০২.
পরদিন দুপুরে ঠিক আগের মতোই কি করবে ভেবে পেলো না অনু। গনগনে রৌদ্রে খড়খড়ির রঙ জানালার শার্সি সব চড়চড় করে পুড়ছে। নিষিদ্ধ ছাদ রৌদ্রের তাপে লোহার মতো লাল হয়ে আছে।
নতুন করে আবার ছিন্নমস্তার মন্দির বইটা নিয়ে বসলো। ভালো লাগলো না। বাসি। খুব আশ্চর্য হয়ে গেল, কিভাবে যে বইটা এতো ভালো। লেগেছিলো আগে?
বই বন্ধ রেখে মেঝের ফরাশে শুয়ে পড়লো। ভাবলো কী-ইবা এমন হবে, মা তো আর ইংরেজিচর্চা ছেড়ে দেখতে আসছে না।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলো।
স্বপ্ন দেখলো মাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তাকে নিয়ে স্যার সন্ধানে বেরুলেন।
এক সময় বাড়ির পেছনে সাগদায় মার মৃতদেহ দেখা গেল; এয়ারগান দিয়ে বহুদিন আগে সে যেসব চড়ুই পাখি মেরেছিলো তার পাশে মৃতদেহটা মুখ থুবড়ে পড়ে, নিসাড়।
মানুষ মরে যায়, কিন্তু মা কি মরে, সে ভাবতে চেষ্টা করে। সম্পূর্ণ লোপ পায় তার বোধশক্তি; ভেতরের যাবতীয় কষ্ট ছুঁই ছুঁই করেও পরক্ষণেই আবার পালিয়ে যায়, কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে।
হঠাৎ ছাদের ওপর থেকে তাতানো লোহার মতো লাল পা নিয়ে নীলচক্ষু আব্বা ত্রুর উল্লাসে লাফিয়ে পড়লেন, হারেরেরেরেরেরেরে—তাঁর হাতে ইয়া এক শাবল!
প্রচণ্ড জোরে অমানুষিক হুঙ্কার ছেড়ে তিনি অনুর মাথায় শাবল বসিয়ে দিলেন। সে চিৎকার করে উঠলো–
যখন ঘুম ভাঙলো, দেখলো রক্তাক্ত ফরাশে তার মৃতদেহ পড়ে আছে। সেখানে অন্য কেউ নেই।
০৩.
পরদিন দুপুরেও অনু অনেকক্ষণ ছটফট করতে করতে এক সময় আগের দিনের মতোই আবার ফরাশে ঘুমিয়ে পড়লো। স্বপ্ন দেখলো লামাদের বাগানে আমগাছের মগডালে পা ঝুলিয়ে বসে লালপেড়ে শাড়ি পরা মা। গলার ওপর থেকে কেটে বাদ দেওয়া, সেখানে একটা কাস্তে।
সে দাঁড়িয়েছিলো গাছের ঠিক নিচে। ওপর থেকে মা তার গায়ে থুথু করে থুতু দিলো। দাউদাউ করে শরীরে আগুন ধরে গেল। আমগাছের ডালে কাকের ছানাগুলো পিউ পিউ করছে।
দমকা হাওয়া। হৈহল্লা হৈহল্লা হৈহল্লা।–
০৪.
অনু আর ঘুমোবে না সাব্যস্ত করেছে। জানালায় এসে দাঁড়ালো আজ। জানালার মতো পুড়তে চায়।
লামাদের বাগানে দস্যু ছেলেরা বেদম হল্লা জুড়েছে, হাউজদ্যাট হাউজদ্যাট! লামার মামা দোনলা বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যা করেছেন, তাঁর লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কবরস্থানে। ছোট্ট একটা শোক মিছিল। এখনো এক মাসও হয় নি পুকুরে ডুবে মরেছে লামা।
অনুর কানে বাজতে থাকে হাউজদ্যাট হাউজদ্যাট।
০৫.
আজ দুপুরে ঠিক একই সময়ে অনু আবার সেই জানালায়। দস্যু ছেলেরা ব্রিং খেলছে। লামাদের বাগানে প্রজাপতির ঝাঁক নেমেছে, প্রজাপতি প্রজাপতি প্রজাপতি—পাখিদের সে কি উল্লাস!
০৬.
কোনো একদিন ঝনঝনে থালার মতো দুপুরে খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে গলা বাড়িয়ে একটা পাখি দারুণ চিৎকার করে উঠলো; কানে বাজলো, এসো অনু–-এসো!
০৭.
পরদিন অনু দুপুরের উদ্দেশে নিজেকে অবাক করে নিরুদ্দেশ হলো।