আজ সোমবার।
হাসপাতালে ভর্তি হবার দিন। আজকের দিনটি অন্য আর দশটি দিনের মতো নয়। একটু যেন অন্য রকম। আলো যেন অন্য দিনের চেয়ে স্নান। বাতাস ভেজাভেজা। মানুষের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে দিন বদলে যায় নাকি?
ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। শেভ করলাম। নতুন ব্লেড, খুব আরামের শেভ হল। দাঁত ব্রাশ করতে করতে করিম সাহেবকে বললাম, বেড টি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে, দিতে পারেন এক কাপ?
দুধ নেই। দুধ ছাড়া যদি চলে, দিতে পারি।
দুধ ছাড়াই দিন।
আজ হাসপাতালে যাওয়ার কথা না?
জ্বি।
কখন যাবেন?
তিনটার দিকে। রহমান গাড়ি নিয়ে আসবে।
বলতে বলতে আমার হাসি পেয়ে গেল। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্যে রহমান বেশ ছোটাছুটি করে গাড়ি যোগাড় করেছে, যেন হাসপাতালে যাওয়ার ব্যাপারটা গাড়ি ছাড়া হবার নয়। গাড়ি করেই যেতে হবে।
গাড়ির ব্যাপারে তার খুবই উৎসাহ। কিছু একটা হলেই সে ছোটাছুটি করে গাড়ি যোগাড় করে ফেলবে। এক বার মীরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে কয়েক জন মিলে যাওয়ার কথা। লাঞ্চ নিয়ে যাব। সারা দিন থাকব। সন্ধ্যাবেলা ফিরব। যাব পাঁচ নম্বর বাসে, ফিরবও বাসে। রওনা হবার কথা ভোর নটায়। দেখা গেল সাড়ে আটটায় রহমান ব্রিটিশ আমলের এক জীপ গাড়ি নিয়ে উপস্থিত। সে গাড়িতে দুটি সুন্দরী মেয়ে বসে আছে। মেয়েদের ছাড়া পিকনিক জমে না, এই জন্যে সে নাকি বহু ঝামেলা করে এদের যোগাড় করেছে। এরা দুজনেই রহমানের দূর সম্পর্কের আত্মীয়।
আমাদের জীপ গাড়ি টেকনিক্যালের সামনে এসে চার পায়ে দাঁড়িয়ে গেল। আর নড়ে না। হুড খুলে বহু খোঁচাখুঁচি, বহু ঠেলাঠেলি।
কিছুতেই কিছু হয় না। শেষ পর্যন্ত ঠিক করা হল, গাড়ি ফেলে রেখে গল্প করতে করতে হেঁটেই যাব। জেসমিন নামের মেয়েটি ঘাড় বাকিয়ে বলল, হিল পরে আমি হাঁটতে পারব না। আমি রিকশায় যাব।
রিকশা ঠিক করা হল। সে একা একা এরকম অচেনা জায়গায় যাবে না। অন্য মেয়েটি কোন এক বিচিত্র কারণে তার সঙ্গে যেতে রাজি নয়। ছেলেদের এক জনকে যেতে হয়। কে যাবে? মনসুর বলল, ফরিদ অসুস্থ মানুষ, ওকে রিকশায় তুলে দিলেই হয়।
জেসমিনের মুখ দেখে মনে হল ব্যাপারটা সে ঠিক পছন্দ করছে না। সে সম্ভবত যেতে চাচ্ছিল রহমানের সঙ্গে। কিন্তু ঐ মেয়েটি রহমানকে চোখে চোখে রাখছে।
রহমান আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সুপুরুষ। কী ভাবে কী ভাবে যেন বিদেশী ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি যোগাড় করে ফেলেছে। চেহারার জোর, বলাই বাহুল্য। বৎসরখানেক না ঘুরতেই শুনলাম তার নাকি একটা প্রমোশনও হয়েছে। এখন তার টেবিলে একটা পি বি এক্স না ডিরেক্ট লাইন। কারো টেলিফোনের দরকার হলে তার কাছে গেলেই হয়। শুধু সোমবার বাদ দিয়ে। কি জন্যে সোমবারটা বাদ কে জানে?
আমরা রিক্সায় উঠতেই রহমান বলল, ছাড়লাম তো দু জনকে, কি হয় কে জানে। সবাই হাসাহাসি করতে লাগল। জেসমিন দাতে দাত চেপে বলল, কি অসভ্যতা করছেন রহমান ভাই?
অসভ্যতা আমরা করলাম কোথায়? অসভ্যতা তো করছ তোমরা
আবার একটা হাসির দমকা উঠল। জেসমিন মুখ অন্ধকার করে বলল, এই রিক্সা চালাও, দাঁড়িয়ে আছ কেন?
পেছন থেকে ফজলু কী যেন বলল। অশ্লীল কিছু নিশ্চয়ই। কারণ ফজলু অশ্লীলতা ছাড়া কোনো রসিকতা করতে পারে না। তার প্রতিটি রসিকতাতেই মেয়েদের শারীরিক কিছু বর্ণনা থাকবেই।
কোনো অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে যাওয়া এই আমার প্রথম। হাতপা শিরশির করতে লাগল। আমি নিচু স্বরে বললাম, হুড তুলে দেব?
না, আমার দমবন্ধ লাগে।
মেয়েটি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হেঁটে গেলেই ভালো হত। আমার প্রতি ইঙ্গিত করে বলল কিনা বুঝতে পারলাম না। চুপ করে গেলাম। জেসমিন বলল, আপনার রোদ লাগলে হুড তুলে দেন।
না, আমার রোদ লাগছে না।
জেসমিন খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হেঁটে গেলে ভালো হত কেন বললাম, জানেন?
না।
বললাম, কারণ ওরা আজ সারা দিন আমাদের দু জনকে নিয়ে ঠাট্টা করবে। খুব ক্ষেপাবে।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ, নিজেই দেখবেন। আমি আসলে আসতে চাই নি। রহমান ভাই এত করে বললেন, তাই আসলাম–নয়তো আসতাম না।
আমি হালকা স্বরে বললাম, এসে ভালোই করেছেন, পিকনিকে দু-এক জন। মেয়ে না থাকলে খুব খারাপ লাগে।
জেসমিন ঘুরেফিরে রহমানের কথা বলতে লাগল। এক জন সুন্দরী মেয়ের মুখে অন্য এক জন পুরুষের কথা শুনতে ভালো লাগে না। আমি হ্যাঁ-হুঁ দিয়ে যেতে লাগলাম।
রহমান ভাই আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আমার খালাতো ভাইয়ের দিক থেকে।
ও আচ্ছা।
আমাদের বাসায় অবশ্যি রহমান ভাইয়ের যাতায়াত তারও আগে থেকে। আমরা একপাড়ায় থাকি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। মালিবাগে, ওয়ারলেস অফিসের কাছে, ওয়ারলেস অফিস দেখেছেন আপনি?
হ্যাঁ।
ওর উত্তর দিকে। আমাদের অবশ্যি ভাড়াবাড়ি, রহমান ভাইয়ের মতো নিজের বাড়ি নয়।
ঐ বাড়ি রহমানদের নিজের নাকি?
হ্যাঁ, আপনি কি ভেবেছিলেন ভাড়াবাড়ি?
হ্যাঁ।
না, ভাড়া না, রহমান ভাইয়ের দাদা বানিয়েছিলেন।
মেয়েটি আমাকে মোটই পছন্দ করছিল না, কিন্তু তবুও অনর্গল তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথা বলে যেতে লাগল। এই অল্প সময়ের মধ্যে আমি জেনে ফেললাম ওর এক মামাতো বোনের ইউট্যারাস অপারেশন হয়েছে। এখন আর তাদের বাচ্চা কাচ্চা হবে না। অথচ ভদ্রমহিলার খুব বাচ্চার শখ। ঘরভর্তি শুধু বাচ্চাদের ছবি। আর ওর বরটি এতই অমানুষ যে দ্বিতীয় বার বিয়ের কথা ভাবছে। ছেলেরা খুব হৃদয়হীন হয়। নিজেদের ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারে না।
রিকশা থেকে নামবার সময় পেরেকে লেগে মেয়েটির শাড়ি অনেকখানি ছিঁড়ে গেল। তার মুখ মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকার হয়ে গেল। কাদো-কাদো গলায় বলল, এখন বাসায় গিয়ে আমি বলব কী?
বাসায় কিছু বলতে হবে নাকি?
বলতে হবে না? শাড়িটা আমার নাকি? কার শাড়ি?
ছোটআপার শাড়ি। রাজশাহী সিক। এক দিনও পরে নি। সে আজ আমাকে মেরেই ফেলবে।
ছিঁড়েছে যে, এটা না বললেই হয়। ভাঁজ করে রেখে দেবেন।
ঠাট্টা করছেন? এরকম অবস্থায় কেউ ঠাট্টা করে?
মেয়েদের ব্যাপার আমি ভালো জানি না। হয়তো নতুন শাড়ি ছিঁড়ে ফেলা একটা ভয়াবহ ব্যাপার। মেয়েটির চোখে জল ছলছল করছে। কেঁদেই ফেলবে কিনা কে জানে। বিচিত্র কিছু নয়।
বোটানিক্যাল গার্ডেনে জেসমিনের সঙ্গে আমার আর কোন কথা হয় নি। সবার হাসিঠাট্টা হজম করে দূরে দূরেই থেকেছি। কিন্তু আধ-ঘন্টা রিকশায় পাশাপাশি বসার মধ্যে অদ্ভুত কোনো ম্যাজিক আছে। আমি সত্যি সত্যি ওর প্রেমে পড়ে গেলাম।
এর পর ছুটিছাটা হলেই মগবাজার ওয়ারলেস অফিসের সামনে ঘঘারাঘুরি করতাম, যদি কখনো দেখা হয়। আশেপাশের যে-কয়টি হলুদ রঙের বাড়ি আছে। সব কটির সামনে দিয়ে কত বার যে গিয়েছি! দেখা হয় নি কখনো। শুধু রহমানের সঙ্গে দেখা হল। সে অবাক হয়ে বলল, এই দিকে কোথায়?
এক জনকে খুঁজছি।
বলে পাশ কাটিয়ে চলে এসেছি, অথচ খুব সহজেই জেসমিনের ঠিকানা জিজ্ঞেস করা যেত। ইচ্ছা করে নি।
আমি চাচ্ছিলাম কারো সাহায্য নিয়ে নয়, নিজেই তাকে খুঁজে বার করি।
তারপর সত্যি সত্যি এক দিন দেখা হয়ে গেল। মেয়েদের সঙ্গে আমি কখনো সহজভাবে কথা বলতে পারি না, কথা জড়িয়ে যায়। কিন্তু আশ্চর্য, সে দিন নিউমার্কেটের সমস্ত ভিড় উপেক্ষা করে হাসিমুখে এগিয়ে বললাম, চিনতে পারছেন?
জেসমিন তাকিয়ে রইল অবাক হয়ে। মনে হল চিনতে পারছে না।
ঐ যে বটানিক্যাল গার্ডেনে গেলাম রহমানের সঙ্গে?
মনে আছে, মনে থাকবে না কেন?
জেসমিনকে আজ আর সেদিনের মতত রূপসী লাগছিল না। সাধারণ বাঙালী মেয়েদের মত দেখাচ্ছিল। সাজগোজ মেয়েদের সম্ভবত অনেকটা বদলে দেয়।
আমি অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বললাম, অনেক দিন থেকেই আপনাকে মনে মনে খুঁজছিলাম।
কেন? আপনার ছোটআপা কী বলল, সেটা জানতে চাচ্ছিলাম। ছোটআপ আবার কী বলবে? কিসের কথা বলছেন?
ঐ যে শাড়ি ছিঁড়ে গেল। আপনি সত্যি সত্যি জানতে চান?
হ্যাঁ চাই।
আপা কিছু বলে নি। ওর অনেক শাড়ি। ছিঁড়ে গেলে কী আর হবে। ইচ্ছা করে তো ছিড়ি নি।
জেসমিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, শুধু এই কথা জিজ্ঞেস করবার জন্যে আপনি আমাকে খুঁজছিলেন?
হ্যাঁ।
বাসায় গেলেন না কেন? ১২১ নং মালিবাগ। বাসার সামনে একটা নারকেল গাছ আছে। রহমান ভাইকে জিজ্ঞেস করলেই ঠিকানা জানতে পারতেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন না কেন?
আমি কিছু বললাম না। জেসমিন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। আমার কিছু বলার ছিল না। কিংবা ছিল, বলতে পারলাম না। ঠিক সময়ে আমরা ঠিক কথাটা বলতে
পারি না। ভুল কথাটা শুধু মনে আসে।
চমৎকার লাগল লেবু চা। আরেক কাপ খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। করিম সাহেবকে দ্বিতীয় কাপের কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা, বুঝতে পারছি না। তিনি হয়তো বিরক্ত হবেন।
জানালার পর্দা সরাতেই দেখলাম আচার-খাওয়া মেয়েটি স্কুলের জামাকাপড় পরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এদের বাড়ির সামনে দিয়ে এত বার আসা-যাওয়া করি, কখনো তার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয় না। একবার দেখা হলে বুঝতাম, সত্যি সত্যি নীলিমার সঙ্গে এই মেয়েটির চেহারার মিল আছে। কিনা। ওদের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব নাকি? বত্রিশ বৎসরের এক জন প্রৌঢ় তের-চৌদ্দ বছরের একটি বালিকার মুখ দেখবার জন্য দাঁড়িয়ে আছে, ব্যাপারটা খুব হাস্যকর। মাঝে মাঝে আমরা সবাই বোধ হয় এরকম উদ্ভট কিছু করি। আমি রাস্তায় নেমে এলাম। এত ভোরে মেয়েটি কোথায় যাচ্ছে? মর্নিং শিফট স্কুল নাকি?
আনন্দ বোর্ডং হাউসের মালিক আমাকে দেখে বললেন, মালিকুম ফরিদ সাহেব, কোথায় যান?
নাশতা খাব। দেখি রেস্টুরেন্ট খুলেছে কিনা।
আজ মনে হয় সকালে উঠেছেন?
জ্বি। আজ হাসপাতালে যাচ্ছি। গণি সাহেব, আপনার রেন্ট কত হয়েছে হিসাব করেন। দিয়ে যাব।
এখনই কেন? মাস শেষ হোক, তারপর দেবেন।
অসুখটা ভালো না। হাসপাতাল থেকে নাও ফিরতে পারি।
গণি সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। এই লোকটিকে আমি বেশ পছন্দ করি। নির্বোধ ভালো মানুষ টাইপের লোক। এ রকম মানুষ বোর্ডংয়ের ব্যবসা করে টিকে আছে কী ভাবে কে জানে।
ফরিদ সাহেব।
জি।
এই রকম কথা বলা ঠিক না। আল্লাহ্ নারাজ হন। হায়াত মউত মানুষের হাতে না। আল্লাহ্ পাকের হাতে।
তা ঠিক। গণি সাহেব, আমার চিঠিপত্র রেখে দেবেন। যদি আসে–আসবে না হয়তো।
জি আচ্ছা।
আর শোনেন ভাই, আমি এখন যাচ্ছি, বারটার দিকে ফিরব। আমার বন্ধুবান্ধবদের আসার কথা, ওদের বসতে বলবেন। চাবিটা রাখেন।
গণি সাহেব বললেন, এক কাজ করেন, আমার রিকশা নিয়ে যান। নানান জায়গায় যাবেন, সুবিধা হবে। এখন রিকশা পাওয়া ঝামেলা। অফিস টাইম।
গণি সাহেবের রিকশাটির পেছনে বড়ো বড়ো করে লেখা প্ৰাইভেট–এটা যে সাধারণ ভাড়া-খাটা রিকশা নয়, সেটা বোঝার জন্য। এটা বানানও হয়েছে। অন্য রকম ভাবে। দেখতে অনেকটা যাত্ৰাদলের সিংহাসনের মত। চড়তে বড়োই অস্বস্তি লাগে। সবাই দেখে তাকিয়ে তাকিয়ে।
রিকশায় উঠেই ঠিক করে ফেললাম, কোথায় কোথায় যাব। প্রথমে যাব আমার অফিসে। যাওয়ার দরকার নেই, আগেই ছুটি নিয়ে এসেছি–তবু একবার যাব। বড়ো ভাইয়ের বাসায় যাব। আমার এক ছোট মামা থাকেন ইন্দিরা রোডে, তাঁর কাছে যাব। তিনি বলে রেখেছেন আমাকে কিছু টাকা দেবেন। অনুর ওখানে গেলে ভালো হত, কিন্তু এখন আর নারায়ণগঞ্জ যাবার সময় নেই। অনুর বরকে টেলিফোনে বলা হয়েছে। সে জানিয়েছে আসবে। পাঁচটার সময় সরাসরি হাসপাতালে আসবে।
প্রথমে যাওয়া যায় কোথায়? বড়ো ভাইয়ের বাসায়। তার ছোট মেয়েটির জন্যে কিছু একটা নেওয়া দরকার। এই মেয়েটি আমার খুব ভক্ত। আমাকে চাচা ডাকে না, ডাকে ফরিদ মামা। মামাদের সঙ্গেই ওর যোগাযোগ বেশি, কাজেই সবাইকেই ভাবে মামা। মেয়েটির বয়স মাত্র চার বৎসর। কিন্তু অসম্ভব স্মৃতিশক্তি। তাকে যত উপদেশ দেওয়া হয়, সব সে গম্ভীর হয়ে আমাকে শোনায়। মাথা দুলিয়ে-দুলিয়ে এমনভাবে কথা বলে যে বড়ো মায়া লাগে। যেমন সে গম্ভীর হয়ে বলবে, ফরিদ মামা, টিভি বেশি দেখলে মাথা ধরে, চোখ খারাপ হয়। বেশি দেখা ভালো না। শুধু কার্টুন দেখতে হয়। কার্টুন দেখলে চোখ খারাপ হয় না। আর শোন মামা, বাইরের মানুষের সামনে নেংটো হয়ে আসা খুব খারাপ। সবাই তখন মন্দ বলবে। আর বিচানায় পেশাব করাও খারাপ। আর পেশাব বলাও খারাপ। বলতে হয় বাথরুম। তোমার যদি পেশাব পায়, তাহলে তুমি বলবে বাথরুম পেয়েছে। তাই না মামা?
বড়ো ভাইকে বাসায় পাওয়া গেল না। তাঁর এক শালীর গায়ে-হলুদ। দল বেঁধে সবাই গেছে নারিন্দা। আজ আর ফিরবে না। বিয়ের ঝামেলা চুকিয়ে ফিরবে। দু- তিন দিনের মামলা। মজিদের মা বলল, নারিন্দা যাইবেন ভাইজান?
না।
তয় বসেন। চা দেই, চা খান।
মজিদের মা কোনো এক বিচিত্র কারণে আমাকে খুব পছন্দ করে। যখনই। আসি, আমার সেবাযত্নের জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। হয়তো আমার মতো দেখতে তাঁর কোনো ছেলে ছিল। কোনো দিন জিজ্ঞেস করা হয় নি।
কোন শালীর বিয়ে, জান মজিদের মা? মধ্যমটার, বেণু আফার।
বেণুকে ঠিক চিনতে পারলাম না। বড় ভাইয়ের অনেকগুলি শালী–এবং সবাই বেশ রূপসী। প্রতি বছরই এদের কারো-না-কারো বিয়ে হচ্ছে। তবু সংখ্যায় কমছে না। এদের মধ্যে এক জন ছিল দেবীপ্রতিমার মতো।
মুখের দিকে তাকালেই মন খারাপ হয়ে যেত। লুরু, চোখ সব যেন তুলি দিয়ে আকা। আমি এক দিন ভাবীকে ঠাট্টা করে বলেছিলাম, এই মেয়েটির সঙ্গে আমার বিয়ের ব্যবস্থা করে দিন না ভাবী।
ভাবী রসিকতা বুঝতে পারলেন না। রেগেমেগে অস্থির হয়ে গেলেন, কী দেখে তোমার কাছে বোন বিয়ে দেব? কী আছে তোমার? টাকাপয়সা না থাকলে লোকজনের বিদ্যাবুদ্ধি থাকে, চেহারা থাকে। তোমার কোনটা আছে?
ঠাট্টা করছিলাম ভাবী।
না, ঠাট্টা তুমি করছ না। ঠাট্টা বোঝার বয়স আমার আছে। তুমি ওর কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাক, সেটা আমি জানি না ভাবছ? ঠিকই জানি।
দারুণ অস্বস্তিকর অবস্থা। কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার কথাটা ঠিক নয়। এক দিন নিউ মার্কেটের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন ভাবীর ঐ বোনটির সঙ্গে দেখা। দু-একটা কথাবার্তা বললাম এবং পৃথিবীর সমস্ত সুন্দরী মহিলার মতো তার ধারণা হল, আমি তার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এই গল্পই সে করেছে ভাবীর সঙ্গে।
ঘটনার এইখানেই শেষ নয়, বড়ো ভাই এক দিন হোস্টেলে এসে নানান রকম ভণিতা করে বললেন, এখন পড়াশোনার সময়, বিয়েটিয়ের কথা চিন্তা করা ঠিক না। পড়াশোনা আগে শেষ হোক। তাছাড়া দুই ভাইয়ের এক বাড়িতে বিয়ে করা ঠিক না। নতুন আত্মীয় করা দরকার। মহা ঝামেলা।
এক বার গিয়ে দেখলে হয় না কোন মেয়েটির বিয়ে হচ্ছে? নারিন্দা খুব একটা দুর কি? রিকশা তো আছেই।
রোদে কোনো তেজ নেই। আকাশে মেঘজমতে শুরু করেছে। আজও বোধ হয় ঝড়-বৃষ্টি হবে। এ বৎসর খুব ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। রিকশাওয়ালা বলল, এখন কুন দিকে যাইবেন?
মগবাজার চল। ওয়ারলেস অফিস।
এই রিকশাওয়ালা প্রফেশনাল নয়, চালাতে পারছে না। যেমে নেয়ে উঠেছে। উৎসাহেরও বেশ অভাব। চলছে টিমে তেতালা ছাদে। তাকে দেখে মনে হয় না, সে কোনোদিন মগবাজার পৌঁছবে।
জেসমিন তো বাসায় নেই। আপনি কে?
সত্যি তো, আমি কে? বুড়ো ভদ্রলোক তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। উনি নিশ্চয় জেসমিনের বাবা। এই দুপুরবেলা ঘামতে ঘামতে আমি উপস্থিত হয়েছি। সঙ্গত কারণেই ভদ্ৰলোক শঙ্কিত বোধ করছেন।
আপনি কে? জেসমিনকে কী জন্য দরকার?
সত্যি তো, ওকে আমার কী জন্যে দরকার? আমি থেমে থেমে বললাম, আমি খুব অসুস্থ। আজ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছি। আমার তলপেটে একটা অপারেশন হবে।
ভদ্রলোক অবাক হয়ে আমাকে দেখছেন।
জেসমিনকে খবরটা দেবেন দয়া করে।
তা দেব, কিন্তু আপনার নাম কী? পরিচয় কী? জেসমিনকে কী ভাবে চেনেন?
দেবার মতো কোনো পরিচয় আমার নেই। আমার নাম ফরিদ।
এই নাম বললে জেসমিন আপনাকে চিনবে?
জানি না। চিনতেও পারে।
আপনার অসুখটা কী?
ক্যানসার। ড়ুওডেনালে ক্যানসার।
ভদ্রলোক তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি হাসতে চেষ্টা করলাম।