আনিস অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে ভয়ঙ্কর একটা রাগের ভঙ্গি করতে। যা দেখে তার আট বছরের ছেলে টগর আঁৎকে উঠবে এবং মুখ কাচুমাচু করে বলবে, আর করব না বাবা। টগর যা করেছে তাকে ক্ষমা করার কোন প্রশ্নই উঠে না। সে ফায়ার ব্রিগেড খেলা খেলছিল। আগুন ছাড়া একরম খেলা হয় না, কাজেই অনেক কষ্টে সে বিছানার চাদরে আগুন ধরাল। তাকে সাহায্য করছিল তার ছোট বোন নিশা যার বয়স পাঁচ হলেও এই জাতীয় কাজ খুব ভাল পারে। খেলার দুটি অংশ, প্রথম অংশে বিছানার চাদর এবং জানালার পর্দায় আগুন লেগে যাবে, নিশা তার খেলনা টেলিফোন কানে নিয়ে বলবে, হ্যালো, আমাদের বাসায় আগুন লেগে গেছে। তখন শুরু হবে খেলার দ্বিতীয় অংশ–টগর সাজবে ফায়ার ম্যান। বাথরুম থেকে নল দিয়ে সে পানি এনে চারদিকে ছিটিয়ে আগুন নেভাবে। বেশ মজার খেলা।
খেলার প্রথম অংশ ভালমত শুরু হবার আগেই ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেল। তিন তলার ভাড়াটে ছুটে এলেন। একতলা থেকে বাড়িওয়ালা এলেন এবং ঘন ঘন বলতে লাগলেন, কি সর্বনাশ! কি সর্বনাশ।
আনিস গিয়েছিল বাড়ির খোজে। বাড়িওয়ালা নোটিশ দিয়েছে। গত মাসেই বাড়ি ছাড়ার কথা। এখনো কিছু পাওয়া যায়নি বলে বাড়ি ছাড়া যাচ্ছে না। বাড়িওয়ালার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এবার তিনি আর মুখের কথা বলে সময় নষ্ট করবেন না। পাড়ার ছেলেপুলে দিয়ে তুলে দেবেন। গত সপ্তাহে খুব ভদ্র ভাষায় এ জাতীয় সংগীত দেয়াও হয়েছে।
সারাদিন বাড়ি খুঁজে ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে বাসায় ফিরে টগর এবং নিশার নতুন কীর্তি শোনার পরে মেজাজ ঠিক থাকার কথা নয়। আনিসের মেজাজ যথেষ্টই খারাপ, কিন্তু তা সে ঠিক প্রকাশ করতে পারছে না। টগরের গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়া খুবই প্রয়োজন, হাত উঠছে না। বাচ্চা দুটির মা এক বছর আগে মারা গেছে। মা নেই দুটি শিশুর উপর রাগ করার কিংবা তাদের শাসন করা বেশ কঠিন ব্যাপার। আনিসের বেলায় তা আরো কঠিন কারণ রাগ তার স্বভাবে নেই। সে এক দৃষ্টিতে টগরের দিকে তাকিয়ে আছে। টগর খানিকটা অস্বস্তি বোধ করছে। তবে খুব ঘাবড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে না।
টগর!
জি বাবা!
টগর যা করে নিশার ঠিক সেই জিনিসটিই করা চাই, কাজেই সেও বলল, জ্বি বাবা।
আনিস বলল, নিশা মা, তুমি এখন কোন কথা বলবে না। টগরের সঙ্গে আমার খুব জরুরি কথা আছে। ওকে আমি যা বলব তা খুব মন দিয়ে শুনবে।
টগর!
ঘরে আগুন লাগিয়েছিলে?
নাতো–বিছানার চাদরে লাগিয়েছিলাম। আর নিশাকে বলেছিলাম জানালার পর্দায় লাগাতে।
কি জন্যে?
আমরা ফায়ার সার্ভিস ফায়ার সার্ভিস খেলছিলাম।
খেলতে আগুন লাগে?
অন্য খেলায় লাগে না। ফায়ার সার্ভিস খেলায় লাগে। আগুন না লাগলে নেভাব কি করে?
আমি খুব রাগ করেছি। টগর। এত রাগ করেছি যে আমার গা কাঁপছে রাগে।
কই বাবা, গা তো কাঁপছে না।
তোমরা দুজন খুবই অবাধ্য হয়েছে। আমার কোন কথা তোমরা শোন না। রোজ অদ্ভুত অদ্ভুত সব খেলা খেল। দুদিন আগে দোতলার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়লে।
দোতলার ছাদ থেকে তো লাফ দেই নি। গ্যারাজের উপর থেকে লাফ দিয়েছি। নিচে বালি ছিল। একটুও ব্যথা পাইনি। বালি না থাকলে লাফ দিতাম না।
তোমাদের কখনো আমি কোন শাস্তি দেই না বলে এই অবস্থা হয়েছে। আজ তোমাদের শাস্তি দেব।
কি শাস্তি?
তুমি নিজেই ঠিক কর কি শাস্তি। আমি কিছু বলব না।
এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকব বাবা?
বেশ দাড়াও।
টগর এবং নিশা দুজনই উঠে এক পায়ে দাঁড়িয়ে গেল। দেখা গেল শাস্তি গ্রহণে দুজনেরই সমান আগ্রহ। এই শাস্তিতে তারা বেশ মজা পাচ্ছে বলেও মনে श्ल। মিটিমিটি হাসছে–
টগর!
জ্বি বাবা!
একটা কথা তোমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে কথাটা হচ্ছে–
আনিস তার দীর্ঘ বাক্য শেষ করতে পারল না, বাড়িওয়ালার ভাগ্নে এসে বলল, আপনাকে মামা ডাকে। আনিস দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ওঠে দাঁড়াল। বাড়িওয়ালার সঙ্গে বকবক করতে তার মোটেই ইচ্ছা করছে না। উপায় নেই, ইচ্ছা না করলেও বকবক করতে হবে।
আনিসের বাড়িওয়ালার নাম মির্জা সুলায়মান। ভাড়াটেদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাল। শুধু ভাল না, বেশ ভাল। সুলায়মান সাহেবের ব্যবহার অতি মধুর। হাসি হাসি মুখ না করে তিনি কোন কথা বলেন না। ভাড়াটেদের যখন ডেকে পাঠান। তখন বসার ঘরের টেবিলে নানান ধরনের খাবার দাবার তৈরি থাকে।
আনিস বাড়িওয়ালার বসার ঘরে ঢুকে দেখল টেবিলে ঠাণ্ড পেপসির গ্লাস, প্লেটে ফ্ৰট কেক। সুলায়মান সাহেবের বয়স ষাটের কাছাকাছি হলেও তিনি তার সব ভাড়াটেদের ডাকেন— বড় ভাই। কেউ এই নিয়ে কিছু বললে তিনি বলেন, এটা হচ্ছে আমার দস্তুর। আমার পিতাজীর কাছ থেকে শিখেছি। পিতাজী সবাইকেই বড় ভাই ডাকতেন।
সুলায়মান সাহেব তার দস্তুর মত আনিসকে দেখে হাসি হাসি মুখ করে বললেন, বড় ভাই সাহেব আছেন কেমন?
জি ভাল।
আপনার পুত্ৰতো সর্বনাশ করে দিয়েছিল। দোতলায় উঠে দেখি বুন্দা বুন্দা ধোয়া। কোথায় আমাকে দেখে ভয় পাবে তা না উল্টা ছেলে আমাকে বলেআপনি এখন যান, আমরা খেলছি। আপনাকে দেখে মনেই হয় না যে আপনার এমন বিছু ছেলেমেয়ে আছে।
আনিস। গম্ভীর গলায় বলল, আপনি আপনার বাবার মত হয়েছেন, সবাই সে রকম হয় না।
খুবই খাটি কথা। তাছাড়া বড় ভাই সাহেব একটা ব্যাপার কি জানেন? অল্প বয়সে মা মারা গেলে ঘাড়ের একটা রাগ তেড়া হয়ে যায়। ওদের তাই হয়েছে। রাগ হয়ে গেছে তেড়া।
হতে পারে।
এদের সামলাবার জন্যে আপনার একটা বিবাহ করা দরকার। ঘরের শাসন হচ্ছে আসল শাসন। নেন কেক মুখে দেন। ফ্রেঞ্চ বেকারীর কেক। একশ টাকা পাউন্ড।
আনিস কেক মুখে দিল। সুলায়মান সাহেব মধুর গলায় বললেন, অনেক পুরুষ আছে যারা মনে করে সংসারে সৎ মা এলে ছেলেপুলেদের উপর অত্যাচার হবে। কথা ঠিক। অত্যাচার হয়। তবে বুঝে সুঝে বউ আনলে হয় না।
আমি বুঝে সুঝেই আনব।
বুদ্ধি কম এমন মেয়ে বিবাহ করতে হবে। বুদ্ধি কম মেয়ে মুখের একটা মিষ্টি কথাতেই খুশি হয়। এদের খুশি করা খুব সোজা। নিউমার্কেট থেকে আসার পথে এক টাকা দিয়ে একটা ফুলের মালা কিনে নিয়ে গেলেন— এতেই খুশি আর বৌ যদি বুদ্ধিমতী হয় তাহলে কিছুতেই খুশি হবে না। জ্বলিয়ে মারবে। বোকা স্ত্রী সংসার হচ্ছে সুখের সংসার।
আনিস বলল, বোকা মেয়ে পাওয়াইতো মুশকিল। সব মেয়েরই বুদ্ধি বেশি।
বড় ভাই সাহেব, ভুল কথা বললেন, পুরুষের চেয়ে মেয়েদের বুদ্ধি অনেক কম।
তাই-না-কি?
হ্যাঁ। আমার মুখের কথা না, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। একজন পুরুষ মানুষের ব্ৰেইনের ওজন হচ্ছে ১,৩৭৫ গ্রাম। আর একজন মেয়ে মানুষের ১,২২৫ গ্রাম। একশ পঞ্চাশ গ্ৰাম।
এই তথ্য পেয়েছেন কোথায়?
খোঁজ-খবর রাখি বড় ভাই। একেবারে মুখতো না। কই, এখানে চা দিল না।
পেপসি খেলামতো আবার চা কেন?
পেপসি খেলেন পানির বদলে। চা ছাড়া নাস্তা শেষ হয় না-কি? হয় না।
আনিস নাস্তার শেষে চা-এর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। সুলায়মান সাহেব বললেন, বড় ভাই সাহেব, এবার একটু কাজের কথা বলি।
বলুন।
ফ্ল্যাটটা যে বড়ভাই ছেড়ে দিতে হয়।
ছেড়ে দেব। বাড়ি খুঁজছি। বিশ্বাস করুন খুঁজছি। পাওয়া মাত্র ছেড়ে দেব।
বুধবারের মধ্যেই যে ছেড়ে দিতে হয় ভাই সাহেব। আমি একজনকে জবান দিয়ে ফেলেছি, সে বুধবারে বাড়িতে উঠবে। জবান তো বড় ভাই সাহেব রক্ষা করতে হয়।
আমি যদি এর মধ্যে কিছু খুঁজে না পাই— আমি যাব কোথায়?
আমি আমার একটা ঘর ছেড়ে দিব। মেহমান হিসেবে কয়েকদিন থাকবেন।
চা এসে গিয়েছে। আনিস চা-য়ে চুমুক দিল। কি বলবে ভেবে পেল না।
বড় ভাই সাহেব।
জি বলুন।
বলতে শরম লাগছে–না বলেও পারছি না। আপনার কাছে তিন মাসের ভাড়া পাওনা আছে। বলেছিলেন একটা ব্যবস্থা করবেন।
অবশ্যই করব।
তা করবেন জানি। কিন্তু ভাইসাহেব যাওয়ার আগে পরিশোধ করে যাওয়াটা কি ভাল না। একবার চলে গেলে আপনার হয়ত মনে থাকবে না।
আনিস তিক্ত গলায় বলল, এই মুহূর্তে আমার হাত একেবারে খালি তবে স্ত্রীর কিছু গয়না আছে। ঐগুলো বিক্রি করে হলেও আপনার পাওনা মিটিয়ে দেব।
এইটা খুব ভাল কথা বলেছেন। যে পুরুষ ঋণ রেখে এক কদম পা ফেলে না, সে হচ্ছে সাচ্চা পুরুষ। বড় ভাই সাহেব, আমার একটা পরিচিত গয়নার দোকান আছে। আপনি যদি চান আপনাকে নিয়ে যাব।
ঠিক আছে যাব আপনার সঙ্গে।
কাল বিকালে কি আপনার সময় হবে?
হবে। এখন তাহলে উঠি? না-কি আরো কিছু খাওয়াবেন?
সুলায়মান সাহেব হো হো করে অনেকক্ষণ হাসলেন। যেন এরকম মজাদার কথা অনেকদিন শোনেননি। আনিস শীতল গলায় বলল, এরকম শব্দ করে হাসবেন না। সুলায়মান সাহেব। শব্দ করে হাসলে হার্টে প্রেসার পড়ে। আপনার যা বয়স তাতে হার্টে বাড়তি প্রেসার দেয়াটা ঠিক হবে না।
সত্যি বলছেন?
হ্যাঁ সত্যি। হাসাহাসি একেবারেই করবেন না। সব সময় মন খারাপ করে বসে থাকবেন তাহলেই দেখবেন হার্ট ভাল থাকবে, অনেক দিন বাঁচতে পারবেন।
অনেক দিন বাঁচতে ইচ্ছা করে না। যত তাড়াতাড়ি কবরে যেতে পারব ততাই ভাল।
তোড়াতাড়ি কবরে চলে গেলে এই যে টাকা পয়সা রোজগার করছেন সেগুলো ভোগ করবে। কে? ভোগ করবার জন্যেই তো আপনার দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা দরকার।
আপনি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন।
হ্যাঁ করছি।
হাসলে হার্টের উপর চাপ পড়ে ঐটাও তাহলে ঠাট্টা?
না। ঐটা ঠাট্টা না। ঐটা সত্যি। যে কারণে হাসি খুশী মানুষদের বেশি দিন বাঁচতে দেখা যায় না। বেঁচে থাকে খিটখিটে গম্ভীর মানুষজন। দেখেন না পৃথিবী ভর্তি বদমেজাজী বুড়ো-বুড়ি।
কথাটাতো ভাইসাহেব খুব ভুল বলেন নাই।
কথা আমি সচরাচর ভুল বলি না। আচ্ছা আজ তাহলে যাই। কাল সন্ধ্যায় দেখা হবে। এক সঙ্গে গয়নার দোকানে যাব।
ইনসাআল্লাহ।
হাসির ব্যাপারটা মনে রাখবেন। হাসি সম্পূর্ণ বন্ধ। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে হলে রাম গরুর ছানা হতে হবে।
নিজের ঘরে ঢুকে আনিসের মন খারাপ হয়ে গেল। টগর এখনো একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিশা রণে ভঙ্গ দিয়ে ছবি আঁকছে। বাবাকে দেখে নিশা বলল, টগর ভাইয়ার শাস্তি আর কতক্ষণ হবে বাবা?
আনিস বলল, শাস্তি শেষ।
টগর বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল। আনিস বলল, পা ব্যথা করছে?
হুঁ করছে।
আর কোনদিন ফায়ার ব্রিগেড খেলা খেলবে না তো?
টগর না সূচক মাথা নাড়ল। আনিস বলর, মাথা নাড়লে হবে না। বল, আর কোনদিন খেলিব না।
আর কোনদিন খেলিব না। ভেরি গুড। তোমরা এখন হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বস। আমি রান্না শেষ করি।
নিশা বলল, আমি কি তোমাকে সাহায্য করব বাবা?
না। সাহায্য লাগবে না। আজ তোমাদের কি খেতে ইচ্ছা করছে বল? ডিমের ভাজি না তরকারী?
টগর বলল, আমরা রোজ ডিম খাচ্ছি কেন বাবা?
ডিম রান্না সবচে সহজ এই জন্যে রোজ ডিম খাচ্ছি।
নিশা গম্ভীর গলায় বলল, আমরা পৃথিবীর সব ডিম খেয়ে শেষ করে ফেলছি তাই না বাবা?
হ্যাঁ তাই। এখন বই নিয়ে বস।
বই নিয়ে বসতে ইচ্ছা করছে না।
কি ইচ্ছা করছে?
নিশা অবিকল বড়দের মত গলায় বলল, কি যে ইচ্ছা করছে তাও তো জানি না।
আনিস হেসে ফেলল। তার ছোট মেয়েটি বড় মায়াবতী হয়েছে। কথা বলার কি অদ্ভুত ধরন। কোথেকে পেয়েছে এসব?
টগর বলল, আজ রাতে কি গল্প বলার আসর বসবে বাবা?
এখনো বুঝতে পারছি না। সম্ভাবনা আছে।
গল্প বলার আসর শেষ পর্যন্ত বসল না। নিশা ঘুমিয়ে পড়েছে। একা একা গল্প শুনতে টগরের ভালো লাগে না। অথচ তার ঘুমও আসছে না। আনিস তার পিঠে চুলকে দিল, মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, তাতেও কিছু হলো না। টগর চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। একটু পর পর বলছে— ঘুম আসছে না বাবা।
একেবারেই আসছে না?
না।
তাহলে আস নতুন ধরনের একটা খেলা দুজনে মিলে খেলি।
কি খেলা?
এই খেলাটার নাম হচ্ছে সত্যি-মিথ্যা খেলা। আমি তোমাকে প্রশ্ন করব তুমি মিথ্যা জবাব দেবে। দশটা প্রশ্ন করব। প্রতি বারই যদি মিথ্যা জবাব দিতে পার তাহলে তুমি জিতে যাবে। যেমন ধর আমি যদি জিজ্ঞেস করি, তোমার নাম কি? তুমি যদি বল টগর তাহলে তুমি হেরে যাবে। সব জবাব হতে হবে মিথ্যা।
এটাতো খুব সহজ খেলা বাবা।
মোটেই সহজ না। খুব কঠিন খেলা। কারণ মানুষ বেশিক্ষণ মিথ্যা কথা বলতে পারে না। পর পর দশটা মিথ্যা বলা মানুষের জন্যে খুব কঠিন। বেশির ভাগ মানুষই পারে না।
আমি পারব?
না তুমিও পারবে না। এসো শুরু করা যাক। রেডি-ওয়ান টু খ্ৰী— খোকা তোমার নাম কি— টগর?
জ্বি না। আমার নাম টগর না।
তোমার ছোট একটা বোন আছে না?
জ্বি না। আমার একটা ভাই আছে।
তুমি কি ক্লাস থ্রিতে পড়?
জ্বি না। আমি ক্লাস টেনে পড়ি।
তোমার কি তিনটা হাত আছে?
হ্যাঁ আমার তিনটা হাত আছে?
তুমি কি তোমার মা-কে খুব ভালবাস?
হ্যাঁ বাসি।
আনিস হেসে ফেলল। টগর মাথা নিচু করে ফেলেছে। আনিস বলল, দেখলে তো টগর, মাত্র পাঁচটা প্রশ্নেই তুমি সত্যি কথা বলে ফেললে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যা কথা বলা খুবই কঠিন।
টগর চাপা গলায় বলল, মিথ্যা কথা বলা কঠিন কেন বাবা?
কঠিন, কারণ মানুষকে মিথ্যা কথা বলার জন্য তৈরি করা হয়নি। তবু আমরা মিথ্যা কথা বলি। যখন বলি তখন আমাদের খুব কষ্ট হয়।
আমার তো কষ্ট হয় না। বাবা।
তুমি কি মিথ্যা কথা বল?
হ্যাঁ বলি। স্কুলে বলি।
আনিস উপদেশমূলক কিছু বলবে কি বলবে না। এই নিয়ে খানিকক্ষণ ভাবলা। শৈশবে নীতিকথার আসলে কি কোন গুরুত্ব আছে? একই পরিবারের চারটি ছেলেমেয়ে শৈশবে একই ধরনের নীতিকথা এবং উপদেশ শোনে কিন্তু বড় হয়ে চারজন চার রকমের হয়। আনিসের ধারণা শিশুরা বইয়ের উপদেশ গ্ৰহণ করে না। একটি শিশু অন্য একটি শিশুর কথা শুনে কিন্তু একজন বয়স্ক মানুষের কথা শুনে না। তাদের জগৎ ভিন্ন, তারা নিজেদের জগৎ থেকে শিক্ষা গ্ৰহণ করে।
টগর।
টগর জবাব দিল না। আনিস দেখল, টগর ঘুমিয়ে পড়েছে। তার নিজের চোেখও ঘুমে জড়িয়ে আসছে কিন্তু সে জানে বিছানায় শোয়া মাত্র ঘুম চলে যাবে। নানান উদ্ভট চিন্তা মাথায় ভর করবে। তারপর আসবে সুখময় কিছু কল্পনা। সেই কল্পনায় চব্বিশ বছর বয়েসী একজন তরুণী এসে ঘরে ঢুকবে। পান খাওয়ায় সেই তরুণীর ঠোঁট লাল হয়ে আছে। তরুণীটির নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। টলমলে চোখে স্নিগ্ধ ছায়া।
আনিস বিরক্ত হবার মত ভঙ্গি করে বলবে, আবার পান খেয়েছ?
তরুণীটি বলবে, হ্যাঁ খেয়েছি।
দাঁতগুলি নষ্ট করবে।
করলে করব। সারা দিনে একবার পান খাই তাতেই–
আচ্ছা যাও আর কিছু বলব না।
তোমার কি চা লাগবে?
হ্যাঁ।
ঘুমুতে যাবার আগে কেউ চা খায় এই প্রথম দেখলাম।
ঘুমুতে যাব তোমাকে কে বলল?
ঘুমুবে না?
নো ম্যাডাম। সারা রাত জাগব।
লেখালেখি? হ্যাঁ লেখালেখি। নতুন উপন্যাস শুরু করছি।
তুমি না বললে সোমবার থেকে শুরু করবে।
দুদিন আগেই শুরু করছি।
উপন্যাসের নাম কি?
ময়ূরাক্ষী। নামটা কেমন?
সত্যি জানতে চাও।
হ্যাঁ।
বললে রাগ করবে নাতো?
না–এর মধ্যে রাগ করার কি আছে?
নিউ এলিফেন্ট রোডের একটা জুতার দোকানের নাম ময়ূরাক্ষী।
আনিস তাকিয়ে আছে। তরুণী খিলখিল করে হাসছে। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। তবু সে হাসছে। কি অসাধারণ একটি দৃশ্য চমৎকার দৃশ্য তার জীবনে অভিনীত হয়েছে এই কথাটা আজ আর কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না। আজ মনে হয় রাত্ৰি নামে কোন তরুণীর সঙ্গে তার কোনদিন পরিচয় ছিল না। সবই কল্পনা সবই মায়া।