০৩. আবার আপনাদের সেই গল্পতে

আবার আপনাদের সেই গল্পতে ফিরিয়ে নিয়ে আসি যে-গল্প দিয়ে সম্পাদকের বৈঠকে শুরু করেছিলাম। শরৎচন্দ্র জলধরদাকে নিয়ে একবার মারাত্মক রসিকতা করেছিলেন, যার ফলে বেশ কিছুকাল দুজনের মধ্যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গল্পটা শুনেছিলাম বৈঠকের সেই গাল্পিক সাহিত্যিকের মুখে। আমি শুধু পুনরাবৃত্তি করছি।

একদিন দুপুরে জলধরদা বিষণ্ণমুখে ভারতবর্ষ অফিসে চুপচাপ বসে আছেন। টেবিলের উপর তাঁর সদ্য লেখা উপন্যাস উৎসর ছাপা ফর্মার উপর সকরুণ দৃষ্টি নিবদ্ধ। এমন সময় শরৎচন্দ্র নিঃশব্দে ঘরে ঢুকেই জলধরদার এমন মুষড়ে পড়া চেহারা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। সভয়ে অথচ স্বভাবগত ফক্কড়ি করে জিজ্ঞাসা করলেন—

একি জলধরদা! কেন আজি হেরি তব মলিন বদন? কিবা প্রয়োজনে মাগিয়াছ–

রাগতস্বরে জলধরদা বললেন—দেখ শরৎ, সব সময় তোমার এই ঠাট্টা ইয়ার্কি ভাল লাগে না। আমি মরছি নিজের জ্বালায়। তোমায় ডেকে পাঠিয়েছিলাম কোথায় আমাকে একটা সৎপরামর্শ দেবে, তা নয় ঘরে ঢুকেই থ্যাটারি শুরু করে দিলে।

জলধরদার সঙ্গে শরৎচন্দ্রের পরিচয় অনেক দিনের। যেদিন থেকে জলধরদা ভারতবর্ষের সম্পাদনার ভার নিলেন সেদিন থেকেই শরৎচন্দ্র এই পত্রিকার নিয়মিত লেখক। লেখক-সম্পাদক পরিচয় ক্রমশ নিবিড় বন্ধুত্বে পরিণত হয়ে এতদিনে মধুর ইয়ার্কির সম্পর্কে এসে দাঁড়িয়েছে। জলধরদাকে শরৎচন্দ্র বরাবরই অন্তরের সঙ্গে শ্রদ্ধা করেন। শুধু বয়ঃজ্যেষ্ঠ বলেই নয়, সাহিত্যিক জলধর সেন শরৎচন্দ্রর অগ্রণী। তাছাড়া এই আত্মভোলা মানুষটির চারিত্রিক মাধুর্য সবসময়েই শরৎচন্দ্রকে আকৃষ্ট করেছে। শরৎচন্দ্র অনুমান করলেন নিশ্চয় সদ্যছাপা উপন্যাস নিয়েই জলধরদার এই দুশ্চিন্তা। ওঁর চোখের দৃষ্টিই তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। এ-যেন অরক্ষণীয়া কন্যার প্রতি পিতার ব্যথাতুর দৃষ্টি।

জলধরদা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন—জানো শরৎ, এইটিই আমার শেষ উপন্যাস। আমার যা-কিছু সঞ্চয় ছিল সেই টাকা দিয়েই উপন্যাসটি ছাপলাম। এখনও প্রেস-কে কিছু টাকা দেওয়া বাকি কিন্তু বাইণ্ডার বলছে কিছু টাকা আগাম না পেলে ছাপাখানা থেকে আর ছাপা ফর্মা ও ডেলিভারি নেবে না। এখন কি করি বল তো?

শরৎচন্দ্র অবাক। এই বৃদ্ধ বয়সে নিজের সামান্য সঞ্চয় এভাবে নিঃশেষ করলেন?

জলধরদা বলেই চললেন-তুমি ভাবছ নিজে খরচ করে কেন এ-বই ছাপলাম। কিন্তু এ-ছাড়া আর উপায় কী ছিল। প্রকাশকরা আমার বই নিতে চায় না, বলে কিনা আমার বইয়ের বিক্রি নেই। আমার আগের যেসব বই প্রকাশকদের কাছে আছে তার বাবদ কি পাওনা হয়েছে তার কোন হিসেব-পত্তর নেই। অন্তত অধিকাংশর কাছে হিসেব চাইতে গিয়ে আমার বই বিক্রি হয় না এই কথা শুনে লজ্জায় ফিরে এসেছি। তাই ভাবলাম আমার জীবনের এই শেষ উপন্যাস আমার যথাসর্বস্ব দিয়ে নিজের খরচেই প্রকাশ করব। কিন্তু এখন দেখছি তরী তীরের কাছে এসেই বুঝি ভেবে ডোবে।

এই জন্যে আপনার এত দুশ্চিন্তা? কিছু ভাববেন না। আমি আপনাকে সোজা উপায় বাতলে দিচ্ছি। কথাটা শরৎচন্দ্র বললেন বেশ একটু জোরে সঙ্গেই, যাতে জলধরদার মনের বোঝা নিমেষেই নেমে যায়। সত্যি সত্যি হলও তাই। ক্ষীণ আশার আলোক সঞ্চারে জলধরদার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

টেবিলের উপর থেকে উপন্যাসের ছাপা ফর্মাগুলি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে শরৎচন্দ্র বললেন–টাইটেল পেজ তো ছাপা হয় নি দেখছি। বইটা উৎসর্গ কাকে করবেন কিছু ভেবেছেন কি?

জলধরদার মুখে সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল। বললেন—ঠিক করেছি বইটা আমার প্রথমা পত্নীকেই উৎসর্গ করব—যিনি ছিলেন আমার প্রথম যৌবনের সাহিত্য প্রেরণার একমাত্র উৎস।

শরৎচন্দ্র মাথা চুলকে বললেন—প্রথমা পত্নীকে আপনি যে প্রাণাধিক ভালবাসতেন এই বৃদ্ধবয়সে সে-কথা দুনিয়াসুদ্ধ লোককে জানিয়ে আর লাভ কি। তাছাড়া তিনিও তো আর স্বর্গ থেকে নেমে এসে আপনার বই প্রকাশের যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিতে পারছেন না। এক্ষেত্রে যাকে উৎসর্গ করলে কাজ হবে তার কথাই ভাবুন।

এতক্ষণে জলধরদা যেন একটু আশার আলো দেখলেন। বললেন–তুমিই বল না কাকে উৎসর্গ করা যায়।

কেন লালগোলার রাজা যোগেন্দ্রনারায়ণ রায় তো আছেন। একেবারে সাক্ষাৎ গৌরী সেন। তাঁর নামে উৎসর্গ করে সশরীরে বইটা তার হাতে তুলে দিন, দু-চার হাজার তো নির্ঘাত এসে যাবে।

শিশুর মত একগাল সরল হাসি হেসে জলধরদা বললেন—এই জন্যই তো তামাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম শরৎ। তুমি ছাড়া এসব বুদ্ধি আর কার মাথায় খুলত বল? তোমার পরামর্শ তো ভালই বোধ করছি, তবু এর মধ্যে একটা কিন্তু থেকে যাচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে শরৎদা বলে উঠলেন—সে কথাও আমি যে ভাবি নি তা মনে করবেন না। উৎসর্গ করা সত্ত্বেও যদি টাকাটা না পান তাহলে একুল ওকুল দুকূল যাবে। এই তো আপনার আশঙ্কা?

ঠিকই বলেছ। জাতও দেব পেটও ভরবে না এরকমটা যেন না হয়।

শরৎচন্দ্র বললেন–তাহলে এক কাজ করুন। উৎসর্গ পত্রটি এখন আর ছেপে কাজ নেই। ওই পাতাটা কম্পোজ করিয়ে ভাল করে একটা প্রুফ টানিয়ে ছাপা ফর্মার সঙ্গে জুড়ে দিলেই হবে। সুতরাং আর কালক্ষেপ না করে দু-চার দিনের মধ্যেই লালগোলা চলে যান, যাবার আগে একটা চিঠি দিয়ে আপনার যাবার কারণটা না জানিয়ে শুধু খবরটা জানিয়ে রাখবেন।

শরৎচন্দ্র তো মোক্ষম পরামর্শ দিয়ে চলে এলেন।

তিন-চারদিন পর জলধদা শিয়ালদায় দুপুরের লালগোলা প্যাসেঞ্জারে চেপে বসলেন। সন্ধ্যার সময় ইস্টিশনে লালগোলার সরকার মশাই এসে উপস্থিত। যথারীতি সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করে তিনি জলধরদাকে নিয়ে গেলেন রাজবাড়িতে, শুভকাজটা সর্বাগ্রে সেরে নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়াই ছিল জলধরদার ইচ্ছে। কিন্তু সরকার মশাই জলধরদাকে নিয়ে তুললেন অতিথিশালায়। জলযোগের ভূরি আয়োজন ছিল। কিন্তু জলধরদার উৎকণ্ঠিত চিত্ত রাজসন্দর্শনের জন্য অস্থির। তিনি প্রশ্ন করলেন-রাজা যোগেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে কখন সাক্ষাৎ হতে পারে?

সরকার মশাই বিনয়ের অবতার। করজোড়ে নিবেদন করলেনপথভ্রমণে আজ আপনি ক্লান্ত, জলযোগাদি সেরে বিশ্রাম করুন। আপনার সেবার যাতে কোনরকম ত্রুটি না হয় সে কথা রাজা বারবার করে আমাকে বলে দিয়েছেন আর বলেছেন, রাত্রে আহারের সময় আপনার সঙ্গে তিনি দেখা করবেন। ততক্ষণ নদীর ধারটা একবার আপনাকে বেড়িয়ে নিয়ে আসতে বলেছেন, অবশ্য শারীরিক ক্লেশ যদি বোধ না করেন।

জলধরদা বললেন–বিলক্ষণ। লালগোলায় আমি আগে কখনও আসি নি। দেশটা ভাল করে দেখে যাওয়াই তো আমার অন্যতম উদ্দেশ্য। প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে এদেশের মহানুভব বাজার সাক্ষাৎ পরিচয় লাভ করা।

সরকার মশাই দুই হাত কচলে বললেন—সে তো নিশ্চয়, রাজাও আপনার মত দেশবরেণ্য সাহিত্যিকের দর্শনলাভের জন্য উৎসুক হয়ে আছেন। তা ছাড়া তিনি জানতে চেয়েছেন রাতে আপনার আহারাদির কি রকম ব্যবস্থা করা হবে।

জলধরদা বললেন—জলযোগের যা বিরাট আয়োজন করেছেন রাত্রে আর কিছু খেতে পারব বলে তো মনেই হয় না। তাছাড়া রাত্রে আমি খাই যৎসামান্যই। বিশেষ কিছু করবেন না-খান কুড়ি খাঁটি গব্যঘৃতে ভাজা লুচি, তার সঙ্গে কিছু মাংস। ভাজাভুজি দু-চার রকম করলেও করতে পারেন। আলু-ফুলকপি দিয়ে একটা নিরামিষ তরকারি। এখানকার গলদা চিংড়ি শুনেছি খুব ভাল। চিংড়ির একটা কালিয়া গরম-গরম লুচি দিয়ে মন্দ লাগবে না, তার সঙ্গে মুখ মারবার জন্যে আনারসের চাটনি থাকলেও থাকতে পারে। সবশেষে একটি ঘন দুধ, ক্ষীর বললেও বলতে পারেন। খাওয়ার শেষে একটা কিছু মিষ্টি খাওয়া আমার বহুদিনের বদভ্যাস। সঙ্গে মর্তমান কলা একটা দিলেও দিতে পারেন। কিন্তু আমার বিশেষ অনুরোধ বেশী কিছু আয়োজন করবেন না। দেখতেই তো পাচ্ছেন-বয়স হয়েছে, তাই রাত্রির খাওয়া একেবারে কমিয়ে দিয়েছি। নইলে ঘুম হয় না, হজমেরও কষ্ট হয়।

সরকার মশাই ততক্ষণে পকেট থেকে নোটবুক-পেনসিল বার করে দশদফা ফর্দ টুকে ফেলেছেন। দুগ্ধফেননি শয্যায় গা এলিয়ে দিয়ে জলধরদা বললেন–আজ আর বেড়াতে যাবার ইচ্ছে নেই, শরীরটা খুবই ক্লান্ত। আপনি বরং রাত্রে খাবার সময় আমায় ডেকে নিয়ে যাবেন।

সরকার মশাইকে বিদায় দিয়ে জলধরদা শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলেন। ভাবনা আর কিছুই নয়, রাত্রে রাজার সঙ্গে দেখা হলে কথাটা কী ভাবে পাড়বেন মনে মনে তারই রিহার্সল দেওয়া।

যথা সময়ে সরকার মশাই এসে জানালেন, খাবার সময় হয়েছে-রাজা অপেক্ষা করছেন। জলধরদার সেই রাজকীয় পোশাক। গলাবন্ধ কোট আর কাধের উপর ভাঁজ করা চাদর। চাদরের আড্ডালে বগলের নীচে কাগজমোড়া বইয়ের বাণ্ডিলটা নিতে ভোলেন নি।

ঝাড় লণ্ঠন আলোকিত রাজবাড়ির প্রশস্ত প্রকোষ্ঠ পার হয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকে দেখেন একটা লম্বা টেবিলের একপ্রান্তে সৌম্যদর্শন রাজা তারই অপেক্ষায় বসে আছেন। চেয়ার থেকে উঠে স্মিতহাস্যে অভ্যর্থনা জানিয়ে টেবিলের অপর প্রান্তে বসবার জন্য আহ্বান জানিয়েই ভোজ্যবস্তু পরিবেশনের জন্য সরকার মশাইকে আদেশ জানালেন

কাল সকালে ওঁকে একবার নদীর ধার এবং তার পাশের গ্রামগুলি বেড়িয়ে নিয়ে আসবেন।

জলধরদা খেতে খেতে বললেন–আপনি ব্যস্ত হবেন না, গ্রাম দেখতেই তো আমার আসা। শৈশব কৈশোর আমার গ্রামেই কেটেছে তাই গ্রামের টান আমার প্রাণের টান।

আহারান্তে লালগোলাধিপতি বিদায় চেয়ে জানালেন পরদিন সকালে যেন জলধরদা তার সঙ্গে চা-পান করেন। প্রয়োজনের কথাটা বলতে গিয়েও সঙ্কোচবশত বলা হয়ে উঠল না, সুযোগই বা পেলেন কোথায়। আহারান্তে বিষণ্ণচিত্তেই শয্যা গ্রহণ করলেন।

রাত আর কাটে না। কখন সকাল হবে, জলধরদা তারই প্রতীক্ষায় মুহূর্ত গুনছেন।

অবশেষে দুঃখের রাত্রি অবসান হল। সরকার মশাই এসে ডেকে নিয়ে গেলেন চায়ের আসরে। জলধরদার সেই এক বেশ। গলাবন্ধ কোট, কাঁথে চাদর, বগলের তলায় উপন্যাসের বাণ্ডিল।

লালগোলার রাজা তারই প্রতীক্ষায় বসেছিলেন। পাশে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—রাত্রে ঘুমের ব্যাঘাত হয় নি তো?

কিছুমাত্র না। একথা বলেই আর কালক্ষেপ না করে বগলের তলা থেকে বাণ্ডিলটা বার করে রাজার দিকে এগিয়ে ধরে বললেন—আমি তো যেতেই বসেছি, এই আমার শেষ কাজ। আপনার নামেই

আহা-হা, হা হা, সে পরে হবে। এখন চা খান। শশব্যস্ত হয়ে জলধরদার কথার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন লালগোলারাজ যোগেন্দ্রনারায়ণ।

সরকার মশাইকে বললেন গ্রামটা একবার ঘুরিয়ে দেখাতে এবং সেই সঙ্গে বললেন–জলধরবাবু দুপুরে এবং রাত্রে কি কি খেতে ভালবাসেন সব তার কাছ থেকে জেনে নিয়ে সেই রকম ব্যবস্থা করবেন। আচ্ছা জলধরবাবু, আমি তাহলে এখন উঠি। দুপুরে খাবার সময় আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে।

বইয়ের বাণ্ডিলটা চাদরের তলায় ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে জলধরদা হতাশ কণ্ঠে বললেন–তাই চলুন সরকার মশাই, গ্রামটা তাহলে ঘুরেই দেখে আসি।

গ্রাম প্রদক্ষিণ করে দুপুরে খাবার সময় যোগেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে দেখা হতেই এবারে মরিয়া হয়ে জলধরদা চাদরের তলা থেকে বইটা বার করেই একেবারে উৎসর্গের পাতাটা খুলে ধরে বলে উঠলেন—আমি তো যেতেই বসেছি—

জলধরদাকে থামিয়ে দিয়ে যোগেন্দ্রনারায়ণ বললেন–আপনি এর জন্যে এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন। আহারাদি করে বিশ্রাম করুন। আপনি যখন আজ বিকেলেই চলে যাবেন স্থির করেছেন, সরকারকে বলে দিয়েছি সে নিজে গিয়ে আপনাকে স্টেশনে তুলে দিয়ে আসবে। আপনি ওর জন্য কিছু ভাববেন না।

খানিকটা নিশ্চিন্ত হলেন জলধরদা। আশার আলোক যেন একটু দেখতে পেলেন। অতবড় মানুষ অথচ কী লজ্জা, কী বিনয়। একেবারে হাতে হাতে দিতে সংকোচ বোধ করছেন বলেই বোধ হয় সরকারের হাতে ইস্টিশনেই পাঠিয়ে দেবেন।

 

যথাসময়ে জলধরদা ইস্টিশনে এসে ঘন ঘন পায়চারি করছেন, ট্রেন আসতে তখনও মিনিট দশ দেরি। সরকার মশাই নীরবে একপাশে দাঁড়িয়ে। একটু রূঢ় কর্কশস্বরেই জলধরদা সরকার মশাইকে বললেন–রাজা কি সত্যিই কিছু আপনার হাতে দিয়ে পাঠান নি? কোন চেক বা চিঠিপত্র?

কই না। কিছুই তো দেন নি।

আমার কথা আপনার কাছে কিছু কি বলেছেন? উৎকণ্ঠিত চিত্তে জলধদা জিজ্ঞাসা করলেন।

আপনার কোনরকম অসুবিধা হয়েছে কি না তাই শুধু জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আর তো কিছুই বলেন নি।

ট্রেন ততক্ষণে এসে গিয়েছে। ট্রেনের কামরায় বসেও জলধরদার স্বস্তি নেই। বার বার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছেন আর সরকার মশাইকে বলছেন-দেখুন তো রাজবাড়ি থেকে কোন লোক ছুটতে ছুটতে আসছে কি না?

সরকার মশাই ভাল করে নিরীক্ষণ করে জানালেন কোন লোককেই এদিকে ছুটে আসতে দেখছেন না।

ট্রেন ছাড়ার হুইসিল বেজে উঠল।

এমন সময় দূরে দেখা গেল একজন লোক সাইকেল চালিয়ে স্টেশনের দিকে আসছে। আর যায় কোথা। জলধরদা চিৎকার করে বলে উঠলেন–সরকার মশাই, গার্ডকে শিগগির বলুন যেন গাড়ি এক্ষুনি ছেড়ে না দেয়। রাজবাড়ি থেকে আমার কাছে তোক আসছে। আপনি ছুটে গার্ডের কাছে চলে যান।

সাইকেল চালক ততক্ষণে অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। সরকার মশাই পরামানিককে দেখেই চিনলেন, স্টেশনমাস্টারের দাড়ি কামাবার জন্যে আসছে। জলধরদাকে সে-কথা জানাতেই তিনি দুঃখে ক্ষোভে অভিমানে এবং ক্রোধে ফেটে পড়লেন-পরামানিক কি আর সোনামানিক হতে পারত না? ইচ্ছে করলেই পারত। ইচ্ছে না থাকলে আর কোত্থেকে হবে। বুঝলেন সরকার মশাই, এই শরৎই যত নষ্টের মূল। সে-ই আমাকে জোর করে পাঠিয়েছিল। কলকাতায় ফিরেই ওর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে।

সরকার মশাই জলধরদার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন, গাড়ি ছেড়ে দিল।

 

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই একখানা ট্যাক্সি নিয়ে জলধরদা সোজ গিয়ে হাজির হলেন শরৎচন্দ্রের সামতাবেড়ের বাড়িতে। ট্যাক্সি থেকে নামা নয়। ভিতরে বসেই খবর পাঠালেন। কী হল জলধরদা, কী হল বলতে বলতে হন্তদন্ত হয়ে শরৎচন্দ্র বেরিয়ে আসতেই জলধরদা গর্জন করে উঠলেন–হবে আবার কি। কিছুই হল না, মাঝখান থেকে তোমার কথায় বেল্লিক বনে এলাম। লালগোলা যাওয়া আসার পরিশ্রমই সার হল।

শরৎদা বিস্মিতকঠে চোখ বড় বড় করে বললেন সে কী! কিছু দিলেন না?

না কিছুই না।

গম্ভীর গলায় দৃঢ়তা এনে শরৎবাবু বললেন—মামলা ঠুকে দিন।

মামলা? জলধরদা তো অবাক।

বাঁ হাতের তেলোয় ডান হাতের ঘুসি ঠুকে শরৎদা বললেন—হ্যাঁ, হ্যাঁ মামলা। প্রিসিডেন্‌স্‌ আছে। এর আগে অনেক লেখকই বই উৎসর্গ করে ওঁর কাছ থেকে টাকা পেয়েছে। আপনিই বা পাবেন না কেন?

রোষকষায়িত চক্ষে, শরৎচন্দ্রের দিকে জলধরদা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। জলদগম্ভীরকণ্ঠে জলধরদা ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললেন–

ড্রাইভার, যেখান থেকে এসেছিলাম, সেখানেই ফিরে চল।

এই ঘটনার পর বহুদিন শরৎচন্দ্রের সঙ্গে জলধরদার বাক্যালাপ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আবার ভাব হয়েছিল জলধরদার সম্বর্ধনা উপলক্ষে আহূত এক সভায়। সে আর এক কাহিনী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *