অবন্তির লেখা
আমার দাদাজান সরফরাজ খান পুলিশের এসপি হয়ে রিটায়ার করেছিলেন। আমি আমার জীবনে তার মতো ভীতু মানুষ দেখি নি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তিনি অসীম সাহসিকতার জন্য পিপিএম’ পেয়েছিলেন। পিপিএম হলো পাকিস্তান পুলিশ মেডেল। পুলিশ সার্ভিসে সাহসিকতার সর্বোচ্চ পুরস্কার।
আমি দাদাজানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী জন্যে এত বড় পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন? দাদাজান বললেন, ফরগেট ইট! এই বাক্যটি তাঁর খুব প্রিয়। কারণে-অকারণে তিনি বলেন, ফরগেট ইট! যেসব প্রশ্নের উত্তরে ‘ফরগেট ইট’ কিছুতেই বলা যায় না, সেখানেও তিনি এই বাক্য বলেন। উদাহরণ দেই—
আমি একদিন বললাম, দাদাজান, বাজার থেকে মাগুর মাছ এনেছে। মটরশুটি দিয়ে রান্না করবে, নাকি আলু দিয়ে?
দাদাজান বললেন, ফরগেট ইট!
আমি বললাম, কী ফরগেট করব? মাছ রান্না?
তুচ্ছ জিনিস নিয়ে আমাকে বিরক্ত করবি না।
রান্না তুচ্ছ বিষয়?
স্টপ আর্গুইং।
তুচ্ছ বিষয় নিয়ে দাদাজান কথা বলতে পছন্দ করেন না, এই তথ্য পুরোপুরি মিথ্যা। তার আগ্রহ তুচ্ছ বিষয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারেন।
১৯৭১ সালের মে মাসে দাদাজান আমার জন্যে গোলাপি রঙের বোরকা কিনে আনলেন। কঠিন বোরকা। বাইরে থেকে চোখও দেখা যায় না এমন। চোখের ওপর মশারির মতো জাল। এখানেই শেষ না, বোরকার সঙ্গে কালো হাতমোজা। পায়ের মোজা। দাদাজান আমাকে বললেন, না আমেন্ট, নো তর্ক, নো ডিলে। বোরকা পর। আমি বোরকা পরলাম। দাদাজান বললেন, এখন চল।
আমি বললাম, কোথায় যাব?
সোহাগী যাব। ঢাকা শহরে থাকা যাবে না। মিলিটারি মেরে ফেলবে। এখনই রওনা হব।
সঙ্গে আর কিছু নেব না? দাদাজান বললেন, ফরগেট ইট! আমি বললাম, দাঁত মাজার ব্রাশও নেব না?
দাদাজান বললেন, বেঁচে থাকলে দাঁত মাজার অনেক সুযোগ পাবি। বেঁচে থাকবি কি না এটাই এখন প্রশ্ন।
ঢাকা শহর আমরা পার হলাম রিকশায় এবং পায়ে হেঁটে। কিছু কিছু বাস ঢাকা থেকে যাচ্ছিল। ঢাকা ছেড়ে যাওয়া বাসগুলিতে মিলিটারিরা ব্যাপক তল্লাশি চালাচ্ছিল। মিলিটারি তল্লাশি মানে কয়েকজনের মৃত্যু। রূপবতী মেয়েদের ধরে আড়ালে নিয়ে যাওয়া তখনো শুরু হয় নি।
ঢাকা থেকে পালানোর সময় রিকশা ছাড়া আর যেসব যানবাহনে আমি চড়েছি সেগুলি হচ্ছে মহিষের গাড়ি, মোটরসাইকেল (শিবগঞ্জ থানার ওসি সাহেব মোটরসাইকেল চালিয়েছেন, তার পেছনে দাদাজান ও আমি বসেছি।) সবশেষে নৌকা। নৌকাও কয়েক ধরনের। এর মধ্যে একটা ছিল বালিটানা নৌকা। এই নৌকায় পাটাতনের নিচে আমাকে দাদাজান লুকিয়ে রাখলেন। যাত্রার পুরো সময়টা তিনি আতঙ্কে অস্থির হয়ে ছিলেন। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন আমরা একপর্যায়ে মিলিটারির হাতে পড়ব। তারা দাদাজানকে গুলি করে মারবে এবং আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। সেই সময় দাদাজান দিনের মধ্যে অনেকবার অজু করতেন। তিনি চাচ্ছিলেন যেন পবিত্র অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
আমরা তিন দিন পর আধামরা অবস্থায় সোহাগী পৌঁছালাম। দাদাজানের বাড়ি সোহাগীতে। বাড়ির নাম ‘রঙমহল’। শ্বেতপাথরে কালো রঙ দিয়ে লেখা। ‘র’-এর ফোঁটা উঠে যাওয়ায় এখন নাম হয়েছে বঙমহল। নদীর পাড়ে দোতলা দালান। বাবার সঙ্গে এই বাড়িতে আগে আমি দু’বার এসেছি। কিছু কিছু বাড়ি থাকে সাধারণ, সেই সাধারণে লুকিয়ে থাকে অসাধারণ। ‘বঙমহল’ সেরকম একটি বাড়ি। এই বাড়ির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই।
দাদাজানের এই বাড়ি পুরোনো। দোতলায় টানা বারান্দা আছে। স্টিমারের ডেকে বসলে যেমন সারাক্ষণ প্রবল হাওয়া গায়ে লাগে, বারান্দায় দাঁড়ালেও তা-ই। সারাক্ষণ হাওয়া বইছে। বাড়ির তিনদিকেই ফলের বাগান। লিচুগাছ থেকে শুরু করে তেঁতুলগাছ, সবই সেখানে আছে। দাদাজানের ওই বাড়িতেই আমি জীবনে প্রথম গাছ থেকে নিজ হাতে পেড়ে লিচু খেয়েছি। লিচু মিষ্টি না, টক। লবণ দিয়ে খেতে হয়।
আমাদের বাড়ির সামনের নদীর নাম তরাই। এই নদী ব্রহ্মপুত্রের শাখা। বর্ষায় পানি হয়। শীতের সময় পায়ের পাতা ভেজার মতো পানি থাকে। সেবার তরাই নদীতে প্রচুর পানি ছিল। জেলেরা সারা দিনই জাল ফেলে মাছ ধরত। তরাই নদীর বোয়াল মাছ অত্যন্ত সুস্বাদু। জেলেরা ভোরবেলায় মাছ দিয়ে যেত। নানান ধরনের মাছ। কৈ, সরপুঁটি, ট্যাংরা, খইলসা। মাঝে মাঝে মাঝারি সাইজের কাতল। সেবারই আমি কাতল মাছের আস্ত মাথা খাওয়া শিখি। রান্না করতেন ধীরেন কাকু। উনি হিন্দু ব্রাহ্মণ। দাদার বাড়ির আশপাশে প্রচুর আত্মীয়স্বজন থাকার কথা। তা ছিল না। কারণ দাদাজানের বাবা (খালেক মুনশি) পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেক দূরে এই বাড়ি করেছিলেন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে তার উপায় ছিল না। তিনি তাঁর বড়ভাইয়ের স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন। ওই মহিলার ছবি আমি দেখেছি। তিনি ছিলেন কদাকার। উঁচু হনু। দাঁত বের হওয়া। গায়ের রঙ পাতিলের তলার মতো কালো। কী দেখে তিনি এই মহিলার প্রেমে পড়েছিলেন তা এখন আর জানার উপায় নেই।
দাদাজানের বাড়িতে কেয়ারটেকার সেন কাকা ছাড়াও ছিলেন ধীরেন কাকার স্ত্রী রাধা। উনি রূপবতী ছিলেন। আমি লক্ষ করেছি, রাধা নামের সব মেয়েই রূপবতী হয়। রাধা কাকি সারাক্ষণই বাড়ি পরিষ্কার রাখার কাজকর্ম নিয়ে থাকতেন। এই দুজন ছাড়াও দবির নামের মধ্যবয়স্ক একজন ছিলেন, যার কাজ গাছপালা দেখা, বাগান করা।
বঙমহলে আমার সময় খুব ভালো কাটছিল। আমি বাগানে দবির চাচাকে দিয়ে দোলনা টানিয়েছিলাম। দোলনায় দুলতে দুলতে গল্পের বই পড়তাম। দাদাজানের লাইব্রেরিতে চামড়ায় বাঁধানো অনেক বই ছিল। বেশির ভাগই গ্রন্থাবলি। রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবি উপন্যাস আমি দাদাজানের বাগানের দোলনায় দুলতে দুলতে পড়েছি।
ধীরেন কাকা আমাকে রান্না শেখাতেন। অধ্যাপকের ভঙ্গিতে বক্তৃতা দিয়ে রান্না শেখানো। এই সময় রাধা কাকি তার পাশে থাকতেন। রান্নার বক্তৃতা শুনে মিটিমিটি হাসতেন। ধীরেন কাকার রান্না-বিষয়ক বক্তৃতামালা।
মা! সবচেয়ে কঠিন রান্না হলো মাছ রান্না। মাছের আছে আঁশটে গন্ধ। রান্নার পর যদি মাছের আঁশটে গন্ধ থাকে, তখন সেই মাছ হয় ভূত-পেত্নির খাবার। প্রথমেই আঁশটে গন্ধ দূর করবে।
এ কাজ কীভাবে করা হবে?
প্রথমে লবণ মেখে কচলাবে। তারপর পানি দিয়ে ধুয়ে লবণ ফেলে দেবে। এরপর দেবে লেবুর রস। কাগজিলেবু হলে ভালো হয়। এই লেবুর গন্ধ কড়া। লেবুর রস দিয়ে মাখানোর পর আবার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলে দেবে। সব মিলিয়ে তিন ধোয়া। এর বেশি না। মাংসের ক্ষেত্রে ভিন্ন ব্যবস্থা। মাত্র এক ধোয়া।
রান্নাবিষয়ে ধীরেন কাকার সব কথা আমি একটা রুলটানা খাতায় খুব গুছিয়ে লিখেছিলাম। খাতাটা হারিয়ে গেছে। খাতাটা থাকলে রান্নার একটা বই লেখা যেত। তবে কৈ মাছ রান্নার একটা রেসিপি আমার মনে আছে। রেসিপিটা এ রকম—
একটা কৈ মাছ সরিষা বাটা, লবণ এবং একটা ঝাল কাঁচামরিচ দিয়ে মাখিয়ে কলাপাতায় মুড়ে ভাতের মাড় ফেলা অবস্থায় হাঁড়িতে ঢুকিয়ে দেওয়া। ব্যস হয়ে গেল।
রাধা কাকি ছিলেন ভূতের গল্পের ওস্তাদ। তাঁর কাছ থেকে কত যে গল্প শুনেছি! বেশির ভাগ গল্পই বাস্তব অভিজ্ঞতার। তিনি নিজে দেখেছেন এমন। তাঁর কথায় সব ভূত ভীতুপ্রকৃতির। মানুষের ভয়ে তারা অস্থির থাকে। শুধু একশ্রেণীর পিশাচ আছে, যারা মানুষকে মোটেই ভয় পায় না। এরা হিংস্র জন্তুর মতো।
আমি বললাম, কাকি, আপনি এই ধরনের পিশাচ দেখেছেন?
কাকি বললেন, একবার দেখেছি। ঘটনা বলি শোনো, আমি এই বাড়ির বারান্দায় বসা। সন্ধ্যা মিলিয়েছে, আমি বড়ঘরে হারিকেন জ্বালিয়ে বারান্দায় এসেছি, তখন দেখলাম পানির নিচ থেকে পিশাচটা উঠল। থপ থপ শব্দ করে সিঁড়ি ভেঙে উঠে এসে উঠানে দাঁড়াল। মুখ দিয়ে ঘোড়ার মত শব্দ করল।
দেখতে কেমন?
মানুষের মতো। মিশমিশা কালো। হাতের আঙুল অনেক লম্বা। আঙুলে পাখির নখের মতো নখ। পিশাচটা দেখে ভয়ে আমি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি—এই সময় একটা কুকুর ছুটে এল। কুকুর দেখে পিশাচটা ভয় পেয়ে দৌড়ে পানিতে নেমে ডুব দিল। পিশাচরা কিছুই ভয় পায় না, শুধু কুকুর ভয় পায়। কুকুর তাদের কাছে সাক্ষাৎ যম।
দাদাজানের সঙ্গে আমার তেমন কথা হতো না। তিনি সারাক্ষণ ট্রানজিস্টারে খবর শুনতেন। মাঝে মাঝে তিন মাইল দূরে হামিদ কুতুবি নামের এক পীর সাহেবের আস্তানায় যেতেন। তিনি এই পীরের মুরিদ হয়েছিলেন। যখন ট্রানজিস্টার শুনতেন না, তখন পীর সাহেবের দেওয়া দোয়া জপ করতেন। দাদাজান আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন। প্রতিদিনই তাঁর আতঙ্ক বাড়ছিল। রাতে তিনি ঘুমুতে পারতেন না। সারা রাত বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে থাকতেন। ভবিষ্যৎ জানার জন্যে তিনি এক রাতে ইস্তেখারা করলেন। ইস্তেখারায় দেখলেন, একটা প্রকাণ্ড ধবধবে সাদা পাখি যার চোখ টকটকে লাল, সে আকাশ থেকে নেমে আমার চুল কামড়ে ধরে আকাশে উঠে গেছে। আমি চিৎকার করছি, বাঁচাও! বাঁচাও! দাদাজান আমাকে বাঁচাও। দাদাজান আমাকে বাঁচানোর জন্যে হেলিকপ্টারে করে উঠে গেলেন। সেই হেলিকপ্টার আবার চালাচ্ছে একজন পাকিস্তানি পাইলট। হেলিকপ্টার চালাবার ফাকে ফাকে সে পিস্তল দিয়ে পাখিটাকে গুলি করছে। কোনো গুলি পাখির গায়ে লাগছে না। লাগছে অবন্তির গালে।
দাদাজানের পীর হামিদ কুতুবি স্বপ্নের তাবীর করলেন। কী তাবীর তা দাদাজান আমাকে বললেন না, তবে তিনি আরও অস্থির হয়ে পড়লেন। চারদিক থেকে তখন ভয়ংকর সব খবর আসতে শুরু করেছে। মিলিটারিরা গানবোট নিয়ে আসছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, নির্বিচারে মানুষ মারছে, অল্পবয়সী মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এইসব।
একসময় আমাদের অঞ্চলে মিলিটারি চলে এল। খাতিমনগরে মিলিটারির গানবোট ভিড়ল। দাদাজানের বাড়ি থেকে খাতিমনগর বাজার দু’মাইল দূরে। খবর শোনামাত্র দাদাজান আমাকে নিয়ে তাঁর পীর সাহেবের হুজরাখানায় উপস্থিত হলেন।
বিশাল এলাকাজুড়ে পীর সাহেবের হুজরাখানা। চারদিকে দেয়াল, দেয়ালের ওপর কাটাতার। দুর্গের মতো ব্যাপার। হুজরাখানার ভেতরে দুটি মাদ্রাসা আছে। একটি ছেলেদের, একটি মেয়েদের। দুটিই হাফেজি মাদ্রাসা। কোরানশরিফ মুখস্থ করানো হয়। হুজরাখানার পেছনে পীর সাহেবের দোতলা বাড়ি। একতলায় থাকেন পীর সাহেবের প্রথম স্ত্রী। তার কোনো সন্তানাদি নেই। দোতলায় থাকেন পীর সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী। তাঁর নাম জুলেখা। এই স্ত্রীর গর্ভে একটি সন্তান আছে। তাঁর নাম জাহাঙ্গীর। তিনি কোরানে হাফেজ। রূপবান এক যুবক। স্র এবং ভদ্র। মেয়েদের মতো চোখে গাঢ় করে কাজল দেন। তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকবার আমার দেখা হয়েছে। তিনি কখনো মাথা তুলে তাকান নি। হুজরাখানার পুরুষদের মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকানোর নিয়ম নেই।
আমি পীর সাহেবের সামনে বসে আছি। আমার পাশে দাদাজান। পীর সাহেব নামাজের ভঙ্গিতে বসেছেন। তার বয়স অনেক, তবে তিনি শারীরিকভাবে মোটেই অশক্ত না। পীর সাহেবের ডানহাতে তসবি। তসবির দানাগুলি নীল রঙের, অনেক বড় বড়। তিনি একমনে তসবি টেনে যাচ্ছেন। ঘরে আরও কয়েকজন ছিল, তাদের হাতেও তসবি। পীর সাহেবের নির্দেশে তারা বেরিয়ে গেল। একজন এসে ফরসি হুক্কা দিয়ে গেল। পীর সাহেব হুক্কায় টান দিতে দিতে বললেন, সরফরাজ! তোমার এই নাতনির মা বিদেশিনী, সেটা জানলাম। তার ধর্ম কী?
খ্রিষ্টান। ক্যাথলিক খ্রিষ্টান।
পীর সাহেব বললেন, মুসলমান ছেলে খ্রিষ্টান বিবাহ করতে পারে। নবিজি মরিয়ম নামের এক খ্রিষ্টান কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। তার গর্ভে এক পুত্রসন্তানও হয়েছিল। সন্তানের নাম ইব্রাহিম। এখন আমার প্রশ্ন, তোমার পুত্রের সঙ্গে খ্রিষ্টান মেয়ের বিবাহ কি ইসলাম ধর্মমতে হয়েছে?
জি হুজুর।
আলহামদুলিল্লাহ। এটা একটা সুসংবাদ। তুমি তোমার নাতনিকে আমার এখানে রাখতে চাও?
জি জনাব।
মেয়ের বাবা কোথায়?
মেয়ের বাবা কোথায় আমি জানি না। আমার ছেলে তিন বছর বয়সের মেয়েকে এনে আমার কাছে রেখে স্পেনে চলে যায়। এরপর আর তার খোঁজ জানি না।
সে কি জীবিত আছে?
তাও জানি না।
পীর সাহেব বললেন, জ্বিনের মাধ্যমে তোমার পুত্রের সংবাদ আমি এনে দিতে পারি। সেটা পরে দেখা যাবে। এই মেয়ের নাম কী?
অবন্তি।
এটা কেমন নাম?
তার বাবা রেখেছে।
সন্তানের সুন্দর ইসলামি নাম রাখা মুসলমানের কর্তব্য। আমি এই মেয়ের নাম রাখলাম, মায়মুনা! মায়মুনা নামের অর্থ ভাগ্যবতী।
দাদাজান চুপ করে রইলেন।
পীর সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কি কোরানমজিদ পাঠ করতে পারো?
আমি বললাম, পারি। কে শিখিয়েছে? তোমার খ্রিষ্টান মা?
না। আমার দাদাজান আমার জন্যে একজন হুজুর রেখে দিয়েছিলেন। হুজুরের নাম বলব?
পীর সাহেব বললেন, নাম বলতে হবে না। তুমি কথা বেশি বলো। কথা কম বলবে। তোমার অজু আছে?
জি-না।
যাও, অজু করে এসে আমাকে কোরানমজিদ পাঠ করে শোনাও। সূরা ইয়াসিন পাঠ করবে।
আমি সূরা ইয়াসিন পড়লাম। পীর সাহেব বললেন, পাঠ ঠিক আছে। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। সরফরাজ, তোমার নাতনি মায়মুনাকে আমি জুলেখার হাতে হাওলা করে দিব। সে নিরাপদে থাকবে। তবে তাকে কঠিন পর্দার ভেতর থাকতে হবে। আমার এখানে তা-ই নিয়ম।
দাদাজান বললেন, আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই সে থাকবে।
পীর সাহেবের কাছে থাকার সময়ই খবর পেলাম, দাদাজানের বাড়িতে মিলিটারি এসে উঠেছে। মিলিটারি ক্যাপ্টেন ঘাঁটি হিসেবে বাড়ি পছন্দ করেছেন। তাদের নিরাপত্তার জন্যে বাড়ির চারদিকের সব গাছপালা কাটার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ধীরেন কাকা ও তার স্ত্রীকে যে মিলিটারিরা গুলি করে মেরে ফেলেছেএই খবর তখনো আসে নি।
দাদাজান আমাকে রেখে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। আমার হাতে এক শ’ টাকার নোটে দুই হাজার টাকা দিলেন এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, আমার ব্যক্তিগত পিস্তলটা তোকে দিয়ে যাচ্ছি। ভালো করে দেখে নে। বারো রাউন্ড গুলি ভরা আছে। সেফটি ক্যাচ লাগানো অবস্থায় ট্রিগার চাপলে গুলি হবে না। সেফটি ক্যাচ কীভাবে খুলতে হয় দেখ। এইভাবে।
আমি বললাম, সেফটি ক্যাচ খেলার কায়দা জেনে আমি কী করব? কাকে আমি গুলি করে মারব?
দাদাজান বললেন, কাউকে মারবি না। জিনিসটা জানা থাকল।
আমি বললাম, তুমি কোথায় যাবে?
দাদাজান বললেন, জানি না কোথায় যাব। ঢাকায় যেতে পারি।
মিলিটারিরা তোমার বাড়ি দখল করে বসে আছে। তাদের কিছু বলবে না?
না।
পীর সাহেবের এই বাড়িতে আমি কত দিন থাকব?
মলিটারির গুষ্টি বিদায় না হওয়া পর্যন্ত থাকবি। আমি মাঝে মধ্যে এসে খোঁজ নিব। পিস্তলটা লুকিয়ে রাখবি। পিস্তলের বিষয়টা কেউ যেন না জানে।
কেউ জানবে না।
পীর সাহেবের বাড়িতে আমার জীবন শুরু হলো। খুব যে কষ্টকর জীবন তা না। দোতলার সর্বউত্তরের একটা ছোট্ট ঘর আমাকে দেওয়া হলো। ঘরে একটাই জানালা। এই জানালা দিয়ে কিছুই দেখা যায় না। জানালার সামনেই বটগাছের সাইজের এক কড়ইগাছ। ঘরে আমি একা থাকি। শুধু রাত্রে সালমা নামের মধ্যবয়স্ক এক দাসী মেঝেতে পাটি পেতে ঘুমায়। তার চেহারা কদাকার। মুখে বসন্তের দাগ, একটা চোখ নষ্ট। মানুষ হিসেবে সে অসাধারণ, মানসিক সৌন্দর্যের কাছে তার শারীরিক ত্রুটি সম্পূর্ণ ঢাকা পড়েছিল। প্রথম রাতেই সে আমাকে বলল, আম্মাজি, আপনি ভয় খাইয়েন না। আমি আছি।
আমি বললাম, ভয় পাব কী জন্যে?
সালমা বলল, আপনের বয়স অল্প। আপনে হুরের মতো সুন্দর। কিংবা কে বলবে, হুরের চেয়েও সুন্দর। আমি তো আর হুর দেখি নাই। আপনের মতো মেয়েছেলের কাইকে কাঁইকে (কদমে কদমে) বিপদ। আপনে সাবধানে চলবেন। আমার একটাই নয়ন। এই নয়ন আপনের উপর রাখলাম।
আমি বললাম, একটা নয়ন আমার উপর রেখে দিলে কাজকর্ম করবেন কীভাবে? তারচেয়েও বড় কথা, নয়ন আপনি আমার উপর রাখছেন কী জন্যে?
সালমা বলল, ছোট মা’র হুকুম।
ছোট মা হলো পীর সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী। তাঁর নাম জুলেখা বিবি। তাঁর একটিই সন্তান, জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীর কোরানে হাফেজ। জুলেখা বিবি আরামে ও আলস্যে সময় কাটান। বেশির ভাগ সময় চুল এলিয়ে উবু হয়ে বসে থাকেন। তখন তাঁর গায়ের কাপড় ঠিক থাকে না। এই নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথাও দেখা যায় না। মনে হয় তিনি তাঁর সুন্দর শরীর দেখাতে পছন্দ করেন। তাঁর মতো রূপবতী মেয়ে আমি কম দেখেছি। প্রায় নগ্ন এই মহিলাকে একজন দাসী তার চুলে বিলি করে দেয়। চুলের উকুন বাছে। সপ্তাহে দুদিন বাটা মেন্দি মাথায় দিয়ে দেয়। আরেকজন দাসী তার পায়ের পাতায় তেল ঘষে। এই দাসীরাই তাঁর কাজা নামাজ আদায় করে। রোজার সময় তার হয়ে রোজা রাখে। তিনি নামাজ-রোজা কিছুই করেন না।
এই অদ্ভুত মহিলার ওপর প্রতি অমাবস্যা রাতে কিসের যেন আছর হয়। তখন তিনি জন্তুর মতো গোঁ গোঁ শব্দ করতে থাকেন। তার মুখ দিয়ে লালা পড়ে। তিনি পুরুষের গলায় বলেন, শইল গরম হইছে। শইল্যে পানি দে। বরফপানি দে। তখন তার গায়ে বালতি বালতি বরফপানি ঢালা হয়। অমাবস্যা উপলক্ষ করেই বরফকল থেকে চাক চাক বরফ কেনা হয়। আছরগ্রস্ত অবস্থায় তাঁর তিন দাসী ছাড়া অন্য কেউ সামনে যায় না।
পীরবাড়িতে আমার জীবনযাত্রাটা বলি। সূর্য ওঠার আগে সালমা আমাকে ডেকে তোলে। আমাকে ঘাটে নিয়ে যায় গোসল করার জন্যে। ঠান্ডায় গোসলের এই কাজ খুব কষ্টকর। পুকুরভর্তি বালি মাছ। গোসলের সময় এই মাছ সারাক্ষণ গায়ে ঠোকর দেয়। বিশ্রী লাগে।
ফজরের আজানের পরপর নামাজের জন্যে দাঁড়াতে হয়। ইমামতি করেন পীর সাহেব। মেয়েদের ও বারো বছরের নিচের বালকদের আলাদা নামাজের ব্যবস্থা। পুরুষদের নামাজ ও মেয়েদের নামাজ একসঙ্গেই হয়, তবে মাঝখানে দেয়াল আছে। নামাজের সময় মেয়েরা ইমামকে দেখতে পারে না, তবে তার কথা শুনতে পারে।
ফজরের নামাজের পরপর মেয়েরা যে যার ঘরে চলে যায়। এই সময় বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে কোরান পাঠ করতে হয়। সকালে নাশতার ডাক এলে কোরানপাঠ বন্ধ হয়। নাশতা হিসেবে থাকে রাতের বাসি পোলাও ও বাসি মাংস।
জোহরের নামাজের পর দুপুরের খাওয়ার ডাক আসে। দুপুরে গণখাবার রান্না হয়। প্রতিবারই দেড় শ’ থেকে দু’ শ’ মানুষ খায়। বাড়ির মেয়েরা এই খাবার খেতে পারে কিংবা নিজেদের জন্যে মাছ, ডাল, সবজিও খেতে পারে।
এশার নামাজের পর রাতের খাবার। রাতের খাবার পীরবাড়ির বাইরের কেউ খেতে পারে না। জ্বিনেরা রাতের খাবারে অংশগ্রহণ করে বলে (?) রাতে সবসময় পোলাও ও মাংস থাকে। গরুর মাংস না, খাসি কিংবা মুরগি।
জ্বিনেরা নাকি গো-মাংস পছন্দ করে না।
আমি সালমাকে বললাম, জ্বিনেরা রাতে খেতে আসে?
সালমা বলল, সবদিন আসে না, মাঝে মধ্যে আসে। পীর বাবার জ্বিন সাধনা। এই কারণেই আসে। মাসে একবার জ্বিন মিলাদ পড়ায়।
আপনি জ্বিন দেখেছেন?
আমি জ্বিন দেখি নাই, তয় একবার তারার মিলাদে ছিলাম। জ্বিনের ক্যানক্যানা মেয়েছেলের মতো গলা। মিলাদের শেষে জ্বিনমুলুকের তবারক ছিল। সবুজ কিসমিস।
খেতে কেমন?
মিষ্টি, তয় সামান্য ঝালভাবও আছে। আপনে যখন আছেন, তখন জ্বিনের মিলাদ নিজের চউখে দেখবেন। জ্বিনমুলুকের ফলফ্রুট ইনশাল্লাহ খাবেন।
পীর বাবার সঙ্গে এক সন্ধ্যাবেলায় মিলিটারি ক্যাপ্টেন দেখা করতে এলেন। তাঁর নাম সামস আরমান। সবাই ডাকত ক্যাপ্টেন সামস। জ্বিনের মিলাদ দেখার জন্যে আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করলেন। পীর বাবা ক্যাপ্টেন সাহেবের আগ্রহ দেখে বিশেষ ব্যবস্থায় জ্বিনের মিলাদের আয়োজন করলেন। ক্যাপ্টেন সাহেবের আগমন উপলক্ষে বিশেষ খাবারের আয়োজন হলো। দুটি খাসি জবেহ করা হলো। খাসির রেজালা, মুরগির রোস্ট এবং পোলাও।
ক্যাপ্টেন সাহেবের উপস্থিতির কারণে জ্বিনের মিলাদে বাড়ির মেয়েরা উপস্থিত থাকতে পারল না। ক্যাপ্টেন সাহেব জ্বিনের মিলাদ দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। এরপর থেকে তিনি প্রায়ই পীর বাবার হুজরাখানায় আসতে শুরু করলেন। ক্যাপ্টেন সাহেবের আগ্রহে পীর বাবা খাতিমনগরে শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান হয়ে গেলেন। হুজরাখানার সবাই খুশি। পাকিস্তানের সেবা করার সুযোগ পাওয়া গেল। এই প্রথম হুজরাখানার মূল গেটে পাকিস্তানের পতাকা উড়তে লাগল। পতাকাটা অদ্ভুত। পতাকার মাথায় কায়দে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নার বাধাই করা ছবি। তার নিচে পতাকা।
সারা দেশে তখন ভয়ঙ্কর অবস্থা চলছে। দেশের মানুষ জীবন বাঁচানোর জন্যে পালিয়ে ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছে। মিলিটারিরা নির্বিচারে মানুষ মারছে, মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, আর আমরা আছি পরম সুখে। পীর বাবার হুজরাখানা সমস্ত ঝামেলা থেকে মুক্ত। এখানে প্রতি জুম্মাবারে পাকিস্তানের জন্যে দোয়া হয়, মিলাদ হয়। একবার খবর পাওয়া গেল, জ্বিনেরা বাগাদে বড় পীর সাহেবের মাজারে মিলাদ করেছে। তারা জানিয়েছে, বাংলাদেশ কখনো স্বাধীন হবে না। দুষ্কৃতিকারীরা সবাই মারা পড়বে। জ্বিনেরা নাকি মানুষের চেয়ে কিছু কিছু বিষয়ে উন্নত। তারা ভবিষ্যৎ দেখতে পারে।
জুন মাসের আট তারিখ দুপুরে পীর বাবা আমাকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। হুজরাখানায় তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। তাঁর এক হাতে তসবি, অন্য হাতে হুক্কার নল।
পীর বাবা বললেন, তোমার সঙ্গে কি কখনো পাকিস্তান মিলিটারির ক্যাপ্টেন সামসের দেখা হয়েছে?
আমি বললাম, না।
পীর বাবা বিরক্ত গলায় বললেন, ভাবনাচিন্তা করে জবাব দাও। তিনি অবশ্যই তোমাকে দেখেছেন। তুমি আমবাগানে আম কুড়াতে গিয়েছিলে। তোমার সঙ্গে আরেকজন ছিল।
জি। সালমা ছিল। আমরা পেছনের গেট দিয়ে বাগানে গিয়েছিলাম।
বোরকা ছিল না?
জি-না।
ক্যাপ্টেন সামস তোমাকে দেখেছেন এবং আমার কাছে বিবাহের পয়গাম পাঠিয়েছেন। তুমি দেশের অবস্থা জানো না। দেশের যে অবস্থা তাতে পাকিস্তানি মিলিটারির প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা অসম্ভব।
আমি চুপ করে বসে আছি। পীর বাবাও চুপ করে আছেন। তামাক টেনে যাচ্ছেন।
একসময় তিনি নীরবতা ভঙ্গ করে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি ক্যাপ্টেন সাহেবকে বলেছি, এই মেয়েটির আমার ছেলে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বিবাহ হয়েছে। মিথ্যা কথা বলেছি। মহাবিপদে জীবন রক্ষার জন্যে মিথ্যা বলা জায়েজ আছে। তোমাকে যে কোথাও পাঠাব সেই উপায় নাই। তোমার পিতা কোথায় আছেন তাও জানি না। এমন অবস্থায় জাহাঙ্গীরের সঙ্গে তোমার বিবাহ দেওয়া ছাড়া আমার উপায় নাই। আগামী শুক্রবারে বাদ জুম্মা তোমার বিবাহ। এখন সামনে থেকে যাও। একটা কথা মনে রাখবা, যা ঘটে আল্লাহপাকের হুকুমেই ঘটে। তার হুকুমের বাইরে যাওয়ার আমাদের কোনো উপায় নাই। জাহাঙ্গীরের সঙ্গে তোমার বিবাহ আল্লাহর হুকুমেই হবে। আমার হুকুমে না।
আমাকে ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা হলো। শুক্রবার বাদ জুম্মা দশ হাজার এক টাকা কাবিনে আমার বিয়ে হয়ে গেল। এত দিন জানতাম মেয়ে তিনবার কবুল না বলা পর্যন্ত কবুল হয় না। সেদিন জানলাম লজ্জাবশত যেসব নারী কবুল বলতে চায় না, তারা রেহেলের ওপর রাখা কোরানশরিফ তিনবার স্পর্শ করলেই কবুল হয়।
আমার হাত ধরে জোর করে তিনবার কোরানশরিফ ছুঁইয়ে দেওয়া হলো।
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে মাগরেবের নামাজের সময় হয়ে গেল, আর তখন শুরু হলো নানান ঝামেলা। একদল মুক্তিযোদ্ধা হুজরাখানা লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি করা শুরু করল। মুক্তিযোদ্ধা নামে একটা দল যে তৈরি হয়েছে, তারা যুদ্ধ শুরু করেছে—এই বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না।
মুক্তিযোদ্ধারা কিছুক্ষণ গুলি করে চলে গেল। তাদের গুলিতে কারও কিছু হলো না, শুধু ইরাজ মিয়া নামের একজনের হাতের কজি উড়ে গেল। সে বিকট চিৎকার শুরু করল, আম্মাজি, আমারে বাচান। আম্মাজি, আমারে বাঁচান। মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে কেউ তাকে হাসপাতালে বা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল না।
ক্যাপ্টেন সামস জিপে করে দলবল নিয়ে এলেন। মিলিটারিরা আকাশের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুড়ে চলে গেল।
সে রাতে অমাবস্যা ছাড়াই জুলেখা বিবির ওপর জ্বিনের আছর হলো। আজকের আছর অন্যদিনের চেয়েও ভয়াবহ। তিনি পুরুষের গলায় চেঁচাতে লাগলেন, শইল জ্বইল্যা যায়। বরফপানি দে। বরফপানি দে।
ঘরে বরফ নেই। দাসীরা তার গায়ে কলসি কলসি পানি ঢালতে লাগল। তাতে তার জ্বলুনি কমল না।
একতলার একটা বড় ঘরে পালংকের ওপর আমি বসে আছি। স্বামীর জন্যে অপেক্ষা। এই ঘরেই বাসর হবে। ঘরে আগরবাতি জ্বালানো হয়েছে। বাসরের আয়োজন বলতে এইটুকুই।
আমার স্বামী হাফেজ মোহম্মদ জাহাঙ্গীর এলেন শেষরাত্রে। তাঁকে ব্রিত ও ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আগে তিনি যেমন আমার দিকে চোখ তুলে তাকাতেন না, এখনো তাকাচ্ছেন না। তিনি খাটে বসতে বসতে কয়েকবার হাই তুললেন। আমি সহজ ভঙ্গিতে বললাম, ইরাজ মিয়ার চিৎকার শোনা যাচ্ছে না। সে কি মারা গেছে?
তিনি হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বললেন, হুঁ। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। উনার ইচ্ছা ছাড়া কিছুই হয় না।
আমি বললাম, এখন আপনাকে একটা জিনিস দেখাব। আপনি ভয় পাবেন। ভয়ের কিছু নাই। এই দেখুন, এটা একটা পিস্তল। এখানে বারো রাউন্ড গুলি ভরা আছে। সেফটি ক্যাচ লাগানো বলে ট্রিগার টিপলেও গুলি হবে না। এই দেখুন, আমি সেফটি ক্যাচ খুলে ফেললাম। এখন ট্রিগার টিপলেই গুলি হবে।
তিনি এতটাই হতভম্ব হলেন যে, তার ঠোঁট নড়ল কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না। আমি বললাম, এখন আমি যদি গুলি করি তাহলে প্রচণ্ড শব্দ হবে, কিন্তু কেউ এখানে আসবে না। সবাই ভাববে মুক্তিবাহিনী আবার আক্রমণ করেছে।
তুমি গুলি করবে?
আমি বললাম, ভোর হতে বেশি বাকি নেই। আপনি আমাকে যদি লুকিয়ে স্টেশনে নিয়ে ঢাকার ট্রেনে তুলে দেন তাহলে গুলি করব না। যদি রাজি না হন অবশ্যই গুলি করব। এতে মন খারাপ করবেন না। যা ঘটবে আল্লাহর হুকুমেই ঘটবে। আর আপনি যদি আমাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন সেটাও করবেন আল্লাহর হুকুমেই।
তিনি মূর্তির মতো বসে আছেন। তাঁর দৃষ্টি আমার হাতে ধরে রাখা পিস্তলের দিকে। তিনি খুব ঘামছেন। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছছেন।
ফজরের আজান হলো। তিনি বললেন, চলো তোমাকে নিয়ে শ্যামগঞ্জের দিকে রওনা হই। সকাল নয়টায় একটা ট্রেন ভৈরব হয়ে ঢাকায় যায়।
তিনি আমাকে শ্যামগঞ্জের ট্রেনে তুলে দিয়ে চলে যেতে পারতেন। তা করলেন না, আমার সঙ্গে রওনা হলেন। একজন স্বামী তার স্ত্রীকে যতটা যত্ন করে ততটাই করলেন। ট্রেনের কামরা ফাঁকা ছিল। তিনি আমাকে বেঞ্চে পা ছড়িয়ে শুয়ে ঘুমাতে বললেন। আমি তা-ই করলাম। পথে কোনো মিলিটারি চেকিং হলো না। কিংবা হয়তো হয়েছে, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম বলে জানি না।
ঢাকায় পৌঁছলাম বিকেলে। তখন ভারি বর্ষণ হচ্ছে। রাস্তায় হাঁটুপানি। রিকশায় ভিজতে ভিজতে বাড়ির দিকে যাচ্ছি। আমার স্বামী বললেন, আমার কিন্তু ফিরে যাওয়ার ভাড়া নাই।
আমি জবাব দিলাম না।
আমাদের বাড়ির গেট খোলা। বাড়ির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কানোর পর দাদাজান ভীতমুখে দরজা খুললেন। তিনি দাড়ি রেখেছেন। মুখভর্তি দাড়ির জঙ্গলে তাঁকে চেনা যাচ্ছে না। আমাকে দেখে তিনি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। টেনে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমার মনে পড়ল না একজন মানুষ গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। তার ফিরে যাওয়ার ভাড়া নেই।
দাদাজান স্তব্ধ হয়ে হুজরাখানার সব গল্প শুনলেন। ক্যাপ্টেন সামস-এর আগমন, আমার বিবাহ কিছুই বাদ গেল না।
দাদাজান বললেন (মেঝের দিকে তাকিয়ে, আমার চোখে চোখ না রেখে) বিয়ের পর বদটার সঙ্গে শারীরিক কিছু কি হয়েছে?
আমি বললাম, না।
দাদাজান হাঁপ ছেড়ে বললেন, তাহলে বিবাহ বৈধ হয় নাই। জাহাঙ্গীর হারামজাদাটাকে আমি লাথি দিয়ে বিদায় করছি।
দাদাজান হয়তো হাফেজ জাহাঙ্গীরকে লাথি দিয়ে বিদায় করতেই ঘর থেকে বের হলেন। ফিরলেন তাঁকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি এতক্ষণ ঝুম বৃষ্টিতে ভিজছিলেন। দাদাজান বললেন, তুমি আমার নাতনিকে কষ্ট করে পৌঁছে দিয়েছ এইজন্যে তোমাকে ধন্যবাদ। শুকনা কাপড় দিচ্ছি। কাপড় পরো। খাবার দিচ্ছি, খাবার খেয়ে বিদায় হয়ে যাও। আমার নাতনি তোমাকে তালাক দিয়েছে, কাজেই এখন আর তুমি তার স্বামী না।
জাহাঙ্গীর হালকা গলায় বললেন, সে আমাকে তালাক দিতে পারবে না।
কেন পারবে না?
তাকে বিয়ের সময় সেই অধিকার দেওয়া হয় নাই।
দাদাজান বললেন, তাহলে তুমি তালাক দিবে। আমি কাজী ডেকে আনছি। তুমি কাজীর সামনে তালাক দিয়ে বিদায় হবে। বুঝেছ?
জি।
জাহাঙ্গীর ভেজা কাপড় বদলালেন না। খাবারও খেলেন না। কঠিন চোখমুখ করে সোফায় বসে রইলেন।
দাদাজান বললেন, হারামজাদা! তুই আমাকে চিনিস না। আমি তোর চামড়া খুলে ফেলব।
জাহাঙ্গীর বললেন, গালাগালি কেন করছেন? যা করা হয়েছে আপনার নাতনির মঙ্গলের জন্যে করা হয়েছে।
দাদাজান বললেন, আবার ফরফর করে কথা বলে। আমি কাঁচি দিয়ে তোর জিভ কেটে ফেলব। দাঁড়া কাঁচি নিয়ে আসি।
দাদাজান হঠাৎ কেন রেগে অস্থির হলেন বুঝলাম না। তিনি সত্যি সত্যি বিশাল এক কাঁচি নিয়ে ফিরলেন। তার আগেই জাহাঙ্গীর সোফায় এলিয়ে পড়লেন। জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছিল।
এই মানুষটি গুনে গুনে তিন সপ্তাহ প্রবল জ্বরে ভুগল। তাঁকে রাখা হলো একতলার একটা ঘরে।
বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতো আমি আমার স্বামীর সেবা-যত্ন করলাম তা যেন কেউ মনে না করেন। মাঝে মাঝে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়েছি। এই পর্যন্তই।
তার নিউমোনিয়া হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার জবাব দিয়ে দেওয়ার পর দাদাজান তাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। কঠিন গলায় বললেন, হাসপাতালে গিয়ে মরুক, আমার এখানে না।
ন্যাশনাল হাসপাতালের সঙ্গে ব্যবস্থা করা হলো। তারা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে রোগী নিতে এল।
রোগী সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলল, আমাকে হাসপাতালে নিতে হবে। আমার রোগ সেরে গেছে। আমার বাপজানের মৃত্যু হয়েছে। আমি এখন গদিনসীন পীর।
দাদাজান বললেন, তোমাকে কে বলেছে? জ্বিনের বাদশা এসে বলে গেছে?
তিনি এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আল্লাহপাক যখন কাউকে বিপদ দেন তখন পরপর তিনবার দেন। তোমার জীবনে আরও দুইবার মহাবিপদ আসবে। তখন একমনে দোয়া গাঞ্জল আরশ পাঠ করবে। আরেকটা কথা, কুকুর থেকে সাবধান। একটা পাগলা কুকুর তোমাকে কামড়াবে।
দাদাজান বললেন, চুপ থাক বুরবাক! ফকির সাব চলে এসেছেন। পেটে পাড়া দিলে নাক-মুখ দিয়ে ফকিরি বের হয়ে যাবে।
হাফেজ জাহাঙ্গীর দাদাজানের কথা শুনে মনে হয় মজা পেয়েছেন। তাঁর মুখভর্তি হাসি।
দাদাজান বললেন, তুই হাসছিস কেন?
আপনার অকারণ রাগ দেখে হাসছি। আপনি চাইলে আপনাকে একটা তাবিজ দেব। তাবিজ ধারণ করলে রাগ কমবে।
আর একটা কথাও না। কথা বললেই থাপ্পড় খাবি।
ন্যাশনাল হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে তাঁকে রেলস্টেশনে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। আমরা তাঁর ভাড়া দিতে ভুলে গেলাম। তিনিও চাইলেন না।