০৩. আমি আছি বাদলদের বাড়িতে

আমি আছি বাদলদের বাড়িতে।

এ বাড়িতে বাস করা দূরের কথা, বাদলের ৫০ হাজার গজের মধ্যে থাকাই আমার জন্যে নিষেধ ছিল। কোনো এক কারণে পরিস্থিতি ভিন্ন। খালু সাহেব আমাকে দেখে হাসিমুখে বলেছেন, আরো তুমি! কেমন আছ?

জি ভালো।

অনেকদিন পরে তোমাকে দেখলাম। এসেছ যখন কয়েকদিন থাক।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, জি আচ্ছা।

খালু সাহেব আনন্দিত গলায় স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, এই শুনছ, হিমু। কিছুদিন থাকবে আমাদের সঙ্গে। গেষ্টরুমটা খুলে দাও। বাথরুমে সাবান, টাওয়েল আছে কি-না দেখা।

খালাও গালভর্তি করে হাসলেন।

যাকে বলে। লালগালিচা অভ্যর্থনা। আমি বাদলকে আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কী রে! আমাকে নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে।

বাদল গলার স্বর কাঁপা কাঁপা অবস্থায় নিয়ে বলল, তুমি তো টানাটানি করার মতোই মানুষ। সাধারণ কেউ তো না।

তোর কাছে টানাটানির মানুষ। খালু সাহেব বাঁ খালার কাছে না। তাদের কাছে Father driven, Mother broomed.

এর মানে কী?

Father driven মানে বাপে খেদানো। Mother broomed মানে মায়ের ঝাড়ু দিয়ে বিতাড়ন।

বাদল বলল, মানে টানে নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। তুমি গেষ্টরুমে থাকতে পারবে না। তুমি থাকবে আমার সঙ্গে। খাটে ঘুমাবে, আমি মেঝেতে কম্বল পেতে ঘুমাব। সারারাত গল্প করব। ছবি দেখব।

গুড।

তুমি যে কয়দিন থাকবে আমি ইউনিভার্সিটিতে যাব না। চব্বিশ ঘণ্টা তোমার সঙ্গে থাকব। আমাকে কেউ হাতি দিয়ে টেনেও তোমার কাছ থেকে সরাতে পারবে না।

কাঁঠালের আঠা হয়ে যাবি?

অবশ্যই।

আমাকে বিস্মিত করে খালা এসে জানতে চাইলেন, দুপুরে কী খাবি?

আমি বললাম, যা খাওয়াবে তাই খাব।

তোর কী খেতে ইচ্ছা করে বল? পথেঘাটে থাকিস, আত্মীয়স্বজনদের বাসায় এসে ভালোমন্দ খাবার ইচ্ছা হতেই পারে। হিমু, দশ পনেরো দিনের আগে নড়ার নামও নিবি না।

আমি বললাম, ঠিক করে বলে তো তোমাদের সমস্যাটা কী?

এর মধ্যে তুই সমস্যা খুঁজে পেয়ে গেলি? আমি তোর খালা না?

বাদলের ঘরে টেলিভিশন ছিল না। সে গেষ্টরুম থেকে টিভি নিয়ে এলো। আমার হাতে টিভির রিমোট ধরিয়ে বলল, শুয়ে শুয়ে টিভি দেখবে। টেবিলের উপর খবরের কাগজ।

আমি টিভি দেখি না। খবরের কাগজও পড়ি না।

এখন টিভি দেখবে, খবরের কাগজ পড়বে। অনেকদিন পর এই কাজটা করবে তো–আনন্দ পাবে। চা খাবে? চা দিতে বলি?

আমি বললাম, দে।

খবরের কাগজ পড়ে বিশেষ আনন্দ পেলাম। সেকেন্ড হেডলাইন— সর্ষেতে ভূত। পুলিশের হেফাজত থেকে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী আয়না মজিদের পালিয়ে যাওয়ার কাহিনীর চমৎকার বর্ণনা।

সর্ষেতে ভূত
(নিজস্ব প্রতিবেদক)

শীর্ষ সন্ত্রাসী আয়না মজিদ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছে। তার পলায়ন নিয়ে নানান ধরনের রহস্য দানা বাঁধতে শুরু করেছে। পুলিশ যে ভাষ্য দিচ্ছে তা কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না।

পুলিশ বলছে, সকাল আটটা বিশ থেকে আয়না মজিদকে একটি বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে সে স্বীকার করে যে, সে-ই আয়না মজিদ। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী লম্বু খোকন এবং তার কুকর্মের বান্ধবী সুষমা রানী বিষয়েও সে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। তথ্যগুলি যাচাইবাছাইয়ের জন্যে তদন্তকারী কর্মকর্তা কিছুক্ষণের জন্যে জিজ্ঞাসাবাদের বিরতি নেন। আয়না মজিদকে হাতকড়া বাধা অবস্থায় ঘরে রেখে তিনি ঘর তালাবন্ধ করে দেন। ফিরে এসে দেখেন আয়না মজিদ হাতকড়া খুলে জানালার গ্রীল কেটে পালিয়ে গেছে।

আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, হাতকড়া খোলার চাবি সে কোথায় পাবে? চাবি কি তাকে গোপনে দেয়া হয়েছিল? গ্রীল কাটার জন্যেও যন্ত্র প্রয়োজন, এই যন্ত্র সে কোথায় পেয়েছে? গ্ৰীল কাটার শব্দ অবশ্যই হবে। থানায় এত লোকজন, কেউ শব্দ শুনতে পেল না! বিশেষ ক্ষণে সবাই একসঙ্গে বধির হয়ে গেল?

জিজ্ঞাসাবাদের সময় এক পর‍্যায়ে আয়না মজিদকে জামাই আদর করে চা গরম সিঙ্গারা খাওয়ানো হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তাও এই তথ্য স্বীকার করেছেন। হাতকড়া দিয়ে হাত পেছনে বাঁধা। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, এই অবস্থায় আয়না মজিদ চা সিঙ্গারা খাবে কীভাবে? আমরা কি ধরে নেব। তদন্তকারী কর্মকর্তা মুখে তুলে তাকে খাইয়েছেন? দুর্ধর্ষ এক সন্ত্রাসীকে হঠাৎ জামাই আদর শুরু করা হলো কেন? কাদের নির্দেশে হঠাৎ আদর আপ্যায়ন?

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আয়না মজিদের পলায়নের পরপরই থানার ওসি সাহেব একটা টেলিফোন পান। টেলিফোনে তাকে জানানো হয় যে, তার জন্যে মধু এবং বনমোরগ আসছে। বনমোরাগের ংখ্যা নিয়ে দরকষাকষিও হয়। ওসি সাহেব চাচ্ছেন চারটা বনমোরগ, অপরপক্ষ দিতে চাচ্ছে তিনটা বনমোরগ। এই বনমোরগ কি আসলেই বনমোরগ? না-কি বনমোরাগের আড়ালে অন্যকিছু?

আমরা মনে করি বনমোরগ সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত। মধু কিংবা বনমোরগ কোনোটাই থাকা উচিত না। তদন্ত কর্মকর্তা এস কবীর সাহেবকে লোক দেখানো সাসপেন্ড করা হয়েছে। আমরা মনে করি বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। পর্দার আড়ালের রাঘববোয়ালদের বের করা উচিত। বনমোরগ বনে থাকবে, মধু থাকবে মধুর চাকে। এটাই শোভন। আইন প্রয়োগকারী কর্তব্যক্তিদের চারপাশে বনমোরগ ঘুরবে এবং ক্ষণে ক্ষণে কোেকর কো করবে। এটা শোভন না। জাতি বনমোরগের হাত থেকে মুক্তি চায়। সর্ষের ভূতের স্বরূপ উদ্‌ঘাটন চায়।

দুপুরে হেভি খাওয়াদাওয়া হলো। খালু সাহেব অফিসে যান নি। সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়া। শুনলাম কয়েকদিন ধরেই তিনি অফিসে যাচ্ছেন না। তার যে শরীর খারাপ তাও না। তবে চোখে ভরসা হারানো দৃষ্টি। হড়বড় করে অকারণে কথা বলে যাচ্ছেন। পৃথিবীর সবচে স্বাদু খাবার কী— এই বিষয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। তাঁর মতে হরিয়াল পাখির মাংস পৃথিবীর সবচে স্বাদু খাবার। কারণ এই পাখি বটফল খায়, মাছ খায় না। হরিয়াল পাখি কীভাবে রান্না করতে হয় সেই রেসিপিও দিলেন। সব পাখির মাংসে রসুন বেশি লাগে, হরিয়ালের ক্ষেত্রে লাগে না। কারণ এই পাখির শরীরেই রসুনটাইপ গন্ধ। নার্ভাস মানুষরা নাৰ্ভাসনেস কাটাতে অকারণে কথা বলে। খালু সাহেব কোনো কারণে নার্ভাস। ঘটনা কিছু একটা অবশ্যই আছে, তা যথাসময়ে জানা যাবে।

দুপুরে খাবার পর বাদলকে নিয়ে ছবি দেখলাম। ছবির নাম Hostel. বাদলকে নিয়ে ছবি দেখা বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা। রানিং কমেট্রির মতো সে বলে। যাবে কোন দৃশ্যের পর কোন দৃশ্য আসছে।

হিমুদা, সুন্দর মেয়েটা দেখছে না, এক্ষুনি কাটা চামচ দিয়ে তার একটা চোখ তুলে ফেলা হবে। বাঁ চোখটা তুলবে।

কেন?

আনন্দ পাওয়ার জন্যে কাজটা করছে। অন্যকে কষ্ট দেয়ার মধ্যে আনন্দ আছে। আবার কষ্ট পাবার মধ্যে আনন্দ আছে। হিমুদা, তাকিয়ে থাক, এক্ষুনি চোখ তোলা হবে। ভয়ঙ্কর দৃশ্য।

চোখ তোলার ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল রাত আটটায়। বিকাল চারটা থেকে রাত আটটা। টানা চার ঘণ্টা ঘুম।

বাদল দ্বিতীয় একটা ছবি নিয়ে অপেক্ষা করছে। আমার ঘুম ভাঙলেই ছবি শুরু হবে। আমাকে বিছানায় উঠে বসতে দেখে বাদল বলল, তুমি যে ঘুমিয়ে পড়েছ এটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে। ছবি শেষ হবার পর তাকিয়ে দেখি তুমি গভীর ঘুমে। ওই ছবির শেষ অংশটা দেখবে, না-কি অন্য কোনো ছবি দেব?

নতুন একটা দে।

Horor?

হুঁ।

তিনটা হরর ছবি কিনেছি। একটার চেয়ে আরেকটা ভালো। চল তিনটা ছবিই আজ দেখে ফেলি। দেখবে?

চল দেখি।

হুট করে তুমি চলে যাবে, তোমাকে নিয়ে আর ছবি দেখা হবে না। ফ্লাস্কভর্তি চা নিয়ে বসব। তোমার ঘুম পেলেই তোমাকে চা খাওয়াব। রাত দশটার পর শুরু হবে ছবির অনুষ্ঠান।

দশটা না বাজা পর্যন্ত কী করব?

বাদল মনে হলো চিন্তায় পড়ে গেছে। দশটা না বাজা পর্যন্ত কী করা হবে ভেবে পাচ্ছে না।

খালু সাহেব বাদলকে বিপদমুক্ত করলেন। আমাকে ছাদে ডেকে পাঠালেন।

 

ছাদে শীতলপাটি বিছিয়ে খালু সাহেব আসর শুরু করেছেন। পানি, গ্লাস, বরফ এবং Teacher নামের হুইস্কির বোতল দেখা যাচ্ছে। খালু সাহেবের হাতে গ্লাস। ছাদ অন্ধকার বলে তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। তিনি আনন্দিত কি-না তাও বুঝতে পারছি না। তবে দুএক পেগ পেটে পড়লেই তিনি আনন্দময় ভুবনে প্রবেশ করবেন।

হিমু। বোস বোস। তোমার সঙ্গে প্ৰায় সময়ই দুর্ব্যবহার করি, কিছু মনে করো না। আন্মি চিন্তা করে দেখলাম, At the end of the day you are a good person.

থ্যাংক য়্যু।

থ্যাংক য়্যু দিতে হবে না। You deserve this. তুমি লোক ভালো। অবশ্যই ভালো। কেউ তোমাকে মন্দ বললে তার সঙ্গে আমি আর্গুমেন্টে যাব।

খালু সাহেব, কটা খেয়েছেন?

দুটা। তাও স্মল পেগ। হাতে আছে তিন নম্বর। খেয়ে কোনো আনন্দ পাচ্ছি। না। টেনশন নিয়ে খাচ্ছি।

কেন?

অ্যালকোহলের বিরাট ক্রাইসিস যাচ্ছে। জিনিস পাওয়াই যাচ্ছে না। প্রিমিয়াম হুইস্কির স্বাদ ভুলে গেছি। বাজারভর্তি নকল দুনম্বরি জিনিস। অনেকেই খেয়ে মারা গেছে।

বলেন কী!

পত্রিকা পড় না? অনেক নিউজ বের হয়েছে। তবে আসল নিউজ কেউ সাহস করে ছাপছে না।

আসল নিউজটা কী?

পেঁয়াজ কাচামরিচের দাম বেড়েছে। পাওয়া যাচ্ছে না, এই নিউজ আছে। কিন্তু অ্যালকোহল যে পাওয়াই যাচ্ছে না। এই নিউজ নাই। আমি চিন্তা করেছি বেনামে পত্রিকায় একটা চিঠি লিখব। লেখা উচিত কি-না তুমি বলে।

অবশ্যই উচিত।

হেডিং হবে বিষাক্ত নকল মদ থেকে জাতিকে রক্ষা করুন। হেডিংটা কেমন?

ভালো।

সেখানে কিছু সাজেশন থাকবে। যেমন, সরকারি পরিচালনায় ন্যায্যমূল্যের মদের দোকান। যে-কেউ সেখান থেকে মদ কিনতে পারবে না, শুধু লাইসেন্সধারীরা পারবে।

আপনার লাইসেন্স আছে?

অবশ্যই আছে। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে দেয়া লাইসেন্স। দেখবে?

দরকার নেই।

অবশ্যই দরকার আছে। তুমি ভেবে বসে আছ আমি বিনা লাইসেন্সে মদ খাচ্ছি। তা-না। আমি যখন নিজের বাড়ির ছাদে বসে মদ খাই তখনো সঙ্গে লাইসেন্স থাকে।

ভালো তো।

খালু সাহেব হাতের গ্লাস দ্রুত শেষ করে চতুর্থটা নিলেন। তৃপ্তির একটা শব্দও করলেন–আহা! সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তোমাকে ছোট্ট একটা কাজ করে দিতে হবে হিমু। পারবে না?

অবশ্যই পারব।

জটিল কোনো কাজও অবশ্যি না। একজনকে কিছু টাকা পৌঁছে দেয়া। দুই লাখ টাকা।

এখন দিয়ে আসব?

কাল সকালে নিয়ে যাও। ঠিকানা দিয়ে দেব। সেই ঠিকানায় যাবে। দরজায় টোকা দেবে। যে দরজা খুলবে তাকে বলবে, কাচাবাজারের খবর কী?

কিসের খবর কী?

কাচাবাজারের খবর কী কিংবা বাজারের খবর কী? বাজার শব্দটা থাকলেই হবে। যে দরজা খুলবে সে তোমাকে বসাবে। কিছুক্ষণ বসে থাকবে। পাঁচ মিনিট হতে পারে, আবার ধর এক ঘণ্টাও হতে পারে। যতক্ষণ উনি না। আসছেন। ততক্ষণ বসে থাকবে। উনি এলে তার হাতে প্যাকেটটা দেবে।

উনিটা কে?

উনি কে তোমার জানার প্রয়োজন নাই।

এতগুলি টাকা কাকে দিচ্ছি জানব না? তার কাছ থেকে রশিদ আনব না?

তোমাকে এইসব কিছু করতে হবে না। তুমি টাকা দিয়ে চলে আসবে। ঘরে ঢোকার password হলো বাজার। বাজার শব্দটা শুধু মনে রাখবে। বাজার না বলে তুমি যদি মার্কেট বলো তাহলে কিন্তু তোমাকে ঘরে ঢুকাবে না।

ডিটেকটিভ উপন্যাসের মতো মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা কী খোলাসা করুন তো খালু সাহেব। ঝেড়ে কাশুন।

খোলাসা করব না। ঝেড়েও কাশব না।

খালু সাহেব এক টানে চতুর্থ শেষ করে পঞ্চমে গেলেন এবং হড়বড় করে পুরো ব্যাপারটা খোলাসা করলেন। কাকে টাকা দিতে হবে জানা গেল। কাকতালীয় হোক বাঁ কোকিলতালীয় হোক, ঘটনার মূল নায়ক আমাদের আয়না মজিদ। এই সন্দেহ আমার গোড়া থেকেই হচ্ছিল।

ঘটনা হলো।— দিন দশেক আগে দুপুরবেলা খালু সাহেব একটা টেলিফোন পেলেন। টেলিফোনের ওপাশ থেকে বিনয়ী গলায় কেউ একজন বলল, স্যার ভালো আছেন?

খালু সাহেব বললেন, ভালো আছি, আপনি কে?

আমাকে চিনবেন না। আমি আপনার প্রতিবেশী। নতুন গাড়ি কিনেছেন দেখে ভালো লাগল। আলফার্ভে না?

জি।

চমৎকার গাড়ি। এরচে ভালো মাইক্রোবাস হয় বলেই আমার মনে হয় না।

কালো রঙ পেলেন না?

খোঁজ করেছিলাম, পাই নি।

মেরুন রঙটাও খারাপ না।

খালু সাহেব বললেন, আপনাকে চিনতে পারছি না। আপনার পরিচয়টা?

আমার নাম মজিদ। সবাই আয়না মজিদ হিসেবে আমাকে চেনে। আপনিও নিশ্চয়ই চিনেছেন। স্যার, আমি সামান্য সমস্যায় পড়েছি। আমাকে একটু সাহায্য করতে হয়। একটা ঠিকানা লিখুন তো।

খালু সাহেব ভড়কে গেলেন। যন্ত্রের মতো ঠিকানা লিখলেন। আয়না মজিদ বলল, এই ঠিকানায় স্যার পরশুর মধ্যে এক লাখ টাকা পাঠিয়ে দেবেন। প্রতিবেশী যদি প্রতিবেশীকে না দেখে তাহলে কে দেখবে? প্রতিবেশী যদি প্রতিবেশীকে না। চেনে তাহলে কে চিনবে? বাইবেলে আছে know thy neighbours. স্যার রাখি?

হতভম্ব খালু সাহেবের ব্লাড প্রেসার আকাশে উঠে গেল। শরীর ঘামতে লাগল। মাথা চক্কর দিতে লাগল। তিনি পুলিশের কাছে পুরো ঘটনা বললেন। পুলিশ ঐ ঠিকানায় উপস্থিত হয়ে দেখে বিধবা এক স্কুল শিক্ষিকা দুই বাচ্চা নিয়ে ঐ বাড়িতে থাকেন। তিনি পুলিশের কাছে ঘটনা শুনে কেঁদেকেটে অস্থির।

খালু সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তার ব্লাড প্রেসার স্বাভাবিক হলো। তিন দিন পর আবার আয়না মজিদের টেলিফোন।

স্যার, কেমন আছেন? চিনতে পারছেন তো? আমি আয়না। শুরুতে একটা ভুল ঠিকানা দিয়েছিলাম, কারণ আমি ধরেই নিয়েছিলাম। আপনি পুলিশের কাছে যাবেন। এখন আসল ঠিকানা দিচ্ছি। কাগজ-কলম নিন। পুলিশে খবর দিয়েছেন বলে এখন এক লাখ টাকা বেশি দিতে হবে। কাউকে দিয়ে দু লাখ টাকা যে ঠিকানা দিচ্ছি। সে ঠিকানায় পাঠাবেন। দরজায় সে কড়া নাড়বে। তার পাসওয়ার্ড হচ্ছে বাজার। বলবে বাজার। ঠিক আছে? আপনাকে সময় দিচ্ছি। সাত দিন। সাত দিন চিন্তা-ভাবনার সময় পাবেন।

সাতদিন তিনি এক নাগাড়ে চিন্তা-ভাবনা করেছেন। অফিসেও যান নি। এখন সিদ্ধান্তে এসেছেন দুলাখ টাকা দিয়ে ঝামেলামুক্ত হবেন।

 

হিমু, কটা খেয়েছি তোমার কি মনে আছে?

না।

সাতটা খেয়ে ফেললাম না-কি? বমিভাব হচ্ছে।

ভাব হলে বমি করে ফেলুন। আরাম পাবেন।

আমার আরামের দরকার নাই। আগামীকাল সাত দিন শেষ হবে, ওই চিন্তাতেই সব আরাম হারাম।

আমি বললাম, চিন্তার কিছু নাই। কাল ভোরে টাকা নিয়ে চলে যাব। কলিংবেল বাজিয়ে বলব, কাচা বাজার এনেছি।

থ্যাংক য়্যু। হিমু! At the end of the day you are a good person. তুমি যে good person এই সম্মানে লাষ্ট একটা খাওয়া যাক।

বমির ভাব হচ্ছে বলছিলেন।

হলে হবে। তুমি কি মনে কর আমি বমি ভয় পাই?

না, সেরকম মনে করছি না।

দুষ্ট প্রকৃতির মানুষকে আমরা ভয় করতে পারি। বমিকে কেন ভয় করব?

খালু সাহেব বমি শুরু করেছেন। তাকে অসহায় লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে বমি প্রক্রিয়াটাকে তিনি যথেষ্ট ভয় পাচ্ছেন।

হিমু।

জি।

আজ মনে হয় বমি করতে করতেই মারা যাব। জঘন্য মৃত্যু কী জানো? ডায়রিয়ায় মারা যাওয়া হচ্ছে জগতের জঘন্যতম মৃত্যু। দ্বিতীয় জঘন্যতম মৃত্যু হচ্ছে বমি করতে করতে মারা যাওয়া।

 

রাত এগারোটা। খালু সাহেবের বাড়ি নীরব। তিনি শান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছেন। বাদল horror ছবি নিয়ে তৈরি। ছবির নাম The Eye, আমি টেলিফোন হাতে বারান্দায় হাঁটহীটি করছি। শোভা আপুর সঙ্গে কথা বলছি। নগরীর ওই প্রান্তে কী হচ্ছে জানা দরকার।

শোভা আপু, ঘুমুচ্ছ?

ঘুমাবো কীভাবে? তুই মহা প্যাঁচ লাগিয়ে চলে গেলি। তোর সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করব তাও জানি না। ঠিকানা দিয়ে যাস নি। এদিকে কী হচ্ছে না হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

ঘটনা। কী? কোথায় প্যাঁচ লেগেছে খুলে বলো, আমি প্যাঁচ খুলে দিচ্ছি। প্যাঁচ দেয়া কঠিন, খোলা সহজ।

তুই চলে যাবার পরপরই তোর দুলাভাই এসে উপস্থিত। চোখমুখ ফ্যাকাসে, ঘামে গায়ের শার্ট ভেজা। চেনা যায় না। এমন অবস্থা। আমাকে বলল, আয়না মজিদ কোথায়?

আমি বললাম, আয়না মজিদ কোথায় আমি কী জানি? তোর দুলাইভাই তোতলাতে তোতলাতে বলল, দুপুরে বাসায় কে খে। খে খে। খেয়েছে?

আমি বললাম, আমার ভাই খেয়েছে।

সে কোথায়?

সে খাওয়া দাওয়া করে চলে গেছে।

শোভা! তুমি এই পৃথিবীর সবচে বোকা মহিলা।

আমি কোন বোকামিটা করলাম?

তুমি যা কর সবই বোকামি।

এই বলে তোর দুলাভাই যা শুরু করল তারচে বড় বোকামি কিছু হতে পারে না। আয়না মজিদকে খোঁজা শুরু করল। খাটের নিচে খোঁজে। বাথরুমে খোঁজে। ছাদে গেল। সেখানে খুঁজল। ছাদের পানির ট্যাংকের ডালা খুলে সেখানে খুঁজল।

আমি বললাম, পাগলামি করছি কেন?

সে বলল, পাগলামি করছি কেন যদি বুঝতে তাহলে পৃথিবীর সবচে বোকা মহিলা টাইটেল পেতে না।

টাইটেল কে দিয়েছে?

আমি দিয়েছি। এখন আমার সামনে থেকে যাও। আমার সামনে ঘুরঘুর করবে না।

আমি শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। রাতে আরেক কাণ্ড।

কী কাণ্ড?

রাতে পুলিশের তদন্ত টিম এসে উপস্থিত। বলো কী?

তদন্ত করতে এসেছিলেন হামিদ সাহেব। তুই তো উনাকে চিনিস।

আমি কীভাবে চিনব?

উনিই তো বোয়াল মাছ পাঠিয়েছিলেন।

ও আচ্ছা।

উনার কী সব উল্টাপাল্টা প্রশ্ন। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, ভাবি, আপনার বাসায় কি কেউ বনমোরগ দিয়ে গেছে?

আমি বললাম, না তো!

কেউ কিছু দিয়ে যায় নি? বনমোরগ, মধু, কিছু না?

আমার এক দূরসম্পর্কের ভাই এসেছিল। সে দশ হাঁড়ি টক দৈ নিয়ে এসেছে।

দশ হাঁড়ি টক দৈ? ও মাই গড়! জিনিস ওই টক দৈ-এর ভেতরে।

কী জিনিস?

ভাবি, আমার যতদূর ধারণা ক্যাশ টাকা। পলিথিন দিয়ে টাকা মুড়িয়ে তার উপর টক দৈ দিয়েছে। ওস্তাদ আদমি।

তারপর কী হলো শোন, প্রতিটি টক দৈায়ের হাঁড়ির দৈ বেসিনে ফেলে বিশ্ৰী কাণ্ড।

টাকা পাওয়া গেছে?

পাগলের মতো কথা বলিস কেন? তুই কি দৈ-এর হাঁড়িতে করে টাকা এনেছিস যে টাকা পাওয়া যাবে? ঘটনা এইখানেই শেষ না। হামিদ সাহেব কেচি দিয়ে তোষক বালিশ এইসব কাটা শুরু করলেন। বাড়ি ভর্তি হয়ে গেল তুলায়। আচ্ছা শোন, ঠিক করে বল তো তুই আয়না মজিদ না তো?

না।

বদ আয়না মজিদটাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। সে আমার সংসার লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে।

দুলাভাইকে দাও তো, কথা বলি।

ওর সঙ্গে কী কথা বলবি! ওকে তো পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। জিজ্ঞাসাবাদ করবে।

শোভা আপু কাঁদতে শুরু করলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *