০৩৫. দেবযানী-যযাতি-শর্মিষ্ঠা

৩৫.

নির্জন উদ্যানবাটিকার মধ্যে শীতল পুষ্করিণীর ধারে একাকী দাঁড়িয়ে ছিলেন দেবযানী। হৃদয়ের মধ্যে ক্ষণিকের অকারণ ঘোর লাগিয়ে দিয়ে মহারাজ যযাতি চলে গেছেন। রাজা চলে যেতে শর্মিষ্ঠার কথা মনে পড়ল দেবযানীর। মনে পড়ল তাঁর চরম অপমানের কথাগুলি। মনে পড়ল–শর্মিষ্ঠা তাঁকে কুয়োর মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে তাঁকে মারবার চেষ্টা করেছেন। রাগে অপমানে দেবযানীর মুহূর্তপূর্বের প্রসন্ন মুখখানি লাল হয়ে উঠল। এদিকে এতক্ষণ তিনি বাড়ি ফিরছেন না দেখে শুক্রাশ্রমের দাসী তাকে খুঁজতে বেরিয়েছে। দাসীর নাম ঘূর্ণিকা।

মহামতি শুক্রাচার্য অনেক আগেই বৃষপর্বার রাজসভায় চলে গেছেন। দেবযানীর সঙ্গে। শর্মিষ্ঠার বিবাদ, দেবযানীকে কুয়োয় ফেলে দেওয়া, এবং যযাতির আগমন–কোনও খবরই তার কাছে পৌঁছয়নি। আশ্রমের দাসী ঘূর্ণিকা জানত–দেবযানী স্নানে গেছেন। সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে স্নানকেলি, নানা র, নানা খেলা-অতএব দেবযানীর দেরি হতেই পারে–এই ডেবে ঘূর্ণিকা এতক্ষণ বাড়িতেই বসেছিল। কিন্তু স্নানের বেলা বয়ে গিয়ে খাবার বেলাও যখন বয়ে গেল, তখন ঘূর্ণিা দেবযানীর খবর নিতে বেরল। দাসী দেখল-শর্মিষ্ঠা সহ অন্যান্য সব সখী বাড়ি ফিরে এসেছে, শুধু দেবযানী ফেরেননি। কানাঘুষোয় সে খবর পেয়েছে যে, উদ্যানবাটিকার মধ্যে শর্মিষ্ঠার সঙ্গে দেবানীর কথা-কাটাকাটি হয়েছে। দাসী ঘূর্ণিকা দেবযানীর জেদ এবং খামখেয়ালিপনার সঙ্গে পরিচিত। সে আস্তে আস্তে সেই উদ্যানবাটিকার মধ্যে এসে পৌঁছল।

দেবযানী দাসীকে দেখামাত্রই শর্মিষ্ঠার সঙ্গে যা যা বাদ-বিসংবাদ হয়েছিল সব জানালেন। তারপর তাকে আদেশ দিলেন–তুমি এই মুহূর্তে পিতার কাছে গিয়ে সমস্ত ঘটনা বলো। আমার যা অপমান হয়েছে তাতে আমি অন্তত বৃষপর্বার রাজবাড়িতে ঢুকব না-নেদানীং সংপ্রবেক্ষ্যামি মগয়ং বৃষপণ। ঘূর্ণিকা তখনই ছুটল দানবরাজ বৃষপর্বায় সভাস্থলে, যেখানে শুক্রাচার্য বসে আছেন। দাসী ব্যস্ততা দেখিয়ে শুক্রাচার্যকে জানালে–আচার্য। বৃষপর্বার মেয়ে শর্মিষ্ঠা দেবযানীকে আঘাত করেছে। দেবযানী বলেছেন–আর তিনি এ বাড়িতে ঢুকবেন না। ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় শুক্রাচার্য সঙ্গে সঙ্গে বৃষপর্বার সভাস্থল ত্যাগ করে নগরোপান্তের সেই উদ্যানবাটিকায় উপস্থিত হলেন। আদরিণী কন্যাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেয়ে খুব দার্শনিকভাবে বললেন–সকলের জীবনেই কখনও দুঃখ, কখনও বা সুখ আসে। তবে জান তো, নিজের কথা অন্যায় অথবা নিজের করা ভাল কাজ থেকে মানুষ দুঃখ পায় অথবা সুখ পায়। আমার ধারণা–তুমি নিজেই এমন কিছু অন্যায় করেছ, যার প্রায়শ্চিত্ত হয়ে গেছে শর্মিষ্ঠার আঘাতে– মনে দুশ্চরিতং তেত্তি যস্যয়ং নিষ্কৃতি কৃতা।

আগেকার দিনে এটা ছিল। পাড়ায় চুড়ান্ত দস্যিপনা এবং বন্ধুদের সঙ্গে মারামারি করার পর বাড়িতে যদি কোনওভাবে সে খবর পৌছত বা নালিশ হত, তাহলে মা-বাবা আমাদেরই ধরে আগে খানিকটা পিটিয়ে নিতেন। তারপরে বিচার-আচার, কথাবার্তা। অনুরূপভাবে এও জানি–যে বন্ধুর অভিভাবক আমার বাড়িতে নালিশ করতে এসেছেন, তিনিও তার পুত্রকে তুমি কি ধোয়া তুলসী পাতা–ইত্যাদি গালাগালি সহযোগে উত্তম না হলেও মধ্যম গোছের কিছু ব্যবহার করে এসেছেন। তারপর যখন বিচার করে দেখেছেন, দোষটা বিপক্ষেরই বেশি, তখনই তিনি সলজে নালিশ জানাতে এসেছেন আমাদের বাড়িতে। আমাদের বাবা-মাদের একটি সহজাত গুণ ছিল যে, তারা নালিশ শ্রবণমাতেই হার আরম্ভ করতেন; তখন পরপক্ষের অভিভাবকেরই যথেষ্ট মায়া হত। তিনি মাঝখান ঘেঁকে এসে প্রহার থামানোর চেষ্টা করতেন এবং বলতেন-দেখুন, ছেলেপিলেদের বাজার, আমারটিও কিছু কম অসভ্য নয়, কাজেই এবার হেড়ে দিন, যা হবার হয়ে গেছে অদ্ভুত উপায়ে যে আমাদের পিতৃ বিশেষত মাতৃকুল এক মুহূর্তের মধ্যে আপন উদগিৰ্য্যমান ক্রোধরাশি সম্বরণ করে নিয়ে পর মুহূর্তেই শত্রুপক্ষের নালিশকারী অভিভাবকের জন্য সহাস্যে বসন সম্বরণ করে চা করতে যেতেন, তা রীতিমতো শিক্ষণীয়। এই নিরিখে আধুনিক পিতামাতাকে জীবনের বহু রোমাঞ্চকর নাটক থেকে বঞ্চিত বলে মনে করি। স্বকপোলকল্পিতভাবে অতি নির্দোষ পুত্র-কন্যার পিতা-মাতা হওয়া প্রায় নির্বাণ-মুক্তির শামিল। পুত্র-কন্যারা তাই এখন অল্প বয়সেই বৃদ্ধ পিতামহের মতো বিজ্ঞ স্বভাব। 

 কথাগুলি উল্লেখ করলাম এইজন্য যে, মহামতি শুক্রাচার্য অতিশয় জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি মনে মনে বেশ জানেন যে, বিনা প্ররোচনায় শর্মিষ্ঠা তার মেয়েকে আঘাত করেনি। দেবযানীর কিছু দোষ নিশ্চয়ই আছে। অন্যদিকে আধুনিক পিতা-মাতার মতো তিনি একটি মাত্র কন্যার পিতা হওযায়, অপিচ কন্যাটি শৈশবের মাতৃহারা হওয়ায়, কন্যার ব্যাপারে তাঁর কিছু প্রশ্রয়ও আছে। কাজেই প্রাচীন এবং অত্যাধুনিক বৃত্তির দ্বৈরথে দাঁড়িয়ে শুক্রাচার্যের মতো পিতা কী করেন, সেটাই এখন দেখার।

লক্ষণীয় বিষয় হল, শর্মিষ্ঠা দেবযানীকে যত অপমান করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি অপমান করেছেন শুক্রাচার্যকে। বালক-বালিকার ঝগড়াঝাটির মধ্যে পিতা-মাতার ওপর এই আক্রমণই ঘটনা জটিল করে তুলল। দেবযানী নিজের সুবিধের জন্য সেই মোক্ষম জায়গায় আঘাত করলেন। বললেন–পিতা! আপনি বলেছেন, আমার নিজের দোষের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে গেছে শর্মিষ্ঠার আঘাতে। কিন্তু কিসের এই প্রায়শ্চিত্ত? দেবযানী যে শর্মিষ্ঠাকে গালাগালি দিয়েছিলেন, সে কথা পিতাকে বললেন। শর্মিষ্ঠা যে ভুল করে তার কাপড়খানি পরে ফেলেছিলেন এবং সেই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটিও যে দেবযানী সহজভাবে নেননি–এসব কথা তিনি কিচ্ছুটি বললেন না। তিনি শর্মিষ্ঠার পরের কথাগুলি সুন্দর করে সাজিয়ে দিলেন পিতার ক্রোধাগ্নি উদ্দীপিত করার জন্য।

দেবযানী বললেন–আমার প্রায়শ্চিত্তই বল আর যাই বল,–নিষ্কৃতিৰ্মেন্তু বা মাস্তু-শর্মিষ্ঠা আমাকে কী বলেছে, একটু মন দিয়ে শোনো। শর্মিষ্ঠা চোখ লাল করে আমাকে বলেছে–তোর বাপ দৈত্যদের চাটুকারী স্তাবক। এ কথা কি সত্যি বাবা? তুমি কি সত্যিই এক স্তাবক-সত্যং কিলৈতৎ সা প্ৰাহ দৈত্যানামসি গায়নঃ? শর্মিষ্ঠা আমাকে বলেছে-তুই হলি সেই বাপের মেয়ে যে আমার বাবার স্তাবক এবং আমার বাবার কাছ থেকে যে দান প্রতিগ্রহ করে। আরও বলেছে–আমি হলাম সেই বাপের মেয়ে, যে স্তুত হয়, যে দান দেয়।

দেবযানী পিতার ক্রোধ উদ্দীপ্ত করে ব্যঙ্গোক্তিতে বললেন–বাবা! আমি যদি সত্যি সত্যি একজন স্তাবক এবং পরের দান প্রতিগ্রহী পিতার পুত্রী হই, তাহলে বলুন, আমি শর্মিষ্ঠার হাতেপায়ে ধরে তাকে যথাসাধ্য খুশি করার চেষ্টা করব;–আমি শর্মিষ্ঠার সখীকে আমার এই প্রতিজ্ঞার কথা বলেই দিয়েছি–প্ৰসাদয়িয্যে শর্মিষ্ঠামিত্যুক্তা তু সখী ময়া। দেবযানী এবার শেষ অপমানের কথাটা ধরিয়ে দিলেন শুক্রাচার্যকে। বললেন–শুধু কথা বলেই আমাকে শাস্তি দেওয়া শেষ হয়নি বাবা! এই বিজন বনের ভেতর আমাকে সে কুয়োয় ফেলে দিয়েছে এবং ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে গেছে–কূপে প্রক্ষেপয়ামাস প্রক্ষিপ্য গৃহমাগমৎ।

 শুক্রাচার্য প্রাথমিকভাবে দেবযানীকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। তিনি মহাপণ্ডিত এবং জ্ঞানী ব্যক্তি। দানবরাজ বৃষপর্বা যে তাকে কত সম্মান করেন, তা তার ভালই জানা আছে। এই অনাবিল সুসম্পর্কের মধ্যে দুটি অল্পবয়সী সুন্দরীর ঝগড়া তাকে ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলেছে। শুক্রাচার্য বললেন–একেবারে, ভুল বুঝেছ দেবযানী! তুমি কখনও একজন স্তবক, যাচক অথবা দানজীবী ব্রাহ্মণের মেয়ে নও। তুমি সেই বাপের মেয়ে, যে কোনওদিন কারও চাটুকারিতা করে না, কারও তোয়াক্কা করে না উলটে সবাই যার স্তব করে,-অস্তোতুঃ স্বয়মানস্য দুহিতা দেবযান্যসি।

তার কথা যে কতটা ঠিক, সেটা প্রমাণ করার জন্য শুক্রাচার্য তিনটি বিশাল ব্যক্তিত্বের নাম উল্লেখ করলেন। তিনি বললেন-অসুররাজ বৃষপর্বা জানেন, দেবরাজ ইন্দ্র জানেন, আর জানেন মলোকের অধীশ্বর মহারাজ যযাতি। তারা জানেন–একমাত্র পরব্রহ্মাই আমার বল, আমার সর্বশক্তি। আর কারও তোয়াক্কা আমি করি না।

মহারাজ যযাতির সঙ্গে দেবযানীর দেখা হয়েছে। তিনিই যে দেবযানীকে উদ্ধার করেছেন–সে কথা এই মুহূর্তে ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করলেন না দেবযানী। শুধু এইটুকু বুঝে নিলেন যে, মনুষ্যলোকের এই কীর্তিমান পুরুষটি তার পিতার যথেষ্ট আদরণীয়। শুক্রাচার্য তখনও দেবযানীকে বোঝাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি যে কত কিছু পারেন, দৈত্য-দানবরা যে তাকে কতটা সমীহ করে চলে, সে সব কথা বলে তিনি শর্মিষ্ঠার কথাটাকে লঘু করে দিতে চাইছেন। শুক্রাচার্য বললেন–ভদ্রলোকেরা নিজের গুণের কথা নিজের মুখে বলে নাকি কখনও! আমার কত ক্ষমতা, সে তো তুমি জান, মা! এ জগতে আমিই একমাত্র লোক, যে সঞ্জীবনী বিদ্যা জানে। আর সেই বিদ্যা দিয়ে কত মৃত মানুষকে আমি জীবন দিয়েছি, তাও তো তুমি জান–ত্বং মে জানাসি য বল।

শুক্রাচার্যের ভাবটা এই–এত যার ক্ষমতা, সে কারও চাটুকারিতা করতে পারে না, বরং অন্যেরাই, তার চাটুকারিতা করে। শুক্রাচার্য দেবযানীকে বুঝিয়ে বললেন-স্বর্গে-মর্ত্যে যা কিছু আছে, সব কিছুই আমার অধীনে। স্বয়ং ব্রহ্মা আমায় সে কথা বলে দিয়েছেন। কাজেই যে যাই বলুক, দেবযানী! তোমার পিতা কোনও যাচক, স্তাবক মানুষ নন। তুমি ওঠো, বাড়ি চলো। বরং এই ভাল, শর্মিষ্ঠাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। কারণ বড় মানুষের গুণই হল ক্ষমা–তস্মাদুত্তিষ্ঠ গচ্ছামঃ স্বগৃহং কুলনন্দিনি।

আমরা দেবযানীর প্রকৃতি একটু-একটু জানি। তার ইচ্ছে এবং অনিচ্ছে দুটোই খুব তীক্ষ্ণ এবং প্রবল। খানিকটা খামখেয়ালিপনাও বলা চলে। শুক্রাচার্য তার মেয়েটিকে খুব ভাল করেই চেনেন। ছোটবেলা থেকে এই মাতৃহারা মেয়েটির ওপর তার অজস্র প্রশ্রয় সত্ত্বেও তিনি জানেন–দেবযানীর কিছু দোষ নিশ্চয়ই আছে। তাছাড়াও এই অকিঞ্চিৎকর ঘটনা তার কাছে নতুন এক বিপন্নতা বয়ে এনেছে। দুই পিতার মধ্যে সম্পর্ক খুবই ভাল, অথচ তাদের মেয়েরা ঝগড়া করছে, দুই স্বামীর মধ্যে সুসম্পর্ক আছে, অথচ তাদের স্ত্রীরা ঝগড়া করছে। এই অবস্থায় দুই পিতা বা দুই স্বামীর মনে যে বিচলিত অবস্থার সৃষ্টি হয়, শুক্রাচার্যেরও তাই হল। এর ওপরেও মনে রাখতে হবে–শুক্রাচার্য মহাজ্ঞানী ঋষি। যেমন তার শাস্ত্রজ্ঞান, তেমনই মার্জিত তার বোধশক্তি। তিনি দেবযানীকে এবার শাস্ত্রের যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করলেন।

শুক্রাচার্য বললেন–রাগ জিনিসটা মোটেই ভাল নয় দেবযানী। ঘোড়ার লাগাম যে ধরে থাকে, সেই লোকটাই শুধু সারথি নয়, কেন না ওই রাগ জিনিসটাই হল ঘোড়ার মতো। শুধুই দৌড়ে চলে, শুধুই টগবগ করে লাফায়। যে মানুষ টগবগে ফুটন্ত ক্রোধ প্রশমন করতে পারে তাকেই আসলে সারথি বলতে হবে-যঃ পতিতং ক্রোধং নিগৃহ্নাতি হয়ং যথা। স যন্তা…। শুক্রাচার্য ক্রোধের দোষ এবং ক্রোধ-প্রশমনের গুণ দেখিয়ে অনেকক্ষণ বক্তৃতা দিলেন। তারপর দেবযানী এবং শর্মিষ্ঠার বিবাদ-বিসম্বাদের অন্তঃসারশূন্যতা সপ্রমাণ করে একটি সারকথা বললেন–অবুঝ নির্বোধ ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ করেই থাকে–যৎ কুমারাঃ কুমাৰ্যশ্চ বৈরং কুর্য্যরচেতসঃ। তাই বলে, বড়রাও যদি সেই বিবাদে শামিল হয়, তাহলে কী করে চলে?

শুক্রাচার্যের শেষ কথাটা দেবযানীর পছন্দ হল না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার প্রতিক্রিয়া জানালেন। বললেন–আমার বয়স অল্প হলেও ধর্ম আর অধর্মের ফারাকটা আমি বেশ বুঝি, বাবা-বেদাহং তাত বালাপি ধর্মাণাং যদিহান্তর। ক্ষমা করা যে খুব ভাল, আর রাগ করাটা যে খুব খারাপ–সেটাও আমার ভালরকম জানা আছে। কিন্তু বাবা! শিষ্য যদি শিষ্যের মতো আচরণ না করে, আর চাকর যদি চাকরের কাজটি না করে তাহলে তো সবই বৃথা-প্ৰেষ্যঃ শিষ্যঃ সুবৃত্তিং হি বিসৃজ্য বিফলং গতঃ। শিষ্য যদি কখনও গুরু-গুরু ভাব দেখায়, আবার কখনও বা শিষ্য-শিষ্য ভাব দেখায় তবে, তাহলে সেই রম মিশ্রবৃত্তি শিষ্যের বাড়িতে আমার থাকতে ইচ্ছে হয় না, বাবা! তাছাড়া আরও একটা কথা। এঁরা কী রকম মানুষ, বাবা! আমাদের যা বৃত্তি আমরা সেই কাজ করি, অথবা আমাদের যা বংশ, আমরা সেই বংশের পরম্পরাগত ক্রিয়াকর্মের অনুষ্ঠান করি। এখন যদি কেউ আমাদের বংশ তুলে ভিখারি’ বলে গালাগালি দেয়, ব্রাহ্মণের বৃত্তির নিন্দা করে, দানজীবী বলে পরিহাস করে–পুমাংসো যে হি নিন্দন্তি বৃত্তেনাভিজনেন চ–তাহলে সেখানে অন্তত কোনও বুদ্ধিমান লোকের থাকা চলে না।

শুক্রাচার্যের মননশীল উপদেশে দেবযানীর খুব লাভ হয়নি। হয়নি তার কারণও আছে এবং সে কারণ বুঝতে গেলে দানবরাজ বৃষপর্বা এবং শুক্রাচার্যের সম্বন্ধ তথা তাঁদের সামাজিক, সাংসারিক অবস্থাটাও বুঝতে হবে। শুক্রাচার্য তার নিজের আশ্রমেই থাকেন, দানবরাজ বৃষপর্বা তাঁকে চুড়ান্ত সম্মান দেন এবং আদরও করেন। তিনি জ্ঞানী, তিনি ঋষি, সর্বোপরি তিনি সঞ্জীবনী বিদ্যা জানেন, যা আর কেউ জানেন না। অসুর-দানবদের ভাগ্যেই যে তিনি তাঁদের পক্ষে আছেন–এ কথা দানববাজ বৃষপর্বার অজানা নয়। এবং এইজনা বৃষপর্বা তাঁকে যথেষ্ট মাথায় তুলেও রাখেন। কিন্তু হাজার হলেও বৃষপর্বা রাজা। তিনি সুপ রাজসিংহাসনে বসে থাকেন, অন্য সভাসদরা সেখানে বসেন রাজার থেকে নীচাসনে। এমনকি অসুরগুরু শুক্রাচার্যের আসনও স্বভাবতই রাজাসনের নীচে। রাজগুরু হিসেবে রাজাকে যদি আদেশ, উপদেশ, এমনকি শাসনও করতে হয়, তবে তা নীচাসনে বসেই করতে হয় শুক্রাচার্যকে। কারণ রাজা রাষ্ট্রের প্রতীক, রাজদণ্ডের প্রণেতা তিনিই।

রাজনন্দিনী শর্মিষ্ঠার কাছে রাজার এই উচ্চ সিংহাসন, তার ব্যক্তিত্ব, তাঁর কর্তৃত্ব এবং সর্বোপরি তার সর্বাধিনায়কত্বই বড় হয়ে উঠেছে। দানবরাজ বৃৰপৰা যে অসু-দানবদের কারণেই শুক্রাচার্যের গুরুত্ব মেনে নিয়েছেন এবং সেই জন্যই যে তিনি শুক্রাচার্যকে দানে-মানে তুই রাখেন-এ কথা শর্মিষ্ঠা বোঝেন না। রাজকৃত ভরণ-পোষণ যে শুক্রাচার্য দয়া করে দীকার করেছেন, এই বোধ তার বালিকা-হৃদয়ে কাজ করে না। বালিকা তার পিতার মাজগৌরবে এই কথাই শুধু উপলব্ধি করে যে, তার পিতা শুক্রাচার্যের ভরণ-পোষণ করেন এবং শুক্রাচার্যকে বসতে হয় রাজার আসনতলে। বালিকা যা দেখে, তার মধ্যে যে বাস্তবের সত্যটুকু নেই, রাজকীয় মর্যাদা এবং মুগ্ধতা শর্মিষ্ঠাকে সে কথা ভাল করে বুঝতে দেয় না।

আর এইটাই ঠিক পছন্দ হয় না দেবযানীর। তিনি আবার তার পিতা শুক্রাচার্যের গুরুত্ব সম্বন্ধে এতটাই সচেতন, যে সমবয়সী শর্মিষ্ঠাকে তিনি মোটেই বন্ধু বলে মনে করেন না। শর্মিষ্ঠার পিতা আমার পিতার শিষ্য, অতএব সম্বন্ধগত নিয়মে শর্মিষ্ঠা আমার শিষ্যায়–এই দৃঢ় ধারণায় দেবযানীর মন ব্যাপ্ত। এই রোপিত অহংকৃতির মধ্যে শর্মিষ্ঠা যখন তাকে। ভিখারির মেয়ে বলেন, অথবা প্রতিহজীবী বলে চিহ্নিত করেন শুক্রাচার্যকে, তখন দেবযানীর মনে আর ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়, অথবা গুরু-শিষ্যের সম্বন্ধ-জ্ঞান অবশিষ্ট থাকে না, তখন সমস্ত সম্বন্ধ পর্যবসিত হয় ধনী-দরিদ্রের চিরন্তন ভেদবৈশিষ্ট্যে। দেবযানী তখন পিতাকে বলেন-ধনীরাও এক ধরনের চণ্ডাল, পিতা। চণ্ডালরা এবং ধনীরা সবসময়েই পরের উৎপীড়ন করে। ভাল কাজ এরা কেউই করে না এবং টাকার ক্ষমতায় এরা বড় হতে চায়। ধনী আর চণ্ডাল একইরকম পাপী, এরা একই রকম দুর্বত্ত–দুর্বত্তা পাপকর্মাণশ্চণ্ডালা ধনিনোপিচ। দেবযানী আরও বললেন–শুধু চণ্ডালের ঘরে জন্ম নিয়ে জাতিতে যারা চণ্ডাল, তাদেরই শুধু চণ্ডাল বললে চলে না। নিজের কর্তব্য কর্মটি যে করছে না, অথচ টাকা-পয়সা, আভিজাত্য, আর বিদ্যার অহংকারে যারা ধরাকে সরা জ্ঞান করছে, তারাও এক ধরনের চণ্ডালধনাভিজনবিদ্যাসু সাশ্চণ্ডাল ধর্মিনঃ।

দেবযানী যা বললেন, তার মধ্যে তিনি নিজেও জড়িয়ে যান কিনা সে কথা পরে বিচার্য। কিন্তু এই মুহূর্তে এমন মোম একটি কথা তিনি বলেছেন, যার সামাজিক তাৎপর্য এখনও বিদ্যমান। ভারি আশ্চর্য লাগে। একটা ব্যাপার ভারি আশ্চর্য লাগে। যার টাকা নেই, সে যখন অপরের কাছে মাথা নোয়ায়, তার কারণ বুঝি। যার শিক্ষা-দীক্ষা, বিদ্যাবত্তা নেই, সে যখন অপরের কাছে মাথা নোয়ায়, তারও কারণ বুঝি। কিন্তু যার টাকা-পয়সা আছে অথবা যার বিদ্যা আছে, সে যে কেন অপরের কাছে মাথা নুইয়ে চাটুকারিতা করে, সেটা ভেবেই আশ্চর্য লাগে। আজকাল কলেজ-ইউনিভার্সিটির অধিকাংশ শিক্ষক রাজশক্তির কাছে মাথা নুইয়ে আরও কিছু পাবার আশায় প্রতিনিয়ত কতগুলি অযোগ্য রাজনৈতিক নেতার পদলেহন করেন। শিক্ষকসমাজের এই সামগ্রিক লোভ এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, সর্বার্থে তাদের দরিদ্র বলতে আমাদের কোনও অসুবিধে নেই।

মহামতি শুক্রাচার্য কারও চাটুকারিতা করেন না, কারও তোয়াক্কা করেন না–সে কথা দেবযানীও ভালভাবেই জানেন। কিন্তু রাজশক্তির প্রতিভূ হয়ে রাজনন্দিনী শর্মিষ্ঠা যদি অন্যায়ভাবে কোনও ভিত্তি ছাড়াও শিক্ষক শুক্রাচার্যকে রাজশক্তির উপাসক বলে চিহ্নিত করেন, তবে তার ঔরসজাতা বালিকা কন্যাও তাকে দরিদ্র মনে করেন। দেবযানী বললেন–দরিদ্র লোক যদি কিছু লাভের আশায় বিদ্বেষী ধনীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বাবা, তবে তার থেকে বেশি দুঃখের আর কিছু নেই এই পৃথিবীতে–যৎ সপত্নবিয়ং দীপ্তাং হীনশ্রীঃ পর্য্যপাসতে।

আসলে শর্মিষ্ঠা নয়, রাজনন্দিনী শর্মিষ্ঠার কটু কথাগুলি দেবযানীর হৃদয়ে কাটার মতো বিধছে। কাটা আঙুল জোড়া লাগে, কুঠারছিন্ন অঙ্গে নতুন অঙ্গ জন্ম নেয়, কিন্তু কটু কথায় জর্জরিত হৃদয় কখনও সুস্থ হয় না। দেবযানী পিতাকে বুঝিয়ে ছাড়লেন–অসুরগুরু শুক্রাচার্য আজ নিশ্চয় রাজশক্তির কাছে মাথা নুইয়েছে, নচেৎ শুক্রাচার্য আজ শর্মিষ্ঠার কটুক্তিগুলিকে বালিকাসুলভ চাপল্য বলে উড়িয়ে দেবেন কেন?

দেবযানীর কথায় শিক্ষক শুক্রাচার্য, গুরু শুক্রাচার্য উত্তেজিত হলেন। ভাবলেন–সত্যিই দানবরা এইরকম চিন্তা করে না তো? তাকে দানবরা রাজার তল্পিবাহক ভেবে বসেনি তো? সঙ্গে সঙ্গে শুক্রাচার্য দানবরাজ বৃষপর্বার সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে সিংহাসনে বসা দানবরাজকে উদ্দেশ করে বললেন–পাপের ফল খুব তাড়াতাড়ি হয় না, মহারাজ! একটু সময় লাগে। ধরুন, এই মুহূর্তে আপনি খুব গুরুপাক দ্রব্য খেলেন, খুব ভালও লাগল খেতে, কিন্তু গুরু ভোজনের ফলটা কি এখনই পাবেন? না, তার ফল পাবেন কাল, পাপ জিনিসটাও ওইরকম। এখনই করলে এখনই তার ফল দেখা যায় না। পাপের ফল ফলতে একটু সময় নেয়– ফলত্যের ধ্রুবং পাপং গুরুভুক্তমিবোদরে। সোজা কথায়–আপনি যদি অন্যায়টা করেন, তার ফল আপনি যদি বা এড়িয়েও যেতে পারেন তবু সে ফল ফলতে পারে গিয়ে আপনার ছেলে বা নাতির সময়ে-পুত্ৰেষু বা নষু বা ন চেদাত্মনি পশ্যতি।

কথাটা শুনতে প্রায় মরে পুত্র জনকের পাপে এর মতো হল। আমাদের শাস্ত্রে পিতার পাপ পুত্রকে ভোগ করতে হয় না–এমন নীতি অবশ্যই আছে। কিন্তু বংশ বংশ ধরে পাপ-পুণ্য ভোগের নীতি আরেকভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। ধরুন পুণ্যের ফলে আপনার অনেক ঐশ্বর্য, অনেক টাকা হল। সেই ঐশ্বর্য সব সময় উপার্জনকারী ব্যক্তির প্রভাগেই ক্ষয় হয় না। উত্তরাধিকারী পুরুষেরা, অন্তত দু-এক পুরুষ পূর্বসঞ্চিত অর্থ বা ঐশ্বর্যের ফলভোগী হন। একইভাবে পাপের ফলে রোগ-শোক, বধ-বন্ধনাদি দণ্ডও শুধু পাপকারী ব্যক্তির শাস্তিতেই শেষ হয় না, কখনও বা তার প্রক্রিয়া চলতে থাকে আরও দু-এক পুরুষ ধরে।

শুক্রাচার্য এখানে দানবরাজ বৃষপর্বার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে তার ওপরেই রাগ দেখাচ্ছেন বটে, কিন্তু অন্তরে তিনি জানেন–বৃষপর্বার কোনও দোষ নেই। দোষ করেছেন তার মেয়ে শর্মিষ্ঠা। এই রাগের সময়েও তিনি যে পাপের কথা বলছেন, সেই পাপাচারণের দায়ভাগিনীও শর্মিষ্ঠাই। ঠিক সেই জন্যই তার আক্রমণের ভাষাটা এইরকম-তুমি ফল না পেলেও তোমার ছেলে বা নাতি সেই ফল পাবে। বৃষপর্বাকে বিনা কারণে গালাগালি দেওয়ার সময় শুক্রাচার্যের সঙ্কোচ হচ্ছে। সেই জন্য শর্মিষ্ঠার অন্যায়ের কথা বলার আগে তিনি বৃষপর্বাকেও একটু জড়িয়ে নিলেন পূর্বতন এক অপরাধের বাঁধনে।

শুক্র বললেন–মহর্ষি অঙ্গিরার বংশজ কচ আমার বাড়িতে গুরুসেবায় নিরত ছিল। সে তোমাদের কোনও ক্ষতি করেনি। অথচ তোমরা তাকে সুখে থাকতে দাওনি, বার বার আঘাত করেছ তাকে। এখন আবার তোমার মেয়ে আমার সরল মেয়েটিকে যা নয় তাই বলেছে। তারপর যা করেছে, তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। অপ্রস্তুত অবস্থায় তার সঙ্গে প্রতারণা করে শর্মিষ্ঠা তাকে কুয়োর মধ্যে ফেলে দিয়েছে–বিপ্রকৃত্য চ সংরম্ভাৎ কৃপে ক্ষিপ্ত মনস্বিনী। যে সব ঘটনা ঘটে গেল, তাতে আমার মেয়ে যে আর এখানে থাকবে, তা আমার মনে হয় না। আর আমার মেয়েই যদি না থাকে, তবে তাকে ছাড়া আমার পক্ষেই বা এখানে কী করে থাকা সম্ভব–সা ন কম্বেত বাসায় তয়াহং রহিতঃ কথম্? অতএব তোমার রাজ্য ছেড়ে আমি চলেই যাব–ত্যজামি বিষয়ং নৃপ।

শুক্রাচার্যের কথার মধ্যেই একটা ফাঁক আছে এবং সে ফাঁকটা তিনি ইচ্ছে করেই রেখেছেন। শুক্রাচার্য একবারও নিজের রাগের কথা বলছেন না। বার বার বলছেন–দেবানী অসন্তুষ্ট, আমার এখানে কিছু করার নেই। দেবযানীকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু শুক্রাচার্য একটু সান্ত্বনাও দেন বৃষপর্বাকে–আমি চলে গেলে তুমি কষ্ট পেয়ো না, বৃষপর্বা। অথবা আমার ওপর রাগ করো না যেন–মা শোচ বৃষপর্বা ত্বং মা ধ্যস্ব বিশাশতে। শুক্রাচার্যের কথা থেকে তার মনের ভাবটা স্পষ্ট বোঝা যায়। অর্থাৎ তিনি বলতে চাইছেন–তোমরা দেবযানীকে যেভাবে হোক ভোলাও এবং তাহলে আমার কোনও সমস্যাই থাকে না।

দানবরাজ শুক্রাচার্যকে বললেন– আমি যদি সত্যি সত্যিই আঙ্গিরস কচকে হত্যা করিয়ে থাকি অথবা যদি শর্মিষ্ঠাকে দিয়ে দেবযানীকে কটু কথা বলিয়ে থাকি, তাহলে যেন আমার সবরকম অসদগতি হয়। শুক্রাচার্য বললেন, আমি কি মিথ্যা কথা বলছি, দৈত্যরাজ? তুমি নিজের দোষটা দেখছ না এবং এখনও আমাকে তুমি উপেক্ষাই করে চলেছ। কথাটার অর্থ, এখনও তুমি শর্মিষ্ঠাকে শাসন করছ না কিন্তু। বৃষপর্বা বললেন–আপনি মিথ্যা বলছেন না, এ কথা নিশ্চিত-নাধর্মং ন মৃষাবাদং ত্বয়ি জানামি ভার্গব। কিন্তু আপনি এ কী করছেন? আপনি সন্তুষ্ট হন অন্তত। আপনি যদি আমার রাজ্য ছেড়ে চলে যান, তবে আমাকে তো সমুদ্রে ডুবে মরতে হবে; এছাড়া আমার আর কী উপায় থাকবে বলুন–সমুদ্রং সংবেক্ষ্যামো নানদস্তি পরায়ণ।

শুক্রাচার্য বললেন–তুমি সমুদ্রেই প্রবেশ কর কিংবা যেদিকে ইচ্ছা যাও, দেবযানীর কষ্ট আমি কিছুতেই সহ্য করব না। শুক্রাচার্য এবার আসল কথাটা পাড়লেন। অর্থাৎ আমার কথা ছাড়, তোমরা দেবযানীকে যদি তুষ্ট করতে পার, তবে সব ঠিক আছে। মে আমার প্রাণের থেকেও প্রিয় তোমরা তাকে তুষ্ট করো–প্রসাদ্যতাং দেবযানী জীবিতং যত্র সে স্থিত। দেবযানীর কথা বলেই শুক্র আবারও বুঝিয়ে দিলেন যে তার নিজের কোনও রাগ নেই বৃষপর্বার ওপর। তিনি তার ঘরে থাকতেই চান। কথাটা ঘুরিয়ে বললেন শুক্রাচার্য। বললেন–দেবগুরু বৃহস্পতি যেমন সদা সর্বদা ইন্দ্রের ভাল চান, তেমনই আমিও তোমাদের ভাল চাই–যোগক্ষেমকরস্তেহমিন্দ্রস্যেব বৃহস্পতিঃ। কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটাই এখন গণ্ডগোল হয়ে গেছে। তোমরা যে করে হোক দেবযানীকে প্রসন্ন করো।

বৃষপর্বা কচি খোকাটি নন। তিনি অসুররাজ। শুক্রাচার্যের টিপ্পনি তিনি বেশ বুঝতে পারছেন। কিন্তু নিজের মেয়ের বয়সী এক বালিকার কাছে তাকে ক্ষমা চাইতে হবে–এই ভাবনা তাকে হয়তো লজ্জিত করেছে। কিন্তু অসুরগুরু শুক্রাচার্যের কাছে যদি তাকে হাত জোড় করতে হয়, তবে তাতে তার কোনও সঙ্কোচ দ্বিধা কিছুই নেই। তাই পুনরায় দেবযানীর প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে তিনি বললেন-অসুর-দানবদের বাড়ি-ঘর, সম্পত্তি যা আছে, গরু, ঘোড়া, হস্তি যা আছে, আপনি সব কিছুরই অধীশ্বর। সব কিছুই আপনার-তস্য ত্বং মম চেশরঃ। সব শুনে শুক্রাচার্য শেষ সিদ্ধান্ত দিলেন–আমি যদি সব কিছুরই প্রভু হই, তবে এই সামান্য কাজটা তোমরা করছ না কেন? তোমরা দেবযানীকে খুশি করো, সব ঝামেলা তাহলে মিটে যায়–তস্যেশ্বরোম্মি যদ্যে দেবযানী প্রসাদ্যতা। অর্থাৎ শুক্রাচার্য মেয়ের ব্যাপারে একেবারে আধুনিক পিতামাতার মতো অন্ধ। একমাত্র মেয়েকে তিনি কিছুতেই চটাবেন না। প্রথম দিকে তিনি প্রাচীন পিতাটির মতো দেবযানীর দোষ নির্ণয় করে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সমস্যার শেষ পর্বে ঘটনার নিয়ন্ত্রণ তিনি দেবযানীর হাতেই ছেড়ে দিলেন অবুঝ মেহান্ধ পিতামাতার মতো। তার বক্তব্য–দেবযানী যা চায়, আমিও তাই চাই। অথচ মনে মনে জানি–তা হয়তো তিনি সম্পূর্ণ চান না।

.

৩৬.

 দানবরাজ বৃষপর্বা শুক্রাচার্যের মতো মহগুরুকে কিছুতেই হারাতে চাইলেন না। শুক্রের কথা তিনি মেনে নিলেন। কথা দিলেন তিনি যে কোনও মূল্যে তার মেয়ে দেবযানীকে তুষ্ট করার চেষ্টা করবেন। শুক্রাচার্য তবু বৃষপর্বার সম্মান বাঁচাতে চেষ্টা করেছিলেন। সত্যিই তো, একজন প্রবলপরাক্রম রাজা শুধু শুক্রাচার্যের কথা ভেবে একটি অল্পবয়সী বালিকার কাছে করুণা ভিক্ষা চাইছেন- এ কথা ভাবতে শুক্রাচার্যের মায়া হচ্ছিল। শুক্র তাই বৃষপর্বার ভবন ছেড়ে আগেভাগেই দেবযানীর কাছে এসে বললেন-দেখ মা! তুমি তো জিজ্ঞাসা করেছিলে– আমি স্তাবক অথবা যাচক কিনা? দেখ, এই এক্ষুনি বৃষপর্বা তার প্রভু বলে আমাকে মেনে নিয়েছেন। বলেছেন– আমিই তার রাজ্য এবং ধনসম্পত্তির প্রভু। দেবযানী বললেন, বিশ্বাস করি না তোমার কথা। রাজা বৃষপর্বা স্বয়ং এসে নিজের মুখে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলুন এই কথা। নইলে বিশ্বাস করি না তোমার বক্তব্য। নাভিজানামি তত্তে’হং রাজা তু বদ স্বয়ম্।

আসলে দেবযানী শর্মিষ্ঠার কথা ভুলতে পারেননি। শর্মিষ্ঠা তাকে স্তাবকের কন্যা বলেছেন। আজকে তিনি দেখবেন- কে কাকে স্তুতি করে? দেবযানীকে তুষ্ট না করলে তার পিতা অসুররাজ বৃষপর্বার রাজ্য ছেড়ে চলে যাবেন–এই ভয় দেখানো যে শুধু মৌখিক আড়ম্বর নয়, এটা শর্মিষ্ঠাকে দেখতে হবে– কীভাবে দানবরাজ শর্মিষ্ঠার অভিমান মিথ্যা করে দিয়ে। দেবযানীর স্তুতি রচনা করেন। দেবযানী তাই পিতাকে বলেই দিলেন– তুমি বললে হবে না, পিতা! শর্মিষ্ঠার বাবা এসে বলুন যে, তুমিই তার সব কিছুর মালিক– রাজা তু বদ স্বয়ম্।

শুক্রাচার্য দানবরাজকে তার নিরুপায় অবস্থার কথা জানিয়ে দিলেন। বলে দিলেন– একবার তোমাকে যেতেই হবে দেবযানীর কাছে। বৃষপর্বা আর দেরি করলেন না। আত্মীয়-স্বজন সঙ্গে নিয়ে বৃষপর্বা উপস্থিত হলেন সেই উদ্যানবাটিকায়, যেখানে অনেক নাটক পূর্বাহ্নেই ঘটে গেছে। দানবরাজা সটান এসে নিজের মেয়ের সমবয়সী গুরুপুত্রীর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন পপাত ভুবি পাদয়োঃ। বললেন- তুমি রাগ কোরো না দেবযানী! তুমি যা চাও, তা যদি দেওয়া অসম্ভবও হয়, তবু তুমি বললে আমি সেটা দেওয়ার চেষ্টা করব। দেবযানী বিনা দ্বিধায় এক মুহূর্তের মধ্যে জবাব দিলেন- আজ থেকে শর্মিষ্ঠাকে আমি দাসী হিসেবে পেতে চাই। শর্মিষ্ঠার সঙ্গে থাকবে আরও এক হাজার দাসী, যারা শর্মিষ্ঠার সঙ্গেই আমার দাসীত্ব করবে– দাসীং কন্যাসহষেণ শর্মিষ্ঠামভিকাময়ে।

দেবযানী যে শর্মিষ্ঠাকে দাসী হিসেবে দেখতে চাইলেন– এ ঘটনার কারণ খুব স্পষ্ট। কিন্তু শর্মিষ্ঠার সঙ্গে যে আরও এক হাজার দাসী চাইলেন, তার দুটি কারণ আছে। এক নম্বর কারণ, দেবযানী ব্রাহ্মণ-ঘরের অনাড়ম্বর জীবন কাটিয়ে নিজেকে আর কোনওভাবেই হীন অবস্থায় রাখতে চান না। ব্রাহ্মণ-ঋষির দারিদ্রের মাহাত্মের থেকেও রাজকীয় আড়ম্বর তার কাছে বড় হয়ে উঠল। শর্মিষ্ঠা তাকে বলেছিলেন-ভিখারির আবার রাগ- রিক্তা ক্ষুভ্যসি ভিক্ষুকি। আজকে রাজবাড়ির হাজার দাসীর সঙ্গে শর্মিষ্ঠা যখন দেবযানীর দাসীগিরি করবেন, তখন দেবযানী থাকবেন রাজকন্যার প্রতিষ্ঠায়। দেবযানীর তাই শর্মিষ্ঠা ছাড়াও আরও দাসী দরকার। দ্বিতীয় কারণ, হাজার দাসীর সঙ্গে শর্মিষ্ঠা যখন তার দাসীত্ব বরণ করবেন, তখন শর্মিষ্ঠাকে বুঝতে হবে যে অন্য দাসীদের থেকে তিনি আলাদা কেউ নন। দাসী হলেও একাকিত্বের মধ্যে শর্মিষ্ঠা যদি বা কখনও তার পূর্বের রাজকীয়তা স্মরণ করতে পারতেন, হাজার দাসীর সঙ্গে শয়নে, ভোজনে, অপমানে শর্মিষ্ঠা একাকার হয়ে যাবেন; এই জন্যই দেবযানীর আরও হাজার দাসী চাই।

শুধু দাসীত্বের শাস্তি দিয়েই ক্রোধ প্রশমন হয়নি দেবযানীর। বৃষপর্বাকে তিনি বলেছেন শুধু এখনই নয়, আমার যখন বিয়ে হয়ে যাবে, তখন পিতা আমাকে যে পাত্রে দান করবেন, শর্মিষ্ঠা আমার পিছন পিছন আমার স্বামীর বাড়িতেও দাসী হয়ে যাবে– অনু মাং তত্র গচ্ছেৎ সা যত্ৰ দাস্যতি মে পিতা। দেবযানীর মুখ দিয়ে কথা বেরবার সঙ্গে সঙ্গেই দানবরাজ শর্মিষ্ঠার। ধাত্রীকে আদেশ দিলেন শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে আসবার জন্য। বলে দিলেন দেবযানী যা চায়, তাই করতে বলো শর্মিষ্ঠাকে।

দানবরাজ নিজের কন্যাকে চিনতেন। তিনি জানতেন– শর্মিষ্ঠা পিতার কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে নেবেন এবং নিজকৃত অন্যায়ের জন্য তিনি অন্তত পিতাকে বিপদে ফেলবেন না। শর্মিষ্ঠা দেবযানী নন। শর্মিষ্ঠার ধাত্রী বৃষপর্বার বক্তব্য নিবেদন করার জন্য রাজনন্দিনীর ভবনে এসে উপস্থিত হলেন। যত সময় ধরে দেবযানী, শুক্রাচার্য এবং বৃষপর্বার কথোপকথন চলেছে, তাতে রাজনন্দিনীর ঘরে সব খবরই পৌঁছে যাবার কথা। কাজেই ধাত্রী এসে যখন বলল- শর্মিষ্ঠা। তোমাকে যেতে হবে সেই উদ্যানবাটিকায় তখনই দেখছি, শর্মিষ্ঠা মানসিকভাবে অনেক প্রস্তুত। তিনি এক দণ্ডের মধ্যেই যেন কৈশোরগন্ধী ষোলো বৎসর বয়সের চাপল্য কাটিয়ে অনেক বড় হয়ে গেছেন। ধাত্রী বলল- চলো শর্মিষ্ঠা! পিতা এবং আত্মীয়-স্বজনের সুখ সম্পাদন করো- উত্তিষ্ঠ ভদ্রে শর্মিষ্ঠ জ্ঞাতীনাং সুখাবহ।

বৃষপর্বা ধাত্রীকে যাই বলুন, রাজবাড়ির ধাত্রী, বহুঙ্কাল ধরে সে শর্মিষ্ঠার দেখাশোনা করছে। সে পরিষ্কার জানাল– দেবযানী। দেবযানীর প্ররোচনায় শুক্রাচার্য আজ তার দানবশিষ্যদের ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন। অতএব দেবযানী যা চায় তাই তোমাকে করতে হবে। শর্মিষ্ঠা জবাব দিলেন দেবযানী যা চায়, আমি তাই করব। এমনকি শুক্রাচার্যও যদি দেবযানীর জন্য আমায় কিছু করতে বলেন, তাও আমি করব। তবু যেন আমার দোষে শুক্রাচার্য এবং দেবযানী এই রাজ্য ছেড়ে চলে না যান– মদদোষান্মাগমঞ্জুক্রো দেবযানী চ মকৃতে।

 রাজনন্দিনী শর্মিষ্ঠা এক হাজার দাসী সঙ্গে নিয়ে পালকি চড়ে নগর থেকে বেরলেন। উপস্থিত হলেন দেবযানীর সামনে, সেই উদ্যানবাটিকায়, যেখানে তিনি চরম অপমান করেছিলেন দেবযানীকে। সবিনয়ে বললেন- দেবযানী! এই হাজার দাসীর সঙ্গে আমি তোমার পরিচারিকা দাসী হলাম– অহং দাসীসহস্রেণ দাসী তে পরিচারিকা। তোমার পিতা যেখানে তোমাকে পাত্রস্থ করবেন, সেখানেও আমি তোমার পেছন পেছন দাসী হয়েই যাব।

দেবযানী ভাবতেও পারেননি অত তাড়াতাড়ি শর্মিষ্ঠা আত্মনিবেদন করবেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন- শর্মিষ্ঠা এসে তাঁর পিতা বৃষপর্বার কাছে অনুযোগ করবেন। ক্রোধে দুঃখে বিদীর্ণ হয়ে তিনি বৃষপর্বার কাছে আর্তি জানিয়ে বলবেন– এ তুমি কী করলে, পিতা? কেন তুমি এমন কথা দিলে? আর দেবযানী সেই করুণ কান্না শুনে মুখ ফিরিয়ে থাকবেন, আর অপেক্ষা করবেন শেষ সিদ্ধান্তের জন্য। বৃষপর্বা যদি শর্মিষ্ঠাকে রাজি করাতে না পারেন, তবে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পিতাকে সঙ্গে নিয়ে রাজ্য ছেড়ে চলে যাবেন।

কিন্তু না, এসব কিছুই হয়নি। শর্মিষ্ঠা এসে পিতার সঙ্গে কথা বলেননি। তিনি যে মুহূর্তে বুঝেছেন- শুক্রাচার্য চলে গেলে দানব-রাজ্যের রাজনৈতিক বিপন্নতা তৈরি হবে এবং তাতে তার পিতা বিপন্ন হবেন, সেই মুহূর্তেই শর্মিষ্ঠা, রাজনন্দিনী শর্মিষ্ঠা দেবযানীর কাছে আত্মনিবেদন করেছেন। যার ওপর খুব রাগ করে বসে আছি, সে যদি একটুও রাগ না করে ঠাণ্ডা মাথায়, যা বলি তাই মেনে নেয়, তবে তার ওপরে আরও রাগ হয়। দেবযানীরও তাই হল। তিনি যখন দেখলেন শর্মিষ্ঠা বিনা দ্বিধায়, একটিও কথা না বলে হাজার দাসীর সঙ্গে তার দাসী হতে এসেছেন, তখন তার মুখ দিয়ে নির্গত হল সেই প্রাচীন আক্রোশ কেন? এখন কেন? তুই না বলেছিলি– আমি স্তাবক যাচক, পরজীবীর মেয়ে, আর তুই নিজে হলি বস্তুত, বহুপ্রার্থিত রাজার মেয়ে, তা এত বড় মানুষের মেয়ে হয়ে তুই আমার দাসী হবি কী করে–য়মানস্য দুহিতা কথং দাসী ভবিষ্যসি?

রাজনন্দিনী শর্মিষ্ঠা রাজকীয় ভঙ্গিতে জবাব দিলেন দেবযানী! আমার বাপ-ভাই-বন্ধুরা আমারই জন্য বিপন্ন বোধ করছেন, যেভাবেই হোক, বিপন্ন আত্মীয়-স্বজনকে বিপন্মুক্ত করাই আমার কাজ। আর ঠিক সেইজন্যই তোমার পিতা তোমায় যেখানে পাত্রস্থ করবেন, আমি সেখানেই তোমার অনুবর্তন করব- অতত্ত্বানুযাস্যামি যত্ৰ দাস্যতি তে পিতা।

দেবযানী বুঝলেন না তিনি হেরে গেলেন। শর্মিষ্ঠা পিতার গৌরবে দেবযানীকে এক সময় অপমান করেছিলেন, এখন আবার দেবযানীর দাসীত্ব স্বীকার করে পিতারই গৌরব রক্ষা করলেন। তার সঙ্গে কোনও আলোচনা না করেও বৃষপর্বা দেবযানীকে যেভাবে কথা দিয়েছিলেন, শর্মিষ্ঠা সেই কথার মর্যাদা রক্ষা করলেন অক্ষরে অক্ষরে। কিন্তু দেবযানীর পিতা শুক্রাচার্য দেবযানীকে হাজার বুঝিয়েও স্বমত প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। তাকে নিরুপায় অবস্থায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও দেবযানীর কথা মেনে নিতে হয়েছে। তিনি পিতার সঙ্গে বৃষপর্বার সম্পর্কের কোনও মূল্য দেননি। অন্যদিকে শুক্রাচার্যও কন্যার প্রতি স্নেহবশত নির্বিচারে কন্যার বক্তব্য পুনরাবৃত্তি করেছেন। কাজেই অসুরগুরু শুক্রাচার্য এবং ঋষিকন্যা দেবযানী দু’জনেই বুঝি হেরে গেলেন রাজকীয় মর্যাদা এবং পরম আত্মনিবেদনের গাম্ভীর্যে। শর্মিষ্ঠার নির্বিরোধ শীতল মন্তব্যে প্রত্যুত্তরহীন দেবযানী শেষ পর্যন্ত আত্মখ্যাপন করে বলেছেন- এইবার আমি সন্তুষ্ট হয়েছি পিতা, এইবার আমি নগরে প্রবেশ করব– প্রবিশামি পুরং তাত তুষ্টাস্মি দ্বিজসত্তম। দানবরা সসম্মানে শুক্রাচার্য এবং দেবযানীকে নগরে প্রবেশ করাল, পিছন পিছন হাজার দাসীর সঙ্গে দেবযানীর অনুগামিনী হলেন রাজনন্দিনী শর্মিষ্ঠা।

দেবযানী এখন বড় আনন্দে আছেন। শুক্রাচার্যের আশ্রমে তিনি পূর্বে যেভাবে ছিলেন, এখন আর তিনি সেইভাবে থাকেন না। বনের ফুল তুলে নিজের আভরণ রচনা করা, পয়স্বিনী হোমধেনুটির পরিচর্যা করা, কিংবা উদাস কোনও মুহূর্তে বেণুমতীর তীরে বসে কোনও এক ব্রাহ্মণ-বয়স্যের স্মৃতিমুখে অলস অবসর যাপন– এ সব দেবযানীর পোয় না। তিনি এখন। রাজকীয় মর্যাদায় থাকেন। দানবরাজ বৃষপর্বা হাজারের ওপর আরও এক হাজার দাসী দিয়েছেন। এক হাজার দাসী শর্মিষ্ঠার সঙ্গে দেবযানীর শর্ত অনুযায়ী। আরেক হাজার দাসী তিনি দিয়েছেন শর্মিষ্ঠাকে, যাতে তার নিজের মেয়ের কষ্ট না হয়। দাসীবৃত্তি করতে গিয়ে শর্মিষ্ঠা যাতে অন্য দাসীদের ভিড়ে মিশে না যান, তাই দেবযানীর বুদ্ধিকে হারিয়ে দিয়ে বৃষপর্বা। আরও এক হাজার দাসী দিয়েছেন শুধু শর্মিষ্ঠার মর্যাদারক্ষার জন্য। দেবযানী না চাইলেও, যেহেতু এটা কোনও শর্তের মধ্যে ছিল না, তাই শর্মিষ্ঠা তাঁর পূর্বপরিচারিকাদের নিয়ে খানিকটা রাজমর্যাদাই ভোগ করেন বলা যায়। তবু শর্মিষ্ঠার তুলনায় দেবযানীর মর্যাদা এখন অনেক বেশি। তিনি দুই হাজার দাসীর পরিচর্যা-সুখে এখন বনস্থলীর সেই কুসুমিত কুঞ্জ-শয্যা, বেণুমতীর তীরে সেই লতাবিতান, অথবা বৃহস্পতিপুত্র কচের পরিবার-সুখ–সব ভুলে গেছেন।

অশেষ রাজকীয় সুখের মধ্যে অন্যতর মধুর এক সুখের আবেশ দেবযানীর অন্তর্গত হৃদয়ের মধ্যে খেলা করে। সেই যে একরাজা এসেছিলেন উদ্যানবাটিকায়। দেবযানীর তারক্ত অঙ্গুলিগুলির প্রশংসা করেছিলেন তিনি। তিনি তার অঙ্গুলিস্পর্শ করে কূপের গভীর থেকে তুলে এনেছিলেন। একবারও কি মনে হয় না- ভালই করেছিলেন শর্মিষ্ঠা। তাকে কুপগর্তে নিক্ষেপ করে ভালই করেছিলেন তিনি। নইলে পাণিপীড়ন করে তাকে তুলতেন না সেই রাজা। আমাদের ধারণা, সেই দিন থেকে প্রায় প্রতিদিন দেবযানী রাজকন্যার মর্যাদায় বসে থাকতেন সেই উদ্যানবাটিকায়। আঙ্গিরস কক্ষ তাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন– কোনও ঋষিপুত্র তাকে বিবাহ করবেন না। বয়েই গেছে দেবযানীর ঋষিপুত্র বিবাহ করতে। তিনি এখন রাজেন্দ্রাণীর মতো সর্বত্র বিচরণ করেন, আর ফিরে ফিরে আসেন সেই উদ্যানবাটিকায়। যদি আরও একবার। রাজার তেষ্টা পায়। তিনি যদি আবারও পথশ্রান্ত হয়ে জল খেতে আসেন।

দেবযানী তাই দুই হাজার দাসীর মেলায় আজও এসে বসে আছেন উদ্যানবাটিকায়-বনং তদেব নির্যাতা ক্রীড়ার্থং বরবর্ণিনী। তিনি ইচ্ছে করেই এমন এক উচ্চাসনে বসে থাকেন যাতে রাজনন্দিনী শর্মিষ্ঠাকে নীচাসনে বসে তার পদসেবা করতে হয়। কারণ, শর্মিষ্ঠা যে তাকে এক সময় তার পিতার আসন নিয়ে কথা শুনিয়েছিলেন। এমনিতে দুই হাজার দাসী নিত্যদিনের ব্যবহারে দেবযানীর সঙ্গে সখীর মতোই আচরণ করে। তারা কেউ আজ গান করছে, কেউ নাচছে, কেউ ফুলের মধু খাচ্ছে, কেউ বা উদ্যানবাটিকার বৃক্ষ-লতার ফল চিবোচ্ছে আলস্যভরে। দেবযানী গান শুনছেন, বাজনা শুনছেন, নাচ দেখছেন আবার কখনও বা শর্মিষ্ঠার দেওয়া পানপাত্রে মধুমদ্য পান করছেন। মধুর আবেশ থেকে শর্মিষ্ঠাও বাদ যাচ্ছেন না। মধুমদ্যের ভাগ তিনিও কিছু পাচ্ছেন।

পাঠক! সেই রাজার কথা স্মরণে আসে তো? সেই রাজা, যিনি দেবযানীর ‘পাণিস্তানখালিঃ স্পর্শ করে সবলে উঠিয়ে এনেছিলেন দেবযানীকে, কূপগর্ত থেকে। সেই রাজা, যিনি মৃগয়ার পরিশ্রমে অবসন্ন হয়ে তৃষ্ণার জল পাবার জন্য উদ্যানবাটিকায় এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেই রাজা, যিনি দেবযানীকে উদ্ধার করার পর প্রায় বিনা বাক্যে বিদায় নিয়ে রাজধানীতে চলে এসেছিলেন। আমরা বলেছিলাম- রাজা পতঙ্গবৎ দেবযানীর রূপবহ্নিতে শুধু পাখা পুড়িয়ে চলে গেছেন। আমরা বলেছিলাম। তিনি আবার আসবেন পতঙ্গবৎ বহ্নিমুখং বিবিক্ষুঃ। আগুনে পুড়ে মরতে কত সুখ, তা পতঙ্গ ভিন্ন আর কে বা জানে! মনুষ্য-পতঙ্গ যযাতির আবারও অকারণ সখ হল মৃগয়া করার। তিনি পাত্রমিত্র সঙ্গে নিয়ে আবারও মৃগয়ায় বেরলেন।

মহাভারতের কবি মন্তব্য করেছেন অনেক দিন পর দেবযানী আবারও একদিন সেই উদ্যানবাটিকায় ক্রীড়া করতে গেছেন। আর নাহুষ যাতি আবারও একদিন মৃগয়া করতে করতে পিপাসার্ত পরিশ্রান্ত হয়ে সেই বনের মধ্যে উদ্যানবাটিকায় এসে উপস্থিত হলেন তমেব দেশং সংপ্রাপ্তো জলার্থী শ্রমকর্ষিতঃ। মনুষ্যচরিত্র যাঁরা অবগত আছেন, তারা অবশ্যই বুঝবেন–এই চরম সমাপতন প্রায় অসম্ভব। মহাভারতের কবি মহারাজ যযাতিকে একটি রমণীর মোহে লালায়িত দেখাতে চাননি। কিন্তু আমরা জানি দেবযানী স্বেচ্ছায় প্রায়ই উপস্থিত হতেন সেই উদ্যানবাটিকায়। কারণ, যদি তিনি আসেন। আর মহারাজ যযাতির মৃগয়ার পথগুলিও এতটাই ধরাবাঁধা ছকে বাঁধা হওয়ার কথা নয় যে, ঠিক ওইখানেই এসে তিনি হারিয়ে যাবেন, পাত্রমিত্ররা আর তাকে খুঁজে পাবে না এবং তাকে শ্রান্ত পিপাসার্ত হয়ে ঠিক ওই বনেই প্রবেশ করতে হবে- জলার্থী শ্রমকর্ষিতঃ। আমরা জানি– যযাতির মনেও সেই তারক্ত নখালির হাতছানি ছিল- যদি তিনি সেখানে থাকেন। পতঙ্গ আগুন দেখতে পেল। আগুনের পুঞ্জ একটি নয়, দুটি।

মহারাজ যযাতি মৃগয়ায় শ্রান্ত হয়ে ঘোড়া থেকে নামলেন। উম্মুক্ত বনস্থলীর মধ্যে বৃক্ষলতার অন্তরালে দাঁড়িয়ে তিনি দেখতে পেলেন– উদ্যানবাটিকায় যেন উৎসব লেগেছে। কত শত রমণী, কেউ গান গাইছে, কেউ বাজনা বাজাচ্ছে, কেউ নাচছে গায়স্ত্যো’থ প্রনৃত্যত্যো বাদয়ন্ত্যো’থ ভারত। আরও দেখলেন একটি রমণী সর্বাঙ্গে আভরণ পরে উচ্চাসনে বসে আছেন। রত্নখচিত আসনে সহাস্যে বসে তিনি অবসর বিনোদন করছেন। অন্যতরা এক রমণী, যাঁকে দেখলেই বোঝা যায় তিনি সাধারণ নন, তিনি কিঞ্চিৎ নীচাসনে বসে উচ্চতরার পা টিপে দিচ্ছেন। অতুল তার রূপরাশি, সমস্ত রমণীর মধ্যে তিনিই প্রধানা হবার উপযুক্ত। তবু তার হেমভূষিত আসনখানি, নীচস্থ এবং তিনি উচ্চাসনস্থ রমণীর পা টিপে দিচ্ছেন–দদর্শ পাদৌ বিয়াঃ সংবহন্তীমনিন্দিতাম্।

দেবযানী এবং শর্মিষ্ঠার দুই হাজার দাসী নানা বিনোদন প্রক্রিয়ায় চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা মহারাজ যযাতিকে আগে দেখতে পান। চপল চটুল রমণী-সমাজের মাঝখানে বিখ্যাত এক পুরুষ এসে পড়ায় নিমেষে দাসীদের মুখ বন্ধ হল। লজ্জায় তাদের মাথা নত হল। যযাতি একটু অবাক হলেন। দুটি মাত্র রমণী। একজন উচ্চাসনে, একজন নীচাসনে। অথচ তাদের পরিচর্যা করছে দুই হাজার দাসী। আগের বার যযাতি যখন দেবযানীকে দেখেছিলেন, তখন তিনি ছিলেন অসহায়। শুক্রাচার্যের মেয়ে বলে তিনি তার পরিচয় পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু তিনি দেবযানীর নাম জানতেন না। সেদিন একটি পরিচারিকাও যার ধারে কাছে ছিল না, আজকে তিনি কোন মন্ত্রবলে হাজার হাজার দাসী নিয়ে রাজকন্যার মতো বসে আছেন। আরও আশ্চর্য, যে অপ্রতিম সুন্দরী এই বিপ্রকন্যার সেবা করছে, তার চেহারাটাও তো মোটেই দাসীর মতো নয়।

কৌতূহলী রাজা দু’জনকে উদ্দেশ করেই বললেন– আপনাদের পরিচয় জানতে ইচ্ছা করি। আপনাদের নাম-গোত্র জানাবেন কি গোত্রে চ নমনী চৈব দ্বয়োঃ পৃচ্ছাম্যহং শুভে। সেকালের দিনে নামের সঙ্গে গোত্র জানানোর রীতি ছিল। তবে এই মুহূর্তে যযাতি যে নামের সঙ্গে গোত্রও জানতে চাইলেন, তার কারণ খুব স্পষ্ট। যযাতি দেবযানীকে যথেষ্টই চিনতে পেরেছেন, কিন্তু অন্যতরা তাকে আরও বেশি মোহিত করছে। এই রমণী আদৌ ক্ষত্রিয়ের বিবাহযোগ্যা কি না– এই তর্ক হঠাৎই রাজার মন জুড়ে বসেছে। আমরা কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকেও দুষ্যন্তকে এই তর্কে নিযুক্ত দেখেছি। কথাশ্রমের ব্রাহ্মণ্য পরিবেশে উপস্থিত হয়ে শকুন্তলাও ব্রাহ্মণকন্যা কি না- এই চিন্তায় দুষ্যন্তকে আমরা আকুলিত দেখেছি। আসলে, কন্যা ব্রাহ্মণী হলে ক্ষত্রিয়ের পক্ষে সরাসরি বিবাহের প্রস্তাব করা কঠিন ছিল, কারণ তাতে বর্ণের অনুক্রম নষ্ট হয়।

এখানে দেবযানীকে যযাতি ব্রাহ্মণকন্যা বলে চিনতেনই, কিন্তু হাত ধরে তাকে তোলবার সময়েই তিনি বুঝেছেন– রমণী মনে বড় দুর্বল। কিন্তু আজ শর্মিষ্ঠাকে দেখে তিনি মোহিত হয়েছেন। তিনিও দেবযানীর সমগোত্রীয় ব্রাহ্মণী কি না, রাজা সেটা যাচাই করে নিতে চান। যথাতির জিজ্ঞাসা দু’জনের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হলেও উত্তর দিলেন দেবযানী। তিনি মালকিন, দাসীভূতা শর্মিষ্ঠার কথা বলারই অধিকার নেই সেখানে। দেবযানী বেশি কিছু বলতে চাইলেন না, জবাবটাও দিলেন শর্মিষ্ঠাকে তাচ্ছিল্য করে। দেবযানী বললেন আমার কাছেই শুনুন, রাজা! আমি শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী।

দেবযানীর রাজ-সম্বোধনেই বোঝা যায়, তিনি রাজাকে চিনেছেন। এবার শর্মিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে বললেন- এ আমার সখীও বটে, দাসীও বটে- ইয়ঞ্চ মে সখী দাসী। কিন্তু সখীত্বের থেকেও শর্মিষ্ঠাকে যে তিনি দাসী বলতেই বেশি পছন্দ করেন, সেটা বোঝানোর জন্য বেশ জোর দিয়ে বললেন- ও হল দানবরাজ বৃষপর্বার মেয়ে শর্মিষ্ঠা। আমি যেখানে থাকব সেখানেই ওকে থাকতে হবে, যেখানে যাব, সেখানেই ওকে যেতে হবে-ইয়ঞ্চ মে সখী দাসী যত্রাহং তত্র গামিনী। মহারাজ যযাতি রাজ্য চালান, তিনি ধুরন্ধর রাজা। কথাটা শুনেই বুঝলেন- কোথায় যেন একটা গণ্ডগোল আছে। তিনি আবারও জিজ্ঞাসা করলেন– অসুরেন্দ্র বৃষপর্বার এমন সুন্দরী কন্যাটি কেমন করে আপনার সখীও হলেন আবার দাসীও হলেন- এটা শোনার জন্য আমার বড় কৌতূহল হচ্ছে– কথং নু তে সখী দাসী কন্যেয়ং বরবর্ণিনী।

সারা ভারত জুড়ে মহাভারতের যে বিভিন্ন সংস্করণ আছে, তার কয়েকটিতে যযাতির এই প্রশ্নের পর আরও কয়েকটি অতিরিক্ত শ্লোক দেখা যায়। সেই শ্লোকগুলির মধ্যে যযাতির মুখে শর্মিষ্ঠার চরম প্রশংসা শোনা যায়। এমনকি দেবযানীর রূপের তুলনায় শর্মিষ্ঠা যে শতগুণ সুন্দরী এবং পূর্বজন্মের অনেক পাপ ছিল বলেই যে শর্মিষ্ঠাকে দেবযানীর দাসীত্ব বরণ করতে হয়েছে– এ সব কথা অনেকটাই বলা আছে। তবে এই শ্লোকগুলি আমাদের কাছে খুব সমীচীন মনে হয় না। তার কারণ যযাতি বিদগ্ধ রাজা। তিনি এত রুচিহীনভাবে দেবযানীর সামনেই শর্মিষ্ঠাকে এমন অসভ্যভাবে প্রশংসা করতে পারেন না। বরং রাজা কৌতূহল দেখাবেন এবং দেবযানী সেই কৌতূহল সবিস্তারে মেটাবেন না– এইরকম কথোপকথনই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয়।

বরং বলা যায়–রাজার যে শর্মিষ্ঠাকে ভাল লেগেছে- একথা রাজার কৌতূহল দেখেই বেশ বুঝতে পারলেন দেব্যানী। কোনও বিস্তারিত বিবরণের মধ্যে তিনি গেলেন না। শর্মিষ্ঠাকে এক তুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে তিনি বললেন– সবই কপাল, রাজা। সবই কপাল। ললাটের লিখন, তাই ও আমার দাসী হয়েছে, এ বিষয়ে বেশি কথা বলে লাভ কী– বিধানবিহিতং মত্বা মা বিচিত্রাঃ কথাঃ কৃথাঃ।

সঙ্গে সঙ্গে দেবযানী অন্য কথায় টান দিলেন। আমাদের ধারণা সব জেনেশুনেও দেবযানী সাভিনয়ে বললেন- বরং আপনার কথা বলুন, আপনাকে দেখে তো রাজা বলে মনে হচ্ছে। কথাও তো বলছেন উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণের মতো। বেদও আপনার জানা আছে মনে হয়। তা আপনার কী নাম? কারই বা পুত্র আপনি? কোথা থেকেই বা এসেছেন কো নাম ত্বং কুতশ্চাসি কন্স্য পুত্র শংস মে।

মহারাজ যযাতিও বুঝলেন– দেবযানী শর্মিষ্ঠার বিষয়ে বেশি কথা বলবেন না। তিনি তাই সাধারণভাবে জবাব দিলেন–তা ঠিকই বলেছেন আপনি। আমার ব্রহ্মচর্যের সময় থেকেই চতুর্বেদ আমার কানে এসেছে। আমি রাজাই বটে, আমার নাম যযাতি। দেবযানী এবার বুঝতে চাইলেন রাজা তাঁর জন্যই এখানে আবার এসেছেন কি না। বললেন–আপনি কী কারণে এই বনস্থলীতে এসেছেন? এই সরোবর থেকে লীলাপদ্ম আহরণ করার জন্য? নাকি মৃগয়া করার জন্য? যযাতি খটখট করে জবাব দিলেন– না, ভদ্রে! আমি মৃগয়া করতে এসে জলের খোঁজে এসেছিলাম এই উদ্যানভূমির মধ্যে। সে যাই হোক। অনেক কথা হল, এবার আপনি বিদায় দিন আমাকে বদ্ধপ্যনুযুক্তোস্মি তদনুজ্ঞাতুমহসি।

কিন্তু হায়! বিদায় চাইলেই কি বিদায় পাওয়া যায়? মুক্তি চাইলেই কি মুক্তি পাওয়া যায়? যযাতি ধরা দিতে এসে আরেকবাঁধনে জড়িয়ে গেলেন। ব্রাহ্মণ-কন্যা দেবযানীর পদপ্রান্তে যে সুন্দরী অধোবদনে বসে ছিল, নিশূপে যে দেবযানীর পাদসংবাহন করছিল, যযাতি তাকে দেখেই বেশি মুগ্ধ হলেন। কিন্তু সে কথা দেবযানীর সামনে তো আর বলা যায় না। অন্যদিকে দেবযানী রাজার কথা শোনার জন্য এতটাই ব্যগ্রভাব দেখিয়েছেন যে, যযাতি এখন পালাতে পারলে বাঁচেন। রাজার কথার মধ্যেও যেন সামান্য বিরক্তি ফুটে উঠেছে অনেক প্রশ্ন হয়েছে বহুধাপ্যনুযুক্তোস্মি– এবার চলি। কিন্তু চলা আর হল না। যে রমণী পুরুষ শিকার করার জন্য হাজারো দাসী নিয়ে উদ্যানবাটিকায় বসে আছে, তার হাত থেকে পালানো কি অতই সোজা?

.

৩৭.

 দেবযানীর কাছে এসে দানবনন্দিনী শর্মিষ্ঠাকে বেশি পছন্দ হয়ে গেল যযাতির। তার সম্বন্ধে সবিশেষ জানা হল না, শুধু দাসীবৃত্তির নিগড়ে আবদ্ধ এক সুন্দরী রমণীর বারুদ্ধ নিষ্পলক দৃষ্টি যযাতিকে মোহিত করল। দেবযানীর নানা প্রশ্ন আর তার ভাল লাগছে না। তিনি এখনই বিদায় নিতে চান। কিন্তু রাজপরিচয় প্রদানের শেষে যযাতির দিক থেকে এবার চলি’–এই অনুমতি-যাচনাটুকুও শেষ হল না। কোনও ভণিতা নেই, কোনও প্রস্তাবনা নেই, দেবযানী প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বললেন- এই দুই হাজার রমণী আর আমার এই দাসী শর্মিষ্ঠার সঙ্গে –দাস্যা শর্মিষ্ঠয়া সহ আজ থেকে আমি তোমার অধীন হলাম, রাজা। আজ থেকে তুমি আমার সখা, তুমি আমার স্বামী হবে। তোমার মঙ্গল হোক–তদধীনাস্মি ভদ্রং তে সখা ভর্তা চ মে ভব।

বুঝি আকাশের নীল থেকে ঘন বজ্রপাতও এত আকস্মিক নয়। ভাবনার বিষয় হল–যে। রমণী মজা কুয়োর মধ্যে পড়ে গিয়েও নিজের অহংকার ত্যাগ করেননি, যে রমণী বিপন্ন অবস্থাতেও বিপৎ-ত্রাতার কুল-পরিচয় জিজ্ঞাসা করেননি, যে রমণী অতি স্বল্প কথায় নিজের ব্যক্তিত্ব বিস্তার করে আত্মমর্যাদা বজায় রাখেন-এই কি সেই রমণী? এক লহমার মধ্যে মহারাজ যযাতির কাছে তিনি বিবাহের প্রস্তাব করে বসলেন!

যযাতি রাজা। রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে লোকচরিত্রও তার নখদর্পণে। তার ওপরে আছে রাজোচিত স্বভাবসিদ্ধি। অন্য পক্ষের কথা শুনে মনের মধ্যে যে ভাব হয়, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে না রাজার মুখমণ্ডলে। তাকে যত্ন করে শিখতে হয়–কী করে মনের ভাব গোপন করতে হয়, কী করে প্রতিক্রিয়া দমন করতে হয়। এমনকি হাত, মুখ, চোখ–কোথাও যাতে কোনও বিকার ধরা না পড়ে–তার জন্য তাকে সযত্নে বিকার-প্রশমনের পাঠ নিতে হয় ছোটবেলা থেকে। এসব কথা প্রাচীন রাজধর্মের নীতিতেই পাওয়া যাবে।

মহারাজ যযাতিকে আমরা তাই একটুও চমকিত দেখছি না। তাছাড়া এত সহজে যদি এক রমণী স্বল্প-পরিচিত একটি পুরুষের কণ্ঠলগ্না হতে পারেন, তার প্রতি আর যাই হোক যযাতির মতো বিদগ্ধ নরপতির প্রেম হয় না। এক মুহূর্তের মধ্যে দেবযানী তার পূর্ব-বিদগ্ধতা, মর্যাদা এবং গাম্ভীর্য ত্যাগ করে যযাতির কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। এই অতিরিক্ত তাড়াহুড়োর পিছনে কারণ একটাই। কচের অভিশাপ ছিল–কোনও ঋষিপুত্র তার পাণিপ্রার্থী হবেন না। অতএব ক্ষত্রিয়ই যদি বিয়ে করতে হয়, তবে ক্ষত্রিয়ের মতো ক্ষত্রিয় হলেন মহারাজ যযাতি। তার পিতা শুক্রাচার্য পর্যন্ত তাকে চেনেন এবং মর্ত্যভূমিতে তাকে প্রমাণস্বরূপ বলে মনে করেন। দেবযানী ভবিষ্যতে আর কোনও আশঙ্কা রাখতে রাজি নন।

দ্বিতীয় কারণও একটা আছে। তবে সেটাকে কারণ না বলে স্বভাব বলাই ভাল। কচের উদাহরণ থেকে যা বোঝা যায়, মহারাজ যযাতির উদাহরণ থেকেও তাই বোঝা যায়। দেবযানী পুরুষের সাহচর্যে এলেই প্রেমে পড়ে যান। প্রথম দিকে একটা সুনিপুণ ইচ্ছাকৃত গাম্ভীর্য এবং অহংকার তার চারদিকে ঘনিয়ে থাকে যেন, কিন্তু সেই গাম্ভীর্য এবং অহংকার পুরুষের সামান্য সান্নিধ্যমাত্রেই ভেঙেচুরে যায়। দেবযানীর এই দুর্বলতা কচও বুঝেছিলেন এবং রাজা হওয়ার দরুন যযাতির কাছে তা আরও তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে গেছে। মহারাজ যযাতিকে মানসিকভাবে আমরা ভীষণ প্রস্তুত দেখছি।

যে মুহূর্তে দেবযানী রাজার কাছে বিবাহের প্রস্তাব জানালেন, সেই মুহূর্তেই আমরা যযাতিকে ঝটিতি উত্তর দিতে দেখছি। দুহাজার দাসী আর শর্মিষ্ঠার সঙ্গে দেবযানীর এই আত্মসমর্পণ যতই আকস্মিক হোক, যযাতি সঙ্গে সঙ্গে তার উত্তর জানিয়ে বললেন–আমি তোমায় বিয়ে করতে পারি না, দেবযানী। তোমার ব্রাহ্মণ পিতা নিশ্চয়ই একজন নিকৃষ্ট বর্ণের ক্ষত্রিয় রাজার সঙ্গে তোমার বিবাহ-সম্বন্ধ করবেন না। দেবযানী লজ্জা ত্যাগ করে বললেন এও কি একটা কথা হল? তুমি তো ভালই জান–বামুনদের সঙ্গে ক্ষত্রিয়ের দিন-রাত ওঠা-বসা, বিয়ে-থাও এই দুই জাতের মধ্যে যথেষ্ট হয়। ক্ষত্রিয় মেয়ের সঙ্গে ব্রাহ্মণের বিয়ে, অথবা বামুনের মেয়ের সঙ্গে ক্ষত্রিয়ের বিয়ে–এরকম বর্ণসংকর সমাজে ভূরি ভূরি আছে– সংসৃষ্টং ব্ৰহ্মণা ক্ষত্রং ক্ষত্রেণ ব্ৰহ্ম সংহিত।

কথাটা যে দেবযানী খুব মিথ্যা বলেছেন, তা নয়। মহাভারতের পূর্বে লেখা ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিতে ক্ষত্রিয়ের থেকে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব সূচিত হলেও বহু জায়গায় এই দুই জাতির পারস্পরিক নির্ভরশীলতা সাদরে উল্লিখিত হয়েছে। শতপথ ব্রাহ্মণ একদিকে বলেছে-ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয় হলেন সমাজের সবচেয়ে শক্তিমান ধারা-ব্রহ্ম চ ক্ষত্রং চাশান্ত উভে বীর্যে, –অন্যদিকে ঐতরেয় ব্ৰহ্মণ বলেছে–ব্রাহ্মণ্য শক্তির মধ্যেই ক্ষাত্র শক্তির প্রতিষ্ঠা, আবার ক্ষাত্র শক্তির মধ্যেই ব্রাহ্মণ্যের প্রতিষ্ঠা-ব্রহ্মণি খলু বৈ ক্ষত্ৰং প্রতিষ্ঠিত, ক্ষত্রে ব্রহ্ম। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ প্রায় কবিতার মতো করে ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়ের পারস্পরিক মেশামিশি ব্যাখ্যা করেছে। বলেছে–স্বর্গ আর মর্তের যে সম্পর্ক, ঋমন্ত্র আর সামগানের মধ্যে যে সম্পর্ক, ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়ের মধ্যেও সেই সম্পর্ক–দৌরহং পৃথিবী ত্বং সামাহং ঋক্ ত্বং বেহ সংবহাবহৈ।

সামাজিক অবস্থান সংক্রান্ত এই মিষ্টি মিষ্টি কথাগুলির সঙ্গে দেবযানীর কথার খুব বেশি তফাত নেই। তবে দেবযানীর দিক থেকে আকস্মিক প্রণয়ের আকুতিটুকু এমন উদভ্রান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, শুধু ক্ষত্রিয়ই নয়, মহারাজ যযাতি যদি বৈশ্য কিংবা শূদ্রও হতেন, তাহলেও বোধহয় দেবযানীর আপত্তি থাকত না। শাস্ত্র-প্রসিদ্ধি অনুসারে পরম পুরুষের মুখ, বাহু, উরু এবং পা থেকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বৈশ্য এবং শূদ্রের সৃষ্টি। শাস্ত্রের কথা অন্য স্থানে যতই বৈষম্য বয়ে নিয়ে আসুক, মহারাজ যযাতির কাছে এই বর্ণবৈষম্যের অন্য এক মাত্রা আছে। তিনি বলেছেন–যদিও একই ঈশ্বর-শরীর থেকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বৈশ্য এবং শূদ্রের সৃষ্টি হয়েছে, তাই বৈষম্যের কথাটা তত বড় না হলেও প্রত্যেক বর্ণের ধর্ম, আচার এবং শুচিতার বোধ ভিন্ন ভিন্ন, যদিও শুচিতার নিরিখে ব্রাহ্মণই সর্বশ্রেষ্ঠ–পৃথধর্মাঃ পৃথক্‌শৌচাস্তেষান্তু ব্রাহ্মণো বরঃ। কাজেই এদিক দিয়ে দেখতে গেলে ব্রাহ্মণের সঙ্গে ক্ষত্রিয়ের বিবাহ সম্বন্ধ সমীচীন নয় মোটেই।

আগেই বলেছি–যযাতির কথার একটা অন্য মাত্রা আছে এবং সেটা বাস্তব সত্য। ভারতে ধর্ম, আচার এবং শুচিতার বোধ এতটাই দৃঢ়মূল যে, এগুলি শুধু ব্রাহ্মণই নয়, বৈশ্য, শূদ্র সমস্ত জাতির মধ্যেই এই বোধ কোনও না কোনওভাবে দৃঢ়প্রাথিত। সন্দেহ নেই, ব্রাহ্মণ্যবাদই এই শৌচ-আচার প্রতিষ্ঠার জন্য মূলত দায়ী, কিন্তু এই শুচিতা এবং আচার পালন অন্য বর্ণের মধ্যে এমনভাবেই সংক্রমিত হয়েছে যে, কখনও সেই শৌচ-আচার খোদ ব্রাহ্মণকেও ছাড়িয়ে গেছে। দু-একটি উদাহরণ দিই।

মনে আছে–ছোটবেলায় আমি এক বৈশ্য সাহার বাড়িতে খেতে বসেছি। বৈশ্যবাড়িতে এই খাওয়া-দাওয়া সমাজ তখন ভাল চোখে দেখত না, কিন্তু আমার পিতৃদেব শুদ্ধ বৈষ্ণব ছিলেন বলে তিনি এসব কিছুই মানতেন না। সে যাই হোক–খাবার সময় যে ব্যাপারটা আমাদের সবার চোখে পড়ল, তা হল–থালা, গেলাস আর পাঁচ-ছটি বাটির চমক। কাঁসা-পেতলের থালা-বাটি, কিন্তু মাজা-ঘষায় সে সব বাসনপত্রের রং ছিল নির্ভেজাল সোনার মতো। সোজা কথায় হাজার আচার-নিয়ম পালন করা বামুন বাড়িতে কোনওদিন আমরা অত মার্জিত থালা-বাটি দেখিনি। আমার মা বললেন– হ্যাঁ গা বউ! তোমাদের বাসনপত্র এমন সুন্দর থাকে কী করে? গৃহকত্রী বিনয় করে বললেন–সবই আপনাদের কাছেই শেখা, মা। বলা বাহুল্য, আমি সেই ছোট বয়সেও বুঝেছিলাম–সেই বৈশ্য-সাহাদের আচার-নিয়ম বামুনবাড়ির থেকে অনেক বেশি কঠোর। শৌচ-আচার-নিষ্ঠাও অনেক বেশি এবং শুধু তাই নয়, আলাদা।

পরবর্তীকালে এমনই এক বৈশ্য-সাহা পাত্রের সঙ্গে একটি বামুন বাড়ির মেয়ের বিয়ে হল। সন্দেহ নেই, সেই ভালবাসার বিয়ে এবং সৌভাগ্যবশত পাত্র-কন্যার পিতারা সে বিয়ে মেনে নিলেন। নতুন সংসার আরম্ভ হল। প্রথমদিকে বৈশ্যা শাশুড়িমাতা নতুন বউকে একটু সমঝেই চলতেন। পরে দেখলেন–নিয়ম, কানুন আচার-নিষ্ঠায় ব্রাহ্মণ-কন্যা অনেক শিথিল। সাহা-বাড়ির শাশুড়ি তার থেকে অনেক বেশি কট্টর, অনেক কিছুই তিনি বেশি মানেন। শাশুড়ি একদিন বলেই ফেললেন–হ্যাঁগা! তুমি বামুনবাড়ির মেয়ে! আর তোমার এই ব্যাভার? আচার-নিয়ম তুমি যে কিছুই মান না। একদিন দুদিন কথা শুনতে শুনতে বধূ জবাব দিল–আমাদের অত মানতে হয় না, এসব আমাদের রক্তে আছে। কথায় কথায় কথা বাড়ল, সংসার ভেঙে দু-খণ্ড হল।

শুধু এই আচার-নিয়মই নয়, বর্ণচতুষ্টয়ের প্রত্যেকের মধ্যে ধর্মবোধ, সংস্কৃতি এবং স্বভাবও এত পৃথক যে, এঁদের মধ্যে বৈবাহিক সম্বন্ধ হলে কিছু না কিছু বিরোধ একভাবে ফুটে ওঠেই। আবারও বলি–হয়তো ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং ব্রাহ্মণের উচ্চতার অভিমানই এই বিরোধের মূল কারণ। তবে জাতি হিসেবে অন্য বর্ণেরও নিজস্ব অভিমান এবং স্বাতন্ত্রও কিছু কিছু আছে। সৌভাগ্যের বিষয় সমাজ এখন পালটাচ্ছে। উচ্চবর্ণ নিজেদের সংকীর্ণতা বুঝতে শিখছে এবং নিম্নবর্ণের মধ্যেও সেই বিশ্বাস গাঢ় হচ্ছে যে, তারাও পারেন, সব পারেন। সমাজের মধ্যবিন্দুতে সমস্ত বর্ণই একাকার হোক–এই কামনার পরেও মহারাজ যযাতির কথাটা আমাদের বুঝতে হবে তৎকালীন সমাজের বৈষম্যের নিরিখেই।

যযাতির বক্তব্য-ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ে যতই মেলামেশা আর বৈবাহিক সম্বন্ধ থোক, ব্রাহ্মণের শৌচ, আচার, নিষ্ঠা ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে একমত নয়। একই শরীরের অন্তর্গত হলেও হাত, পা মুখের কাজ যেমন আলাদা, তেমনই একজন যেখানে যাগ-যজ্ঞ, ব্ৰতহোম নিয়ে দিন কাটাচ্ছে, অন্যজন সেখানে অমাত্য-সচিবের মন্ত্রণা, পররাষ্ট্রনীতি, শুকনীতি, দূত-নিয়োগ–এইসব নানান রাষ্ট্রীয় ভাবনায় ব্যস্ত। চতুর্বর্গের মধ্যে মোক্ষধর্ম যেখানে ব্রাহ্মণের পরম অনুসন্ধানের বিষয়, রাজাদের সেখানে শাস্ত্রের নিয়মেই মোক্ষের অভিসন্ধি থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। কারণ রাজা যদি মুক্তিচিন্তায় বিভোর হন তবে রাজ্য লাটে উঠবে।

ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের ক্রিয়াকর্মের এই ভিন্নতাই তাঁদের আচার-নিষ্ঠা এবং স্বভাবেও ভিন্নতা এনেছে। বৈবাহিক জীবনে এই ভিন্নতা যদি পদে পদে বিরোধের সৃষ্টি করে–সেই ভয়েই যযাতি বললেন–এই বিবাহ হতে পারে না, দেবযানী! ধর্ম এবং শুচিতার বিধানে ব্রাহ্মণরা আমাদের থেকে অনেক বড়। দেবযানী বললেন- কেন যে তুমি এমন ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের বিষম আচরণ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ? তোমাকে আমি আমার সমান বর্ণ বলে মনে করি। ঋষি বল আর ঋষিপুত্ৰই বল, তুমি আমার কাছে তাই। তুমি আমার প্রিয়তম। আমাকে দয়া করে তুমি বিবাহ করো–ঋষিশ্চাঋষিপুত্ৰ নহুষাঙ্গ বহস্ব মাম্।

যযাতি নহুষের পুত্র। তিনি রাজা। কিন্তু দেবযানী তাকে ঋষি অথবা ঋষিপুত্র বলে প্রমাণ করে ছাড়বেন। আমরা বুঝি-দেবযানীর মনে ক্রিয়া করছে কচের সেই অভিশাপ–কোনও ঋষি বা ঋষিপুত্র তোমার পাণিগ্রহণ করবেন না। দেবযানী তাই যেন-তেন-প্রকারেণ যযাতিকে ঋষি অথবা ঋষিপুত্র বলেই প্রমাণ করতে চান। তার যুক্তিটা এইরকম–চন্দ্রবংশের প্রথম পুরুষ চন্দ্র মহর্ষি অত্রির পুত্র। আবার চন্দ্রপুত্র বুধ চন্দ্রের ঔরসজাত হলেও দেবগুরু ব্রাহ্মণ বৃহস্পতির সঙ্গেও তার পিতৃসম্বন্ধ আছে। বুধ ইলাকে বিবাহ করবার সময় ছল করে নিজেকে ব্রাহ্মণের পুত্র বলে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন-পিতা মে ব্রাহ্মণাধিপঃ–এবং তা দিয়েছিলেন বৃহস্পতির পুত্রত্ব তিনি অস্বীকার করেন না বলেই। এইভাবে মূল বংশলতিকা থেকে যদি আরম্ভ করা যায়, তবে মহারাজ যযাতিও একভাবে ঋষির বংশধরই বটে, এমনকি ঋষিপুত্রও বলা যায় টেনেটুনে।

কিন্তু দেবযানী যযাতির ঋষিত্ব কিংবা ঋষিপুত্রত্ব প্রমাণ করে যতই আপনাতে আপনি সন্তুষ্ট হোন, যযাতি টললেন না একটুও। তিনি চতুর্বর্ণের উত্তরোত্তর নিকৃষ্টতা দেখিয়ে নিজেকে বিবাহের অনুপযুক্ত বলে স্থাপন করলেন। দেবযানী এবার যযাতির প্রতি শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলেন। তিনি বললেন–ওসব বর্ণধর্ম, আশ্রমধর্মের কথা না হয় বুঝলাম, কিন্তু মশাই! পাণিধর্মের বেলায় কী হবে? কোনও কন্যার পাণিগ্রহণ করে তাকে আবার প্রত্যাখ্যান করার মতো অভদ্রতা এ পর্যন্ত কোনও পুরুষ মানুষ করেননি- পাণিধর্মো নাহয়ং ন পুঃভিঃ সেবিতঃ পুরা। তুমি যে একবার আমায় সেই হাত ধরে উঠিয়েছিলে কুয়ো থেকে, সেই তো পাণিগ্রহণ হয়ে গেছে। আর আমিও সেই কারণেই তোমাকে স্বামী হিসেবে বরণ করেছি। তুমিই বল–তোমার মতো একজন ঋষিপুত্র যদি কোনও ভদ্র ঘরের মেয়ের হস্ত স্পর্শ করে থাকে, তবে সেই রমণী কী করে আবার অন্য পুরুষের হাত ধরবেকথং নু মে মনস্বিন্যাঃ পাণিমন্যঃ পুমান্ স্পৃশেৎ?

 য্যাতি তবু মানলেন না। যদিও পূর্বে হস্তস্পর্শ করার ফলে এবং এখন সেই হস্তস্পর্শের আকস্মিকতাই বৈবাহিক নিয়মের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করায় তিনি যথেষ্ট অপ্রতিভ হলেন। আবারও প্রশ্ন তুললেন, সেই ব্রাহ্মণ্যের প্রশ্ন। ব্রাহ্মণরা যে কত বড় শ্রেষ্ঠ আসনে বসে আছেন, ক্রুদ্ধ হলে অভিশাপ দিয়ে তারা যে কত ক্ষতি করতে পারেন–এই সব নানা অজুহাতে যযাতি হস্তস্পর্শের পূর্ব অভিজ্ঞতাটুকুও যেন এড়িয়ে যেতে চাইলেন। বেশি বিনয় এবং নিকৃষ্টতা দেখালে দেবযানীও যদি তাকে শেষ পর্যন্ত নিকৃষ্ট ভেবে পাণিগ্রহণের নাগপাশ থেকে মুক্তি দেন–এই ভরসায় যযাতি ব্রাহ্মণের স্তুতি করলেন অনেক। তারপর বললেন–তুমি যাই বল, দেবযানী! তোমার পিতা যদি আমার হাতে তোমাকে সমর্পণ না করেন, তবে আমার পক্ষে তোমাকে বিবাহ করা সম্ভব নয়, দেবযানী– অতো দত্তাঞ্চ পিত্রা ত্বাং ভদ্রে ন বিবহাম্যহম্। যযাতির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল- অল্প বয়সী দেবযানী যাই বলুন, অসুরগুরু শুক্রাচার্যের মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রাহ্মণ কিছুতেই ক্ষত্রিয় রাজার হাতে নিজের মেয়ে দেবেন না।

কথাটা যযাতি একভাবে ঠিক বললেও, মেয়ের কাছে শুক্রাচার্য যে একেবারে নিস্তেজ ক্রীড়নকে পরিণত হন– সেকথা বুঝি যযাতি জানতেন না। দেবযানী মুহর্তের মধ্যে যযাতির কথাটা লুফে নিয়ে বললেন বেশ তো মহারাজ! আমি তো তোমাকে আমার স্বামী হিসেবে বরণ করেইছি। এখন আমার পিতাই না হয় আমাকে তোমার হাতে সম্প্রদান করবেন। কথাটা তো জলের মতো পরিষ্কার। তুমি তো আর আমাকে জোর করে বিয়ে করতে চাওনি। আমি নিজেই আমাকে তোমার হাতে সঁপে দিয়েছি। তুমি একজন আত্মসমর্পিতা রমণীকে গ্রহণ করে ধন্য করেছ মাত্র। এতে নিশ্চয়ই তোমার কোনও ভয় থাকতে পারে না অযাচতো ভয়ং নাস্তি দত্তাঞ্চ প্রতিগৃহ্নতঃ।

 দেবযানী যযাতির সঙ্গে কথা শেষ করেই ধাত্রীকে পাঠালেন শুক্রাচার্যের কাছে। বললেন–তুমি শিগগির যাও। আমার পিতাকে নিয়ে এসো এখানে। তাকে কিন্তু এ কথাও জানিও যে, আমি নহষপুত্র যযাতিকে স্বামী হিসেবে বরণ করেছি–স্বয়ংবরে বৃতং শীঘ্রং নিবেদয় চ নাহুষ। ধাত্রী গিয়ে সমস্ত বৃত্তান্ত দেবযানীর মনমতো করেই শুক্রাচার্যকে জানাল। অসুরগুরু শুক্রাচার্যও সঙ্গে সঙ্গে এসে রাজা যযাতিকে দর্শন দিলেন। যযাতি শুক্রাচার্যের চরণ বন্দনা করে হাত জোড় করে অবনত শিরে দাঁড়িয়ে রইলেন।

দেবযানী বললেন–পিতা! এই সেই রাজা, যিনি সেই মজা কুয়োর মধ্যে থেকে টেনে তুলবার সময় হাত ধরেছিলেন আমার–দুর্গমে পাণিগ্রহী। আপনি আমাকে এঁর হাতেই সম্প্রদান করুন। কারণ, ওই রকম করে হাত ধরার পর আমি কোনও পুরুষকে আর স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারব না-নমস্তে দেহি মাম্ অস্মৈ লোকে নান্যং পতিং বৃণে।

আগেও আমরা দেখেছি–যেখানে যে কথাটি দরকার, সেটা খুবই সুন্দর করে সাজিয়ে দিতে পারেন দেবযানী। বিবাহের সংজ্ঞা এবং সম্পূর্ণতা কালে কালে পরিবর্তিত হয়েছে। একটা সময় ছিল, যখন পাণিস্পর্শমাত্রেই বিবাহ সম্পূর্ণ হত। কোনওকালে পিতা কর্তৃক। কন্যাসম্প্রদানের মাধ্যমেই বিবাহ সম্পূর্ণ হত। পরবর্তীকালে সপ্তপদীগমন না হলে বিবাহ অসম্পূর্ণ থেকে যেত। সময়ের পরিণতিতে এমনও হয়েছে যে, বিয়ের দিন কন্যা-সম্প্রদান অথবা সপ্তপদীগমন–এসবের কোনও মূল্য হবে না, যদি কুশণ্ডিকা না হয়। এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, দেব্যানীর সময়ে কোনও রমণীর হস্তস্পর্শের মূল্য ছিল সাংঘাতিক এবং শুধুমাত্র এই কারণ দেখিয়েই বৈবাহিক বিধির অলঙ্ঘনীয়তা প্রমাণ করা যেত। দেবযানীর বুদ্ধিমত্তাও এইখানেই যে, তিনি যযাতির পাণিগ্রহণের তাৎপর্য বিবাহের অনিবার্যতায় পরিণত করতে পেরেছেন।

শুক্রাচার্য সব বুঝলেন। আগেই বলেছি–তিনি মহাজ্ঞানী ঋষি। শর্মিষ্ঠার সঙ্গে বিবাদের সময়েও তিনি দেবযানীর দোষের কথা প্রথমে উল্লেখ করেছিলেন। পরে অবশ্য কন্যার প্রতি স্নেহের মোহগ্রস্ততায় তাঁর কথাই মেনে নেন। এখানেও দেখছি, দুর্গত অবস্থায় রাজার হস্তাবলম্বন-দানের ঘটনার মধ্যে দেবযানী যখন বিবাহের ধর্মীয় তাৎপর্য আবিষ্কার করলেন, তখন শুক্রাচার্য খুব কায়দা করে বললেন-দেখ বাছা! ধর্ম এক জিনিস, আর ভালবাসা আরেক জিনিস। অর্থাৎ এই ব্যক্তির প্রতি তোমার ভালবাসা জন্মেছে, বেশ কথা। সেটাই বলো। এখানে আবার ধর্মের প্রলেপ লাগাতে চাইছ কেন? তর্ক করলে বলা যায়–তুমি কুয়োর মধ্যে পড়ে ছিলে, রাজা তোমায় দয়া করে বাঁচিয়েছেন। এখানে বিপৎত্রাণই ধর্ম। কিন্তু সেই হাত ধরার ব্যাপারটাকে তুমি যদি এখন তোমার ঈঙ্গিত কাজে ব্যবহার করে রাজাকে ফাঁদে ফেল, সেটা মোটেই ধর্ম নয়। শুক্রাচার্য তাই খুব মিষ্টি করে দেবযানীর কথা উড়িয়ে দিয়ে বললেন–ধর্মের কথা আলাদা, প্রণয়ের কথা আলাদা, ও দুটোকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলো না, বাপু। তুমি তো আমার কাছে আগে কিছু বলোনি, আমার মতামতও চাওনি। তার আগেই তুমি রাজাকে বরণ করে বসে আছ–অন্যো ধর্মঃ প্রিয়নন্যা বৃত্তে নাইষঃ পতিঃ।

শুক্রাচার্য মহারাজ যযাতিকে ধর্মবিষয়ে অন্যতম প্রমণ বলে মনে করেন। পূর্বে শর্মিষ্ঠার সঙ্গে দেবযানীর বিবাদের সময়ে তিনি দেবরাজ ইন্দ্র এবং অসুররাজ বৃষপর্বার সঙ্গে মর্ত্য রাজা যযাতিকেও সমান মূল্য দিয়েছিলেন। ফলে যযাতির সামনে তিনি দেবযানীর ধর্মধ্বজিতার মূল্য দিলেন না। ধর্মের বড়াইকে বাড়তে না দিয়ে তিনি বরং উলটে দেবযানীর পূর্ব তর্কযুক্তিতে জল ঢেলে দিলেন। দেবযানী তো মহারাজ যযাতিকে কোনও এক সুদূর ঋষিসম্বন্ধে একেবারে ঋষি অথবা ঋষিপুত্র বলে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন। যেন কচের কথা কিছুই খাটল না, কচের অভিশাপ মিথ্যে করে দিয়ে তিনি যেন ঋষিপুত্রকেই বরণ করে ফেলেছেন-এমনই এক সাহংকৃত ভাব ছিল দেবযানীর।

কিন্তু শুক্রাচার্য বেশ কায়দা করে বললেন–তা বাপু! নিজে দেখে শুনে যযাতিকে তুমি স্বামীত্বে বরণ করেছ, বেশ করেছ। তোমার তো বাপু কোনও ঋষি অথবা ঋষিপুত্রের সঙ্গে বিয়েও হবে না–একথা তো কচ আগেই বলে দিয়েছে–কচশাপায়া পূর্বং নান্যভবিতুম অহতি। অর্থাৎ ঋষি, ঋষিপুত্রের বাহানা দেখিয়ে তুমি নিজেকে ভোলাতে পারো, কিন্তু আমাকে ভুলিও না। যাতি পরিষ্কার এক ক্ষত্রিয় রাজা। তুমি তাকেই স্বামী হিসেবে বরণ করেছ। এ যাত্রায় আর ঋষি অথবা কোনও ঋষিপুত্র তোমার স্বামী হিসেবে দেখা দেবেন না। সোজা কথা হল, তুমি পছন্দ করেছ, বিয়ে করো; কিন্তু ধর্ম, ঋষিপুত্র–ওইসব হেঁদো যুক্তি দিয়ে মহামতি শুক্রাচার্যকে যে কাবু করা যায় না, সেটা তিনি সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিলেন। তবে হ্যাঁ, সঙ্গে সঙ্গে তিনি দেবযানীর প্রতি স্নেহের যুক্তিটাও মেনে নিলেন। অর্থাৎ দেবযানীর প্রণয় যেমন ধর্মাধর্ম অতিক্রম করে উৎসারিত হয়েছে, তেমনই দেবানীর প্রতি শুক্রাচার্যের স্নেহও ধর্মাধর্ম অতিক্রম করে স্বতই উৎসারিত হল। সাগ্রহে তিনি যযাতিকে বললেন–আমার পরম স্নেহের পাত্রী এই আমার কন্যা দেবযানী। সে তোমাকে স্বামীরূপে বরণ করেছে; আমিও সাগ্রহে এঁকে তোমার হাতে সমর্পণ করলাম। তুমি তোমার মহিষী হিসেবে এঁকে গ্রহণ করো–গৃহাণেমাং ময়া দত্তাং মহিষীং নহুষাত্মজ।

.

৩৮.

 ভার্গব শুক্র দেবযানীকে ক্ষত্রিয় যযাতির হাতে সমর্পণ করতে চাইলে যযাতি সসংকোচে বললেন আমার দিক থেকে কোনও অধর্মের আশঙ্কা নেই তো, মুনিবর? আমি যে এই জেনেশুনে বর্ণসংকর ঘটাচ্ছি, তাতে কি ভীষণ অন্যায় হয়ে যাবে না– অধর্মো ন শৃশেদেষ মহান্ মামিহ ভার্গব? শুক্রাচার্য অভয় দিয়ে বললেন–অধর্ম যদি ঘটেও তবে সে অধর্ম থেকে আমি তোমায় মুক্ত করব। শুক্রাচার্য জানতেন তার মেয়ে সমস্ত অহংকার সত্ত্বেও যদি কারও প্রতি অনুরাগিণী হয়ে থাকে, তবে তিনি এই রাজা যযাতি। দেবযানী যেমন, তাতে মর্ত্যভূমির এই রাজার থেকে ভাল পাত্র তার জুটবে না। তাই রাজাকে তিনি প্রশ্রয় দিয়ে বললেন- এই বিয়েতে বর্ণসংকর ঘটলেও তুমি বিষণ্ণ হয়ো না রাজা! আমি তোমার সমস্ত পাপ অপনোদন করব- অস্মিন্ বিবাহে মা গ্লাসীরহং পাপং নুদামি তে।

যদি বলেন কোন এক্তিয়ারে শুক্রাচার্য বললেন কথাটা। তার কি এত ক্ষমতা, তিনি শাস্ত্রযুক্তি উলটে দিতে পারেন? আমাদের তাহলে সেই পুরনো কথাটাই বলতে হয় শক্তিমান, মর্যাদাসম্পন্ন পুরুষ সব পারেন। তাদের জন্যই সমাজে নতুন ভাবনার আমদানি হয়। প্রাচীন শাস্ত্রযুক্তির এদো পুকুর থেকে সমাজ উঠে আসে নতুন আলোয়, নতুন সিন্ধুপারে। ভগবদ্গীতায় ভগবান নামে চিহ্নিত সেই পুরুষটি সাংঘাতিক একটা কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন–দেখ অর্জুন! বড় মানুষেরা যা করেন, সাধারণ লোকে তাই করে-য যদ আচরতি শ্রেষ্ঠত্তদেবেতরে জনাঃ। বড় মানুষ যদি কোনও নতুন কাজ করে ফরমান জারি করে বলেন–এইটাই প্রমাণ, তবে.লোকে সেটাই মেনে নেয়–স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে।

 ভগবদ্গীতায় প্রসঙ্গ ছিল অন্য এবং সেখানে বড় মানুষেরা সমাজ এবং শাস্ত্র-বিগর্হিত কাজগুলি যাতে না করেন, তারই নির্দেশ আছে। আপাতদৃষ্টিতে কথাটা ঠিক, কারণ কথা সমাজ-সচল প্রথার বাইরে গিয়ে বড় মানুষেরা যা করবেন, সাধারণে তার অনুবর্তন করবেই। একই সঙ্গে এও ঠিক যে, বড় মানুষ বলেই, তারা সমাজের উর্ধ্বে উঠে বৈপ্লবিক পথ দেখাতে পারেন। তা না হলে আমাদের দেশে বেদের পর উপনিষদ আসত না, বুদ্ধ-মহাবীর আসতেন না, চৈতন্যদেব আসতেন না- রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দও আসতেন না। এই যে শুক্রাচার্য বললেন- দেবযানী তোমাকে ভালবেসে নিজের পছন্দে বরণ করে নিয়েছে, তুমিও এর সাহচর্যে অপার আনন্দ অনুভব করো- এই কথাটার মধ্যেই বড় মানুষের প্রশ্রয় আছে। ভাবটা এই, হোক বর্ণসংকরের অধর্ম, সে আমি বুঝব; তোমার পাপ অপনোদন করব আমি– অহং পাপং নুদামি তে।

বস্তুত কেউ কারও পাপ অপনোদন করতে পারে না। কিন্তু তথাকথিত অন্যায়ী মানুষের পাশে যদি কোনও বড় মানুষ দাঁড়িয়ে যান, তবে তার অন্যায় লঘু হয়ে যায়। তথাকথিত পাপী এইরকম কোনও পারস্পরিক অনুরাগযুক্ত যুবক-যুবতীর পাশে দাঁড়িয়ে কোনও শুক্রাচার্য যদি পিতার ভূমিকা পালন করেন তবে সমাজ তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও কিছু করতে পারে। শুক্রাচার্য সেখানে অভয় দেন- অধর্ম যদি কিছু হয়, তবে তা থেকে তোমাকে বের করে নিয়ে আসার ভার আমার– অধমত্ত্বাং বিমুঞ্চামি শণু ত্বং বরমীলিত।

শুক্রাচার্যের অনুমতিতে এবং সাহসে যাতির হৃদয় কিছু শান্ত হল। কিন্তু এই সাহস দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুক্রাচার্য আরও একটি নির্দেশ দিলেন। তিনি দীর্ঘদর্শী ঋষি। তিনি জানেনদেবযানী আপন ক্রোধে শর্মিষ্ঠাকে দাসী হিসেবে চেয়েছিলেন। তাও না হয় ঠিক ছিল। কিন্তু স্বামীর বাড়িতেও শর্মিষ্ঠাকে দাসী হিসেবে চরাতে নিয়ে যাবে- এই দম্ভ দেবযানীকে বিপন্ন করবে। শর্মিষ্ঠা দেবযানীর থেকে কম সুন্দরী নন, তার ওপরে রাজার মেয়ে। রাজবাড়ির মর্যাদা এবং বিদগ্ধতা তার শরীরে এবং মনে প্রধান আকর্ষণচিহ্নের মতো সতত আলম্বিত। ফলে রাজা যদি দেবযানীকে অতিক্রম করে শর্মিষ্ঠার প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন, সেটা কিছুই আশ্চর্যের হবে না। দীর্ঘদশী শুক্রাচার্য তাই যযাতিকে একটু সাবধান করে বললেন- এই যে এই মেয়েটিকে দেখছ, এ হল দানবরাজ বৃষপর্বার মেয়ে কুমারী শর্মিষ্ঠা ইয়ঞ্চাপি কুমারী তে শর্মিষ্ঠা বার্ষপর্বণী। শর্মিষ্ঠাকে তুমি পূজনীয়ভাবে প্রতিপালন করবে। কিন্তু কখনও যেন তাকে আপন শয্যায় স্থান দিয়ো না- সম্পূজ্যা সততং রাজন মা চৈনাং শয়নে বয়েঃ। কথাটা যযাতি শুনলেন, শর্মিষ্ঠাও শুনলেন।

সংস্কৃতে কথাটা যেভাবে আছে, সেটাকে সোজাসুজি বাংলা অনুবাদ না করলেও বোঝা যায় শুক্রাচার্য অত্যন্ত চাচাছোলা মানুষ। দেবযানীকে রাজা বিয়ে করলেও তার কাছে যে শর্মিষ্ঠার আকর্ষণ যে কোনও সময় বেশি হয়ে উঠতে পারে- এই বাস্তব সত্যটা শুক্রাচার্য বোঝেন বলেই বড্ড কাটাকাটা কতগুলি শব্দ ব্যবহার করেছেন। সে যাই হোক, শুক্রাচার্যের উপস্থিতিতে শাস্ত্রোক্ত নিয়মে মহারাজ যযাতির সঙ্গে শুক্রকন্যা দেবযানীর বিয়ে হয়ে গেল। সুন্দরী দেবযানীর সঙ্গে দুই হাজার দাসী আর বৃষপর্বার মেয়ে শর্মিষ্ঠা প্রতিষ্ঠানপুরে মহারাজ যযাতির। রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করলেন।

যযাতির রাজভবন দেবরাজ ইন্দ্রের বৈজয়ন্ত প্রাসাদের মতো মহেন্দ্রপুরসন্নিভ। বিশাল বিশাল মহালের পর রাজার অন্তঃপুর। যযাতি সেই অন্তঃপুরে দেবযানীকে যথাযোগ্য মর্যাদায় উপবেশন করালেন। সমস্যা হল-শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে। তাকে অন্তঃপুরে স্থান দিলে, তার মর্যাদা। বাড়ে বই কমে না। দেবযানী তাকে দাসীর মতো খাটালেও, অন্তঃপুরে থাকলে অন্তঃপুরচারিণী। রাজমহিষীদের সঙ্গে তার সমতা আসে। অতএব শর্মিষ্ঠাকে যদি রাজভবনের বাইরে কোথাও একটা ঘর-টর তুলে থাকতে দেওয়া হয়, তবে তার রাজমর্যাদা সামান্যও অবশিষ্ট থাকে না। এই পরিকল্পনাই দেবযানীর মনমত হল। রাজা তখন রাজ্যোদ্যানের প্রান্তভাগে যে অশোকবন আছে, সেই বনের কাছে একটা নতুন বাড়ি তৈরি করে শর্মিষ্ঠাকে থাকতে দিলেন–অশোকবণিকাভ্যাসে গৃহং কৃত্বা ন্যবেষয়ৎ।

শর্মিষ্ঠার অসুবিধে কিছু রইল না। তার জন্য বরাদ্দ এক হাজার দাসী তারই সেবায় নিযুক্ত হল। মহারাজ যযাতি অন্ন, বস্ত্র পানীয়ের ঢালাও ব্যবস্থা করে দিলেন শর্মিষ্ঠার জন্য। এই ব্যবস্থার মধ্যে শুধু কর্তব্যের শুষ্কতা ছিল না। কারণ, কবি টিপ্পনি কেটেছেন–সুসকৃতা– অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, পানীয়ের আয়োজনে আদর ছিল যথেষ্ট বাসোভিরশ্নপানৈশ্চ সংবিভজ্য সুসৎকৃতাম্। এই সাদর আয়োজন শুধু দেবযানীর দাসী বলেই শর্মিষ্ঠার লভ্য হল, নাকি সেই উদ্যানবাটিকার মধ্যে দাসীত্বের পিঞ্জরে বাঁধা কোনও এক রাজনন্দিনীর করুণ আনত দৃষ্টিই এর জন্য দায়ী তার বিচার করতে পারে শুধু সহৃদয়ের হৃদয়।

সব ব্যবস্থা শেষ হলে মহারাজ যযাতির সঙ্গে দেবযানীর দাম্পত্য বিহার আরম্ভ হল। রসে-রমণে অনেক কাল কেটে গেল এবং দেবযানী একটি পুত্রও লাভ করলেন। অশোকবনে নির্জনে থাকা শর্মিষ্ঠার কাছে খবর গেল- দেবযানীর পুত্র হয়েছে। তার মনটা ভারি খারাপ হল। তাকে যে এখন দিনরাত দেবযানীর ফাইফরমাশ খাটতে হচ্ছে, তাও নয়; দিনরাত যে তার পা টিপে দিতে হচ্ছে, তাও নয়। অথচ রাজ-অন্তঃপুরের বাইরে, পুষ্পবনের নির্জন অন্তরালে শর্মিষ্ঠার এই বন্দিদশা তাকে ক্ষত-বিক্ষত করে। কোনও কাজ নেই, কর্ম নেই, কষ্ট নেই, সুখ নেই, কিছুই নেই। অথচ অশোকবনের প্রকৃতির মধ্যে এক গভীর গোপন গতি আছে শরৎ-বসন্তের সঙ্গে আকাশ বাতাস সেই গতিময়তার ইঙ্গিত বয়ে আনে শর্মিষ্ঠার অন্তরে। আর আছে শর্মিষ্ঠার শরীর। বহিঃপ্রকৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেই শরীর এমনই এক সম্পূর্ণতায় উত্তীর্ণ হল যে, বসন্তের জাগরণে অশোক ফুল ফুটলে সে শরীর বলে–আমিও পুষ্পবতী; বসন্তের মৃদু-মন্দ হাওয়ায় সে শরীর আপনি আন্দোলিত হয়, পুষ্পের অন্তর্গত রেণুকণায় শিহরণ জাগে। শর্মিষ্ঠা সম্পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত হলেন– দদর্শ যৌবনং প্রাপ্তা ঋতুং সা চাচিস্তয়ৎ।

অশোকণিকার অন্তৰ্গতে দাঁড়িয়ে শর্মিষ্ঠা কেবলই মনে মনে আকুলিত হন, বিকুলিত হন। দেবযানীর ওপর তার ঈর্ষা হয়। তার বিয়ে, দাম্পত্যসুখ, পুত্রলাভ- সবই তাকে কাতর করে তোল। দাসীত্বের শৃঙ্খলে তার শরীর-যৌবন বাঁধা পড়েছে। তিনি মনে মনে শুধু মুক্তির উপায় খোঁজেন। কী করব, কী করেই বা সেই বারে শৃঙ্খল অতিক্রম করে স্বামী-পুত্র লাভ করা যায় এই ভাবনা শর্মিষ্ঠার কষ্ট বাড়িয়ে তুলল চতুগুণ-কিং প্রাপ্তং কিং নু কর্তব্যং কিং বা কৃত্বা কৃতং ভবেৎ।

চিন্তা করতে করতে মনের মধ্যে যে আকুলতা দেখা দেয়, সেই আকুলতাই যৌবনবতীর মনে সিদ্ধান্তের জন্ম দেয়। সিদ্ধান্ত তৈরি হয় মনের অনুকূলে। যৌবনবতী ভাবে- দাসী তো দাসী। সে তো একটা কথার জালে আটকা পড়েইছি। তাই বলে কি সব বৃথা। আমি কি মানুষ নই। কথা দিয়েছিলাম- দেবযানী যেখানে যাবে, সেখানেই যাব। তা বেশ তো, এসেছি কথা রেখেছি। কিন্তু এমন কথা তো বলিনি যে, বসন্তের ফুল ফুটলে দেখব না, বাতাস দিলে গায়ে মাখব না। আর এদিকে তার স্বামী-সুখে, সংসার-সুখে ছেলে পর্যন্ত হয়ে গেল, আর আমার স্বামী নেই, সংসার নেই, জীবন-যৌবন, রূপ সব বৃথা গেল- দেবযানী প্রজাতাসৌ বৃথাহং প্রাপ্তযৌবনা।

এইসব যুক্তি-তর্ক থেকেই শর্মিষ্ঠার মনে সিদ্ধান্তের জন্ম। তিনি ভাবলেন- দেবযানী যদি নিজের স্বামী নিজে ঠিক করতে পারে, তবে আমিও বা নয় কেন। সে যেমন রাজা যযাতিকে স্বামী হিসেবে বরণ করেছে, আমিও তাকেই স্বামী হিসেবে বরণ করব যথা তয়া বৃতা ভর্তা তথৈবাহং বৃণোমি তে। আমি যদি তার কাছে একটি পুত্র চাই তবে তিনি নিশ্চয় আমাকে বিফল করবেন না– ইতি মে নিশ্চিতা মতিঃ।

 রাজার ব্যাপারে শর্মিষ্ঠা এত নিশ্চিত কেন, তা আমরা বুঝি। সেই উদ্যানবাটিকায় রাজা দেবযানীকে শুধু শর্মিষ্ঠার কথাই জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আর শুধু কথা কেন, শর্মিষ্ঠাকে দেখা অবধি মহারাজ যযাতির মুগ্ধতা দেবযানীরও চক্ষু এড়ায়নি। সন্দিহান ছিলেন বলেই দেবযানীর পিতা শুক্রাচার্য যযাতিকে অত সাবধান করে দিয়েছেন– আপনি এঁকে পুজো করতেও পারেন। মহারাজ! কিন্তু শয্যায় আহবান করবেন না যেন। তারপর এই যযাতির রাজপ্রাসাদে এসেও রাজা যেমন করে অশন-বসনের ব্যবস্থা করেছেন, তাতেও শর্মিষ্ঠার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে, রাজা তাকে বিফল করবেন না নিশ্চয় ইতি মে নিশ্চিতা মতিঃ। শর্মিষ্ঠার এখন শুধু একটাই চিন্তা– রাজা যদি কখনও একবার ওই নির্জন অশোকঘনের দিকে আসেন, তবে শর্মিষ্ঠা তার মনের কথা বলবেন– অপীদানীং স ধর্মাত্মা ইয়ান্মে দর্শনং রহঃ।

মহাভারতের কবি যুবক-যুবতীর ওপর সরল বিশ্বাসে মন্তব্য করেছেন–তারপর রাজাও একদিন নিজের রাজভবন থেকে বেরিয়ে ঈশ্বরেচ্ছায় ওই অশোকবনের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন তস্মিন কালে যদৃচ্ছয়া। সোজা কথায় বলি,- ঈশ্বরেচ্ছা যতই বলবতী হোক, রাজার নিজের ইচ্ছে কিছু কম ছিল না। আমাদের দৃঢ় অনুমান- ওই একদিন নয়, ঈশ্বরেচ্ছায় তিনি প্রায়ই আসতেন অশোকবনের বিজন প্রান্তে। মুগ্ধ হৃদয় জুড়াতে। কথা কিছুই হত না। কিন্তু বহু পূর্বে সেই উদ্যানবাটিকার মধ্যে দুই উদ্ভিগ্ন হৃদয় যুবক-যুবতীর মধ্যে যে নির্বাক দৃষ্টিবিনিময় হয়েছিল, তাতে অশোকবনিকার প্রান্তভূমিতে একজন অপেক্ষা করে বসে থাকলে অন্যজন সেখানে দর্শন দিতে বাধ্য। তাছাড়া দেখা দিতে এলে দেখাটাও হয়ে যায় একই সঙ্গে। ধারণা করতে পারি সেই নির্বাকৃ দৃষ্টি কথনের দিন এখনও হয়তো শেষ হয়নি, কিন্তু আজকের দিনটা অন্যরকম। আজ শর্মিষ্ঠা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তিনি মনের কথা। বলবেন, অতএব ঈশ্বরেচ্ছাতেই হোক অথবা স্বেচ্ছায় মহারাজ যযাতি অশোকবনের উপাত্তে এসে উপস্থিত, যেখানে শর্মিষ্ঠা দুয়ার খুলে বসে আছেন আত্মদানের বাসনা নিয়ে।

 যযাতি এসেছেন এবং একা এসেছেন। ঈশ্বরেচ্ছায় সঙ্গে পাত্রমিত্র কেউ নেই। রাজাকে দেখে শর্মিষ্ঠা ধীর-মধুর হেসে এগিয়ে এলেন রাজার কাছে হাত জোড় করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে প্রত্যুগম্যাঞ্জলিং কৃত্বা শর্মিষ্ঠা চারুহাসিনী। শর্মিষ্ঠা বললেন- বলার মধ্যে ব্যঙ্গ ছিল- শর্মিষ্ঠা বললেন- ভগবান সোম বা ইন্দ্র, বিষ্ণু বা যমের গৃহে অবস্থানরতা একটি রমণীকে যেমন অন্য কোনও পুরুষ দেখতে পায় না, আপনার গৃহের সুরক্ষাও তেমনই- তব বা নাহু গৃহে কঃ স্বিয়ং দ্রষ্ট্রমহতি? ভাবটা এই– এমন নির্জন স্থানে আমাকে রেখেছেন, মহারাজ! যেখানে কোনও পুরুষের সুদৃষ্টি কি কুদৃষ্টি, কোনওটাই আমার ওপর পড়েনি। আর ঠিক সেই কারণেই একটি স্ত্রীলোকের সম্পূর্ণ শুদ্ধতা নিয়ে আপনার কাছে আমি যাচনা করতে পারি। যাচনা করতে পারি আমার স্ত্রীধর্ম রক্ষার জন্য।

শর্মিষ্ঠা পুষ্পবতী হয়েছেন। সেকালের দিনে পুষ্পবতী রমণী যথার্থ সময়ে পুত্রলাভের জন্য যে কোনও পুরুষের সঙ্গে সঙ্গত হতে পারত। এই নিয়ম ছিল প্রায় ধর্মীয়। বৈদিক যুগ থেকে আরম্ভ করে মহাভারত পুরাণের যুগ পর্যন্ত ভারতীয় রমণীর কাছে বহু পুত্রের জননী হওয়াটা ছিল প্রায় আদর্শের মতো হয়তো স্থানান্তর থেকে আর্য পুরুষদের সঙ্গে আসা স্ত্রীলোকের সংখ্যা নগণ্য ছিল এবং হয়তো যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে যেকোনও উপায়ে বীর পুত্র লাভ করাটা তাদের কাছে পরম ইঙ্গিত ছিল। বেদের মধ্যে আর্য-রমণীদের পুত্র-লাভের আকাঙ্ক্ষা বারবার শোনা গেছে। রমণীর কাছে বীরসূ, বীরমাতা বীরপ্রজা হওয়াটা যেমন গর্বের ছিল, তেমনই পুত্রজন্মের অর্থই ছিল পরম কল্যাণ য বৈ পুরুষস্য বিত্তং তদ্ ভদ্রং, গৃহা ভদ্রং প্রজা ভদ্র।

হয়তো এই কল্যাণের মাহাত্ম থেকেই স্ত্রীলোকের দিক থেকে ঋতুকালমাত্রেই যে কোনও পুরুষের কাছে পুত্রলাভের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করাটা অস্বাভাবিক ছিল না। মহাভারত এবং পুরাণে এমন বহু উদাহরণ পাওয়া যাবে, যেখানে রমণী ঋতুর পর্যায় সফল করার জন্য পুরুষের সঙ্গ কামনা করছে। ঋতুরক্ষার তাগিদটা যেহেতু প্রায় ধর্মীয় সংস্কারের মতো হয়ে গিয়েছিল, তাই একজন বুদ্ধিমতী রমণীর পক্ষে এই সময়টাই ছিল অভীষ্টতম পুরুষের সঙ্গে সঙ্গত হওয়ার প্রকৃষ্টতম উপায়। উপায় না বলে তাই এটাকে কৌশল বলাই ভাল, যদিও শর্মিষ্ঠার আমরণ দাসীত্বের নিরিখে শর্মিষ্ঠার দিক থেকে এটাকে আমরা সুযোগ নেওয়া বলব, কৌশল বলব না।

 নির্জন স্থানে আপন অশোক-কুঞ্জে রাজাকে পেয়ে শর্মিষ্ঠা বললেন আমার রূপ নিয়ে আপনার কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়, রাজা! আমার আভিজাত্য এবং চরিত্রও আপনার অজানা নয়- রূপাভিজন-শীলৈ হিঁ ত্বং রাজন্ বে মাং সদা। আমার এখন ধর্মসঙ্কট উপস্থিত। আপনার কাছে আমার সানুনয় প্রার্থনা– আমি পুষ্পবতী, আপনি আমার ঋতুরক্ষা করুন।

 যযাতির মনের মধ্য থেকে এতকালের জমে থাকা উচ্ছ্বাস এক মুহূর্তের মধ্যে বেরিয়ে এল। যযাতি বললেন- তোমার সুন্দর স্বভাবের কথাও জানি, তোমার বংশ এবং মর্যাদার কথাও আমার যথেষ্ট জানা। আর রূপের কথা বলছ? তোমার গায়ে যদি একটা উঁচ বিধিয়ে ছুঁচের আগায় যদি এতটুকু সামান্য অংশ খুঁচিয়ে তুলে আনি, তবে সেই অংশটুকুকেও কোনওভাবে খারাপ বলা যাবে না, আলাদা করে তাকে সুন্দর বলতে হবে, তোমার রূপ এতটাই– রূপঞ্চ তেন পশ্যামি সূচ্যগ্রমপি নিন্দিত।

বোঝা যায়, শর্মিষ্ঠার রূপ এবং অভিজাত্য নিয়ে রাজার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই; রাজার চিন্তা অন্য জায়গায়। শর্মিষ্ঠার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি দেবযানীর কথা ভাবছেন। শর্মিষ্ঠার রূপ-গুণের প্রশংসা করতে করতেই রাজা বলে ফেললেন–সবই বুঝি, শর্মিষ্ঠা। কিন্তু দেবযানীকে বিয়ে করার সময় শুক্রাচার্য বলে দিয়েছিলেন এই বৃষপর্বার মেয়ে শর্মিষ্ঠাকে তুমি যেন কখনও তোমার শয্যাসঙ্গিনী কোরো না। এখন সেই কথার কী করব?

শর্মিষ্ঠা রাজার মুখে নিজের রূপ-লাবণ্যের প্রশংসা শুনে বুঝলেন–রাজার অর্ধেক হৃদয় তিনি পেয়েই গেছেন। তার সামনে বড় বাধা ওই শুক্রাচার্যের একখানি কথা। শর্মিষ্ঠা ভরসা। পেয়ে শাস্ত্রবিধি ছেড়ে লোকাঁচারের বিধি আঁকড়ে ধরলেন। কারণ নীতিশাস্ত্রে বলে– শাস্ত্রবাক্যে কুশল হওয়া সত্ত্বেও যে লোকাঁচার জানে না, সে মূর্খ। শর্মিষ্ঠা বললেন– আপনি এখনও সেই কথা চিন্তা করছেন, মহারাজ! কেন, লোকে ঠাট্টা করার সময়ও তো মিথ্যা-কথা বলে, সে মিথ্যায় পাপ নেই। পছন্দসই রমণীর রূপ-গুণের প্রশংসা করেন পঞ্চমুখে, কতবার বলেন– ভালবাসি। তার মধ্যেও মিথ্যে কথা থাকে। বিয়ের সময় তো লাখ কথা না হলে বিয়ে হয় না, তার মধ্যেও মিথ্যে থাকে। তাছাড়া ধরুন, নিজের প্রাণ নিয়ে টানাটানি হল, অথবা বাড়িতে সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে, তখন যদি মিথ্যে বললে কাজ হয়, তো সবাই মিথ্যেই বলে। আসলে মহারাজ! পাঁচটা জায়গা। পাঁচ জায়গায় মিথ্যে বললে দোষ নেই কোনও পরিহাস, প্রেম, বিয়ে আর সর্বনাশ অথবা প্রাণসংশয় উপস্থিত হলে লোকে যে মিথ্যে কথা বলে তাতে কোনও পাপ লাগে না–পঞ্চানৃতান্যাহুরপাতকানি।

যযাতির গলার স্বর নিচু হল। বললেন–আমি রাজা বটে। রাজারা যা করবেন, প্রজাদের কাছে সেইটাই উদাহরণ হয়ে দাঁড়াবে। আজকে আমি যদি এই কারণে মিথ্যার আশ্রয় নিই, তবে আমার প্রজারাও কাল থেকে মিথ্যার দোষ বুঝবে না। তাই বলছিলাম–মিথ্যে কথাটা বলা বোধহয় ঠিক হবে না আমার পক্ষে।

শর্মিষ্ঠা এবার মোম যুক্তি দিলেন। রাজার পছন্দ এবং সংশয়ের অনেক ওপরে সেই যুক্তি। শর্মিষ্ঠা বললেন নিজের স্বামী এবং সখীর স্বামী– দুজনেই সমান। দুই সখীর বিয়েও সমান। অতএব আমার সখী যাঁকে স্বামিত্বে বরণ করেছে, আমিও তাকে স্বামী হিসেবে বরণ করতে পারি– সমং বিবাহমিত্যা সখ্যা মেসি বৃতঃ পতিঃ।

শর্মিষ্ঠার এই কথাটার মধ্যে একটু বুঝে নেবার ব্যাপার আছে সখীর স্বামীই আমার স্বামী এমন যুক্তি অর্থের সংশয় ঘটায়। এমনটি হলে যে কোনও রমণীর স্বামী, তার বন্ধু বা সখীর। স্বামী বলে পরিগণিত হতে পারতেন। আসল কথাটা অন্য জায়গায়। শর্মিষ্ঠা নিজেকে দেবযানীর দাসী বলে পরিচয় দিতে ভালবাসেন না। দেবযানী এবং শর্মিষ্ঠার মধ্যে যখন ভাব-ভালবাসা ছিল, তখন এরা পরস্পরের সখীই ছিলেন। এমনকি শর্মিষ্ঠার সঙ্গে দেবযানীর যখন চরম ঝগড়া হয়ে গেছে, তখনও কিন্তু রাজার কাছে পরিচয় দেবার সময় দেবযানী বলেছিলেন- এ আমার সখীও বটে, দাসীও বটে- ইয়ঞ্চ মে সখী দাসী। তাছাড়া দেবযানী যখন দুই হাজার দাসীর সঙ্গে সেই উদ্যানবাটিকায় ক্রীড়া-বিনোদন করছিলেন, তখন কিন্তু দাসীদের সখী বলেই অভিহিত করেছেন কবি– তাভিঃ সখীভিঃ সহিতা সর্বাভিমুদিতা ভূশম।

 এই কথাগুলি থেকে পরিষ্কারভাবে শর্মিষ্ঠার যুক্তি ব্যাখ্যা করা যায়। সখী বলতে শর্মিষ্ঠা দাসীই বুঝিয়েছেন। তখনকার দিনে রাজারাজড়ার বিয়ের সময় বিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে যে দাসী বা দাসীরা আসতেন, তারাও বিবাহিতা স্ত্রীর মতোই ভোগ্যা হতেন। পরবর্তী সময়ে আমরা দেবব- ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুর মাতা অম্বিকা এবং অম্বালিকার দাসীর গর্ভে ব্যাসের ঔরসে বিদুরের জন্ম। আবার গান্ধারীর সঙ্গে যে দাসী এসেছিলেন গান্ধারের রাজবাড়ি থেকে তিনিও ধৃতরাষ্ট্রের ভোগ্যা ছিলেন। সেই দাসীর গর্ভে যুযুৎসুর জন্ম।

ব্যাপারটা এই নিরিখে দেখলে বোঝা যাবে যে, সখীর স্বামী আর দাসীর স্বামী একই হতেন। দাসীরা যেহেতু নিজেরা বিবাহ করার অধিকার বা সুবিধা কোনওটাই পেতেন না, কাজেই দাসীদের যৌবন সফল করতে হত তাদের মালিকানীর স্বামীদের মাধ্যমেই। মালিকানীরাও এতে আপত্তির কিছু দেখতেন না, বরং স্বামীরা অতিরিক্ত ভোগপরায়ণ হলে,এই ব্যবস্থায় মালিকানীদের সুবিধেই হত। দেবযানীর ব্যাপারটা আলাদা। তিনি শর্মিষ্ঠার ওপর এতটাই রেগে ছিলেন যে কোনওভাবে শর্মিষ্ঠার সুখ হোক, এ তিনি চাইতেন না। উপরন্তু দাসীদের যেহেতু রাজভাৰ্যাত্ব স্বীকৃত সত্য ছিল, অতএব জেনেবুঝেই শুক্রাচার্য যযাতিকে শর্মিষ্ঠার ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছিলেন।

আজকে শর্মিষ্ঠা রাজার বিবাহিতা পত্নী এবং পত্নীর দাসীর মধ্যে সমতার যুক্তি এনে যযাতিকে একেবারে বিচলিত করে দিলেন। বিচলিত না বলে বিগলিতই বলা উচিত। কেননা যযাতি বললেন- যে প্রার্থনা করছে, তাকেই দান করব- এ হল আমার ব্রত। তুমি আমার সঙ্গ কামনা করছ, সেটা কীভাবে সম্ভব তুমিই বলো- তঞ্চ যাচসি মাং কামং হি কিং করণি তে।

.

৩৯.

 মহারাজ যযাতি শর্মিষ্ঠার আশা পূরণ করার জন্য সেই মুহূর্তে মনে মনে দেবযানীকে অতিক্রম করলেন। অতিক্রম করার কারণও ছিল। যযাতির হৃদয় সামান্য বিগলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শর্মিষ্ঠা নিজের দাসীত্বের যন্ত্রণাটুকু বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলেন। শর্মিষ্ঠা বলেছিলেন মহারাজ। আপনি তো জানেন–দাস-দাসী, পুত্র এবং স্ত্রীলোক–এরা নিজের চেষ্টায় যে অর্থ উপার্জন করে, সেই অর্থ পর্যন্ত তার নিজের নয়, সে অর্থও তার মালিকের–য় এবাধনা রাজন্ ভার‍্যা দাসস্তথা সুতঃ।

শর্মিষ্ঠার হাহাকারে সেকালের স্ত্রীলোক এবং ক্রীতদাসের করুণ অবস্থাটা বোঝা যায়। বোঝ যায়, এই যুগে স্ত্রীলোক এবং ক্রীতদাসের কোনও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছিল না। পুত্র-সন্তানেরা যে অর্থ উপার্জন করত, সে অর্থেরও মালিক হতেন তার পিতা, ঠিক যেমন একটি স্ত্রীর উপার্জন চলে যেত তার স্বামীর হাতে এবং ক্রীতদাসের উপার্জন তার প্রভুর হাতে। শর্মিষ্ঠা বললেন–আমি তো দেবযানীর দাসী আর অন্যদিকে দেবযানী হলেন আপনার অধীনা। কাজেই মহারাজ! দেবযানী যেমন আপনার ভোগ্যা, তেমনই তার দাসীও আপনারই ভোগ্যাসা চাহঞ্চ ত্বয়া রাজন্ ভজনীয়াং ভজস্ব মাম।

শর্মিষ্ঠার কথা মহারাজ যযাতির কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হল। যযাতি শর্মিষ্ঠার সঙ্গে মিলিত হলেন। মনে মনে এই মিলন তার কাম্য ছিল। হয়তো যেদিন তিনি শর্মিষ্ঠাকে দেখেছিলেন, সেদিন থেকেই এই মিলন তার কাম্য ছিল। দেবযানী এবং শুক্রাচার্যের সাবধানবাণীতে এতদিন যে মিলন বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ছিল, আজ শর্মিষ্ঠার যুক্তিতে এবং যযাতির মনের অনুকূলতায় সেই মিলন বাঁধভাঙা নদীর মতো আছড়ে পড়ল অশোক-বনের উপান্ত-শয্যায়। মিলন সম্পূর্ণ হলে দুজনেই পরস্পরকে সানন্দে কৃতজ্ঞতা জানালেন, তারপর যে যেখানে ছিলেন চলে গেলেন সেইখানে–অনন্যান্যঞ্চাভিসম্পূজ্য জগ্মতুস্তৌ যথাগতম্।

শর্মিষ্ঠা চারুহাসিনী যযাতির ঔরসে প্রথম পুত্র লাভ করলেন যথাসময়ে এবং তৎক্ষণাৎ সে খবর দেবযানীর কাছে পৌঁছল। স্বামী-সুখে, পুত্ৰসুখে যার কথা প্রায় খেয়ালই ছিল না, দেব্যানী সেই শর্মিষ্ঠার ক্ষুদ্র গৃহে নেমে এলেন সশঙ্কিত চিত্তে, নিজের গরজে চলে এলেন; এলেনও বড় তাড়াহুড়ো করে। ঘরে ঢুকেই তার প্রশ্ন–এ সব কী শুনছি পাপের কথা, শরীর পুড়ছে বুঝি? কার সঙ্গে রঙ্গ করে এই পাপ জোটালি কোথা থেকে–কিমিদং বৃজিনং সুস্র কৃতং বৈ কামলুব্ধয়া।

শর্মিষ্ঠা বললেন কিসের পাপ! এক ধার্মিক বেদজ্ঞ ঋষি এসেছিলেন আমার কাছে। তিনি বর দিতে চাইলে আমি তার সঙ্গে মিলন প্রার্থনা করি। সেই ঋষি-ঔরসেই আমার এই পুত্রের জন্ম। এর মধ্যে কাম-চরিতার্থতারই বা কী আছে, অন্যায়ই বা কী আছে?

শর্মিষ্ঠা দেবযানীকে তার কথাই ফিরিয়ে দিয়েছেন। দেবযানীই একসময় নিজের বিয়ের স্বার্থে মহারাজ যযাতিকে ঋষি অথবা ঋষিপুত্র প্রমাণ করে ছেড়েছিলেন। পিতা বৃষপর্বার সেই উদ্যানবাটিকার মধ্যে দেবযানী এবং যযাতির সম্পূর্ণ কথোপকথনের সাক্ষী ছিলেন নির্বাক শর্মিষ্ঠা। আজকে সুযোগ পেয়ে সেই কথাটাই তিনি অন্যভাবে শুনিয়ে দিলেন দেবানীকে। কোনও মিথ্যা নেই এর মধ্যে–তুমি যাকে ঋষি ভেবেছ আমিও তাকে ঋষি ভেবেছি—এই বিচার।

শর্মিষ্ঠার কথা শুনে দেবযানী বললেন–তা বেশ, তা বেশ–শোভনং ভীরু যদ্যেব–যদি এইরকমই হয়ে থাকে, তাহলে কিছুই বলার নেই আমার। তবে কিনা ব্রাহ্মণ-ঋষির কথা বলছিস, তা তার নাম, গোত্র, বংশের কথা বল না একটু, যদি চিনতে পারি। শর্মিষ্ঠা সলজ্জে বললেন–তখন কি আর ওই সব কথা মনে থাকে নাকি? কী তার সূয্যিপানা চেহারা। কী তার তেজ। অমন তেজি পুরুষ দেখে নায়, গোত্র-ওসব সাধারণ কথা আর জিজ্ঞাসা করার শক্তি হল না আমার–তং দৃষ্টা মম সংগ্রইং শক্তি নাসীছুচিস্মিতে।

দেবযানী বললেন–যাগ যে যাক, সে ঠিক আছে বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ বলে কথা। তুই যদি একজন ব্রাহ্মণ ঋষির কাছ থেকে সন্তান লাভ করে থাকি, তাহলে জেনে রাখিস-কোনও রাগ নেই আমারন মনুর্বিদ্যতে মম।

 অনেক দিন পর দেবযানীর সঙ্গে শর্মিষ্ঠার দেখা হল। রাগ নিয়ে এসেছিলেন দেবযানী, রাগও গলে জল হয়ে গেল। এতদিন পর দেখা, দুজনে পূর্বধিত্ব ফিরে পেলেন যেন। আলাপে, হাসিতে ঠাট্টায় বেশ খানিকক্ষণ কেটেও গেল–অনন্যান্যমেবকা তু সম্প্রহস্য চ তে মিথঃ। দেবযানী শর্মিষ্ঠার কথা সত্য মনে করেই চলে গেলেন, কথাটার দ্ব্যর্থচিন্তা তার মনেও এল না।

তারপর বহুদিন চলে গেছে। বহু দিন। শর্মিষ্ঠার কথা দেবযানীর খেয়ালও হয়নি। এর মধ্যে দেবযানীর আরও একটি পুত্রও হয়ে গেছে। তার বড় ছেলের নাম যদু, ছোট ছেলের নাম তুর্বসু। সেদিন দেবযানী ছেলেদের বাড়িতে রেখে বেড়াতে বেরিয়েছেন রাজার সঙ্গে। কর্মক্লান্ত রাজার আজ সময় হয়েছে। দেবযানীর ইচ্ছে হল রাজার সঙ্গে নিভৃতে বিস্তালাপ করবেন। ঘুরতে ঘুরতে সেই অশোকবনের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন দেবযানী। জায়গাটা এমনিতে নির্জন; অশোকবনিকার প্রান্তদেশে শর্মিষ্ঠার বাড়ি। বনের পথ ধরে একটু এগোতেই দেবযানী দেখলেন–তিনটি অল্পবয়সী বালক পরস্পর খেলা করছে। তাদের চেহারা ভারি মিষ্টি এবং তারা যেভাবে খেলা করছে, তাতে একবারও মনে হচ্ছে না যে, তারা এই জায়গায় অন্য সময় খেলে না। রাজোদ্যানের এই প্রান্তে বালকদের এই একান্ত বিশ্বস্ত এবং অভ্যস্ত খেলাধুলো দেবযানীকে একটু অবাকই করে দিল।

দেবযানী পাশে দাঁড়ানো যযাতিকে বললেন–কী সুন্দর দেখতে ছেলেগুলো? দেখ দেখ, কেমন দেবতার মতো সুন্দর! আচ্ছা, এরা কার ছেলে? মুখগুলো তো দেখে মনে হচ্ছে যেন তোমার মুখ বসানো-বসা রূপতশ্চৈব সদৃশা মে মতাস্তব। দেবযানী যযাতিকে কোনও কথা বলতে দিলেন না, কথা শুনতেও চাইলেন না। তিনি সোজাসুজি খেলায় মেতে ওঠা ছেলেগুলিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন-বাছারা! তোমাদের বাবার নাম কী? কোন বংশেই বা তোমাদের জন্ম? ছেলেরা তর্জনী তুলে নিশূপে দাঁড়ানো যযাতির দিকে প্রথমে দেখিয়ে দিল। বলল–এই আমাদের বাবা। তারপর দুরে দাঁড়ানো শর্মিষ্ঠার দিকে অঙ্গুলিসঙ্কেত করে ছেলেরা। বলল–আর ওই হল আমাদের মা।

 চরম অস্বস্তি নিয়ে যযাতি দাঁড়িয়ে রইলেন এবং সেই অস্বস্তি দ্বিগুণ করে দিয়ে শর্মিষ্ঠার ছেলেরা সবাই মিলে তাদের পিতা যযাতিকে জড়িয়ে ধরতে চাইল-রাজানমুপচক্রঃ। দেবযানীর সামনে শর্মিষ্ঠার ছেলেরা তাকে এতই বিপদে ফেলল এবং এই বিপদ আরও বাড়বে–এই আশঙ্কায় যযাতি আর শর্মিষ্ঠার ছেলেদের তেমন আমল দিলেন নানাভ্যনন্দত তা রাজা দেবান্যাস্তদন্তিকে। প্রত্যালিঙ্গন তো করলেনই না, উপরন্তু ভাব দেখালেন যেন এই ছেলেগুলি তার ছেলেই নয়। শর্মিষ্ঠার পুত্রেরা পিতার কাছে কখনও এই ব্যবহার পায়নি। পিতার আকস্মিক এই পরিবর্তন দেখে ছেলেরা কাঁদতে কাঁদতে শর্মিষ্ঠার কাছে গেল। ছেলেদের কান্না শুনে রাজারও মন খারাপ হল, একটু লজ্জাও হল–সব্ৰীড় ইব পার্থিবঃ।

দেবযানী ক্ষণিকের মধ্যেই বুঝে গেলেন–অনেক নাটক হয়ে গেছে অশোক বনের অন্তরালে। একটি নয়, দুটি নয় শর্মিষ্ঠা যযাতির ঔরসে অন্তত তিনটি পুত্র লাভ করেছেন। দেবযানী ক্রোধে অধীর হয়ে শর্মিষ্ঠাকে বললেন–তুই আমারই অধীনে দাসীর কাজ করে আমারই সর্বনাশ করছিস। আমাকে কি তোর ভয় নেই একটুও? অবশ্য অন্যায় করতে তোর ভয় হবে কী করে? তুই অসুরঘরের মেয়ে। এখনও তোর অসুরের স্বভাব যায়নি তমেবাসুরধর্মং ত্বমাস্থিতা ন বিভেষি মে।

গালাগালি খেয়েও শর্মিষ্ঠা খুব বেশি অপ্রস্তুত হলেন না। তিনি বুঝলেন- যে কোনও সময় দেবযানীর মুখোমুখি দাঁড়াতেই হত। কেননা, যদি শুধু ঋতুরক্ষার ধর্মেই ঘটনাটা শেষ হত, তাহলে শর্মিষ্ঠার প্রথম পুত্রের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই রাজসংসর্গের অবসান ঘটত। কিন্তু আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস–রাজা শর্মিষ্ঠাকে ভালবাসতেন এবং শর্মিষ্ঠাও রাজাকে ভালবাসতেন ততোধিক। উপরন্তু দেবযানীর সদাজাগ্রত রক্তচক্ষুর অন্তরালে যযাতি এবং শর্মিষ্ঠার এই যে ‘চৌর্যমিলন’ আরম্ভ হয়েছিল, তার সুখ এবং আনন্দ যে দেবযানীর শুদ্ধ দাম্পত্যের দৈনন্দিনতার চেয়ে অনেক অনেক বেশি, তার প্রমাণ দিয়ে রেখেছেন আলঙ্কারিকেরা। অশোকবনিকার কুঞ্জভবনে শর্মিষ্ঠার সঙ্গে ‘চৌর্যসুরত-ব্যাপার-লীলাবিধির ব্রত-নিয়ম পালন করে যযাতি ইতিমধ্যে তিনটি সন্তানের জনক হয়েছেন। দ্রুহ্য, অনু এবং কনিষ্ঠ পুরু–শর্মিষ্ঠার গর্ভে এই তিন পুত্র। তারা কেউই এখন আর খুব ছেলেমানুষও নয়, প্রায় যুবক। প্রিয় পুত্রদের জনক কে–এ কথা আসবেই এবং সে প্রশ্ন অবধারিতভাবে দেবযানীর কাছ থেকেই আসবে– এ কথা শর্মিষ্ঠা জানতেন বলেই আজ তিনি স্পষ্টতই দেবযানীর মুখোমুখি হতে চাইলেন।

শর্মিষ্ঠা বললেন–আমি যে সেই ‘ঋষির কথা বলেছিলাম, সেটা তো ঠিকই আছে, আমি তো তাকে ঋষিই মনে করি–যদুক্তং ঋষিরিত্যব তৎ সত্যং চারুহাসিনি। যযাতির সম্বন্ধে দেবযানীর পূর্বকল্পিত সেই ঋষি-সম্ভ্রম শর্মিষ্ঠা আবারও ফিরিয়ে দিলেন। শর্মিষ্ঠা আরও বললেন-তোমাকে আমার অত ভয় পাবার কীই বা আছে বল? আমি তো অন্যায় কিছু করিনি। ধর্ম থেকেও চ্যুত হইনি একটুও। কারণ, আমার দাসীত্বের নিরিখে এটাই আমার ধর্ম। আমার মালিকানীর স্বামী, আমারও স্বামী। তুমি আমার পূজনীয়, মাননীয় যাই হও, কিন্তু স্বামী হিসেবে রাজর্ষি যাতি যে আমার কাছে তোমার থেকেও পূজনীয়, সেটা কি তুমি জান না–ত্বত্তোপি মে পুজতমো রাজর্ষিঃ কিং ন বেথ তৎ?

দেবযানী বুঝলেন–শর্মিষ্ঠার সঙ্গে আর একটি কথাও বলে লাভ নেই। তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল যযাতির ওপর। আর রাগ হলে তার একটাই কথা–আর এক মুহূর্তও এখানে থাকব না, ঠিক যেমন পূর্বে শর্মিষ্ঠার সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার সময়েও তিনি পিতা শুক্রাচার্যকে একই কথা বলেছিলেন–এই নগরে আর থাকব না। দেবযানী যযাতিকে বললেন-মহারাজ! আপনি যা করেছেন তা আমার ভীষণ ভীষণ অপছন্দ, আজ থেকে আর আমি এখানে থাকব না–রাজন্ নাদ্যেহ বৎস্যামি বিপ্রিয়ং মে কৃতং ত্বয়া।

কথাটা বলেই দেবযানী সেখান থেকে উঠে পড়লেন। দেবযানীর সুন্দর মুখমণ্ডল এক লহমায় যেন কালি হয়ে গেল। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রুর ধারা। তিনি শুক্রাচার্যের বাড়ির দিকে রওনা হলেন। বেগতিক দেখে উদ্বিগ্ন ভয়াকুল রাজা দেবযানীকে বোঝাতে বোঝতে তার পিছন পিছন চললেন। কিন্তু দেবযানী রাজার মধুর সান্ত্বনাবাক্যে একটুও বিগলিত হলেন না, ফিরেও এলেন না।

দেবযানী আগে এবং যযাতি পরে এসে উপস্থিত হলেন শুক্রাচার্যের সামনে। প্রণাম, অভিবাদন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেবযানী নালিশ জানালেন পিতার কাছে–আজ অধর্ম ধর্মকে দূরে ঠেলে ফেলেছে, পিতা! নীচ উঠে এসেছে ওপরে। বৃষপর্বার মেয়ে শর্মিষ্ঠা আজ আমাকে অতিক্রম করেছে। দেবযানী শর্মিষ্ঠার কথা বেশি বললেন না। কারণ, দোষ তার নিজের ঘরের মধ্যে। তিনি যযাতিকে দেখিয়ে বললেন–ইনি শর্মিষ্ঠার গর্ভে তিনটি পুত্রের জন্ম দিয়েছেন, আর আমি দুর্ভাগা, আমার গর্ভে দুটি। লোকে মহারাজ যযাতিকে ধর্মজ্ঞ বলে সম্মান করে। আর এই তার ধর্মের নমুনা। আমার মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন এই রাজা–অতিক্রান্তশ্চ মর্যাদাং কাব্যৈতৎ কথয়ামি তে।

দেবযানীর কথার সারমর্ম–তার গর্ভে দুটি পুত্র, আর শর্মিষ্ঠার গর্ভে তিনটি পুত্র। আর দ্বিতীয় অনুযোগ–দেবযানীর সম্মান অতিক্রম। মজা হল–এই অনুযোগ যদি তিনি রাজার কাছে সোজাসুজি করতেন, তবে রাজার পক্ষে দুটির জায়গায় পাঁচটি সন্তান দিতেও অসুবিধে ছিল না। কিন্তু গোলমালটা নিশ্চয়ই এখানে নয়, আরও গভীরে। দেবযানীর সেই সাহংকৃত বোধ আমাকে অতিক্রম করা চলবে না। মহাভারতের টীকাকার আসল কথাটা ধরে দেবযানীর মনের ভাবটুকু বলে দিয়েছেন। দেবযানীর ভাব-আমি হলাম গিয়ে ব্রাহ্মণ ঋষি শুক্রাচার্যের মেয়ে। সেই বামুনের মেয়েকে অতিক্রম করে অসুরের মেয়ে শর্মিষ্ঠার ওপর এতটাই রাজার দরদ যে তার গর্ভে তৃতীয় একটি পুত্রের জনক হতেও তার বাধেনি ব্রাহ্মণদুহিতুঃ প্রাধান্যে কর্তব্যে অসুরদুহিতুঃ প্রাধান্যকরণা-মর্যাদামতিক্রান্ত। অর্থাৎ দেবযানীর শর্মিষ্ঠার সঙ্গে সমতাও নয়, তার চেয়ে অধিক প্রাধান্য চাই।

অসুরদুহিতা শর্মিষ্ঠার ওপর শুধু দরদ কেন, ভালবাসাও যে রাজার বেশি ছিল, সেটা বলাই বাহুল্য। দিনের পর দিন দেবযানীর সম্মান এবং মর্যাদা সামলাতে সামলাতে রাজা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। মহারাজ যযাতি যতই রাজার আধিপত্যে থাকুন, প্রথম থেকেই তিনি এই উচ্চবর্ণের ঋষিকন্যাটিকে ঘরে আনতে কুণ্ঠিত ছিলেন। তাও যদি বা দেবযানীর সাময়িক চাটুবাক্যে ভুলে তিনি বিবাহে সম্মত হয়েছিলেন, কিন্তু রাজার ঘরে এসে ইস্তক দেবযানী কখনই ভুলতে পারেননি যে, তিনি ব্রাহ্মণ শুক্রাচার্যের মেয়ে। দিন-রাত এই ব্রাহ্মণ্যের মূল্য দিতে দিতে মহারাজ যযাতি রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন অশোকবনের প্রান্তে, শর্মিষ্ঠার কাছে।

 প্রথম দর্শনেই যাকে ভাল লেগেছিল, সেই শর্মিষ্ঠার কাছে তিনি মনের মুক্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। ফলত শর্মিষ্ঠার সঙ্গ তার কাছে দিন দিন কাম্য থেকে কাম্যতর হচ্ছিল। একাদিক্রমে তিনটি পুত্রের জন্ম শর্মিষ্ঠার সঙ্গে রাজার অধিক ঘনিষ্ঠতাই প্রমাণ করে। ভালবাসা তো আর বংশ-কুল মনে হয় না, আর তাই অসুরকন্যার সম্ভ্রমে, লালনে শুশ্রূষায় যযাতির ভালবাসা পুষ্টিলাভ করেছিল। এই ভালবাসার কথা মহাভারতের কবি অতি স্পষ্ট করে স্বকণ্ঠে না বললেও পরবর্তী কালের মহাকবিদের তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। কালিদাসের মতো ঋষি মহর্ষি কষের মুখ দিয়ে শকুন্তলার প্রতি আশীর্বাদজ্ঞাপন করেছেন যাতেরিব শর্মিষ্ঠা ভর্তুবহুমতা ভব–তুমি তোমার স্বামীর কাছে এতটাই প্রার্থনীয়া হও, যেমনটি শর্মিষ্ঠা ছিলেন যযাতির কাছে।

 দেবযানীর কাছে এই ভালবাসার মূল্য নেই। তিনি তার ব্রাহ্মণ্যে উৎসিক্ত হৃদয় দিয়ে ব্রাহ্মণ পিতার কাছে যযাতির বিচার চাইলেন, মর্যাদা অতিক্রমের বিচার। বিচার পেলেন। শুক্রাচার্য কার্যাকার্য বিবেচনা না করে, কন্যার ওপর সমস্ত প্রশ্রয় ঢেলে দিয়ে যাতিকে অভিশাপ দিলেন–তুমি ধর্মজ্ঞ হয়েও যে অধর্ম করেছ, তার ফলে বার্ধক্যের চিহ্ন জরা বিস্তার লাভ। করবে তোমার সমস্ত শরীরে–তস্মাজ্জরা ত্বামচিরাদ্ধষয়িষ্যতি দুর্জয়া। যযাতি অনেক বোঝনোর চেষ্টা করলেন শুক্রাচার্যকে। শর্মিষ্ঠার ঋতুকাল, তার পুত্রকামনা, তার দাসীত্ব, এবং সর্বোপরি যাচকের প্রতি করুণার ধর্ম–সব এক এক করে বোঝানোর চেষ্টা করেও বিফল হলেন যযাতি। শুক্রাচার্যের মতে যযাতি ধর্মের নামে যেমন যুক্তি দেখাচ্ছেন, সে সব আসলে চালাকি ছাড়া কিছুই নয় এবং এই চালাকির সঙ্গে তুলনা হয় শুধু চুরি করার অপরাধের মিথ্যাচারস্য ধর্মেষু চৌর্যং ভবতি নাহুষ।

যযাতির কোনও যুক্তি শুক্রাচার্যের কাছে টিকল না। শুক্রের অভিশাপে তৎক্ষণাৎ জরা তার অকাল-বার্ধক্য বয়ে নিয়ে এল। যযাতি দেখলেন–নিজের নয়, নিজের স্বার্থ নয়, একমাত্র দেবযানীর স্বার্থের কথা বললেই শুক্রাচার্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি হতে পারে। যযাতি শুক্রাচার্যকে বললেন-মুনিবর। আপনার কন্যা দেবযানীর সঙ্গে সম্ভোগ সুখের বাসনা এখনও শেষ হয়নি আমার। আপনি অনুগ্রহ করুন, যাতে এই সাঙ্ঘাতিক জরা আমার শরীরে প্রকট না। হয়। শুক্রাচার্য বললেন–জরা তোমার শরীরে আসবেই। তবে একটাই সুযোগ আছে–তুমি তোমার জরা অন্যের শরীরে সংক্রমণ করতে পারবে।

 যযাতি বললেন–তাহলে এমন হয় না মুনিবর। যে পুত্র আমাকে আমার যৌবন ফিরিয়ে দেবে, পুণ্যবান, কীর্তিমান আমার সেই পুত্রই ভবিষ্যতে লাভ করবে আমার রাজ্যের উত্তরাধিকার। আপনি অনুমতি দিন। শুক্রাচার্য স্বীকার করে নিলেন রাজার প্রার্থনা। বস্তুত রাজার এই প্রার্থনার মধ্যেই যযাতির রাজনৈতিক পরিশীলন লুকিয়ে ছিল। এতদিনে তিনি তার সব পুত্রকেই ভালভাবে চিনেছেন। তাদের ভাব-সাব, মতিগতি–সব কিছুর ব্যাপারেই তার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। দেবযানীর স্বার্থ চিন্তা করে শুক্রাচার্য তার জামাতাকে জরা-সংক্রমণের অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু রাজা আপন যৌবন ফিরে পাবার উপকার যে পুত্রের কাছে পাবেন, তইে রাজ্যের উত্তরাধিকার দিয়ে প্রত্যুপকার করতে চান রাজা। এখন পরে যদি প্রশ্ন আসে–তুমি দেবযানীর পুত্রদের কাউকে রাজ্য দাওনি কেন? যযাতি সেই প্রশ্নের মীমাংসার ভার নিজের হাতেই রেখে দিলেন। যে তার জরা গ্রহণে সম্মত হবে, রাজা তাকেই রাজ্য দেবেন। শুক্রাচার্যের সম্মতি সেখানে আগে থেকেই জানা রইল।

যযাতি শুক্রাচার্যের কাছে বিদায় নিয়ে প্রতিষ্ঠানপুরের রাজধানীতে ফিরে এলেন অকাল-বার্ধক্য নিয়ে। স্বামীর ওপর রাগে দেবানী যযাতির যে ক্ষতিটুকু করলেন, তাতে যে তার নিজেরই বেশি ক্ষতি হল–সেই চেতনা তার ছিল না। দেবযানী ফিরলেন এক পককেশ শিথিলচর্ম বৃদ্ধ যযাতির সঙ্গে। বৃষপর্বার রাজোদ্যানের কূপগর্ত থেকে যে রমণীকে তিনি উদ্ধার করেছিলেন, সেই রমণী বাস্তবে অগ্নিপুঞ্জ ছাড়া কিছুই নয়। যযাতি পতঙ্গবৎ সেই আগুনে জ্বলে মরলেন। দেবযানী শুধু শর্মিষ্ঠাকে দাসী বানাননি, তিনি যযাতিকেও দাসে পরিণত করেছিলেন। দেবযানীকে বিবাহ করলে এই দাসত্ব যে আসবে–যযাতি সেই কথাই দেবযানীকে বারবার। বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন প্রথমে। ক্ষত্রিয় হয়ে ব্রাহ্মণকন্যাকে বিবাহ করলে, সেই ব্রাহ্মণকন্যার চির-স্ফীত ব্রাহ্মণ্যচেতনা যে তাকে পদে পদে জর্জরিত করবে, সে কথা যযাতি আগেই বুঝেছিলেন। কিন্তু এই কথোপকথনের মধ্যে শুক্রাচার্য এসে যাওয়ায় তিনি নিরুপায় হয়ে দেবযানীকে বহন করেছিলেন। অতি পরিচিত বিবাহ শব্দটা যে এমন গদ্যজাতীয় বহনে পরিণত হবে–এ কথা বোধ করি যযাতি বুঝেছিলেন। ভারি আশ্চর্য, দেবযানীর সঙ্গে যযাতির প্রথম বিবাহ প্রসঙ্গে যখন দেবযানী আর যযাতির উতোর-চাপান চলছে, তখন মহাভারতের কবিও ‘বি’ উপসর্গ বাদ দিয়ে শুধু বহন’ শব্দটাই বারবার প্রয়োগ করেছেন। অর্থাৎ তিনিও বুঝেছেন–এটা যতখানি বিবাহ, তার চেয়ে বেশি বয়ে নিয়ে চলা।

যযাতি দেবযানীর চাপে বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিলেন। শর্মিষ্ঠার সঙ্গে তিনিও যে পরিণত হয়েছিলেন দেবযানীর দাসে–একথার সত্যতা প্রতিপন্ন হয় শুক্রাচার্যের সঙ্গে যযাতির কথোপকথনে। শর্মিষ্ঠার সঙ্গে কেন তিনি মিলন সম্পূর্ণ করেছেন–এই কথা যযাতি যখন প্রাণপণে শুক্রাচার্যকে বোঝনোর চেষ্টা করেছেন, তখন শুক্রাচার্য যযাতিকে বলেছিলেন-তুমি কি আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন বোধ করলে না? তুমি কি জান না–তুমি আমার অধীন–নহং প্রত্যবেক্ষ্যস্তে মদধীনোসি পার্থিব। বিশাল ক্ষমতাশালী একটি মাত্র কন্যার পিতাদের আমরা একালেও দেখেছি। তাদের সকলের কথা বলছি না, কিন্তু সেই রকম অনেক পিতার মধ্যেই জামাতাকে গ্রাস করার যে প্রবৃত্তি থাকে, শুক্রাচার্যের মধ্যে সেই প্রবৃত্তি ছিল, অবশ্য তা ছিল দেবযানীর কারণেই। এই বিবাহের প্রাক্ বা প্রথম অবস্থায় দেবযানী বা শুক্রাচার্যের দিক থেকে যত স্তুতিবাক্য বা যত ভরসাই দেওয়া হোক, নিজের প্রখর রাজনৈতিক বুদ্ধিতে য্যাতি বুঝেছিলেন-তিনি কার্যত দাসে পরিণত হয়েছেন। এই দাসত্বের মুক্তি অন্যভাবে সম্ভব হয়নি, সেই মুক্তি ঘটেছে অন্যতরা এক দাসীর সঙ্গে গোপন মিলনে। যযাতির অন্তর থেকে হাহাকার বেরিয়ে এসেছে অশোকবনিকার অন্তরালে–আমি যত ভার জমিয়ে তুলেছি সকলি হয়েছে বোঝা।/এ বোঝ আমার নামাও বন্ধু, নামাও।

কিন্তু শুক্রাচার্য যত বড় ব্রাহ্মণই হোন, অথবা দেবযানী যত বড়ই ব্রাহ্মণকন্যা, তারা যাতির রাজনৈতিক বুদ্ধির কাছে হার মেনেছেন। যযাতি সেই প্রথম থেকেই বুঝেছেন যে তিনি এক অভিশাপ-প্রবণ ব্রাহ্মণ-ঋষির কন্যাকে বিবাহ করে দাসে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু সেই দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবার জন্য একদিকে যেমন তিনি শর্মিষ্ঠার সঙ্গে মিলিত হয়ে অন্তরের মুক্তি খুঁজেছেন, যদিও আমাদের মনে হয়–এ মিলন একান্তই ইচ্ছাকৃত, তেমনই অন্যদিকে শুক্রাচার্যের কথার পৃষ্ঠে অনুকূল কথা বলেই তিনি নিজের বংশধরকেও মুক্ত করেছেন শুক্রাচার্য এবং দেবযানীর ব্রাহ্মণ্যের কবল থেকে। নিজের অভিজ্ঞতায় যযাতি তার সন্তানদের নাড়িনক্ষত্র জানতেন। ফলে কে তার জরাগ্রহণে সম্মত হবেন–সে কথা তার পূর্বাহ্নেই জানা ছিল। কিন্তু শুক্রাচার্য এবং দেবযানীর সামনে–সাধারণ এবং নৈর্ব্যক্তিকভাবে দেবযানীর পুত্রদেরও (জরা-গ্রহণের পরিবর্ত উপকার হিসাবে) রাজ্যপ্রাপ্তির সম্ভাবনা জিইয়ে রেখে এবং তাতে পূর্বাহ্নেই শুক্রাচার্যের অনুমতি গ্রহণ করে রেখে যযাতি তার সারা জীবনের রক্তচাপ থেকে উদ্ধার পেলেন, অপিচ রাজনৈতিকভাবে শুক্রাচার্য এবং দেবযানীকে হারিয়েও দিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *