আমি এক সময় মার্ক্সবাদ করেছি
আমি এক সময় মার্ক্সবাদ করেছি, সাম্যবাদী ইশতেহার পড়েছি, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ছাড়া আর কিছু বুঝি নি, সব কিছু ব্যাখ্যা করেছি মার্ক্স-এঙ্গেলসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী ভাষায়, হেগেলকেও টেনে এনেছি; বলেছি, কম্যুনিষ্ট ইশতেহার হচ্ছে শ্ৰেষ্ঠ বই, শ্ৰেষ্ঠ ঘোষণা, নেতাদের সঙ্গে শ্লোগান দিয়েছি পথে পথে, কিছু পাই নি; আমাদের নেতারা রাশিয়ার ভোদকা আর চীনের বিড়ি পেতো, আমি তাও পাই নি; আলহজ এরশাদের সময় আমার নেতারা যখন তার পা চাটতে শুরু করে, মন্ত্রী প্ৰধান মন্ত্রী হতে শুরু করে, আমার ঘেন্না লাগে; তখন আমি সর্বহারা দলে যোগ দিই, এখানে সেখানে দু-একটি খুন করি, ডাকাতি করি—করতে ভালোই লাগে, দু-একটি মেয়েকে ধর্ষণ করি, আমি ঠিক ধর্ষণের মতো করি নি, তাদের আমি রাজি করাই, প্রথমে ছেড়েই দিই, তারপর থেকে তাদের সঙ্গে আমার কয়েকবার দৈহিক সম্পর্ক হয়, আমি ঠিক মতো পেরে উঠি নি, তারা সবাই বলে, ‘তুমি পারো না’, তখন আমি পারতাম না, এখন পারি, আমি ধীরেসুস্থে পারতে শিখেছি, তারপর আমি যোগ দিই ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম পার্টিতে। আমি মুক্তির পথ খুঁজে পাই, জীবন পাই।
জামাঈ জিহাদে ইছলাম আমাকে উদ্দীপ্ত করে, আমি প্ৰচণ্ড উত্তেজনা বোধ করি, ওই উত্তেজনা দেহের বিশেষাঙ্গের উত্তেজনার থেকে অনেক বেশি তীব্ৰ, অনেক বেশি প্রচণ্ড, আমি দেখতে পাই আমি বেঁচে উঠছি, আমি বেহেশতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠি। মওলানা মওদুদি, ইমাম গাজালি, আয়াতুল্লা খোমেনির বই, আর কোরান-হাদিছ, নেয়ামুল কোরআন, মুকছোদুল মামেনিন, বেহেস্তের জেওর পড়ে আমি বুঝতে পারি। এতোকাল আমি ভুল পথে ছিলাম, দোজগের রাস্তায় ছিলাম, এখন আমি ঠিক পথে এসেছি; এখানে সব সময়ই খোয়াব, সব সময়ই উত্তেজনা; পৃথিবীতে মুছলমান আর ইছলাম ছাড়া আর কিছু থাকবে না, এ-বিশ্বাস আমাকে মাতাল ক’রে তোলে–নাউজুবিল্লা, ‘মাতাল’ শব্দটি ঠিক হয় নি, আল্লা আমাকে মাফ করবেন; এ-সময়ই আমি একটি চমৎকার জীবন পাই। যখন মার্ক্সবাদী ছিলাম, যখন সৰ্বাহারা ছিলাম, তখন আমার কোনো জীবন ছিলো না; জামাঈ জিহাদে ইছলামে যোগ দেয়ার পর আমি প্ৰায় সবই পাই, বেহেশত তো পাবোই। যোগ দেয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই আমি জামাঈ জিহাদে ইছলাম-এর ‘মদিনাতুন্নবি’ অঞ্চলের নেতা হয়ে উঠি, আমার খুব চেষ্টা করতে হয় না; আমার প্ৰধান নেতারা বুঝতে পারেন যে-তিরিশটি মাদ্ৰাছার তালেব এলেম নিয়ে এআঞ্চলিক সংঘটি গঠিত, ওই সব হাফেজিয়া ফোরাকানিয়া কওমি কামিল দাখিল সাধারণ মাদ্ৰাছার তালেবানদের মাথায় ঘিলু নেই, যেমন তাদের মাথাও নেই, তাদের মগজ অন্য জায়গায়; তাই যোগ দেয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই আমি নেতা হয়ে উঠি, যা আমি কখনো হই নি।
নেতা হওয়ার মতো সুখ ও স্বাদ ও কাম আর নেই।
শুধু ক্ষমতা নয়, ক্ষমতার মধ্যে যা শ্রেষ্ঠ— টাকা, তা আমার হাতে অঢেল আসতে থাকে–টাকা যে পানির স্রোতের মতো নানা খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়, তা আগে আমি জানতাম না, এখানে এসে দেখি নানা খাল দিয়ে ঢেউ তুলে টাকা আসছে আমার দিকে। ক্ষমতা ও টাকা মানুষকে মহাপুরুষে পরিণত করে, অমরতা দেয়। মার্ক্সবাদে আমার পকেটে একটা আধুলিও আসতো না, সর্বহারা ডাকাতির সময় আসতো দু-তিন হাজার টাকা, কিন্তু তখন সব সময় বিপদের ভয়ে থাকতে হতো, এখন কোনো ভয় নেই; এখানে নেতা হওয়ার পর আমার হাতে আসতে থাকে লাখ লাখ টাকা। টাকা যে কতো সুন্দর, রূপসী, শাশ্বতী, তা আমি বুঝতে পারি নেতা হওয়ার পর থেকে; অস্ত্ৰ কেনার পর, ইছলামের সিপাহিদের টাকা দেয়ার পর, আমার বাক্সে পড়ে থাকতে শুরু করে লাখ টাকা। আল্লা আর পাক স্তান ছাড়া এতো টাকা আমাকে কে দিতে পারতো?
টাকা পেয়ে আমি একবার নফল নামাজ পড়ি, প্রতিদিনই পড়তে হয়; পড়ে আমি সুখ পাই। দিলে শান্তি পাই। আর আসতে থাকে ব্ল্যাক লেভেল, সিভাস রিগাল, ব্যালেন্টাইন–এগুলোর নামও আগে আমি শুনি নি; সাম্যবাদের কালে মেথরূপট্টিতে যেতাম ব্যাটারি ভেজানো ধেনো খেতে, ওগুলো খাওয়ারও পয়সা ছিলো না; না থেকে ভালোই হয়েছে, বেশি খেলে এতোদিন থাকতাম না, লিভার সিরোসিসে চলে যেতাম। এখন ব্ল্যাক লেবেল, সিভাস রিগাল, ব্যালেন্টাইন ছাড়া অন্য সব আমার কাছে ভিখিরির লাল মূত্ৰ মনে হয়।
আমরা দুটি অসামান্য কর্মকাণ্ড গ্ৰহণ করেছি, যা দেশকে বদলে দেবে।
আজকে আমাদের আন্দোলন ‘ভৈরব’ উপজেলার নাম বদলের; আগামীকাল আন্দোলন ‘শ্যামসিদ্ধি’ গ্রামের নাম বদলের; আমরা দুনিয়াকে খোলনলচেসহ বদলে দেবো। ভৈরব আর শ্যামসিদ্ধি দুটি নামই আমার ছেলেবেলা থেকে প্রিয়, কিন্তু তাতে কি, ভৈরব আর শ্যামসিদ্ধি দুটিই পৌত্তলিক নাম, মালাউন নাম, এই নাম আমি আর মানতে পারি না, এটা শিরক; আর শ্যামসিদ্ধির ওই মঠটি, যেটিকে দূর থেকে একবার না দেখলে ছেলেবেলায় আমার ঘুম হতো না, ওটিকে আমার মনে হয় ইছলামের ওপর পাক স্তানের ওপর আমার দিলের ওপর একটা শরকির আঘাতের মতো, লাৎ মানৎ উজ্জা যেনো এখন কাবাঘর ছেড়ে এসে বাস করছে মঠটিতে–মঠটি ভেঙে একটি মসজিদ তৈরি করতে হবে; ওখানে আমি একটি আল আকসা বা বায়তুল মোকাররাম দেখতে চাই।
ওই মঠটির দিকে তাকালি আমার এক সময়ের প্রিয় পরম শ্রেদ্ধেয় মহান অদ্বিতীয় সানগ্লাস জেনারেল নেতাকে মনে পড়েন। তিনি আমার হৃদয়ে সব সময় আছেন, সব সময় থাকবেন। আমি তাঁর দলে যোগ দিই নি, দিতে পারি নি, দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমার সাম্যবাদী নেতাদের পায়ের চাপে বারবার পিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম; তিনি পল্টন ময়দানে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, জ্বালাময়ী বক্তৃতায় আমরা কঁপিছিলাম, তিনি হঠাৎ বক্তৃতা বন্ধ করে ডান হাতের তর্জন আমাদের বায়তুল মোকাররামের দিকে স্থির করে রাখেন।
তিনি স্তব্ধ হয়ে থাকেন কয়েক মিনিট, আমরাও স্তব্ধ হয়ে যাই, তাঁর আঙুলের দিকে তাকিয়ে থাকি, নিশ্চয়ই ওই আঙুলি কোনো গভীর বাণী প্ৰকাশ করছে।
তিনি স্তব্ধ হয়ে থাকেন কয়েক মিনিট, আমাদের মনে হয় তিনি হাজার হাজার বছর ধরে স্তব্ধ হয়ে আছেন, তার বদলে কথা বলছে তার জ্যোতির্ময় তর্জানি। আমি তাঁর তর্জনির ভাষায় কাঁপতে থাকি। সব কিছুরই ভাষা আছে; কিন্তু তর্জন যে এতো অর্থ প্ৰকাশ করতে পারে, যে-অর্থ আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হচ্ছিলো না, ওই বিরাট নীরব নিঃশব্দ অর্থের মুখোমুখি আমরা নিজেদের অসহায় বোধ করছিলাম—মহাঅর্থের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।
এক সময় তিনি বলে ওঠেন, ‘চ্ছি-ল-না।’
আমরা বিস্মিত শিহরিত উত্তেজিত হয়ে ভাবতে থাকি কী ছিলো না?
আমরা কী ক’রে জানবো?
তিনি বলেন, ‘চ্ছি-ল-না, আল্লাহু আকবর ছিল না; বায়তুল মোকাররামের উপরে আপনারা যে ‘আল্লাহ আকবর’ দেখতেছেন, তা ছি-ল-না; আল্লাহু আকবর ওয়াজ নট দেয়ার।‘
আমাদের বুক থেকে একটি পাহাড় নেমে যায়, আমরা নিশ্বাস নিই।
আমরা বোধ করি তিনি কতো মহান, কতো অসাধারণ, তিনি কতো বড়ো দ্রষ্টা; আমাদের সবচেয়ে বড়ো জিনিশই ছিলো না আমাদের সবচেয়ে বড়ো জিনিশের ওপর, আমরা বুঝতে পারি নি, বুঝেছিলেন আমাদের মহান নেতা, সানগ্লাসের ভেতর দিয়েও তিনি তা দেখেছিলেন। তাঁর সানগ্নাস ছিলো দূরদৃষ্টির সানগ্লাস, পৃথিবীতে ওই সানগ্লাস একটিই ছিলো।
সত্যিই তো, এতো দিন আমরা খেয়াল করি নি, বায়তুল মোকাররামের ওপর আল্লাহ আকবর ছিলো না; মহান নেতার তা চোখে পড়েছে, তিনি সেখানে আল্লাহ আকবর বসিয়েছেন, যা রাতে জ্বলজ্বল ক’রে জ্বলে রাহমানির রাহিমের গৌরব ঘোষণা করছে; মহান নেতা ইছলাম প্রতিষ্ঠিত করেছেন; তার থেকে বেশি। প্রতিষ্ঠিত করেছেন আমাদের। মহান আল্লাতালা এখন নিশ্চয়ই তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসে রেখেছেন। তিনি হয়তো সেখানেও সানগ্লাস পরে তাকিয়ে আছেন। তার প্রতিষ্ঠিত আল্লাহু আকবরের দিকে, আর আমাদের দিকে, আমরা যারা পাক স্তান প্রতিষ্ঠা করবো, পাক সার জমিন গাইবো।
ওই ঘটনা আমার মনে দাগ কেটে আছে; আমি শ্যামসিদ্ধির মঠটি ভেঙে ফেলবো, বা সেটিকে মসজিদ বানিয়ে বড়ো বড়ো অক্ষরে লিখবো ‘আল্লাহ আকবর’, যা মহান রাহমানির রাহিমও দেখতে পাবেন। তিনি অবশ্য সবই দেখেন, একটি পোকাও তাঁর চোখের বাইরে নয়।
তবে মালাউনদের দু-একদিন সময় দিতে পারি, একটু দয়া করতে পারি।
যদিও আন্দোলন আমাদের আজই করতে হবে, আন্দোলন কাজ করতে আমরা পারি না, দয়া ক’রে ওদের একটু সুযোগ দিতে পারি। কী সুযোগ দেবো? গতকাল রাতে আমার জিহাদিদের সঙ্গে আমি আলাপ করেছি, তখন ভিডিওতে এক্সএক্সএক্স চলছিলো, ডেঞ্জারাস জিনিশ, লাস্ট ফর ডগ্জ্, তারপর ইন্ডিয়ান জিফনিশ–এখন আমরা আর ফ্যাটফ্যাটে শাদা বেহায়া বেলেহাজ মেয়েগুলোর চোষাচুষি, পাছা মারামারি, ডাবল ট্রিপল স্ক্রু মারা দেখে এক্সাইটেড হই না, অনেক দেখেছি, সবই একই রকম, রাবিশ, পানসে, আমাদের পছন্দ মালাউন গুড্স্, সাউথ ইন্ডিয়ান আর মুম্বাইর–ইন্ডিয়ান এক্সএক্সএক্স দেখে আমরা সঙ্গে সঙ্গে খাড়া হই, শাদা মাইয়াগুলো দেখলে হই না, ওইগুলোর দেহে কোনো স্বাদ নেই, ওগুলো ব্লাডার ও পাম্পারের অটোমেটিক মেশিন; ওগুলো দেখতে দেখতে আমাদের মনে পড়ছিলে দুৰ্গা, বকুলমালা, কণকলতা, সরস্বতী, রমা, সীতা, উৰ্মিলা, মাধুরী, শুভঙ্করী, কৃষ্ণকলি, আর কী কী যেনো ওদের নাম, সেই ডবকা মেয়েগুলোকে, যদি ওদের এবং আরো কয়েকটিকে পাই, একা আমি পেলে তো হবে না, তালেবান মোঃ হাফিজুদ্দিন, জিহাদি মোঃ কেরামত আলি, জিহাদি মোঃ মোস্তফা, জিহাদি মোঃ আকবর আলিকেও ভাগ দিতে হবে, তাহলে মালাউনদের কয়েকটি দিন দিতে পারি, কয়েকটি দিন।
জিহাদিদের একটি মহান গুণ হচ্ছে তারা মালাউন মেয়ে পছন্দ করে।
আমিও করি, ওদের একটু খেলাতে পারলে ওরা উর্বশীদের মতো নাচে; আমার জিহাদিরা অবশ্য নাচটাচ পছন্দ করে না, ওরা ঢুকতে বেরোতে পারলেই শুকরিয়া আদায় করে। এতে প্ৰধান প্রতিভা তালেবান মোঃ হাফিজুদ্দিন, ও হয়তো ফেরেশতাদের কাছে থেকে বিশেষ কোনো হালুয়া লাভ করে; তবে মোঃ কেরামত আলি, মোঃ মোস্তফা, মোঃ আকবর আলিও কম যায় না, এটা আমি পছন্দই করি, জিহাদে কোনো কম যাওয়া-যাওয়ি নেই, তাতে জোশ কমে যায়। ওরা যখন একেকটি মালাউন মেয়ের ওপর চড়ে, তখন ওরা মনে করে ওরা একেকটি নাছারা নগর ধ্বংস করছে, যার নির্দেশ রয়েছে। আমি আশ্চর্য হই, ওরা রুহুল্লা খোমেনির কিছুই পড়ে নি, কিন্তু চিন্তা ও কর্মে তাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
মালাউন মেয়েগুলোর গন্ধ আমার ভালো লাগে, ব্ৰাহ্মণ হোক আর চাঁড়াল হোক আর কৈবর্ত, যাই হোক, ওগুলোর গন্ধ ভালো, একটা তীব্ৰ প্ৰচণ্ড দমবন্ধ করা মহাপার্থিব গন্ধ ছুটে আসে। ওদের স্তন থেকে, বগলের পশম থেকে, উরু থেকে, ওদের কুঁচকির ঘামেও অদ্ভুত সুগন্ধ; হয়তো গাদা তুলসি রক্তজবা পদ্ম, বকুল শেফালি গন্ধরাজ ফুলের সঙ্গে ওদের একটা সম্পর্ক আছে বলে, আর ওরা ক্ৰীড়া করেও ভালো, মনে হয় ওদের প্রত্যেকেরই কামসূত্র মুখস্থ; এমনকি কৈবর্ত মেয়েগুলোর গন্ধও আমাকে পাগল করে, আমি কৈ আর গজার মাছের গন্ধ পাই, মনে হয় পুকুরে ডুব দিয়ে কাদার ভেতর থেকে মাছ ধরছি।
ওই সময়টায় সবাই আমাদের অসামান্য কর্মকাণ্ড সবাই দেখেছে, কিন্তু কেউ একটু টু শব্দ করার সাহস পায় নি; তখন অবশ্য আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি।
আমাকে ছুটে চলতে হয়েছে আমার মদিনাদুন্নবি থেকে, রিয়াদ, কান্দাহার, বাগদাদ, তিকরিত, বসরা প্রভৃতি অঞ্চলে–এই অঞ্চলগুলো আমাদের সাংকেতিক নাম, সব মহান কাজেই প্ৰথম সাংকেতিক নাম লাগে, সিম্বল লাগে। তখন একটা অসামান্য মজার সময় এসেছিলো, তখনই আমরা আমাদের শক্তিটাকে পাথরের মতো করে তুলি, যে পাথর আমাদের দিল ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে না। নির্বাচনটিাৰ্বাচনে, ইলেকশনটিলেকশনে, আমরা বিশ্বাস করি না, ওটা আমাদের পাক ধর্মে নেই, তবু আমরা অংশ নিয়েছি মেইন পার্টির সঙ্গে; মেইন পার্টির কর্মী আর আমাদের ওপর দুটি নির্দেশ ছিলো, ভোটের দিন মালাউনদের বাড়ি থেকে বের হতে দেয়া হবে না; আর জানতামই যে আমরা জিতবো–আমাদের নেতারা ওপরের দিকে সব কাজ চমৎকারভাবে ক’রে রেখেছিলেন, তত্ত্বাবধায়কদের তারা তত্ত্বাবধান করছিলেন; আমরা জানতাম জিতবোই; জেতার পর আমাদের কাজ ছিলো একদিন চুপ করে থাকা, তার পরের দিন থেকে মালাউন আর তাদের দালালদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া। ঝাঁপিয়ে পড়া শব্দটি ঠিক হলো না, আমাদের কাজ ছিলো শান্তির ঠাণ্ডা আগুন জ্বালানো, যা জ্বলে না, দহন করে।
আমার ভাগে পড়েছিলো মালাউনরা; আমিই বেছে নিয়েছিলাম।
আমি আমার জিহাদিদের আর মেইন পাটির জোয়ান খিলজিদের নিয়ে প্রথম ১৮টি মালাউনপল্লী চিহ্নিত করি–সীতারামপুর, হরিরামপুর, মদনগঞ্জ, মদনপুর, ব্ৰাহ্মণভিটা, কালীগঞ্জ, আর কী কী যেনো নাম–ওই নামগুলোকেও বদলে দিতে হবে; এবং বেশ আগে থেকেই কাজ শুরু করি। আমরা ভালো ক’রেই জানি ওরা কাফের, ওরা কাফেরদের বাক্সে ভোট দেবে; ওদের ভোট দেয়া চিরকালের জন্যে বন্ধ করে দিতে হবে। ওরা ভোট দেবে কেনো; ওরা দেবে জিজিয়া কর, ওরা আমাদের জিম্মি, আমরা ওদের রক্ষা করবো, তার জন্যে। ওরা কর দেবে।
আমি এ-ব্যাপারে সম্রাট আওরঙ্গজেবকে আদর্শ মনে করি।
আমরা তাদের পাড়ায় পাড়ায় যাই, আমাদের দেখেই তারা কেঁপে ওঠে। সালাম দিয়ে আমরা তাদের বাড়ি উঠি, তারা নমস্কার’, ‘আদাব’ বলে ব’লে মুখে ফেনা তুলে ফেলে, সবচেয়ে উৎকৃষ্টভাবে বলে, ‘আচ্ছালামুয়ালাইকুম’।
আমিও এখনো তাদের মতো শব্দটি বলতে পারি না। আমাদের কোথায় বসাবে তা ঠিক করতে পারে না, চেয়ার টুল বেঞ্চ নিয়ে টানাটানি করতে থাকে, যদিও বসার দরকার আমাদের ছিলো না। একদিন আমরা বসবো, চড়বো, চেয়ার বেঞ্চের ওপর নয়, আরো কোমল সুখকর জিনিশের ওপর।
আমি বলি, ‘মহাশয়েরা, আপনারা কেমন আছেন, তা দেখতে এলাম; ভালো আছে সবাই?’
একেকজন ভয়ে ভয়ে বলে, ‘সেইটা আমাগো ভাইগ্য, আপনেরা আমাগো বাড়িতে আসবেন, কোনদিন চিন্তাও করতে পারি নাই, আপনাগো পায়ের ধুলায় আমগো বাড়ি পবিত্র হইল।‘
আমাদের অনেকের জামার ভেতর থেকে নানা রকমের শান্তিপ্রদ জিনিস উঁকি দিচ্ছিলো–দু-একটা পিস্তল, দু-একটা কাটা রাইফেল, দু-চারটি ক্ষুর, কয়েকটি এম-১৬, আর বেশি না।
আমি বলি, ‘আপনাদের ভোটার তালিকা দিতে এলাম, যাতে ভোট দিতে আপনাদের কষ্ট না হয়।’
একেকজন বলে, ‘আপনেরা কষ্ট কইর্যা আসছেন, কি দিয়া যে আপনাগো আপ্যায়ন করি। একটু চা দেই।’
দু-চারটি মালাউন বউ মেয়ে দেখার ইচ্ছে আমাদের সবারই ছিলো। আগে থেকে দেখে রাখলে পরে কাজ দেবে।
আমি বলি, ‘তালিকায় ২৫ নম্বরে আছেন শ্ৰীমতি পদ্মাবতী দেবী, তার সঙ্গে কি একটু কথা বলতে পারি?’
পদ্মাবতী দেবী আমাদের সামনে আসেন, আমরা দেখি বেশ ভালো!
আমি বলি, ‘আপনার পিতার নাম কৃষ্ণচন্দ্ৰ দাস?’
পদ্মাবতী দেবী। খুবই লজ্জা পান, তার লজ্জা পাওয়াটা দেখার মতো, কিন্তু তখনও ভালো করে দেখার সময় আসে নি।
তিনি সলজ্জভাবে বলেন, ‘অইটা ভুল অইছে, অইটা আমার স্বামীর নাম।’
আমি জানি পিতার জায়গায় স্বামী, আর স্বামীর জায়গায় পিতার নাম বসানো আমাদের নির্বাচন কমিশনের একটি বড়ো কৃতিত্ব। তারা আজো পিতা আর স্বামীর পার্থক্য বোঝে না; তবে দল বোঝে, দালালি বোঝে, ক্ষমতা বোঝে, আর কারা ক্ষমতায় আসবে, তাও বোঝে।
আমি বলি, ‘এই জন্যে আমরা ক্ষমা চাই, মাফ ক’রে দেবেন। আপনারা ভোট দেবেন কোন দলকে?’
পদ্মাবতী দেবী চালাক মাল, বলেন, ‘আপনাগো দলরেই দিমু।’
আমি বলি, ‘তাহলে তো আপনার ভোট পেয়েই গেলাম, কষ্ট করে আর আপনার ভোট দিতে যাওয়ার দরকার নেই।’
পদ্মাবতী দেবী বলেন, ‘হুজুর, অনেক কষ্ট থিকা বাচাই দিলেন, লাইনে দাড়াইতে দাড়াইতে মাজা বেদনা অইয়া যায়; তার উপর আমার এইখন আট মাস চলতেছে, হাডতেই পারি না।’
আমার এক জিহাদি হতাশ হয়, পদ্মাবতীকে তার পছন্দ হয়েছিলো, কিন্তু মাগিটা আট মাস বাঁধিয়ে বসেছে, আট মাসের পেটের ওপর চড়তে পারবে কি না বুঝতে পারে না; আরেক জিহাদি খুশি হয়, আট মাসের পেটের ওপর চড়তে কেমন লাগে, তা সে দেখতে চায়। দেখার সময় আসতে আসতে পদ্মাবতীর সাড়ে আট মাস হয়ে যাবে। এটা এক সুন্দর জিনিশ: কেউ খালি পেট পছন্দ করে, কেউ ভরা পেট পছন্দ করে; আল্লার দুনিয়ায় বৈচিত্র্যের শেষ নেই।
মালাউনদের পাড়ায় আগে আমি বেশি যাই নি। ইস্কুলে পড়ার সময় স্যারের বাড়িতে যেতাম প্ৰাইভেট পড়তে, স্যারকে দেখার আগে তার মেয়ে ছবিকে দেখতাম, স্যারের আগে ছবিই আসতো ছবির মতো হয়ে, একটা সুগন্ধ পেতাম, গাঁদা আর বলকুলের মেশানো গন্ধ, যা কোনো মুছলমান মেয়েকে দেখলে পেতাম না; নানাবাড়ি যাওয়ার সময় দেখতাম পুকুরপাড়ে স্নান করার আগে গোয়ালবাড়ির শাদা শাদা মেয়ে ও মেয়েলোকগুলো শাড়ি হাঁটু পর্যন্ত তুলে চড়াচড় ক’রে প্রস্রাব করছে; আমি অদ্ভুত একটা গন্ধ পেতাম। কিন্তু মালাউনদের বাড়িতে বেশি যাই নি, এবারই আমার সৌভাগ্য হলো মালাউনগুলোকে নিবিড় পর্যবেক্ষণের।
আমরা পাড়ায় পাড়ায় যাই, যেতে আমাদের ভালো লাগে।
আসার আগে বলি, ‘দেখেন ভোটের দিন গোলমাল হতে পারে, খুনটুনও হয়ে যেতে পারে; আপনারা ভোট দিতে যাবেন কি যাবেন না, ওই দিন বাড়ি থেকেই বের হবেন কি হবেন না, তা একটু ভেবে দেখবেন; জানেনই তো এবার আমরা পাশ করবো, আপনাগো দালালরা পারবে না।’
তারা বলে, ‘সেই কতা আমরা জানি, তাগো আর ভোট দিমু না, ভোত দিতেই যামু না, ভোট দিলে আপনাগোই দিমু, আমরা তাগো ভোট দিমু। ক্যান, আমরা কি তাগো বান্দা গোলাম?’
তবে মালাউনদের বিশ্বাস করা যায় না, ওরা চিরকাল বেঈমান; আমরা শুধু ওদের কথার ওপর চলতে পারি না।
ভালো ক’রেই বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি, তারাও বুঝতে পেরেছে।
শুধু এভাবে বোঝালে ও বুঝলেই চলবে না; বোঝানোর জন্যে দু-একটি উদাহরণও ওদের চোখের সামনে থাকা ভালো; মানুষ কখনো কথায় বোঝে না, উদাহরণে সহজে বোঝে, এমনভাবে বোঝে যে আর ভোলে না। আমরা আগেই ঠিক ক’রে রেখেছি গোপালচন্দ্রের বাড়িটা, হারামজাদাটা পয়সা করেছে, সালাম দেয় না দেয়ার মতো, মালপানিও দেয় না, আবার দালালদের পার্টি করে।
ওর বাড়িটা ঠিক ক’রে রেখেছি, বেশি কিছু নয়, সন্ধ্যার পর আমাদের কয়েক জিহাদি ও মেইন পার্টির কয়েক খিলজি যাবে, এদিকে ওদিকে কয়েক গ্যালন পেট্রোল ছড়াবে, আর কয়েকটি ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে ছুঁড়ে দিয়ে আসবে। তাতে কাজ হবে, কাজ হয়ও; ওই সন্ধ্যায় গোপালচন্দ্রের বাড়িটা একটু দাউদাউ ক’রে ওঠে, তখন আমরা কয়েকজন অসি সাহেবের সঙ্গে একটু ব্ল্যাক লেবেল একটু সিভাস রিগ্যাল টেস্ট করছিলাম।