আপনি খেলোয়াড় ছিলেন?
হ্যাঁ।
কী খেলতেন আপনি?
চেয়ারে সামান্য শব্দ করে উঠে দাঁড়ায় শ্যাম, ব্যাগাটেলি আর ক্যারাম।
লোকটা তাড়াতাড়ি নিজের চশমায় হাত দিয়ে টেবিলের কাগজপত্রের দিকে তাকায়, কই! এখানে লিখেছেন ক্রিকেট আর ফুটবল।
শ্যাম টেবিলের ওপর ঝুঁকে বলে, দেন হোয়াই ড়ু ইউ আসক!
লোকটা অবাক চোখে শ্যামকে একটু দেখে নিয়ে বলে, ওঃ! আচ্ছা, আপনি বসুন।
শ্যাম আবার বসে পড়ে। তার গাল গলা ভয়ংকর চুলকোচ্ছিল, অনেক দিন পর গালে ক্ষুর পড়ায় দাড়ির গোড়া ফুলে উঠেছে। সে গালে হাত বোলাতে থাকে। লম্বা সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে তিনজন। এ পাশে শ্যাম একা। দু’ধারে দু’জনের দিকে তাকায় না শ্যাম। মাঝখানে তার মুখোমুখি অল্পবয়সি যে লোকটা বসে আছে তার দিকেই চেয়ে থাকে। লোকটা কাগজপত্র থেকে আবার মুখ তোলে এবং প্রশ্ন করে, কভার পয়েন্টটা কোন অঞ্চল তা ডায়াগ্রাম না দেখিয়ে শুধু মুখে বুঝিয়ে দিন তো!
শ্যাম টেবিলের নীচে সামান্য পা নাচায়; নির্বিকারভাবে বলে, ভুলে গেছি।
লোকটা আবার মুখ খোলে, কথা বেরোবার আগেই শ্যাম তাড়াতাড়ি বলে, আমি সিভিল ড্রাফটসম্যান, আমার খেলা দিয়ে আপনারা কী করবেন?
লোকটা হতাশভাবে চেয়ারের পিছনে ঠেস দেয়, মুখের ওপর আড়াআড়িভাবে তুলে ধরে একটা পেনসিল, তারপর চিন্তান্বিতভাবে তার দিকে চেয়ে থাকে।
এইবার ডান দিক থেকে ইংরিজিতে প্রশ্ন আসে, হু ইজ ডিন রাস্ক?
শ্যাম এতক্ষণে দেখে লোকটাকে। আধবুড়ো, মাথায় টাক, মোটা গোঁফ আর ঠান্ডা কূটনৈতিক হাসি তার মুখে।
শ্যাম মাথা ঠান্ডা রেখে বলে, আমি রিপোর্টার নই। তারপর কোলে রাখা ড্রইংয়ের ফাইলটা তুলে টেবিলে রাখে, তোমরা আমার ড্রইং দেখেছ।
লোকটা তেমনি ঠান্ডা হাসি হাসে, আমরা একজন আপ-টু-ডেট লোক চাই, শুধু ড্রাফটসম্যান নয়। তোমার কাগজপত্রে লেখা আছে সেইন্ট অ্যান্ড মিলারে তুমি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের চাকরি করতে, ড্রাফটম্যানের নয়। প্রশ্নের উত্তর দাও।
শ্যাম দ্রুত চিন্তা করে যায়। কিছুই মনে পড়ে না তার। মাথার ভিতরে ঘোলা জল টলমল করে ওঠে। তবু সে মাথা ঠাণ্ডা রেখে বেপরোয়াভাবে বলে, তিনজন ডিন রাস্ক আছে। কোনজনের কথা জিজ্ঞেস করছ?
লোকটা সামান্য থমকে গিয়ে বলে, বাকি দুজন কে?
শ্যাম চোখ বুজে আন্দাজে বানিয়ে বলে, একজন নিউজিল্যান্ডের ভলিবল খেলোয়াড়, অন্যজন অস্ট্রেলিয়ান কেমিস্ট।
লোকটা সামান্য দুলে ওঠে, অ্যান্ড দি থার্ড ওয়ান?
অসহায়ভাবে লোকটার দিকে চেয়ে থাকে শ্যাম, তারপর আস্তে আস্তে বলে, আমি জানি না। দি থার্ড ওয়ান মাস্ট বি আনইম্পর্ট্যান্ট।
কিন্তু তুমিই বলেছ তিনজন আছে। সুতরাং আর-একজন কে তা তোমার জানা উচিত। কিন্তু তুমি জানো না।
শ্যাম মাথা নাড়ে, না। তারপর আস্তে আস্তে বলে, ডিন রাস্ক নামে কেউ আছে কি না আমি জানি না, যেমন ডিন রাস্কও জানেন না শ্যাম চক্রবর্তী বলে কেউ আছে কি না। ইট ইজ মিউঁচুয়্যাল ইগনোর্যান্স স্যার!
তারপর আর কোনও শব্দ হয় না। অনেকক্ষণ চুপচাপ কেটে যায়। শ্যাম তিনজনকেই নীরবে লক্ষ করে। বাঁ দিকে কালো রোগা মাঝবয়সি মাদ্রাজি ভদ্রলোক বোধহয় কম দামি অফিসার, সারাক্ষণ লোকটি তার ওপরওয়ালাদের সামনে মাথা নিচু করে আছে, একটিও কথা বলেনি। সামনে মুখোমুখি বসা অল্পবয়সি বাঙালি লোকটি ছটফটে, অহংকারী, খুব তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে যেতে চায়। অনেকটা তার মতো। ডান দিকের আধবুড়ো লোকটিই সবচেয়ে শান্ত। মুখে হাসি, তবু পাথরের মতো অনড় মুখ, একটিও পেশি নড়ে না। বোঝা যায় না কোন দেশি লোক। আস্তে আস্তে শ্যামের হাই উঠতে থাকে, শরীর এলিয়ে আসে। শ্যাম জানে এরা কুকুরের মতো সতর্ক, খরগোশের মতো উৎকর্ণ লোক পছন্দ করে। তবু সে সাবধান হয় না। মাথা এলিয়ে দেয় চেয়ারের পেছনে, হাই তোলে, চোখ রগড়ায়।
মুখোমুখি বসা লোটা হঠাৎ মুখ তুলে বলে, আচ্ছা, আপনি আসতে পারেন।
শ্যাম ধীরে সুস্থে ওঠে, দরজার দিকে এগোয়। তারপর মাঝপথে সে দাঁড়িয়ে পড়ে দরজাটা ডান দিকে সরে গেছে। একটু ইতস্তত করে শ্যাম, তারপর ডান দিকে ঘুরে এগোতে চেষ্টা করে। তারপরই বুঝতে পারে বৃথা চেষ্টা, দরজাটা চক্রাকারে ধীরে ধীরে বাঁ দিকে সরে যাচ্ছে। বড় অদ্ভুত। সে আবার দাঁড়ায়। তার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সে চোখ বুজে কয়েক পা হাঁটে। চোখ খুলে দেখে সেক্রেটারিয়েট টেবিলটার মুখোমুখি সে দাঁড়িয়ে আছে। ও-পাশের তিনজন সকৌতুকে তাকে দেখছে। সামান্য লজ্জা বোধ করে শ্যাম। তিনজনের দিকে চেয়ে একটু হেসে অনাবশ্যক কথা বলে, আমার ড্রইং আপনারা দেখেছেন, আমার কাগজপত্রও, আমাকেও। এখন জিজ্ঞেস করি এ-চাকরিটা কি আমার হতে পারে? বলতে বলতে সে এক-পা এক-পা করে পিছু হটে যায়। মাঝখানের আর বাঁ দিকের লোক দু’জন কথা বলে না, সম্ভবত তার অবস্থা দেখে অস্বস্তি বোধ করে চোখ সরিয়ে নেয়। ডান দিকের আধবুড়ো লোকটা স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, শান্ত গলায় বলে, সাইকোলজিক্যালি ইউ আর আনফিট ফর দি জব।
পিছনে হাত বাড়িয়ে শ্যাম দরজার গোল হাতলটা হাতে পায়, তারপর ‘ইয়াঃ বলে হেসে ওঠে। ইচ্ছে করে এগিয়ে গিয়ে সে লোকটার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে, আমি জানতুম তুমিই এদের মধ্যে সবচেয়ে পাকা। আমি হলে তোমাকেই নিয়ে নিতুম আমার কোম্পানিতে।
ঝট করে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে শ্যাম। রুমালে মুখ মোছে। খোলা বারান্দায় একটু দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর আস্তে দীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে শ্যাম। এবার তার দিক ঠিক থাকে, পা ফেলতে গোলমাল হয় না। বস্তুত চাকরিটা হল না বলে সে খুব স্বস্তি বোধ করতে থাকে, তার চোখেমুখে হাওয়া লাগে।
বস্তুত সে বুঝতে পারে, তার আর কিছুই করবার নেই।