আর্হত দর্শন / আর্হতদর্শন / আর্হত-দর্শন
আর্হতেরা দিগম্বর। তাহার বৌদ্ধদিগের ক্ষণিকতামত* খণ্ডন করিয়াছে। দিগম্বর আর্হতগণ কহে, যদি প্রতিশরীরে এক এক আত্মা নিরন্তর অবস্থান না করে, তাহা হইলে ঐহিক ফল সাধনের নিমিত্ত কৃষি বাণিজ্যাদি কর্ম্মে কোন মতেই লোকের প্রবৃত্তি হইতে পারে না। কারণ আপনার ফলভোগের নিমিত্তই সকল উপায়ানুষ্ঠান করে; যদি উপায়ানুষ্ঠান কর্ত্তা যে আত্মা সে ফলভোগকালে উপস্থিত না থাকে, তবে একের ফলভোগের নিমিত্ত অপরের প্রবৃত্তি কি প্রকার সম্ভব হইতে পারে। আমি কৃষি বাণিজ্যাদি করিয়াছিলাম, আমিই তাহার ফল ভোগ করিতেছি, সকল লোকেরই এই অনুভব হইয়া থাকে, সুতরাং আত্মাকে চিরস্থায়ী বলিয়া অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবেক। আর্হত মতে জীবের পরিমাণ দেহসদৃশ, অর্হৎই পরমেশ্বর, তিনি সর্ব্বজ্ঞ ও রাগদ্বেষাদিশূন্য। এই মতে সম্যগদর্শন, সম্যগজ্ঞান ও সম্যকচারিত্র এই তিনকে রত্নত্রয় কহে। জিনোক্ত তত্ত্ব বিষয়ে বিপরীত জ্ঞান ও সংশয়াদির নিবারণাদিরূপ সম্যক শ্রদ্ধাকে সম্যগদর্শন কহে; এবং সংক্ষেপে অথবা বিস্তারিতরূপে জিনোক্ত তত্ত্বের যে জ্ঞান, তাহাকে সম্যগজ্ঞান কহে। নিন্দিত কর্ম্ম ত্যাগকে সম্যকচারিত্র বলে। ঐ চারিত্র পাঁচ প্রকার; অহিংসা, অস্তেয়, সূনৃত, ব্রহ্মচর্য্য ও অপরিগ্রহ। কি স্থাবর কি জঙ্গম কোন প্রকার জীবের বিনাশ না করাই অহিংসা, দত্তাতিরিক্ত বস্তুর অগ্রহণ অস্তেয়, সত্য ও হিতকর অথচ প্রিয় ঈদৃশ বাক্যের কথন সূনৃত, কাম ক্রোধাদি পরিত্যাগ ব্রহ্মচর্য্য এবং সকল বিষয়ে মোহত্যাগ অপরিগ্রহ। এই পাঁচটি মহাব্রত, ইহার সাধনাতে পরম পদ প্রাপ্তি হয়।
আর্হতদিগের মধ্যে মতের অনেক প্রভেদ দৃষ্ট হইয়া থাকে। কোন মতে কহে, তত্ত্ব দুইটি জীব ও অজীব। জীব বোধাত্মক, অজীব অবোধাত্মক। কোন মতে পঞ্চ তত্ত্ব, কোন মতে সপ্ত তত্ত্ব এবং কোন মতে নব তত্ত্বো কহিয়া থাকে। আর্হতদিগের মধ্যে আর এক সম্প্রদায় আছে। ঐ সম্প্রদায়কে জৈন কহে। জৈনেরা জিনোক্ততত্বের অনুবর্ত্তী হইয়া চলে। জৈনদিগের মধ্যে যাঁহারা সাধু, তাঁহাদিগের লক্ষণ এই, তাঁহারা ভিক্ষালব্ধ অন্নমাত্র ভক্ষণ করেন, শুক্ল বস্ত্র পরিধান করেন ও লুঞ্চিত কেশ ধারণ করেন, এবং তাঁহারা অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও নিঃসঙ্গ। জিনর্ষিরা বস্ত্র গ্রহণ করেন না, লুঞ্চিত কেশ রাখেন, হস্তে পিচ্ছিকা ধারণ করিয়া থাকেন, এবং চলিবার সময় জীবহত্যার ভয়ে পিচ্ছিকা দ্বারা অগ্রে পথ হইতে জীব সকল অপরাসিত করিয়া পশ্চাৎ পাদ প্রক্ষেপ করেন, জলপাত্র ব্যবহার করেন না, হস্ত দ্বারাই জল পান করিয়া থাকেন, একাকী আহার করেন না, এবং স্ত্রীসম্ভোগে একান্ত বিরত।
——————
* বৌদ্ধমতে সকল বস্তুই ক্ষণিক অর্থাৎ প্রথম ক্ষণে উৎপন্ন ও দ্বিতীয় ক্ষণে বিনষ্ট হয় এবং আত্মাও ক্ষণিক ও জ্ঞানস্বরূপ, ক্ষণিক জ্ঞানাতিরিক্ত স্থিরতর আত্মা নাই।