আখড়ানামা
লোককবি বিজয় সরকারের একশো এগারোতম জন্মোৎসবে যোগ দিতে কেউটিয়া এসেছিলেন লালনশাহি সাধক, বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি-চিন্তক ও বাংলার ভাবান্দোলন নিয়ে সব সময় কর্মনিবিষ্টতার মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে রাখা ফরহাদ মজহার। যদিও অনুষ্ঠানের দিন আমি কেউটিয়া থাকতে পারিনি। আমাকে চলে যেতে হয়েছিল একচক্ৰায় নিত্যানন্দ প্রভুর জন্মস্থানে জন্মতিথির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। তার আগের দিন হঠাৎ করে ঘনিয়ে আসা নিম্নচাপের ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গিয়েছিলাম কেউটিয়া। মজহারের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারিনি। দিন তিনেক আগে অবশ্য তিনি ঘোষপাড়ায় এসেছিলেন সতী মা’র ঘর দেখবার বাসনা নিয়ে। সে রাত্রেই তাকে সমস্ত ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি। ঘোষপাড়ার বাউলদেরও সঙ্গ করিয়েছি। সে রাত্রেই ফাকে কথা উঠেছিল তন্ত্র নিয়ে। মজহার শুনেছেন আমার তন্ত্রচর্চার সরেজমিন গবেষণার কথা। কলকাতা এসে জোগাড় করে নিয়েছেন ‘ভৈরব ভৈরবীর সঙ্গে তন্ত্র জিজ্ঞাসায়’। কিন্তু নিজস্ব সেমিনার, অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত থাকার দরুন পাতা উলটানোরও ফুরসত পাননি। কেউটিয়ায় লজের নিরালায় বিজয়ের জন্মোৎসবের আগের দুপুর আমার সঙ্গে একান্তে আড্ডায়, আলোচনায় কাটাবেন বলেই তিনি আমাকে নিমন্ত্রণ করেছেন। দুপুরে ঘি-পুরি, মটর-পনির, টক দই দিয়ে আহারের পর আমরা সেই বৃষ্টিস্নাত দুপুরে ঘুরে বেড়িয়েছি লোকায়ত সাধনপথে। মজহার নিজে যেহেতু সাধক, তাই তার লালনচর্চার বোধ ও বোধি এক ভিন্নমাত্রা যোগ করে। লোকায়ত সাধনা মৌখিক ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে বিশ্বাসী। গুরু সেখানে বন্ধনটিকে শুরু করেন। মনে পড়ছে আসাননগরে, লালন মেলায় প্রবীণ লোকায়ত সাধক ত্রিভঙ্গ খ্যাপা আমাকে বলেছিলেন, ‘গুরু ধরো, গুরু। গুরু না হলে এ পথ যে তোমার শুরুই হবে না বাবা।’ লোকায়ত পথ করণে বিশ্বাসী। আর সেই করণক্রিয়ার মূল আধারই হল গিয়ে ‘গুরু পূচ্ছিঅ জান’। গুরুকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও। মজহার বলছিলেন জিজ্ঞাসার সেই ধারাক্রমেই আমাদের গণ্ডগোলটা বেধেছে। আমরা বাউলকে দেখছি আমাদের চিন্তার তর্কবিতর্ক দিয়ে। ভাবের ভাষায় পৌঁছোনোর আমাদের যোগ্যতা নেই। কেননা আমাদের শুরু নেই। আমাদের আছে কেবল অনুসন্ধিৎসু মন। যে মন লোকায়ত সাধনপথের সরেজমিনে বেরিয়ে প্রশ্ন করছে, উত্তর মনঃপূত না হলেই তৎক্ষণাৎ সেটা নিজেদের সর্দারি ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় নাকচ করে দিচ্ছে। আর এভাবেই ভাব দিয়ে ভাব বুঝবার আসল অভিমুখটি নষ্ট হয়ে গিয়ে তখন কেবল পুরুষের বীর্য আর মহিলার মাসিক চর্চায় গিয়ে আটকে যাচ্ছে আমাদের মন। সেখান থেকে আমরা খুঁজে ফিরছি নব্য অভ্যুদয়ের কোনো উপমহাদেশ নয়। খুঁজে ফিরছি ব্যভিচার-পতন-লাঞ্ছনার গল্প। আমরা যুগল ভজনার একপেশে একটি দিকই দেখছি। অপরদিকের বা মূল দিকের ভাবের আধুনিকতা নিয়ে আমাদের তখন কোনো প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন আমাদের ভাবের সীমান্তবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে গিয়ে ভাবসাধকের আধুনিক বিকাশের টানাপোড়েন নিয়ে।
.
যখন শুরু করেছিলাম তখন সেটা সরেজমিনে অনুসন্ধানের বিষয়ই ছিল না কোনো। মনের টানে আমি ওদের সঙ্গে রীতিমতো বসবাস করতে শুরু করেছিলাম। ভূমিতলকে বুঝতে একেবারেই ভূমিতে নেমে পড়তে হয় আমার ঠাকুরদা বলতেন এ কথা। আমি যখন মেলা, মোচ্ছব, দিবসী, সাধু-গুরুদের অনুষ্ঠানে ঘন ঘন যাতায়াত করছি তখনই প্রবৃদ্ধ বাউল সাধক শশাঙ্কশেখর দাস বৈরাগ্য একদিন আমাকে বললেন, আলগা ঢঙে দেখলে বাপ বাউলের জমিখান দ্যাখবা তুমি ক্যাম্বা। দ্যাখতি হবে তোমারে ধূলিতলে নামি। ভাবসত্য, জীবনবীক্ষণ হল গিয়ে বাউল সাধনা। ও কি আর গায়নশৈলী? তুমি শুনে বুঝে রপ্ত করবা! অচেদ্য শরিক না হলে পর আলগা বাঁধনে ধর্ম বোঝা যায় না। আশ্রমে কাটাও। গুরুপাটে বসবাস করো। অনুগত হও। তবে না পৌঁছবার পারবা আয়নামহলে। শশাঙ্কশেখর আমার চোখ খুলে দিয়েছিলেন। বলা ভালো ঠাই-ও দিয়েছিলেন মজলিশপুরের আশ্রমে। আমি তার শিষ্য না হলেও বাউল মতের সেই গুরুর সন্নিধানে শিক্ষা এবং দীর্ঘ প্রস্তুতি পেয়েছিলাম কেবলমাত্র জিজ্ঞাসু হয়েও এই আশ্রমে। শশাঙ্কুশেখর এতখানি করেছিলেন আমার জন্য। তিনি চাইতেন বাউল সম্পর্কে একটা পরিচ্ছন্ন ধারণা গড়ে তুলতে। ভাবের পরিমণ্ডলকে প্রসারিত করতে। সবসময় বলতেন, মরমিবাদ না জানলে মরমিয়া সাধকের কথা কইবা তুমি ক্যামনে? আমি বুঝতাম তার কাছে আসা গবেষকদের জট খোলা অনুমান তার পছন্দই নয় একেবারে। বলতেন, এ পথে অনুমান নেই বাপ। বর্তমান। তা সেই শশাঙ্কশেখরের কথা বলি প্রথমে। আমি তাকে পেয়েছি বছর তিনেক মতো। ২০০৬-এর তিনি দেহ রেখেছেন। মজলিশপুরেই তাঁর সমাধি রয়েছে। শশাঙ্কশেখর রাঢ়ের লোক। অথচ গোটা নদিয়া জুড়ে তার অনেক বাঙাল ভক্তশিষ্য। মদনপুরে আমার জ্যাঠাদের বাড়িতে তার প্রতিষ্ঠিত রাধাগোবিন্দ আছে। বাৎসরিক ভোগরাগে তিনি এখানে পৌঁরোহিত্য করতে আসতেন। আর অসাধারণ বাঙাল ভাষাও বলতে পারতেন। আমি বয়ঃসন্ধির কাল থেকে তাকে দেখেছি। আমাকে বাঙাল ভাষার মধুরিমা বোঝাতে তিনি এ ভাষায় মাঝে মাঝে বাক্যালাপ করতেন। তবে শশাঙ্কশেখর একা নন রাঢ়ের অনেক বাউলই ভালো বাঙাল ভাষা বলতে পারেন। তবে বাঙাল বাউল রাঢ় বলছেন আমি দেখিনি। আসলে রাঢ়ের খটোমটো ভাষা বলতে বাঙালদের জিভে কুলোবে না। এ ভাষায় পেলবতার ছোঁয়া কম বলে রপ্ত করা শক্ত।
শশাঙ্কশেখর পুরোপুরি বাউল নন। জাতবৈষ্ণব। কায়াবাদী বৈষ্ণবদের সঙ্গে বাউলের সাযুজ্য নিয়ে বরাবরের এক গোল রয়েছে। সেজন্যই বোধহয় লালনশাহি ধারার সাধক দুন্দু শাহকে বিশ শতকের গোড়াতেই এর নিষ্পত্তিতে নামতে হয়েছিল। তিনি লিখলেন : ‘বাউল বৈষ্ণব ধর্ম এক নহে তো ভাই—বাউল ধর্মের সাথে বৈষ্ণবের যোগ নাই। / বিশেষ সম্প্রদায় বৈষ্ণব / পঞ্চতত্ত্বে করে জপতপ / তুলসী-মালা-অনুষ্ঠান সদাই। / বাউল মানুষ ভজে। যেখানে নিত্য বিরাজে / বস্তুর অমৃতে মজে / নারী সঙ্গী তাই।’ দুদ্দু যতই বাউল বৈষ্ণব পন্থায় ভেদরেখা টানবার চেষ্টা করে থাকুন না কেন, এই একুশ শতকেও দুই সম্প্রদায়ের ভেতর এখনও কিন্তু এক ঐক্যসূত্র বর্তমান আছে। তবে সেই ঐক্যসূত্র নৈষ্টিক গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের সঙ্গে নয়। ঐক্য মূলত জাতি-বৈষ্ণব বা সহজিয়াদের সঙ্গে। এর প্রধান কারণ বোধহয় সহজিয়াদের কায়াবাদী সাধন। এরা দেহকে বৃন্দাবন মেনে আরোপ সাধনাতে বিশ্বাসী। সেখানে অনুমানের ব্যাপার নেই কোনো। সবই বর্তমান। দেহভাণ্ডেই সবকিছু রয়েছে। দেহের তাই কোনো কিছুই ঘৃণ্য এবং বর্জ্য হতে পারে না। আর এখানেই বাউল বৈষ্ণব এক হয়েছে। যে কারণে গ্রামবাংলার অনেক বাউল সাধকদের মুখে বলতে শুনেছি, আমরা হলাম গিয়ে খ্যাপা, বৈষ্ণব-বাউল। গ্রামের মানুষ বাউল ও তার সাধনসঙ্গিনী মাধুকরীতে এলে বৈষ্ণবীয় আচরণ বলেই সে সময় গুলিয়ে ফেলে বাউলের সাধনসঙ্গিনীকে ‘বোষ্ট্রমী’ বলে ডেকে উঠেছে, এ তো আমার স্বচক্ষে দেখা। বাউলদের সিংহভাগ যেসব জমায়েত সবই তো বৈষ্ণবতীর্থ হিসেবেই চিহ্নিত। কেঁদুলিতে বাউলদের সবচেয়ে বড়ো সমাবেশ। আড়ংঘাটার বাউল সুবল দাস বৈরাগ্য আমাকে বলেছিলেন জয়দেব-কেঁদুলি হল খ্যাপা, আমাদের কাশী। ঠিক একই তানে গোরভাঙার ফকিরদের মুখে ধ্বনিত হতে শুনেছি, পাথরচাপড়ি হল গিয়ে ফকিরদের মক্কা। আসলে বাউল-ফকিরেরা বেদবিধি-শাস্ত্র-কোরান-শরিয়ত মানেন না বলেই বিধি-বিশ্বাসকে বর্তমান করতে গিয়েই কেঁদুলিকে কাশী বলেন, পাথরচাপড়িকে মক্কা। ঠিক একইভাবে যেমন জাতবৈষ্ণবরা দেহকেই রাধারানির বাসস্থান বলে মানেন। কায়াবাদী সাধনের মান্য বর্তমানকে তারা এভাবেই আরোপ করেন। বর্ধমান-বীরভূম-বাঁকুড়ায় প্রতি বছর নির্দিষ্ট তিথিতে যে-সব প্রাচীন বাউল সমাবেশ হয়ে থাকে তার মূল সুরে রয়েছে সহজিয়া বৈষ্ণবদের ঐক্যসূত্র। বাঁকুড়ার সোনামুখীর বাউল সমাবেশের পেছনে রয়েছে মনোহর খ্যাপার যোগ। মনোহর জাতি-বৈষ্ণব ছিলেন। বর্ধমানের অগ্রদ্বীপে ঘোষঠাকুরের শ্রাদ্ধে গোপীনাথের কাছা পরে শ্রাদ্ধশান্তির অনুষ্ঠান বৈষ্ণবীয় পন্থার আচার হলেও সেখানে বাউলদের আখড়া রীতিমতো প্রসিদ্ধ। একশো বছর ধরে চলা বীরভূমের কোটাসুরের উৎসব বৈষ্ণবদের সাধুসেবার হলেও সেখানে বাউলদের রমরমা। বেনালীপুরের মেলা, রামকেলীর সমাবেশ, বোরেগীতলার মেলা-সবই হল গিয়ে আখড়াধারী জাতি-বৈষ্ণবদের রীতিপরম্পরার স্মরণ উৎসব। কিন্তু সেখানে বাউলদের জমায়েত। নদিয়ার গয়েশপুরের কুলের পাটের মেলা, ডিগরের রসরাজ গোঁসাইয়ের মোচ্ছব, আড়ংঘাটার বিখ্যাত যুগলকিশোরের মেলা, কৃষ্ণনগরের বারুণীর মেলা-সবেতেই বৈষ্ণবীয় আচরণ প্রধান হলেও শেষমেষ বাউলস্রোতেরই গিজগিজ। নদিয়ার কর্তাভজা, সাহেবধনী, বলরামী স্রোতে লালনশাহি মতের সমাবেশ ঘটলেও জাতি-বৈষ্ণবদের আনাগোনা তো আছেই। সব মিলিয়ে এটাই বলা চলে যে, নিম্নবর্গীয়দের গোপন, গুহ্য স্রোতে দুদ্দু শাহের সেই ভেদরীতিকে সরিয়ে সমাঝোতা জোটের মতো বাউল-বৈষ্ণব পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন বাংলারই লোকায়ত সাধনপথে। বাউল সাধকদের তো জাতগোত্র ধারণের দরকার নেই কোনো। বাউল ভাবনার মূলে তো উদার ও সমন্বয়বাদী মানবচেতনা। যেখানে শাস্ত্র নেই। মন্ত্র নেই। তথাপি সিংহভাগ বাউলদের বলতে শুনেছি যে, তারা সব হলেন অচ্যুতানন্দ গোত্রের। শশাঙ্কশেখরও এই একই পোত্র বলেছিলেন আমাকে। নবনী দাসের পুত্র, পূর্ণদাসের ভাই নামি বাউল লক্ষ্মণ দাসও আমাকে তার গোত্র বলেছিলেন বৈষ্ণবীয় পন্থায়। সিউড়ির কেন্দুয়াতে থাকেন তিনি। এ বাড়িতেই আছে নবনী দাসের সমাধি। রবীন্দ্র আবহে মিশে থাকা নবনী দাসের সমাধি দেখতে গিয়ে গায়ে রীতিমতো কাটা দিয়েছিল। সন্ধেবেলা লক্ষ্মণের বাড়িতে মেয়ে-বউরা যে সান্ধ্যকালীন প্রার্থনা করলেন সঙ্গে ক্রিয়াকর্ম, যাতে তিনি নিজেও উপস্থিত; সবেতেই বৈষ্ণববাড়ির নামগন্ধ পেলাম আমি। লক্ষ্মণ যেখানে থাকেন বীরভূমের সেই কেন্দুয়া নদিয়ার ঘোষপাড়ার মতোই পুরোপুরি বাউল পল্লিই বলা চলে। গেরুয়া অঙ্গবাস, চুল চুড়ো করে বাঁধা, গলায় নানা পাথুরে মালা, ঘোষপাড়ার দীনদয়ালের পায়ে আবার নেলপালিশ, রুপোর মল। কিন্তু সবাই সহজিয়া মতে শামিল। সকলেই রীতিমতো স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-নাতি-নাতনি নিয়ে প্রবল সংসারী। আয়ের উৎসে বাউলপন্থা। ভেক। গান। অনুষ্ঠান। দু-একজন করণগুণে ঘরনার বশবর্তী হয়ে বেশ খ্যাতিমান। লক্ষ্মণদাস তাদেরই একজন। তার বিদেশ গমন, বিদেশিনি সংসর্গ, নানা জায়গার সরকারি ও সম্রান্ত অনুষ্ঠানের ডাক কেন্দুয়ার অনেকেরই কাছে বেশ ঈর্ষণীয়। লক্ষ্মণ না হয় বাউল বংশেরই সন্তান। ঘোষপাড়ার দীনদয়াল তো আর বংশপরম্পরার বাউলও নন। থাকতেন রানাঘাটে। আড়ংঘাটার সুবল দাসের কাছে প্রথমে নাড়া বাধা। বাড়ি পুরোপুরি বৈষ্ণবীয় মতের। ছেলেবেলাতেই দীক্ষা পেয়েছেন সেই অচ্যুতানন্দ গোত্রেই। লেখাপড়া প্রাইমারি ইস্কুলের গণ্ডি পর্যন্ত। সুবলের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গাতে যেতে যেতেই তার চিন-পরিচয়ে মুরশিদাবাদের বেলডাঙার কাছে মানিকনগরে মদনমোহন দাসের আখড়াতে গিয়ে ওঠা। মদনমোহন হলেন শশাঙ্কশেখর দাসবৈরাগ্যের একমাত্র পুত্র। পদকর্তা হিসেবে তারও একটা মান্যতা আছে এখন নদিয়া–মুরশিদাবাদ-বীরভূমে। যোগ্য পিতার উত্তরসূরি। তবে শশাঙ্কশেখরের মতো সাধনভজনের উচ্চাবস্থা তার নেই। কিছু ভক্তশিষ্য আছে। দীনদয়াল সুবলকে ছেড়ে মদনমোহনের পোঁ ধরেন। এখানকার আনুকূল্যে তার বিদেশযাত্রার সুযোগ ঘটে। বাস গিয়ে ওঠে বাউল আভিজাত্যের কিংবদন্তিসম সতী মা-র থানের ঘোষপাড়াতে। দীনদয়াল আমাকে তার ইটালি-প্যারিস-আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া যাত্রার গল্প শোনান। এখানকার পরিবেশ, রাস্তাঘাট, ট্রামে-বাসে ভ্যানরিকশায় তার এখন রীতিমতো অনীহা। আমি স্বদেশেই ঘুরতে পারিনি ঠিকমতো। তাই তার সেই বিদেশবাসের গল্প হাঁ মেরে শুনি। তিনি আমাকে বিদেশি নামি ব্রান্ডের সিগারেট, চুরুট, মদ উপহার হিসেবে দেন। দীনদয়াল এমনিতে সজ্জন অতিথিবৎসল আধ্যাত্মিক মানুষ। ভাগবত, চৈতন্যচরিতামৃত সহ নানা বৈষ্ণবীয় গ্রন্থ নিজ উদ্যোগে এবং শশাঙ্কশেখর-মদনমোহনের তদারকিতে আত্মস্থ করে নিয়েছেন। তারও কিছু ভক্তশিষ্য আছে। দীক্ষা দেন বৈষ্ণবীয় মতো হরিকথা, হরিনাম করেন উত্তরবঙ্গের গ্রামে গ্রামে। আমাকে নিয়ে গিয়ে তার সেই অনুষ্ঠান দেখানোর জন্য জোরাজুরি করেন। তবে সেখানে না গেলেও বেশ কয়েকবারই দীনদয়ালের কণ্ঠে বাউলগান শুনবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। গলা সুমিষ্ট, সুরে খেলে, ভালো বাঁশি বাজাতে পারেন। তাঁর কাছে দেখেছি অনেকে বাঁশি ও গান শিখতে আসেন। আগে লালনগীতি, শশাঙ্কশেখরের পদই বেশি গাইতেন। এখন নিজের গানই বেশি পরিবেশন করে থাকেন আসরে। সে গানে নিজস্ব সাধনভজনের অনুভব না থাকলেও দেহতত্ত্বের যোজনা তারিফ করার মতো। সব মিলিয়ে দীনদয়াল বাউল না হয়েও তার গানের পন্থাকে অবলম্বন করে ভাবসাম্রাজ্যে বেশ জাঁকিয়ে বসেছেন। সাধনসঙ্গিনী না থাকলেও স্ত্রীকে সেই হিসেবেই দেখে থাকেন। কিছুদিন আগে ঘটা করে ছেলের বিয়ে দিলেন। ছেলেও গান-বাজনা করে। ঘোষপাড়াতে পুরসভার সহযোগিতায় তার স্থায়ী আখড়া হয়েছে। সরকারি অনুদানও আসে মাসে মাসে। সূতরাং প্রবীণ লক্ষ্মণ দাস বাউলের খ্যাতির পাশটিতে দীনদয়াল তার পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সে তো অনায়াসেই বসে পড়তে পারেন। একুশ শতকে বাউল এখন এভাবেই বৈষ্ণব-বাউল যোগসূত্রে স্বমহিমায় বিরাজ করছেন। সহজিয়াদের অচ্যুতানন্দ গোত্রে শামিল হওয়ার পেছনে বোধহয় অভিজাত বৈষ্ণবশ্রেণির সঙ্গে সমঝোতাই কাজ করে। অবহেলার জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েই বোধহয় তারা চৈতন্যদেবের শিক্ষাগুরু অদ্বৈত আচার্যের বড়ো ছেলে দক্ষ বৈষ্ণব সংগঠকের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিতে চলে আসেন। হচ্ছিল শশাঙ্কশেখরের কথা। সেখানেই আবার ফিরে যাই।
শশাঙ্কশেখরের জন্ম বিশ শতকের প্রথম দশকেই। বেশ দীর্ঘায়ুরই মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর আদি নিবাস ছিল মুরশিদাবাদেরই মালতীপাড়ায়। পরে চলে আসেন রসোয়াড়ার ভাটেরায়। বন্যায় ভিটে হারিয়ে এরপর কাটোয়ার আতুরহাটে চলে যাওয়া। সেখান থেকে আবারও সেই আদি নিবাস মালতীপাড়ায়। বহরমপুরের রাধার ঘাটে আখড়া করে ছিলেন প্রায় এক যুগেরও বেশি। সেখান থেকে আখড়া সরে আবারও সেই কান্দির রসোড়ায়। বারবার ঠাইনাড়ার পর রেজিনগরের কামনগর গ্রামে পাকাপাকিভাবে আখড়া গড়ে এখানেই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন। শশাঙ্কশেখরের বাবার পেশা ছিল গান ও মাধুকরী। জাতবৈষ্ণব বলে একই পথে আসেন ছেলেও। বৈষ্ণব উৎসবে তাকে শেষ বয়সে গাইতেও দেখেছি। রীতিমতো আগে মহোৎসবে তিনি পৌঁরোহিত্য করতেন। রাধাকৃষ্ণের ভোগরাগ দিতেন। পরবর্তীতে গাঁয়েগঞ্জে গেয়ে ফিরলেও শহরে গান শোনানোর ক্ষেত্রে তার ছিল তীব্র অনীহা। যদিও কয়েকবার শহরের মঞ্চে, আকাশবাণীতে গেয়েছেন। তবে মধ্য যৌবনে কলকাতার যাত্রাদলেও বিবেকের পাঠ করতেন। ঐতিহ্যবাহী বাউল নাচের ধারক তিনি যে ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠছিলেন, তার মুখে শুনেছি এ নাচের হাতেখড়ি নাকি হয়েছিল যাত্রাদলে। বৈষ্ণবপন্থী থেকে দরবেশি মতে সরে আসেন শশাঙ্কশেখর। মুরশিদাবাদের পদ্মাতীরের আখেরিগঞ্জে ছিল অটলবিহারী দরবেশের আশ্রম। সেই আশ্রম অবশ্য পরে সরে যায় বীরভূমের দুবরাজপুরে। রাঢ়ের বহু বৈষ্ণব-বাউল এখনও এই মতে চলে আসছেন। শশাঙ্কশেখরের মুখেই শুনেছি এই স্রোতটি নাকি নিত্যানন্দের ছেলে বীরভদ্রের। বীরভদ্র সহজিয়া সাধক মাধববিবির দীক্ষিত বলে কিংবদন্তি রয়েছে। আর এভাবেই নৈষ্ঠিক-সহজিয়া এক হয়েছে। সহজিয়া আবার বাউলে গিয়ে মিশেছে। সে যাই হোক না কেন, লোকায়ত সাধনের মূলগত ঐক্য হল জাতপাতের ভেদাভেদহীনতায়। নদিয়া-মুরশিদাবাদ-বীরভূমে শশাঙ্কশেখরের অনুগামী ভক্তশিষ্যের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তার পদ বহু খ্যাতিমান গায়ক বাউলরা গেয়ে ফেরেন। মজলিশপুরে বসেই তিনি আমাকে বলেছিলেন তার শিক্ষাগুরুর নাম। গুরুপ্ৰণালীর ভাগ বলেছিলেন। সেই ভাগে মধুরানন্দের স্রোত এসে মিশেছে। ‘মাজবাড়ি’ বলে তিনি তাকে চিহ্নিত করেছিলেন। বলেছিলেন সন্ন্যাস দীক্ষা তার এখানকার। আর শিক্ষাদীক্ষার প্রণালী তার কাছাধারী’ মতে। সেজন্যই পত্নী নিয়ে প্রথম জীবনে তার বসবাস। তারপর ভেকগুরু প্রণালী মেনে হয়েছিলেন তিনি আখড়াধারী। সাধকজীবনের নানা কথা নানা সময়ে বলেছিলেন শশাঙ্কশেখর। তার আখড়াতে ঘন ঘন একসময়ে আমার যাতায়াত ছিল। জন্মরহস্য বলতে গিয়ে একবার বলেছিলেন, ‘জীবনে চার বার জন্ম হয়।
-কীরকমভাবে? জিজ্ঞেস করেছিলাম।
বলেছিলেন, প্রথম জন্ম হয় মাতৃক্রোড়ে। পিতার বীর্য মাতার রজ নিয়ে। দ্বিতীয় জন্ম দেন দীক্ষাগুরু। তৃতীয় জন্ম ক্রিয়াকরণের। গুরুর হাতে নিজেকে সমর্পণ করতে হয়। চতুর্থ জন্ম হয় ভেকে।
ভেক হল সিদ্ধি। প্রচলিত ভাষায় ভেক নেওয়া হল ছদ্মবেশ। যেমন বলা হয়—ছিল চোর, বদমাশ এখন সাধুর ভেক নিয়েছে। হতভম্ব হয়ে যাওয়াকেও ভেক বলা হয়। কিন্তু শশাঙ্কশেখর দাস বৈরাগ্যের বলা ভেক হল বাউল সিদ্ধি। সাধনার সর্বোচ্চ দশা।
ভেক জন্মের আগে ক্রিয়াকরণ নিয়ে নানা সময়ে নানা কথা তিনি বলেছিলেন আমাকে। একবার বললেন, দশেন্দ্রিয়, ষড়রিপু এগুলো সব হল গিয়ে বাবা চিনি খাওয়া রাক্ষুসি। শরীরের মধু সব খেয়ে নেয়। সাধনায় আগে এদের মারতে হবে বাবা।
গুরুর নির্দেশে শিক্ষানবিশ বাউল প্রথমে বাঁ নাকের সাহায্যে বাইরের বাতাসকে টেনে এনে শরীরের অভ্যন্তরে রেখে ধীরে ধীরে ডান নাক দিয়ে ছেড়ে দেয়। এই যে বাইরের বাতাসে শরীরের অভ্যন্তর পূর্ণ হচ্ছে সেজন্য এর নাম পূরক। শরীরের ভেতরে এই যে বাতাস ধরে রাখা তা অনেকটা কলশিতে জল ভরে রাখার মতোই। তাই এর নাম কুম্ভক। আর বাতাসকে যখন ডান নাকে নিয়ে বা নাক দিয়ে বের করে দেওয়া হচ্ছে তখন তার নাম হচ্ছে রেচক। এই ক্রিয়া বাউলকে শিখতে হয়। এতে সমস্ত নাড়ি পরিশুদ্ধ হয়ে সুষুম্না দিয়ে সোজা উপরে উঠতে আরম্ভ করে। উর্ধপথ এভাবেই তৈরি করে নিতে থাকেন শিক্ষানবিশ বাউল। এই উর্পযোগেই ‘বিন্দুধারণ’ শক্তি অর্জন করা যায়।
প্রাণায়ামের প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হয়েছিল আমার মজলিশপুরে বসেই। তিনি দাঁতহীন গালের দু-দিকে হাসিতে সেই গর্তে বুজিয়ে বললেন, এই করণকৌশলের নানা নিয়ম আছে। শুরুর কাছে এসবই শিখতে হয়। বুঝলে বাবা, সাধকের কাজ হল, বায়ুর ঘর বায়ু বাড়ি বায়ু নিয়ে নাড়িচাড়ি। এই নাড়াচাড়া না হলে সাধক সিদ্ধ হবেন কোন্ প্রকারে শুনি? বায়ু কী জানো বাবা?
বললাম, কী?
-বায়ু হল বীজাবস্থা। শুদ্ধ চৈতন্য বায়ু। বায়ু না হলে শক্তিতত্ত্ব আর শিবতত্ত্ব জাগবে কীভাবে? এই শক্তি কোথা থেকে আসে জানো বাবা?
-কোথা থেকে?
–মায়া থেকে বাবা।
–মায়া তো পাশ বলেন আপনারা? জিজ্ঞেস করলাম।
-মায়া তো পাশই বাবা। মায়ামুক্ত হলে আসে শুদ্ধ মায়া। আর এই শুদ্ধ মায়া থেকেই শক্তি ও শিব জাগরিত হয়। যুগল নেয় সত্তা। মায়া হল শরীরের সব সৎ বৃত্তি। অসৎ কী জানো বাবা?
বললাম, আপনার চোখে অসৎ কী? আমি যে অর্থে অসৎ বলব তা হয়তো আপনার সঙ্গে মিলবে না।
বললেন, তা তুমি যে অর্থেই বল অসৎ আসলেই হল অনস্তিত্ব মন। মায়া যে সৎ বৃত্তি তার কারণ মায়া অস্তিত্বের প্রকাশ। মায়াকে শুদ্ধ মায়াতে আনতে হবে। শরীরকে, মনকে অনস্তিত্বের জায়গায় আনতে হবে। তবে না আনন্দশক্তির আত্মপ্রকাশ আসবে। ঘর কী?
বললাম, কী?
বললেন, ঘর হল গিয়ে দেহক্রিয়া। মূলাধারের অস্থি, স্বাধিষ্ঠানের মেদ, মণিপুরের মাংস, অনাহতের রক্ত, বিশুদ্ধের ত্বক আর আজ্ঞার মজ্জা নিয়ে ঘর গঠিত। ঘরকে আগে ক্রিয়াশীল করতে হবে।
বাউলের ঘর ক্রিয়াশীল, সক্রিয় এখন সবথেকে বোধহয় গানে। সাধক বাউল কোথায় এখন? সবদিক গায়ক বাউলে শুধু ছয়লাপ। মুরশিদাবাদ জুড়ে আগে ছিল কেবল সাধক বাউলদের আখড়া। আর মুরশিদাবাদ এখন গায়ক বাউলদের আখড়া সাজিয়ে বসে আছে। শশাঙ্কশেখর যখন শরীরে ছিলেন মুরশিদাবাদ তখন কিছু ক্রিয়াকরণের স্রোত নিয়ে জেগে ছিল। এখন মরা সেতায় কেবল গান ঘুরে বেড়াচ্ছে। শশাঙ্কশেখরের ছেলে মদনমোহন বাবার গুরুপাটের ঐতিহ্য সেভাবে আর রক্ষা করতে পারলেন কই! যে উচ্চমার্গের সাধক ছিলেন শশাঙ্কশেখর তার ধারকাছ দিয়েও যেতে পারলেন না তিন জেলায় ছড়িয়ে থাকা তার শিষ্যদের কেউই। তিনি আখড়ায় সাধনসঙ্গিনী নিয়ে বসবাস করতেন না। একক সাধনে ব্রতী ছিলেন। যতদূর জানি সন্তান উৎপাদনের পর থেকেই তিনি বিন্দুধারণ করে আসছিলেন। প্রবৃদ্ধ এই সাধকের মৃত্যুর পরও হয়তো বা এই জেলায় প্রাজ্ঞ নির্জন সাধক রয়ে গেছেন কেউ। তার হদিস আমার গোচরে নেই। শশাঙ্কশেখরের ছবছর আগে দেহ রেখেছিলেন মুরশিদাবাদ জেলার আর এক নির্জন সাধক সাঁটুইয়ের মনমোহন দাস বাউল। তার সাধনসঙ্গিনী ছিলেন স্ত্রী সুলক্ষণাই। নিঃসন্তান ছিলেন তিনি। ধর্মরক্ষা করে গেছেন। আমি তাকে দেখেছি একেবারেই অর্থব অবস্থাতে। তখন শরীর বশে নেই। কণ্ঠও। সুলক্ষণা বলেছিলেন, তিনি নাকি মাদুর, কুলো, ধামা, ফুলদানি-বাঁশের নানা কাজে পারদর্শী ছিলেন। তার নিজের হাতে লেখা একখানি জীবনীর কথাও শুনেছিলাম সে সময়। দেখতে চাইলে সুলক্ষণা জানিয়েছিলেন, সে আর নেই। একজন দেখতে চেয়ে নিয়ে গিয়ে শেষে আর ফিরিয়ে দেননি। অথর্ব হলেও মনমোহনের বাকশক্তি তখনও তাজা ছিল। স্মৃতিও বেশ প্রখর। আমাকে তিনি তার জীবনের বেশ কিছু কথা বলেছিলেন।
মনমোহন প্রথমে তন্ত্রশিক্ষা করেছিলেন রতিকান্ত মোহন্তর কাছে। তিনি নাকি কামাখ্যাতে সাধনা করতেন। কিন্তু মনমোহন আমাকে জানিয়েছিলেন তার তান্ত্রিক গুরুর দীক্ষা ছিল নদিয়ার সতী মায়ের ঘরে। এটা কতখানি সঠিক এখন বলা শক্ত। কেননা সতী মা’র ঘরের ধারক আউলচাঁদের সঙ্গে সুফি যোগসাজশের একটা ঐক্য পাওয়া গিয়েছে ভাবপন্থায়। কিন্তু আউল তন্ত্র করতেন এর কোনো প্রামাণিক বহর এখনও পর্যন্ত উঠে আসেনি। মনমোহন শ্মশানে-মশানে ঘুরবার কথাও বলেছিলেন। সেখানেই বোধহয় তিনি গুরু ছিলেন; আবার এমনও হতে পারে আউলপস্থার সেই সাধকই পরে তন্ত্রধারায় এসেছিলেন। তন্ত্র থেকে সরে মনমোহন বাউলপথে এসেছিলেন। তখনই তার নাম আশুতোষ থেকে মনমোহন হয়। নামকরণ করে গুরু সদানন্দ। মনমোহনের শিক্ষাগুরু ছিলেন সদানন্দ। সাঁটুইয়েই গঙ্গাঘেঁষা তার আশ্রম ছিল। মনমোহনের আশ্রমের অদূরে। মনমোহনের ভেকের গুরু তবে সদানন্দ নন। সদানন্দও ছিলেন বাউল সাধক। তার রচিত বহু পদ এখনও গায়কদের মুখে ফেরে। তারও বাউল নাচের একটি নিজস্ব ধারা ছিল। সদানন্দের আশ্রম দেখেছি কিন্তু তাকে দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়নি। সদানন্দের কথা শুনেছি মুরশিদাবাদের খ্যাতনামা তরুণ বাউল সোমেন বিশ্বাসের কাছে। সোমেন আমাকে জানিয়েছিলেন, তিনি সদানন্দের কাছে গান ও নাচের শিক্ষা নিয়েছিলেন। তাকে নাকি ওঁর কাছে যেতে বলেছিলেন তার গুরু মনমোহন। মনমোহন তার নিজের অথর্ব দশাকে গুরু মা’র অভিশাপ হিসেবে চালাতেন। গুরু মা তাকে কেন অভিশাপ দিয়েছিলেন সাঁটুইয়ের আশ্রমে বসেই আমি ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, নিজ গুরুসেবার জন্য তিনি তার শিষ্যের কন্যাকে ভেট দিয়েছিলেন। এজন্য গুরু মা তাকে অভিশম্পাত করেছিলেন। গুরুর নাম তিনি বলেছিলেন ননীগোপাল মোহন্ত। বহরমপুরের ভাকুড়িতে তার আশ্রম রয়েছে। মনমোহনের সাধনসঙ্গিনী শেষমেশ সুলক্ষণাতে গিয়ে ঠেকেছে ঠিকই। কিন্তু তিনি দেহসাধনার সঙ্গিনী হিসেবে বহুগামী হয়েছিলেন যে একথা আমার কাছে নিজ মুখেই স্বীকার করেছেন। আর সেখান থেকেই তার যৌনশিথিলতা এসেছিল বোধহয়। কেননা সুলক্ষণাকে তিনি শেষপর্যন্ত বিবাহ করলেও সন্তান দিতে পারেননি। তা বোধহয় বিন্দুসাধনার জন্য নয়। সুলক্ষণা অসহায় ছিলেন। তার অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না বলেই সটুইয়ের আশ্রমে যে তিনি পড়ে আছেন এ আমাকে সে সময় সুলক্ষণাই বলেছিলেন। আর এও জানিয়েছিলেন মনমোহনের আসলে শিরার অসুখ আছে। ভালো পদ লিখলেও প্রথম প্রথম বিন্দুসাধনার শিক্যে রপ্ত করে সাধনপন্থাতে থাকলেও মনমোহনের সঙ্গী পালটানোর বাই ছিল তার গুরুর মতোই। এসব ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই তিনি নাকি তার জরাকে গুরু মা’র অভিশাপ বলে চালাতেন। বলেছিলাম, মনমোহন কেন করবেন এমন? ওঁর তো গায়ক ও পদকর্তা হিসেবে সম্মান রয়েছে। কিছুক্ষণ থম মেরে সুলক্ষণা বলেছিলেন, সুম্মানের তলে কালি গো কালি। ধলা গুরুও কালি মুখো। এ পথে নারী বদলানোর কালি আছে। বলেছিলাম তখন, উলটোটাও তো আছে। সুলক্ষণা বলেছিলেন, আমাদের কালে নারীর গান কোথায়! আশ্রমের বাইরে গান অপরাধ। পুরুষ বদলাতে স্বাধীন পথ লাগে গো। একলা গাওয়ার দাপট।
মনমোহনের বিখ্যাত শিষ্য হলেন সোমেন বিশ্বাস। পঞ্চাশের ওপর বয়স তার। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। পড়াশুনা করতে করতে গাঁয়ের বাউল আবহে তার রক্তে মেশে গায়ক হওয়ার নেশা। এ তথ্য আমাকে সোমেনই দিয়েছেন। গান শিখবার জন্য তিনি সাঁটুইয়ে গিয়ে উঠেছিলেন। গানের জন্যই মূলত মনমোহনের কাছে সশিক্ষা নিয়েছিলেন। একথা তিনি নিজমুখেই স্বীকার করেছেন। পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত বাউল শিল্পী বলা যায় সোমেনকে। রাজ্য সংগীত অকাদেমি তাকে পুরস্কার দিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি মান্য বাউল উৎসবে অনুষ্ঠানে তিনি গান পরিবেশন করেন। ভারতের বহু জায়গায় তিনি গান পরিবেশন করেছেন। বিদেশে যাওয়ার সুযোগ এসেছে তার জীবনে বহুবার। নেহরু যুবকেন্দ্র থেকে রাজস্থানে শিল্পী হিসেবে যোগদানের জন্য তাকে পাঠানো হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসীকেন্দ্র, পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র, বাউল ফকির সঙ্গ সহ নানা লোকায়ত মাধ্যমে তিনি পদে রয়েছেন। তার নিজস্ব গায়নশৈলীও রয়েছে একটা। সুকণ্ঠের অধিকারী। মহাজনদের পদ আমি অন্তত দেখেছি সোমেনকে শ্রদ্ধাসহকারে গাইতে। নিজে গানও লেখেন এবং সুর করেন। ক্যাসেড-সিডি আছে। নিয়মিত আকাশবাণী-দুরদর্শনের শিল্পী। কেরলের বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী পার্বতী পারিয়াল শশাঙ্কশেখরের কাছে এসে নাচ ও গানের তালিম নিয়েছিলেন। সেই সূত্রে সোমন পার্বতীর সঙ্গে কেরলেও বহু অনুষ্ঠান করেন। সোমেন বাউল শিল্পী। বাউল সাধক নন। বিন্দুধারণ, করণ, চক্ৰসাধন এসব ববাঝেন বলে মনে হয় না। সেসবে আগ্রহ নেই তার। তিনি ব্রহ্মচারী। দীর্ঘ কেশ ও দাড়িতে পুরোপুরি বাউল আধার হলেও কোনোভাবেই নামি, পেশাদার শিল্পী ছাড়া আর কিছুই নন। গানের তত্ত্ব সেভাবে বিশ্লেষণেও দক্ষ নন। হওয়ার কথাই তো নয়। সাধন অনুভূতি তার কোথায়? যা ছিল শশাঙ্কশেখরের, সদানন্দের, কিছুটা মনমোহনের। মুরশিদাবাদের সাধক বাউলের পরম্পরা ভেঙে সোমেন জীবন-জীবিকার তাগিদে এখন বাউল গায়ক।
.
অখণ্ড নদিয়ার স্রোতে রয়েছে লালনশাহি মত। কিন্তু কালের নিয়মে সে মতেও এখন জং ধরেছে। নদিয়ার ছেউড়িয়া পাকিস্তানের পর বাংলাদেশে গিয়ে উঠেছে কুঠিয়া জেলায়। লালনকে দেশবিভাগের আগে হিন্দু প্রতিপন্ন করবার প্রবল প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন তার আখড়াতে যাওয়া কাঙাল হরিনাথ, অক্ষয়কুমার মৈত্ররা। পাকিস্তানি আমলে সেই প্রচেষ্টায় জল ঢেলে তাকে রীতিমতো মুসলমান বানিয়ে নেওয়া হল। সমাধি হয়ে উঠল মাজার। মাজারে লাগল স্থাপত্যের ছোঁয়া। বাংলাদেশ আমলে তারই যেন আবার বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা হল। কবরকে পিরদের কবরের মতো করে গম্বুজ খিলান-টিলান বানিয়ে সাজিয়ে তোলা হল। এর পেছনে হয়তো বা তখন আমাদের নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারই আইডল হয়ে উঠেছিল। এবারের সতী মা’র মেলাতে এসে ছেউড়িয়ার এক সাধক আমাকে বলে গেলেন সেই দুঃখেরই কথা।
বললাম, সতী মা’র ঘরের চারদিকে খ্যাপা, কর্তাভজাদের আর রমরমা নেই।
বৃদ্ধ ফকির মনমরা হয়ে তাকিয়ে বললেন, আপনে কি মনে করে আমাদের শুরুর ঘরে আমাদেরও তেমন রমরমা আছে? কিছুই নাই গো খ্যাপা। সবই শূন্য। হাহাকার ভরা। আমাদের ঘর হল গিয়ে মানুষ ভজনার ঘর। সে ঘর বর্তমান। সেখানে মৃত জিনিসের পূজা হয় না। কিন্তু সেখানে দেখেন গা খ্যাপা, সব ধূপতি জালায়ে লালনের পূজা করতাছে। আমার গুরু বলতেন, গুরু রে কেবল ভক্তি দেওনের কথা। গুরু বর্তমান। তার পূজা হয় ক্যামনে?
বললাম, সতী মা’র ঘরকে তো আপনারা খুব মান্যতা দেন বলে শুনেছি। এ ঘরেও তো দেখি তার ভাবছবিতে পূজা-অর্চনা চলে।
আমার কথায় হতবাক হলেন না ফকির। ঘন দাড়ির জঙ্গলে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আমার গুরু ছিলেন লবান শাহ। চেনেন তারে? তিনি লালন সাঁইয়ের সাক্ষাৎ শিষ্য ভোলাই শাহের দীক্ষিত। গুরু বলতেন, ঘর আমাদের ভাবের। ভাবের কোনো পূজা হয় না। পূজা-নামাজ ওসব তো শাস্ত্র-শরিয়তের ধর্ম খ্যাপা। লালন ঈশ্বর আল্লাকে অগ্রাহ্য করবেন বলেই তো তারে সাঁই ডেকে শাস্ত্র-শরিয়তকে খর্ব করে মাইনষের জয়গান করলেন। লালনের সঙ্গে শেষে সাঁই জুড়ে তার শিষ্যরা সাঁইকে জুড়লেন নিজের সঙ্গে। এভাবেই খ্যাপা, মানুষে পরমে অভেদ হল। তা খ্যাপা, একাত্মতার কোনো পূজা হয় নাকি আবার? সাঁইয়ের মাজারে বাতিদান, প্রণাম এসব হয় বলেই আমরা মাজারে ঢুকি না। বাইরে থেকেই সাঁইজিকে ভক্তি দিই। ভাবভক্তি আমাদের পথ। সাঁইজি সতী মা’র ভাবের বশে এখানে এসেছিলেন। আমিও এলাম সেই ভাবের ঘরের টানেই।’
বললাম, সে টানের সুতো কি তবে এবার এখানেও এসে ছিড়ল?
–না খ্যাপা, গুরু আমার পাঁচ ঘরকে ভক্তি দিতেন। সাঁইজির নিজের ঘরের ভক্তির পাশে রাখতেন সতী মারে। ঘোষপাড়ার ঘরকে জানবেন ঘেঁউড়িয়ার ফকিরেরা সবসময়ই মান্যতা দেয়। এ তো আমাদের সাঁইজির কাছ থেকে পাওয়া। পাঞ্জু শাহের ঘরকে আমাদের গুরু ভক্তি দেন। আমরাও দিই। চৌধুরীদের ঘর, দেলদার শাহের ঘরের ভাবে গুরুজি বলতেন সাঁইজির মত রয়েছে। পাঁচ ঘরের একতায় সাঁইজির ঘর বুঝলেন খ্যাপা। সেই বাঁধনে কালের টানে সুতো আলগা হবে। সুতোর ফ্যাকড়ায় মূল ভাব নষ্ট হবে না তবে। ভাব বইবেন ভাবের গুরু। আমি-আপনে সেই ভাবের ঘর চর্মচক্ষে কতখানি পারব দেখতে! ভাব দিয়ে ভাব দেখতে হয়।
লালন নিজে সাধুসঙ্গে জোর দিতেন। জীবদ্দশায় নিজে তিনি ভরা পূর্ণিমায় সাধুসঙ্গ করতেন। দোলের দিন তার বিশেষ পছন্দের ছিল। ওইদিন সাধুসঙ্গ ছিল যেন তার ভাববিনিময়ের মতো। সারা বছরজোড়া সাধন উপলব্ধির আধারমহিমা পরস্পরের মধ্যে বিতরণের উদ্দেশ্যেই সাধুর মেলে যাওয়া। লালনের ঘর তাই দোলকে এখনও গুরুত্বপূর্ণ মনে করে হেঁউড়িয়ার সেই স্মৃতিধামে সর্বজনীন উৎসব বা মেলা করে থাকে। বৃদ্ধ ফকির আমাকে বললেন, ছেউড়েতেও সাধুর মেলা বসে প্রতি দোল পূর্ণিমায়।
জিজ্ঞাসা করলাম, ওইদিন কী হয়?
বললেন, গুরুর আমল থেকেই তত্ত্বকথা হয়। গান হয়। জ্ঞানচর্চা হয়।
–সাঁইজির স্মরণ অনুষ্ঠান তাহলে?
একেবারে ঘাড়কে অসম্মতিসূচক সজোরে নাড়িয়ে ফকির বললেন, স্মরণ নয় খ্যাপা। মনন হয় সেদিন। স্মরণ পহেলা কার্তিক। সাঁইজির মৃত্যুদিবসে জ্ঞানচর্চা হয় না কোনো। হয় না কোনো ভাবেরও আদানপ্রদান। সেদিন কেবলই সাঁইজির দৈন্য গান গেয়ে সাঁইজিরে ভক্তি দিতে দীনহীনভাবে ডাকা হয়।
সতী মা’র ঘরেও দোল গুরুত্বপূর্ণ খুব। দোল এখানেও বাৎসরিক মিলন উৎসব। তিন দিনের সেই উৎসবে গুরু-পরম্পরায় সাম্প্রদায়িকগণ আসন স্থাপন করেন এবং সাধনভজনে নিরত থাকেন। গুরু (মহাশয়) ও শিষ্যের (বয়াতি) মেলবন্ধনে কর্তা বা মালিকের সঙ্গে এদিন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তা এই দোলমেলাও বাউলদের প্রধান এক উৎসব হয়ে উঠেছে। যদিও কর্তাভজারা সরাসরি বাউল কিন্তু নন। কর্তাভজা আর বাউল এই দুই সম্প্রদায়ের সংযোগসূত্র হিসেবে রয়ে গেছেন চৈতন্যদেব। অনেক প্রাজ্ঞ বাউলকেই আদি পুরুষ হিসেবে চৈতন্যদেবকে চিহ্নিত করতে দেখেছি। নৈহাটির সাহেব কলোনিতে থাকেন স্মরজিৎ খ্যাপা। ভবা পাগলার সঙ্গ করেছেন নির্জন এই সাধক। স্মরজিৎকে আমি সবসময়ই ভাবতন্ময় দশার ভেতরই প্রত্যক্ষ করেছি। যথেষ্টই বয়স হয়েছে এখন তার। গলা প্রতিদিন সুরে খেলে না। উঁচু স্বরে সেইভাবে আর দাপটও রাখতে পারেন না। তথাপি গান নিয়ে গুরুকে ভক্তি দেওয়ার ঐকান্তিক ইচ্ছা কতবারই আমি দেখেছি সাহেব কলোনিতে তার গুরুর আশ্রমে। খুব গর্ব করে একদিন আমায় বলেছিলেন, ‘জানেন কাটোয়ার মচ্ছবে ভবা পাগলা আমার গান শুনে নিজের গলার মালা খুলে আমারে পরিয়ে দিয়ে খ্যাপা টাইটেল দিয়েছিলেন। সেই থেকে স্মরজিৎ বাউল থেকে আমি হলাম স্মরজিৎ খ্যাপা।
গুরুর আশ্রমে বসেই দুপুরে সেবা নেওয়ার পর স্মরজিৎ খ্যাপা একদিন আমাকে বললেন, চৈতন্যচরিতামৃতরে কী মনে হয় আপনার?
বললাম, চৈতন্য আকর হিসেবে দেখি। আবার ভক্তির বাড়াবাড়িতে কখনও ভগবানের লীলাপুস্তক বলেও ভ্রম হয় আমার।
আমার এই অভিমত শুনে দেখলাম খ্যাপার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বললেন, আপনি ধারপাশ দিয়েই গেছেন। সাধকসঙ্গে ঘোরাফেরা করেন তো। একটা আধার এমনিতেই রয়েছে আপনার।
বললাম, আপনার কী মনে হয় তবে? আর বাউল হয়ে গ্রন্থকে মানেন আপনি!
—চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থ আপনাকে এ কে বলল?
—তবে কী সেটা?
—চৈতন্যচরিতামৃত হল গুপ্তলীলার প্রহেলিকা। তার পাতায় পাতায় দেখুন মহাপ্রভু কেবল ক্রিয়ামূলক সাধন দেখিয়ে গেছেন।
বললাম, সেই সাধনে বিশ্বাস রাখেন আপনি?
—কেন রাখব না খ্যাপা! মহাপ্রভুর প্রেম ক্রিয়ামূলক। প্রকৃতি-পুরুষের মিলনযোগ বুঝিয়েছেন তিনি। গোপনে গুপ্তলীলার মতো করে দেখবেন চৈতন্যচরিতামৃতে ইন্দ্রিয় সংযমের কথা রয়েছে। প্রকৃতি-পুরুষ যোগ। পরম রহস্য এসব সেখানে স্পষ্ট করে বলা আছে।
জিজ্ঞাসা করলাম, বাউলেরা চৈতন্যকে মানেন?
-মানবেন না কেন খ্যাপা! চৈতন্যদেব তো রীতিমতো মানুষ ভজনা করেছেন। তার ভজনে করণ ছিল। পূজন ছিল না কোনো। শরীরকে প্রকৃতিযোগে বসিয়ে রেখে পুরুষের করণ করতে চেয়েছিলেন তিনি। বাউল গোপনীয়তায় বিশ্বাস করে। তার সাধনধারায় চৈতন্যদেবের গুহ্যসাধন প্রণালীর যোগ রয়েছে।
প্রায় একইরকম কথা বলেছিলেন এক কর্তাভজা সাধক। পড়ারি গ্রামে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রবর্তক আউলচাঁদের সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে তিনি আমাকে বলেছেন, আমাদের ধর্ম হল আচরণীয় ধর্মে যুক্ত। যার কোনো বাহ্য চিহ্ন নেই। পোশাক নেই। মালা-তিলক নেই। পুরোপুরি গৃহীর ধর্ম।
বললাম, তাহলে আপনাদের প্রকৃতি-পুরুষ সাধনা? সেটাকেও কি আপনি গৃহীর ধর্ম বলে মান্য করবেন?
–প্রকৃতি আর পুরুষ তো একই শরীরে। এ তো মহাপ্রভুর শিক্ষা। ধর্ম বুঝতে হলে আপনাকে আগে অভেদ বুঝতে হবে। সেই অভেদত্বগুণে মহাপ্রভু আর আউলাদ এক। সেই অভেদত্বগুণেই শরীরের প্রকৃতিতে পুরুষযোগ আসে। আপনি আসলে যুগল ভজনার ইঙ্গিত করেছেন। আমাদের ধর্মে উদাসীনরা কেউ কেউ যুগল ভজনা করেন। স্কুল সেই কায়াসাধনের ভেতর দিয়ে তারা সূক্ষ্মস্তরের প্রকৃতি-পুরুষকে অভেদ করেন আর কী!
কর্তাভজা, বাউল, বৈষ্ণব, সহজিয়া—সব এক হয়ে যাওয়ার পেছনে আসলে রয়েছেন সেই একজন মানুষই। সকলের সঙ্গেই চৈতন্যদেবের কিংবদন্তির নানা সূত্র নিয়ে যুক্ত হয়ে থাকাটাই সব সম্প্রদায়ের মতাদর্শগুলোকে কোনো একটিমাত্র বিশেষ বিধিপন্থায় একীভূত করে দেওয়ার মূলে রয়েছে। এর পেছনে ওপর ওপর দেখে ধর্মমতকে নির্দেশিকায় চাপিয়ে দেওয়া বিশিষ্ট গবেষকদের হাত যেমন রয়েছে, তেমনই আবার সম্প্রদায়গত মান্যতাও কিছু রয়েছে। যেমন—অদ্বৈত আচার্যের প্রহেলিকা ভরা চৈতন্যদেবের লিখিত চিঠির সেই ‘বাউল’ অভিধা থেকে চৈতন্যদেবকে তারা নিজেদের গোত্রভুক্ত মনে করে থাকেন। আবার ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এর মধ্যে শ্রীচৈতন্যের যে গুপ্তলীলার ইঙ্গিত রেখে গেছেন রচয়িতা সেই ইঙ্গিতকে পর্যন্ত তারা বাউল সাধনার দিকে ঘুরিয়ে নেন। স্মরজিৎ খ্যাপা কিন্তু সেই কাজটিই করছেন সাহেব কলোনিতে তার গুরুর আশ্রমে বসেই। তবে শুধু স্মরজিৎ খ্যাপাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আসল দোষটি করেছিলেন এখানে চৈতন্যদেবই। তার বর্ণভেদহীনতাই লোকায়ত সাধকদের আকৃষ্ট করেছিল বেশি। সেজন্য লৌকিক ধর্মের সর্বস্তরে কালক্রমে চৈতন্যদেবই হয়ে উঠেছিলেন প্রধান পুরুষ। কেবলমাত্র বৈষ্ণবদের নানা উপশাখা তাকে মেনেছেন তা তো নয়। বাউল-ফকির-দরবেশ সকলেই তাকে মর্যাদা দিয়েছেন বোধহয় তার মানুষ ভজা’-র মতোই ভেদাভেদহীন জীবনপ্রণালীর তাপে। চৈতন্যদেবের সমন্বয়বাদ মনে ধরেছে ‘ভ্রষ্ট’, ‘পাষণ্ড’, ‘কদাচারী’ বলে খ্যাত লৌকিক ধর্মের এইসব সামাজিক দিক থেকে ভীষণই পিছিয়ে পড়া মানুষজনদের। আর এভাবেই বৈষ্ণব-বাউল এক হয়ে ওঠার ফলে বাউল ধর্ম আর বৈষ্ণব ধর্ম আলাদা বলে বাউল শুরুদের হাঁক পাড়তে হয়। কর্তাভজাদের সাধনপদ্ধতিতে শুরু হলেন ঈশ্বর। গুরুকে ঈশ্বরবোধে এঁরা পুজো করে থাকেন। এঁদের মূল আচরণ যেহেতু দেহাচারমূলক এবং ক্রিয়াসাধন, সেহেতু এখানে গুরু ছাড়া উত্তীর্ণ উপায় নেই। হাওয়ার খবর, মহাবায়ু, কুলকুণ্ডলিনী যোগের মাধ্যমে দেহগত সাধনার সাধনপদ্ধতি নির্দেশিত হওয়ার কারণে কর্তাভজারা গুরুর উপদেশ-নির্দেশে সাধনার পথে অগ্রসর হন। গুরুকেই আরাধ্যরূপে পুজো এ ঘরের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। মনে রাখতে হবে বাউলরা কখনও কিন্তু গুরুকে পুজো করেন না। ভক্তি দেন। ছেউড়িয়ার সেই লালন ঘরের সাধক মজনু শাহ ফকিরকে আমি ভক্তি দেওয়ার বিধিটি জিজ্ঞাসা করেছিলাম। মজনু হেসে বলেছিলেন, বিধি আমাদের নেই। ওসব তো খ্যাপা, বৈষ্ণব ধর্মের ব্যাপার। আমাদের করণের ঘর। করণের নিয়ত্তা হল গিয়ে শরীর। শরীরকে কর্তা মনে করতে হবে খ্যাপা।
জিজ্ঞাসা করলাম, শরীর তাহলে পুরুষ?
-শরীর পুরুষ ঠিকই, তবে প্রকৃতি কর্তা। প্রকৃতির গুণেই শরীরকে পুরুষ হিসেবে ধরে নেওয়া।
বললাম, তাহলে খ্যাপা সেই অনুমানের ধর্মই তো হল আমাদের?
অনুমান কী প্রকারে? শরীরকে ঘিরে অনুমান। শরীর তো বর্তমান। বর্তমানের ভেতর আমাদের অনুমান। অন্বেষণ। নিরাকার আল্লাহকে পুরুষ জ্ঞান করে বর্তমান সাকার শরীরে এনে তাকে কর্তা জ্ঞান করে তার গুণ বিচার করা। অধরাকে ধরবার জন্য আমাদের প্রাকৃতিক চিহ্ন।
বললাম, মানে ভেদাভেদ!
—হ্যাঁ ঠিক তাই। শরীরের কর্মঠ প্রকৃতিকে পুরুষের সাকাররূপে এনে প্রকৃতি-পুরুষের অভেদত্ব জ্ঞানই হল আমাদের ঘরের সাধনা। লবান শাহ আমাকে তা হাতে ধরে শিখিয়ে গেছেন খ্যাপা।
কর্তাভজারা গুরুকেই ‘কর্তা’ বা ‘মহাশয়’ নামে অভিহিত করে থাকেন। মানবদেহস্থিত পরমতত্ত্ব বা আত্মার সন্ধান তারা বিশ্বাস রাখেন গুরু নির্দেশিত পথেই একমাত্র হতে পারে। নচেৎ কোনোভাবে আর সম্ভব নয়। আত্মাকে তারা নামে নামেও ভূষিত করেন। ‘সহজ মানুষ’, ‘মনের মানুষ’, ‘ভাবের মানুষ’, ‘অধর মানুষ’, ‘আলেক’, ‘সাঁই’, ‘কাঙ্গাল’ ইত্যাদি নানা নামেই এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা আত্মাকে চিহ্নিত করে থাকেন। আর এগুলো সবই কিন্তু হল গিয়ে বাউলভুক্তির শব্দ। এই পথে সাধনপদ্ধতিতে ভজন প্রসঙ্গটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ভজনা এখানে সেই বাউলভুক্তির মানুষের হয়ে থাকে। কেননা মানুষই অভেদত্বে একমাত্র যেতে পারেন। মানুষই ঈশ্বরের উপলব্ধিকে তার দেহে রাখতে পারেন। সেজন্যই সহজিয়া ধর্ম মেনেই কর্তাভজারা তাদের সাধনসংগীতে সেই মানুষেরই জয়ধ্বনি দিয়েছেন। বলেছেন, ‘মানুষ ভজ, মানুষ চিন্ত, মানুষ কর সার / সকলি মানুষের খেলা, মানুষ বই নাই আর।‘ সাধক লালশশীর এই উপলব্ধিও মানুষের ভেতর আত্মা ও পরমাত্মার অভেদত্বকেই স্পষ্ট করে। লালনের ঘর মানুষের মধ্যেকার অভেদত্বকে ভিত্তি করেই কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে। সে কারণেই সতী মা’র ঘরকে লালন ঘরের মানুষেরা শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। সতী মা’র ঘর চৈতন্যদেব এবং তাদের সম্প্রদায়ের প্রবর্তক আউলচাঁদের মধ্যে অভেদত্বর কিংবদন্তি চাপানোর ফলেই বোধহয় কর্তাভজাদের চৈতন্য-নিত্যানন্দ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন অক্ষয়কুমার দত্তের মতো ক্ষেত্রানুসন্ধানী গবেষকও। এটি বেশ আশ্চর্যেরও বটে। তিনি ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ নামক সেই মহামূল্য লোকায়ত আকর গ্রন্থে লিখেছেন, ‘…বাঙ্গালাদেশে চৈতন্যসম্প্রদায়ের অনুরূপ অথবা উহার শাখা স্বরূপ আর একটি সম্প্রদায় সংস্থাপিত হইয়াছে, তাহার নাম কর্তাভজা। দীনেশচন্দ্র সেনের মতো ঐতিহাসিক পর্যন্ত বৈষ্ণব শাখার সঙ্গে কর্তাভজাদের জুড়ে দিয়েছেন, যেটা কিনা আরও আশ্চর্যের। সম্প্রদায়ভুক্তরা মনে করেন যে চৈতন্যদেবই আত্মগোপন করে দীর্ঘদিন বাদে নবরূপে প্রকট হয়ে এই ধর্মমতের প্রবর্তন করেন। কিন্তু এটা তাদের মাথাতে আসে নানীলাচলে চৈতন্যের সেই অন্তর্ধান রহস্যের প্রায় ১৬১ বছর পর কীভাবে তিনি আউলাদ হয়ে ফিরে আসবেন। কিংবদন্তি চৈতন্য-আউলকে এক করেছে ঠিকই, তথাপি এই দুই সম্প্রদায় ভাবগত দিক থেকে এক নয়। ধর্মীয় মতবাদ, সাধনপদ্ধতি, আচার-অনুষ্ঠান যথেষ্টই আলাদা। দুই ধর্মপথের উদার মানবিক দিকটি একসূত্রে গ্রন্থনের একটা দিক হলেও গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম মূলত ভারতীয় বৈষ্ণবতার একটি শাখা বই আর কিছুই নয়। সহজিয়া বৈষ্ণবদের সঙ্গে কর্তাভজাদের সাধনপদ্ধতিতে কিছু মিল রয়েছে এটা মানা যেতে পারে। তবে সহজিয়া তো কোনো ধর্ম সম্প্রদায় নয়। এটি সুপ্রাচীন কাল ধরে বয়ে আসা একটি সাধন পদ্ধতি। যেখানে প্রকৃতি-পুরুষের মিলিত দেহকেন্দ্রিক চর্চায় মানুষে-পরমে অভেদত্ব আসে। বৈষ্ণবাচার্য বীরচন্দ্ৰ আউলচাঁদের শিষ্য মাধববিবির কাছ থেকে শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সহজিয়া সাধনতত্ত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন, এই কিংবদন্তির কারণেই বোধহয় সহজিয়া কর্তাভজা একীভূত হয়েছেন। বৈষ্ণবতার সঙ্গে কর্তাভজাদের গুলিয়ে ফেলবার উদ্ভব এখান হতেই হয়েছে বলে মনে হয়। আসলে যেটা হয়েছে সহজিয়া স্রোতে তন্ত্র বা সঠিক করে বললে দেহভিত্তিক যোগক্রিয়ার ব্যাপারটি প্রথম থেকেই ছিল। বৌদ্ধ সহজযান ধর্মসাধনার ছোঁয়াও তাতে যেমন লেগেছিল, তেমনই বৈষ্ণব রাগাত্মিকা প্রেমসাধনাও এতে একীভূত হয়েছে। এমনকি ইসলাম বেশরিয়তি সুফিতত্ত্বও সহজিয়া স্রোতে যুক্ত হয়েছে বলেই কর্তাভজাদের সঙ্গে ইসলামও জুড়ে গেছে। এই সমস্ত জোড়াজুড়ির প্রধান কারণ হল, এইসব ধর্মমত সবই দেহাচারমূলক ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। আর সব গিয়ে কর্তাভজা ঘোতে মিশেছে তার সবথেকে বড় কারণ হল আঠারো শতকের মধ্যভাগে প্রতিষ্ঠিত এই লোকায়ত ধর্মমতে পরবর্তীতে সমাজের উচ্চবর্গীয় স্রোতের দাপট চোখে পড়বার মতো। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, সন্তুদাস বাবাজির মতো প্রতিষ্ঠিত ধর্মগুরুরা পর্যন্ত একসময় ঘোষপাড়ার কর্তাভজা সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুদের কাছে নাড়া বেঁধেছিলেন। উনিশ শতকে ইউরোপীয় মিশনারিরাও কর্তাভজাদের মেলাতে এসেছিলেন। উইলিয়াম ওয়ার্ড তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Account of the writ ings, Religion and manners of the Hindoos’-a az qacerata সম্পর্কে মতপ্রকাশ করেন। ওয়ার্ডের সমকালে উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান, আলেকজান্ডার ডাফ পর্যন্ত ঘোষপাড়াতে এসেছিলেন, ১৮৪৬ সালের ‘Calcutta Review’-তে এ তথ্যও উজ্জ্বল রয়েছে। সম্প্রদায়ভুক্ত হারাধন মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘সত্যস্রোত’ গ্রন্থে তাদের বয়াতি রামনারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে রামমোহন রায়ের ঘোষপাড়াতে আসার বিবরণ দেন। ঈশ্বর গুপ্ত, অক্ষয়কুমার দত্ত, নবীনচন্দ্র সেনদের লেখাই প্রমাণ করে যে তারা ঘোষপাড়া সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তবে ঘোষপাড়ার সাধন নিয়ে বিরূপ মন্তব্য ভেসে এসেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখ থেকে। নবীনচন্দ্র সেনকে তিনি বলেছিলেন, ‘কর্তাভজাদের মেলা! শুনিয়াছি, উহা বড় জঘন্য ব্যাপার।’ আর ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব ঘোষপাড়ার সাধন পদ্ধতি সম্পর্কে আগত ভক্তদের সাবধান করে দিয়েছিলেন, ‘হরিপদ ঘোযপাড়ার এক মাগীর পাল্লায় পড়েছে। ছাড়ে না। … আমি অনেক সাবধান করে দিয়েছি। …কী জান? মেয়েমানুষ থেকে অনেক দূরে থাকতে হয়, তবে যদি ভগবান লাভ হয়। … এরা সত্তা হরণ করে।’ যুগল সাধনা বরাবরই এইসব বদনামের শিকার হয়েছে। কাম-কামনার মধ্যে অপরকে আস্বাদনের তীব্র শারীরিক আকুতিকে যে পরমাবস্থা বা শরীরের যোগ যৌক্তিক অভেদত্বের ভেতর এনে একেবারেই পারমার্থিক প্রেমের উৎসবে মিশিয়ে দেওয়া যায় আর তা একটা দম-শাসের কৃৎকৌশল—এটা ধরতে অনেকেরই অসুবিধের কারণ সেই নারী-পুরুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি-প্রক্রিয়ার স্মরণ। আর তা করতে গিয়েই লিঙ্গগত, যৌনগত রাজনীতির দিকে গড়িয়েছে লোকায়ত সাধনের ধারা। তথাপি তারও যে প্রবল নামডাক বাংলার মনীষাদের সমালোচনা শিল্পই তার প্রমাণ। এর থেকে অনুমেয় সতী মা’র ধর্ম কীভাবে সেই সমসময়ের মনীষী ও সাধক সংযোগে অনন্য হয়ে উঠেছিল। না হলে তাকে নিয়ে এত মাতামাতিই বা থাকবে কেন? ফলস্বরূপ লোকায়ত সাধনের নানা স্রোত সে সময় সতী মা’র ধারাতে মিশে যেতে চেয়েছে বোধহয় বৃহত্তম সমাজের অনুশাসন থেকে রক্ষা পেতে। কেননা সতী মা’র ধর্ম সমাজের সেই চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করেই এগিয়েছে। লালনের ঘরের সঙ্গে আবার সতী মা’র সাযুজ্য কিন্তু এখানেই। জীবদ্দশাতেই ফকির লালন শাহ কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন। তার গান আর উপলব্ধি দুটোই নিজস্ব ভক্তশিষ্যমণ্ডলীর বাইরেও যে আদৃত ছিল তা তো তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদের তার আখড়াতে যাতায়াতের বহরটি দেখলেই বোঝা যায়। আবার এই বহরটি লালনকে শ্রীচৈতন্যের বাইরে এনে দাঁড় করলেও শ্রেণিগত বিভাজন যে লালন ঘরের কিংবদন্তিতে লেগেছিল এটা তো ঠিক। তার ভক্তশিষ্যরা কোনোভাবেই উচ্চকোটির সংস্কৃতির মানুষজন ছিলেন না। সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণিও যে তার আখড়াকে খুব একটা নেকনজরে দেখত তা নয়। লালন বিশ্বাস রাখতেন করণে। আর এই করণ শরীরগত আচরণ বই তো আর কিছু না। শরীরের সেই আচরণ হল গিয়ে লিঙ্গ প্রক্রিয়াকে রুখে দেওয়া। নারী-পুরুষের কোনোপ্রকার লিঙ্গকেন্দ্রিক আচরণ এই ঘর বরদাস্ত করেনি। সৃষ্টিকাজ যে কারণে নিষিদ্ধ বলেই গ্রাহ্য ছিল। প্রাকৃতিকতাকে পুরোপুরি অস্বীকার করে লালনের ঘর নারী-পুরুষের মধ্যেকার জৈবিক তাড়নাকে নষ্ট করে দিয়ে মানুষের স্বাভাবিক আবির্ভাবকেই গ্রাহ্য করেছিল। সেই স্বাভাবিকতা ছিল প্রকৃতির মধ্যে যে অখণ্ড প্রকৃতির ধারা, তাকে অখণ্ড রেখেই প্রকৃতির উজানে ফিরে যাওয়া। নিম্নগামী না হওয়া। এভাবেই পুরুষের জৈবিক স্বলনকে ব্যর্থ করে দিয়ে শরীরের ভেতর সহজ মানুষের আবির্ভাবকে বরণ করে নেওয়া। যার ভেতর যৌনগন্ধ থাকলেও যৌনতাকে অস্বীকার—এই ভাব প্রচলিত সংস্কারের প্রবলরূপে বিরুদ্ধাচরণ করেছিল বলেই ফকির লালন শাহ এবং তার আখড়া লালনের জীবদ্দশাতেই কখনও কলঙ্কমুক্ত ছিল না। ফকির লালন শাহকে অনেক যুদ্ধ করেই উচ্চকোটি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির আঁচ বাঁচিয়ে টিকে থাকতে হয়েছিল। চৈতন্যদেবের ক্ষেত্রে সেটি হলেও সেখানে যৌনচর্চার কোনো গন্ধ ছিল না বলেই তার সাধনায় ব্যভিচার, কামাচারের প্রলেপ পড়েনি কোনো। যে কারণে মনে হয় লালনের লড়াইটা আরওই মারাত্মক ছিল। শ্রেণি বায়োগ্রাফির একটা ব্যাপার ছিল। যতই তিনি সেটিকে অতিক্রম করতে চান না কেন। সুতরাং এইসব সামাজিক আহাওয়ার ভেতর তার জীবন ফুলের বিছানা হয়ে যায়নি। যে কারণে মনে হয় জীবদ্দশাতেই তার বহু বহু ভক্তের কলতানের কথা শোনা গেলেও বোধহয় খুব বেশি ভক্তপরিমণ্ডলবেষ্টিত হয়ে বসেছিলেন ফকির লালন শাহ এটা অন্তত আমার মনে হয় না। বরং বলা যায় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা তাকে নিয়ে তার মৃত্যুর পর করবার সময়ে ভক্তসংখ্যা সে সময় বাড়ার একটা সংগত কারণ থাকতে পারে। চৈতন্যের তিরোধানের পর বাংলার বৈষ্ণব সমাজে যে দিশেহারা দশা চলেছিল সেই দশা খানিকটা দিশাতে গিয়েছিল নিত্যানন্দ প্রভু বেঁচে থাকার কারণে। কিন্তু লালনের তিরোধানের পর তার দুই শিষ্য মনিরুদ্দিন শাহ ও ভোলাই শাহের ঝগড়া-বিবাদের মাঝখানে দিশা দেওয়ার মত যোগ্য মানুষের অভাবেই লালনের ঘর তখন ঝগড়া, ঝামেলা, মনকষাকষি, একজনের বিরুদ্ধে অন্যজনের নিন্দা ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এখনকারও লোকায়ত সাধনার বৃত্ত আঠারো শতকের শেষার্ধের সেই লালন পরিমণ্ডল থেকে খুব একটা বেরিয়েছে বলে আমার অন্তত মনে হয় না। আমরা লোকায়ত সাধনার ভাব ও ভাবুকতাকে এখনও ঠিকভাবে ধরতেই পারিনি। সেজন্য একে মূলধারা থেকে পৃথকই করে রেখেছি। লোকায়ত সাধক আমাদের কাছে ভীষণই অনাধুনিক, কিন্তু তার গান যেহেতু আজ নেহাতই কেবল বাউলিয়াপনার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সেহেতু তার যেমন খুশি শব্দ-বাক্য বদলিয়ে, ওপরের অন্তরা পরে, নীচের অন্তরা আগে—এইভাবে ইচ্ছামতো ওলোটপালট করে দেদার বিকোচ্ছে ক্যাসেট-সিডিতে। আমাদের প্রজন্মের কাছে লোকায়ত সাধকের কদর বেড়েছে বোধহয় কেবল তার নেশাদ্রব্য ও অবাধ শরীর ব্যবহারের স্বাধীনতায়। এখানে এসে আমরা অনেকেই তাই অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়েছি আমাদেরই সমাজজীবনের কঠোর বাস্তবতার মারপ্যাচে। আবার কিছুদিন থেকে, নেশা করে, কেউ বা সাধিকা বা গুরু মা’র পালিতা আশ্রমকন্যার শরীরের আংশিক কিছু স্বাদ পেয়ে মূলস্রোতে ফিরে গিয়ে কেবলই টিপ্পনি কেটেছি। বুঝিনি, উপলব্ধি করিনি দেহকে ঘিরে, শরীরকে দিয়ে নিরাকারের সাকার রূপ পরিগ্রহণের এই ধর্মকে। বুঝিনি তার সাধনকেন্দ্রিকতার গানকে। সেখানকার প্রজ্ঞা বা জ্ঞান, উপলব্ধি কিছুই আমাদের টানেনি। কেননা আমরা আমাদের প্রবল আধুনিকতা নিয়েও এখনও সেই বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা উৎপাদনে তৎপর মানুষ। আত্মপরিচয়ের জায়গায় আছে আমাদের রক্তপাত, বিভেদ, বিরহ, ব্যথা, সংগ্রামের যাবতীয় অমীমাংসা। আমরা তাই সামাজিকবিধান, আইন থেকে দূরে থাকা এইসব মানুষদের বরাবরই সন্দেহের চোখেই দেখেছি। এরা এদের নিরক্ষরতা, দারিদ্রতার ভেতর কীভাবে অসাম্প্রদায়িক চর্চায় ব্রতী হতে পারেন আমরা তা ভেবে পাইনি। আমাদের ভাবারও অবকাশ নেই। আমাদের আছে কদাচার আর বিকার। গেঁজেল ও নেশাখোরদের দমসাধনা দেখে আমরা লোকায়ত সাধককে সবসময় বিচার করেছি। তাই তাঁর ভাবের নেশা আমাদের চোখে পড়েনি। এভাবে আঠারো-উনিশ শতকের লোকায়ত পথের আবর্জনা একুশ শতকে আরও স্তুপীকৃত জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। তবু তারও ভেতর থেকে উঁকি মারছেন এই এখনও কোনো না কোনো লোকায়ত সাধক কিংবা তার বয়ে আনা কোনো গান।
ফকির লালন শাহ চৈতন্যদেবের লৌকিক উদারতাকে চিহ্নিত করে। দিয়েছিলেন তার গৌরগানে। তিনি গৌরকে শরীরের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত দিয়েছিলেন। এই ভাব চৈতন্যজাত চৈতন্য হয়ে উঠেছিলেন। হয়ে ওঠাটি করণ বা শরীরকেন্দ্রিক। সতী মা’র ঘর চৈতন্যদেবের সেই হয়ে ওঠাটিকেই মোক করেছিল। সেই একই ভাব লালন ধারণ করেছিলেন বলেই একেবারে স্পষ্ট বোঝা যায় শুধুমাত্র এই হয়ে ওঠাটিকেই চিহ্নিত করতে তিনি সতী মা’র ঘরকে প্রাধান্য দেন। মজনু শাহ ফকিরও কিন্তু তাই দিয়েছিলেন। হেঁউড়িয়ার সেই ফকির বলেছিলেন গুরুর মান্যতায় তাদের তৃতীয় ঘর হল পাঞ্জু শাহের ঘর। লালনের সমকালে ও পরবর্তীকালে পাও সারা বাংলার বাউল ফকিরমহলে একজন প্রধান ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বেঁচেও ছিলেন দীর্ঘকাল। লালনের মৃত্যুর পর থেকে প্রায় পঁচিশ বছর যাবৎ তিনি লালনের অপূর্ণতা অনেকখানি পূর্ণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন তান্ত্রিক সাধক ও গীতিকার। অভিজাত বংশেই তার জন্ম। লালনের মতো দুর্বিপাকে গোত্রহীন তিনি কখনও নন। গোড়া মুসলিম পরিবার বলেই আরবি-ফারসি পাঠ তার নখদর্পণে ছিল। তথাপি বাংলার মরমি সাধনা তাকে টেনেছিল বলেই তিনি পরবর্তীতে ফকিরি জীবন বেছে নেন। পাঞ্জু লালনের মতোই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মসাধনার বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। তার গানে জাতি-বর্ণের আচরণ থেকে বেরিয়ে আল্লা-ঈশ্বর মতবাদ দূরে ঠেলে সেই জীব ও পরমের অভেদতত্ত্বটিইউঠে এসেছিল বলেই বোধহয় ফকির লালন শাহ তার ঘরকেও নিজ বারামে শামিল করে নিয়েছিলেন। চতুর্থ ঘর উজল চৌধুরি ও তার শিষ্য জহরউদ্দিন শাহের ঘর। চৌধুরিদের ঘর বলেই সেটি চিহ্নিত। মজনু শাহ ফকির তাই-ই বলেছিলেন। জহরউদ্দিনের গানে সুফি ভাবের সমালোচনা আছে। তবে তার গানে আরবি-ফারসি শব্দের বহু ব্যবহার বলে অনেকে এই ঘরকে সুফি ভাবধারার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। লালন, জহরউদ্দিন দুজনেই তাদের গানে নবীন তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন ইসলামকে দূরে রেখে। ইসলাম সম্পর্কে তাদের ব্যাখ্যা বাংলার ভাব, ভাষা, সংস্কৃতির মধ্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। ইসলামকে তারা মোকাবিলা করেছেন আরব দেশে বসে বা আরবি ভাষাকে শিরোধার্য করে নয়। আরবের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে ইসলামকে বের করে এনে নদিয়ার প্রবাহমান ভাবের সঙ্গে তাকে তারা মিশিয়ে দিয়েছিলেন বলেই ইসলামে যেমন বাংলার সংস্কৃতির ছোঁয়া লেগেছিল, তেমনি সেই ছোঁয়াতে বেদ-কুরান বিরোধিতারও একটা জায়গা ছিল। যে বিরোধিতা থেকেই আলাঈশ্বর ভজনা পাশ কাটিয়ে মানুষ ভজনা তাদের মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কেননা জীবের মধ্যে মানুষই একমাত্র দেহগত সাধনার বলে পরমে মিশে যেতে পারে। এই হয়ে ওঠা আল্লা ও ঈশ্বরের সঙ্গে অভেদের মীমাংসাকেই জন্ম দেয়। জহরউদ্দিন তার গানে এই মীমাংসাকেই আরবি-ফারসির দোটানায় বাংলার লোকায়ত ভাবে এনে ফেলেছিলেন বলেই তার গান নিয়ে একটা সুফি তরিকার সংশয় কাজ করেছিল বোধহয় সে সময়। লালন যেজন্য তার নিজের ঘরের সঙ্গে চৌধুরিদের ঘরকে জুড়ে রেখেছিলেন। শেষ ঘর হল দেলদার শাহের ঘর। এই ঘরে পাটনার শাস্ত্রীয় সংগীত ঘরানার একটা আমেজ আছে। লালনের গানের মধ্যেও জয়জয়ন্তী, সিন্ধুভৈরবী, বৃন্দাবনী সারং ইত্যাদি ক্ল্যাসিকাল ঘরানার ছাপ সুস্পষ্ট। দেলদার শাহের গানে লালন ঘরের একটা প্রভাব কাজ করেছিল অবশ্য তারই স্বতন্ত্র মুনশিয়ানায়। তার শিষ্য বেহাল শাহের গানে লালন ঘরানা আরও যেন সুতীব্র। যেজন্য এ ঘরও লালন ঘরের অন্তর্ভুক্ত। এই পাঁচটা ঘরকে একসঙ্গে লালনের ঘর বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। আর এই পাঁচ ঘরেই কিন্তু গৌরাঙ্গের গৌর হয়ে ওঠাটা বেশ বর্তমান। নারী-পুরুষসত্তা ভেদ করে এই পাঁচ ঘরই একটা আলাদা আইডেন্টিটির জন্ম দিয়েছিল। যে আইডেন্টিটি তৎকালীন প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে দাঁড়িয়েছিল।
ঘোষপাড়ার বাউলদের এই ঘর নিয়ে কখনও কোনোরকম মাথাব্যথা আমি অন্তত দেখিনি। তারা যে এই ঘর সম্বন্ধে খুব একটা ওয়াকিবহাল তাও বোধহয় না। কেননা ঘোষপাড়ার বাউলরা দু-একজন বাদে কেউই সাধক বাউল নন। কখনও ছিলেন না। সতী মা’র মন্দিরের চারপাশ জুড়ে যে বাউল পাড়া সেখানকার বাউলরা সব উদ্বাস্তু হয়ে এখানে এসে ওঠেন। কেউ কেউ আবার জাতে ওঠার জন্যও এখানে একেবারে জায়গাজমি কিনে পাকাপাকি বসবাস করেন। গৃহী, রীতিমতো সংসারী এইসব বাউলেরা যে কর্তাভজা সম্প্রদায় সম্পর্কেও খুব একটা কিছু জানেন তাও নয়। কর্তাভজা সাধন এখন গৃহসাধনাতেই কেবল আটকে। সতী মা’র ঘর বংশপরম্পরা মেনে এবং ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে চলছে। সেখানে সকাল-সন্ধ্যায় গুরুভজন, শুক্রবার পালন, বিশেষ উৎসব-অনুষ্ঠান ছাড়া আর কিছু পালনীয় নয়। উপলক্ষ্যেই সেখানে কেবল ভক্তশিষ্যের সমাগম হয়। তারা কেবল এখন মেনে চলেন আউলাদ প্রবর্তিত সৃষ্টাচার। দেহধর্ম পালনের চর্চা সেখানে আর নেই। আমি অনন্ত ঘোষপাড়ায় তেমন কোনো সাধক দেখিনি। দেখেছি মহাশয়দের। যাঁরা বয়াতিদের দীক্ষা দেওয়ার সময় আচরণীয় বিধিদেশ যেমন—পরীতে গমন না করা, পরদ্রব্য হরণ না করা, পরহত্যার কারণ না হওয়া, মিথ্যে না বলা, দুর্ব্যবহার না করা, প্রলাপ না বকা, জীব হত্যার চিন্তা না করা—এইসব কায়ধর্ম, বাক্যধর্ম, মনধর্ম বলে দিয়ে থাকেন। তবে ভজন সংগীতে লালশশীর গান গাওয়ার চল আছে। সেই গানের উপলব্ধ সাধন প্রণালীর পথের আর অনুসরণ নেই। লালশশীর গান ঘোষপাড়ার বাউলরা গেয়ে থাকেন। ঘোষপাড়ার সাধক বাউল বলতে ছিলেন কেবল নবকুমার দাস ও তার সাধনসঙ্গিনী কৃষ্ণা দাসী। যখন আমার ওঁদের সঙ্গে আলাপ, জোড় ভেঙে গেছে। নবকুমার অন্য সাধনসঙ্গিনী জোগাড়ও নাকি করেছিলেন। সে জোড়ও টেকেনি। আমি যখন নবকুমারের কাছে গিয়েছিলাম তিনি তখন বিয়ে করে ঘোর সংসারী। ওদিকে কৃষ্ণাকেও দেখেছিলাম তিনিও শাখা-সিঁদুর পরা এক স্বাভাবিক রমণী। বাউল গানের দল খুলেছেন। পাঁচ পুরুষের দলকে একা হাতে সামলাতেন কৃষ্ণা। কৃষ্ণার জামাই তখন দলে বাঁশি বাজাতেন। মেয়েও গাইতেন। কৃষ্ণা চলে যাওয়ার পর জামাই এখন দল ম্যানেজার। মেয়ে সে দলের প্রধান গায়িকা। নবকুমারের বেশি বয়সের বিয়েতে সন্তানাদি না আসায় তিনি চলে যাওয়ার পর তার দল এখন শিষ্যসামন্তদের হাতে। দোলমেলায় আমতলাতে বোসড়ো আখড়া করতেন নবকুমার। নানা জায়গার বাউল এসে ঘোষপাড়ার মেলার তিনদিন উঠতেন এই আখড়াতে। দু-একজন সিদ্ধ বাউলের দেখাও পেয়েছি আমি নবকুমারের আখড়াতে। মহাজনি পদ বিশ্লেষণে যাঁদের জুড়ি মেলা ভার। তাদের তত্ত্বকথাই বলে দিচ্ছিল বাউল সাধনের অনিবার্য পরম বা সহজানন্দের দ্যুতি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। নবকুমারের আখড়ার সেই বহর এখন আর নেই। তার ভক্তশিষ্যরা গুরুর জমির ওপর ঘাঁটি গেড়েছেন এই যা। দলের সুনামও তেমন এখন নেই। নবকুমার কৃষ্ণার সঙ্গে জোড় ভেঙে যখন সংসারী হলেন তখন থেকে গানকেই পেশা করলেন। সঙ্গে জুড়েছিল গুরুগিরি। জাতি-বৈষ্ণবভাবাপন্ন নবকুমার এরপর থেকে দীক্ষা দিতেন। স্ত্রী-ও হয়ে উঠলেন গোঁসাই মা। তার স্ত্রী বোধহয় এখনও গোঁসাই মা’র ভেকেই রয়েছেন। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে একলা গ্রামবাংলার অসহায়া রমণী এর বেশি আর কী-ই বা করতে পারেন। পরবর্তীতে নবকুমার গায়ক বাউল হলেও যুগল সাধনা তিনি একসময় করেছিলেন। বাউল সমাজে সেই সাধনভজনের কদর ছিল। অনেককেই বলতে শুনেছি নবকুমার কৃষ্ণার জুড়ির কথা। জোড় ভেঙে যাওয়ায় সে কথার ভেতর তাদের আপশোসও ঝরে যেতে দেখেছি। তবে একটা বিষয়ে ঘোষপাড়াকে বদহাই দেওয়া দরকার সেটা হল নবকুমারের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর একলা নারী কৃষ্ণার সামাজিক অবস্থানটি নিয়ে। ঘোষপাড়া বাউলবৃত্ত হলেও সেখানে সংসারী মানুষজনের বাস। নবকুমার কৃষ্ণা সাধক ও সাধনসঙ্গিনী হিসেবে ঘোষপাড়ার আখড়ায় ছিলেন। সেখান থেকে সরে এসে সেই ঘোষপাড়াতে কৃষ্ণার একলা অবস্থান, বাঁচা, লড়াই, জীবনযাপন ঘোষপাড়া মেনে নিয়েছে। কৃষ্ণা একজন সাথি পেয়েছিলেন যিনি তাকে পরবর্তীতে সম্মান দিয়েছিলেন। তাকে বুঝবার চেষ্টা করেছিলেন। তার জমির হাতায় কৃষ্ণার ঘর। কৃষ্ণার মেয়েকে তিনি দাড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়ে বাবার কর্তব্য পর্যন্ত করেছেন। এখনও কৃষ্ণা চলে যাওয়ার পর কৃষ্ণার মেয়ে-জামাইকে তিনিই পিতৃস্নেহে আগলিয়ে রেখেছেন। নবকুমারের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর কৃষ্ণা বিয়ে করে সংসারী হয়েছিলেন কেবলমাত্র সামাজিক নিরাপত্তায়। এসব কৃষ্ণাই আমাকে বলেছিলেন। কিন্তু সেই মানুষটি তাকে একটি কন্যা উপহার দিয়ে নিরাপত্তার সিঁদ কেটে ভেগে গিয়েছিলেন। বাউল মতের কৃষ্ণা মনের মানুষ পেয়েছিলেন পরবর্তীতে যাকে কেন্দ্র করে তার নাম কৃষ্ণা কখনও আমাকে বলেননি। কৃষ্ণা শাখা খোলেননি, সিদুরও ছাড়েননি জীবনের শেষদিন অবধি। ঘোযপাড়া তাকে রক্ষিতার নজরে দেখেনি কোনোদিন। দেখেছে তাকে কেবল পেশাদার বাউল গায়িকা হিসেবে। নবকুমারকে টেক্কা দিয়ে কৃষ্ণা দল গড়েছেন। খ্যাতি পেয়েছেন। তার সংগ্রামকে ঘোষপাড়া স্যালুটই দিয়েছে। প্রথম যেদিন আমি নবকুমারের সন্ধানে গিয়ে পড়েছিলাম সেখানকারই মানুষজনের কাছে, কৃষ্ণার কথা জিজ্ঞাসা করতে তারা সম্মানের নজর নিয়ে কথা বলেছিলেন, কৃষ্ণা দাসী? তিনি আর নবকুমারের সঙ্গে থাকেন না। ওই গলি দিয়ে চলে যান। শেষ মাথায় কৃষ্ণা দাসী বাউলের বাস। সাধনসঙ্গিনীর এই সম্মান আমাকে মুগ্ধ করেছে। আশ্চর্যের যেটা, প্রাচীনপন্থী সাধিকারা যারা কেবল আশ্রমে-আখড়ায় শত অপমান, লাঞ্ছনা সহ্য করে সাধকের সঙ্গে থাকার পক্ষপাতী তারা কৃষ্ণাকেই কেবল গালমন্দ করেছেন। এ আমার নিজের চোখে দেখা। নবকুমার তাদের চোখে যেন ধোয়া তুলসীপাতা। বাউল সঙ্গিনী বদলাতেই পারেন, কিন্তু বাউলানির তা মেনে হয় আশ্রম-আখড়ায় পড়ে থাকা, নয় পরিত্যক্ত সঙ্গিনী হয়ে মাধুকরীতে জীবনধারণ কিংবা নতুন সাধকের খোঁজ—এই তিন ভিন্ন যেন আর জীবন নেই। একলা নারীর গান বাউল বাগান বাড়ির সদস্যরা কখনোই মেনে নিতে পারেননি প্রথম প্রথম। কৃষ্ণাকে তাই তারা মানতে পারেননি। পারেননি নদিয়ার আর এক নারী সুমিত্রাকেও। তবে এই নারীরাই দেখিয়েছেন গায়কের মতো তারাও গানকে সঙ্গী করে একা বাঁচতে জানেন। বাউলের নারী চরণদাসী, তার গান আশ্রম-আখড়ায়, মঞ্চে নয়, সরকারি ঝলসানিতে নয়—এই ধারণা ভেঙেছেন কৃষ্ণা, সুমিত্রাই। সাধকের কাছ থেকে অসম্মানিত হয়ে, দাগা খেয়ে, ব্যথা পেয়ে এই নারীরা গানকে ভালোবেসে তারই সাধনা করে দাপট নিয়ে আছেন। কৃষ্ণা চলে গেছেন। আছেন সুমিত্রা। এঁদেরও অগ্রবর্তিনী রাধারানি, ফুলমালা, কালীদাসীরাও তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গিয়ে গেছেন। সাধকের সাধনার নামে নারীকে ব্যবহার বড়োবড়ো গালগল্প দিয়ে এসব পরবর্তীতে আর মেনে নেননি এইসব জেহাদি নারী সাধিকারা। তারা গানকে সত্য মেনে, ধ্রুবকরে এগিয়েছেন। বয়স্কা রাধারানির তার অবস্থান নিয়ে আপশোস থাকলেও ভাগ্যদোষ বলে মেনে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন আমাকে, নবনী দাসের মেয়ে আমি, পূর্ণর দিদি। গান আমার রক্তে বয়, অথচ দ্যাখো কেউই গাইতে ডাকে না। রাধারানির গান বীরভূমের বাইরেই বেরোতে পারেনি কোনোদিন। মাধুকরী সম্বল এই মহিলার ইচ্ছে ছিল কলকাতাকে গান শোনানোর। তার সে ইচ্ছে সফল হয়নি। ব্যক্তিগত আগ্রহে কিছু মানুষজনদের কাছে রাধারানির গানের সংগ্রহ আছে। কিন্তু তাঁর গানের ক্যাসেট-সিডি না থাকার দরুন সেসব বিপুল ভাণ্ডার হারিয়েই গেছে। এ আমাদেরই দুর্ভাগ্য। ফুলমালার ক্ষেত্রেও আদতে তাই হবে। এখন অতি বৃদ্ধা হয়েছেন ফুলমালা। তাকে আমি ট্রেনেও গাইতে শুনেছি। জয়দেবের মেলায় দাপটের সঙ্গে একসময় গাইতেন একখানা একতারা হাতেই। বাউলরা কেউ সংগতে এগিয়ে আসতেন না। এ আমার নিজের চোখে দেখা। সমস্ত অসহযোগিতার ভেতর থেকে তবু ফুলমালা যা গাইতেন তা দেখে দক্ষ বাউল শিল্পীও অবাক হয়ে যেতেন। সেই ফুলমালাও প্রচারের আলো পাননি। কলকাতা একবার দু-বার তার গান শুনেছে কেবল। বীরভূমের আহমেদপুরের ভাঙা পরিত্যক্ত রেল কোয়ার্টারে ফুলমালার বাস। তিনি এখন প্রায় অথর্ব হয়ে আপশোস নিয়ে এখানকার থেকেও আরও বড়ো কোনো ইন্দ্রসভায় গান গাইবার জন্য দিন গুনছেন। সদ্য আমি তাকে দেখে ফিরেছি। চিকিৎসার জন্য তার অর্থের প্রয়োজন। একটু সেবা, পথ্য, সুচিকিৎসা পেলে বোধহয় ফুলমালা তার বিবাগী বহীন গলাতে এখনও বিপুল গানের ভাণ্ডার উজাড় করে মণিমুক্তো দিতে পারেন। আমি জানি সেটা আমাদের চরম উদাসীনতায় আর সম্ভবপর হবে না। এই ফুলমালাই জেহাদ তুলেছিলেন। কেঁদুলির সরকারি মঞ্চে তাকে গাইতে না দিতে চাইলে তিনি উদ্যোক্তাদের বলেছিলেন, ‘ওসব হবে না বাবু। বাউলেরা নেচেকুঁদে মঞ্চ মাতাবে, বিদেশে যাওয়ার মতলব আঁটবে আর আমরা আশ্রমে টুংটুঙি বাজাব। আমরা দেখাতে চাই যে আমরাও গাইতে জানি। জোর করে প্রোগ্রাম ছিনিয়ে নিতেন ফুলমালা। এমন দাপট ছিল আরও একজনের। তিনি হলেন নদিয়ার ঘূর্ণির কালীদাসী বৈষ্ণবী। জেলা অফিসে মাঝে মাঝে গিয়ে দরবার করতেন একাকী এই মহিলা। গাইবার জন্য হন্যে হয়ে ফিরতেন। কী তার গায়নশৈলী। মহাজনের পদ, ব্যাখ্যা ও গায়ন সহযোগে আসরে এক নৈসর্গিক পরিবেশ সৃষ্টি করতেন কালীদাসী। তার সম্পদও আমরা ধরে রাখতে পারিনি। কৃষ্ণা বেতার-দূরদর্শনে গেয়েছেন। কলকাতার রবীন্দ্রসদনে অনেকবারই তিনি শ্রোতাদের মুখোমুখি হয়েছেন। ক্যাসেট, সিডি-ও আছে তার। মাধবপুরের সুমিত্রা এখনও নিজের জেলা নদিয়াসহ বাকি ষোলোটিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। মঞ্চে অনেক যন্ত্রানুষঙ্গ নিয়ে সুমিত্রা গান করেন এখন। সুমিত্রাকে বলেছিলাম, এত সব আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করো কেন তুমি? সুমিত্রা বলেছিল, ‘কী করব বলো? আমার আগের বাউল লম্পঝম্ফ দিয়ে গান গেয়ে গেল, তারপর আমি উঠে যদি একতারা নিয়ে টুংটাং করে গান গাই লোকে নেবে? পেটের টানে আমাকেও সময় উপযোগী করে গাইতে হয়।‘ এর উলটো পিঠে দাঁড়িয়ে আছেন নদিয়ার পাগলদহের মীরা মোহন্ত, বীরভূমের নবাসনের নির্মলা গোস্বামীরা। রীতিমত তারা স্বচ্ছন্দ মা গোঁসাই। নির্মলা বছর তিনেক হল দেহ রেখেছেন। প্রবৃদ্ধ বাউল হরিপদ গোঁসাইয়ের সাধনসঙ্গিনী ছিলেন নির্মলা। হরিপদ তাকে নবাসনে সম্মাননীয়াই করে রেখেছিলেন। আমাকে বলেছিলেন ‘নির্মল সেবাদাসী নন, সাধনসঙ্গিনী।’ নির্মলার মতো ভাগ্য নিয়ে সকল নারী পথে আসেন না। হরিপদ মান্য সাধক। তার কাছে যোগ শিখতে বিদেশ থেকে লোক আসেন সমানে। তার মতো তাত্ত্বিক, যোগী বাউল পথে আমি কমই দেখেছি। ফকির লালন সাঁই ছিলেন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। ঘোড়ায় চড়ে গ্রামের গ্রামে গিয়ে তিনি গাছগাছড়া দিয়ে চিকিৎসা করতেন। হরিপদও এ বিষয়ে সিদ্ধহস্ত। আমাকে বলেছিলেন তিনি, ‘এখনকার বাউলদের বেশি রোগভোগ। সংযম নেই বাউলের। রোগ গিয়ে ঠেকে তার সাধনসঙ্গিনীর শরীরে। তাই প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্র ঘেঁটে রোগ নিরাময়ের প্রচেষ্টা করি।‘ তার যোগচর্চার গল্প বলেছিলেন হরিপদ গোসাই। বিদেশে তাকে নাকি নাঙ্গ করে মেয়েরা সব জলের মধ্যে জাপ্টাজাপ্টি করেছিল। তিনি তখন কুম্ভক করে দম-শ্বসে সব মেমদের কাবু করে ফেলেছিলেন। তারা নাকি তাকে বলেছিলেন, আমাদের পুরুষেরা যা পারে না, তুমি তা পারো কী করে বাবা? হরিপদ বেশ গর্বের সঙ্গে আমাকে বললেন, আমি তাদের বললাম আমার ঊর্ধ্বযোগ হয়। বীর্যকে টেনে তুলে মস্তিষ্কের ব্রহ্মরন্ধ্রে আমি উঠিয়ে নিতে পারি। আমার দম বেশি। এসব করতে দম লাগে। হাজার রমণেও আমার পাত হবে না। আমি যে সাধক। নির্মলার দুই মেয়ে ছিল। হরিপদই তাদের পাত্রস্থ করেছেন। হরিপদর সন্তানাদি নেই। বলেছিলেন, ‘সাধক সন্তানের জন্ম দেয় না কখনও। সে কি আর গৃহী?‘ নির্মলা গোস্বামী নবাসনের বেশ স্বচ্ছল আশ্রমে সকলেরই মা। তার মুখেই শুনেছিলাম সাধিকা জীবনের আগের গল্প। বলেছিলেন অল্প বয়সেই বিধবা হয়ে দুই মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ির গলগ্রহ হয়েছিলেন তিনি। এক কীর্তনের আসরে তার সঙ্গে গোঁসাইয়ের আলাপ। যোগাযোগ। এরপর ঘড়ছাড়া। ঘুরতে ঘুরতে শেষমেষ এই নবাসনেই স্থায়ী আশ্রম বানানো গাঁয়ের লোকেদের সহায়তায়। সন্ধ্যায় আশ্রমে কীর্তন হয়। স্বায়ংসন্ধ্যা নামগানের পর বাউল আসর বসে। সে আসরে নির্মলাও গান। কী তার গানের দাপট। পাল্লা গানে হরিপদকে পর্যন্ত কাবু করে দিতে পারেন। নবাসনের মচ্ছবের আসরে নির্মলার সঙ্গে পাল্লা গানে নামতেই চাইতেন না কোনো বাউল। নির্মলা বলেছেন আমায়, কিছুই জানতেন না তিনি। গোঁসাই তাকে হাতে ধরে সব শিখিয়েছেন। শ্বাসের কাজ, যোগ, যুগল আসন, গান সবই তার গোঁসাই সংসর্গে পাওয়া। সেইসঙ্গে বোধহয় আশ্রম জীবনের ঘোর স্বচ্ছলতা, সম্মান, বিদেশবাস, ক্যাসেট, সিডি। তাই এসব নিয়ে নির্মলার হেলদোল নেই। তাকে তো আর যুদ্ধ করতে হয়নি কৃষ্ণা, সুমিত্রার মতো! রাধারানি, কালীদাসীর মতো অসহায়াও তিনি নন। ফুলমালার মতো তাকে ট্রেনে গান গাইতে হয় না। তার রোজগারের দরকার নেই। কিংবা নদিয়ার বাঙালঝির সুভদ্রা শর্মার মতো শয্যাশায়ী স্বামী-সাধকের চিকিৎসা ও নিজেদের জীবনধারণের জন্য গেয়ে ফিরতে হয় না। নির্মলা ভাগ্যবতী। প্রথম জীবনে কিছু দুর্বিপাকে পড়লেও প্রকৃত বাউল সাধকের ছত্রছায়ায় সে দুর্যোগ তার কেটে গেছে। যতদিন ছিলেন নবাসনের আশ্রমে বলা যায় রাজ করে গেছেন। তাই সাধনসঙ্গিনীর চৌহদ্দির বাইরে গানের প্রয়োজনীয়তা তিনি ধরতেই পারেননি বলে কৃষ্ণা-সুমিত্রাদের গালমন্দ করতেন। প্রাচীন সিদ্ধ মহাজন, সাধকদের প্রতিষ্ঠিত নারীসাধনের সম্মানে তিনি বিশেষ বিশ্বাস রাখতেন। কেননা সাধনের সেই উপলব্ধ স্বচ্ছতা, অনুভূতি, বোধ তিনি পেয়েছিলেন সাধক হরিপদ গোঁসাইয়ের কাছ থেকে। ক-জন নারী এখন এ পথে এমন সাধক সংসর্গ পেয়ে থাকেন? আশ্রমে তাই নির্মলা সান্ধ্য আসরে অনায়াসেই গাইতে পারতেন, ‘আছে ভাবের তালা সেই ঘরে / সে ঘরে সাঁই বাস করে। ভাব দিয়া খোল ভাবের তালা / দেখবি সেই মানুষের খেলা / ঘুচে যাবে শমন জ্বালা / থাকলে সেই রূপ নেহারে।’ হরিপদ যখন গাইতেন নারীভজনার কোনও মহাজনি পদ, তখন গর্বিতা নির্মলাকে আমার দিকে সম্মতির চোখে চেয়ে থাকতে দেখেছি। সাধকের চরম এই দুর্দিনে, সমাজ বাস্তবতায় নারীর গানকে আমার সমর্থন নির্মলা মেনে নেনইনি কোনোভাবে। বলেছিলেন, ‘ও নারীর পথ নয়। নারীর পথ আশ্রমে থেকে সাধনভজন। সংসারী নারী যেমন গৃহকর্ম করে পতি-সন্তানের যত্নআত্তি করে, তেমনই সাধিকা নারী আশ্রমে সাধনচর্চা করবে, গোঁসাইসেবা করবে। ভক্তশিষ্যদের মাতৃস্নেহে কাছে টানবে। সাধনে এসে সাধিকা কি তার সহজাত নারীধর্ম খোয়াবে তুমি বলো ছেলে?’ ‘নির্মলা মা’র যুক্তিকে আমি খর্ব করতে পারিনি। প্রতিপক্ষ যুক্তি দিয়ে তাকে অমান্য করার ইচ্ছে ও সাহস কোনোটাই আমার ছিল না। কেননা নির্মলা মা বাউল সাধনের প্রকৃতাবস্থার মধ্যে ছিলেন। তাই তার মনের বিসদৃশ ভাবনা, সাধন ভাবনা, অনুভূতি, উপলব্ধি, সিদ্ধ সাধকের পরশ থেকে সরে আসা অসম্ভব। কেননা তিনি সেই সহজ মানুষের বোধটি রপ্ত করতে পেরেছিলেন সহজ সাধকের বদান্যতায়। সাধনের ব্যভিচার, সঙ্গী পালটানো, আশ্রমে গিয়ে যুবতি বয়সের নারী হাতানোর পাশে যেজন্য নারী সাধিকা বা সঙ্গিনীর ধর্মমত থেকে তাকে কোনোভাবে সরানো যায়নি। যেমনটি নদিয়ার মীরা মা-কেও সাধকের প্রবল অবিচারে সরানো যায়নি। কেননা মীরা মহন্তও একসময় সিদ্ধ সাধকের কাছ হতে পরশমণি পেয়েছেন। যা তিনি আজও হৃদয়ে রেখে দিয়েছেন। সত্তর পেরোনো কালীদাসীর গায়ন দাপট তার দেখাবার প্রয়োজনই-বা কী? কালীদাসীকে বৃদ্ধা বয়সেও এ মেলা সে মেলা করতে হত। জেলা তথ্য-সংস্কৃতি অফিসে, বিধায়ক বা পঞ্চায়েত সভাপতির কাছে করতে হত অনুনয় গানের সুযোগ, পেনশনের জন্য। কালীদাসীর তিন কুলে কেউ ছিল না। নিঃসম্বল মহিলা তত্ত্বগান রপ্ত করে আর কীই-বা করতে পারতেন। তিনি তো একই জেলার মীরা মার মতো গুরু মা নন। সচ্ছল আশ্রমের কত্ৰী নন। তিনি চান আখড়ায় গাইবার সুযোগ। সেখানে গাইলে যদি রসিক-ভক্ত সমঝদার কিছু দান দক্ষিণা দেন তবে তার জীবনধারণে সুবিধে হয়। আর মীরা আখড়া বসান নিজে অগ্রদ্বীপের মেলায়। সেখানে নানা জায়গার বাউল গাইতে আসেন। তার তো আর গান গেয়ে রোজগারের দরকার নেই। তিনি গান ঘরোয়া আসরে মনেরই আনন্দে। গৌরবর্ণা, রূপসী মহিলা, তেজস্বিনী। মধ্যবয়স্কা এই মহিলা কিন্তু বাউলের ছেড়ে যাওয়া সাধনসঙ্গিনী হননি। তিনি নিজে ছেড়ে গেছেন সাধক বাউল নরোত্তম দাসকে। নরোত্তমকে ছেড়ে গেলে মীরা তিনি আবার বৈষ্ণব ঘরের বউ শ্যামা দাসীকে বের করে এনে সাধনভজন শুরু করলেন। দশ বছর এভাবে চলার পর মীরা একদিন এসে হঠাৎ উপস্থিত। অল্প বয়সি মীরাকে পেয়ে নরোত্তমই বলা চলে শ্যামা দাসীকে ত্যাগ করলেন। যদিও শ্যামা দাসী তা মানতে চান না। আসলে তিনি বৈষ্ণব নরোত্তমকে বাড়িতে পেয়ে সেবাযত্ন করে প্রেমে মজে স্বামী-পুত্র ছেড়ে তার সঙ্গে বেরিয়ে এসেছিলেন। সেই প্রেম বজায় ছিল বলেই বোধহয় তার বিশ্বাস গোঁসাইয়ের সায় ছিল না মীরা এসেই তাকে খেদিয়েছে। মীরার পাকা সচ্ছল আশ্রমের পাশে এখন জীর্ণ কুঁড়েতে শ্যামা দাসী থাকেন। বৃদ্ধ হয়েছেন। মাধুকরীতেও যেতে পারেন না। উপোস দিয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে দয়া পরবশ হয়ে কোনো ভক্ত কিছু দিয়ে গেলে জোটে। মীরা বোধহয় ফিরেও চান না। দাপুটে মীরাকে টপকিয়ে আমার অবশ্য শ্যামা দাসীর কুঁড়েতে যাওয়ার সাহস ছিল না। একদিন বেলাবেলি গেলে আশ্রমে মীরা ছিলেন না। এক ভক্তই বললেন, ‘পাশেই শ্যামা দাসী থাকেন। যাবেন? গেলে এ পথের অনেক কিছু জানতে পারবেন।
বললাম, তিনি কে?
জনৈক ভক্ত বললেন, আপনি এত আসেন এখানে। দেখি। কিছুই কি জানেন না?
বললাম, সত্যিই আমি জানি না।
বললেন, মীরা মা জিনিস একখানা। শ্যামা দাসী ছিলেন গোঁসাইয়েরই সাধনসঙ্গিনী। মীরা মা তার পরের সাধনসঙ্গিনী। অল্পবয়সি মীরা মা তখন গোঁসাইয়ের মোহে এসেছিলেন। গোঁসাই এ অঞ্চলের নামকরা সাধক। ভক্তশিষ্য
প্রচুর।
—আপনি কি ওঁর দীক্ষিত?
—শুধু আমি কেন এ গাঁয়ের সবই ওঁর দীক্ষিত। গোঁসাই দেহ রাখবার পর সব বাগিয়ে মীরা মা দীক্ষা দেন। এখন এখানকার সর্বেসর্বা।
-তোমাদের গোঁসাইয়ের কতজন সাধনসঙ্গিনী ছিল?
—আমিই তো জনা পাঁচেক দেখেছি। আসলে বিন্দুধারণ করতেন। তাই তার সাধনসঙ্গিনী লাগত। তিনি বৃদ্ধ হলে কী হবে যোগবলে তো উর্দ্ধরেতা করে নিতে পারতেন বীর্যকে। এ তো রজ-বীর্যের সাধনা। গোঁসাই মা বয়স্কা হয়ে স্রাব না হলে সাধন হবে কীসে? তাই গোঁসাইয়ের সাধনসঙ্গিনী অদলবলদ।
-মীরা মা তবে ছেড়ে গেলেন কেন তোমাদের গোঁসাইকে?
-ওই যে বললাম না জিনিস। ছেড়ে গেলেন বাঁকুড়ার এক সাধকের কাছে। সেখানে সুবিধে না পেয়ে আবার এখানে।
জিজ্ঞাসা করলাম, গোঁসাই রাখলেন?
–রাখবেন না কেন? পড়ন্তবেলার গোঁসাই। ডাগর সুন্দরী সাধনসঙ্গিনী থাকলে তো বোঝানো যায় যে তিনি মস্ত সাধক।
—কীভাবে? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
—কীভাবে আবার! এটা তো প্রমাণ হয় তিনি ডাগর সাধিকার গুপ্ত বৃন্দাবন ভ্রমণে সক্ষম, নাকি?
বললাম, তাহলে বলছেন আপনি আপনাদের গোঁসাই বড়ো সাধক ছিলেন।
—তা নয়। কীর্তন, দেহতত্ত্ব এসবে তার নাম ছিল। দেশগাঁয়ের লোক মান্যি করতেন তো। মীরা মার তারই সঙ্গ করা। গোসাই যোগ জানতেন। চারচন্দ্র করতেন। মীরা মা তো সেই গুড়েরই লাডু পাকাচ্ছেন এখন।
-ঠিক বুঝলাম না।
-ওই যে এখন মধ্যবয়স্কা, দাপুটে, গেরুয়া বসনে রসকলি আঁকা বৈষ্ণব-বাউল। শাস্ত্ররপ্ত। জ্ঞানচর্চা আছে। গান জানেন। সব রপ্ত করে নিয়েছেন গোঁসাইয়ের কাছ থেকে। তাকে আর পায় কে!
–মীরা মা’কে এ গাঁয়ের লোক তাহলে খুব একটা বোধহয় ভালো নজরে দেখেন না?
-তা দেখবে না কেন শুনি? হাজার হোক সিদ্ধ সাধকের সাধনসঙ্গিনী। গুরুসঙ্গে তাঁরও সিদ্ধাই যোগ এসেছে যে! শাস্ত্রকথা বলেন যখন থ মেরে শুনতে হয়। মনে হয় তিনি বলছেন না কিছুই। কোনো এক দৈবশক্তি তারে দিয়ে বলাচ্ছেন।
ঘোষপাড়ার নবকুমার দাসকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম চারচন্দ্রের কথা। নিত্যানন্দ বালা, নরোত্তম দাসকে বললে কিছুই বলেননি তারা। নরোত্তম গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন। প্রথমে গুনগুন করেই গাইছিলেন বাউল। শিষ্য (বাজনদার) একতারাতে সুর দিতেই গাইলেন, দিন-দুপুরে চাঁদের উদয় রাত পোহান ভার। হলো অমাবস্যায় পূর্ণিমার চাঁদ তের প্রহর অন্ধকার। / সূর্যমামা মরে গেছে বুকে মেরে শূল,/ বামুনপাড়ায় কায়েতবুড়ি মাথায় বইছে চুল। / আবার কামরূপেতে কাকা ম’ল, / কাশীধামে হাহাকার। দরাজ গলায় বাউল বাড়ি (আখড়া) ম ম করতে থাকল চাঁদেরই গন্ধে।
গান শেষে থামলেন বাউল। বললেন, লাইনে না এলে এর মানে জানা যাবে। একটু ঘোরাফেরা করেন, ঠিক একদিন জেনে যাবেন। আমাকে আর শুধোতে হবে না।
হাসলেন বাউল। বললেন, দীক্ষা হয়েছে?
বললাম, না।
—আগে চট করে দীক্ষাটা নিয়ে ফেলুন। তাহলেই দেখবেন অনুরাগ আসবে। প্রথম প্রথম শুধু চারচন্দ্ৰ কেন, নবকুমার আমার কোনো প্রশ্নেরই সেইভাবে জবাব দিতেন না। বিরক্ত প্রকাশ করতেন। ভাবখানা এমন এখানে না আসলেই পারেন। ওদিকে যখন অত যাতায়াত তাহলে ওখানে গিয়েই মেটান না কৌতুহলী জিজ্ঞাসা সব। তবে আমি রাগ করতাম না। বুঝতাম বিষয়টা হয়তো পছন্দ করছেন না নবকুমার। কিন্তু কোনোদিন এই বিষয়ে তিনি আমাকে কটু কথা বলেননি। বাউল সমাজে মিশে এটা বুঝেছি সেখানে তাদের ভেতরে নানা অরাজকতা থাকলেও তারা বাইরের মানুষদের প্রাপ্য অতিথির সম্মান দেন। প্রথম প্রথম তাকে বোধহয় কেউ ভুল বুঝিয়েছিল। বাউলে আগ্রহী মানুষ জেনে শেষমেষ তিনি মধুর সম্পর্কই রেখেছিলেন।
একদিন বেশ ঠান্ডা মেজাজেই পেয়েছিলাম নবকুমারকে। গরিফার এক অনুষ্ঠানে গাইবার আগে কথা চলছিল।
বললেন, আমাদের শরীরে তো নিয়ত চন্দ্রের চলাচল। চন্দ্র হল শীতলতা।
-কীসের? জিজ্ঞসা করেছিলাম।
—কীসের আবার, সিদ্ধির।
–কীভাবে আসবে এই সিদ্ধি? বললাম।
–চন্দ্ৰতত্ত্বে আসবে তা। শরীরের মধ্যে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র আছে। যুগলে অমাবস্যাতে এই সাড়ে চব্বিশকে ধরতে-ঘঁতে-জানতে-বুঝতে হবে। তারপর জোয়ার নামবে।
আর কিছু বলতে চাইলেন না নবকুমার।
বললেন, একদিন ঘোষপাড়া আসেন। সেখানে হবে ‘খোন। এই হাটে-মাঠে তত্ত্ব হয়? হয় না।
ইতিমধ্যে ডাক পড়ল তার। বাজনদাররা উঠে মঞ্চের দিকে এগোতে লাগলেন। নবকুমার পায়ে ঘুঙুর-জোড়া বাঁধতে বসলেন।
গুরুতত্ত্ব নিয়ে কথা বলছিলেন নিত্যানন্দ বালা তার নতুনপল্লির আখড়াতে বসে। নবকুমারের মতো খ্যাতিমান বাউল না হলেও নিত্যানন্দ ঘোষপাড়ার বাউল হিসেবে যথেষ্টই পরিচিত। যেদিনকার কথা বলছি এখন সেদিন নিত্যানন্দ ছিলেন দারুণ মুডে। ভক্ত-শিষ্য পরিবেষ্টিত একেবারে। সবে সতী মা’র মেলা ভেঙেছে গতকাল। আজও সব বাউল যেয়ে উঠতে পারেননি আখড়া ছেড়ে। নিত্যানন্দের বাড়ির আখড়াতেও বাউল গমগম। সন্ধ্যার আসরে ক্রিয়াকরণের পর গেয়ে উঠলেন তিনি পাঞ্জু শাহের পদখানা—’গুরু-রূপে নয়ন দে রে মন। / শুরু বিনে কেউ না তোর আপন।। / গুরু-রূপে অধর মানুষ দিবে তোরে দরশন।।‘
নিত্যানন্দ বললেন, তা খ্যাপা আপনি মনের মানুষের কথা বলছিলেন না সেদিন? আজ বলি দেহ না জাগলে চিনবেন কী করে তারে। দেহ তো সাতে আবদ্ধ।
জিজ্ঞাসা করলাম, কী এই সাত?
বাউল বললেন, সাত সপ্তধাতু। যা দিয়ে স্থূল দেহ তৈরি। শুক্র, রজ, রক্ত, মাংস, মেদ, অস্থি, ত্বক—এই সাতে শরীর গঠিত। তাতে আবার পাঁচের সমন্বয়–ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। এই এগারোর আবাসভূমি শরীর। গুরু চেনান তারে।
—কীভাবে চেনান গুরু?
–সে বড়ো কঠিন কাজ। চক্ৰ চেনেন আপনে?
–মাথা নেড়ে বললাম, না। সেভাবে জানি না।
বললেন, এত অল্প জ্ঞানে মনের মানুষ বুঝবেন কী করে আপনি?
–সহজভাবে বলুন না। যদি ধরতে পারি।
-কী করে ধরবেন খ্যাপা? আগে গুরু ধরেন। তবে তো আপনে মানুষ ধরবেন।
ইচ্ছে করে কিছু বললাম না। কেবল হাসলাম। আসলে আমার জানাটা কেবল নয়—নিত্যানন্দর জানাটা দিয়ে আমি জানতে চাইছি আজকের বাউল সমাজকে। তার গান পেশা। গানের জন্য দরবার করেন। এখানে-ওখানে ছুটে বেড়ান। রীতিমতো গৃহী বাউল তিনি। ঘোষপাড়ার প্রায় সমস্ত বাউলই এখন তাই। তার মধ্যে একজন-দুজন যাঁরা কিছুটা সাধনভজন করতেন, তারা কেউ আর শরীরে নেই। তবে এখানকার এবং এখনকার গায়ক বাউলেরা তত্ত্বটাকে বেশ রপ্ত করেছেন। গান বেচে, খানিকটা গুরুগিরি করে তারা পেট চালান। ভক্তশিষ্য জোটান। নিত্যানন্দ কথা বলেন সুন্দর। ভক্তশিষ্যর সংখ্যা নেহাত কম নয়।
বাউল বললেন, গুরু তো রস-সাধনা শেখান। নরদেহকে গুরুই আমাদের নারায়ণ করে দেন। নররূপী নারায়ণ। দেখেন, আমাদের দেহঘরে গুহ্যদেশে যে মূলাধারটি তা পৃথিবীর হদিস দেয়। লিঙ্গের সন্ধিমূলে স্বাধিষ্ঠান জলের কথা বলে। নাভিমূলের মণিপুর শিখা ছড়ায়। হৃদয়ের অনাহত বায়ু ধরে। এই বায়ু পার করে। সহজ মানুষ করে।
কীভাবে করে? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
বললেন, শুরুবস্তু বায়ুক্রিয়াতেই ধরে রাখেন বাউল। নিজ শরীরে সঞ্চিত সব গুরুতত্ত্ব শরীরের চক্রগুলোর ভেতর দিয়ে মাথায় ওঠে। ঊর্ধ্বে ওঠেন বাউল। পরমাত্মার দেখা পান।
বুঝলাম, নিত্যানন্দ আমাকে দীক্ষিত হতে বলছেন তার কাছে। দলে টানতে চাইছেন আর কী। প্রান্তিকতার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজনকে এঁরা তো সবসময়ই টানতে চান। শিক্ষিত, অভিজাত এদের কাছে ঘুরঘুর করলে যে সমাজে তাদের দড় বাড়ে। শিষ্য তৈরি হয় একটু বেশি।
দেবগ্রাম, নদিয়ার দয়াল ব্যাপার নিবাস সেখানকারই মদনমোহন আশ্রম। দুবেলা মদনমোহনের সেবাপুজো চলে এখানে। দয়ালের মা ছিলেন জাত বৈষ্ণব। বাবা ব্রাহ্মণসন্তান হলেও ঘোষাল পদবি উড়িয়ে খ্যাপা হয়েছিলেন। সাধক পিতার একমাত্র সন্তান দয়াল। পূর্বনাম ছিল দয়ালচন্দ্র ঘোষাল। তিরিশ বছর ধরে সাধনরত দয়ালের আবার একাধিক সন্তান রয়েছে। পিতা-পিতামহক্রমে অনেক শিষ্য দয়াল খ্যাপার। নিরামিষাশী। ঘর তাদের মাজবাড়ি। উপাধি খ্যাপা। এ ঘরে নাকি সর্বকেশ রক্ষা করতে হয়। কিন্তু দয়ালের দাঁড়ি-গোফ অল্প বলেই তা তিনি আর রক্ষা করেননি। নব্বইয়ের কাছাকাছি সুঠাম শরীরের দয়াল। তার পিতা কালিদাস খ্যাপা একশো কুড়ি বছর নাকি বেঁচেছিলেন। দয়াল বলেন সাধকজীবনে চারচন্দ্রের ক্রিয়া জরুরি। তার সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ চারচন্দ্রেই রয়েছে। তিনি লিখতে পড়তে জানেন। গানও রচনা করেছেন অনেক। বয়সের কারণে এখন অবশ্য তার গাইবার শক্তি কিছুটা কমে এসেছে তথাপি তিনি গাইবার ঢঙে, দমে যুবক বাউলকে কাত করে দিতে পারবেন। আর দয়ালকে দেখলেও তার বয়স বোঝ যাবে না একদম।
চাপড়া, মহাখোলার সামসুল আলম বাউল চর্চা করলেও তিনি হাটখোলা হাই মাদ্রাসার শিক্ষক। রক্ষণশীল মোল্লা পরিবারে জন্মিয়েও সামসুলের বাউল জীবন আমাকে হতবাক করে। তিনি জানিয়েছেন হাই মাদ্রাসার শিক্ষক বলে তার এখানে একটা প্রাধান্য থাকলেও শরিয়তপন্থীদের সঙ্গে তাকে এখনও যুঝতে হয়। মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে তাই সরে এখন চাপড়া শান্তিপাড়ায় তাকে উঠে আসতে হয়। চাপড়ার সামাজিক ইতিহাসেইসলাম থেকে খ্রিস্টান ধর্মান্তরেরও একটা স্রোত আছে। সেই স্রোত ও ইসলাম উপেক্ষা করে তার গুরু ওয়াদেব শা ফকির শ্যাওড়াতলা আশ্রমে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান শিষ্যদের নিয়ে উৎসব করে আসতেন। এখন সামসুল করেন। সামসুল বলেন, দেহে কৃষ্ণ-যিশু-নবি সব রয়েছেন। তার খৈবর ফকির আমাকে জানালেন, শ্রীচৈতন্য নদে জেলার মানুষ। আবার আমাদের লালন সাঁইও তো এই নদে জেলারই। একজন অবতার, অন্যজন মানবতাবাদী। গোরভাঙার ফকির, চাপড়া-করিমপুর-আসাননগর–ভীমপুরের বাউল এখন বাইরের মানুষের কাছে পরিচিত হচ্ছে এটা অনেকেরই জানেন সহ্যি হচ্ছে না তেমন।
জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কারা?
–কারা আবার। এখানকারই কিছু ধ্বজাধারী ফকিরেরা।
—বাউলদের এতে সায় নেই বলছেন।
-না না। ওরা তো এমনিতেই পরিচিত। আপনি তো ঘোরাঘুরি করেন। জানেন তো নদে জেলার গান গাইতে না পারা বাউলরা পর্যন্ত বিদেশ ঘুরি এ্যয়েছে। আর আমরা কেবল গান আগলিয়ে বসি রয়েছি। গোঁড়া ফকিররা সব এখানকার বলে কী জানেন খ্যাপা সাঁই?
-কী বলেন তারা?
-বলে সাধনার অঙ্গ গানরে বাজারে নিয়ি যেতে দেবুনি আমরা। বলেন খ্যাপা কুনড়া এ্যাহন বাজার লয়। সাধনে পেট ভরে খালি? আমাদের মুরিদ-বায়েদ হাতে গোনা। তাদের দানধ্যানে কতটা কী হয়!
সত্যিই তো। খৈবরের প্রশ্নকে উপেক্ষা করা যায় না বর্তমান এই জীবন জীবিকায়। আত্মমগ্ন ফকিরেরও তো ফকিরানি আছেন, মুরিদ-বায়েদ-শিষ্যভক্তদের আনাগোনা, অনেকেরই সন্তান—তাদের ভরণপোষণ কীভাবে বা করবেন দেল-কোরান নিয়ে মেতে থাকা ফকির? ইসলাম উপেক্ষার জের তাকে বইতে হয়। বাউলের এই প্রতিষ্ঠিত ধর্মপেষণ তেমন নেই। ফকিরদের রীতিমতো আছে। চাপড়ার ফকিরেরা তো এই একুশ শতকেও ঘরছাড়া হয়েছিলেন শরিয়ত উপেক্ষার কারণেই। গ্রামের মাতব্বরা তাদের টিকতে দেননি বলে শেষপর্যন্ত পুলিশকেও জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা। সেখান থেকেও চূড়ান্ত হতাশ হয়ে তারা তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। চাপড়ার আড়ংসারিষার এ সংবাদ তো আমি আনন্দবাজার পত্রিকাতেই পড়েছিলাম। তাই খৈবরদের পাশে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এই তৎপরতা ওঁদের মনোবল বাড়িয়েছে বই কি। তারা গান সংরক্ষণের কাজ করছে। অমিতাভ জানিয়েছেন যে ফকির-বাউল গুরুর দেহাবসানের সঙ্গে সঙ্গে গানও তো হারিয়ে যায়। তাই তাদের রচিত গান খেরো খাতা থেকে তুলে ছাপিয়ে বিলিও করা হচ্ছে। এসবের মাঝে তথাকথিত গুটিকতক গবেষরাও পোঁ ধরেছেন। তাদের বক্তব্যটি এইরকম : গোরভাঙার ফকিরদের তো এখানকার বাউলদের মতো দেখানেপানা ছিল না। তারা এখন প্রচার পেয়ে বাউলের মতো আলখাল্লা পরে মঞ্চে উঠছেন। কথাটি মিথ্যে নয় ঠিকই। গোরভাঙার বাউল-ফকির উৎসবে গেলে ফকিরদের জাঁকজমক এখন টের পাওয়া যায়। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে অর্থনীতির জাঁতাকলে পিষ্ঠ সাধক ফকির-বাউল বা গায়ন শিল্পী চিরকালই অন্তরালে থাকবেন কেন? লোকগান আমাদের ঐতিহ্য। সম্পদ। মহাজনের পদাবলি আমরা মান্য করেছি আর বর্তমান মহাজনদের সাধনসম্পদ এই গান যদি একটু বৃহত্তর আঙিনায় আসে তাহলে তো আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই পরিপুষ্ট হয় আমজনতার দরবারে। নির্জন সাধক কমে আসছেন। লোকায়ত সাধন ধর্মের অনেকগুলোরই এখন মরা সোঁতা। কিন্তু লোকায়ত সাধকের মূল সম্পদ সাধন উপলব্ধির গান সেটা নষ্ট হবে না। কোনোদিনই সাধকের না হোক পেশাদার গায়নের বদান্যতায় এ আমার বিশ্বাস। নদিয়ার বাউল-ফকিরদের নিয়ে তাই এই নতুন ঐকতানকে আমি অন্তত কোনোভাবেই খাটো করে দেখতে পারি না আমাদের বাস্তবিক বিশ্বায়নের দুনিয়ায়। অস্তেবাসীর বিশ্বকে অন্তর্মুখিতা দিয়েই এখনও চেপে রাখতে হবে এই বোধ আমাদের আগে নষ্ট করতে হবে। না হলে পর লোকায়ত সাধনসম্পদকে অনুধাবন তো পরের প্রশ্ন, রক্ষা পর্যন্ত আমরা করতে পারব না।
বাউল গান নিয়ে বুদ্ধিজীবী, গবেষকদের পাশাপাশি মার্কিন ও ইউরোপীয় সমাজের উৎসাহের কথা না বললে বর্তমান বাউল সাধকদের অবস্থাটি একেবারেই অন্ধকারে চলে যাবে। সে দিকটির কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই আমি বলব কার্তিক দাস বাউলের কথা। তাকে এখন ই-টিভির জনপ্রিয় শো বিগ বসে পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। কার্তিকের বাড়ি বর্ধমানের আলুটিয়ায়। আলুটিয়া গুসকরা অঞ্চলের প্রত্যন্ত গাঁ। তার বাবা প্রথমে রিকশা চালাতেন। তার পর আর না পেরে ভিক্ষা করে বেড়াতেন। কার্তিক সে সময় বর্ধমান-রামপুরহাট ট্রেনের কামরায় অ্যাসবেস্টারের ভাঙা টুকরো বাজিয়ে জনপ্রিয় সব হিন্দি ও বাংলা গান গেয়ে একপ্রকার ভিক্ষাই করতেন বলা যেতে পারে। এই লাইনের ট্রেনে উঠতেন বীরভূমের বাউলরাও গান গেয়ে পয়সা রোজগারের জন্য। কার্তিকের সেই দেখে বাউলের রোগ লাগে। সুর-তালের জ্ঞান তার বরাবরই ছিল। আর ছিল শুনে শুনে গান তুলে ফেলবার ক্ষমতা। এই দুই ক্ষমতা প্রয়োগ করে প্রথম প্রথম নিজেই বাউল শিখতে শুরু করেন। দু-একদিন কামরায় বাউল না উঠলে সেই ফঁাক ভরাট করে দিতেন। এখনকার জনপ্রিয় বাউল গায়ক কার্তিক দাস বাউল। এভাবেই চলছিল তার নিজস্ব বাউল সাধনা। বিশ শতকের আশির দশকে ফরাসি চিত্র পরিচালক জর্জ লুনো আসেন পশ্চিমবঙ্গের বাউলদের নিয়ে তথ্যচিত্র বানাতে। সেই সময়ে বরাত খোলে কার্তিকের। তাকে ট্রেনে গাইতে দেখে লুনো তথ্যচিত্রের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। এর পর স্টুডিয়োতে শুটিং চলাকালীন কার্তিকের সঙ্গে আলাপ হয়ে যায় বীরভূমের সাধক বাউল দেবদাসের সঙ্গে। কার্তিক নাড়া বাঁধেন ওঁর কাছে। দেবদাসের আশ্রমে থেকে বাউল শিক্ষা করে হয়ে ওঠেন এরপর কার্তিক দাস বাউল। এদিকে সেই ছবি ‘সঙস অফ ম্যাডম্যান’ সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন উৎসবে দেখানো হয়। কয়েকটি পুরস্কারও পায় ছবি। ছবিতে দেখানোও হয় কার্তিক দেবদাসের কাছে তার বোলপুরের শুড়িপাড়াতে বসে বাউল শিক্ষা করছেন। আশির দশকের মাঝামাঝি ১৯৮৫-তে ওয়াশিংটন ডিসি-তে ভারত উৎসব হয় সেখানে তিনি গান গাইবার আমন্ত্রণ পান। এরপর বহুবার বিদেশযাত্রা কার্তিকের। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাউল গান পরিবেশন। কলকাতার এক রক ব্যান্ডের নজরে পড়া। সেই ব্যান্ডে বাউল গেয়েই আবার আমেরিকা থেকে ফ্রাঙ্কফুট দাপিয়ে বেড়ানো। হিন্দি-বাংলা ছবিতে সুর ও গানে কণ্ঠদান। এভাবেই ট্রেনের কামরাতে সেই গান গেয়ে ফেরা যুবকের পরনে ওঠে গেরুয়া আলখাল্লা। মাথায় নেমে আসে চুলের ঢাল, বুক পর্যন্ত দাড়ি। কার্তিক মাথার চুল চুড়ো করে বেঁধে, গলায় নানা বাহারের হার, হাতে বালা পায়ে ঘুঙুর বেঁধে দেবদাসের কাছে গান আর কিছু দম-শ্বাসের চর্চা করে পুরোপুরি নামি বাউল হয়ে ওঠেন। তিনি চারচন্দ্র করেন না। বিন্দু ধরতে পারেন না। তার সাধনসঙ্গিনীও নেই। এখন তাকে পয়সার জন্য ট্রেনে গাইতে হয় না। বিয়ে করে রীতিমতো সংসারী। পাকা বাড়িতে বাস করেন। সেখানে কালার টিভি, ফ্রিজ সহ আধুনিক নানা উপকরণও রয়েছে। এক ছেলে এক মেয়ে তার। সম্প্রতি মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। মিডিয়ার পরিচিত মুখ এখন কার্তিক দাস বাউল। বিজ্ঞাপনে পর্যন্ত তার গান ব্যবহার হয়-সারের গুণাগুণ, ম্যালোরিয়ার সচেতনতা নিয়েও গাইতে দেখা যায় টিভিতে কার্তিককে। এমনকি তথ্যচিত্রে অভিনয় দিয়ে জীবন শুরু করে বাংলাদেশের বিশিষ্ট চলচিত্রকার তনভির মোকাম্মেলের ছবিতে পর্যন্ত তিনি অভিনয় করেন সেই বাউল বেশে। কার্তিক সাধক বাউল নন কখনও। তার চর্চায় আগ্রহে তিনি নামকরা পয়সাওয়ালা গায়ক বাউল। বিগ বসেও আসর জমান। ‘যাওরে আনন্দবাজারে চলে যাও। / বাজারে বসতি করে স্বরূপ-রূপে মন মাতাও। / সহজ সে আনন্দবাজার, / সহস্র খবর খুলেছে যার, / সহজ আছে হৃদে তোমার, / হেরে ত্রিতাপ জুড়াও।‘ তবে কার্তিকের মতো বাউলদের সঙ্গে তাদের জীবনের ওঠাপড়া নিয়ে কথা বলা যায় কেবল, সাধনার বিচিত্র জগৎ নিয়ে এগোনো যায় না তেমন। এ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। কার্তিক বৈষ্ণবভুক্ত বাউল। কেননা তার শুরু হলেন নিত্যানন্দ পরিবারের। অচ্যুতানন্দ গোত্রের। অর্থাৎ কিনা জাতি-বৈষ্ণব। দেবদাসের বংশকৌলিন্য ছিল। ব্রাহ্মণ। সেখান থেকে এ পথে তিনি। সচ্ছল পরিবার থেকে বাউল মতে এসেছেন। দাসকলের রামানন্দ গোঁসাইয়ের কাছে তাঁর শিক্ষাদীক্ষা। গুরুর কন্যাকেই সাধনসঙ্গিনী হিসেবে পেয়েছেন। সাধনা তার বাউল মতের হলেও সেখানে বৈষ্ণবাচার বেশ মিশে। রামানন্দ তাকে যত্ন করেই তৈরি করেছেন। না হলে কি কোনো গুরু-গোসাই তার মেয়েকে শিষ্যর হাতে সমর্পণ করেন? দেবদাস যৌন যৌগিক গুহ্য সাধনা রপ্ত করেছেন। সাধক বাউল হিসেবে সমাজে তিনি প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু শিষ্য কার্তিকের মতোর্তার অত খ্যাতি নেই। খ্যাতি তার সীমাবদ্ধ বাউল সমাজে। অনেকেই বাউল শিক্ষা করতে তার আশ্রমে গিয়ে ওঠেন। ভাবতন্ময় সাধক হিসেবে দেবদাস বীরভূমে এখনও যথেষ্ট সম্মাননীয়।
বীরভূমের আর এক সাধক বাউল হলেন বেণীমাধব দাস বাউল। এখন তিনি অবশ্য মাধব গোঁসাই নামে সুপরিচিত। বয়স তার পঞ্চাশের কাছাকাছি। স্কুল শিক্ষা ক্লাস ফোর। পারিবারিক মিষ্টির কারবারে মন লাগত না তার। মন পড়ে থাকত সবসময় সাধু বাউলে। এখান হতেই চর্চা, গুরু ধরা, আশ্রম বানানো। সাধনসঙ্গিনী নিয়ে রীতিমতো সেখানে এখন বসবাস। গাইতেও ভালো জানেন। তত্ত্ব জানেন। সেখানে তার শ্রদ্ধা ও সম্মান থাকলেও গলাতে রয়েছে খেদ বিদেশ না যাওয়ার। হয়তো বা বিদেশি সাধনসঙ্গিনী পাওয়ারও। কেননা বীরভূম দেখেছে মেম নিয়ে সাধন করা। সেই ঐতিহ্য মেনে চলতে চেয়েছেন অনেকে। আর চলতে গিয়ে মাঝপথে থুবড়ে পড়ছেন আবার অনেকেই। এসব তো আমার গোঁসাইয়ের কাছেই শোনা। বিশ্বনাথ বাউলের মেম নিয়ে বীরভূম দাপানো কষ্ট দিয়েছিল বেণীমাধব গোঁসাইকে। কেননা বিশ্বনাথ তার সমসাময়িক। তিনি নাকি গোঁসাইকে বিদেশে নিয়ে যাবেন বলে কথা দিয়েও নানাদিকে রটিয়ে নিয়ে যাননি শেষমেশ। এত তার আঁতে ঘা লেগেছে। স্বাভাবিক। লাগারই কথা। গোঁসাই তো গানটা খারাপ গান না। তত্ত্বকথাও জানেন। তাঁর শিষ্যসামন্তও কম নয়। তো মাধব গোঁসাইয়ের সেই ক্ষোভের আগুনে খানিক জল দিয়েছিল বিশ্বনাথের ছেলে আনন্দ দাস বাউল। গোঁসাই আমাকে বলেছেন, সেদিনের ছোঁড়া আনন্দ সেও জানো মেম বগলে বীরভূম ঘোরে। আমার আশ্রমে আসে। তা সেই মেম সঙ্গে করেই ও বিদেশে পাড়ি দিল।
বললাম, এখানে মেম কোথায় পেলেন তিনি।
-শোনো কতা! মেম তো ওর জলভাত। ঠাকুরদা সিদ্ধ সাধক। বাপ নাম করেছে। দম-শাস শিখতে খয়েরবুনিতে সাহেব-মেমের লাইন লাগে। সেখান থেকেতুলেছে।
জিজ্ঞাসা করলাম, তার পর?
–তার পর আর কী। মেম নিয়ে গেল আনন্দরে বিদেশ বিভূঁই। সেখানে নিয়ে তারে ছিবড়ে করে দিল। আনন্দ মেম-হীন হয়ে ফিরে গেল খয়েরবুনি। আর আসে না বীরভূম। আমি খবর পাই পঙ্কজ বাউলের কাছে। ও তো ধান্দা করেছিল বিদেশ যাওয়ার। দিলি গিয়েছিল আনন্দকে ধরে। তা সেই আনন্দ ফেল মেরে ফিরে আসতে পঙ্কজ মনমরা।
আমি ভাবছি পঙ্কজের মন বিষাদগ্রস্ত হলেও বেণীমাধব এখন বেশ আনন্দিত। কেননা তার প্রবল প্রতিপক্ষের ছেলে বিদেশ থেকে সাধনসঙ্গিনী ছাড়া ফিরে এসেছে এটা তার কাছে মনে হয়েছে চরম লজ্জা আর অপমানের। অনেকটা সেই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটার মতোই বেণীমাধব আনন্দিত। তবে যেটা মনে হয় বেণীমাধব দাস বাউল আনন্দ সম্পর্কে ভুল কিছু বলেননি। আমি পবন দাসের মিকলু, সাধন দাস বৈরাগ্যের রীতিমতো খ্যাতিমান সাধনসঙ্গিনী মাকি কাজুমিকে সম্মাননীয়া করে রেখেই কথা ক-টা বলছি। মাকিকে আমি স্যালুট জানাই। বর্ধমানের হাটগোবিন্দপুরে সাধনের আশ্রম একা হাতে সামলাতে দেখেছি আমি মাকিকে। সাদা থান পরে জাপানি ছোটোখাটো চেহারার এই মহিলা হয়ে উঠেছেন গুরু মা। শিষ্যদের নিজে হাতে পাত পেড়ে খাওয়াচ্ছেন। বাংলাতে বলছেন সব। আমার মনে হয়েছে এখানে সাধনের কৃতিত্ব কিছু নেই। সবই মাকির। বাংলাকে ভালোবেসে বাংলার লোকায়ত সাধনাকে বুঝে আর বোধহয় সাধনকে ভালোবেসেও মাকি হয়ে উঠলেন আমজননী। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে সবাই মাকি নন। মিকলু আশ্ৰমজননী হয়ে না উঠলেও পবনকে ছেড়ে যাননি। পাশে পাশে রয়েছেন। তা ছাড়া পবনের সাধনের মতো ভাবতন্ময়তা নেই। আশ্রমে তার মন টিকবে না। তিনি পৃথিবী ভ্রমণে আন্তর্জাতিকতা মাখতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। বাউল গানকে ফিউশন করে চমক লাগাতেই যেন পবন সিদ্ধহস্ত। তবে এটাও ঠিক পূর্ণদাসের পর তার হাত ধরে বাংলার বাউল বিশ্বজগৎসভায় বেশিমাত্রায় স্থান করেছে। পূর্ণদাস, পবন পাকা প্রোফেশনাল। তবে এখনকার বিশ্বনাথ, কার্তিক নাম করা সব বাউল নিজের ঢঙে গেয়ে প্রোফেশনালিজম বজায় রেখেছেন যথেষ্টই। বিশ্বনাথ সনাতনের পুত্র বলেই ভাবতন্ময়তার ভেতর মানুষ হয়েছেন। তাই তার গায়নে সিদ্ধ সাধকের দশা ফুটে ওঠে। তবে তা সনাতনকে ছাড়াতে পারে না। কথাও নয়। প্রবীণ বহুমান্য সাধক বাউল তিনি। গানের সঙ্গে বাউল নাচকেও একটি উচ্চ রূপকল্পে নিয়ে গিয়েছিলেন সনাতন। বাউলতত্ত্ব নিয়ে বইও পর্যন্ত লিখেছেন তিনি। বিদেশেও গেছেন কয়েকবার। অনেক পদ রচনা করেছেন। এখনকার বাউলেরা তার পদও সম্মানের সঙ্গে দরদ দিয়েই গেয়ে থাকেন। আকাদেমি পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। লালন পুরস্কার। তাকে নিয়ে সম্প্রতি ‘মায়ানদীর কারিগর’ নামে একটি আকরগ্রন্থও প্রকাশ পেয়েছে। বিশ্বনাথ বাবার ঘরানা কিছুটা রাখতে পারলেও নাতি আনন্দ বেণীমাধব দাসের মতে ঠিকই আসলে ‘বংশে চুনকালি’ দিয়েছে। যে পরম্পরা তিনি পেয়েছিলেন, মেম-প্রীতিতে তা তিনি ধরে রাখতে পারেননি। শুনতে পাই তার সেই বাই এখনও যায়নি। আসলে বর্তমান বাউল গায়কদের এই এক সমস্যা। বিদেশে গিয়েও যে সকলের খুব রোজগারপাতি হয় তাও নয়। যাঁরা সরাসরি উদ্যোক্তাদের হাতে পড়েন তাদেরই কপাল খোলে। সে কপাল তো মোটামুটি নামি ও চালাকচতুর বাউলের হতে পারে। বাদবাকি যাঁরা বাউলের সঙ্গে পোঁ ধরেন মানে বাউল নিজ উদ্যোগে নিয়ে যান, তাদের প্রোগ্রাম পিছু সামান্যই দিয়ে থাকেন বাউল। তারা এখন এসব জেনেও যান একটাই কারণে যদি ফিরে গাঁ-দেশে বিদেশ ভ্রমণের তকমা লাগিয়ে বাড়তি কিছু অনুষ্ঠান আর ভক্তশিষ্য-শাগরেদ জোটাতে পারেন। অনেকে আবার এও ভাবেন যদি মেমের নেকনজরে পড়ে, সাধনসঙ্গিনী হয়ে আসে সে সাধন-পবন সহ আরও অনেকের মতো। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে সে গুড়ে বালিই পড়ে যায়। আর এইসব বিদেশিনি এদেশে এসে গ্রামগঞ্জ ঘুরে সকলেই যে বাউল গান ও গায়ক কিংবা সাধককে মান্য করে সংসর্গ করেন তাও নয়। এখানে অনেক ক্ষেত্রে বিদেশিনীর যৌন কামনাও কাজ করে। বাউলকে ভালোবেসে মিশে সিদ্ধ বাউল হলে তার রমণাবস্থার বীর্যধারণের সেই মজা লুটে এঁরা আসলে যৌনতাকেই আস্বাদন করতে চান অসম সংসর্গের নতুন এক স্বাদে। তাকে নিজ জায়গাতে নিয়েও যান। অনেকে পরবর্তীতে ভালোবাসা গাঢ় হলে এদেশে আসেনও পুনর্বার। অনেকে আবার এ পথ আর মাড়ান না। এ ঘটনা এখন বাউল গানের চূড়ান্ত বাণিজ্যিক প্রক্রিয়া ও চাহিদায় বলা ভালো নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। এখানে বাউলের কৃতিত্ব কতটা? বিদেশিনিই তো বাউলকে নির্বাচন করেন। বাংলার বাউল শুধু রাজি হন তাঁর সুবাদে বিদেশে যেতে পারবেন বলে। অনেক বিদেশিনির বদান্যতায় বাউলের চালাঘর পাকা হয়। স্যানিটারি পায়খানা বসে। পাতকুয়ো। টিউবওয়েল। তবে সে ভাগ্য হয় প্রবৃদ্ধ বাউল সাধকদের। যাঁদের কাছে সাহেব-মেম আসেন বাংলার বহুচর্চিত যোগ শিখতে। তারা তো আর মেমকে সাধন সঙ্গিনী করতে চান না। তাদের শরীরের সেই দাপটও নেই। আর সাধক বাউল জীবনে তিনি তখন তো একেবারেই পরিতৃপ্ত। সচ্ছলতা, নাম, পুরস্কার, বিদেশ গমনের পর এইসব অতীন্দ্রিয় সাধকদের আর কী লাগে! তেমনই সাধক হরিপদ গোঁসাই, সনাতন দাস বাউল। এঁরা বিদেশিদের অনুদানে আশ্রমে তাক লাগানো সচ্ছলতা এনেছেন। সাধনও এনেছেন তবে সেটা কেবলমাত্র সাধনসঙ্গিনী মাকির সৌজন্যে। এখানে যোগপন্থা নেই। ভালোবেসে মাকি রয়েছেন গ্রামবাংলায়। আর একটা কথা, সব বিদেশিনি যে বাউলবাড়ি আসেন সংগীতের সুরমূর্ধনায় আর সাধনরত প্রচুর দম ধরতে পারার কিংবদন্তির সেই যুবাপুরুষের শরীর পাওয়ার লোভে তাও নয়। অনেকে এসে এখানে ওঠেন পশ্চিমবঙ্গ দেখবেন বলে ঠিকঠাক অনেক সময় নিয়ে। হয়তো বা তারা সংস্কৃতি কিংবা কোনো একটা কিছু নিয়ে কেবল গবেষণা করবেন বলে। কিন্তু হোটেলে বা ঘর ভাড়া করে থাকবার মতো তাদের সামর্থ্যও নেই। তখন তারা শরণাপন্ন হন বাউলবাড়ি। আর এখানকার অবাধ যৌনতার পরশ তাঁদের জীবনের সঙ্গে একেবারে মানানসই হয়ে যায়। দু-তরফের সুবিধায় এক হন বাউল আর বিদেশিনি। এও আমার গ্রামবাংলার আখড়া-আশ্রম ঘুরে চরম বাস্তব বুঝবার অভিজ্ঞতা। বাউলসাধনে একেবারেই নিজস্ব অনুধাবনের টিপছাপ।