আপন সাধন কথা না কহিও যথাতথা
লোকধর্ম উদাত হওয়ার পেছনে যতই উদার মানবতাবাদের যোগসূত্রটা খুঁজে বের করা হোক না কেন, আদতে উচ্চবর্ণের ধর্মীয় কর্তৃত্বই নিম্নবর্গের মানুষদের শুধু। বর্ণগত নয়, ধর্মগত এই পৃথকীকরণের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। ব্রাত্য, অন্ত্যজরা সমাজপতিদের সামাজিক নিষ্পেষণের ভেতর দিয়ে যেতে যেতেই একসময় নিজ জনগোষ্ঠীর কারও মধ্যেই নেতৃত্ব বা মুক্তির স্বপ্ন সত্য হওয়ার অলৌকিক শিখাটি খুঁজে পেয়েই তাঁকে লোকনায়ক বা গুরু বলে মেনে নিয়ে তাঁর দেখানো বিপরীত ধর্ম নির্দেশ ও কায়াবাদী আচার সর্বস্বতাকে আঁকড়ে সামাজিক মোকাবিলার দিকে চলতে গিয়েই একেকটি লোকধর্মের আকস্মিক সন্নিপাত ঘটিয়েছিল।
লোকধর্মে তাই ধর্মীয় উদারতন্ত্র ও সমন্বয়বাদের অভিজ্ঞান যত না রয়েছে, তাঁর থেকে বেশি মিলেছে গ্রামকেন্দ্রিক বাংলার অকুলীন, দরিদ্র, সাধারণ মানুষদের জোটবদ্ধতার মতামত।
শিক্ষিত বাঙালি উচ্চকোটির সংস্কৃতির ভেতর দাঁড়িয়ে এ পাড়ে কলকাতা ও পাড়ে ঢাকাকেই ধরে বসেছে কৃষ্টি ও সভ্যতার তীর্থজমি। এর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দু’দিকেরই বৃহত্তর বাংলায় সংস্কৃতি তাঁদের কাছে হয়ে উঠেছে ক্রমশই লোকায়ত আর অনাধুনিক। শহরে বাস করা শিক্ষিত বাঙালি লোকায়তের ব্যুৎপত্তিগত তাৎপর্যকেই আসলে ভুলে মেরেছে। জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া বিস্তীর্ণ যে সংস্কৃতি, সেটাই যে লোকায়ত অভিধার ঐতিহ্য বহন করে, এটা শহরে বাস করে নিত্য নতুন আধুনিক বস্তুবাদী প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসে তাঁদের মাথার ভেতর থেকে একেবারেই বেড়িয়ে গেছে। ‘লোকেষু আয়তো লোকায়তঃ–এই পারিভাষিক তাৎপর্য তাঁদের কাছে বৃহত্তর বাংলায় সাধরণ ঘেঁষা ব্যাপার। নয় কোনও শহরকেন্দ্রিক সংস্কৃতিকে তারা নিজেদের মতো করে তাই মূলধারা বানিয়ে তুলেছে। আর বাদবাকি যতটুকু, যা কিছু, সবই এখন লোকায়ত বাংলার সংস্কৃতি। শিক্ষিত বাঙালির নিজস্ব ইতিহাস চর্চার বহর ক্রমশই ঢাকা-কলকাতার ফ্ল্যাটবাড়ির মতো ছোট হচ্ছে বলেই, তারা তাই শেকড় ভুলে গিয়ে স্বল্প পরিসরের সংস্কৃতিকেই প্রধান বলে দেগে দিয়ে নিজেদের বিদগ্ধ ও পণ্ডিতজন মেনে আধুনিক মননচর্চায় ব্রতী হয়েছে। তাদের সামনে পড়ে রয়েছে অবিদগ্ধ লোকায়ত জনের সংস্কৃতি। এই গরিমার ভেতরই বড় হচ্ছে, বৃহত্তর হচ্ছে শিক্ষিত বাঙালির বোধ ও বিবেক।
লোকধর্ম তথা লোকায়তজনের সংস্কৃতিকে ধরতে হলে তাই সংকীর্ণ বাঙালির নষ্ট জাতিসত্তার দরজার ভেতর দিয়ে প্রবেশ করলে হবে না কখনওই; আমাদের ঢুকতে হবে বৃহত্র বাংলার সেই বন্ধ হয়ে যাওয়া লোকায়তের দরজা দিয়েই।
*****
অজয় নদের দক্ষিণ পাড়ে যেদিন পাল রাজার ঢিবি আবিষ্কৃত হল, সেদিনই খ্রিষ্টপূর্ব দেড় হাজার বছর আগেকার বাঙালির কৃষ্টি ও সভ্যতায় জুড়ে গেল অন্ত্যজ অভ্যুত্থানের সত্য। বাংলাদেশের সেই তাম্র প্রস্তর যুগে বরেন্দ্র কৈবর্ত্যনায়ক দিব্যোক পাল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। রাজা দ্বিতীয় মহীপালকে হত্যা করে তখনই বরেন্দ্রভূমিতে কৈবর্ত্যাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
পাল রাজসভার সভাকবি ছিলেন সন্ধ্যাকর নন্দী। স্বভাবতই তিনি রামচরিত এর পাতায় দিব্যোকদের বিদ্রোহকে হেয় প্রতিপন্ন করবেনই। কবিমশাই তাই দিব্যোককে দস্যু আখ্যা দিলেন। প্রজাবিদ্রোহকে ধর্মবিপ্লব বলে দেগে দিয়ে তিনি ভরস্য আপদম বলে বর্ণনা রাখলেন ‘রামচরিত’ এর পাতায়। বিকৃত হল ইতিহাস। বাঙালি ধরতেই পারল না ঠিক ভাবে, এগারো শতকে কৈবর্ত্যদের গণবিদ্রোহের উত্তাপ। সন্ধ্যাকর দিব্যোকের সামাজিক অবস্থান, বৃত্তি সব বেমালুম চেপে গেলেন। বললেন না তাঁর নামিত এই দস্যু সমাজের প্রতিনিধিরাই এগারো বারো শতকে গোটা বাংলা জমি জুড়ে কেবট্ট নামে পরিচিতি পেয়েছিল। এঁদের কেউ কেউ শিক্ষিত ছিলেন, সংস্কৃত চর্চা করতেন, কবিতাও লিখতেন। ‘সদুক্তি কর্ণামৃত’ নামক সংকলিত কাব্যগ্রন্থে পপীপ রচিত একখানি পদও বর্তমান। পপীপ জাতে ছিলেন কৈবর্ত শিক্ষিত উচ্চবর্ণের ভাগ করা লোকায়ত বাংলার প্রতিনিধি। জীবিকা বৃত্তির দিক থেকে কৃষক ও জেলে সমাজের প্রতিনিধি।
সন্ধ্যাকরের রাজ সন্তুষ্টির ব্যাপার ছিল। সেজন্যই তিনি পাল রাজবংশের জয়গান গাইতেই ব্যস্ত ছিলেন। রাজবংশের আভ্যন্তরীণ অন্তর্দন্দ্ব; মহীপালের নির্বুদ্ধিতা, রামপালের বিচক্ষণতা–এসব বোঝাতেই তিনি ব্যস্ত। রামচরিত লিখতে বসেছেন তিনি। তাই রামপালের বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তা–পাল রাজাদের সেনাবাহিনীর পক্ষে এই বিদ্রোহ দমন কোনোভাবেই সম্ভব নয় বুঝে নানান ছোট বড় রাজা ও সামন্ত সৈন্য সংগ্রহ করে সেই বিদ্রোহ দমনের কাহিনী লিখতে গিয়ে সন্ধ্যাকর এটা অবশ্য বুঝিয়ে দিলেন যে, কৈবর্ত্য সংগঠন কী বিপুল জোরদার ছিল।
বিদগ্ধ পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশাই যখন বইটি সম্পাদনা করে বাজারে আনলেন, তখনই শিক্ষিত বাঙালি তথা ঐতিহাসিক মহলের চোখ খুলে গেল। তাঁরা সন্ধ্যাকরের পাল রাজার গুণপ্রশস্তি সরিয়ে এটা তখন বুঝতে পারলেন যে, এর ভেতর রয়েছে কৈবর্ত বিপ্লবের সংঘবদ্ধতা রামচরিত কেবলমাত্র রাম রাজার জীবনীগ্রন্থ তো নয়, এতে মিশে আছে গণঅভ্যুত্থানের সত্য, শিক্ষিত বাঙালির দাগা সেই লোকায়ত সমাজের উঠে দাঁড়ানো, ঘুরে দাঁড়ানোর শ্বাস প্রশ্বাস।
শাস্ত্রী মশাই তো এমন কাণ্ড আরও ঘটিয়েছিলেন। ১৯১৬ সালে তিনি হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোঁহা বের করে শিক্ষিত বাঙালির বিদ্যাচর্চার। মুখে একেবারে ঝামা ঘষে দিলেন। পরবর্তীকালে যখন তিব্বতী গ্রন্থ ‘চতুরশীতি-সিদ্ধ প্রবৃত্তি’তে চুরাশি সিদ্ধর কাহিনী সম্পূর্ণ উদ্ভাসিত হল বাঙালির পড়ার দরজায়, তখনই বিদগ্ধ বাঙালি বুঝতে পারল, বাংলা ভাষাচর্চার মান্য প্রকরণে আদতে মিশে আছে লোকায়ত সমাজের ইতিহাস। গ্রাম্য চাষি,জেলে, জোলা, তিলি, মুচি, চণ্ডালরাই লিখেছেন তাঁদের ধর্মাচরণের ইতিহাস। লোকায়ত সমাজের ধর্ম, সাধনা, সংস্কৃতি, সংঘাত, লড়াই নিয়ে এসব কাব্যকথাই শেষমেশ হয়েছে প্রামাণ্য বাংলার প্রতিনিধি। আর এই কাহিনীর সময়কালটাও জড়িয়ে আছে পাল রাজাদের সময়সীমায়।
একদিকে চলছে তাত্ত্বিক বৌদ্ধধর্মচর্চা। পাল রাজাদের চূড়ান্ত পৃষ্ঠপোষকতা। নালন্দা, বিক্রমশীল, ওদন্তপুরী, সোমপুর বিহারে শাস্ত্রজ্ঞ বৌদ্ধাচার্যদের দাপট। এর ঠিক উল্টোপিঠে শ্মশানে, বেশ্যাবাড়িতে, গুঁড়িখানায় মাথা তুলছে, বিদ্ধ হচ্ছে, আক্রান্ত হচ্ছে তখন লোকায়ত সহজসাধনা। এরা গুরুর নির্দেশে ইন্দ্রিয় সংযম করছেন মাত্র, পাশ কাটাতে বাসি-পচা খাচ্ছেন, মদ-মাংস-মৈথুনের স্থূলতার ভেতর দিয়েই সাধন সঙ্গিনী নিয়ে বসবাস করছেন নির্জন পরিত্যক্ত স্থানে। সমাজ ছেড়ে, জাত ছেড়ে, বর্ণ ভুলে এরা মজে রয়েছেন কিন্তু বাউল ফকিরদের অনুসারী সেই সহজধর্মে। তাই বাংলার বাউল ফকির লোকসাধনার ইতিহাস ও প্রেক্ষাপটে এইসব স্বজন, সুজন, মনের মানুষদের জীবনাচরণ ও যুঝে চলার ইতিহাসটিরও একটি সদর্থক জায়গা রয়েছে। পেশা, শিক্ষা, সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে এরা সেই শিক্ষিত বাঙালির বানানো লোকায়ত সমাজেরই প্রতিনিধি। বাংলায় লোকধর্ম উদাত হওয়ার পেছনে এঁদেরও সাযুজ্যের অন্তর্ভুক্তি কায়াবাদী সহজ সাধনার কারণেই।
* *** *
বাংলার সাধারণজনের প্রধান জীবিকা চাষবাস বা কৃষিকাজ। এমনকি প্রাচীন ভারতের লোকায়ত মত অনুসারে এই বৃত্তিটিরই স্বীকৃতি রয়েছে একমাত্র বিদ্যা হিসাবে। বিদগ্ধদের দেওয়া গাল ভরা বার্তা নামে। এই বার্তা শব্দের মূল অর্থটি হচ্ছে কৃষিকাজ। চাষবাস চিরকালই উচ্চকোটির ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি বলয়ের বাইরে। মনু মশাই তো তাঁর। সংহিতাতে একবারে স্পষ্ট ভাষায় কৃষিকর্মকে ব্রাহ্মণদের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। অর্থাৎ কিনা সমাজের উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিরা কখনওই উৎপাদন কার্যের সঙ্গে যুক্ত থাকবে না। তারা পুঁথি লিখবে, শাস্ত্রচর্চা করবে, সমাজ পরিচালনার বিধিনিয়ম বানাবে, ধর্ম সংস্কৃতিটা পুরোপুরি তাদের হাতে থাকবে। আর দেশ রক্ষার দ্বায়িত্ব ক্ষত্রিয়দের। গায়ের জোরে, কর্ম ক্ষমতায় ধূর্ত শিক্ষিত ব্রাহ্মনরা ওদের সঙ্গে পেরে উঠবে না বলেই একটা সামাজিক সম্মানের থাক বরাদ্দ রয়েছে ক্ষত্রিয়দের জন্য, এঁদের চটালে দেশে বসে পরম নিশ্চিন্তে করে-কষ্মে খাওয়া শক্ত। বর্গীর হানা থেকে দেশ বাঁচানো ক্ষত্রিয়দের তাই চট করে উত্তেজিত করতে চায়নি ব্রাহ্মণরা। বৈশ্যদের সঙ্গে অর্থনীতির যোগ। দেহে সেই স্থিতাবস্থাটাও তো জরুরি। তাই এই থাক নিয়েও ব্রাহ্মণরা নীরব। এর বাইরে যে বৃহত্তর জনতা জনার্দন, লোকায়ত সমাজ–চাষি ও কৈবর্ত, হালিক জেলে বা জেলিয়া সম্প্রদায় ছাড়াও আছে ধোপা, যুগী, গুঁড়ি, কলু, মাঝি, কাহার, চণ্ডাল, বাড়ুই, চামার, নিকিড়ি, জোলা, নলুয়া, মাল, মিস্তিরি–নিম্নবর্গীয় এই হিন্দু ও মুসলমানদের বিস্তৃত লোকায়ত এলাকা। তারাই চর্যাপদের যুগ থেকে অদ্যাবধি জাতিভেদ, শাস্ত্র এবং ধর্মাচারকে অগ্রাহ্য করে মুখবাহিত মুখরক্ষিত গুরুকেন্দ্রিক করণধর্মের দিকে ঝুঁকে আছে। এগারো শতকে এই শ্ৰেনীটিই পাল রাজাদের মুখ পুড়িয়েছে। দিব্যোক যার প্রধান প্রতিনিধি। বরেন্দ্রজমিতে কৈবর্তদের এই অধিকারের পুরুষানুক্রমেই বাড়বৃদ্ধি ঘটেছে।
দিব্যোকের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই রুদোক, রুদোকের পর তাঁর ছেলে ভীম। দ্বিতীয় মহীপাল যখন দিব্যোকের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। তখন তাঁর দুই ভাই শুরপাল ও রামপাল কারাগার থেকে পালিয়ে গিয়ে পালবংশের অধিকৃত এক অংশে রাজত্ব করতে থাকেন। এরপর দিব্যোকের উৎখাতের জন্য সৈন্য সংগ্রহ, শুরপালের মৃত্যু, রামপালের সিংহাসনে বসা, মগধ, ওড়িশা, বরেন্দ্ৰজমি,দণ্ডভুক্তি বা হালের মেদিনীপুর, বগড়ী বা নতুন গড়বেতা, কুজটি বা গালভরা সাঁওতাল পরগনা সহ বিস্তীর্ণ এলাকার সামন্ত রাজাদের এক করে কৈবৰ্তরাজ ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শেষমেশ তাঁকে বন্দী করে, তাঁর পরিবারবর্গকে নৃশংসভাবে হত্যা করে কৈবর্ত্যদের বরেন্দ্রভূমি থেকেই বলা চলে একেবারে উৎখাত করেন রামপাল।
সন্ধ্যাকর নন্দী রামচরিত এর পাতায় সেই জয়গানই গেয়েছেন। কিন্তু লোকায়ত তথা নীচু মানুষদের গন অভ্যুত্থানকে যতটা সম্ভব হেয় প্রতিপন্ন করে বেমালুম চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, যেটুকু যা বেড়িয়ে পড়েছে তা তাঁর ওই কলম চালানোর অসতর্কতায়। আর হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশাই সম্পাদনাকালে দৃষ্টিগোচরে এনেছেন বিষয়টি। শিক্ষিত বাঙালি তাই প্রামান্যের নথিকে আর অস্বীকার করতেই পারেনি। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বৌদ্ধগনের দোহায় দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের মতো বৌদ্ধাচার্যেরও নাম রেখেছেন, নাম আছে মহাসুখতাব্রজ, বৈরোচন, দৃষ্টিগেন নামক বৌদ্ধ আচার্যদেরও। অথচ এরা কেউই কিন্তু সহজ সাধক নন, কায়াবাদী সাধনা করেননি। লোকচক্ষুর অন্তরালে শাস্ত্রীয় ধর্মাচার খুইয়ে তান্ত্রিক যোগ সাধনাই সিদ্ধদের কাহিনীতে সংযুক্ত, এখানেই দেখা মিলছে ডাকিনী মা গুরুর। এই ডাকিনীদের সঙ্গে বাংলার ভৈরবী মা-গুরুদেরও প্রভূত মিল। তারাও শশ্মশানে। থাকছেন, সহজ শক্তির বিদ্যা রপ্ত করে শক্তিশালিনী হচ্ছেন, অথচ তারাও সিদ্ধ ডাকিনী মা গুরুদের মতোই নিষ্পেষিতা, তাচ্ছিল্যপ্রাপ্তা, শিক্ষিত বাঙালির ধর্মচর্চায়। বৈষ্ণব সহজ সাধনাতেও সেই একই প্রবাহমান ধারা। উচ্চবংশীয় ব্রাহ্মণ চণ্ডীদাসকে ধোপানিকে সাধন সঙ্গিনী করে কায়াবাদী রস সাধনায় মনোনিবেশ করতে গিয়েই শেষে একঘরে হতে হয়েছিল। পরে চণ্ডীদাস জাতে উঠেছেন। বৈষ্ণব কবি বলে কলকে পেয়েছেন। বয়াতি বাউল, ফ্যাকরা-ফকির সেজে পদ লিখলে তাঁকে আর জাতে উঠতে হতো না।
বাংলায় বৈষ্ণব আন্দোলন অনেকটা একক ধর্মগোষ্ঠী পাকিয়ে দানা বেঁধেছিল বলে, আর প্রবর্তক, গুরু গোঁসাইরা সব শিক্ষিত শাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন বলেই একটা গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য শাখা পদাবলী কীর্তনের সৃষ্টি হয়ে যাওয়ার কারণেই তাঁরা সব বাঙালি কবির মর্যাদা নিয়ে বসে যেতে পেরেছেন সাহিত্য ইতিহাসের পাতায়। বৈষ্ণব মহাজনদের শিক্ষিত বাঙালি তাই মান্যতা দিয়েছে। বাউল-বয়াতি, ফকির-ফ্যাকড়াদের দিকে চোখ তুলে আর তাকাবার সময়ই পায়নি। এখন অবশ্য ঢাকা কোলকাতায় ফোকলোর আধুনিকায়ন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হওয়াতে বাউল ফকিরদের কপাল খুলেছে। বাউল ফকিরি গান, গায়ক, পদকর্তাদের খুঁজে পেতে গ্রথিত করার অবকাশ মিলছে। শিক্ষিত বাঙালি ঘুরে তাকাচ্ছে এদের দিকে। গান শুনতে আখড়ায় যাচ্ছে, গাঁজা খাচ্ছে। লোকধর্মের সাধুগুরুদের। নিয়ে তাই গড়ে উঠছে এক পপুলার কালচার, যার পুরোভাগে দাঁড়িয়ে আছেন যিনি, তিনি হলেন ফকির লালন সাঁই।
*****
লোকধর্মের মান্য ইতিহাস যে শুরুর কাল থেকেই সমাজের উপরতলার শাসক সম্প্রদায়ের নেকনজরে বড় হয়েছে তার নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে চতুরশীতিতে, বৌদ্ধগন ও দোঁহায়। অভয়দত্তশ্রীর বিবৃতি আর হরপ্রসাদীয় সংগ্রহই বলে দিচ্ছিল যোগী ও ডাকিনীর কাছে সিদ্ধ হওয়া মহাজনেরা দীক্ষালব্ধ নামে প্রচারিত হয়েছেন তাঁদের নিম্নবর্গীয় জনসমাজে বেশিরভাগটাই বৃত্তিগত নজির নিয়েই। জেলে-চাষা-কুমোর-চামার-কামার তাঁতি-জোলা সকলেই জীবিকা উপায়কে শিরোধার্য করেই শ্মশানে, প্রান্তিক এলাকায় সাধনা করেছেন, গুহ্যজ্ঞান লাভ করে সিদ্ধ পদবাচ্য হয়েছেন। দীক্ষায় তাঁদের নামান্তর ঘটলেও দীক্ষালব্ধ নামের ভেতরও তাঁরা তাঁদের পূর্বাশ্রমের জীবন জীবিকাকে ভুলে মারেননি। বরং হীন সামাজিক স্তর থেকে উঠে এসেই তন্তিপা তাঁতি, তেলিপা তেলি, ধোম্বিপা ধোবি, চামরিপা চামার, কংপরিপা কামার, মেদিনীপা চাষি, কুমরিপা কুমোর এটাই বোঝাতে চেয়েছেন তাঁদের পরিবেষ্টিত নীচুতলার পরিশ্রমজীবী মানুষদের, তোমরাও সাধনা করো, বৃত্তিনির্বাহ করো প্রবল আত্মবিশ্বাসে; রাজশক্তির মতো সামাজিক বাঁধা থাকবে, থাকবে শাসক স্বার্থের মতো দাবানো, প্রতিহত করবার মতো সামাজিক বাস্তবিক নিষ্পেষণ, তবু এরই ভেতর রাজ দরবারের মান্য ভাষায় নয়, উচ্চবর্ণের সংস্কৃত ভাষ্যে নয়, কথা বলতে হবে, গান বাঁধতে হবে, সাধন গুহ্য কথা বলতে হবে নিজেদেরই বোধগম্য ভাষায়। এই ভাষাকে উচ্চবর্গীয় সমাজের ভেতর কোনোভাবেই ছড়িয়ে দেওয়া যাবেনা, এ ভাষা হবে নিজেদের গুরু আধারিত, সাধনলব্ধ, দেহজ্ঞান বা অনুভূত সত্যেরই ভাষা। উচ্চবর্ণের সমাজ পরবর্তীতে এই ভাষার মধ্যে নাক গলাতে গিয়েই তাই থই পায়নি। টাকাকার–ভাষ্যকারেরা সেজন্য এর নামকরণ করে দিলেন ‘সন্ধ্যা ভাষা’বলে। ‘পরিশ্রমজীবীদের’ সহজ সরল ধর্মচর্চার চর্যাগান বা সাধন উপলব্ধ সত্যকে নিয়ে তাঁরা। মাতম্বরি মারলেন একেবারে সংস্কৃতে টীকাটিপ্পনী, ভাষ্যটাস্য করে ফেলে। তাঁরা একবারও বুঝলেন না, এই ভাষায় রয়েছে সহজ সাধনার প্রয়োগমূলক এক জীবনচর্যা। সেই জীবনে প্রবেশ না করলে, নিজে সাধনা করে ফলিত আচরণ বুঝতে না পারলে ভাষাতত্ত্বের অধিকার নিয়ে তাঁর টীকা-ভাষ্য করলে সেগুলো হয়ে উঠবে দার্শনিক জ্ঞান, লোকধর্ম যাকে বরাবরই এড়িয়ে চলেছে। শাস্ত্র, পুথির বক্তব্যকে অস্বীকার করে লোকধর্ম যুগল দেহসাধনার লৌকিক রীতিটিকেই নিজেদের বায়েত বয়াতিদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে বলেই আচরণবাদী, প্রচ্ছন্ন ও সংগুপ্ত এই সাধনপথের গুরু বলেছেন–
আপন সাধন কথা না কহিও যথাতথা
আপনার আমিরে তুমি হইও সাবধান।
লোকধর্ম চিরকালই আপ্ত সাবধান হওয়ার কথা বলে এসেছে। দেহনির্ভর সাধনা, কাম থেকে প্রেমে উত্তরনের পথ-নির্দেশিকা, শ্বাস নিয়ন্ত্রণের যৌন-যৌগিক ক্রিয়া নিয়ে তাই গড়ে উঠেছে দেহতত্ত্বেরই সাধনমালা। চুরাশি সিদ্ধদের লেখাও সেই পর্যায়ভুক্ত। মুনিদত্তের মতো বিদগ্ধ সংস্কৃত পণ্ডিত তাই গম্ভীর সংস্কৃত এমন এক টীকা ভাষ্য রচনা করে বসলেন এগুলোর অর্থপ্রাপ্তি ঘটাতে, যেখান থেকে বেড়িয়ে এল কেবল মহাযান বৌদ্ধসাধনার জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা। সহজ সাধনার গুরু নির্দেশিত বস্তু ধরার করণকৌশল, যুগল সাধনা, রস সাধনা-সবই এখানে হয়ে উঠল বৌদ্ধদর্শনের মান্য শাখা। ভারতীয় দর্শনের স্বভাব চরিত্রে শেষমেশ তাকে বসাতে গিয়ে মুনিদত্ত একে এনে ফেললেন দেহতত্ত্বের জটিল পরিক্রমায়। লোকধর্ম বরাবরই এই শাস্ত্রীয় জটিলতার বাইরে থাকতে চেয়েছে আর আমাদের বিদগ্ধ পণ্ডিতপ্রবর ব্যক্তিরা সবসময়ই এর ভেতর নাক গলাতে গিয়ে দেহচর্চার করণে এলোপাথাড়ি জ্ঞানগম্ভীর বক্তব্য প্রকাশ করে এই এলাকাটাও দখল নিতে চেয়েছেন। ঠিক যেমনভাবে সন্ধ্যাকর নন্দী শূদ্র জাগরণের ইতিহাসকে চাপা দিতে একে ধর্মবিপ্লবের পর্যায়ে দাঁড় করাতে এক প্রকার বাধ্যই হয়েছিলেন রাজশক্তির দাক্ষিণ্য লাভের আশায়, মুনিদত্তও তো এর ব্যতিক্রম নন।
দিব্যোক, রুদোক, ভীম–এই তিন কৈবর্ত জননায়কের বরেন্দ্রজমিতে রাজা বা গননায়ক হিসাবে প্রতিপত্তির কথা বল্লালচরিত এও রয়েছে। কৈবৰ্তরা যখন বরেন্দ্ৰজমির অধিকার ছাড়তে বাধ্য হল রামপালের তৎপরতায়, তখন তারা হুগলী, হাওড়া, মেদিনীপুরে ছড়িয়ে পড়ল। এই হুগলিতেই ছিল ভুরশুট রাজ্য। চোদ্দ পনেরো শতকে যা কিনা ধীবর রাজার অধীন। যদিও এই ধীবর রাজার ইতিহাসের ঐতিহাসিক কোনো তথ্য নেই, তিনি বেঁচে আছেন কাহিনী-কিংবদন্তিতে স্থানীয় মানুষদের স্থানিক ইতিহাসে। তবে শেষ ধীবর রাজা শনিভাঙ্গের পরাজয় এবং গড় ভবানীপুরবাসী চতুরানন নিয়োগীর ভুরশুট রাজ্য দখল করে নেওয়াটা জাহাঙ্গীর আকবরের রাজত্বকালের আলোকায়নে ঘটা বলেই ইতিহাসে সামান্য জায়গা মিলেছে। লোকধর্ম তথা লোকায়ত মানুষদের স্বীকৃতির পেছনে। এভাবেই জড়িয়ে গিয়েছে সবসময়ই বিদগ্ধদের পদচারনা।
সন্ধ্যাকর কৈবর্ত বিদ্রোহে ধর্মাবহের প্রলাপ বকলেও পরবর্তীতে ময়মনসিংহের কৃষক বিদ্রোহের নায়করা কিন্তু নিজেদের বাউল বলে পরিচয় দিয়েছে, আবার আসাম দেশের কৃষক বিদ্রোহীরা বৈষ্ণব বলে অভিহিত করেছে নিজেদের। এর থেকে এটাই অনুমেয়, লোকায়ত মানুষদের উঠে দাঁড়ানো, লড়াইটা সব সময়ই আদতে পরিশ্রমজীবীদের জীবনধারা বাহিত ধর্মাবহের ভেতর দিয়েই ঘটেছে। এই যে নিজেদের বাউল, বৈষ্ণব বলে দেগে লড়াইয়ে নামাটা কিন্তু সেই প্রবর্তক বা ধর্মগুরুদের পরশ্রমজীবীদের শাস্ত্রীয় ভাবধারার বাইরে গিয়ে দাঁড়ানোরই এক পৃথকীকরণের মণ্ডল।
ঢাকার মান্য গবেষক যতীন সরকার প্রাকৃতজনের ‘জীবন দর্শন’ গ্রন্থে এই শ্রেণিকরণটিকে পরিশ্রমজীবী ও পরশ্রমজীবী বলে চিহ্নিত করে দিয়ে দুই সমাজের দর্শনকে ভাববাদ-আশ্রয়ী ও বস্তুবাদেরই প্রাধান্য বলে উল্লেখ করে লোকধর্ম তথা দেবীপ্রসাদ কথিত ‘লোকায়ত দর্শন’ এর মূল যে সাধনায় দেহ তথা দেহেরই রজঃ বা বর্জ্য পদার্থের ব্যবহার তারও ইঙ্গিত রেখেছেন। লোকধর্ম এক অর্থে তাই বস্তুবাদী সম্প্রদায়েরই নামান্তর। শক্তিনাথ ঝাঁ সেই কারণেই বাউলের সমাজ, সংস্কৃতি ও দর্শনের গ্রন্থনাকে বস্তুবাদী বাউল বলেই স্পষ্ট করে রেখেছেন। লোকধর্মের মান্য ইতিহাস বা লোকায়ত দর্শনে এই বস্তুবাদ আদতে যে রজবীর্যের দেহক্ষয় বা কামের তৎপরতাকে টপকানোরই বস্তু সাধনা, সেটা প্রথমেই মাথায় ঢুকিয়ে নিতে হবে। রহস্যাচ্ছাদিত সেই করণের ভেতরই দাঁড়িয়ে আছে বাংলার লোকধর্মের ইতিহাসও প্রেক্ষাপট। চুরাশি সিদ্ধ-র কথন দিয়েই তাই শুরু করতে হবে আমাদের ঘুরে তাকানো। নচেৎ লোকায়ত চর্চায় বাদ পড়ে যাবে মধ্যযুগের ইতিহাস।
*****
আঠারো শতকের নবদ্বীপ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এক্তিয়ারে। দক্ষিণ দেশ থেকে কট্টর দ্রাবিড় বৈষ্ণব ভক্ত তোতারাম এসেছেন নবদ্বীপে ন্যায়শাস্ত্র পড়তে। নবদ্বীপে চৈতন্যের আমলের ন্যায়চর্চার অক্ষত ধারা না থাকলেও তখনও শ্রুত গৌরব অক্ষত; রমরম করে চলছে ন্যায়চর্চার টোল তোলারাম এই টোলে পড়তে পড়তেই বৈষ্ণবতার ছোঁয়া মাখলেন। গায়ে, আর পর পরই সাধন ভজন করতে ছুটলেন কৃষ্ণের দেশ বৃন্দাবনে।
বৃন্দাবনে বসেই তোতারাম বাবাজি খবর পেলেন বাংলার বৈষ্ণবতায় শাস্ত্রিক আচারে ধ্বস নেমেছে, লোকধর্মের নানা শাখায় গৌড়ীয় বৈষ্ণবতা বিপন্ন। তিনি ছুটে এলেন নবদ্বীপে বৈষ্ণবীয় ভজনে শাস্ত্রিক শুদ্ধাচারের বাণী শোনাতে। পেলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দাক্ষিণ্য। ছয় বিঘা নিষ্কর জমিতে পত্তন করলেন আখড়া। তাঁর আখড়াতেই চর্চিত হতে থাকল নৈষ্টিক বৈষ্ণব ধর্ম। নবদ্বীপ তথা বাংলায় তখন নানা বৈষ্ণব উপসম্প্রদায়ের স্রোত, সহজিয়া মত, কায়াবাদী সাধনার রমরমা। জাতপাত, উচ্চনীচ, অধিকারী-অনধিকারী বিচারের গৌড়ীয় বৈষ্ণবতাই হাড়ি, ডোম, বাগদি, বাউরি, ঘোষ, পাল, দাস, রুইদাস, কাঁসারি, শুড়ি, ধোপা, ঘুগী, কলু, কপালী, মাঝি, মালো, রাজবংশী, পোদ, কাহার, চণ্ডাল, বেলদার, কোরা, বাগদী, বাড়ুই, করণ, গাঁড়ল, ভূঁইয়া, চামার, মাল, বেদে, বুনোদের পৃথক এক ধর্মীয় আচারের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। যেখানে এলে ধর্মচর্চা, শাস্ত্রচর্চা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনার অধিকারী পুরোহিত বা ব্রাহ্মণশ্রেণীর উৎপাত বা শোষণ নেই। বৈষ্ণব উপসম্প্রদায়ের স্রোতে, সহজিয়া মতে, কায়াবাদী সাধনায় পুরোহিত নেই কোনও, গুরু আছেন। তবে তিনি ব্রাহ্মণ মন্ত্র-দীক্ষাদাতা গুরুও নন, তিনি যেমন শূদ্র, তেমনি কিছু ক্ষেত্রে নারীও বটে।
জনবিন্যাসের এই বিচিত্রতায় বৃহত্তর লোকায়ত সমাজ তখন বাঙালির শাস্ত্রিক বিধির বাইরে। তারা ইহজীবন, দেহ আর দৃশ্য মানুষের ভজনা করে খালি। জাত, লিঙ্গ, সাম্প্রদায়িক সীমানা, পরলোক, পূর্বজন্ম, পুনর্জন্ম, ব্রত, পুজো, রোজা–এইসব অনুমানে তাঁদের বিশ্বাসীই নেই। তারা বর্তমানপন্থী, ‘যা আছে দেহভাণ্ডে, তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে’–এই তাঁদের সিদ্ধান্ত। প্রকৃতির সকল গুপ্ত শক্তির সঙ্গে শরীরের গুপ্ত শক্তির যোগাযোগ নিয়েই তাঁদের দেহতত্ত্বের সাধনা পুষ্ট। যে সাধনাতে মানুষই হল গিয়ে অন্বিষ্ট। সাধনসঙ্গী-সঙ্গিনী গুরু ইষ্ট, আর দেহ শরীর হল গিয়ে বেদ-কোরান।
বৃহত্তর এই জনগোষ্ঠীর এমন অবৈদিক-বেদবিরোধী বা লিখিত শাস্ত্র অমান্য করার কায়াবাদী-আচরণমূলক ধর্ম দেখে তোতারাম বাবাজি ভীষণ চিন্তিত হয়ে শেষমেশ নিদান হাঁকলেন:
আউল বাউল কর্তাভজা নেতা দরবেশ সাঁই।
সহজিয়া সখী ভাবকী স্মার্ট জাত গোঁসাই।।
অতি বড়ী চূড়াধারী গৌরাঙ্গ নাগরী।
তোতা কহে এই তেরোর সঙ্গ না করি।।
উচ্চবর্ণের সমাজপতি বা ধর্মগুরুর এই নিদানই বলে দিচ্ছে আঠারো শতকে হঠাৎ গজানো বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশ্রয়স্থল শাস্ত্র মান্যতার ধর্মকে কতখানি বেগ দিয়েছিল। উনিশের শেষ পাদে ১৮৮২ নাগাদ দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ ঠাকুর পর্যন্ত চিন্তিত তাঁর ওখানে যাতায়াত করা ভক্ত হরিপদর ধর্ম নিয়ে। কেননা হরিপদ ঘোষপাড়ার কর্তাভজা ধর্মের এক ‘মাগীর’পাল্লায় পড়েছে। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে বৌদ্ধিক আসরেও বেগ দিচ্ছে কর্তাভজা ও বাউল ধর্ম। কেননা ঠাকুর বাউল ধর্ম নিয়েও উদ্বিগ্ন; পায়খানার দরজা’ দিয়ে প্রবেশ করা পথ বলে তিনি একেও টিপ্পনী কাটছেন। দাশরথি রায়ও ফুট কাটছেন–
নূতন উঠেছে কর্তাভজা শুন কিঞ্চিৎ তার মজা
সকল হতে শ্রবনে হয় মিষ্ট
বাল বৃদ্ধা যুবা রমণী নিষেধ মানে না যায় অমনি
অন্ধকারে পথ হয় না দৃষ্ট।
আর বাংলা সাহিত্যের প্রধান ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ শতক শেষে ১৮৯৫ সালে রানাঘাটের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কবি নবীনচন্দ্র সেনের কর্তাভজা মেলায় পৌরহিত্য করবার কথা শুনে রীতিমতো আঁতকে উঠে বলে ফেললেন–
শুনিয়াছি উহা বড় জঘন্য ব্যাপার।
এইসব নিদান, টিপ্পনী, খোঁচা, উদ্বেগ, ব্যভিচারের তর্জনী নির্দেশই বলে দিচ্ছে আঠারোর শেষ থেকে শুরু হওয়া কর্তাভজা ধর্ম সহ আউল, বাউল, সাঁই, দরবেশ, সহজিয়া মত উচ্চবর্ণের সমাজকে বেগ দিচ্ছে। আর নিম্নবর্গীয়রা সংস্কৃত মেশানো মন্ত্র না বানিয়ে একেবারে বাংলায় মন্ত্র পড়ছেন, তত্ত্বকথা বলছেন, মধুস্রারী সঙ্গীত রচনা করছেন এমনই এক ভাষায় যার গ্রহ্যাবয়ণ ভেদ করতে গিয়ে এখনকার গবেষকদেরও মুনিদত্তের পথ ধরতে হয়েছে।
কর্তাভজারা বললেন–
কৃষ্ণচন্দ্র গৌরচন্দ্ৰ আউলচন্দ্র
তিনেই এক একেই তিন।
সাহেবধনীরা বললেন–
সেই ব্রজধামের কর্তা যিনি
রাই ধনী সেই নামটি শুনি
সেই ধনী এই সাহেবধনী।
হাড়িরামী-বলরামীরা বললেন–
হাড়িরাম তত্ত্ব নিগূঢ় অর্থ বেদান্ত ছাড়া।
করে সর্ব ধর্ম পরিত্যাজ্য সেই পেয়েছে ধরা।।
ওই তত্ত্ব জেনে শিব শ্মশানবাসী।
সেই তত্ত্ব জেনে শচীর গোরা নিমাই সন্ন্যাসী।।
বীরভদ্রপন্থীরা বললেন–
বীরচন্দ্ররূপে পুনঃ গৌর অবতার।
যে না দেখেছে গৌর যে দেখুক এবার।
লালনশাহীরা বললেন–
গুরু ছেড়ে গৌর ভজে
তাতে নরকে মজে।
সহজিয়া বৈষ্ণবরা বললেন–
যে রাধাকৃষ্ণের কথা পদে গায়।
সে তো বৃন্দাবনের কৃষ্ণ রাধা নয়।।
লোকধর্মের এইসব বলাবলিই বলে দিচ্ছে যে, আঠারো শতকের বাংলায় যে সব বৈষ্ণবীয় উপসম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছিল সবেরই মূলে রয়ে গেছেন সেই আচণ্ডালে প্রেম বিতরণকারী চৈতন্য মহাপ্রভু। সামগ্রিক লোকধর্ম সম্পর্কেই আদতে কথাটি খাটে।
*****
একদিকে মুসলমান শাসন, অপরদিকে ধর্মান্তকরণ;গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতো তাঁর ওপর আবার ব্রাহ্মণ সমাজপতিদের মাতব্বরি; মৃদু আচারে তন্ত্র সাধনা ও বৌদ্ধ সহজাচার্যদের যৌন বিকৃতি; লোকাচারে চণ্ডী-মনসার ভীতি-বিশ্বাসের নিম্নবর্গীয়দের। অবলম্বন; কেননা দূর্গা-লক্ষ্মীর ব্রাহ্মণ্য মন্ত্রাচারে, বৈদিক অৰ্চনায় এদের তো আর ঠাঁই নেই, সেই ঠাঁইহীন মানুষজনদের জন্য চৈতন্যদেব তখন শাস্ত্রাচারের, মন্ত্রাচারের জটিলতাকে দূরে সরিয়ে এনে দিলেন কেবল অহৈতুকী ভক্তির কৃপা। তিনি ত্রাতা, অজ্যদের ভগবান; ব্রাহ্মণ্য শক্তির বিরুদ্ধে জেহাদ তোলা নেতা; নামজপের সাধারণী করণে বাংলার সাধারণজনকে দিয়েছেন প্রতিরোধের ভাষা। কিন্তু সেই ভাষাই আবার চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের একশো বছরের মধ্যেই ঘুরে গেল বৃন্দাবনের গোস্বামীদের শাস্ত্রীয় কচকচালিতে আর বাংলার বৈষ্ণবদের সেই একই ধাঁচায় ব্রাহ্মণ্য ফেঁকড়ি তথা হিন্দু স্মার্তদের উচ্চবর্ণের নিয়ন্ত্রণে। নামজপে মাতোয়ারা হওয়ার সহজ ধর্মে রাধাতত্ত্ব, কৃষ্ণতত্ত্বের শোরগোল উঠল; করুণাবতার চৈতন্যদেব চাপা পড়ে গেলেন উচ্চবর্গীয় শাস্ত্রিক সমাজের শাস্ত্রীয় বৈষ্ণবতার চর্চায়। এই চর্চাই বিভেদ আনল পুনর্বার; শূদ্র পতিতদের জায়গাই হল না চৈতন্য মাহাত্মের বৈষ্ণব ধর্মে। বৈষ্ণবতায় ফিরে এল জাতপাত, উচ্চনীচ, অধিকারী-অনধিকারীর বিচার। এই বিচারই বলা চলে সতেরো শতকের গোড়ায় জন্ম দিল নানা বৈষ্ণবীয় দল উপদলের। আঠারো শতকে দক্ষিণ দেশীয় দ্রাবিড় ব্রাহ্মণ নবদ্বীপে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বদান্যতায় ‘বড় আখড়া’ খুলে এদের বিরুদ্ধেই ক্ষোভ উগরে দিলেন। অচ্ছুৎ বলে ত্যাজ্য হলেন আউল-বাউল-কর্তাভজা-নেড়া-সাঁই দরবেশ-সহজিয়া-সখী ভাবকী-জাত গোঁসাইরা। এমনকি চৈতন্য পার্ষদ নরহরি ঠাকুর প্রবর্তিত গৌরাঙ্গ নাগরীরা পর্যন্ত তোতারামের কাছে ধিকৃত হলেন। সম্প্রদায়, অচ্ছুৎ মানুষের দল ক্রমশই বাড়তে থাকল। তোতারাম বাবাজি তাই এবার খেদোক্তি করলেন–
পূর্বকালে তেরো ছিল আসম্প্রদায়।
তিন তেরো বাড়ল এবে ধর্ম রাখা দায়।।
উনচল্লিশটি উপসম্প্রদায়েরই জন্ম হল সেই আবারও শ্রীচৈতন্যের উদার জাতি বর্ণহীন ভাবনার বীজসূত্রটি নিয়ে। লোকধর্মের সব সম্প্রদায়েই চৈতন্যদেব হয়ে উঠলেন তাই সর্বস্বীকৃত ত্রাতা। যে কারণে এইসব লোকধর্মের প্রবর্তকদের প্রধান গুরু-মহাজনদের অনেকেই চৈতন্য-অবতারের কিংবদন্তি নিয়েই যেন ফিরে এলেন। চৈতন্যদেব এই মানুষগুলির কাছে শ্রদ্ধেয় এই কারণেই, তাঁদের মুখ্য ধর্মের প্রতি অগ্রাহ্যতা বা বেদপুরাণকে অবমাননা করার পেছনে যে রয়ে গেছে মানুষের মূল্যে গড়া শাস্ত্রাচারের বেড়াজালকে টপকে যাওয়া প্রবণতা। সেই প্রবণতাই বাংলার লোকধর্মে এনে দিল গতি ও সাহস। তাঁর বাড়বৃদ্ধি শেষমেশ অবশ্য এমন দশায় পৌঁছল যে, লোকধর্মের সাধকরা বিশ্বাসই করতে থাকলেন এবার চৈতন্য সাধনার ভেতরও আদতে লুকিয়ে আছে কায়াবাদী গুহ্য প্রকৃতি সাধনা। চৈতন্যদেবের নিষ্পেষিত, অসহায় মানুষদের জাগানোর প্রচেষ্টা এভাবেই যেন জুড়ে গেল কখন ফকির বাউলদের মনের মানুষকে জানবার সাজুয্যে। চৈতন্যদেবের স্থান হল কায়াবাদী চৈতন্যে। ফকির লালন সাঁই তাঁকে জুড়ে নিলেন ‘আলেখ মানুষের সঙ্গে–
শুনে অজানা এক মানুষের কথা
গৌরচাঁদ মুড়ালেন মাথা।
ফকির-বাউল-দরবেশদের সেই অদৃশ্য প্রভু, অলক্ষ্য স্বামী, পরমাত্মা, মানুষ, আল্লাহ, আলেখ সাঁই, সহজ মানুষ, ভাবের মানুষ, রসের মানুষ–সবই এভাবেই বসে গেল শ্রীচৈতন্যদেবেরই সাজুয্যে। চৈতন্যদেব এভাবেই হয়ে উঠলেন দিব্য যুগের কারিগর। শাস্ত্রীয় সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি’র মাঝখানে অশাস্ত্রীয় লালন সাঁই এভাবেই চৈতন্য সকাশে গিয়ে তাঁকে দিয়েই দিব্যযুগ আনালেন–
সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি হয়
গোরা তার মাঝে এক দিব্যযুগ দেখায়।
চৈতন্যদেব শুধু দিব্যযুগ দেখিয়েই ক্ষান্ত হলেন না ফকিরিপন্থায়, তিনি নবীন আইন’ও আনলেন লালন শাহের ভাষায়—
গোরা এনেছে এক নবীন আইন দুনিয়াতে
বেদপুরাণ সব দিচ্ছে দুষে
সেই আইনের বিচার মতে।
এভাবেই চৈতন্যদেবের ভেদাভেদহীন সমাজ ব্যবস্থায় আর শাস্ত্র টপকানো নাম গানের ভাষাতে জুড়ে গেল বেদপুরাণকে অস্বীকার করা নিরক্ষর, নিষ্পেষিত, ব্রাত্য, সমাজ বিচ্ছিন্ন কুষ্টিয়ার ফকিরের মত। তিনি তাঁর কায়াবাদী গুহ্য সাধনার ভেতর চৈতন্যদেবকেও রেখে দিলেন নতুন আইনের প্রবর্তক হিসেবে, বাংলার লোকধর্ম এভাবেই চৈতন্যদেবের সঙ্গে গাঁটছড়াটি বেঁধে নিয়ে তাঁকেই দ্রষ্টা ও প্রদর্শকের ভূমিকাতে দিব্যি ঠেলে তুলে বলহীন, নিষ্পেষিত, নির্যাতিত, সমাজছিন্ন, নিরক্ষর মানুষদেরই শক্তি হয়ে উঠলেন। গৌরজন্মের সঙ্গে জুড়ে গেল লোকধর্মে ব্রজ ও নদিয়া–
ব্রজ ছেড়ে নদেয় এল
তার পূর্বান্তরে খবর ছিল
এবে নদে ছেড়ে কোথা গেল
যে জানো বলো মোরে।।
চৈতন্যদেবের এই অন্তর্ধানের কাহিনীটিই আদতে জুড়ে গিয়ে লোকধর্মে হয়ে উঠল প্রবর্তকদের আসারই মধুস্রাবী সঙ্গীত।
সহজিয়া বৈষ্ণবরা গড়লেন গৌড়ীয় সাজুয্যে একেবারে ধ্বনিবহুল সংস্কৃত পয়ারঃ
শ্রীচৈতন্যং প্রভুং বন্দে প্রেমামৃতরসপদং।
শ্ৰীবীরচন্দ্ররূপেণ প্রকটিভূত ভূতলং।।
কর্তাভজারা বললেন–তিন এক রূপ।
শ্রীকৃষ্ণ শ্রীগৌরচন্দ্র ও শ্রীদুলালচন্দ্র
এই তিননাম বিগ্রহস্বরূপ।।
সাহেবধনীরা বললেন–
ওরে বৃন্দাবন হতে বড় শ্রীপাট হুদা গ্রাম
যথা পিবানিশি শুনি দীনবন্ধু নাম
হেরি নীলাচলে যেমন লীলে
এখানে তার অধিক লীলে
হিন্দু যবন সবাই মিলে স্বচক্ষে দেখতে পেলাম।
বলরামীরা বললেন–
নিত্য চৈতন্য পুরুষ হাড়িরাম উদয় মেহেরপুর
যে জানতে পারে তারই নিকট নইলে বহুদূর।।
বৈষ্ণবের জন্য কাঁদে নিতাই আর গৌর
আবার এই বৈষ্ণব গোঁসাই ঠাকুরের ঠাকুর।।
পাটুলি-কাটোয়া-অগ্রদ্বীপের আস্তানায়, ঘোষপাড়া–হুদা–মেহেরপুর নদীয়ায় এভাবেই লোকধর্মের প্রবর্তকদের ভেতর চৈতন্যাবতার নেমে এলেন। চৈতন্যদেবই হয়ে উঠলেন বাংলার বাউল, ফকির, কর্তাভজা, সাহেবধনী, বলরামী, সহজিয়া সহ নানা উপসম্প্রদায়েরই প্রধান পুরুষ। বাংলার বাউল ফকির লোকসাধনার ইতিহাস ও প্রেক্ষাপটে চৈতন্যদেব আবারও যেন জুড়ে গেলেন আঠারো উনিশ শতকের লোকধর্মে–
যাঁদের আছে সুসঙ্গ
দেখে গঙ্গা গৌরাঙ্গ
সময় সময় সুরধনীর বাড়ে তরঙ্গ।
*****
লোকধর্ম চৈতন্যদেবকে আদতে নিয়েছে কায়াবাদী দেহসাধনায়। বৈষ্ণবদের। পঞ্চতত্ত্ব তাই অনায়াসেই ঢুকে যেতে পেরেছে বাউলের সাধনায়। পঞ্চতত্ত্বে শরীরের গঠন বোঝাতে গিয়েই বাউল গুরু বলছেন, চৈতন্য একটা ভাবান্তরিত চেতনারই নাম; তিনি মূর্তিতে, মন্ত্রতে নবদ্বীপ, শান্তিপুর, খড়দহ, বাগনাপাড়া, অগ্রদ্বীপ, কাটোয়া, আদি সপ্তগ্রামের বৈষ্ণবতীর্থে, শ্রীপাটের সিংহাসনের শোভায় বিরাজিত নন। তিনি হলেন বাউল গুরু, সহুজে আখড়ায় কায়াবাদী সাধকদের প্রেমস্বরূপ একটা স্তরান্বিত সত্তা। তিনি আছেন কায়াবাদী সাধকের কামের রঙে, ঘোর কৃষ্ণ হয়ে। সেই কামের শরীরে ঝাঁপ দিয়েই সাধক সাধন সঙ্গিনীর শরীর শোধন করে দেন। নিজের দেহকেও করে তোলেন প্রেমের বরণ কাঞ্চন। চৈতন্য হল সাধক ও সাধন সঙ্গিনীর বীজ ও হলাদিনী সত্তারই সমন্বয়াবস্থা একটা। চূড়ান্ত দেহগত দশা। প্রকৃতি, সাধন সঙ্গিনী ছাড়া এই চৈতন্যসত্তাকে বোঝা খুব মুস্কিল। আনন্দস্বরূপ রসের সন্ধানেই সাধকের প্রকৃতি সাধনা। চৈতন্য লাভের জন্যও প্রকৃতি সাধনা। ব্রজজমির কৃষ্ণলীলায় রাধার জায়গা কৃষ্ণের হৃদয়ে আর নবদ্বীপলীলা বাউল সহজিয়াদের মতে সেই ‘উল্টা স্রোতে নৌকা বাওয়া’–রাধার অন্তরে শ্রীকৃষ্ণ। সেই কারণেই আসলে তিনি গৌরাঙ্গ; গৌরাঙ্গ প্রেমস্বরূপ, হেমবর্ণ। লালন ফকির সাঁই তাঁর সাধন সঙ্গীতে, দেহতত্ত্বে চৈতন্যতত্ত্বেরই কিন্তু ইঙ্গিত রেখেছেন–
ও না ব্রজে ছিল জলদ কালো
জানি কি সাধনে গৌর হলো
এই গৌর হয়ে ওঠাটাই তো ফ্যাঁকড়া-ফকির, বাউল-বয়াতির সাধনা। বাংলার আউল-বাউল, ফকির-ফ্যাকড়া, দরবেশ, উদাসীন, বয়াতিরা চৈতন্যের সেই গৌরতত্ত্বের সাধনার ভেতর দিয়ে যেতে গিয়েই চৈতন্যদেব ও তাঁর পরিকরদের পঞ্চতত্ত্বকে দেহ। গঠনের মধ্যেই এনে তুলেছেন। ব্যোম মানে তাঁদের চৈতন্য, মরুৎ নিতাই, তেজ অদ্বৈত, ক্ষিতি গদাধর আর অপ হল শ্রীবাস। শরীরের গঠন প্রক্রিয়ায় শ্বাস হল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই শ্বাস চলাচলেরই ভেতরই রয়েছে কায়াবাদী সাধকের বিন্দুর চলাচল। শ্বাস। নিয়ন্ত্রণ যেমন এই সাধনার মুখ্য একটি বিষয়, তেমনই শ্বাসক্রিয়ার সমতায় বিন্দু নিয়ন্ত্রণ বা বস্তুরক্ষাও তাই কায়াবাদী সাধনার ভরকেন্দ্র। এই বিন্দু, বীর্য তাই সাধকের চৈতন্য যেমন, তেমনই কৃষ্ণসত্তাতেও তো সামিল। একদিকে চৈতন্যদেব, অপরদিকে নবী মহম্মদকে গুপ্তজ্ঞানে চিহ্নিত করেই বাউল ফকিররা কিন্তু তাঁদের সাধন আধার স্পষ্ট করেছেন। কায়াবাদী সাধনায়, গুপ্ত সাধন কড়চায় তাই চৈতন্যদেব, নিত্যানন্দ, অদ্বৈত, গদাধর, শ্রীবাসদের দেহসাধনা, রসসাধনার যেমন বিচিত্র বিবরণ আছে, তেমনই আবার ফকিরি গুপ্তজ্ঞানের কড়চায় নবী মহম্মদ, মা ফতেমা কেউই তো পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক চরিত্র নন, সকলেই জায়গা পেয়েছেন রসের সাধনায়। কায়াবাদী বাউল ও সহজিয়া সাধনা চৈতন্যযুগের সীমানা ছাড়িয়ে শিব, ব্রহ্মা, কৃষ্ণের প্রাধান্যে এবং ভাগবতাদির সাজুয্যে আদতে প্রাচীনত্বের জায়গা জমিটিকেই হাসিল করতে চেয়েছে। বোঝাতে চেয়েছে প্রকাশ্য বা মুখ্য ধর্মের সমান্তরালে এই ধর্ম গুপ্ত, গোপ্য,গুহ্য সাধনার ভাষা হিসেবেই চিহ্নিত।
লোকধর্মের গুরু গোঁসাইরা চৈতন্যদেবের থেকেও নিত্যানন্দকে প্রাধান্য দিয়েছেন বেশি। চৈতন্যের মতো এখানে দেহগত নিত্যানন্দের জায়গাটি অবশ্য আরওই মারাত্মক। বাউল মহাজন ‘নিত্যানন্দ দ্বার’ বোঝাতে সাধন সঙ্গিনীর যোনিটিকেই বুঝিয়েছেন। এতে নিষ্ঠাবান বৈষ্ণবদের বৈষ্ণব ভাবনায়, তত্ত্ব ভাবনায় আঘাত লেগেছে ঠিকই। লোকধর্মের গুরু-গোঁসাই-উদাসীন-বৈরাগীদের তারা চিরকালই হেয় প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন, দাবিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন; তাঁদের জাতপাত ধর্মবর্ণহীন নারী পুরুষের যুগল সাধনার উদার সমীকরণটিকে বুঝতে চাননি। অবশ্য এ বোঝাতে প্রথম থেকেই গোড়ায় গলদ ছিল। সেই গলদই চৈতন্যদেব–নিত্যানন্দ–অদ্বৈত–গদাধর–শ্রীবাস পর্বের পর বৃন্দাবন সংযোগের শ্রীজীব গোস্বামী পরম্পরার নরোত্তম শ্রীনিবাস শ্যামানন্দ এবং আরও পরের কৃষ্ণদাস কবিরাজ, নরহরিদের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাংলার বৈষ্ণবতার বিচ্ছিন্নতাটিকে রুখে দিতে পারেনি।
চৈতন্যদেব জাতিবর্ণের ভেদাভেদ ঘোচাতে চেয়েছেন। পরবর্তীতে নিত্যানন্দ, নরোত্তম, শ্যামানন্দ ছাড়া সকলেই ব্রাহ্মণত্বের প্রভাব ও প্রতিপত্তির সঙ্গে সমঝোতা করে গেছেন। বিমানবিহারী মজুমদার আরও এক মারাত্মক সংবাদ দিয়েছেন। চৈতন্যদেবের ৪৯০ জন প্রত্যক্ষ শিষ্যের তালিকা করে ‘শ্রীচৈতন্যচরিতের উপাদান’ নামক আকর গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন তাঁর প্রত্যক্ষ শিষ্য সংখ্যা ৪৯০ জন, যাঁদের মধ্যে ২৩৯ জন ব্রাহ্মণ শিষ্য, ২৯ জন কায়স্থ, বৈদ্য শিষ্য সংখ্যা ৩২, ২ জন মুসলমান শিষ্য, মহিলা শিষ্য ১৬ আর ১১৭ জন শূদ্র। আচণ্ডলে কোল দেওয়া ঠাকুরের ব্রাহ্মণ শিষ্য সংখ্যাই বলে দিচ্ছে যে, চৈতন্যদেব গোস্বামীদের শাস্ত্রীয় বৃন্দাবনীয় ভক্তিধারায় বর্ণাশ্রমী সমাজ জমির দিকেই শেষমেশ ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছিলেন। কেননা শেষ জীবনে হিতাহিত শূন্য দশায় তিনি সম্পূর্ণ বৃন্দাবনীয় গোস্বামীদের শাস্ত্রিক খপ্পরে। যেখানে উচ্চবর্ণের আনাগোনা আর ক্ষমতাবৃত্তের ভক্ত পরিকর খালি, নিম্নবর্গীয় জনতার ঠাঁই নেই না নীলাচলে, না বৃন্দাবনের শাস্ত্রীক তর্ক ও জ্ঞানগরিমায়। বাংলার নিষ্পেষিত জনগনকে তখন কোল দিলেন নিত্যানন্দ প্রভু। নিত্যানন্দ হলেন তখন আমজনতার ত্রাণকর্তা। ফকির লালন সাঁই নিত্যানন্দের এই মহিমা উপলব্ধি করেই কিন্তু গান বেঁধেছিলেন–
দয়াল নিতাই কারো ফেলে যাবে না
চরন ছেড়ো না রে ছেড়ো না
নিত্যানন্দের এই জনাকর্ষী ক্ষমতাই বাংলার ফকির বাউল সহজিয়াদের আকৃষ্ট করেছিল চৈতন্যদেবের থেকেও বেশি লোকধর্ম তাই দয়াল নিতাই কেই কাণ্ডারী করেছে–
দৃঢ় বিশ্বাস করি এখন
ধরো নিতাইচাঁদের চরণ
এবার পার হবি পার হবি তুফান
অপারে কেউ থাকবে না।
*****
লোকধর্মের ভেতরে সবচেয়ে জনপ্রিয় ধর্ম হল গিয়ে বাউল ধর্ম। দেহকেন্দ্রিক ইহবাদের ছায়াঘেরা লোকধর্মে বরাবরই শরিয়তপন্থী মুসলমান ও শাস্ত্র ও পুরোহিত তন্ত্র মানা হিন্দু ধর্মাচারীদের কাছ থেকে অনাদৃত ও নিগৃহীত হওয়ার কলরব উঠেছে। পনেরো ষোলো শতক থেকে শুরু করে বিশ শতক পর্যন্ত বাংলায় নানা বৈষ্ণবীয় উপসম্প্রদায় সহ। বেশকিছু লোকধর্মের উদ্ভব হয়েছে। যার ভেতর বৃহত্তর হিসাবে চিহ্নিত বাউল ফকিরদের কায়াবাদী আচরণ আর অবশ্যই কর্তাভজা ধর্মমত। এ ধর্মের প্রবর্তক আউলেচাঁদ আঠারো শতকের দ্বীতিয়ার্ধে সম্প্রদায়ের প্রধান গুরু রামচরণ পাল সহ ২২ জনকে দীক্ষা দিয়ে এ ধর্মের সূচনা করেন। পরবর্তীতে রামচরণ পালের স্ত্রী সরস্বতী পাল কর্তাভজা সম্প্রদায়ের কত্রীর ভূমিকাতে অবতীর্ণ হন। তাঁর সরস্বতী পাল থেকে সতী মা হয়ে ওঠাটাই প্রমাণ করে যে নদিয়ার ধর্ম বরাবরই মাতৃকামণ্ডলের আধারিত। নদিয়া পালন করেছে বৃন্দাবনের ধর্ম যেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মর্ত্যবাসিনী সাধারণ নারী রাধিকার জায়গা হয়েছে। তবে কৃষ্ণের সিংহাসন উচ্চকোটির সংস্কৃতিতে বরাবরই উজ্জ্বল শাস্ত্রকারদে টাকাভাষ্যের কল্যাণে। সংস্কৃত ভাষার দখলদারিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জায়গা পেয়েছেন এমন এক সমাজে, যেখানে গণমানুষদের কোনও প্রবেশাধিকারই ছিল না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আর শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য পরিশেষে বৃন্দাবনের গোস্বামীদের খপ্পর থেকে আর বেরোতেই পারলেন না। এই দু’জনের অস্তিত্বের যা কিছু জায়গাজমি লোকধর্মে, লোকায়ত মানুষদের মনে, সবটুকুই নিত্যানন্দ প্রভু ও প্রেমময়ী শ্রীরাধিকার কল্যাণেই। রাধা কোনোদিনই দেবীত্বের মর্যাদা অর্জন করতেই পারেননি শাস্ত্রমান্যতার পুরুষতন্ত্রের ধাঁচায়। তাঁর যেটুকু যা স্বীকৃতি আর সম্মান সবই কিন্তু প্রাদেশিক ভাষায়। কোনও সন্দেহেরই জায়গা নেই শ্রীমতি শ্রীরাধিকা বৃন্দাবনে একটি মাতৃকামণ্ডল গড়ে নিতে পেরেছিলেন। এই মাতৃকামণ্ডলীর প্রধানাকে শেষপর্যন্ত স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন বৃন্দাবনের গোস্বামীরা। রাধার একটি শাস্ত্রীয় জায়গা তাই তৈরি হচ্ছিল কৃষ্ণের সাজুয্য মেনে। কৃষ্ণকে প্রাধান্য দিয়ে রাধা সংস্কৃত সাহিত্যে প্রতিষ্ঠাতা। অথচ লোকধর্ম, সহজিয়া বৈষ্ণব সাধনার কড়চায় তাঁর মস্ত সিংহাসন:
সিদ্ধি ধর্মের গুরু শ্রীরাধাসুন্দরী।
ইহার কৃপা বিনে নাহি মিলে ব্রজপুরী।।
মহাপ্রভু রাধার সেই প্রেমময়ী সত্তাটিকেই ব্রজ থেকে নদিয়ায় নামিয়ে এনেছিলেন, নদিয়া থেকে গোটা বাংলায় শ্রীরাধিকার সেই সত্তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন লোকায়ত সাধকরা তাঁদের করণকেন্দ্রিক গুহ্য ধর্মে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাই লোকায়ত এলাকায়, লোকধর্মে বিন্দুস্বরূপ,বস্তু বা বীর্যতে রূপান্তরিত হয়েছেন। কৃষ্ণ যদি বিন্দু বস্তু বীর্য হয়ে ওঠে তবে তাঁকে ধারণ করছে সাধক শরীরের স্থূল দশা; যা প্রকৃতিতে সামিল–
কোন কৃষ্ণ হয় জগৎপতি
মথুরার কৃষ্ণ নয় সে সে-কৃষ্ণ হয় প্রকৃতি।
জীব দেহে শুক্ররূপে এ ব্রহ্মাণ্ড আছে ব্যেপে
কৃষ্ণ তারে কয় পুরুষ সেই হয় সেই রাধার গতি।।
রাধাকে সেই কৃষ্ণের স্বকীয়া হিসেবে তৈরি করে নেওয়ার বৃন্দাবনীয় জায়গা ছেড়ে বের করতে পেরেছিলেন নদীয়ার নিরক্ষর ফকির। লোককবিদের হাতে পরে রাধা কলঙ্কী হয়েছেন, অসতী হয়েছেন। বৃন্দাবনের শিক্ষিত গোস্বামীরা তখন লোকধর্মের হাতে পরা রাধার কলঙ্ক মোচনে উদ্যোগী হলেন। ‘স্বরূপত স্বকীয়া’, ‘পরকীয়া’-এইসব তত্ত্বত্ত্ব চাপিয়ে শেষমেশ সাবধানবানী পর্যন্ত জুড়ে দিলেন–
পরকীয়া বিনা নাহি রসের উল্লাস।
ব্রজ বিনা ইহার অন্যত্র নাহি বাস।।
অথচ রাধা ব্রজ ছেড়ে দিব্ব্যি নদিয়ায় এলেন চৈতন্যের ভাব ও আরোপ সাধনায়। সহজিয়া বৈষ্ণব শাখায়, বাউল শাখায়, ফকিরিপন্থায় তাঁর একটি সম্মাননীয়ার জায়গাও হল।
ফকির সাঁই বললেন–
রাধারানির ঋণের দায় গৌর এসেছে নদিয়ায়
গৌর-গৌরাঙ্গের রাধাবাহিত হয়ে এই আসাটিকেই নদিয়া তথা বাংলার লোকধর্ম সম্মান করেছে, মর্যাদা দিয়েছে। সেই মর্যাদা, সম্মানের কারণেই নদিয়ার মাতৃকামণ্ডলে বৈষ্ণবাচার্য অদ্বৈত আচার্যের সহধর্মিনী সীতা দেবীর সীতা মা হয়ে ওঠা এবং নিত্যানন্দ প্রভুর সহধর্মিনীর স্বামীর অবর্তমানে দিশাহীন বাংলার বৈষ্ণবধর্মকে পথ দেখাতে জাহ্নবী মা হয়ে ওঠার মতই কর্তাভজা ধর্মগুরু রামচরন পালের অবর্তমানে সরস্বতী পাল হয়ে উঠলেন ধর্মগুরু, সতী মা। লোকধর্মে এও এক নারীর প্রাধান্যের দিক। আর তাঁর করণ দিকে তো অনবদ্য নারী বা মাতৃবন্দনারই আধার–
নিগম বিচারে সত্য গেল তাই জানা
মায়েরে ভজিলে হয় তার বাপের ঠিকানা
লোকধর্ম এই ঠিকানার সন্ধানে ঘুরতে ফিরতে গিয়েই তো কলঙ্কিত হয়েছে, নিষ্পেষিত হয়েছে। তবে এই নিষ্পেষণের বড় কারণটি কিন্তু শাস্ত্রশাসনের বাইরে নিজেদেরকে নিয়ে যাওয়াটা। মানুষের মধ্যে খোদা বা ঈশ্বরকে খুঁজে ফিরে, মৃত্যুর পর দেহ আকাশ মাটি আগুন বায়ু জলে ফিরে যাওয়াটাকে মেনে, পূর্বজন্ম–পুনর্জন্মকে নষ্যাৎ করে, ব্রত পুজো রোজাকে উপেক্ষা করে দেহধর্মের রজবীজের করণে মেতে থাকা একটা সমাজ শাস্ত্রীয় প্রনালীবদ্ধ ধর্মাচারীদের কাছ থেকে তাঁদের দেহ বেদ-কোরান বলে প্রচারের জন্য কোনও সংঘাতের মুখোমুখিই হবে না, এটা কী কোনওভাবেই সম্ভব?
সাম্প্রদায়িক সীমানা অস্বীকার, জাতপাত বর্ণে লিঙ্গে অগ্রাহ্যতা,মানুষের সেবাপুজো খালি ধর্মাচারের মূল প্রতিপাদ্য, মানুষ অন্বিষ্ট, সেই অন্বেষণে দেহের রজঃ বা বর্জ্য ব্যবহার, তাঁর ভেতর করণকে গুপ্ত করে সাধনার মহামন্ত্র গানে ধরে রাখা, যতই সেটা হোক না কেন সমাজ শাসনের ভয়–এতে শাসকরা, মোল্লা মৌলবী পুরোহিতরা তাঁদের সার্বভৌম প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তি ক্ষয়ের বিরুদ্ধে বিরোধিতা ও সামাজিক নিগ্রহ। করবে, এটা কিন্তু একটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই বাংলায় বাউলবিরোধী আন্দোলন, বাউল-ফকির ধ্বংসের ফতোয়া একেবারেই অনভিপ্রেত ঘটনাই নয়, এ হল শাস্ত্রশাসিত ধর্মাচারীদের ভিত নড়ে যাওয়ার অস্বাভাবিক ভয়। অসহায়, বঞ্চিত, নিগৃহীত, নিপীড়িত, নিরক্ষর মানুষরা মূল সমাজ পরিমণ্ডলে অন্তজ হওয়ার কারণেই ব্রাত্য হয়েছে, উচ্চবর্গের ধর্মে, বর্ণে, সমাজে জায়গা পায়নি বলেই তাঁদেরই কোনও কোনও প্রতিনিধিরা সাহস করে, আশা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। সেই নির্ভীক মানুষগুলির কাছে তখন পিলপিল করছে জনতার স্রোত। এই মানুষগুলি তাঁদের বুঝিয়েছেন, কৃষ্ণ, শিব, ব্রহ্মা, মহম্মদ ব্যক্তিনাম। বৃন্দাবন, মথুরা, মক্কা, কাশী হল গিয়ে জায়গা বেদ, কোরান হল গিয়ে কেতাব, শাস্ত্রের বাণী মৌলভী, পুরোহিত, নবী, মুনি, পণ্ডিতদেরই রচনা। এখানে ভগবান বা আল্লাহর কোনও হাত নেই। যারা এগুলো লিখেছেন বলছেন তারা সকলেই দেহসাধনার অর্জিত ফলাফলই ঘোষণা করেছেন। তাই তোমরা দেহকে জানো, করণ দিয়ে; শ্বাস দিয়ে, দম দিয়ে, রজঃ, বর্জ্য দিয়ে তাঁকে ব্যবহার করো স্কুল ও সূক্ষ্মতে; স্কুলের সেই ব্যবহারেই মদ-মাংস-মৎস্য-মুদ্রা-মৈথুন। আর সেই মৈথুন ঘেরা লোকধর্ম, যুগল সাধনা তাই আক্রমণের শিকার। এই আক্রমণে যেমন দেহগন্ধী ব্যভিচারের ইঙ্গিত আছে, তেমনই আবার মোল্লা-মৌলবী-পুরোহিত-ব্রাহ্মণদের আধিপত্য হারানোর ভয়টাও আছে। লোকধর্ম কতখানি আড়ে বহরে বাড়লে এই ভয় আসতে পারে উনিশ শতকের বাংলার বাউল বিরোধী আন্দোলন বা বাউল ধ্বংস ফতোয়া থেকে তা তো সহজেই অনুমেয়।
*****
মুসলমান ধর্ম সম্প্রদায়ের মোল্লা মৌলবিরাই বাউল বিরোধী আন্দোলনে সব থেকে বেশি অংশগ্রহন করেছেন। উনিশের বাউলধর্মে বাউল গুরু-মুর্শিদের সংখ্যাধিক্য, জনপ্রিয়তা, বয়াতি বৃদ্ধিই মোল্লা মৌলবীদের টনক নড়িয়ে দিয়েছিল। তবে হিন্দু পুরোহিত ব্রাহ্মণ গোস্বামীরাও এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেননি এরকম ভাবার কোনও কারণই কিন্তু নেই। একদিকে ছেউড়িয়ার আখড়া যেমন আক্রান্ত হয়েছে লালনের জীবদ্দশাতেই; ফকির সাঁই মুসলমান হিন্দু দুই সম্প্রদায়েরই আক্রমণ সহ্য করেছেন অপরদিকে ঘোষপাড়ার কর্তাভজা ধর্ম নিয়ে দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ ঠাকুর পর্যন্ত আক্রমণ শানিয়েছেন। বাউলধর্মকে পায়খানার দরজা দিয়ে ঢোকার পথ বলে তীর্যকতাও ছুঁড়েছেন তিনি। ‘কর্তাভজা মাগীদের নিয়ে রীতিমত তিনি চিন্তিত। অথচ এই ধর্মমতে ব্যাপক জনজোয়ার দেখে উনিশের প্রথমেই ঘোষপাড়া ছুটেছিলেন শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশনারী উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যানরা। উনিশের মধ্যভাগে মিশনারীদের সাথে কর্তাভজা সংযোগ আরও বেড়েছে কেবল একটি মাত্র উদ্দেশ্যকে লক্ষ্য করে। বর্ণহীন শ্রেণিহীন দরিদ্র অশিক্ষিতদের যদি কর্তাভজাদের কর্তা ভজনার একেশ্বরবাদ দিয়েই ধর্মান্তরিত করে নেওয়া যায়, ইংরেজ মিশনারী বিশপ উইলস, জে.জে ওয়েট ব্রেখটদের এই উদ্দেশ্য সফলও হয়েছিল। উনিশের মধ্যভাগে কর্তাভজা খ্রিষ্টান হয়েছে ঘোষপাড়ার মতের অনেকেই। এই ধর্ম আখড়া নিয়ে কম তো আঙুল ওঠেনি। অক্ষয়কুমার দত্ত পেছনে লেগেছেন। ঈশ্বর গুপ্ত কলম শানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরূপ মন্তব্য করেছেন। তৎকালীন শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত বুদ্ধিজীবিরা দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন কর্তাভজা ধর্ম বা সতী মায়ের। মত নিয়ে। যে কারণে রামমোহন রায়, ভূকৈলাশের রাজা জয়নারায়ণ ঘোষাল, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, সন্তদাস বাবাজি, নবীনচন্দ্র সেনদের মতো সমাজ সংস্কারক, রাজা সম্রান্ত, আধ্যাত্মিক পথসন্ধানী, কবি প্রশাসকদেরও যাতায়াত ঘটেছে নিজ নিক প্রয়োজনেই। পাদ্রী, সাধু সন্ত, তান্ত্রিক-বৈদান্তিক, ফকির-সন্ন্যাসী সকলেই এসেছেন সতীমায়ের অঙ্গনে প্রাণের টানে কিংবা কৌতুহলে। সংবাদপত্র, সাময়িকীতে কর্তাভজা ধর্মের বিরূপ সমালোচনা, টিপ্পনীসহ দাশরথি রায়ের গান, দোলমেলাতে বাবু-বেশ্যার সমাহার সবই এটাই আদতে প্রমাণ করে যে, উনিশ শতকের সবচেয়ে বৃহত্তর লোক সম্প্রদায়টিই ছিল কর্তাভজা ধর্ম। আজও এই বিশ পেরিয়ে একুশ শতকেও কিন্তু কর্তাভজা ধর্ম সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকসম্প্রদায়। ছেউড়িয়ার ধর্ম, লালন সাঁই পপুলার কালচার হয়েছে ঠিকই বিশের শেষ থেকে শুরু করে এই ভরা একুশে; যার চর্চা অবশ্য শুরু হয়েছিল শিলাইদহে ঠাকুরবাড়ির বদান্যতায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, সরলা দেবী, ‘প্রবাসী’, ‘ভারতী’ পেরিয়ে দেশভাগে ফকির সাঁইয়ের পাকিস্তানি আমল থেকে ছেউড়িয়া বাংলাদেশে মোল্লা মৌলবীদের ইসলামীকরণের পরিসর টপকিয়ে, চেকনাই লালনের মাজার, বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রকের অর্থানুকুল্যে ‘লালন কমপ্লেক্স’, শ্বেতশুভ্র প্রাসাদ পেরিয়ে লালন এখন দুই বাংলা পেরিয়ে বাউল ফকিরদের কণ্ঠ নির্গত হয়ে বিনোদনকামী বিশ্বনাগরিক। অথচ আজও, একুশ শতকে বাউলপন্থীরা আক্রান্ত হন বাংলাদেশে, চুয়াডাঙ্গার গোবিন্দপুরে আখড়ায় ঢুকে বাউলদের মারধর করা হয়, আখড়ায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, প্রতিরোধে নামে চুয়াডাঙ্গা জেলার বাউল সংঘ। লালন ফকিরের দেশে বাউল হামলা আজও বলবৎ, আখড়া ভাঙা, পোড়ানো, একতারা-দোতারা-ডুবকি নষ্ট; আখড়াবাসীদের চুল দাড়ি কেটেকুটে নির্যাতন এ তো বিশের শেষদিকে বাউল সঙ্গীত পপুলার কালচার হয়ে ওঠার পর এ বঙ্গেও কম ঘটেনি। নদিয়া মুর্শিদাবাদের তেহট্ট, করিমপুর, বেলডাঙ্গা, নওদা, জলঙ্গি, ডোমকল, হরিহরপাড়াতে সংখ্যাগুরু ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বাস। এইসব এলাকার বাউল ফকিরদের ওপর তাই শরিয়তবিধি পালনের নির্দেশ আছে। সভা করে সমঝোতায় না আসায় বাউলদের দীর্ঘ চুল কেটে নেওয়া হয়; ফকিরদের জোর করে গো মাংস খাইয়ে দেওয়া হয়। সত্তর দশকের এই ঘটনার পর নব্বই দশকে ফকিরি গানের জলসা বা সম্মেলনগুলিকে হারেম আখ্যা দেওয়া হয়। মুসলমানদের নামাজ না পড়া নিয়ে, রোজা, শরিয়ত ইসলাম মেনে না চলার কারণে আক্রমণ আসে ফকিরি ধর্মে,বাউল মতে। থানা-পুলিশ-প্রশাসন-সংবাদপত্র বাউল-ফকির সংঘ সবই ধর্মীয় নিপীড়ন নিয়ে বিরুদ্ধাচারে নামে। গ্রামত্যাগে বাধ্য করা, আশ্রম ভাঙা, আখড়া পোড়ানো, গান বন্ধ, সেচ বন্ধ, মিথ্যা মামলা, মাঠ বন্ধ,জরিমানা, সাধুসভা বন্ধ, ঘর পোড়ানো, চুরি, লুঠ, ফসল নষ্ট, গৃহপালিত পশুপাখি চুরি, প্রাণনাশের হুমকি, হিন্দুকে গুরু করার অপরাধে বয়কট, স্ত্রী কে তালাকে বাধ্য করা, লাঞ্ছনা, তোবা করানো, এমনকি গলা কেটে নৃশংস হত্যা–সব রকমের সামাজিক নিষ্পেষণ বিশের শেষ তিন দশক ধরে বাউল সঙ্গীত পপুলার কালচার হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগঞ্জে ঘটেছে। ফকির বাউলদের এই নিপীড়ন, লোকধর্মের সাধুগুরুদের বিরতিহীন বিরোধিতা এটাই তো প্রমাণ রাখে যে, বিশ–একুশের বাউল ফকিরদের সংস্কৃতি সঙ্গীতের ঐতিহ্য এখন পপুলার কালচার হলেও শাস্ত্রবাদী শরিয়ত ভাবনার সেই উনিশের প্রভাব প্রতিপত্তি ক্ষয়ের চিন্তাধারাটা আজও একই মানচিত্রেই আছে। হিন্দু মুসলমান উভয় ধর্মাবলম্বীদের দ্বারাই নিগৃহীত হয়েছে, হচ্ছে, হবে বাউল ফকিরের মত। কেননা এ মতেই রয়েছে বেদ, কোরান, পুরাণ, বাইবেল কিছুই না মানার অভিমত। যা চিরকালই প্রাতিষ্ঠানিক গোঁড়া রক্ষণশীল ধর্মাচারীদের চিন্তায় ফেলেছে, ফেলছে, ফেলবে। লোকধর্ম তাই মূল ধর্ম ও সমাজের বিরাগভাজন ও শত্রু বলে বিবেচিত যে হবেই, তাতে খুব একটা আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
*****
মুসলমানদের নজরে ফকির বাউলরা বেদাতী, বেশরা, ন্যাড়ার ফকির আর হিন্দুদের চোখে তারা কায়াবাদী, কদাচারী, ভ্রষ্ট, পাষণ্ড, জাত খোয়ানো, পতিত, ব্রাত্য, একঘরে। মুসলমানদের ফতোয়া, হিন্দুদের বিধানে এরা শরিয়ত, বেদবিধির বাইরে বেরোনো লোকায়ত সম্প্রদায়। মূল ধর্মের উপহাসের পাত্র। শুধুমাত্র তোতারাম বাবাজির বয়কট তো নয়, তার আগে তো কবিরাজ গোস্বামী মশাইও তোতারামের কায়দাতে নিদান হেঁকেছেন ‘চৈতন্য চরিতামৃত’তে–
বাউল্যা বিশ্বাসেরে না দিবে আসিতে।
বাউল ধর্ম যে চৈতন্যপন্থী বৈষ্ণবতায় বেগ দিচ্ছে তাঁর মস্ত প্রমাণ তোতারাম বাবাজির দুই শতক আগে গোস্বামী বাবাজির বিধান। তবে গোস্বামী বাবাজিকে লোকধর্ম আপন করেছে চৈতন্যদেবের মতই। সহজিয়া, বাউল, দরবেশ, সাঁইরা পুঁথি লিখে কৃষ্ণদাস কবিরাজের নামে অহরহ চালিয়ে দিয়েছেন। বিমানবিহারী মজুমদার এমন পুথির হদিশ জানিয়েছেন আমাদের। দরবেশের পুঁথি ‘বীরভদ্রের শিক্ষা মূল কড়চা’ বইটি বের হয়েছিল ১৩২৮ সনে। বইটির রচয়িতার নাম কৃষ্ণদাস কবিরাজ। বিষয়বস্তু যুগল দেহসাধনার নির্দেশ। পিতা নিত্যানন্দ পুত্র বীরভদ্রকে শিক্ষা নিতে পাঠাচ্ছেন মাধববিবির কাছে–
শ্রীঘ্র করি যাহ তুমি মদিনা সহরে।
যথায় আছেন বিবি হজরতের ঘরে।।
তথা যাই শিক্ষা লহ মাধব বিবির স্থানে।
তাহার শরীরে প্রভু আছেন বর্তমানে।।
মাধব বিবি বিনে তোর শিক্ষা দিতে নাই।
তাহার শরীরে আছেন চৈতন্য গোঁসাই।।
বীরভদ্র এরপর মদিনা রওনা হলেন। মাধববিবির কাছে শিক্ষা চাইলেন। বিবি তাঁকে কায়াবাদী ভজনের স্বরূপ চেনাতে গিয়ে দেহতেই বৃন্দাবন দেখিয়ে বসলেন–
মনে মনে মাধববিবি ভাবিতে লাগিল।
বীরভদ্রে মন করি উলঙ্গ হইল।।
উলঙ্গ দেখিয়া বীরের আনন্দিত মন।
রূপের তুলনা দিতে নাহি ত্রিভুবন।।
বিবি কহে শুন কথা ইহার কারণ।
সাক্ষাতে দেখহ এই করহ ভজন।।
কে কোথায় আছে দেহে কর দরশন।
গোপ গোপী সাথে দেখ নন্দের নন্দন।।
শ্রীরাধিকার
দেহ দেখ সখীগন সহ।
এই দেহে বর্তে তাহা তুমি নিরিখহ।।
রসময়ী শ্রীরাধিকা দেহ ভিন্ন মন।
গোপী তার অনুচারী বিযুক্ত না হন।।
আরোপ সাধনা, পরকীয়াবাদ, সহাজানন্দের ভজন নিয়েই তো বাউলদের সাধনা। গৌরাঙ্গ সেখানে নারী সাধনায় রত। ফকির বাউল সহজিয়া বৈষ্ণবদের অটল সাধনা করছেন তিনি। মহাপ্রভুর সেই পরকীয়া সংবাদের পুথির হদিশ দিয়েছেন আমাদের সুধীর চক্রবর্তী। মুকুন্দ দাসের লেখা সেই পুঁথিতে রয়েছে মহাপ্রভুর দেহসাধনার খবর–
সন্ন্যাস করিয়া প্রভু সাধে পরকীয়া।
সার্বভৌম নন্দিনী শাটি কন্যাকে লইয়া।।
মহাপ্রভুর পরকীয়া শাটি কন্যা লইয়া।
অটল রতিতে সাধে সামান্য মানুষ হইয়া।।
চৈতন্যদেবের এই সহজ সাধনার ভজন ফকিরিবাদেও ছায়া ফেলেছে। লালন শাহের শিষ্য দুদ্দু শাহ মারফতি সাধনাতেও চৈতন্যদেবের দেহসাধনাকে স্থান দিয়েছেন–
শাটি যে গোবিন্দচাঁদের পরকিয়া কয়।
কোন চাঁদ সাধিতে গোরা শাটির কাছে যায়।।
ধরে শাটির রাঙা চরণ।
সেধে নেয় সহজ সাধন।।
সহজ সাধনার আরেক পুথির হদিশ দিয়েছেন রমাকান্ত চক্রবর্তী। সতেরো শতকের সেই পুঁথিতে রয়েছে আবার বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ এর প্রভাব। সেখানে রাধাকৃষ্ণের গান্ধর্ব বিবাহ দিয়েছেন রচয়িতা নৃসিংহ। লক্ষ্মীর সঙ্গে বিয়ের পর গৌরাঙ্গের সম্পর্ক হচ্ছে নবদ্বীপের গোয়ালার মেয়ে মালতীর সঙ্গে। রাধাভাব চলছে গৌরাঙ্গের। চৈতন্যদেব মদ পান করছেন। রতিলীলা করছেন কৃষ্ণেরই অসংখ্য নায়িকার মতই। ‘রাধাতন্ত্রম’এর পরোক্ষ প্রভাবই রয়েছে এই পুথিতে। বৈষ্ণব তান্ত্রিক যোগাযোগকে কাজে লাগিয়েই নৃসিংহ গৌরাঙ্গলীলার দেহবাদ রচনা করছে। আবার বৈষ্ণবীয় রাধা, ভগবান, মহাপুরুষ–সকলেই ফকির বাউল সাধনায় শরীরী জায়গা পেয়েছেন, অনুমান নয় বর্তমানের ধর্ম মেনে। বর্তমানের পথে এই শরীরের ধর্ম নিয়েই যত গোল বেঁধেছে। নৈষ্টিক গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা যেমন মেনে নেননি রাধাকৃষ্ণের শরীরী আরোপ, তেমন চৈতন্যদেব নিত্যানন্দ-নবী মহম্মদের শরীরী ব্যাখ্যা নিয়েই মারফতি পথের প্রয়োগে গোল বাঁধিয়েছেন শরিয়তপন্থী সাচ্চা মুসলমান, গোঁড়া ব্রাহ্মণ পুরোহিত, রক্ষণশীল বনেদী হিন্দু।
মারফতি সাধনায় নামাজ, রোজা অনাবশ্যক বলে মনে করেন মুর্শিদ। তারা বলেন, প্রকাশ্য নামাজের তো কোনো দরকারই নেই। শরীরটাই হল গিয়ে মসজিদ। সেখানে সবসময়ই দায়েমি নামাজ চলছে। আর কায়মনবাক্যের সংযমটাই হল গিয়ে ফকিরের মারফতি পথের রোজকার কাজ। সেটাই তো রোজা। তাই আলাদা করে হজ করতে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। শরীরটাই তো মক্কা। ফকিরের করণ কৃত্যে ‘আলেখ’ বলার রীতি। আলেখ হলেন অলক্ষ্যের আল্লা। আল্লাহ হলেন ‘রহমন’। মানে হল দয়ালু। আল্লা ‘কুদ্দুস’ পবিত্র, ওদুদ প্রেমময়, বসির স্রষ্টা, জাহির প্রকাশিত, বাতিন প্রচ্ছন্ন, কাইউম নিরপেক্ষ, একরাম সম্মানিত,ওয়ালি বন্ধু, নূর জ্যোতি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শতনামের মতো আল্লাতালারও শতাধিক নাম আছে। ফকিরি ঘরের দীক্ষাশিক্ষায় প্রবর্তক স্তরের সাধক বা কাঁচা মুরিদের আল্লাহর নামগুলো মুখস্থ রাখাই প্রাথমিক শিক্ষা। শরীরের মধ্যেই আছে। প্রশস্ত চিদাকাশ। বাউল ফকিরি মতের ঘরের খবর মানে হল তো সেই শরীরের তত্ত্ব জানা। আল্লাহ আছেন শরীরে, দেহযন্ত্রে। বাউল দেহযন্ত্রকেই বাজানোর কথা বলেছেন। এই দেহের ভেতরই আল্লাহ, দেহেই আকাশের অবস্থান। ‘আপন ঘরে’তাই খোদাকে না খুঁজে আসমানে। তাকিয়ে কোনো লাভ নেই। মুর্শিদই চিনিয়ে দেন আপন ঘর, ঘরের গঠন। অন্তদৃষ্টির এই ঘরে নেহার করলে রূপের মধ্যে স্বরূপকে দেখা যায়। মারফত কথার একটি অর্থ জ্ঞান, আর এই জ্ঞান আদতে দেহঘরের গঠন প্রকৃতি, তাঁর পুব দক্ষিণ, সেই ঘরে কার কার বসত সে সব বুঝবারই জ্ঞান। মুর্শিদ গুরু তাই দেহঘরের আসমান আর খোদাকে খুঁজে দেওয়ার প্রধান ভরসা।
বাউল ফকিররা মাংস ডিম খান না। গোমাংস গুরুর নিযেধ। তবে মাছটা খান। মীনের মধ্যে আছে সাধকের সুলক্ষণ। কারণ মাছের চোখের পলক পড়ে না। সাধককেও দেহঘরে অন্তদৃষ্টি দিয়ে সর্বক্ষণ পলকহীন চোখেই তাকিয়ে থাকতে হয়।
ফকির বাউলের পথে আসা মানেই হল কামের ঘরে কপাট দিয়ে দেওয়া। বাউল ফকিরেরা জন্মদ্বারকে ঘৃণার চোখে দেখেন। সন্তান কামনার সঙ্গম এ পথের নয়। ফকিরালি পথে দীক্ষা, বাউল পথে দীক্ষা হলে পর কামের পথকে চিরতরে বিদায় দিয়ে দিতে হয় বলেই সন্তান জন্ম একেবারেই নিষিদ্ধ। তবে এই নিয়ে এখন অবশ্য বাদবিবাদ তুঙ্গে। এখনকার মহাজনেরা বলেন, সন্তান না এলে সিদ্ধ ফকির বাউলের জন্ম হবে কেমন করে? কেমন করেই বা হবে ‘ঘর রক্ষা’।
সহজিয়া বৈষ্ণবদের শাখা উপশাখা, স্রোতের মতোই মারফতি পথেও আছে। নানান ঘরের হদিশ। কালার ঘর, নেড়ার ঘর, কাদের ঘর–প্রচ্ছন্ন নানান ঘরানা সব। রীতি রেওয়াজে বিচ্ছিন্ন হলেও সব ঘরেরই মূল বিষয় কিন্তু আবার লালন ঘরানার সেই ‘আলেখ’। অর্থাৎ কিনা গোপ্ত বা বাতুন। সাহেবধনীরা বলেন ‘গোপ্তবাবাজি’র কথা। ঘরের মুর্শেদ গোপ্তবাবাজির দেখা পেয়েছিলেন মুরিদ চরণ পাল চৈতি একাদশীর অগ্রদ্বীপের মেলায়। আবার চরণ পালের মুরিদ কুবির গোঁসাইও চৈতি একাদশীর ফালি চাঁদের আলোয় নিশুত রাতেই গোপ্তবাবাজির কৃপা পেয়েছিলেন। সেই পরম্পরাতেই এখনও একই প্রত্যাশায় কাঁথা সুজনি দিয়ে বালিশ দিয়ে দু’দুখানা বিছানায় চরণচাঁদ, কুবিরচাঁদ আর তাঁরই মাঝে হাপিত্যেশ দশার সাহেবধনী ঘরের দর্শনপ্রার্থী মুরিদ। আসলে তিনি ঘর মুর্শিদ। এ দিন কৃপাপ্রার্থী হয়ে বায়েত সাজেন দর্শন প্রত্যাশায়। অগ্রদ্বীপ গেলে এখনও এই দৃশ্য চোখে পড়বেই। বাতুন পথের এই হল গিয়ে দশা। এখানে সবটাই ‘দিলের পথ’, ‘রসের পথ’। জ্ঞানের বালাই নেই, তাই ফকির পড়েন ‘দেলকেতাব’। তাঁর ছাপা বই নেই। এই দেলকেতাব আসছে মুর্শেদ থেকে মুরিদ হয়ে। এর কোনও লয়-ক্ষয় নেই। তরিকা ভেদে ঘরে ঘরে পার্থক্য থাকলেও মূল ব্যাপারটা হল গিয়ে দৈন্যদশায় খোদা বা ঈশ্বরের কাছে গিয়ে দাঁড়ানো। তাঁর জন্যই যাবতীয় এবাদত। আর এই ফকির বাউলদের এবাদতের প্রধান তারিকাটাই হল গিয়ে সঙ্গীত। অশিক্ষিত অল্পশিক্ষিত ফকির-বাউল গান এবাদতের মাধ্যমেই দেলকেতাব বা মৌখিক বাণী রেখে যান। যা আবর্তিত হয় শিষ্য পরম্পরায়। আর এই গানই, এবাদতই শরিয়ত বা খাঁটি ইসলামীপন্থায় হল গিয়ে নাজায়েজ। শরিয়তপন্থায় কেউ মারা গেলে গোর বা কবর দেওয়া হয়। যাকে শাস্ত্রীয় ভাষায় বলে, দাফন। দাফনের সময় মৃতদেহ গোসল করে দেওয়া হয় কাফন। স্নান করিয়ে বস্ত্র পরিয়ে কাফন দিয়ে দোয়া বা মঙ্গলের জন্য জানাজার নামাজ পড়া হয়। আর সেই নামাজ পড়া নিয়েই ফকিরালি পথে বাঁধে ঘোর বিপত্তি। বিশ শতকের শেষেও কিংবদন্তি হয়ে ওঠা বাউল সাধক শাহ আবদুল করিমের পত্নী সরলা যখন দেহ রাখেন, তখন উজানধল গ্রামের ইমাম সাহেব বাউলের স্ত্রীর জন্য বেশরা, ইসলামবিরোধী কাজ। এই অপরাধেই বাউল ফকিরেরা আবহমান কাল ধরেই মূল ধর্মচর্চার বাইরের লোক। তারা নিজেদের কবর। নিজেরাই দেন। মুর্শেদ কবর করেন, জানাজা পড়েন মুরিদের ইমাম সাহেব ঘুরেও তাকান। না এদের দিকে। কবরস্থানকেই ফকির বাউলেরা পবিত্র মনে করে ধোয়া পাখলা করেন। কবর প্রদক্ষিণ করে দোয়া মাগেন। সন্ধেবেলা ধূপ, চেরাগ জ্বালেন। জানাজা-জিয়ারত মুর্শেদের কাজ। মোল্লা মৌলবিরা বেশরাদের দিকে ফিরে দেখেন না।
মারফতি পথ মীনরূপী সাঁইয়ের কথাই বলে। সহজিয়া বৈষ্ণবরাও বলেন যে, মাছের চোখ পেলে পলকহীন চোখে রাধাকৃষ্ণের বিচ্ছেদলীলা তো আর দেখতে হতো না–
কেন মীনের নয়ন নাহি দিলে
রাধাকৃষ্ণলীলা মধুরলীলা
পলকে কেন ছেদ হানিলে
সহজিয়া বৈষ্ণব সাধক, মারফতি মতের ফকির বাউলরা তাই মীনের স্বভাব ধর্ম নিয়েও ভাবেন। বলেন, ডিমে, মাংসে কামভাব আসে, মাছে তামসিক ভাবটা কম থাকে। পুকুরের তলায় যে মাছ থাকে তারা দেহতত্ত্ব জানে। তল থেকে তাই শ্বাস নেয় যোগী মৃগেল মাছ আর ওপরে কুম্ভক, রেচকের জোরে বুরবুরি ওঠে। ফকির বাউল বৈষ্ণবরা তাই মৃগেল মাছ খান, অল্প জলের মাছ খান না, জিওল মাছও খান না। কেননা জিওল মাছ ভোগী স্বভাবের মাছ। পুকুর-বিল-দিঘি থেকে তোলার পর গৃহস্থের ছোট পাত্ৰতেও তারা বাঁচে। বড় মাছ হল ত্যাগী। জলই আশ্রয়। আশ্রয়হীন হলে আর বাঁচে না। মারফতি পথে তাই সব সময় গুরুর আশ্রয়েই থাকতে হয়। বাতুন শ্বাস জানতে হয়, মৃগেল–কাতলা–রুইয়ের মতো সাত্ত্বিক মাছের সেবা নিতে হয়। এতে বড় মাছের কুম্ভক, রেচকের গুণও শরীরে এসে লাগে। মারফতি পথ তাই দম জিকিরের। দমের কাজ জপতপের কায়দা মুর্শেদ গুরুই শিখিয়ে দেন। চিনিয়ে দেন তন বা শরীরের মধ্যস্থ আল্লাহ বা ঈশ্বরকে। সেই চেনানোর তরিকা নিয়েই বিবাদ বা গোলযোগ। কেননা ছেউড়িয়া, পাথরচাপড়ি যেখানে। ফকির বাউলদের মক্কা, দেবতার মূর্তি ঈশ্বর নন, ঈশ্বর মানুষরত্ন; সাঁই, সেখানে স্বভাবতই তাই রক্ষণশীল ইসলাম-হিন্দুর কশাঘাত পড়াটাই তাৎপর্যপূর্ণ।
*****
ইসলামীয় এলাকায় নানা গোষ্ঠীর প্রাদুর্ভাব ঘটে নবী মহম্মদ দেহ রাখার পর। একই প্রাদুর্ভা দেখা যায় গৌড়ীয় বৈষ্ণবতার ভেতরে চৈতন্যদেবের অন্তর্ধানের পর। মারফতি সাধকরা চৈতন্য প্রভুর অন্তর্ধানেই বিশ্বাস করেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবতার বিশ্বাসটাও তাই। তবে শাস্ত্রীয় বৈষ্ণব এলাকায় চৈতন্যদেব ফিরেছেন আউলচাঁদ হয়ে, চরণচাঁদ, কুবির চাঁদের পরম্পরাও চৈতন্য সকাশেই রয়েছে। আবার বৈষ্ণবতার উপস্রোত মতুয়া ধর্মের। হরিচাঁদ-গুরুচাঁদও চৈতন্যাবরেই সামিল। চৈতন্যদেব ও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ পরিকরেরা। শাস্ত্রীয় এবং অশাস্ত্রীয় বৈষ্ণব দেহসাধনার কড়চায় অহরহ অবতারবাদে সামিল হয়েছেন। এর অসংখ্য নজির রয়েছে সব বাংলার গুরুত্বপূর্ণ পুঁথিশালায়। লোকধর্মে চৈতন্যাবতারের জন্ম ধর্মীয় কর্তৃত্বের হাত থেকে নিষ্কৃতির কারণে, সেই একই কারণটিই বলবৎ হয়েছিল ইসলামীয় পরিমণ্ডলে হজরত মহম্মদের দেহত্যাগের পর পরই। মসজিদের ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়েই তৈরি হয়েছিল সুফি মত নামাজ, রোজা, কালেমা, হক, যাকাত–পঞ্চাচারের শরিয়ত ইসলামকে অগ্রাহ্য করতেই সুফিদের ইমান–অদৃষ্ট বস্তুতে বিশ্বাস, তলব–বস্তুর অনুসন্ধান, ইরফান–বস্তু সম্পর্কে জ্ঞানতত্ত্ব, ফানা ফিল্লাহ–বস্তুতে বিলীন হয়ে যাওয়ার পথ ও পন্থাটি তৈরি। সাধক গায়েবি বস্তুতে বিশ্বাস রাখবেন। সেই ইমানের জোরেই দৃশ্যমান জগৎ সম্পর্কে তলব আসবে মনে। গায়েবি বা অদৃষ্ট বস্তুকেই খুঁজে মরবেন সাধক। খুঁজতে খুঁজতেই ইরফান হবে–জ্ঞানচক্ষুর বিকাশ। জ্ঞানের চরম সীমায় পৌঁছে স্রষ্টা ও সৃষ্টির তফাৎ হারিয়ে ফানা হবেন সাধক। সুফি সাধনার মূল জায়গাটি কিন্তু মারফতি দেহতত্বের বা লৌকিক ইসলামের। আল্লাহর পথে স্থিতি লাভ–মোকাম। সেই স্থিতির জন্যই তাঁর ধ্যানে আত্মস্থ হওয়া–তরিকত। তারপরই জাগতিক জ্ঞান হারানো–হকিকত দেহ মন প্রাণ সমর্পণ মারফত। এই করণদশাগুলো হল গিয়ে সুফি সাধকের চক্র পেরোনোর মতই মোকাম দশা–মোকাম মঞ্জিল। প্রথম মঞ্জিল শরিয়ত, দ্বিতীয় লাছুত, তৃতীয় জবরুত, চতুর্থ লাহুত। সমস্তটাই আদতে হল গিয়ে দেহসাধনার সেই অহংবোধের শূন্যতা।
যাইবি যদি মুরাকিবায় দেখবি রে নূরের খেলা
গুরু মৌল বসাইছে প্রেমের মেলা।
মনকে একাগ্র করে নিয়ে সুফি সাধক মুরাকিবায় বসে আল্লাহর জ্যোতিতে ফানা ফিল্লাহ বা বিলীন হয়ে যান। তাঁরই কারণে প্রথমে জিকর করতে হয়। অর্থাৎ কিনা আল্লাহর নামকে ক্রমাগত জপ করা। জিকর মানে সংযোগের দশাপ্রাপ্তি। এই সংযোগ ঘটান মুর্শেদ। তিনিই বায়েতকে উপদেশ দেন, পদ্ধতি শেখান। সুফি মতের এই সাধন পদ্ধতি নিয়েও ফকির বাউলদের মতই অসংখ্য দেহতত্ত্বের গান আছে। চট্টগ্রামের মাইঝভাণ্ডারি গান সুফি সঙ্গীত হিসেবে বাংলায় প্রসিদ্ধ। জিকর শেষে মুরাকিবায় বসার জন্যই রাবিতার কথা নিয়ে অসংখ্য সাধন সঙ্গীত রচনা করেই বাংলার সুফিরা শরিয়তবাদীদের কাছে ফকির বাউলদের মতই বেশরা সুফি আখ্যা পেয়েছেন।
পারস্য থেকে এসেছিল সুফিদের সাধনার ঘরানা। ভারতে এদের আবির্ভাব পারস্য হতেই। সুরাবর্দিয়া, চিস্তিয়া, কাদেরিয়া, নকশবন্দিয়া, মাদারিয়া, আহমদিয়া, কলন্দরিয়া–এই সাত গোষ্ঠীর সুফির খোঁজ মিলেছে ভারতবর্ষে, বাংলায় মাদারিয়া গোষ্ঠীর বিশেষ প্রাধান্য। ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর, চট্টগ্রামের মাদারশা ও মাদারবাড়ি এখনও এই তরিকার ঐতিহ্য বহন করছে। বাংলার সুফি তরিকা বেশ ভালোরকম রপ্ত করেই ফকিররা এখানে ফরিরালি পথে নেমেছেন তা আজ যথেষ্টই প্রামাণ্য। জেলাওয়ারি বাংলাদেশ বা ওপার বাংলা ছেড়ে এপারের দাতাবাবার আখড়া বিখ্যাত ফকিরি মক্কা পাথরচাপড়িতেও রয়েছে এখনও মাদারি গোষ্ঠীর ফকির। বজবজের প্রসিদ্ধ দম্মাদার ফকির, গোরভাঙ্গার আরমানরাও একই গোষ্ঠীভুক্ত।
বঙ্গের সুফিপন্থাও দরবেশী পথ বা সহজ ধর্ম, বাউল, বাংলার ফকির বাউলদের ভেতর সুফি ধর্মের প্রাধান্য নিয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজটিই ছিল মুহম্মদ এনামুল হক সাহেবের। ইসলামের লৌকিক ছায়া নিয়ে তাঁর গবেষনাই দেখিয়ে দেয় যে, সাধারণ শ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে শরিয়ত বা শাস্ত্রীয় ইসলাম কোনোদিনই গুরুত্ব পায়নি। আদতে শরিয়তিরাই মারফতিদের কলকে দেননি। ব্রাত্য, অন্তজ করে রেখেছেন। বাংলার সুফি মত ফকির বাউলদের মতই নিষ্পেষণের ইতিহাসে সমৃদ্ধ। সুফিদের দমন–পীড়নও আঠারো শতকের ফকির বাউলদের উৎখাতের মতো বাংলার নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনাই ছিল।
শরিয়তপন্থা ও রক্ষণশীল হিন্দুআনায় প্রথম বেগ দিয়েছিলেন পাগলা করিম শাহ। আঠারো শতকের শেষে তিনি ময়মনসিংহের সুসঙ্গ পরগনার গারো, হাজং নিম্নবর্গীয়দের বাউলধর্মে দীক্ষিত করেন। সুফিপন্থার আল্লাহর সঙ্গে বিভোর মরমিয়া চিন্তার উদ্দীপ্ত পীর তিনি। আস্তে–ধীরে শেরপুরের সাতসিকা ও সুসঙ্গ সীমান্ত এবং পাহাড় সন্নিহিত অঞ্চলে তিনি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা অলৌকিক ক্ষমতার দাবীদার হয়ে গারো, হাজং মুসলমানদের রোগব্যধি ও ধর্মপথের উপায় বাতলিয়ে আল্লাহ রাসুলের মরমিয়াবাদ প্রচার করে বৃহত্তর পাগলাপন্থী সম্প্রদায়েরই জন্ম দিয়ে বসেন। যে সম্প্রদায় পরবর্তীতে পাগলা করিম শা ও তাঁর বায়েত টিপু শাহের নেতৃত্বে জমিদারবিরোধী সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়। শেরপুর, ঘোষ গাঁও, নেত্রকোনা, সুসঙ্গ, গোটা ময়মনসিংহ জুড়ে গারো-হাজং আদিবাসীদের জনজাগরনের ভেতর ধর্মীয় আলোড়ন তোলেন করিম শাহ। মানুষ ঈশ্বরের সৃষ্টি, তাঁর উচ্চ নীচ প্রভেদ নয়। এই ভেদহীন সমাজের কথা বলেছেন করিম ও টিপু শাহ। জমিদার গোষ্ঠীর সামাজিক ভেদাভেদের নিষ্পেষণের কারণে গারোরা করিম-টিপুদের সকল মানুষ সমান–এর ধর্মে ছুটে এসে শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বল পায়।
ময়মনসিংহে এই পাগলপন্থা বিকাশের অনেক পরে উনিশ শতকের শেষভাগে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ার লালনশাহী আখড়া গড়ে ওঠে। যশোরের হরিশপুরে পাঞ্জু শাহ, দুদ্দুশাহের মত প্রাধান্য পেতে থাকে। একে একে আরও লোকধর্মের প্রবর্তক, লোকনেতার দেখা মিলতে থাকে এদিকে। পীর জালাল নুরুল্লাপুরে, চট্টগ্রামে মাইজভাণ্ডারি আস্তানার পীর আহাম্মদুল্লা শাহ, মহম্মদ জান শরীফ ফরিদপুরে, রাজশাহিতে পাগলা কানাই, ঘোষদাড়ি কুষ্টিয়াতে পাঁচু শাহ, গোপাল শাহ পাবনায়, জঙ্গীপুর মুর্শিদাবাদে সৈয়দ মর্তুজা, ঘোষপাড়ায় আউলেচাঁদ-দুলালচাঁদ-সতী মায়ের কর্তাভজা ঘর, মাইজপাড়া বাউদিয়াতে উজল শাহ, নাজিরপুর নদিয়ায় গোপাল শা, নদিয়ার ভাগা গ্রামে খুশি বিশ্বাস, বৃত্তিহুদায় চরণ পাল–কুবির গোঁসাই–এভাবেই অকুলীন দরিদ্র মুসলমান। সদগোপ, গোয়ালা, হাড়ি, যুগী, চামারদের ধর্মমতের আকস্মিক সন্নিপাত ঘটে যায় আঠারোর শেষ থেকে উনিশের বিস্তৃত সীমানায়। বঙ্গ জুড়ে শা, শাহ, চাঁদ, দরবেশ, সাঁই, নেড়া, খ্যাপা, পাগল, আউল, বাউল, ফকিরদের বৃহত্তর জনতা। শরিয়তের বেশ, খাদ্য, সংস্কৃতি, ভাষা থেকে যাঁদের অনেকখানি পার্থক্য। পার্থক্য একেবারে সরাসরি আচরণবাদেও নাম, জপ, জিকির, চন্দ্রভেদ, রসরতি, রজঃ সাধনা, তন্ত্র সাধনা নিয়ে এখানেও তারা খাদ্য, পোশাক, চন্দ্রভেদের তারতম্যে, চারচন্দ্র ভেদ, দ্বিচন্দ্রভেদ, একচন্দ্র ভেদ, রসরতি যুক্ত ও বিহীন–অর্থাৎ শরীরের মল-মূত্র-শুক্র-রজের একত্র, একটি, দুটির ব্যবহারে, সন্তানের জন্ম দিয়ে বা যোনি অযোনি দেহসাধনা দিয়ে লুঙ্গি পাজামা পরে, গোঁফ হেঁটে, সর্বকেশ, দীর্ঘকেশ, গোঁফ রেখে, খত্ন বা ত্বকচ্ছেদ করে বাহ্যিক আচরণেও এরা বিচিত্রধারী। বৈদিক শরিয়তের প্রচলিত বিধান থেকে সরে আসার কারণেই এদের অণৈশ্রমিক লৌকিক আচরণ ও প্রথাকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্যই ‘বাউল ধ্বংসের ফওয়া’ ওঠে। মুর্শিদই খোদা, বিবাহ আবশ্যক নয়, বায়েতদের ভ্রাতা ভগ্নীদের মধ্যে দেহ মিলন, চারচন্দ্র, নেশা–এসব ইসলাম বিপন্নতার নজির। তাই উঠে পড়ে লেগে পড়লেন ফতোয়াধারী দলের সম্পাদক আলী আহাম্মদ।
উনিশ শতক বাউল শতক। বাংলার বাউল শিরোমনিরা সকলেই উনিশ শতকের সন্তান। আর বাউলমতের উদ্ভবের সঙ্গে জড়িয়ে যায় নদিয়ারই নাম। উনিশের কুষ্টিয়ার লালনপন্থার প্রচার ও প্রসারে বাঁধা ও বিপত্তির মাঝেই সাঁইজি তো বন্ধু পেয়েছিলেন কিছু। যারা তৎকালীন প্রভাবশালী হিসেবে চিহ্নিত। কুমারখালির হরিনাথ মজুমদার, জলধর সেন, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, মীর মোশারফ হোসেন’দের মতো শিক্ষিত আলোক প্রাপ্ত সমাজ সচেতনদের লালনের আখড়ায় যাতায়াত ছিল। আর ছিল শিলাইদহের কুঠিবাড়ির সংসর্গ। সত্যেন্দ্রনাথ–জ্ঞানদানন্দিনী–জ্যোতিরিন্দ্রনাথ–সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সেই আলাপ আলোচনার বিস্তার পায় রবীন্দ্রনাথের হাতে। সাঁইজি দেহ রাখার পরই আসলে লালনের সাধনক্ষেত্রের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির যোগাযোগ বাড়ে; বিশেষত রবীন্দ্রনাথ আরও আগ্রহী হন লালন ঘরানার ফকিরদের চোখের সামনে দেখে, গান শুনে, তাঁর জমিদারভুক্ত
যার সঙ্গীত সুলভ আচরণে আকৃষ্ট হয়েই ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা ‘ভারতী’তে জায়গা পায় সাঁইজির গান। ছাপা হয় কুষ্টিয়ার দুই গায়কের গান বিষয়ক প্রবন্ধ–’লালন ও গগন’। লালন দেহ রাখার পর হিতকারী পত্রিকার প্রতিবেদনই তাঁর দেহকেন্দ্রিক আচরণবাদের। সঙ্গীত সাধনা নিয়ে প্রথম আলো ফেলে। সেই আলো পর্যবেসিত হয় প্রামাণ্য ও বিকৃত লালন গবেষণায়। নদিয়ায় লালনের এই খ্যাতি ও কিংবদন্তির আগেও যে কোনো বাউল মুর্শেদের আবির্ভাব ঘটেনি তা কিন্তু নয়। ষোলো শতকের শেষ থেকে সতেরোর প্রথম ভাগেই হরিগুরু, বনচারী, অখিলচাঁদ, সেবাকমলিণীরা ছিলেন নদিয়ার বাউলধারার প্রবর্তক। সুতরাং বাংলার প্রাচীন বাউল সংস্কৃতির কেন্দ্র হল নদীয়া। সতেরোর মধ্যভাগেই বাংলার নিরক্ষর মুর্শেদের মরমিয়াবাদ ও সঙ্গীত বাংলার নানাস্থানে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আঠারো শতকে বাউল মত প্রতিষ্ঠিত বিস্তৃত হতে থাকে। উনিশ শতকে আদৃত হয়। শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত অংশে। মান্য-অমান্যের ছায়া নিয়ে মুখর হয় বাংলার বাউলপন্থা। ব্যাপক বিস্তৃতির সুযোগে বিকৃত বিকৃত অনাচারের কিছু প্রাধান্য এল না তাও কিন্তু নয়। তবে সংস্কারপ্রবণ মুসলমান ও হিন্দুদের বাউল শত্রু হয়ে ওঠার মূল কারণ আপামর সাধারণের লোক আচরণের প্রতি ঝোঁক। যে কারণে মূলধর্মের সমাজপতি গুরুদেব সিংহাসন হারানোর ভয়। তারাই জোরকদমে লেগে পড়লেন সংস্কার ধর্মে। এদের মধ্যে অগ্রগণ্য মৌলানা কেরামত আলী ও হাজী শরীয়তুল্লাহ বাংলার সর্বাঞ্চলেই সংস্কার আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছেন। নামকরণ পেয়েছে এইসব সংস্কার আন্দোলন। ওহাবি আন্দোলনের ফলে বাউল,মুর্শিদি চর্চা বিপন্ন হয়েছে যশোর কুষ্টিয়ায়। কুমারখালির দুর্গাপুর নিবাসী ওহাবি সংগঠক কাজী মিয়াজান নানা জায়গা থেকে লোক সংগ্রহ করে বাউল আখড়াগুলোতে শরিয়তের অনুশাসন মেনে চলার জন্য কড়া নির্দেশ পাঠাতেন। ফারায়জী আন্দোলন সংস্কারক হিসাবে হাজী শরীয়তুল্লাহ নন-ইসলামিক কার্যকলাপ দূর করার জন্য ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, ঢাকা, পাবনা, বরিশালে প্রচার চালান। তাঁর পুত্র পীর মোহসেনউদ্দীন বা দুদ্দুমিঞা মুসলমান বাউলদের ওপর রীতিমতো বলপ্রয়োগ করতেন। কেরামত আলীর সংগ্রামটা ছিল বিধর্মীয় কার্যকলাপের বিরুদ্ধে। বাউল ধ্বংস করার আয়োজনে এইসব সংগঠকরাই সর্বপ্রথম বিশেষ ভূমিকা নেন। তারপর শুরু হয় মওলানা আব্দুল্লাহেল বাকী ও মওলানা আবদুল্লাহেল কাজী ভ্রাতৃদ্বয়ের হাদিস আন্দোলন। বাউলদের সংখ্যা ও ঐক্য নামে রীতিমত এরা বাহাস করতে থাকেন। যশোরের মুনসী। মোহম্মদ মেহেরুল্লাহও অশিক্ষিত, দরিদ্র মুসলমানদের বাউলধর্ম হতে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসেন। মেহেরপুরের মুনসী শেখ জমিরুদ্দীন এই এলাকাতে পাদ্রিদের প্রচারের কাজেও বাঁধা সৃষ্টি করেন। মুনসী মেহেরুল্লাহ তাঁর বাউল বিরোধী কেতাব ‘মেহেরুল ইসলাম’ এ কিংবদন্তি বাউল গুরু পাগলা কানাইয়ের জানাজা অনুষ্ঠান নিয়ে টিপ্পনী কাটেন। তিনি বাউলদের ‘গণ্ড মুর্খ ভেদুয়া’ বলেছেন। তাঁদের সঙ্গীতকে ‘কাফেরী কালাম’ বলে দেগে দিয়েছেন। এ সময়ই বাউল-নেড়া-ফকিরদের বিরুদ্ধে তাঁদের শরিয়ত বিরোধী কার্যকলাপকে উদ্দেশ্য করে বেশ কিছু গ্রন্থ রচিত হয়। কুষ্টিয়া থেকে বের হয় ‘ভণ্ড ফকির, বশিরহাট থেকে ‘উচিৎ কথা’, যশোর থেকে ‘হেদায়েতল ফাছেকিন’। এই সব বইয়ের ভেতর বিশেষ উল্লেখযোগ্য মওয়ালা রেয়াজউদ্দীন আহমেদের ‘বাউল ধ্বংস ফাৎওয়া’। এরপরও বের হয় জাফর সাহেবের ‘বাতেল ফেরকা’, নাসিরুদ্দীন আহমদের ‘সমাজ সংস্কার’ সহ অসংখ্য বাউলপন্থার বিরুদ্ধে প্রকাশ। লালনের জীবদ্দশাতেই লালন বিরোধী আওয়াজ ওঠে। নেড়াদের বিরুদ্ধাচারণ নিয়ে প্রকাশ ঘটে ‘রদ্দে নাড়া’। লালনের দেহ রাখার পর কুষ্টিয়াতে মওলানা আফছারউদ্দীনরা ছেউড়িয়া আখড়ার বাউলদের ঝুঁটি কেটে আখড়া ছাড়া করেন। বিশ শতকেও লালন পপুলার কালচার হয়ে ওঠার পরও কুষ্টিয়াতে লালনের নামে শহর গড়তে বাধা আসে।
‘বাউল ধ্বংস ফাওয়া’-ই জানান দিচ্ছে তকালীন সময়ে ষাট-সত্তর লক্ষ বাউলের অস্তিত্ব। আন্দোলনে তা কমে এক লক্ষতে নেমেও আসে। শরিয়ত পন্থার জয় লোকধর্মের ওপর আঘাতে এভাবেই ঘোষিত হয়। উত্তরবঙ্গের নীলফামারিতে মাঝবাড়ি, মধ্যমা বাউল সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ শুরু হয়। মারফতি পন্থার এই নির্যাতন ও নিষ্পেষনই প্রমাণ করে এই ধর্মে শরিয়তিপস্থা কতখানি নাজেহাল হয়েছিল। দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান ইসলামি রাষ্ট্র। মারফতিপন্থায় তাই ইসলামিকরণ শুরু হওয়াটাই খুব স্বাভাবিক। বাংলাদেশ জন্মের পর বাউলপন্থা মর্যাদা লাভ করে। তথাপি মৌলবাদের হানায় এদের বিকাশ ও প্রকাশ সংকুচিত হচ্ছে না তা তো নয়।
লোকধর্মে এভাবেই মিশেছে অত্যাচারের কাহিনী আর ঘুরে দাঁড়ানোর স্রোত। সেই স্রোতে শরিয়ত–তরিকত–হকিকতকে এক করে দেখাতে চেয়েছেন আধুনিক বাউল সাধক। লোকধর্মের ভিত্তিভূমি এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে এখন দুই বাংলার অখণ্ডপন্থায়–
মন মুসল্লি ভাই
শরিয়তে আছ তুমি
তরিকতে নাই
তরিকতে নাই তুমি
হকিকতে নাই।
হকিকতের হক বিচারে
মন পবিত্র হলে পরে
দেখতে পাবে আপন ঘরে
আল্লা আলেক সাঁই।।
হও যদি খাঁটি মুসলমান
বাহির ভিতর করো সমান
যে হবে মুনাফিক নাদান
নরকে তার হবে ঠাঁই।।
আসা যাওয়া করে দমে
দিনে দিনে আয়ু কমে
কয় বাউল আবদুল করিমে
মরণকালে চরণ চাই।।