আকাশে বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব
আকাশে বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব। বিজলি চমকাচ্ছে। বাতাস ভরি। মাটির ভেতর থেকে অদ্ভুত গন্ধ আসছে। ছোট বাচ্চাদের গায়ের গন্ধের মতো গন্ধ। প্ৰবল বর্ষণের আগে আগে এ রকম গন্ধ পাওয়া যায়। হাসান রিকশা থেকে নেমেছে। তবে মনস্থির করতে পারছে না। রিকশাটা ছেড়ে দেবে না রিকশা করেই ফিরে যাবে। বৃষ্টি নামলে আর রিকশা পাওয়া যাবে না। রিকশাওয়ালারা এখন স্বাস্থ্যসচেতন। ভিজে জবজবা হয়ে তারা রিকশা চালায় না। বৃষ্টির সময় হুড তুলে সেটির ওপর আরাম করে বসে বিড়ি টানে। কেউ যদি জিজ্ঞেস করেভাড়া যাবেন? বিরক্ত হয়, জবাব দেয় না।
হাসান আকাশের দিকে তাকাল–কতক্ষণে বৃষ্টি নামবে বোঝার চেষ্টা। হাস্যকর চেষ্টা তো বটেই। আবহাওয়া বিষয়ে তার কোনো জ্ঞান নেই। আকাশে। কত রকমের মেঘ হয় ছােটবেলা পড়েছিল-ৰূপ মেঘ, পালক মেঘ…। তার আবহাওয়াবিদ্যা এই পর্যন্তই। রিকশাওয়ালা টুনি টুন করে দুবার ঘণ্টা বাজিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, খাড়াইয়া আছেন ক্যান? ভাড়া দেন। হাসান ভাড়া দিয়ে দিল। পাঁচ টাকা ভাড়া, দুটাকা বাড়তি দিল। আজ তার পকেটে টাকা আছে। সে এখন দাঁড়িয়ে আছে তিতলীদের বাসার গেটের সামনে। গেট খুলে ভেতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না বুঝতে পারছে না। তার হাতে ঘড়ি নেই, তবে রাত মনে হয় ভালোই হয়েছে, দশটার কম না। এত রাতে তিতলীর বাসায় ঢুকলে সবাই সরু চোখে তাকাবে। না ভুল বলা হলো, সবাই তাকবে না তিতলীর বাবা মতিন সাহেব তাকাবেন। সেটা কি ভালো হবে? হাসান ক্লান্ত পায়ে গেট খুলে ভেতরে ঢুকল, ঠিক করল গেট থেকে বাড়ির দরজা পর্যন্ত যেতে যদি তার গায়ে কোনো বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে তাহলে সে ফিরে আসবে। এতদূর এসে তিতলীকে এক পলকের জন্যে না দেখে গেলে খুব খারাপ লাগবে। লাপ্তক। পৃথিবীতে বাস করতে হলে অনেক খারাপ লাগা সহ্য করে বাস করতে হয়। হাসান বাড়ির দরজা পর্যন্ত চলে এসেছে, গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে নি। এখন কলিংবেল টেপা যেতে পারে।
কলিংবেলে হাত দিয়েই হাসান ভালো একটা শক খেল। ডান হাতটা বিনবিশ্বন করে উঠল। প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবার মতো অবস্থা। শক খেলেও বেল ঠিকই বাজল। ভেতর থেকে ধমকের সুরে তিতলীর বাবা বললেন, কে? হাসান জবাব দিল না, সে শকের ধকল সামলাচ্ছে। হাতের বিনবিন ভাব এখানো যাচ্ছে না।
তিতলীদের বাসার কলিংবেলটা অনেকদিন থেকেই নষ্ট। কিছুদিন কলিংবেলটার ঠিক ওপরে হাতে লেখা একটা কাগজ স্কচটেপ দিয়ে আটকানো ছিল। কাগজে লেখা–
কলিংবেল নষ্ট। দয়া করে হাত দেবেন না।
কাগজটা এখন নেই। আর থাকলেও লাভ হতো না। হাসান ঠিকই বেল টিপত। তিতলীদের বাসার আশপাশে এলে তার মাথা খানিকটা এলোমেলো হয়ে যায়। সম্ভবত ব্লাডপ্রেসারঘটিত কোনো সমস্যা। হয় প্রেসার বেড়ে যায় কিংবা কমে যায়।
হাসান কড়া নাড়ল। তিতলীর বাবা মতিন সাহেব একবার ‘কে’ বলে চুপ করে আছেন। তাঁকে মনে করিয়ে দেয়া দরকার, যে কলিংবেল টিপেছিল। সে চলে যায় নি। এখনো আছে। মতিন সাহেব। আবারো ধমকের গলায় বললেন, কে? হাসান জবাব দিল না। বন্ধ দরজার দুপাশ থেকে বাক্যালাপ চালানোর অর্থ হয় না। হাসান বলবে, আমি। মতিন সাহেব বলবেন, আমিটা কে? হাসান বলবে, জ্বি আমি হাসান। কোনো মানে হয় না। এরচে’ বিশ্ৰীভাবে কয়েকবার কড়া নেড়ে চুপ করে থাকা ভালো।
দরজার ছিটিকিনি খোলার শব্দ হচ্ছে। এ বাড়ির দরজার ছিটিকিনিগুলোও নষ্ট। সহজে খোলা যায় না, ধস্তাধস্তি করতে হয়। হাসান ভেবেছিল মতিন সাহেব দরজা খুলে শ্লেষজড়ানো বিরক্ত গলায় বলবেন, ও আচ্ছা তুমি? এত রাতে কী মনে করে? হাসানকে অবাক করে দিয়ে দরজা খুলল তিতলী। এত রাতেও সে বেশ সেজেণ্ডজে আছে। চুল বাঁধা। পরনে চাঁপা রঙের শাড়ি। ঠোঁটে লিপস্টিকও আছে। গলায় চিকমিক করছে সরু চেইন। মনে হয় কোনো বিয়েবাড়ি থেকে দাওয়াত খেয়ে এসেছে। তিতলী গভীর বিস্ময় নিয়ে বলল, আরো তুমি? এত রাতে তুমি কোথেকে?
রাত খুব বেশি নাকি?
সাড়ে ন’টা বাজে।
ভেতর থেকে মতিন সাহেব বললেন, কার সঙ্গে কথা বলছিস? তিতলী লাজুক গলায় বলল, হাসান ভাইয়া এসেছেন। বাবা। মতিন সাহেব বিরক্ত স্বরে বললেন, ও।
তিতলী হাসানের দিকে তাকিয়ে হাসল। তার এত আনন্দ লাগছে। আনন্দে চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। শুধু পানি জমা না–আনন্দে শরীরও কাঁপছে। এই তো সে দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়েছে। আঙুলগুলো সত্যি সত্যি কাঁপছে।
বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ভেতরে এস।
হাসান খানিকটা অস্বস্তি নিয়েই ঘরের ভেতর ঢুকল। এত রাতে এসে তিতলীকে বিব্রত করার কোনো মানে হয় না। তিতলীদের বসার ঘরের অবস্থা শোচনীয়। পুরনো সোফায় কয়েক জায়গায় গদি ছিঁড়ে তুলা বের হয়ে পড়েছে। একটা সোফার স্প্রিং নষ্ট। বসলে তলিয়ে যেতে হয়। দুটা বেতের চেয়ার আছে। চেয়ারের নানা জায়গা থেকে পেরেক বের হয়ে আছে। অসাবধানে চেয়ার থেকে উঠতে গেলে প্যান্ট বা শার্ট ছিড়বেই। হাসানের কালো প্যান্টটা এভাবেই ছিঁড়েছে। ঘরের অর্ধেকটা অংশ জুড়ে খাট পাতা। খাটে তোশক বিছানো আছে। তোশকের ওপর বেশির ভাগ সময় কোনো চাদর থাকে না। আজ অবশ্যি আধ্যময়লা একটা চাদর আছে। দেয়ালে গত বছরের একটা ক্যালেন্ডার। জুন মাস বের হয়ে আছে। ক্যালেন্ডারের ছবিটা সুন্দর। হ্রদের জলে মানের পোশাক পরা এক তরুণী চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তরুণীর চোখ বন্ধ। হ্রদের জল যেমন নীল, তরুণীর স্নানের পোশাক তেমনি লাল। লাল-নীলে মিলে দারুণ একটা ছবি। ক্যালেন্ডারটার পাশেই একটা দেয়ালঘড়ি। ঘড়িটা আজ বন্ধ। সাতটা একুশ বাজছে। হাসান ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল, তিতলী এক গ্লাস পানি খাব।
তিতলী পানি আনতে গেল। খাবার ঘরের টেবিলে পানির জগ এবং গ্লাস রাখা আছে। তিতলী সেদিকে গেল না। বাবা খাবার টেবিলে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। তাঁর মুখ সন্ধ্যা থেকেই থমথমে। এখন সেই থমথমে ভাব আরো বেড়েছে। তাঁর সামনে পড়লে তিনি কঠিন চোখে তাকবেন। সব সময় কঠিন চোখ দেখতে ভালো লাগে না।
রান্নাঘরে তিতলীর মা সুরাইয়া ভাত বসিয়েছেন। মতিন সাহেবের জন্যে আলাদা করে। ভাত রাঁধতে হচ্ছে। তিনি আতপ চালের ভাত খান। সেই ভাত বািরকারে হতে হয়। ভাতের প্রতিটি দানা থাকবে আলাদা। একটার গায়ে আরেকটা লেগে থাকবে না। পাকা রাধুনির জন্যেও কঠিন ব্যাপার। সুরাইয়া পাকা রাধুনি নন। স্বামীর ভাত রান্নার সময় তিনি ভয়ে অস্থির হয়ে থাকেন। তিতলী রান্নাঘরে ঢুকতেই সুরাইয়া মেয়ের দিকে তাকালেন। তিতলী লজ্জামাখা গলায় বলল, হাসান ভাইয়া এসেছে মা। বলতে গিয়ে ত্রিতলীর কথা জড়িয়ে গেল, গাল খানিকটা লালচে হয়ে গেল। ব্যাপারটা সুরাইয়ার চোখ এড়াল না। সুরাইয়া ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ওকে খেয়ে যেতে বল।
দরকার নেই মা।
তিতলী পানির গ্লাস নিয়ে বের হয়ে গেল। কেমন হড়বড় করে বের হচ্ছে। দরজার চৌকাঠে ধাক্কা খেয়ে খানিকটা পানি সে ছলকে ফেলে দিল। মেয়েটার অস্বাভাবিক অস্থিরতা দেখে সুরাইয়ার মন কেমন করতে লাগল। হাসানকে দেখলেই মেয়েটা এমন অস্থির হয়ে পড়ে কেন? কী আছে হাসানের মধ্যে? এ বছরও এম.এ. পরীক্ষা দেয় নি। প্রতি বছর শোনা যায় পরীক্ষা দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দেয় না। হাসানের চেহারাও ভালো না। কেমন বোকা বোকা ভাব। সংসারের অবস্থা সাধারণ, ভাইয়ের সঙ্গে বাস করছে। চাকরি বাকরি কোনোদিন পাবে। এ রকম মনে হয় না। আজকাল চাকরি বাকরি হলো ধরাধরির ব্যাপার। হাসানের ধরাধরি করার কেউ নেই।
ভাতের পানি ফুটছে। সুরাইয়া ভাত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর কেন জানি মনে হচ্ছে আজ ভাতে কোনো গণ্ডগোল হবে। ভাত গায়ে গায়ে লেগে যাবে। তিতলীর বাবা খেতে বসে নানান ধরনের কটু কথা বলবেন। সুরাইয়া তিনবার ‘ইয়া জালজালালু ওয়াল ইকরাম’ বলে হাঁড়ির ঢাকনা তুলে ফুঁ দিলেন।
হাসান এক চুমুকে পানিটা শেষ করে গ্লাস তিতলীর দিকে বাড়িয়ে বলল, তিতলী যাই।
তিতলী কিছু বলল না। মাথা নিচু করে হাসল। এমনভাবে হাসল যেন হাসান দেখতে না পায়। হাসানের অনেক বিচিত্র অভ্যাসের একটা হচ্ছে তিতলীদের বাড়িতে এসেই সে প্রথমে এক গ্লাস পানি খেতে চাইবে। পানি খাওয়া শেষ হলে বলবে–তিতলী যাই। মুখে বলবে কিন্তু যাবার কোনো লক্ষণ দেখাবে না।
মা তোমাকে খেয়ে যেতে বলেছে।
আরে না।
আরে না কেন? খেয়ে যাও না। মেনু অবশ্য ভালো না–চোখে দেখা যায় না। এমন সাইজের কই মাছ। বাবার ধারণা কই মাছ সাইজে যত ছোট হয় তত স্বাদ বেশি হয়।
হাসান কিছু বলল না। তিতলী বলল, তুমি যে আজ আসবে এটা কিন্তু আমি জানতাম।
আমি আসব। কীভাবে জানতে?
আজ ঘুম থেকে উঠেই তিনটা শালিক দেখেছি। মুখ ধুতে কলঘরের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি বারান্দায় কাপড় শুকোবার দড়িতে দুটা শালিক বসে আছে। তারপর কী হয়েছে শোন–মুখ ধুয়ে ফিরে এসে দেখি আরো একটা শালিক এসে বসেছে। মোট তিনটা শালিক। তখনই আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম–আজ তুমি আসবে।
তিনটা শালিক দেখলে কেউ আসে?
তিতলী গানের মতো গুনগুন করে বলল–
‘One for Sorrow
Two for joy
Three for letter
Four for boy.
প্রথমে দুটা শালিক দেখলাম— তার মানে আনন্দের কোনো ব্যাপার ঘটবে, তারপর দেখলাম তিনটা, অর্থাৎ চিঠি পাব। তুমি যখনই আস একটা চিঠি নিয়ে আসা। কাজেই আমি পুরোপুরি নিশ্চিত তুমি আসবে। শাড়ি পরে কেমন সেজে আছি দেখছি না। রাত সাড়ে ন’টার সময় কেউ এমন সেজেণ্ডজে থাকে? এটা নতুন শাড়ি, আগে কখনো পরি নি। রংটা সুন্দর না?
খুব সুন্দর।
না দেখেই তুমি বললে খুব সুন্দর। বল তো কী রঙের শাড়ি?
চাপা রং।
গুড। হয়েছে। আমার চিঠি এনেছ?
হুঁ।
দাও।
হাসান পাঞ্জাবির পকেট থেকে চিঠি বের করল। তিতলীর হাতে দিতে দিতে বলল, আজ উঠি {
তিতলী উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, এসেই উঠি উঠি করছি কেন? মা তোমাকে ভাত খেয়ে যেতে বলেছে।
তিতলী চিঠি মুঠোয় লুকিয়ে তার ঘরে চলে গেল। তার ঘর হলেও সে একা ঘুমোয় না। এই ঘরে দুটা খাট পাতা। দুটা খাটে তারা তিন জন ঘুমোয়। সে আর তার ছোট দু বোন–নাদিয়া, নাতাশা। নাদিয়া-নাতাশা আজ বড় ফুফুর বাসায় বেড়াতে গেছে, রাতে থাকবে। তিতলীরও যাবার কথা ছিল। ভোরবেলায় তিনটা শালিক না দেখলে সে অবশ্যই যেত। বড় ফুফুর বাসায় যেতে তার সবসময় ভালো লাগে।
চিঠি খুলে তিতলীর মন খারাপ হয়ে গেল। এতটুকু একটা চিঠি-এক সেকেন্ডে পড়া হয়ে যাবে। তিতলী চিঠিটা গালে চেপে দাঁড়িয়ে রইল। শরীর কেমন ঝিমঝিম করছে, হাত-পা কাঁপছে। আশ্চৰ্য, এ রকম হচ্ছে কেন? হাসানের চিঠি তো সে আজ নতুন পড়ছে না। অনেকদিন থেকেই পড়ছে। হাসানের এই চিঠিটা তিয়াত্তর নম্বর চিঠি। চিঠিটা পড়তে ইচ্ছে করছে না। পড়লেই তো ফুরিয়ে যাবে। এখন থাক, রাতে বিছানায় শুয়ে আরাম করে পড়া যাবে। ইচ্ছে করলে চিঠিটা বুকের ওপর রেখে ঘুমিয়েও পড়তে পারে। নাদিয়ানাতাশা কেউ নেই। ঘরটা আজ তার একার। আচ্ছা মানুষটা লম্বা একটা চিঠি লিখতে পারে না? উপন্যাসের মতো লম্বা একটা চিঠি। সে পড়তেই থাকবে পড়তেই থাকবে চিঠি ফুরাবে না। এমন লম্বা চিঠি যে রাতে ঘুমোতে যাবার সময় চিঠি পড়তে শুরু করল ভোরবেলা আযানের সময় চিঠি শেষ হলো।
তিতলী।
তিতলী চমকে উঠল। এমনভাবে চমকাল যে গালে ধরে রাখা চিঠি মেঝেতে পড়ে গেল। দরজার কাছে সুরাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন। তিতলীর বুক ধকধক করছে। মা কি চিঠিটা দেখে ফেলেছেন? মনে হয় না। চিঠি দেখলে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তিনি তাকিয়ে আছেন তিতলীর দিকে। মা অবশ্যি দেখেও না দেখার ভান করতে পারেন। এইসব ছোটখাটো ভান মা খুব ভালো করেন।
সুরাইয়া বললেন, ঘরে একা একা কী করছিস?
কিছু করছি না মা।
তিতলী কী করবে বুঝতে পারছে না। পা দিয়ে চিঠিটা চেপে ধরবে? না যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে? মা সামনে থেকে না। সরলে সে ঘর থেকে বের হতে পারবে না। আগে চিঠিটা লুকোতে হবে।
তোর বাবাকে ভাত দিচ্ছি। তোর বাবার খাওয়া হয়ে যাক তারপর তুই হাসানকে খাইয়ে দে। এত রাতে না খেয়ে যাবে কেন?
আচ্ছা।
সুরাইয়া সরে যেতেই তিতলী ছোঁ মেরে চিঠিটা তুলে বালিশের নিচে লুকিয়ে ফেলল। তার বুকের ধুকধুকনি এখানো যায় নি। তার কেন জানি মনে হচ্ছে মা চিঠিটা দেখেছে।
মতিন সাহেব প্লেটে ভাত নিতে নিতে বললেন, এতদিনেও সামান্য ভাত ঠিকমতো রাঁধা শিখলে না। এটা এমন কী জটিল কাজ যে কুড়ি বছরেও শেখা যাবে না।
সুরাইয়া চুপ করে রইলেন। মতিন সাহেব বললেন, তোমাকে পোলাও-কোরমা, কোপ্তা-কালিয়া তো রাঁধতে বলি না। সামান্য ভাত–এটাও ঠিকমতো রাঁধবে না।
সুরাইয়া কোটা থেকে এক চামচ ঘি ভাতের ওপর ছড়িয়ে দিলেন। মতিন সাহেব আগুনগরম ভাতের প্রথম কয়েক নলা ঘি দিয়ে খান। এই ঘি দেশ থেকে আসে।
মতিন সাহেব বললেন, রাতদুপুরে হাসান এসেছে কেন? তিতলীও দেখি ওর সঙ্গে গাবের আঠার মতো লেগে আছে। দু’জনে মিলে গুটুর গুটুর গল্প। ঘরের ভেতর বাং সিনেমা আমার খুব অপছন্দ। রাতদুপুরে সে আসবেই বা কেন?
সুরাইয়া ক্ষীণ গলায় বললেন, আমি আসতে বলেছি।
তুমি আসতে বলেছ? কেন?
শুনেছিলাম হাসানের মা’র খুব অসুখ ছিল–এখন কেমন তা জানার জন্যে আসতে বলেছিলাম।
কোনো কিছুরই বাড়াবাড়ি ভালো না। মা’র অসুখের খবর ছেলেকে রাতদুপুরে ঘরে এনে জিজ্ঞেস করতে হবে? মা’র অসুখের তুমি করবে। কী? তুমি সিভিল সার্জনও না, পীর ফকিরও না।
সুরাইয়া ক্ষীণ স্বরে বললেন, আরেক চামচ ঘি দেব?
দাও। আর শোন, তোমাকে বলছি, তোমার কন্যাদেরও বলছি–বাড়াবাড়ি আমার পছন্দ না। বাড়াবাড়ি আমি খুব অপছন্দ করি। হাসানের মা’র খবর জেনেছ?
হুঁ।
তাহলে ওকে বসিয়ে রেখেছি কেন–চলে যাক না।
ভাত খেয়ে যেতে বলেছি।
ভাত খেয়ে যেতে বলেছ কেন?
সুরাইয়া প্ৰায় অস্পষ্ট গলায় বললেন, এত রাতে না খায়ে যাবে!
মতিন সাহেব প্লেটে ডাল নিতে নিতে বললেন, তুমি সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করা। বড়াবাড়ির ফল কখনো শুভ হয় না। হাসানের মা’র হয়েছে কী সেটা তো বললে না।
সুরাইয়া সমস্যায় পড়ে গেলেন। মেয়েকে বাঁচানোর জন্যে তিনি সামান্য মিথ্যা বলেছেন। মিথ্যা বলাটা ঠিক হয় নি। একটা মিথ্যা বললে পরপর কয়েকটা মিথ্যা বলতে হয়। সুরাইয়া ইতস্তত করে বললেন, জ্বর।।
জ্বর শুনে একেবারে ছেলেকে খবর দিয়ে নিয়ে এসেছি। টাইফয়েড-টয়েড হলে তো গুষ্ঠীসুদ্ধা খবর দিয়ে নিয়ে আসতে। আমাকে বল তো–এই বাড়াবাড়ির মানে কী?
আরেকটা মাছ নাও। আগেই ডাল নিলে কেন?
মতিন সাহেব আরেকটা মাছ নিলেন। জনপ্ৰতি একটা করে কই মাছ তিনি হিসেব করে নিয়ে এসেছেন। দুই মেয়ে তাদের ফুফুর বাড়িতে গেছে। দুটা মাছ বেঁচে গেল। তিনি একটা নিতে পারেন। তারপরেও হাসানের জন্যে একটা থাকবে। মতিন সাহেব খাওয়া শেষ করে শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আজ তিনি একা শোবেন। সুরাইয়া তার মেয়ের সঙ্গে ঘুমোবে। আঠার বছরের মেয়েকে কখনো একা ঘরে শুতে দিতে নেই। আঠার বছরের মেয়ে হলো সাক্ষাৎ আগুন। আগুনের সঙ্গে সব সময় পানি রাখতে হয়। মেয়ের মা হলো সেই পানি। আগুন-পানি একসঙ্গে থাকলে বিপদ থাকে না।
হাসান লজ্জিত মুখে খেতে বসেছে। সুরাইয়া তিতলীকে বললেন, তুই খেতে বসে যা।
তিতলী বলল, আমি তোমার সঙ্গে খাব মা।
তিতলীর চোখ জ্বলজ্বল করছে। মনে মনে মাকে সে অনেকবার ধন্যবাদ দিয়েছে। মা এই অল্প সময়ের মধ্যে অনেক পদের খাবার করে ফেলেছে। বেগুন ভাজা, ডিম ভাজা, পটল ভাজা। সুরাইয়া বললেন, তুই হাসানকে দেখেশুনে খাওয়া; আমি দেখি তোর বাবার কিছু লাগে কি না।
তিতলী মনে মনে বলল, মা তুমি এত ভালো কেন? আমি কোনোদিনও তোমার মতো ভালো মেয়ে হতে পারব না। হাজার চেষ্টা করলেও পারব না।
হাসান কিছু খেতে পারছিল না। একটু ডিম ভেঙে মুখে দিল। বেগন ভাজা দিয়ে ভাত মেখে এক পাশে সরিয়ে রাখল।
তোমার প্রাইভেট টিউশ্যানি কেমন চলছে?
ভালো।
আর ওই যে জীবনী লেখার কাজ। লিখছ?
হুঁ।
ভদ্রলোকের নাম যেন কী?
হিশামুদ্দিন।
তাঁকে তুমি বল না কেন একটা চাকরি যোগাড় করে দিতে। তাঁকে বল–স্যার আমি চাকরিও করব। আর ফাঁকে ফাঁকে আপনার জীবনীও লিখব।
হাসান জবাব দিল না। তিতলীর খুব ইচ্ছে করছে হাসানকে একটু ছুঁয়ে দেখতে। সাহসে কুলোচ্ছে না, কখন হুট করে মা ধুকে পড়বেন। তাছাড়া হাত ছয়ে দেখতে হলে অজুহাত লাগে। তেমন কোনো অজুহাতও মাথায় আসছে না। ‘তোমার গালে এটা কী?’ এই বলে কি গালটা ছুঁয়ে দেখা যায় না?
তিতলী বলল, খাচ্ছ না কেন?
রুচি হচ্ছে না। জ্বর আসছে বোধহয়।
দেখি তো জ্বর কিনা!
তিতলী হাসানের কপালে হাত রেখে চমকে উঠল। জ্বরে কপাল পুড়ে যাচ্ছে। এত জ্বর নিয়ে কেউ খেতে বসে? তার উচিত গায়ে চাদর জড়িয়ে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকা। জ্বর নিয়ে তার আসার দরকার ছিল কী। সে তো তাকে আসার জন্যে খবর দেয় নি।
তোমাকে খেতে হবে না। তুমি হাত ধুয়ে ফেল।
হাসান সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। বেসিনের কাছে গিয়ে হাত ধুয়ে ফেলল। তিতলী বলল, লেবু দিয়ে এক গ্লাস শরবত বানিয়ে দেব?
না।
জ্বর নিয়ে আসার দরকারটা ছিল কী?
তোমার টাকাটা নিয়ে এসেছি।
টাকার জন্য কি আমি মরে যাচ্ছিলাম?
এখন দিতে না পারলে পরে হাত খালি হয়ে যাবে। দিতে পারব না।
সামান্য দুশ টাকা–আশ্চর্য! খবরদার ওই টাকা তুমি আমাকে দেবে না। তোমার কাছে থাকুক সুদে-আসলে বাড়ুক।
বমি বমি লাগছে। তিতলী ঘরে পান আছে?
আছে। তুমি বসার ঘরে গিয়ে বোস। এ কী! তুমিতো দেখি ঠিকমতো হাঁটতেও পারছি না। বাসায় যাবে কীভাবে?
অসুবিধা হবে না, রিকশা নিয়ে চলে যাব।
তিতলী চিন্তিত গলায় বলল, এক কাজ কর-আজ থেকে যাও। বসার ঘরের খাটে মশারি খাটিয়ে দিচ্ছি। এত জ্বর নিয়ে তুমি কোথায় যাবে?
আরে না, তুমি কী যে বল! তোমার বাবা যদি ভোরবেলা উঠে দেখেন আমি শুয়ে আছি–তিনি খুব ঠাণ্ডা মাথায় আমার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে দেবেন।
আমি মাকে বলি। মাকে বললেই মা ব্যবস্থা করে দেবে।
উনাকে কিছু বলবে না।
মা এত জ্বর নিয়ে তোমাকে কিছুতেই একা যেতে দেবে না।
উনাকে কিছু বলার দরকার নেই। তিতলী আমি যাচ্ছি।
পান। পান খাবে না?
উহুঁ।
বৃষ্টি পড়ছে তো, বৃষ্টির মধ্যে যাবে কীভাবে?
অসুবিধা হবে না।
জ্বর নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে?
হুঁ।
পাগলের মতো হুঁ হুঁ করছ কেন? ভালোমতো কথা বল।
হাসান হেসে ফেলল। তিতলীর অস্থিরতার মধ্যে শিশুসুলভ একটা ব্যাপার আছে, যা দেখতে ভালো লাগে।
হাসছ কেন?
জ্বর হলে হাসতেও পারব না?
জ্বর নিয়ে তুমি এলে কেন? কে তোমাকে আসতে বলেছে?
হাসান আবারো হাসল। তিতলী বিরক্ত মুখে বলল, কথায় কথায় হাসবে না।
আচ্ছা যাও হাসব না।
তিতলী হাসানের হাত ধরল। ধরেই থাকল। মা এসে দেখে ফেললে দেখবে। সে কিচ্ছু কেয়ার করে না। তার চোখে এখন পানি এসে গেছে। হাসানের হাত ধরলেই তিতলীর চোখে পানি আসে।
হাসান নিজেই দরজা খুলল। ভালো বৃষ্টি নেমেছে। বাতাস নেই। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সরাসরি নেমে আসছে, বাঁকাভাবে আসছে না। বাতাস থাকলে বৃষ্টি ধরে যেত— বাতাস জলভর্তি মেঘ উড়িয়ে নিয়ে যেত। আজ মেঘ উড়ে যাবে না। অনেক রাত পর্যন্ত বৃষ্টি পড়তেই থাকবে। আজ রাতটা হচ্ছে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর রাত। হাসান বৃষ্টির ভেতর এগোচ্ছে। দরজা ধরে তিতলী দাঁড়িয়ে আছে। হাসানের ইচ্ছা করছে। ঘাড় ফিরিয়ে একবার তিতলীকে দেখে। ইচ্ছাটা সে চাপা দিল। মেয়েটার কান্না কান্না মুখ না দেখাই ভালো। হাসানের শরীর কাঁপছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো অতিরিক্ত ঠাণ্ডা। রবফের কুঁচির মতো গায়ে এসে লাগছে। চামড়া ভেদ করে ঠাণ্ডা ঢুকে যাচ্ছে শরীরের ভেতর। এমন প্রবল বৃষ্টিতে সুপ্রিয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। হেঁটে হেঁটে পুরানা পল্টন থেকে ঝিকাতলা যাওয়া কি সম্ভব?
হাসান প্যান্টের পকেটে হাত দিল–টাকার বান্ডিলটা আছে তো? ডান প্যান্টের পকেটে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাধা তিন হাজার টাকা আছে। তিনটা পাঁচ শ টাকার নোট, বাকি সব এক শ টাকার নোট। সুমির মা তাঁকে তিন হাজার টাকা দিয়েছেন। সুমিকে তিন মাস ইংরেজি এবং অঙ্ক শেখানোর পারিশ্রমিক। টাকা দেবার সময় ভদ্রমহিলা শুকনো মুখে বললেন, টাকাটা দিতে দেরি হলো কিছু মনে করবেন না। আপনাকে তো আগেই বলেছিলাম মেয়ের বাবা প্রতি মাসে টাকা পাঠান না, তিন-চার মাস পর পর একসঙ্গে পাঠান। হাসান হাসিমুখে বলল, কোনো অসুবিধা নেই। একসঙ্গে পেয়ে আমার বরং সুবিধাই হলো।
টাকাটা গুণে নিন।
গুণতে হবে না।
গুণতে হবে না কেন? অবশ্যই গুণতে হবে। গুণুন।
ভদ্রমহিলা সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। হাসান টাকা গুণল। সব চকচকে নতুন নোট। নতুন নোটের গন্ধ শুকে ভালো লাগে। ভদ্রমহিলার সামনে এই কাজটা করা যাবে না।
হাসান সাহেব।
জ্বি।
আমি ঠিক করেছি এখন থেকে আমার মেয়েকে আমি নিজেই পড়াব। আপনার আর আসার দরকার নেই।
হাসানের মন খারাপ হয়ে গেল। তার তিনজন ছাত্রছাত্রী আছে। তিন জনের ভেতর সুমি মেয়েটা অন্যরকম। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে টুকটুক করে গল্প করে। প্রতিটি গল্পই খুব মজার। বেণি দুলিয়ে যখন গল্প করে তখন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়।
স্যার, আমার বাবার যে অসম্ভব বুদ্ধি এই গল্পটা কি আপনাকে বলেছি?
না তো!
বাবার অসম্ভব বুদ্ধি। বুদ্ধিতে বাবার নাম্বার হলো এক শ-তে এক শ দশ।
এক শ-তে এক শ দশ কীভাবে হয়?
সবার জন্যে হয় না, বাবার জন্যে হয়।
তাই বুঝি?
হাঁ তাই। বাবার বুদ্ধি যে এক শ-তে এক শ দশ এটা কে বলে জানেন স্যার?
না জানি না। কে বলে?
আমার মা বলেন। আর কী বলেন জানেন?
জানি না।
আর বলেন–মানুষের এত বুদ্ধি থাকা ভালো না।
তোমার বুদ্ধি কেমন?
এখন আমার বুদ্ধি কম, তবে আমি যখন বড় হব তখন আমার বুদ্ধিও হবে এক শতে এক শ দশ। স্যার আসুন। এখন আমরা পড়াশোনা করি। অনেকক্ষণ ধরে গল্প করছি তো মা টের পেলে রাগ করবেন।
হাসান টাকা গোণা শেষ করেছে। সুমির মা বললেন, রাবার ব্যান্ড দিচ্ছি, রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে নিন। আর শুনুন আমার মেয়েটা আপনাকে খুব পছন্দ করে। ওর বাবা বিদেশে–মেয়েটা একা একা থাকে, কথা বলার কেউ নেই। আপনি মাঝেমধ্যে এসে সুমিকে দেখে যাবেন।
জ্বি আচ্ছা। সুমিকে একটু ডাকুন। ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাই।
ওকে ডাকার দরকার নেই। আপনি চলে যাচ্ছেন সে জানে। কান্নাকাটি করতে পারে।
এতগুলো টাকা পকেটে থাকলে মনের বিষন্ন ভাব কেটে যায়! হাসানের কাটে নি। সে সুমিদের বাসা থেকে বের হবার সময় একবার ভাবল বলে–আমাকে কোনো টাকাপয়সা দিতে হবে না। আমি সপ্তাহে তিন দিন এসে আপনার মেয়েকে পড়িয়ে যাব। বলা হয় নি। লাজুক ধরনের মানুষ বেশির ভাগ সময়ই মনের কথা বলতে পারে না। মনের কথা হড়বড় করে শুধুমাত্র পাগলরাই বলতে পারে। পাগলরা সেই কারণেই মনে হয় সুখ।
বড় রাস্তায় নেমেই হাসান রিকশা পেয়ে গেল। একটা না, তিনটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। তিনজনই ঝিকাতলা যাবার জন্যে প্রস্তুত। হঠাৎ এ রকম সৌভাগ্যের কারণটা কী? সৌভাগ্যের পরই দুৰ্ভাগ্য আসে। তাকে কি পথে হাইজ্যাকার ধরবে? ধরতে পারে। ধরলে মানিব্যাগ হাতে তুলে দিতে হবে। মানিব্যাগে দুটা এক শ টাকার নোট আছে। ওরা হাসিমুখে মানিব্যাগ নিয়ে চলে যাবে। প্যান্টের পকেটে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা তিন হাজার টাকার খোঁজ করবে না। তবে হাইজ্যাকারদের সঙ্গে ঝড়বৃষ্টির রাতে দেখা হবার সম্ভাবনা প্রায় থাকেই না। ঝড়বৃষ্টির রাতে তারা মজা করে নেশাটেশা করে। বৃষ্টিতে ভিজে হাইক্যাকিং করা রতাদের পোষায় না।
জ্বর সম্ভবত আরো বেড়েছে। হাসানের শরীর থরথর করে কাঁপছে। মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে রিকশায় পড়ে গেলে সমস্যা হবে। হাসান দু হাতে রিকশার হুড ধরে আছে। রিকশাওয়ালার হয়তো ধারণা হয়েছে সে রিকশা চালাচ্ছে না, স্পোর্টস কার চালাচ্ছে। রাস্তার পানি কেটে রিকশা শাঁ শাঁ করে এগোচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে রাস্তা ডুবে আছে। গর্তখানা-খন্দ কিছুই চোখে পড়ছে না। হাসানের কেবলি মনে হচ্ছে কোনো একটা গর্তে পড়ে রিকশা উল্টে যাবে।
রিকশাওয়ালাকে রিকশা আস্তে চালাতে বলতেও ইচ্ছা করছে না। হাসানের মনে হচ্ছে–তার কথা বলার শক্তিও নেই।
ঝিকাতলা গলির মুখে এসে রিকশা থামল। এরচে’ ভেতরে আর যাবে না। গলিতে একহাটু পানি। ছোটখাটো একটা খাল তৈরি হয়ে গেছে। স্রোতের মতো পানি বইছে–কল কল শব্দও হচ্ছে।
হাসান রিকশা ভাড়া মিটিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখে রাবার ব্যান্ডে মোড়া তিন হাজার টাকার প্যাকেটটা নেই। রিকশার সিট খালি–পা রাখার জায়গাটাও খালি।
রিকশাওয়ালা বলল, ভাইজান আপনার কি শইল খারাপ?
হাসান ক্লান্ত গলায় বলল, হুঁ।
তাইলে টাইট হইয়া বহেন লইয়া যাই। জুম বৃষ্টি নামছে–সোভানাল্লাহ কী অবস্থা!
হাসান রিকশা থেকে নেমে গেল। রিকশায় টাইট হয়ে বসে থাকতে ইচ্ছা করছে না। গলির নোংরা পানিতে পা টেনে টেনে হাসান এগোচ্ছে। বৃষ্টি নেমেছে আকাশ ভেঙ্গে। হাসানের মনটা খুব খারাপ। তিন হাজার টাকা তার কাছে অনেক টাকা। এই টাকার শোক ভুলতে তার দীর্ঘদিন লাগবে। তিতলী দুশ টাকা পেত, সেই টাকাটাও তাকে দেয়া হলো না। আবার কবে তার হাতে টাকা আসবে কে জানে!
রাত যত বাড়ছে বৃষ্টি ততই বাড়ছে। তিতলী শুয়েছে জানালার পাশে। জানালা দিয়ে ছাট এসে তাকে প্রায় ভিজিয়ে দিচ্ছে। সুরাইয়া উঠে বসলেন, তিতলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, জানালাটা বন্ধ করে দে। ভিজে যাচ্ছিস তো!
ভিজছি না।
ভিজছিস না মানে–গা তো অর্ধেক ভেজা।
সুরাইয়া জানালা বন্ধ করার জন্য এগোলেন। তিতলী করুণ গলায় বলল, পায়ে পড়ি মা। জানালা খোলা থাকুক।
শেষে একটা অসুখ-বিসুখ বাঁধাবি।
আমার কিছু হবে না।
তিতলী গুটিসুটি মেরে মায়ের কাছে ঘেঁষে এল। সুরাইয়া মেয়ের গায়ের ওপর একটা হাত তুলে দিলেন। মেয়ের জন্য আজ তাঁর মনটা খুব কাঁদছে। তিতলীর সামনে ভয়াবহ দুঃসময়। তিতলীর বড় ফুফু তিতলীর বিয়ে প্রায় ঠিকঠাক করে ফেলছেন। ছেলে খুবই ভালো, জিওলজিতে মাস্টার্স করে ইউনিভার্সিটির লেকচারার হয়েছে। কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়েছে। বউ নিয়ে পিএইচডি করতে যাবে কানাডায়। তারা এসে কয়েক দফায় তিতলীকে দেখে গেছে। মেয়ে পছন্দ কি অপছন্দ হয়েছে এমন কিছু বলছে না।
তবে পছন্দ তো হয়েছে নিশ্চয়ই–নয়তো দফায় দফায় মেয়ে দেখত না। তিতলীর ফুফু আজ এসেছিলেন, তিনি সুরাইয়াকে আড়ালে ডেকে বলেছেন–ওরা খবর পাঠিয়েছে মেয়ে ওদের পছন্দ। তারপরেও একটু খোঁজখবর করছে–ফাইনাল কথা আগামী সপ্তাহে বলবে। আল্লাহ আল্লাহ কর।
যদি শেষ পর্যন্ত ওরা পছন্দ করে ফেলে তিতলীকে সেখানেই বিয়ে দিতে হবে। বড় ফু ইচ্ছার বাইরে যাবার ক্ষমতা তিতলীর নেই। তিতলীর কেন, এ বাড়ির কারেই নেই।
জ্বি মা।
হাসানের কি একটা এনজিওর চাকরি যে হবার কথা ছিল হয় নি?
হয়েছিল। সে যায় নি–গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হয়, বেতনও খুব কম।
কত বেতন?
আঠার শ টাকা।
বলিস কী! মাত্র আঠার শ টাকা?
হুঁ।
সুরাইয়া বিস্মিত হয়ে লক্ষ করলেন–তিতালরি শরীর কেমন যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। তিনি মেয়েকে আরো কাছে টেনে নিলেন।
তিতলী!
জ্বি মা।
কাঁদছিস নাকি?
তিতলী জবাব দিল না, তবে তার ফোঁপানির শব্দ শোনা গেল।
কাঁদছিস কেন?
তিতলী অস্পষ্ট স্বরে বলল, ফুফু তোমাকে আড়ালে নিয়ে কী বলেছে?
কিছু বলে নি।
আমি জানি বলেছে। মা শোন, আমি এখন বিয়ে করব না।
তোর ফুফু চাইলে না করবি কীভাবে?
তিতলী জবাব দিল না। তার শরীরের কাঁপুনি বন্ধ হয়েছে। সে নিজেকে সামলেছে। সুরাইয়া নরম গলায় বললেন, একটা মেয়ের জীবনে বিয়ে অনেক বড় ব্যাপার। বিয়ে হলো তার নিজের ঘর-সংসার। সুন্দর ঘর-সংসার সব মেয়েই চায়। চায় না?
হুঁ।
একটা বেকার ছেলেক বিয়ে করে অভাব-অনটনে সারা জীবন কাটানোর কোনো মানে হয় মা? প্রেমের চেয়েও টাকা-পয়সা অনেক বেশি জরুরি।
এখন এইসব কথা থাক মা। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাক।
তোর ফুফুরা তোর জন্যে যে বিয়েটা দেখছে সেটা যদি হয় তাহলে তোর জন্যে কিন্তু ভালো হবে। বরের সঙ্গে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াবি। ঢাকা শহরে নিজের বাড়িতে থাকবি…
মা চুপ কর তো।
টাকা-পয়সাটা যে কত জরুরি সেটা কি তুই আমাদের এই সংসার দেখেও বুঝতে পারছিস না? তোর বাবার চাকরি নেই–সংসার চালাতে হয় ফুফুদের দেয়া টাকা থেকে। তোর ফুফুদের কথা আমরা ফেলব কীভাবে? মা, ঘুমিয়ে পড়েছিস?
তিতলী জবাব দিল না। তার আবারো কান্না পাচ্ছে। খুব সাবধানে কাঁদতে হবে। মা যেন টের না পায়। মা টের পেলে মনে কষ্ট পাবে। তিতলী কাউকে কষ্ট দিতে চায় না। কষ্ট দিতে না চাইলেও তাকে কষ্ট দিতে হবে। হাসানকে ছাড়া সে বাঁচবে না। সে যদি পথে পথে চক্ষা করেও বেড়ায় তাতেও কোনো ক্ষতি নেই। দেশ-বিদেশ দেখে কী হবে? সে তার একটা জীবন হাসান ভাইয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে।
তাছাড়া কোনো একটা চাকরি তো হাসান ভাইয়ের অবশ্যই হবে। তখন তারা ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া করবে। দু কামরার ঘর হলেই তাদের চলবে। একটা শোবার ঘর, একটা বসার ঘর। এক চিলতে বারান্দা থাকলে খুব ভালো হয়। বারান্দায় সে ফুলের টব রাখবে। কোনো এক সময় তাদের সংসারে একটা বাবু আসবে। বাবুর নামও সে ঠিক করে রেখেছে।
সুরাইয়া ভারি ভারি নিঃশ্বাস ফেলছেন। তিতলীর ঘুম আসছে না। তার খুব অস্থির লাগছে। হাতের আঙুল কাঁপছে। হাসানের আশপাশে থাকলে তার এ রকম হয়। নির্জনে যখন হাসানের কথা ভাবে তখনো হয়। বিয়ের পরেও কি এ রকম হবে? নাকি সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে! বাবা যেমন মায়ের সঙ্গে কঠিন গলায় কথা বলেন, হাসানও তার সঙ্গে কঠিন গলায় কথা বলবে? না, তা সে কখনো হতে দেবে না। তিতলী খুব সাবধানে বিছানা থেকে নামল। হাসানের চিঠিটা আরেকবার পড়তে ইচ্ছে করছে। সে বারান্দায় চলে যাবে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিঠিটা আরেকবার পড়বে।
হাসানের চিঠিগুলো খুব সাদামাটা ধরনের হয়। আবেগের কথা কিছুই থাকে না, তবু চিঠি চোখের সামনে ধরলেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কেন এ রকম হয়?
তিতলী, কদিন ধরে আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। রাতে ঘুমোতে গেলেই উদ্ভট স্বপ্ন দেখি। একটা স্বপ্ন বেশ কয়েকবার দেখে ফেললাম-স্বপ্নটা হচ্ছে। আমি একদল হাসের সঙ্গে ঘুরছি। শামুক গুগলি খাচ্ছি। কী বিশ্রণী স্বপ্ন তাই না? আচ্ছা শোন হাস বানানে কি চন্দ্ৰবিন্দু আছে? যদি থাকে তুমি দিয়ে নিও।
ইতি
হাসান।
হাসান এই হচ্ছে চিঠি। কষ্ট করে কি আরো কয়েকটা লাইন লেখা যেত না? সে কি লিখতে পারত না
‘তিতলী শোন, আমি সারাক্ষণ তোমার কথা ভাবি। সারাক্ষণ আমার ইচ্ছা করে তোমার হাত ধরে বসে থাকতে। সেই দিন কবে। যে আসবে আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। চল আমরা কোর্টে বিয়ে করে ফেলি–তারপর যা হবার হবে।
না হাসান এই জাতীয় কথাবার্তা কখনো লিখবে না। তার চিঠিগুলো হলো কাজের চিঠির মতো।
তিতলী ঘুমোতে এল। বৃষ্টি আরো প্রবল হয়েছে। তারা যখন সংসার করবে। তখন বৃষ্টির রাতগুলো ঘুমিয়ে নষ্ট করবে না। তিতলী মায়ের গায়ে হাত উঠিয়ে দিল। সুরাইয়া মেয়েকে নিজের দিকে আরেকটু টেনে নিয়ে বললেন, চিঠিতে কী লেখা যে একটু পর পর পড়তে হচ্ছে? তিতলীর হাত-পা শক্ত হয়ে গেল। সুরাইয়া হাসলেন। অন্ধকারে সেই হাসি তিতলী দেখতে পেল না–সে গুটিসুটি মেরে মায়ের বুকের কাছে চলে এল।