০৩. আমার নিজের কথা বলার আগে

আমার নিজের কথা বলার আগে আমাদের পরিবারের বিষয়ে তোমাকে কিছু বলা দরকার।

আমাদের আদিবাড়ি হুগলিতে। চন্দননগরের খুব কাছে। ১৭৫৭ সালে লর্ড ক্লাইভ আর ওয়াটসন সাহেব চন্দননগরের দরলেয়া দুর্গ আক্রমণ করেন, তা তুমি নিশ্চয়ই জানো। ওই সময় আমাদের এক পূর্বপুরুষ একজন আহত ফরাসি সেনাপতিকে সেবা করে ফরাসিদের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হন এবং মনে হয় পরবর্তীকালে ইনি ফরাসিদের অধীনে কোনো চাকরি বা ব্যবসা শুরু করেন। এর বিষয়ে আমরা আর বিশেষ কিছু জানি না।

এই যুদ্ধের প্রায় ষাট বছর পর ইংরেজ চন্দননগরের ওপর ফরাসিদের পূর্ণ আধিপত্য স্বীকার করে নেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পূর্বপুরুষের ভাগ্যও বদলে গেল। শুনেছি, ঈশ্বরীপ্রসাদ চৌধুরী শুধু ধনী নন, সেকালে একজন বিশেষ গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন। তখনকার দিনে স্কুল-কলেজ না থাকলেও ইনি অত্যন্ত শিক্ষিত ছিলেন। ওঁর ইংরেজি জ্ঞানের কথা বলতে পারব

কিন্তু ইনি যে ফরাসি ভাষায় অত্যন্ত সুপণ্ডিত ছিলেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ইনি ফরাসি ভাষায় বেশ কয়েকখানি বইও লেখেন। তার মধ্যে গঙ্গানদীর কাহিনি নিয়ে লেখা বইখানি প্যারিস থেকে প্রকাশিত হয় ও বিশেষ প্রশংসা লাভ করে।

আমি ছেলেবেলায় দাদুর কাছে এর সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি। দাদু বলতেন, বিশ্বাস কর দিদি, আমার দাদুর মতো সুপুরুষ ও সুপণ্ডিত খুব কম নয়। দাদু প্যারিস গেলে এক বিখ্যাত আর্টিস্ট স্বেচ্ছায় তার যে ফুল সাইজ অয়েল পেন্টিং করে দেন, তার সামনে দাঁড়িয়েই আমরা মুগ্ধ হয়ে যেতাম।

আমার দাদু তার দাদুর কথা বলতে শুরু করলে থামতেন না। একের পর এক কাহিনি বলতেন। তারপর হঠাৎ থামতেন। সঙ্গে সঙ্গে তার উজ্জ্বল মখখানা ম্লান হয়ে যেত। তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলতেন, এমন একজন মহাপুরুষ তুল্য মানুষের সন্তান হয়েও বাবা কি কেলেঙ্কারিই করলেন!

আমি তখন স্কুলের নীচু ক্লাসে পড়ি। বয়স বেশি নয়। তাই দাদুর দুঃখের কারণটা ঠিক বুঝতাম না। তবে বেশ উপলব্ধি করতাম, দাদুর বাবা নিশ্চয়ই এমন কিছু করেছিলেন, যার জন্য তার এই দীর্ঘনিশ্বাস।

আস্তে আস্তে আমার বয়স বাড়ল। সবকিছু জানতে পারলাম।

.

ঈশ্বরপ্রসাদ মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে হঠাৎ মারা যান।

ঈশ্বরীপ্রসাদের একমাত্র সন্তান গঙ্গাপ্রসাদ চৌধুরীর তখন বয়স মাত্র একুশ। বছর খানেক বিয়ে হয়েছে। বাবার মৃত্যুর পর টাকাকাড়ি বিষয় সম্পত্তির হিসাব-নিকাশ বুঝে নিতেই দু-এক বছর কেটে গেল। ইতিমধ্যে আমার দাদুর জন্ম হল।

প্রচুর টাকাকড়ি ও বিষয় সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী হবার গৌরব অর্জন করার পরই গঙ্গাপ্রসাদের রূপান্তর শুরু হল। প্রথমে লুকিয়ে, তারপর প্রকাশ্যে। শেষ পর্যন্ত সেদিন উনি এক ফরাসি সুন্দরীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে হাজির হয়ে নিজের বিবাহিতা স্ত্রীর সামনে তাকে চুম্বন করে সগর্বে ঘোষণা করলেন, মাই বিলাভেড নিউ ওয়াইফ, সেদিন সেই মুহূর্তেই গঙ্গাপ্রসাদের স্ত্রী পুত্রের হাত ধরে ওই প্রসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন। তখন আমার দাদুর বয়স মাত্র বারো-তেরো।

।কয়েক বছর এখানে ওখানে কাটাবার পর দাদু স্টীমার কোম্পানির বুকিং ক্লার্কের চাকরি নিয়ে প্রথমে চাঁদপুর, পরে গোয়ালন্দ এলেন।

আমরা হুগলির লোক হলেও ঢাকার বাসিন্দা হয়ে গেলাম।

আর গঙ্গাপ্রসাদ? তিনি হুগলি আর চন্দননগরের সব বিষয় সম্পত্তি বিক্রি করে ওই ফরাসি সুন্দরীকে নিয়ে প্যারিস চলে যান এবং বছর দশেক পরে ওখানেই তার মৃত্যু হয়।

ঢাকাতেই আমার জন্ম। আমার জ্ঞান-বুদ্ধি হবার পর দাদুকে স্টীমার কোম্পানির চাকরি করতে দেখিনি। শুনেছি আমার জন্মের দিনই দাদু একটা লঞ্চ কেনেন এবং তাই সে লঞ্চের নাম দেন দিদি।

ছেলেবেলার সেই কটা বছরের স্মৃতি কোনোদিন ভুলব না। বাবা মা বা দিদার চাইতে দাদুর সঙ্গেই আমার বেশি ভাব ছিল। আমার খাওয়া-শোয়া, ওঠা-বসা সবকিছুই দাদুর সঙ্গে ছিল। অনেক আগেকার কথা হলেও আমার বেশ মনে পড়ে, রোজ বিকেলবেলায় আমি সদরঘাটে যেতাম। দূর থেকে যাত্রী বোঝাই আমাদের লঞ্চ দেখেই দাদু বলতেন, দ্যাখ দিদি, তোর লঞ্চ আসছে। আমি আনন্দে, খুশিতে নাচতে শুরু করতাম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই লঞ্চ সদরঘাটে আসত। যাত্রীরা নেমে যাবার পর দাদু আমাকে নিয়ে লঞ্চে উঠতেই গিয়াসুদ্দীন চাচা আমাকে কাঁধে তুলে নিতেন। আমার এখনও বেশ মনে আছে, উনি রোজ আমার জন্য কিছু আনবেনই। কোনোদিন মিষ্টি, কোনোদিন ফল বা লজেন্স। আমি তখন বুঝলাম না গিয়াসুদ্দীন চাচা আমাকে কেন অত ভালোবাসতেন কিন্তু পরে জেনেছিলাম।

.

তখন আমি একটু বড় হয়েছি। বোধহয় ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়ি। কোনোদিন কোনো কারণে দাদুর সঙ্গে সদরঘাটে যেতে না পারলে গিয়াসুদ্দীন চাচা আমাদের বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে দেখা করবেনই।

দিদি, তোমার লঞ্চ চালিয়ে পেট চালাই। তাইতো ডাঙ্গায় নেমে তোমার মখখানা না দেখে ঘরে ফিরতে পারি না।

আমি হাসি।

গিয়াসুদ্দীন চাচা হাসেন না। গম্ভীর হয়ে বলেন, না, না, দিদি, হাসির কথা নয়। তোমাকে দেখলে আমার পোড়া বুকখানা জুড়িয়ে যায়।

আমি কিছু জিজ্ঞাসা করতাম না কিন্তু বেশ বুঝতে পারতাম, গিয়াসুদ্দীন চাচার মনে অনেক দুঃখ। আর বুঝতাম, উনি আমাকে সত্যি ভালোবাসেন।

তুমি কলকাতার ছেলে। পূর্ব বাংলায় যাওনি। বর্ষকালে পূর্ববাংলার রূপ না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সেই বর্ষা-বাদলের দিনেও গিয়াসুদ্দীন চাচা আমাকে দেখতে আসবেনই।

আমি হয়তো বলতাম, চাচা, এই বর্ষায় কেউ আসে?

গিয়াসুদ্দীন চাচা একমুখ হাসি হেসে জবাব দিতেন, সেই অঘ্রাণের আগে তো বর্ষা থামবে। তাই বলে কি এই কমাস তোমার মখখানা দেখব না?

দাদু আমাকে বলেছিলেন, গিয়াসুদ্দীন চাচার একমাত্র মেয়ে কলেরায় মারা যায় এবং পরের বছর ওর জন্মদিনেই আমার জন্ম হয়।

সেই সে সময় আমি স্কুলের আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় একটা বই পুরস্কার পাই। দাদুর কাছে সে খবর শুনে গিয়াসুদ্দীন চাচার কি আনন্দ! হাতে সময় থাকলেই বলতেন, দিদি, আমাকে একবার কাজলাদিদি কবিতাটা শুনিয়ে দাও তো-যেটার জন্য তুমি মেডেল পেয়েছ।

গিয়াসুদ্দীন চাচার প্রশংসায় আমি এমনই উৎসাহিত হয়েছিলাম যে যখন-তখন যাকে-তাকে কাজলাদিদি কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতাম। ওই এক কবিতা হাজার বার শুনতে শুনতে বাড়ির সবাই পাগল হয়ে যেতেন কিন্তু গিয়াসুদ্দীন চাচার কথা মনে করে আমি মা বা দিদার হাসাহাসিকেও গ্রাহ্য করতাম না।

তারপর একদিন সদরঘাটে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পরও আমাদের লঞ্চ এলো না। আস্তে আস্তে রাত হল। রাতের পাতলা অন্ধকার গাঢ় হল, কিন্তু গিয়াসুদ্দীন চাচা লঞ্চ নিয়ে ফিরলেন না। অনেক রাত্রে সর্বনাশের খবর এলো। আমি আর জীবনে কোনোদিন কাজলাদিদি কবিতা আবৃত্তি করতে পারলাম না।

এরপর মাস খানেক বিছানায় শুয়েই দাদু বেঁচে ছিলেন। তারপর তিনি চলে গেলেন। বছরখানেক ঘুরতে না ঘুরতেই দিদাও দাদুর কাছে চলে গেলেন।

আমার হোট দুনিয়া হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে ডুবে গেল।

আমার দাদু নিজে বিশেষ লেখাপড়া করতে পারেননি বলে বাবাকে এম. এ. বি এল. পর্যন্ত পড়ান। একে দাদু দিদার মৃত্যু তারপর ঢাকা কোর্টে ওকালতি করে বিশেষ সুবিধে না হওয়ায় বাবা ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় চলে এলেন। আসার পর জানলাম মার ক্যান্সার হয়েছে এবং তার চিকিৎসার জন্যই বাবা ঢাকা ছেড়ে কলকাতা এসেছেন।

কলকাতায় আসার পর প্রায় বছর দুই মা মোটামুটি ভালোই ছিলেন। নিজেই সংসারের কাজকর্ম করতেন। আমি স্কুল থেকে ফিরলে ঘন্টাখানেক গল্প করবেনই। তারপর বাবা কোর্ট থেকে ফিরলেই বলতেন, অমন করে তাকিয়ে দেখার কোনো কারণ হয়নি। আমি ভালোই আছি।

বাবা তার সমস্ত উৎকণ্ঠা লুকিয়ে হাসি মুখে বলতেন, ভালো থাকবে না কেন? নিশ্চয়ই ভালো থাকবে।

.

আমার বাবা অত্যন্ত সৎ ও শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন। তিনি আপন মনে নিজের কাজকর্ম-লেখাপড়া করতেন। তাইতো দাদু বাবাকে ব্যবসা-বাণিজ্যে না টেনে স্বাধীন পেশায় দেন, কিন্তু অমন লাজুক লোকের পক্ষে ওকালতিতেও সুবিধে করা সহজ নয়। বাবাকে কোনোদিন তাস-পাশা খেলতে বা কোথাও কারুর সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখিনি। কোর্টে যাওয়া-আসা ছাড়া সবই সময়ই নিজের ঘরে বসে পড়াশুনা করতেন। দাদু থাকতে আমি বাবার কাছে যেতাম না, কিন্তু কলকাতায় আসার পর আমাদের সবকিছু বদলে গেল। বাবার কাজকর্মের চাপ অত্যন্ত বেড়ে গেলেও বাবা আমার অনেক কাছের মানুষ হলেন।

গিয়াসুদ্দীন চাচা আর দাদুকে হারানোর পর এই পৃথিবীকে আমার মরুভূমি মনে হয়েছিল। ভেবেছিলাম ওই ক্ষণস্থায়ী সুখের স্মৃতি রোমন্থন করেই আমাকে বাকি জীবন কাটাতে হবে, কিন্তু না, কলকাতায় আসার পর অসুস্থ মা আর কর্মব্যস্ত বাবা আমাকে স্নেহ-ভালোবাসায় ভরিয়ে দিলেন। আমার পৃথিবী আবার সবুজ, সুন্দর হয়ে উঠল।

আমার প্রাণভরা ভালোবাসা নিও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *