০৩. অল্পবয়সী মেয়েরা সহজেই হতাশ হয়

অনেকক্ষণ ধরে ফোন বাজছে।

ফকনার বসে আছে পাশেই, কিন্তু রিসিভার তুলছে না। কানের পাশে ফোন বাজা একটি বিরক্তিকর ব্যাপার। কিন্তু লোকটি বিরক্ত হচ্ছে না। নির্বিকার ভঙ্গিতে সিগারেট ফুকছে। মাঝেমাঝে ভুরু কোঁচকাচ্ছে, যা থেকে মনে হতে পারে কোনো–একটি বিষয় নিয়ে সে চিন্তিত।

হার্ভি ফকনার হচ্ছে সেই জাতীয় লোক, যাদের বয়স বোঝা যায় না। এর জুলফির সমস্ত চুল পাকা। বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চান্নর মধ্যে হতে পারে। মাঝারি আকৃতির মানুষ। রোদে পোড়া তামাটে গায়ের রঙ। চোখ দুটি অস্বাভাবিক ছোট। বিড়ালের চোখের মতো জ্বলজ্বলে। সমস্ত মুখাবয়বে একটি ছেলেমানুষি ভাব আছে, তীক্ষ চোখের কারণে যা ্কখনো স্পষ্ট হয় না।

টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে। ফকনার রিসিভার এক বার তুলেই নামিয়ে রাখল। যদি ওপক্ষের প্রয়োজন খুব বেশি হয় আবার করবে।

প্রয়োজন বেশ আছে মনে হচ্ছে। আবার টেলিফোন বাজছে। ফকনার সিগারেটে শেষ টান দিয়ে রিসিভার তুলল।

হ্যালো।

হার্ভি ফকনার?

কথা বলছি।

আমি কি আপনার সঙ্গে একটি জরুরি বিষয় নিয়ে আলাপ করতে পারি?

তার আগে আপনার নাম বলুন।

নাম বললে আপনি আমাকে চিনতে পারবেন না।

আমি অপরিচিত কারো সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি না।

ফকনার নির্বিকার ভঙ্গিতে টেলিফোন নামিয়ে রাখল। এটা প্রায় নিশ্চিত, লোকটি আবার টেলিফোন করবে। প্লাগ খুলে রাখলে কেমন হয়? ফকনার দ্বিতীয় বার সিগারেট ধরিয়ে বাথরুমে ঢুকল। দু দিন শেভ করা হয় নি। গালভর্তি নীলচে দাড়ি। হেমিংওয়ের মতো দাড়ি রাখার একটা পরিকল্পনা ছিল। এখন মনে হচ্ছে সেটা সম্ভব নয়, গাল চুলকাচ্ছে। কিন্তু দাড়িগুলির ওপর একটি মায়া পড়ে গেছে। থাকুক না-হয় কিছুদিন, তারপর দেখা যাবে। ফকনার আয়নায় নিজের ছবির দিকে তাকাল। লোকটিকে চেনা যাচ্ছে না, যেন অপরিচিত কেউ।

টেলিফোন আবার বাজতে শুরু করেছে। বাজুক। তার এমন কোনো ঘনিষ্ঠ মানুষ নেই, যারা এরকম সাত-সকালে ব্যাকুল হয়ে টেলিফোন করবে। ফকনার মনেমনে বলল, আই হ্যাপেন্ড টু বি এ লোনলি ম্যান। কার কবিতা যেন এটা? এ্যান্থনি স্কীলম্যান?

মনে পড়ছে না। স্মৃতিশক্তি আগের মতো নেই। বাথরুমের বেসিনে গত রাতের অভুক্ত খাবারসুদ্ধ প্লেট পড়ে আছে। দূষিত একটা গন্ধ চারদিকে। মেঝেতে তিনটি বিয়ারের খালি ক্যান। লোনলি ম্যান হবার অনেক রকম ঝামেলা।

হেল্পিং হ্যান্ডজাতীয় কাউকে পাওয়া গেলে মন্দ হত না। ঘর পরিষ্কার করে রাখত। বললেই পারকুলেটর চালু করে কফি বানিয়ে আনত। কফির কথা মনে হতেই তার কফির তৃষ্ণা হল। ক্ৰীম, সুগারবিহীন র-কফি। ব্রাজিলিয়ান বিস্ থেকে টাটকা তৈরি, যার গন্ধেই স্নায়ু সতেজ হয়ে ওঠে।

টেলিফোন এখনও বাজছে। ফকনার বিরক্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল—

হ্যালো।

আমি লিজা, লিজা ব্রাউন।

ফকনার চিনতে পারল না। মেয়েদের নাম তার মনে থাকে না।

তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ না?

চিনতে পারব না কেন? কেমন আছ লিজা?

তাহলে এমন রাগীরাগী গলায় কথা বলছ কেন?

সকালবেলা ঘুম ভাঙলে আমার খুব মেজাজ খারাপ থাকে তো, তাই।

রাতে খুব ড্রিংক করেছ, তাই না?

খুব না, তিন ক্যান বিয়ার। তিন ক্যান বিয়ার খেলে একটা মৌমাছির নেশা হয়, কিন্তু আমি মৌমাছি না।

তুমি সবসময় এমন মজার-মজার কথা বল কেন?

মেয়েটি খিলখিল করে হাসতে লাগল। হাসির শব্দটা চেনা। সি থেকে মেয়েটিকে চেনা যাচ্ছে। নর্থ অ্যাভিন্যুর পিজা পার্লারের মেয়ে। হাসি-রোগ আছে। মেয়েটির। অকারণে আসবে এবং বকবক করবে।

গত সপ্তাহে পিজা এনে দিয়ে গিয়েছিল। অন্যদের মতো প্যাকেট নামিয়ে রেখেই চলে যায় নি। হাসিমুখে বলেছে, পিজা ছাড়া তুমি কিছু খাও না? প্রায়ই তোমাকে পিজা পালারে দেখি। তুমি নিশ্চয়ই ইটালিয়ান নও?

না, ইটালিয়ান নই। পিজাও খুব পছন্দ করি না। সস্তা বলে খাই। আমি একজন দরিদ্র ব্যক্তি।

তোমার ঘর এত নোরা কেন?

ফকনার হেসে ফেলল।

হাসছ কেন? নোংরা ঘর আমার ভালো লাগে না। গা জ্বলে।

আমি মানুষটি খুব পরিষ্কার, কাজেই আমার ঘর নোংরা। যে-সব মানুষের ঘরদুয়ার খুব পরিস্কার, তারা মানুষ হিসেবে নোংরা।

কই, আমি তো মানুষ হিসেবে ভালোই। কিন্তু আমার ঘর তো খুব পরিষ্কার, ঝকঝকে।

আমার থিওরি শুধু ছেলেদের জন্যেই। মেয়েদের জন্যে নয়। মেয়েদের বেলায় উল্টোটা।

তুমি তো খুব চালাক মানুষ।

ফকনার মেয়েটির চেহারা মনে করতে চেষ্টা করল। চেহারা মনে পড়ছে না। তার মানে মনে রাখার মতো চেহারা নয়। সুন্দরী মেয়েদের চেহারা মনে থাকে। এই মেয়েটিকে নিয়ে সে কি কখনো বাইরে খেতে গিয়েছে? মনে হয় গিয়েছে। কারণ সে। কথা বলছে অত্যন্ত পরিচিত ভঙ্গিতে। ফকনার মনে করতে চেষ্টা করল লিজা ব্রাউন নামের কাউকে নিয়ে সে ডেটিং-এ গিয়েছে কি না।

হ্যালো, তুমি কথা বলছ না কেন?

কী বলব?

পিজার অর্ডার দিলে দুপুরবেলা নিয়ে আসতে পারি। আনব?

আনতে পার। তার মানে, তোমার খুব-একটা ইচ্ছা নেই।

ইচ্ছা থাকবে না কেন, ইচ্ছা আছে। সুন্দরী মেয়েদের সামনে বসিয়ে পিজা খেতে আমার ভালোই লাগে।

আমি সুন্দরী, তোমাকে কে বলল?

আমার কাছে পৃথিবীর সব মেয়েকেই সুন্দরী মনে হয়। সবাইকে মনে হয় হেলেন অব ট্রয়।

তুমি এত মজার কথা বল কেন?

আমি মানুষটি মোটেই মজার নই, সেজন্যেই বোধহয়। আচ্ছা শোন, আমি কি কখনো তোমাকে নিয়ে বাইরে খেতেটেতে গিয়েছি?

লিজা ব্রাউন অবাক হয়ে বলল, তোমার মনে নেই?

না।

তার মানে, তুমি অসংখ্য মেয়েকে নিয়ে ডেটিং-এ গেছ?

ফকনার কিছু বলল না। লিজা ব্রাউন বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি আসব দুপুরে।

ফকনার টেলিফোন নামিয়ে বাথরুমে ঢোকামাত্র কলিংবেল বাজল। কলিংবেলের শব্দ থেকে যে এসেছে তার সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। যেমন, অল্পবয়েসী মেয়েরা খুব ঘন-ঘন বেল বাজাবে। বৃদ্ধরা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বেশ টিপে ধরে থাকবে, সেই সঙ্গে কড়া নাড়বে। কিন্তু এখন যে বাজাচ্ছে, তার সম্পর্কে কোনো ধারণা করা যাচ্ছে না। ফকনার দরজা খুলল। নীল স্যুট-পরা লম্বা একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বীমা কোম্পানির এজেন্টদের মতো ছিমছাম একটা ব্রীফকেস। লোকটি মেয়েলি গলায় বলল, ভেতরে আসতে পারি?

আসুন।

আমিই কিছুক্ষণ আগে আপনাকে টেলিফোন করেছিলাম। আমার নাম জন হপার।

বসুন। কি ব্যাপার, বলুন।

আমার কিছুক্ষণ সময় লাগবে।

আপনাকে দশ মিনিট সময় দেওয়া হল।

আধ ঘন্টা দিন।

ঠিক আছে, আধ ঘন্টা। কফি?

হ্যাঁ, কফি খেতে পারি।

জন হপার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারদিক দেখতে লাগল, যেন ঘরের অবস্থা থেকে এর বাসিন্দা সম্পর্কে একটা ধারণা করতে চায়।

ফকনার কফির পেয়ালা হাতে করে তার সামনে এসে বসল। ভারি গলায় বলল, হ্যাঁ, এবার বলুন।

আপনি নিশ্চয়ই জেনারেল ডোফাকে চেনেন?

হ্যাঁ, ভালো পরিচয় আছে। আমি তার একটি কমান্ডো গ্রুপকে ট্রেনিং দিয়েছিলাম। গ্রুপের নাম ছিল প্যান্থার।

জুলিয়াস নিশোর সঙ্গে কি আপনার কখনো দেখা হয়েছিল?

না। রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে আমার কোনো উৎসাহ নেই।

জেনারেল ডোফার সঙ্গে কি আপনার কোনোযোগাযোগ আছে?

না। আমি হচ্ছি ভাড়াটে সৈন্য। যে টাকা দেবে তার হয়ে আমি কাজ করব। কাজ শেষ হলে চলে আসব। ডোফার কমান্ডো ইউনিট তৈরি হবার পর চলে এসেছি। আর কোনোযোগাযোগ হয় নি।

আপনি কি গতকালের খবরের কাগজ পড়েছেন?

না, খবরের কাগজ আমি পড়ি না। পৃথিবীর কোথায় কী হচ্ছে, সে সম্পর্কে আমার কোন উৎসাহ নেই।

তাহলে জুলিয়াস নিশোর মৃত্যুসংবাদ আপনি জানেন না?

তা জানি। টিভি নিউজ দেখেছি। সিবিএস ভালো কভারেজ দিয়েছে।

জুলিয়াস নিশোর মৃত্যু কি আপনার কাছে খুব রহস্যময় মনে হয় না?

দেখুন মিঃ হপার, মৃত্যুর মধ্যে কোনো রহস্য নেই। আপনি কী বলতে চান খোলাখুলি বলুন। আমি স্পষ্ট কথা ভালবাসি।

আপনি কি সাউথ আফ্রিকায় একটি মিশন পরিচালনা করতে পারবেন?

সেটা নির্ভর করে কী পরিমাণ টাকা পাওয়া যাবে তার ওপর এবং মিশনটি কী ধরনের তার ওপর।

জুলিয়াস নিশোকে ফোর্টনক থেকে বের করে আনা।

মৃত একজন মানুষকে বের করে আনার প্রয়োজনটি ধরতে পারলাম না।

জুলিয়াস নিশো বেঁচে আছেন।

ফকনার সিগারেট ধরিয়ে দীর্ঘ টান দিয়ে শুকনো গলায় বলল, মিঃ হপার, আপনি কে?

আমি সিআইএ-র সঙ্গে আছি।

আমার সঙ্গে কী ধরনের কথা বলার দায়িত আপনাকে দেওয়া হয়েছে?

মিশন সম্পর্কে যদি আপনি উৎসাহী হন, তাহলে আপনাকে শিকাগোতে নিয়ে যাবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

কখন যেতে চান?

আমরা এখনি রওনা হতে পারি।

যাবেন কিসে?

আমি সেনাবাহিনীর একটি বিমান নিয়ে এসেছি। একটা টু-সীটার।

আপনি নিজেই চালাবেন?

হ্যাঁ। আমি একজন বৈমানিক। এক সময় বিমানবাহিনীতে ছিলাম।

বিষয়টি খুব জরুরি মনে হচ্ছে?

খুবই জরুরি।

টাকার ব্যাপারে সিআইএ কৃপণতা করবে না বলে আশা করতে পারি।

টাকা কোনো সমস্যা হবে না বলেই মনে করি। মিঃ ফকনার, আপনি তৈরি হয়ে নিন।

আমি তৈরিই আছি। শুধু একটা নোট লিখে দরজায় রেখে যাব।

 

লিজা ব্রাউন পিজার প্যাকেট নিয়ে এসে দরজায় আটকানো নোটটি পড়ল।

লিজা, তুমি খাবারের প্যাকেটটি দরজার বাইরে রেখে যাও। দেখা হল না বলে দুঃখিত। তারপর বল, তুমি কেমন আছ? ফকনার।

পুনশ্চঃ খাবারের বিল আমি এসে মিটিয়ে দেব।

লিজা ব্রাউন বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েটির বয়স খুবই অল্প। সাদামাঠা চেহারা। মাথার চুল ছেলেদের মত কাটা বলেই হয়তো সমস্ত চেহারায় একধরনের মায়াকাড়া ভাব এসেছে। সে কি কিছুটা হতাশ হয়েছে? হয়তো-বা। অল্পবয়সী মেয়েরা সহজেই হতাশ হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *