তৃতীয় পরিচ্ছেদ
অন্যকে আপনার সঙ্গী করুন–নয় তো একলা চলতে হবে
প্রতিটি গ্রীষ্মকালেই আমি মেইনে মাছ ধরতে যাই। ব্যক্তিগতভাবে আমি আবার স্ট্রবেরী আর ক্রীম খুবই ভালোবাসি, তবে আশ্চর্য ব্যাপার হলো মাছেরা ভালোবাসে পোকামাকড়। অতএব আমি মাছ ধরতে গেলে আমি আমার নিজের পছন্দের কথাটা ভাবিনা বরং মাছেরা কি চায় তাই ভাবি। বঁড়শিতে তাই স্ট্রবেরি বা ক্রীম না আটকিয়ে আমি লাগাই পোকামাকড় বা একটা ফড়িং তারপর মাছেদের বলি : ‘এটা পছন্দ হয়েছে?’
তাহলে মানুষ গাঁথতে গিয়ে এই সাধারণ বুদ্ধিটাই কাজে লাগান না কেন?
লয়েড জর্জ ও ঠিক এমনটি করেছিলেন। তাঁকে যখন কেউ জিজ্ঞাসা করেছিল যুদ্ধের সময় উইলসন, অর্ল্যাণ্ডো আর ক্লিমেন্সের মত নেতারা যখন বিস্মৃত আর ক্ষমতাচ্যুত হন তখন তিনি কেমন করে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় আসীন থেকেছেন। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে তার ক্ষমতার শীর্ষে থাকার কারণ একটাই, আর তা হলো তিনি শিখেছিলেন মাছ বুঝে চার ফেলা চাই।
আমরা যা চাই তা নিয়ে আলোচনা কেন? এটা ছেলেমানুষী অবাস্তব কাজ। এটা অবশ্য ঠিক আপনি যা চান তাতে আপনার আগ্রহ আছে, চিরকাল ধরেই সেটা আছে। কিন্তু আর কেউ তেমন আগ্রহশীল নয়। আমরা বাকি সবাই আপনারই মত, আমরা যা চাই তাতেই আমাদের আগ্রহ।
অতএব এ জগতটায় অন্য মানুষকে আগ্রহী করে তোলার উপায় হলো সে যা চায় সে সম্পর্কে কথা বলা আর কি করে সেটা সে পেতে পারে তা দেখিয়ে দেওয়া।
ভবিষ্যতে কাউকে দিয়ে কিছু করিয়ে নিতে গেলে কথাটা মনে রাখবেন। ধরুন আপনি চান না আপনার ছেলে ধূমপান করুক, তাহলে তাকে উপদেশ দিতে যাবেন না বা আপনি যা চান বলবেন না। বরং তাকে দেখিয়ে দিন সিগারেট খেলে সে বেসবল টীমে সুযোগ না পেতে পারে বা একশ গজ দৌড়ে বিজয়ী না হতেও পারে।
এ ব্যাপারটা মনে রাখা খুবই ভালো, আর তা আপনি ছোট ছেলেমেয়ে, শাবক বা শিম্পাঞ্জি যাকে নিয়েই চলতে চান না কেন। যেমন উদাহরণ হিসেবে : রাফল ওয়ালডো এমার্সন আর তার ছেলে একটা বাছুরকে একদিন খোঁয়াড়ে ঢোকানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তারা খুব সাধারণ সেই ভুলই করলেন। তারা নিজেরা যা চান তাই করছিলেন। এমার্সন বাছুরটাকে ঠেলে দিচ্ছিলেন আর তাঁর ছেলে টানতে চাইছিলেন। বাছুরটাও নিজে যা চায় তাই করতে লাগল–সে পা শক্ত করে কিছুতেই জায়গাটা ছাড়তে চাইলো না। বাড়ির আইরিশ পরিচারিকা ওঁদের ঝামেলা লক্ষ্য করছিল। পরিচারিকার প্রবন্ধ বা বই লেখার ক্ষমতা ছিল না, তবে এমন অবস্থায় তার প্রচুর সাধারণ বুদ্ধি ছিল, যা এমার্সনের ছিল না। বাছুরের মনোভাব সে বুঝল। সে করলো কি ওর আঙুলটা মাতৃস্নেহে বাছুরের মুখে ঢুকিয়ে দিতেই বাছুরটা সেটা চুষতে শুরু করলো আর তাকে ঘরে ঢুকিয়েও দেয়া গেল।
জন্মের পর থেকে আপনি যা করে আসছেন তা হলো আপনার কিছু উদ্দেশ্য আছে বলে। মনে ভাবুন যেদিন রেড ক্রশের তহবিলে একশ ডলার দান করেছিলেন। হ্যাঁ, এটা নিয়মের কোন ব্যতিক্রম নয়। আপনি রেড ক্রশকে একশ ডলার দিয়েছেন কারণ আপনি সাহায্যের হাত বাড়াতে চেয়েছেন, আপনি চেয়েছেন চমৎকার একটা স্বার্থপরতাহীন স্বর্গীয় কাজ করতে।
.
একশ ডলার আপনি যদি খুব বড় মনে করতেন তাহলে নিশ্চয় টাকাটা আপনি হাতছাড়া করতেন না। অবশ্য দানটা আপনি চক্ষুলজ্জাতেও করে থাকতে পারেন বা কোন মক্কেলের কথাতেও তা পারেন। তবে একটা ব্যাপার ঠিক। আপনি দানটা করেন যেহেতু আপনি কিছু চেয়েছিলেন।
প্রফেসর হ্যারী এ ওভারষ্ট্রীট তাঁর চমৎকার বই ‘ইনফ্লুয়েন্সিং হিউম্যান বিহেভিয়ারে’ লিখেছিলেন : আমাদের কাজের উৎপত্তি হল আমাদের ইচ্ছাশক্তি থেকেই …ভবিষ্যতে যারা অন্যদের বশে আনতে চান, সেটা পরিবারে, স্কুলে, রাজনীতিতে যেখানেই হোক না কেন–তাদের প্রতি সব সেরা পরামর্শ হলো প্রথমে সেই মানুষের মনে সে যা চায় সে সম্বন্ধে আগ্রহ জাগিয়ে তোলা। একাজ যে করতে পারে সারা দুনিয়াই তার সঙ্গে থাকবে। যে পারে না তাকে একলাই চলতে হয়।’
একেবারে গরীবের সন্তান স্কচ অ্যান্ড্রু কার্নেগী, যিনি ঘন্টায় দু সেন্ট রোজগার করে জীবন শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত কয়েক হাজার কোটি ডলার দান করেন। জীবনে শুরুতেই শিখেছিলেন যে মানুষের উপর প্রভাব বিস্তারের গোড়ার কথা হলো অন্যরা কি চায় সেটা বুঝে কথা বলা। তিনি মাত্র চার বছর স্কুলে পড়েছিলেন, তবুও মানুষদের ভালোভাবেই চালনা করতে শেখেন।
একটা উদাহরণ দিচ্ছি : তার শালী একবার তার দুই ছেলে নিয়ে দারুণ চিন্তায় পড়েন। দুজনে ইয়েলে পড়াশুনা করছিল আর তারা নিজেদের নিয়েই এতে মশগুল ছিল যে বাড়িতে চিঠিপত্র লেখার কথা বা মায়ের চিঠির জবাব দেওয়ারও সময় থাকতো না তাদের।
কার্নেগী সব শুনে একশ ডলার বাজি রাখলেন যে উত্তর না চেয়েও পরের ডাকেই তিনি ওদের উত্তর এনে দেবেন। একজন বাজিতে রাজীও হয়ে গেল। তিনি এবার দুজনকে বেশ তামাশা করে চিঠি লিখে জানালেন এবং সঙ্গে দুজনকে পাঁচ ডলার করে নোট পাঠাচ্ছেন তাও জানালেন।
টাকাটা অবশ্য তিনি পাঠালেন না।
পরের ডাকেই যথারীতি উত্তর এসে গেল মেশোমশায়কে ধন্যবাদ জানিয়ে। অবশ্য চিঠিতে আর কি ছিল নিজেরাই সেটা ভেবে নিন।
আগামীকালই আপনি হয়তো কাউকে দিয়ে কোন কাজ করাতে চাইবেন। কথা বলার আগে একটু চিন্তা করে প্রশ্ন করুন : ‘ওকে কাজ করতে আগ্রহী করবো কিভাবে?’
এই প্রশ্নটা মনে জাগলে আমরা পাগলের মত ছুটে গিয়ে সেই লোককে আমি কি চাই বোঝাতে বসবো না। একাজ বৃথাই হবে।
নিউইয়র্কের কোন এক হোটেলের বলরুমটা আমি কুড়িটি রাতের জন্য ভাড়া করেছিলাম, উদ্দেশ্য কিছু বক্তৃতা দেওয়া। এক সীজুনের শুরুতে আমাকে আচমকা জানানো হলো আমার আগের ভাড়ার প্রায় তিনশগুণ বেশি দিতে হবে। এ খবর আমার কাছে আসে টিকিট ছেপে বিলিয়ে দেবার আর ঘোষণা করার পরে।
স্বাভাবিকভাবেই বাড়তি টাকা দেবার ইচ্ছে আমার ছিল না। কিন্তু আমি কি চাই তা নিয়ে হোটেলের সঙ্গে কথা বলে কোন লাভ হতো কি? তাদের আগ্রহ তারা কি চায় তাই নিয়ে। তাই দিন কয়েক পরে
আমি ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।
দেখা করে আমি বললাম, আপনার চিঠিটা পেয়ে একটু ধাক্কা খেয়েছি। তবে আপনাকে দোষ দিচ্ছি না। আপনার জায়গায় থাকলে আমিও বোধ হয় এরকম চিঠিই লিখতাম।এ হোটেলের ম্যানেজার হিসেবে যত বেশি লাভ করা যায় সেটা দেখা উচিত। তা না করলে আপনার চাকরি হয়তো থাকবে না, আর না থাকই স্বাভাবিক। এখন একবার আসুন এক টুকরো কাগজে লেখা যাক এই ভাড়া বাড়ালে আপনার কি সুবিধে অসুবিধে হতে পারে।
.
এরপর আমি একটা লেটার প্যাডের কাগজ নিয়ে মাঝবরাবর একটা লাইন টেনে একপাশে লিখলাম ‘সুবিধা’ অন্যপাশে লিখলাম ‘অসুবিধা’।
এবারে সুবিধার ঘরে লিখলাম : বলরুম বিনা ভাড়ায়। তারপরেই বললাম, আপনি বলরুম নাচ আর অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া পেলে আপনাদের সুবিধেই হয়। এ বেশ বড় সুবিধে কারণ বক্তৃতার জন্য ঘরটা ছেড়ে দেওয়ার চেয়ে বলরুমে নাচের অনুষ্ঠানে ভাড়া দিয়ে অনেক বেশি লাভ হয়। আপনাদের বলরুমটা কুড়িটা রাতের মত আটকে রাখলে নিশ্চয়ই আপনাদের লাভ বেশ কমই হবে।
‘এবার আসুন অসুবিধের ব্যাপারটা দেখা যাক। প্রথমে, আমার কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় না করে আপনাকে তা কমাতে হবে। আসলে এটা আপনাকে মন থেকে একদম মুছে ফেলতে হবে। কারণ যে ভাড়া চাইছেন আমি তা দিতে পারবো না। আমাকে বাধ্য হয়ে অন্য কোথাও বক্তৃতার ব্যবস্থা করতে হবে।
‘এছাড়াও আপনার আর একটা অসুবিধে আছে। এই বক্তৃতা আপনার হোটেলে বহু শিক্ষিত আর সংস্কৃতিবান মানুষ টেনে আনবে। আর সেটা আপনার পক্ষে চমকার বিজ্ঞাপন হবে, তাই না? আসলে, খবরের কাগজে আপনারা যদি ৫০০০ ডলারের বিজ্ঞাপন দেন তাহলেও এতো মানুষকে হোটেল দেখাতে হাজির করতে পারতেন না, আমি এই বক্তৃতার মধ্যে দিয়ে যা পারবো। এটা হোটেলের পক্ষে অনেকখানি, তাই না?
কথা বলতে বলতে আমি অসুবিধা দুটো ঠিক জায়গায় লিখে ফেললাম, তারপর কাগজটা ম্যানেজারের হাতে দিয়ে বললাম, আশা করি সুবিধে আর অসুবিধে দুটোই ভালো করে দেখে তারপর আপনার মতামত আমায় জানাবেন।‘
পরের দিনই একটা চিঠি পেলাম, তাতে আমায় জানানো হয়েছিলো যে আমার জন্য ভাড়াটা তিনশগুণের বদলে মাত্র শতকরা ৫০ ভাগ বাড়ানো হয়েছে। মনে রাখবেন এই ভাগ কামানো হয়েছিল এ ব্যাপারে আমার মনের ইচ্ছে একটুও না জানিয়ে। আমি সারাক্ষণই অন্য জন কি চায় আর পেতে পারে সেটাই ভেবেছি।
মনে করুন স্বাভাবিক মানুষের মতই আমি যদি কাজ করতাম, ধরুন সটান সবেগে ঘরে ঢুকে আমি বলতাম, এভাবে তিনশগুণ ভাড়া বাড়ানোর মানে কি একবার বলবেন? আপনি জানেন যে টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে আর ঘোষণাও করা হয়ে গেছে? তিনশগুণ! হাস্যকর? অসম্ভব! এ টাকা কিছুতেই দেব না!
এতে কি হতো! এটা তর্কের অবকাশ শুরু হতো, বেশ গরম কথাবার্তা চলতো–আর আপনাদের অবশ্যই জানা আছে তর্কের পরিণতি কেমন হয়। তাকে যদি স্বীকার করাতেও পারতাম তার ভুল হচ্ছে, তাহলেও তার অহমিকাবোধই তাকে সব মেনে নিয়েও হার মানাতে দিতো না।
মানবিক সম্পর্ক নিয়ে চমৎকার একটা পরামর্শের বিষয়ে বলছি। কথাটা হেনরি ফোর্ডের। তিনি বলেছিলেন, কারও যদি সাফল্যের গোপন চাবিকাঠি থাকে, তাহলে সেটা থাকে তার অন্যের কথার দৃষ্টিকোণ আর নিজের দৃষ্টিকোণ বুঝে নেওয়ার ক্ষমতার মধ্যে। কথাটা বারবার বলার আর মনে রাখার মতই।
ব্যাপারটা খুবই সরল আর এতোই স্বাভাবিক যে,যে কেউ একবার দৃষ্টি মেলেই এর অন্তরের সত্য দেখতে পারবে, তবুও দুনিয়ার শতকরা ৯০ ভাগ মানুষই শতকরা ৯০ বার এটা আগ্রাহ্য করে।
কোন উদাহরণ চান? তাহলে আগামীকাল সকালে যেসব চিঠি আসবে সেগুলো দেখে নিন–তাহলেই দেখবেন বেশির ভাগই এই সাধারণ বুদ্ধির ব্যাপারটা মানতে চায় না। একটা উদাহরণ নিন : কোন বিজ্ঞাপন এজেন্সীর বেতার দপ্তরের প্রধানের লেখা সারা দেশের নানান অফিসের কাছে। সারা দেশের স্থানীয় বেতার স্টেশনের ম্যানেজারদের কাছে লেখা হয় চিঠিটা (প্রতিটি প্যারাগ্রাফেই আমার নিজস্ব মতামত আমি লিখে দিয়েছি)
.
মিঃ জন ব্ল্যাঙ্ক,
ব্ল্যাঙ্ক ভিল,
ইণ্ডিয়ানা।
প্রিয় মিঃ ব্ল্যাঙ্ক,
বেতার দুনিয়ায় আমাদের কোম্পানী বিজ্ঞাপন বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে ইচ্ছুক।
(আপনার কোম্পানী কি চায় তাতে কার মাথা ব্যথা? আমি আমার সমস্যা নিয়েই বিব্রত। ব্যাঙ্ক আমার বাড়ির বন্ধক আগেই বন্ধ করে দিয়েছে। পোকায় সব ফসল নষ্ট করছে, শেয়ার বাজার গতকাল উল্টেছে, আজ সকালে ৮-১৫র গাড়ি ধরতে পারিনি, জোন্সের নাচের অনুষ্ঠানে গতরাতে আমি নিমন্ত্রিত হইনি, ডাক্তার বলছেন আমার ব্লাড প্রেসার খুব বেড়ে গেছে, স্নায়ুর রোগ আর খুশকিও হয়েছে। এরপর কি হবে? আমি দুশ্চিন্তা নিয়ে সকাল বেলা অফিসে আসবো, চিঠিপত্র খুলবো, আর খুলেই দেখবো নিউ ইয়র্কের কোন এক কেউকেটা তার কোম্পানী কি চায় তাই নিয়ে সাতকাহন লিখেছে। ফুঃ। লোকটার যদি ধারণা থাকতো এরকম চিঠি কি রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তাহলে বিজ্ঞাপন ব্যবসা ছেড়ে সে ঘোড়ার ঘাস কাটা শুরু করতো)।
‘এই এজেন্সী জাতীয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যে টাকা আয় হয় সেটা সবার চেয়ে বেশি। আমাদের পরবর্তী কর্মসূচী বছরের পর বছর ধরে শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে চলেছে।‘
(আপনারা অনেক বড় আর ধনী, একেবারে চুড়াতেই আপনাদের আসন। তাতে কি আসে যায়? আপনারা জেনারেল মোটর, জেনারেল ইলেকট্রিক আর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে নিয়ে গড়া বিরাট কিছু হলেও আমি তার কানাকড়ি দামও দিই না। আপনার যদি ক্ষুদে চড়ুই পাখির মতও বুদ্ধি থাকতো তাহলে বুঝতে পারতেন আমি কত বড় আর তাতেই আমার আগ্রহ আছে–আপনি কতো বড় তাতে নয়। আপনাদের বিরাট সাফল্যের কথা শুনে আমার নিজেকে দারুণ ছোট আর হীন মনে হয়)।
‘আমরা চাই আমাদের প্রতিষ্ঠান বেতার সম্পর্কে শেষ কথাই হয়ে উঠুক …।
(আপনারা চান। আপনারা আস্ত গর্দভ। আপনারা বা মুসোলিনী বা কিং ক্রসবী কি চান আমার জানতে কণামাত্রও আগ্রহ নেই। আপনাকে শেষবারের মত জানাতে চাই যে আমি নিজে কি চাই তাতেই শুধু আমার আগ্রহ আছে–আর আপনার এই অদ্ভুত চিঠিতে সে কথা আপনি একবারও বলেন নি।)
‘অতএব আপনারা আমাদের প্রতিষ্ঠানকে আপনাদের তালিকায় সাপ্তাহিক বেতার ষ্টেশনের খবরের জন্য নথীভুক্ত করবেন আশা রাখি …।‘
(নথীভুক্ত করবো! আপনাদের স্নায়ুর জোর আছে বটে! আপনার বড় বড় কথায় আমার নিজেকে একেবারে অপদার্থ মনে হচ্ছে তার উপর আপনি আবার আমাদের তালিকায় আপনাকে নথীভুক্ত করতে বলছেন। লেখার সময় একবার দয়া করে কথাটা বলারও প্রয়োজন বোধ করছেন না।)।
এই চিঠির দ্রুত প্রাপ্তি স্বীকার করে আপনাদের বর্তমান কাজের ধারা জানালে উভয়ের পক্ষেই সেটা কাজের হবে।
(মূর্খ! একখানা সস্তাদরের, বাজে কাগজে লেখা চিঠি পাঠিয়াছেন-চৈত্রের ঝরাপাতার মত একখানা চিঠি-তার উপর আমি যখন বন্ধক, ব্লাড প্রেসার, পোকার উৎপাত নিয়ে ব্যতিব্যস্ত তখন আবার বলার স্পর্ধা দেখিয়েছেন আপনার ওই বাজে চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করতে–তাও আবার দ্রুত’! আপনার কি জানা আছে আপনার মত আমিও ব্যস্ত–অন্ততঃ আমি সেটাই ভাবতে চাই? আর কথাটা যখন উঠেছে তখন বলি এমন লাট সাহেবের মত হুকুম করার সাহস কোথায় পেলেন? আপনি বলেছেন ‘এটা উভয়ের পক্ষেই কাজের হবে। শেষ পর্যন্ত তাহলে আমার মনটা বুঝতে পেরেছেন দেখছি। তবে আমার কি সুবিধা হবে সে ব্যাপারটা ধোঁয়ার মতই রয়ে গেছে।)
আপনার
বিশ্বস্ত,
জন ব্ল্যাঙ্ক
ম্যানেজার, বেতার দপ্তর।
‘পুনশ্চ : ভিতরে পাঠানো ব্ল্যাঙ্কভিল পুস্তিকাটি আপনার আগ্রহ জাগাতে পারে, আর এটা আপনি বেতারে ঘোষণার ব্যবস্থাও করতে পারবেন।
(শেষ পর্যন্ত পুনশ্চতে যা লিখেছেন তাতে আমার কোন সমস্যার সমাধান হতেও পারে। আপনি এটা দিয়েই তো চিঠিটা শুরু করতে পারতেন–কিন্তু কি লাভ? যে কোন বিজ্ঞাপন দপ্তরের লোক এমন চিঠি লিখলে তার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ জাগে। আমাদের ইদানিং কালের কাজের বিবরণ লেখা চিঠি পেয়ে আপনার কোন কাজই হবে না–আপনার দরকার হলো আপনার থাইরয়েড গ্ল্যাণ্ডের জন্য খানিকটা আয়োডিন।)
.
এখন ধরুন বিজ্ঞাপন ব্যবসাতেই জীবন কাটাচ্ছেন আর মানুষকে প্রভাবান্বিত করতে পারেন বলে আত্মশ্লাঘা আছে এমন একজনের কাছ থেকেই যদি এরকম চিঠি আসে তাহলে আমাদের মাংসওয়ালা, রুটিওয়ালা বা কার্পেট সারাইওয়ালা কাছ থেকে কেমন আশা করবো?
আর একখানা চিঠির উদাহরণ দেখুন। এ চিঠিটা লিখেছিলেন এই বিষয়ের একজন ছাত্রকে জনৈক মালপরিবহণ কোম্পানীর সুপারিন্টেন্ডেন্ট। যাকে লেখা হয়েছিল তার মনে এটা কি রকম প্রভাব ফেলেছিল? আগে চিঠিটা পড়ুন তারপর বলছি।
‘এ জেরেগাস সন্স ইনকরপোরেটেড
২৮, ফ্রন্ট স্ট্রীট,
ব্রুকলীন. এন. ওয়াই।
মিঃ এডওয়ার্ড ভার্মিলেন সমীপেষু।
মহাশয়,
আমাদের বহির্গামী রেলপথের মাল গ্রহণ কেন্দ্রে অপরাহ্নে মাল পাঠানোর জন্য বিশেষ অসুবিধা হচ্ছে।
এই সবের ফলে দেখা দিচ্ছে ভিড়, আমাদের কর্মীদের ওভারটাইম, ট্রাকের জন্য দেরি আর কোন
কোন ক্ষেত্রে মাল পাঠানোয়
দেরি হয়ে যাচ্ছে। ১০ই নভেম্বর আপনাদের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৫১০
পেটি মাল আসে প্রায় বিকেল ৪-২০ মিনিটে।
আমরা এই সব কাজের আর দেরীতে মাল পরিবহণের অবাঞ্ছনীয় প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে রেহাই পেতে আপনার সহযোগিতা কামনা করি। আমরা কি এই অনুরোধ জানাতে পারি এরপর যখন এই রকম বেশি পরিমাণে মাল পাঠাবেন তখন সেগুলি ট্রাকে করে বিকেলের আগেই পাঠাবেন বা অন্ততঃ কিছু সময় আগেই পাঠাবেন?
এই রকম ব্যবস্থায় আপনাদের যে লাভ হবে তাহলো আপনাদের ট্রাক আরও দ্রুত খালি হতে পারবে, আর আমরা এ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে আপনাদের ট্রাক সঙ্গে সঙ্গেই খালি করে দিতে পারবো।
আপনার অতি বিশ্বস্ত,
জে-বি
সুপারিন্টেন্ডেন্ট।
চিঠিটা পড়ার পর এ জেরেগাস কোম্পানীর সেলস ম্যানেজার মিঃ ভার্মিলেন সেটা আমার কাছে নিচের মন্তব্যসহ পাঠিয়ে দেন :
‘যা চাওয়া হয়েছিল এ চিঠিটায় ঠিক তার উল্টো ফল হয়। চিঠিটা শুরু করা হয়েছে মাল খালাস ইত্যাদির অসুবিধা জানিয়ে, তবে বলতে গেলে এ নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। আমাদের কোন অসুবিধার কথা চিন্তা ভাবনা ছাড়াই অনুরোধ জানানো হয়েছে যে আমরা সহযোগিতা করলে ট্রাক দ্রুত খালাস করে ঐদিনেই মাল পাঠানো হবে।
‘অন্যভাবে বলতে গেলে আমাদের যে ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ আছে সেটা সবার শেষে লেখা হয়েছে আর চিঠিটা সহযোগিতার না হয়ে শত্রুতাপূর্ণই উঠেছে।
আসুন এবারে দেখা যাক এচিঠিটা আবার নতুন করে লিখে আরও ভালো করা যায় কিনা। আমাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। হেনরি ফোর্ড যেমন বলেছিলেন : সব সময় অপরজনের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করবেন, সঙ্গে নিজেদেরও।‘
নিচে চিঠিটা ঘুরিয়ে লেখার উদাহরণ রাখছি। এটাই হয়তো সবচেয়ে ভালো নয়, তবে অবশ্যই কিছুটা উন্নত, কী বলেন?
মি.
এডওয়ার্ড ভার্মিলেন,
অ/এ. জেরেগাস সন্স ইনকং।
২৮ ফ্রন্ট স্ক্রীট,
ব্রুকলীন, এন. ওয়াই।
প্রিয় মি. ভার্মিলেন,
গত চৌদ্দ বছর যাবৎ আপনার প্রতিষ্ঠান আমাদের একজন ভালো মক্কেল হয়ে আছেন। স্বাভাবতই তাই আপনাদের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। তাই আপনাদের যা প্রয়োজন সেই দ্রুত পরিচ্ছন্ন। কাজ আমরা করতে প্রস্তুত। যাই হোক আমরা দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি এটা করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব যদি আপনাদের ট্রাক প্রচুর মালসহ বিকেলের অনেক পরে আসে, যেমন এসেছিলো ১০ই নভেম্বর। কেন? তার কারণ অন্যান্য কোম্পানীও বিকেলের দিকে মাল সরবরাহ করে থাকেন। স্বভাবতই এর ফলে ভিড় জমতে থাকে। এর অর্থ হলো অনিবার্য ভাবেই আপনাদের ট্রাক জেটিতে আটকে যায়, আর অনেক ক্ষেত্রে আপনাদের মাল পরিবহণে দেরিও হয়ে যায়।
এটা বড়ই খারাপ। এটা কেমন করে এড়ানো যায়? এটা সম্ভব আপনাদের মাল বিকেলের আগেই জেটিতে পৌঁছে দেওয়া। এতে সব কাজ দ্রুত হতে পারবে, আপনাদের মাল আমাদের নজরে থাকবে আর আমাদের কর্মচারিরাও তাড়াতাড়ি রাতের আগে বাড়ি ফিরে নিজেদের তৈরি সুস্বাদু ম্যাকারোনি আর নুডলস্ সহযাগে নৈশভোজ সারবে।
আমার অনুরোধ এচিঠিকে কোন অভিযোগ বলে ভাববেন না, আর এটাও ভাববেন না আপনাদের ব্যবসা চালানোর ক্ষেত্রে মাথা গলাচ্ছি।
যখনই আপনারা মাল পাঠান না কেন আমরা আনন্দের সঙ্গেই যথাসাধ্য আপনাদের সেবায় নিয়োজিত থাকবো।
আপনারা অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ। দয়া করে এ চিঠির উত্তর দিতে চাইবেন না।
আপনার বিশ্বস্ত
জে–বি–সুপারিন্টেন্ডেন্ট।
আজকের দিনে হাজার হাজার বিক্রেতা রাস্তার ধারে ক্লান্ত, ভগ্ন মনোবল অল্প মাইনেতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কেন? তার কারণ তারা সর্বদাই নিজেরা কি চায় সে কথাই ভেবে চলে। তারা উপলব্ধিই করতে পারে না আপনি বা আমি কিছু কিনতে আগ্রহী নই। আমরা যদি চাইতাম তাহলে দোকানে গিয়ে কিনে আনতাম। কিন্তু আমি বা আপনি চিরায়ত পথেই নিজেদের সমস্যা সমাধান করতে ব্যস্ত। অবশ্য কোন বিক্রেতা যদি আমাদের দেখিয়ে দিতে পারে তার সাহায্য বা জিনিস আমাদের সমস্যা সমাধানে কতটা সাহায্য করতে পারবে তাহলে তাকে আমাদের কাছে বিক্রি করতে হবে না। আমারাই কিনব। একজন খরিদ্দার এটাই ভাবে সে নিজের থেকে ক্রয় করছে–তাকে বিক্রি করা হচ্ছে সে ভাবতে চায় না।
এ সত্ত্বেও কিন্তু বহু লোকই সারা জীবন বিক্রীর চেষ্টায় কাটাতে চায়–তারা সব কিছু ক্রেতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চায় না। যেমন উদাহরণ দিচ্ছি–আমি গ্রেটার নিউ ইয়র্কের ফরেস্ট হিল এলাকাতে থাকি। একদিন যখন স্টেশনে ছুটছিলাম তখন একজনের সঙ্গে আমার দেখা হয়–লোকটি বহুদিন যাবত লং আইল্যাণ্ডে জমির কেনা বেচা করে কাটিয়েছেন। ফরেস্ট হিল এলাকা তার ভালই জানা ছিল তাই আমি তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করলাম আমার বাড়িটি কি দিয়ে বানান-ধাতব পাত না ফাঁপা টালি। সে জানাল ওটা তার জানা নেই, বরং তিনি যা বললেন সেটা আমার আগে তেকেই জানা। অর্থাৎ আমি নিজেই যেন ফরেস্ট হিলস গার্ডেন অ্যাসোসিয়েশনকে ফোন করে জানতে পারি। পরের দিন সকালে লোকটির কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। চিঠিতে আমি যা জানতে চেয়েছিলাম সেটাই তিনি দিয়েছিলেন কি? সেটা তিনি ষাট সেকেণ্ডের মধ্যে একটা টেলিফোন করেই জানাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। তিনি বরং লিখেছিলেন আমি নিজেই টেলিফোন করে অ্যাসোসিয়েশন থেকে জেনে নিই এবং চিঠির শেষে তিনি অনুরোধ করেছিলেন আমি যেন আমার বীমা সংক্রান্ত ব্যাপারটা তাকেই দেখতে দিই।
আমাকে সাহায্য করতে তার কোন আগ্রহ ছিলো না। তিনি শুধু নিজেকেই সাহায্য করতে চাইছিলেন। আমার উচিত ছিল ওকে ভ্যাস ইয়ং-এর চমৎকার বই, ‘এ গো গিভার’ আর ‘এ ফরচুন টু শেয়ার’ পড়তে দেওয়া। তিনি বই দুটো পড়ে বইয়ের বক্তব্য অনুসরণ করলে আমার বীমার কাজ করার চেয়ে হাজার গুণ বেশি লাভ করতেন।
পেশাদার মানুষরাও একই ভুল করে থাকেন। বেশ কয়েক বছর আগে আমি ফিলাডেলফিয়ার একজন নামী নাক আর গলা বিশেষজ্ঞর কাছে যাই। লোকটি আমার টনসিলটা না দেখেই প্রশ্ন করেছিলেন আমার কাজকর্ম কি। আমার টনসিলের আকার নিয়ে তার কোন মাথা ব্যথা ছিল না। তার আগ্রহ ছিল আমার টাকা দেবার ক্ষমতা সম্বন্ধে। আমাকে কতটা সাহায্য করতে পারেন না ভেবে তিনি ভাবছিলেন আমার কাছ থেকে কত আদায় করতে পারবেন। ফল দাঁড়ালো তিনি কিছুই পেলেন না। আমি তার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম তার ব্যক্তিত্ব অভাবের নিন্দা করে।
দুনিয়াটাই এইরকম মানুষে ভর্তি, শুধু লোভী আর স্বার্থপর। তাই নিঃস্বার্থভাবে অন্যের সাহায্যে তৎপর এমন লোক বড় কম, অথচ অন্যের চেয়ে তাদের প্রচুর সুবিধা আছে। তার প্রতিযোগিতা থাকে সামান্য। ওয়েন ডি. ইয়ং বলেছিলেন : ‘যে ব্যক্তি অন্যের জায়গায় নিজেকে ভাবতে পারেন, অন্যের ভাবনা নিজের করতে পারেন ভবিষ্যতে তার ভাবনা থাকে না।
এই বইটি পাঠ করার পর আপনি যদি শুধু একটা জিনিসই পান, শুধু বেশি করে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে চিন্তা করা, এবং তার দৃষ্টিভঙ্গিকে দেখা–এই একটামাত্র জিনিস বইটা থেকে পেলে সেটাই হবে আপনার জীবনের একটা সোপান।
.
বেশিরভাগ লোকই কলেজে যান ভার্জিল পাঠ করতে আর ক্যালকুলাসের রহস্যের মত বিষয়ে ওস্তাদ হতে। তারা নিজেদের মন কিভাবে কাজ করে আদৌ ভাবেন না। যেমন ধরুন, আমি একবার ঠিক মত বক্তৃতা করার বিষয়ে একটা শিক্ষার ব্যবস্থা করি–এটা করা হয় নিউ জার্সির নেওয়ার্কের ক্যারিয়ার কর্পোরেশনে কাজে যোগদানের জন্য তৈরি কিছু কলেজে ছাত্রের জন্য। তাদের কাজ হল তাপ নিয়ন্ত্রণ জিনিসপত্র তৈরি। তাদের একজন অন্যান্যদের বাস্কেটবল খেলার জন্য আহ্বান জানাচ্ছিল। তার নিজের কথাটা ছিল এই রকম : আমার ইচ্ছে আপনারা বেরিয়ে এসে বাস্কেটবল খেলতে চলুন। আমার খেলাটা ভালো লাগে, কয়েকবার জিমনাসিয়ামে গেলেও খেলতে পারিনি তোক ছিল না বলে। কিছুদিন আগে দু’তিনজন মিলে বল ছুঁড়তে গিয়ে চোখটা প্রায় কানা হবার মত হয়েছিল। আমার ইচ্ছে আগামীকাল আপনারা সবাই চলুন বাস্কেটবল খেলা যাবে, আমার এটা খেলতে খুব ইচ্ছে।
সে কি আপনারা কি চান একবারও বলেছে? আপনারা কেউই জিমনাসিয়ামে যেতে চান না, তাই না? সে যা চায় তাও খেলতে চান না। চোখ কানা হোক তাও কেউ বোধহয় চাইবেন না।
সে কি জিমনাসিয়ামে গেলে আপনাদের কি উপকার হতো সেকথা বোঝাতে পারত? নিশ্চয়ই পারত। এতে শরীর চালনা দ্রুত হতে পারে, এতে ক্ষিদে হয়। মাথা সাফ হয়। মজা পাওয়া যায়। হৈ চৈ খেলাধুলা করা যায়, বাস্কেটবলও খেলা যায়।
প্রফেসর ওভারস্ট্রীটের কথাটা একবার শুনুন। তার কথা হল : ‘প্রথমে অন্যজনের মধ্যে একটা সাগ্রহ চাহিদা বাড়িয়ে তুলুন। যে এটা পারে সারা দুনিয়াই তার সঙ্গে থাকে। যে তা পারে না তাকে একলাই চলতে হয়।’
আমার শিক্ষানবীসদের মধ্যে একজন তার ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়েছিলেন। ছেলের ওজন কম ছিল, সে ঠিকমত খেতেও চাইত না। তার বাবা মা লোকে যা বলে তাই করছিলেন। ছেলেকে বকাবকি করছিলেন। ‘মা তোমাকে এটা খেতে বলেছে’ বা ‘বাবা তোমাকে মস্ত বড় হয়ে উঠতে বলেছেন।’
ছেলেটা কি ওই সব গুজবে কান দিয়েছে? একটুও না। যার মাথায় ছিটে ফোঁটা বুদ্ধিও তাকে তিনি বুঝতে পারেন, তিন বছরের একটা ছেলে আর ত্রিশ বছরের বাবার দৃষ্টিভঙ্গী এক হতে পারে না। ত। সত্ত্বেও কিন্তু এক্ষেত্রে ছেলেটির বাবা তাই চাইছিল। এটা একটা অবাস্তব ব্যাপার। অবশ্য এটা শেষ পর্যন্ত তার খেয়াল হয়। তাই তিনি নিজেকে বললেন : ‘ছেলেটা কি চায়? ও চায় আর আমি যা চাই দুটোকে মেলাবো কেমন করে?’
চিন্তা আরম্ভ করতেই ব্যাপারটা তার কাছে সহজ হয়ে গেল। তার ছেলের একটা তিন চাকার সাইকেল ছিল, সেটায় চড়ে সে তাদের ব্রুকলীনের বাড়ির পাশের রাস্তায় বেড়াতে চাইতো। কটা বাড়ির পরে রাস্তায় এক দুষ্টু ছেলে থাকতোতার ছেলের চেয়ে বয়সে সে বড়ো। সে ঐ ছোট ছেলেকে ওর সাইকেল থেকে টেনে নামিয়ে নিজেই সেটা চালাত।
স্বভাবতই ছোট্ট ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে মার কাছে ছুটে এসে বলতেই তার মা আবার গিয়ে সেই শয়তান ছেলেটাকে সাইকেল থেকে টেনে নামিয়ে ওকে চড়িয়ে দিতেন। এ রকমই প্রায় রোজ ঘটত।
বাচ্চাটি কি চাইত? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শার্লক হোমসের সাহায্যের দরকার হয় না। ওর অহঙ্কার, ওর রাগ, নিজেকে বড় বলে মনে করা ওর মনের এই সব আবেগই ওর মনে খেলে যেতে চাইত–আর সেটা ওকে প্রতিশোধ নেবার জন্য উদ্বুদ্ধ করত, সেই শয়তান ছেলেটির নাক ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে জাগত। তার বাবা এরপর যখন বাচ্চাটিকে বুঝিয়ে ছিল, সে যদি ওর মার কথামত ঠিকঠিক খেয়ে নেয় তাহলে আর কিছুদিনের মধ্যেই ও বড় হয়ে সেই শয়তান বড় ছেলেটার নাক ভেঙে একেবারে সায়েস্তা করে দিতে পারবে-ব্যাস্ এর পর তাকে খাওয়ানোর ব্যাপারে আর কোন সমস্যাই রইল না। সে তখন সব খাবারই ঠিক ঠিক খেতে আরম্ভ করলো, ক্রমে তরিতরকারি, মাছ যাই থাকুক। এর কারণ হলো ওর চেয়ে বড় একটা ছেলেকে ও ঠাণ্ডা করতে চেয়েছিল, যে ওকে সবসময় জ্বালাতন করত।
এই সমস্যার সমাধান করার পর তার বাবা তার একটা সমস্যা সমাধানে নামলেন। বাচ্চা ছেলেটি প্রায়ই বিছানা ভিজিয়ে ফেলত।
বাচ্চাটি ঘুমোত ওর ঠাকুমার কাছে। সকাল বেলায় ঠাকুমা উঠে বিছানার অবস্থা লক্ষ্য করে ওকে বলতেন, ‘দেখ জনি, রাত্তিরে আবার কি করছি।’
ছেলেটা জবাব দিত : না না, আমি করিনি, তুমি করেছ।
ওকে বকুনি দিয়ে, মারধর করে নানা রকমে বুঝিয়ে সুঝিয়েও কিন্তু বিছানা শুকনো রাখা যাচ্ছিল না। অতএব তার বাবা মা স্বভাবতই প্রশ্ন তুললেন : ‘ছেলেটাকে দিয়ে কেমন করে এই নোঙরা কাজ বন্ধ করাব?
ছেলেটার ইচ্ছেটা কি ছিল? প্রথমত সে চাইত তার বাবার মত পাজামা পরতে, ঠাকুমার মত রাতের গাউন তার একটুও ভালো লাগতো না। ঠাকুমা ওই বিছানা ভেজান নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, অতএব নাতির জন্যে রাতের পাজামা এসে গেল বেশ আনন্দের সঙ্গেই। আশা ছিল যদিও বদলে যায়। দ্বিতীয়তঃ ছেলেটি আরও চাইত নিজের একটা বিছানা। ঠাকুমা তাতেও আপত্তি করলেন না।
ওর মা ওকে ব্রুকলীনের একটা বড় দোকানে নিয়ে গিয়ে সেলস গার্লকে চোখ টিপে বললেন : ‘এই ছোট্ট ভদ্রলোক কিছু কেনাকাটা করবেন।’
মেয়েটিও ওর শ্রেষ্ঠত্ববোধ জাগাতে চেয়ে বলল, বল, তোমাকে কী দেখাব?
ছেলেটি পা উঁচু করে একটু লম্বা হয়ে বলল, আমি আমার জন্য একটা বিছানা চাই।
ওর মা মেয়েটিকে একটা বিছানা দেখিয়ে চোখ টিপলেন। আর ছেলেটিকে সে সেটাই পছন্দ করাল। আর তাই কেনাও হয়ে গেল।
বিছানাটি পরের দিন পৌঁছে গেল বাড়িতে। রাতের বেলা বাবা বাড়িতে আসতেই ছেলেটি দরজার কাছে এসে চিৎকার করে বলল, বাবা! উপরে এসে আমার বিছানা দেখে যাও, আমি নিজে কিনেছি।
বাবা চার্লস্ শোয়াবের কথাটাই মেনে চললেন। অর্থাৎ দারুণ খুশি হয়ে প্রশংসা করে চললেন ক্ষুদে ভদ্রলোকের।
‘এ বিছানাটা নিশ্চয়ই ভেজাবে না, কী বলো?’ বাবা এবার বললেন।
‘ওঃ না, না। কখনও এ বিছানা ভেজাব না।’ ছেলেটি অবশ্যই তার কথা রেখেছিল যেহেতু তার গর্ব এর উপর নির্ভর করছিল। বিছানাটা যে ওর নিজের। তাছাড়া সে এক খুদে ভদ্রলোকের মত পায়জামাও পরেছিল। সে তাই বড়সড় একজন মানুষের মত ব্যবহার করতে চাইছিল। আর তা করেও ছিল।
আর একজন বাবা যিনি টেলিফোন ইঞ্জিনিয়ার, আমারই একজন ছাত্র তার তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে দারুণ সমস্যায় পড়েন। মেয়েটি তার প্রাতরাশ খেতে চাইত না একেবারেই। নানা রকম বকাবকি, অনুরোধ কোন কিছুতেই কাজ হল না। অতএব তার বাবা মা স্বভাবতই প্রশ্ন করলেন : ‘কি করে আমাদের ছোট্ট মেয়েকে প্রাতরাশ খাওয়াব?’
বাচ্চা মেয়েটি ওর মাকে নকল করতে ভালোবাসত। সে সব সময়েই নিজেকে মা-র মত মস্ত বড় হয়ে গেছে বলে ভাবতে চাইতো। অতএব ওর বাবা মা একদিন তাকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে প্রাতরাশ বানাতে দিলেন। আর ঠিক মনস্তাত্ত্বিক সময়টাতে মেয়েটির বাবা রান্নাঘরে ঢুকে পড়লেন, সে তখন খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে বলে উঠল : ‘ওঃ দেখ বাবা, আমি আজ সকালের জন্য মল্টেক্স বানাচ্ছি।’
এরপর সেদিন সকালে তাকে খাওয়ানোর জন্য একটুও কষ্ট পেতে হল না। সে সবই খেয়ে নিল কারণ আজ তার আগ্রহ জেগেছিল। সে নিজের সম্বন্ধে বেশ গর্ববোধ করতে আরম্ভ করেছিল। নিজেকে জাহির করার একটা উপায় মেয়েটি পেয়ে যায় খাবার বানানোর মধ্যে দিয়ে।
উইলিয়াম উইন্টার একবার বলেছিলেন : নিজেকে প্রকাশ করা মানুষের চরিত্রের একটা প্রধানতম দিক। আমরা ব্যবসার ব্যাপারে এই মনস্ততু কেন কাজে লাগাতে পারি না? যখন কোন একটা চমৎকার ধারণা কিংবা ভাল কাজ কররবার ইচ্ছা আমাদের মাথায় খেলে যায়, তখন তা অন্য লোককে দিয়ে চিন্তা করিয়ে নিলেই হয় যে, এই কাজ করবার ইচ্ছা তাদের মাথা থেকে বেরিয়েছে। সে তখন সেটা তার নিজের বলেই ভাবতে চাইবে, আর এতেই সে কাজ করতে বিশেষভাবে আগ্রহান্বিত হবে।
মনে রাখবেন : প্রথমেই অন্য লোকটির মধ্যে বেশ কিছুটা আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে হবে। যে এটা পারে সারা দুনিয়াকেই সে সঙ্গে পেতে পারে। যে পারে না তাকে একা একাই পথ চলতে হবে।’
.
এই বই থেকে সবচেয়ে বেশি উপকার পেতে হলে এই ন’টি পরামর্শ মেনে চলবেন।
(১) আপনি যদি এই বইটি থেকে সবচেয়ে বেশি কিছু চান তাহলে একটি অপরিহার্য কাজ করতেই হবে। সেটা অন্য যে কোন রকম আইন, নীতি বা নিয়মের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটা এমনই অপরিহার্য যে আপনার হাজার হাজার নিয়ম জানা থাকলেও কোন কাজ হবে না। অন্যদিকে আপনার এই রাজকীয় জিনিসটি যদি থাকে তাহলে এই বইয়ের পরামর্শ না দিয়েই আশ্চর্যজনক ফল পেতে পারবেন।
সেই যাদুকরী ব্যাপারটা কি রকম? সেটা হলো এই : গভীর আর আন্তরিকভাবে শেখার আগ্রহ এবং মানুষের সঙ্গে ব্যবহারের কাজে নিজের দক্ষতা বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রবল আকাঙ্ক্ষা।
এরকম আকাক্ষা বাড়ানোর কাজটা কিভাবে গড়ে তোলা যাবে? এটা করা সম্ভব অনবরত নিজেকে বোঝান এই নীতিগুরো আপনার কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। নিজের মনেই এঁকে দেখতে থাকুন একাজে দক্ষতা অর্জন করলে কিভাবে আপনি সামাজিক আর অর্থকরী লাভের কাজে সাফল্য পেতে পারবেন। বার বার আপনার নিজেকেই বলুন : ।আমার জনপ্রিয়তা, আমার সুখ আর আমার আয় নির্ভর করে মানুষের সঙ্গে আমার ব্যবহার করার দক্ষতারই উপর।
(২) প্রতিটি পরিচ্ছেদে দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে মনে মনে একটা ধারণা করে ফেলুন। এরপরেই আপনার লোভ জাগবে পরেরটাতে দ্রুত এগুনোর জন্য। কিন্তু তা করবেন না। শুধু মানসিক আনন্দের জন্যই যদি পাট করেন তাহলে আলাদা কথা। কিন্তু জনসংযোগে দক্ষতা বাড়ানোর জন্যই যদি পাঠ করতে চান তাহলে প্রতিটি পরিচ্ছেদ বেশ ভাল করে বারবার পড় ন। শেষ পর্যন্ত দেখতে পাবেন তাতে সময় বাঁচান এবং ফললাভ উভয়ক্ষেত্রেই দারুণ কাজ হয়েছে।
(৩) পড়তে পড়তে মাঝেমাঝে এটু থেমে যা পড়লেন সেটা সম্পর্কে ভাবতে থাকুন। নিজেকে প্রশ্ন করুন প্রতিটি উপদেশ কোথায় কখন কিভাবে কাজে লাগাতে পারেন। এরকম ভাবে পড়লেই সবচেয়ে বেশি কাজ পাবেন তাতে সন্দেহ নেই।
(৪) পড়ার সময় লাল রঙের কোন পেন্সিল বা পেন রাখবেন, যাতে পড়তে পড়তে কোন উপদেশ যদি দেখতে পান সেটা কাজে লাগাতে লাল কালির দাগ দিয়ে চিহ্নিত করুন। যদি সেই পরামর্শ বা উপদেশ খুবই ভালো মনে হয় তাহলে তার তলার লাইন টেনে পাশে চারটে তারা চিহ্ন X X X X দিন। লেখার তলায় লাইন আর এই রকম তারা চিহ্ন এইটিকে আরও আগ্রহের করে তোলে। তাছাড়া আবার পড়ার কাজেও সুবিধা হয়।
(৫) আমি একজন ভদ্রলোককে চিনি যিনি পনের বছর ধরে বিরাট এক বীমা প্রতিষ্ঠানের অফিসের ম্যানেজার ছিলেন। তিনি প্রতি মাসে তার প্রতিষ্ঠান সে সমস্ত বীমার চুক্তি করে তার সব পড়ে ফেলতেন। হ্যাঁ, তিনি একই চুক্তিপত্র মাসের পর মাস, বছরের পর বছর পড়ে যেতেন। কিন্তু কেন? কারণ তিনি তার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জেনেছিলেন চুক্তির শর্তাবলী এইভাবেই তিনি মনে রাখতে পারবেন।
আমি একসময় প্রায় দুবছর ব্যয় করি জনগণের সামনে বক্তৃতা দেবার উপর একখানা বই লিখতে তা সত্ত্বেও কিন্তু ওই বইটাতে কি লিখেছি মনে করার জন্য আমাকে প্রায়ই সে বইয়ের পাতা উল্টে দেখতে হত। কি রকম দ্রুততায় যে আমরা সব ভুলে যাই ভাবলে অবাক হতে হয়।
অতএব এ বইটি থেকে যদি সত্যিকার চিরকালীন কোন উপকারে পেতে চান, তাহলে মনেও ভাববেন না যে একবারের মত শুধু পড়ে ফেললেই যথেষ্ট হবে। বেশ ভাল করে পড়ে ফেলার পর প্রতি মাসে বেশ ভাল করে আপনাকে কয়েক ঘন্টা আবার এই বইয়ের সব কিছু আলোচনা করতে হবে। বইটা আপনার ডেস্কে চোখের সামনে রেখে দিন। প্রতিদিন সময় পেলেই একটু চোখ বুলিয়ে নেবেন। প্রতিদিন নিজেকে বোঝাতে চান আপনার নিজের উন্নতি করার আশাতিরিক্ত সম্ভাবনা রয়েছে। মনে রাখবেন, এই পরামর্শ আর নিয়মগুলো বারবার পড়া আর আলোচনার মধ্য দিয়েই সেগুলো সহজ হয়ে আসবে। এছাড়া আর কোন উপায় নেই।
(৬) বার্নার্ড শ একবার বলেছিলেন : কোন মানুষকে কিছু শেখাতে চাইলে সে কিছুতেই শিখবে। শ ঠিকই বলেছিলেন। যেহেতু শেখা ব্যাপারটা ব্যবহারিক। আমরা কাজ করতে করতেই শিখি। অতএব, এই বই থেকে যে নিয়মগুলো আপনি শিখতে চান সেগুলো সম্বন্ধে কিছু করার চেষ্টা করুন। সুযোগ পেলেই নিয়মগুলো কাজে লাগান। তা না করলে খুব তাড়াতাড়ি সেগুলো ভুলে যাবেন। যে জ্ঞান কাজে লাগানো যায় তাই কেবল মনে থাকে।
এই উপদেশগুলো আপনি হয়তো সবসময় কাজে লাগাতে গিয়ে অসুবিধা বোধ করতে পারেন। আমি এটা জানি, কারণ বইটা আমরই লেখা আমি নিজে প্রায়ই যা বলেছি তার সব প্রয়োগ করতে অসুবিধা বোধ করি। উদাহরণ হিসেবে বলছি, আপনি যখন অসন্তুষ্ট হন তখন অপরের সমালোচনা করেন, কিন্তু তার মন বুঝতে কখনও চেষ্টা করেন না। অপরের দোষ খুঁজে বার করা প্রশংসা করার চেয়ে ঢের সহজ। আপনি যা চান সেটার সম্বন্ধে বলা খুব সহজ, কিন্তু অপরে কি চায় সেটা বুঝে ওঠা অনেকটা কঠিন। এরকম আরও আছে। অতএব এই বই পড়ে চলার ফাঁকে, মনে রাখবেন যে আপনি কেবল খবরাখবর সংগ্রহ করছেন, আপনি চাইছেন নতুন অভ্যাস গড়ে তুলতে। হ্যাঁ, আপনি নতুন জীবনবেদ গড়ে তুলতে চলেছেন। এজন্য চাই সময়, ধৈর্য আর প্রাত্যহিক প্রয়োগ।
অতএব এই পাতাগুলো অনবরত দেখুন। এটাকে জনসংযোগের ক্ষেত্রে একটা ব্যবহারিক বই হিসেবেই ভাবতে আরম্ভ করুন–আর যখনই আপনি কোন বিশিষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হবেন–যেমন কোন শিশুর সঙ্গে ব্যবহার, আপনার স্ত্রীকে স্বমতে আনা বা কোন অসন্তুষ্ট মক্কেলকে সন্তুষ্ট করা–তখনই স্বাভাবিকভাবে চট করে যে ভাবনা আসে সেটা করবেন না। তাতে সাধারণত ভুলই করা হবে। এর বদলে এ বইয়ের পাতাগুলো উল্টে যেখানে লাইনের তলায় দাগ দিয়ে রেখেছেন সেগুলো একটু দেখে নিন। তারপর ওই নতুন পদ্ধতি কাজে লাগান, দেখবেন তাতে যাদুর মত কাজ হচ্ছে।
(৭) আপনার স্ত্রী, ছেলে বা কাজের সহকর্মীকে প্রত্যেক দিন আপনি এবইয়ের নিয়ম ভঙ্গ করছেন দেখিয়ে দিলে, তাদের আপনি এক ডলার করে দেবার ব্যবস্থা করুন। এই নিয়মগুলো আয়ত্ত করার ব্যাপারটা একটা খেলার পর্যায়ে এনে ফেলুন।
(৮) ওয়াল স্ট্রীটের কোন এক বিখ্যাত ব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট আমার ক্লাসে একবার বর্ণনা করেছিলেন আত্ম উন্নতির জন্য তিনি কী রকম চমৎকার এক পথ অবলম্বন করতেন। ভদ্রলোক ছেলেবেলায় তেমন লেখাপড়ার সুযোগ পাননি, তা সত্ত্বেও তিনি আমেরিকার একজন বিখ্যাত অর্থ বিনিয়োগকারী। তিনি স্বীকার করেন যে, তাঁর সাফল্যের জন্য দায়ী তার নিজেরই আবিষ্কার করা এই পদ্ধতি। তিনি যা করতেন তা হল এই রকম। যতটা আমার মনে আছে তার নিজের কথাতেই জানাচ্ছি :
বছরের পর বছর আমি রোজ আমার যে সব সাক্ষাৎকার ঘটত তার একটা বিবরণ লিখে রাখতাম। আমার পরিবারের লোকজন শনিবারের রাতে আমার জন্য কোনরকম পরিকল্পনা রাখত না, কারণ তারা জানত শনিবার আমি কাটাই আত্ম-সমীক্ষা আর সমালোচনার মধ্য দিয়ে নিজেকে জানার চেষ্টা করি। নৈশভোজের পর আমি সেই দেখা সাক্ষাতের বিবরণ লেখা বইটা খুলে সারাদিনের সাক্ষাৎ আলোচনা, সভা ইত্যাদি নিয়ে সমস্ত সপ্তাহের ব্যাপারটা পড়ে ফেলি। তারপর নিজেকে প্রশ্ন করি :
“ওই দিনে কি ভুল করেছি?”
“কোন্ কাজটা আমি ঠিক করেছি এবং আরও ভালোভাবে কাজটা কেমন করে করতে পারতাম?”
“ওই অভিজ্ঞতা থেকে কি শিক্ষা পেতে পারি?”
‘আমি প্রায়ই দেখতে পেয়েছি ওই সমালোচনায় আমি দুঃখই পেয়েছি। আমার নিজের ভুল দেখে আমি প্রায়ই অবাক হয়েছি। অবশ্য, বছর ঘুরে চললে দেখছি এরকম ভুলের সংখ্যা কমে এসেছে। মাঝে মাঝে এই রকম বিচার করার পর নিজেকেই আমার প্রশংসা করতে ইচ্ছে জেগেছে। এই রকম আত্মবিশ্লেষণ, আত্মসমালোচনা বছরের পর বছর করার ফলে অন্য সব কিছুর চেয়ে আমার ঢের বেশি উপকার হয়েছে।
‘এটা আমায় কোন সিদ্ধান্ত নিতে আমার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে–আর এটা জনসংযোগের কাজে আমাকে দারুণভাবে সাহায্য করেছে। এর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কিছু আমি ভাবতে অপারগ।’
আপনিও এই রকম পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে, এই বইয়ের নীতির ব্যবহারিক প্রয়োগ করুন না কেন? এটা করলে দুটো ফল লাভ হবে।
প্রথমত, আপনি নিজেকে বেশ অদ্ভুত আর অমুল্য কোন শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে জড়িত দেখতে পাবেন।
দ্বিতীয়ত, আপনি দেখতে পাবেন মানুষের সঙ্গে মেলামেশার কাজে আপনার দক্ষতা বর্ষাকালের চারাগাছের মতই হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে।
(৯) একটা ডায়েরি লেখার অভ্যাস করুন-যে ডায়েরিতে আপনি আপনার এই নিয়ম মেনে চলায় প্রাপ্ত সাফল্যের হিসাব রাখবেন। খুব স্পষ্ট ভাবেই লিখবেন। এতে দেবেন নাম, তারিখ, ফলাফল ইত্যাদি। এরকম তালিকা রাখার ফলে আরও কাজ করার প্রেরণা পাবেন। বেশ কয়েক বছর পরে ডায়েরীর পাতায় একবার যখন চোখ বুলিয়ে দেবেন তখন কি চমৎকার তৃপ্তিই না পাবেন।
এই থেকে সবচেয়ে বেশি ফল পেতে গেলে এই কথাগুলো মনে রাখবেন : (১) মানবিক সম্পর্কের নীতির সম্বন্ধে দক্ষতা অর্জনের জন্য এক গভীর আকাক্ষা গড়ে তুলুন।
(২) পরবর্তী পরিচ্ছেদ পাঠ করার আগে প্রতিটি পরিচ্ছেদ দুবার পড় ন।
(৩) পড়ে চলার ফাঁকে নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন প্রতিটি উপদেশ কিভাবে কাজে লাগাতে পারেন।
(৪) প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণার তলায় দাগ দিন।
(৫) প্রতি মাসে বইটি পর্যলোচনা করুন।
(৬) সুযোগ পেলেই নীতিগুলো কাজে লাগান। আপনার দৈনিক সমস্যা মেটানোর কাজে এই বইকে কাজে লাগান।
(৭) নিজের ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করুন।
(৮) প্রতি সপ্তাহে কতটা এগোলেন তার হিসাব নিন। কি কি ভুল করলেন আর কি উন্নতি করেছেন তার হিসাব রাখুন।
(৯) নিয়মগুলি কি রকম কাজে লাগালেন তার জন্য ডায়েরি রাখুন। মনে রাখবেন : প্রথমেই অন্য লোকটির মধ্যে বেশ কিছুটা আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে হবে। যে এটা পারে সারা দুনিয়াকেই সে সঙ্গে পেতে পারে। যে পারে না তাকে একা একাই পথ চলতে হবে।