দুর্বিন শাহ কয়
ফাজিলনগরে খেজমত ফকিরের ডেরায় সন্ধ্যা মজে যেতেই চেরাগ জ্বালা হয়ে গেছে তখন। হাত-পায়ের গোসল করে একে একে বায়েত সব এসে জুটছেন মুর্শেদের ডেরায়। সকলেই চেরাগ বাতি আগরবাতি জ্বালছেন সায়ং সন্ধ্যায়। খেজমত তখন তোড়জোর করছেন সাধন গানের, গুরু বন্দনার, ভারিক্কি চেহারার এক বায়েদ, মাথায়। তেল চুকচুকে বাবরি, গলায় পাথরের মালা, কজিতে তামা-স্টিল-কেরুয়া নানা জাতের বালা, সাদা ধুতি লুঙ্গি করে পরা, ওপরে ফকফকে ফতুয়া হাঁটু গেঁড়ে বসে খেজমতকে ভক্তি দিয়ে বললেন, ‘আলেখ’। মুর্শেদ বায়েদ এরপর সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘আলেখ’। মুর্শেদ আমার দিকে চেয়ে একবার তৃপ্তির হাসি দিলেন। খেজমতের ইশারায় বেজে উঠল। ডুবকি, খমক, একতারা। যুবক বায়েদ বেঁধে নিচ্ছে দোতারা। একতারায় পিড়িং পিড়িং করছে মাঝবয়সী এক বায়েত। একজন খোলবাদ্যে কটা চাঁটি মেরে নিল। খেজমত ফকির সুর ধরলেন হারমোনিয়ামের রীড চেপে। তারপরই গেয়ে উঠলেন–’নামাজ আমার হইল আদায়–/নামাজ আমি পড়তে পারলাম না/ দারুণ খান্নাসের দায়।’
ফকিরি গ্রাম গোরভাঙা ও তার আশেপাশের গ্রাম জুড়ে তখন রোজার মাস। মারফতি সাধকরা রোজা ও নামাজে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু শরিয়ত পন্থায় নামাজ রোজা তো আবশ্যক। মারফতি গ্রাম গোরভাঙায় এর বালাই না থাকলেও আশপাশের গ্রাম জুড়ে শরিয়তে বিশ্বাসী মানুষদের বাস। তবে এখানকার সিংহভাগ মানুষই বিপন্ন গরীব। সারাদিন মাঠেঘাটে কাজের পর কর্মক্লান্ত হয়ে সংসারে ফেরে। পেটে খিদের আখ্যান। তাই ইচ্ছে থাকলেও তারা সবসময় নামাজ পড়ার অবসর-অবকাশ পায় না। যখন তারা বাড়ি ফেরে গোরভাঙার ফকিরি গ্রাম ধরে, অনেকেই শুনতে পায় খইবর-আরমান-গোলামরা তখন সাধন গান গাইছেন একেবারে তাঁদেরই যেন মনের কথায়–’ফজরের নামাজের কালে/ ছিলাম আমি ঘুমের ঘোরে/ জোহর গেল আইতে যাইতে/ আসর গেল কামের দায়।’
পাথরচাপড়ি হল ফকিরদের মক্কা। চোতমাসে দাতাবাবার উরস উৎসবে দুনিয়ার পীর ফকির এক হন। চারিধারে তখন পিরান-পাজামার গিজগিজ। পূজা, উৎসর্গ, সিন্নি, মানত, মোমবাতি–তারই মাঝে অবাঙালি ফকিরেরা গাইছেন কাওয়ালি, বাঙালি ফকিরেরা বসিয়েছেন মারফতি গানের আসর। গান হচ্ছে। মাইক্রোফোনেই ধ্বনিত হচ্ছে পীর-সুফী-ফকিরি পন্থার রীতি ও তরিকা–ঘুড়িষার নূর মহম্মদ ফকির গাইছেন–’মগরেবের নামাজের কালে/ গেলাম আমি গোয়াইল ঘরে/ হাওর থাকি আইল না গাই/ বাছুর আমার বান্ধা নায়।‘ পঞ্চাশ পেরোনো নূরের বাবা তোরাব আলি শাহ ফকিরি গান করতেন। হাওরের এ গান তোরাব পেয়েছিলেন খোদ পদকর্তার মুখ থেকেই। নূর মহম্মদ দৈন্যের ভঙ্গিমায় গানখানি আমাকে শোনানোর পর বললেন, ‘চোপর রাত জুড়ে গান হলে বাবা সারিন্দা বাজিয়ে গাইতেন এ গান।’ ডুবকির সঙ্গতে নূর এবার ভণিতায় চলে এলেন–’এসেয়ার নামাজের কালে/ বিবি বলেন চাউল ফুরাইছে/ ছাইলা মাইয়ার কান্দন শুইনা/ কান্দে পাগল দুর্বিন শায়।’
নূরের শেষ করাটায় রীতিমত আমার গায়ে কাঁটা দিল। খোদ পদকর্তা তাঁর আব্বাকে এ গান দিয়েছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোরাব আলি কবে নাগাদ দিয়েছিলেন সিলেটের দুর্বিন টিলায়?’
নূর মহম্মদ বললেন, ‘আব্বার মুখে শুনেছিলাম দাতাবাবার উরসে দুর্বিন পাগল এসেছিলেন শেষ বয়সে। সঙ্গে তাঁর ছেলে আলম শরীফও ছিলেন। আমার তখন মেলায় আসার বয়স ছিল না।’
মাজারে তখন ভিড় বাড়ছে। ফকির চামর নেড়ে বলছেন, ‘আঁটকুড়ার পুত্র যদি হয় সত্য ভাবে/ নিধনের ধন হয় পীরের স্বভাবে। পীর বন্দনার এই ফাঁকে পাথরচাপড়িতে বসে আমি ভাবছি মারফতিদের নামাজ, রোজা, কোরান না মানার বাহাস-ঝগড়ায়, কত আসরে শুনেছি এই গান–’নামাজ আমার হইল না আদায়–’, কিন্তু আজ এমন একজন গাইলেন পাগল দুর্বিনের এই গান, যাঁর উত্তরাধিকারে মিশে আছে পদকর্তার পরম্পরা। তিনি নিজেই দিয়েছেন আবার তাঁর সাধন আখড়ারও পরিচয়–’সিলেট জেলার ভিতরে, পোষ্ট অফিস ছাতক বাজারে দুর্বিন টিলার উপরে, দুর্বিন শাহ হয় যার নাম।।’
দুর্বিন শাহ সুফিপন্থা ও মারফতি মতে বিশ্বাসী। সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার নোয়ারাই গ্রামের তারামনটিলা তাঁর সাধন ক্ষেত্র। দেহতত্ত্বের অসংখ্য গান লিখেছেন তিনি। তত্ত্বগানে তিনি ছিলেন পূর্ববর্তী সাধক মরমীয়া আরকুম শাহ, শিতালং শাহ, জালাল উদ্দিনের অনুসারী। বিশেষত জালালউদ্দিনের গানের দেহঘরের নিমগ্ন প্রতীকগুলিই যেন দুর্বিন মূর্ত করেন তাঁর অতীন্দ্রিয় দশায়। এর পাশাপাশি বৈষ্ণবীয় পন্থার ভাবতত্ত্ব, রাধা কৃষ্ণলীলা, গোষ্ঠলীলাও আশ্চর্যভাবেই তাঁর গানের বিষয় হয়ে ওঠে। সাধক মহলে তিনি জ্ঞানের সাগর অভিধায় চিহ্নিত। কুষ্টিয়া ও হাওর–মরমিয়া সাধন ধারার দুই মতামত, আচরণ, ভেক, রীতিনীতি সবটাই বেশ আলাদা ধরণের। নদিয়া, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, যশোরে গুরু ধরে বাউল সাধনার রীতি। সিলেট, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ সহ গোটা হাওরেই সেটা মুর্শিদ এর দীক্ষা আধারিত। এ তো গেল স্থূল স্তরের তারিকা। প্রবর্তস্তরে নদিয়া তথা বাংলাদেশের লালনপন্থী বাউলেরা ভেক-খিলাফৎ নিয়ে থাকেন। তাঁরা সাদা পোশাক পরেন। বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে এই ভেক খিলাফতের কোনো ব্যাপার নেই। শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহরা তাই ভেক খিলাফত না নিয়েই মুর্শিদ, পীর এর কাছে দীক্ষা নিয়ে বাউল সাধনা করে গেছেন।
দুর্বিন শাহের সাধনশৈলী তাঁর গানের ভেতরই ধরা আছে। তিনি পুরোদস্তুর সংসারী মানুষ ছিলেন। তথাপি তিনি যেন ঘরছাড়া বাউল। আজমীর শরিফের খাদিম সৈয়দ আব্দুস সামাদ গুলজেদি ছিলেন তাঁর মুর্শিদ। ছেলেমেয়ে থাকলেও তিনি যে বাউল ধারার চারচন্দ্রভেদ, দমসাধনা, রজঃসাধনা সম্বন্ধে বিশ্বাসী এবং আচরণবাদী তা তাঁর গানগুলির ভেতরই স্পষ্ট চিহ্নিত। ১৯৫০ সালে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘প্রেমসাগর পল্লীগীতি’এর প্রথম খণ্ড প্রকাশ পায়। দ্বিতীয় খণ্ডও ওই একই সালে বের হয়। তৃতীয় খণ্ডের প্রকাশ সাল ১৯৬৮ সে বছরই তিনি শাহ আব্দুল করিমের সঙ্গে বিদেশ যাত্রা করেন। সেখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর সাধনতত্ত্বের গান পরিবেশিত হওয়ার পর তিনি প্রবাসীদের কাছ থেকেই জ্ঞানের সাগর উপাধিটি লাভ করেন। পরবর্তীতে গোটা বাংলাদেশই তাঁর নামের আগে বিশেষণ স্বরূপ উপাধিটি জুড়ে দেন। ১৯৬৮ সালেই ‘প্রেমসাগর পল্লীগীতি’র চতুর্থ খণ্ডের প্রকাশ ঘটে। এরপর তিনিও মুক্তিযুদ্ধের শরিক হয়ে ওঠেন। জনগনকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। এক্ষেত্রে করিমের মতোই তাঁর প্রধান সহায় গান। তিনি বেশ কিছু দেশাত্মবোধক সঙ্গীতও রচনা করেন। ১৯৭২ সালে এইসব সংগ্রহ নিয়েই বের হয় বই ‘সোনার বাংলা সংগ্রাম গীতিকা’। এইসব গানের মূল বিষয়বস্তু হল মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৭০ সালেই সিলেটের ইউনাইটেড প্রেস থেকে বের হয় ছটি গানের সংকলন ‘পাক বঙ্গ ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ গীতি’। ১৯৭৩ সালে ঋত্বিক ঘটক তাঁর বিখ্যাত সিনেমা ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’তে দুর্বিন শাহের জনপ্রিয় সাধন সঙ্গীত নামাজ আমার হইল না আদায় ব্যবহার করেন। এটি গেয়েছিলেন ভাটির বিখ্যাত গায়ক রণেন রায়চৌধুরী। ১৯৭৭ সালে দুর্বিন টিলার নিজ বসত বাড়িতেই এই মরমিয়া সাধক দেহ রাখেন। বাউনের বিশিষ্ট তাত্ত্বিক আবুল আহসান চৌধুরী লিখেছেন–’দুর্বিন শাহ কত গান রচনা করেছিলেন তার সঠিক হিসেব পাওয়া ভার। তবে তাঁর গানের একটা বড়ো অংশ ‘প্রেমসাগর পল্লীগীতি’ নামে মোট ছ’খণ্ডে বেড়িয়েছিল ১৯৫০ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে। সপ্তম খণ্ডের পাণ্ডুলিপি অসম্পূর্ণ থাকায় তা প্রকাশিত হয়নি। গবেষক আবদুল রহমান লিখেছেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই বাউল দুর্বিন শাহের গান নানাজনের কণ্ঠে শুনে আসছি। যেমন শুনতাম শাহ আবদুল করিমের গানও। আমাদের গ্রামের গানপিপাসু আলেক ভক্তগন প্রতি মাসে তিন চার দিন ঘরোয়া আসর করতেন। তখন বিভিন্ন পীর ফকির বাউল মহাজনের গান গাইতেন। প্রত্যেক আসরে দুর্বিন শাহের। দুই চারটি গান গাইতেন। যিনি গাইতেন তিনি ব্যতীত আর সবাই মুখ বন্ধ করে ‘আল্লাহ আল্লাহ’ জিকির করতেন। কোনওপ্রকার বাদ্যযন্ত্র ছাড়া গাইতেন। তখন গানকে বলা হতো কালাম। অনুসন্ধিৎসু টি এম আহমেদ কায়সার লিখেছেন দুর্বিন শাহের গায়কি নিয়ে।
তিনি বলছেন, ‘এমনকি উচ্চারণও স্পষ্ট হতো না সব সময়; গাইতেন কাশযুক্ত ভাঙা ফ্যাসফ্যাসে গলায়, কিন্তু তাতে কী হবে, ভক্তেরা কয়, আসরে আসরে কত নির্ঘুম রাত যে কাটিয়েছি দুর্বিন নেশায় এই গান শুধু তাঁর স্বকণ্ঠে শোনার জন্যে। এক অন্তর্মগ্ন মিনতি, আহা! কী যে এক বিষাদঘন মাধুর্য, যেন কান্না ঝরে পড়ত গানের ছত্রে ছত্রে। গানের বিশাল বিশাল আসর বসত তখন মাজারে, আখড়ায়, প্রত্যন্ত গ্রামে আবার কোনো কোনো গঞ্জেও। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ হন্যে হয়ে ছুটে আসত গান শোনার জন্য। দুর্বিন শাহ’র কিছু গান একদা সারা বাংলাদেশ মাতিয়েছিল। অবশ্য তখনও বাউলা গানের কদর ছিল বেশ, বাউলরাও উপেক্ষিত ছিল না খুব একটা।
২০১০ সালে দুর্বিন শাহের প্রকাশিত–অপ্রকাশিত–অগ্রন্থিত ৩২ টি গান নিয়ে একটি সংকলন বের হয় সুমন কুমার দাশের সম্পাদনায়। সুমন সিলেটের ছেলে। আমারই বয়সী। গ্রাম ঘুরে ঘুরে লোকগান সংগ্রহ করে সে। ওর ব্যক্তিগত সংগ্রহে নানা ধারা উপধারার গান রয়েছে।
ভূমিকায় সুমন লিখছে, ‘আমি নিজে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে চেষ্টা করেছি দুর্বিন শাহের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গানগুলো একত্রে গ্রন্থভুক্ত করার। তবে সংকলিত গানগুলোর বাইরে আরও কিছু গান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বিভিন্ন সময় গানের মঞ্চে তাৎক্ষণিক ভাবে রচিত অধিকাংশ গান সংরক্ষণের অভাবে শিল্পী নিজেই হারিয়ে ফেলেছেন। শিল্পীর অনুরাগী, ভাবশিষ্য ও ভক্তদের বদৌলতে হয়তো একদিন এসব গানও সংগৃহীত ও সংকলিত হবে। তখন হয়তো বা দুর্বিন শাহের গানের প্রকৃত সংখ্যা জানা যাবে…।
২০১৪ সালে ‘দুর্বিন শাহ সমগ্র’র দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়। এই সংস্করণে সুমন লিখছে, ‘দুর্বিন শাহ সমগ্র’ গ্রন্থে পূর্ববর্তী সংস্করণের ৩২৭ টি গানের সঙ্গে আরও ২৮ টি অগ্রন্থিত গান মুদ্রিত হল। অগ্রন্থিত গানের মধ্যে ‘ভুলে পড়ে জগৎ ঘোরে, তার পিছনে আমিও ঘুরি’ ও ‘ফুলের মালা হল কী জ্বালা’ শীর্ষক দুটি গানের কোনো নামপদ পাওয়া যায়নি। সব মিলিয়ে দুর্বিন শাহের গানের সংখ্যা ৩৫৫ তে দাঁড়ালো। এর বাইরে আরও কিছু গান হয়তো শিষ্য-অনুরাগীদের সংগ্রহে থাকতে পারে। তবে সে সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য বলেই আমাদের ধারণা। তবে বর্তমান সংস্করণ থেকে বইটির নতুন নামকরণ করা হয়েছে দুর্বিন শাহ সমগ্র।
এই সংকলনেই সুমন যোগ করেছে দুর্বিন শাহের জীবনপঞ্জী ও গ্রন্থপরিচয়। জুড়েছে আবুল আহসান, আবদুর রহমান ও আহমেদ কায়সারের লেখাগুলি।
সংকলনে গ্রথিত করবার সময় সুমন দুর্বিনের গানগুলো বলা চলে একেবারে সাধন বিন্যাসেই দিয়েছে। হামদ ও নাতে রাসুল, সৃষ্টিতত্ত্ব, আউলিয়া শানে, মুর্শিদ বর্ণনা, পারঘাটা, দেহতত্ত্ব, মারিফত তত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, কামতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, কারবালা স্মরণ, বিচ্ছেদ, ভাটিয়ালি, গোষ্ঠ–এই পনেরোটি সাধন আধারে রেখে সুমন দুর্বিনের পদাবলী সাজিয়েছে। আর ওঁর স্বদেশ পর্যায়ের গানগুলোকে রেখেছে সে বিবিধ হিসাবে।
বাউলের সাধন পদ্ধতি, আচরণ ও গায়নশৈলী বদলায় আসলে অঞ্চলের জল হাওয়ায়। নদিয়া বৈষ্ণব আচরণে ধন্য বলেই কুষ্টিয়ার সাধনা ও সুরে কীর্তনের প্রভাব।
ভাটির দেশের মরমিয়াদের সুরে ভাটিয়ালির প্রভাব থাকাটা তাই স্বাভাবিক। দুর্বিনের গান তাঁর ব্যাতিক্রম নয়। শরিয়ত মারফতের বিশ্লেষণ, দম-শ্বাসের দেহসাধনা, গুহ্যচর্চার গানের পাশাপাশি দুর্বিনের মুর্শিদ বন্দনার গানগুলির ভেতর যে আচরণবাদ তা বাউল পন্থারই যথার্থ তারিকা। যখন মেলায় খেলায় ঘোরাঘুরি শুরু করি, গুহ্য আচরণবাদে আকৃষ্ট হয়ে মরমিয়াদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করি তখন অনেকেই বলতেন আমায়, ‘আগে গুরু ধরেন গা, গুরু না ধরলি কোনও কিছু শুরুই হবে না নে।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম খয়েরবুনির সনাতন দাসকেই, ‘গুরু কেন?‘
বলেছিলেন, ‘গুরু হলেন নিয়ন্ত্রণ।‘
বললাম, কীসের?
বললেন, শ্বাস প্রশ্বাসের। শরীরে নানা কাম যাতনার চক্র রে খ্যাপা। গুরু এর ঘোর কাটায়।
বিকেল যখন মজেছে। সনাতন একতারা তুলে নিয়ে গাইতে থাকলেন মুর্শেদ বন্দনারই গান। খয়েরবুনিতে সন্ধ্যা নামছে তখন হু হু করে। বাউলেরা এ সময় গুরু ভরসার দৈন্যগান করেন।
সনাতন গাইছেন, ‘মুর্শিদ নাম ভরসা করে অকূলে দিলাম সাঁতার।’
‘দুর্বিন শাহ সমগ্র’র ভেতর এই গানখানি নাড়াচাড়া করতে করতে খয়েরবুনির খ্যাপাকে বড় মনে পড়ছে। ওঁর গলাতেই আমি যে প্রথম শুনেছিলাম দুর্বিন শাহের পদ। কিছুকাল হল খ্যাপাও চলে গেছেন দুর্বিন শাহের দেশে।