চই যদি আগের মঞ্চটির চাইতে ঘণ্টায় চার মাইল বেশি বেগে চলত তবুও এমন কোনো বিন্দুতে আপনি পৌঁছাতে পারতেন না যে বিন্দু ভূমি সাপেক্ষ আলোকের বেগে চলমান। আপনার যদি বহু মিলিয়ন মঞ্চ থাকত তাহলেও না। ক্ষুদ্র গতিবেগের ক্ষেত্রে যে গরমিল অতি ক্ষুদ্র, গতিবেগ বৃদ্ধির সঙ্গে সে গরমিল বৃহত্তর হয়। ফলে আলোর গতিবেগ একটি অপ্রাপ্য সীমা হয়ে দাঁড়ায়। এটা কি করে হয় পরের আলোচ্য বিষয় সেটাই। এখন আমাদের সেই আলোচনাই করতে হবে।