হো, যারা ধোঁকে হ্যায়…
হিরণের হাতের আঙুলগুলো লম্বা-লম্বা। আঙুল কেন, তার তালুর গোটা গড়নটাই কেমন যেন অমানবিক ঢঙে লম্বাটে। চামড়া দিয়ে ঢাকা তাই, যৎকিঞ্চিৎ মেদমাংসও রয়েছে, পাঠোদ্ধারের আশায় রয়েছে বিবিধ হস্তরেখা। নইলে বলা যেত, কঙ্কালের হাত। সমস্ত স্কেলিটনের হাত লম্বাটে।
হাতে সানের মাউন্ট তার বরাবরই চাপা। বস্তুত, একটা গহুরই সেখানে। সূর্য-রেখাটিও ভেঙে চুরমার। আর… লাইফ-লাইনের কথা ধরলে সে তো কবেই মরে-হেজে গেছে বলতে হয়, এতই হাস্যকর ছোট্ট সেটা, ধর্তব্যের মধ্যে নয়, এবং, অমনটা বললে সম্পূর্ণ মিথ্যেও বলা হয় না। জীবন জুড়ে বেঁচে থাকতে, থাকতে, থাকতে, থাকতে কে যে কবে, কখন, টুক করে কোথায় মরে পড়ে আছে, সে গায়েব লাশের সন্ধান জীবদ্দশায় আর পাওয়া যায় না।
আশপাশে অনেকেই তো এভাবে মরণোত্তর বেঁচে আছে। অনেকে কেন, অধিকাংশ। একদিন ছিল, যখন মনে হত, ব্যতিক্রমহীনভাবে প্রায় সকলেই। একদিন, যখন তার বয়স ২৫-২৬, মনে হত তার, সে আপাদমাথা বিশ্বাসও করত যখন এমনটা ভাবত, যা প্রায় টায়ে-টায়ে দেখতে পেত বললেও অংশত ঠিক বলা হবে, যে, এত লাশ তার মৃত অস্তিত্বের চারিধারে, শুধু এই একটা শহরে! অফিসে যাও— লাশ সহকর্মী, কারখানার খোলা গেটে বিড়ি ফুঁকছে লাশ শ্রমিক, বাড়িতে লাশ-ভ্রাতা, লাশ-পিতা, লাশ-মাতা, কোনওদিন একগাড়ি লাশ-যাত্রী নিয়ে চলেছে ৯ নং ডাবলডেকার, কেবিনে লাশ-ড্রাইভার, অনাদি কেবিনের ছোট্ট টেবিলে মুখোমুখি লাশ-দম্পতি, সামনে গরম মোগলাই, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গাড়ি চেপে বেরিয়ে আসছেন লাশ-ভাইস চ্যান্সেলর, কফি হাউসে লাশ-কবি, লাশ-সাংবাদিক, লাশ-মেয়র, লাশ-মন্ত্রী মায় হাইকোর্টে বিচারাসনে লাশ-বিচারপতি… কিন্ডারগার্টেনেও কলহাস্যমুখর লাশ-শিশুর দল এমনকি! তখন, সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য লাশ মনে হত তাদের, এ মরা শহরে যারা তখন প্রেম করত। প্রবল বর্ষার মধ্যে, ময়দানের বাসসাপে, পিছনে ভিক্টোরিয়া, রঙিন চীনা ছাতার নিচে এক বাঙালি লায়লা-মজনুকে দেখে মনে পড়ে, আজ থেকে ২৫/২৬ বছর আগে একদিন, কোনও একদিন, তার অবিকল তাই মনে হয়েছিল।
পরে এম. এস এবং এফ. আর. সি. এস হলে কী হবে, তার ছোটভাই রঞ্জন ছিল আদতে একটি ইন্টারমিডিয়েট, যে কিনা প্রথম টি, এস. এলিয়ট পড়েছিল বিলেতে গিয়ে! হিরণই তাকে বইটি পড়তে বাধ্য করে। এখান থেকে এক কপি ওয়েস্ট ল্যান্ড কিনে সে তার তঙ্কালীন চেলসির ঠিকানায় তাকে পাঠায়। সেই টি, এস, যার অমর প্রেমগীতিতে ছিল—
A crowd flowed over London Bridge, so many
I had not thought Death had undone, so many
তো, হিরণের হাতে আয়ু-রেখা একরকম না থাকার মধ্যে। ভাগ্য বলতেও তার হাতে কিছু নেই, নেই কোনও রেখাটেখা। সানলাইন বা যশোরেখা, সে তো কবে ভেঙে চুরমার। যশ নেই, আয়ু নেই, ভাগ্য নেই। একটি প্রখর বিদেশ-রেখা তবু, কেন যে, তার তালুর নিচে থেকে অমন অমোঘভাবে রিং-ফিঙ্গারের দিকে উঠে গেছে! সেই ছোটবেলা থেকে যখন যতবারই হাত পেতেছে, এমনকি মা-র সঙ্গে কাশীর হরিশ্চন্দ্র ঘাটে বাল্যকালের প্রসিদ্ধ ভৃগুমুনিও, অন্যান্য বিষয়ে মতান্তরে মাথা নাড়লেও তার হাতের ওই চচ্চড়ে বিদেশ-রেখাটির প্রবল অস্তিত্ব সম্পর্কে তিনিও সংশয় প্রকাশ করেননি। ম্যাপে নীল সমুদ্র-ছবির ওপর একটি বল বাণিজ্য-রেখা যেন, যার ওপর একটি নিশ্চল পালতোলা অর্ণব-পোতই শুধু যা এখনও দেখা দেয়নি।
ছেলেবেলা থেকে হাত পাততে পাততে তাই, একটা ধারণা তার কখনও না মরে, অজান্তে হঠাৎ লাশ না হয়ে গিয়ে, না-গায়েব বেঁচে ছিলই যে আর কিছু না হোক, বিদেশ সে যাচ্ছেই। কীভাবে, তা জানে না। কোনও পরিকল্পনা নেই। তেমন কোনও লাইনও সে ধরে নেই। তবু সে যাচ্ছে।
এ নয় যে জ্যোতিষে তার খুব বিশ্বাস। আদৌ তা নয়। তবু সেই কবে থেকে একটাই কথা শুনতে শুনতে শুনতে শুনতে শুনতে সে, ঠিক বিশ্বাস নয়, ভাবতে কেমন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে হয়ত একটা সুযোগ আসবে। এলে, সে যাবে।
কলেজে ঢুকে ফোর্থ ইয়ার পড়তে না-পড়তেই বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে ডানা মেলা শুরু হল। না, ডানা মেলা বললে ঠিক বলা হয় না। বেশ ভুল বলা হয়ে যায়। বলা উচিত, পাল তোলা। কেননা, তখন তো সবাই জাহাজেই যেত।
সবার আগে গেল বাদল। বাদলের সঙ্গে হিরণ পড়ছে সেই ক্লাস-টু থেকে, টাউন স্কুলে। ১৯৫২-য় শেষ ম্যাট্রিকুলেশনে সে আর বাদল দুজনেই পাস করল সেকেন্ড ডিভিশনে। তার হওয়ার কথা ছিল ফার্স্ট ডিভিশন আর বাদলের মেরেকেটে থার্ড। বাদল পেল থার্ড ডিভিশন থেকে ২১৭ নম্বর বেশি, আর সে পেল ফার্স্ট ডিভিশনের থেকে ৫ নম্বর কম। মুড়ি-মিছরির দর এক হয়ে গেল। নম্বরের দিক থেকে কান ঘেঁষে, প্রেসিডেন্সিতে ঢুকল আর্টস নিয়ে। বাংলা বৈ অনার্স পেল না। বাদল নিল কমার্স। খোলা গেট দিয়ে গটগট করে অনার্স-সহ ঢুকে গেল সুরেন্দ্রনাথে। সেই থেকে জন্ম বাদলের প্রতি তার অবিশ্বাসের। সে বাদলকে সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করল।
তারপর, ফোর্থ ইয়ারে তারা তখন। কলেজ স্ট্রিটে তখন রোজ দুপুরে তেলেঙ্গানার বিলম্বিত ঢেউ আছড়ে পড়ে। রোজ বিপ্লব! ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়। তৎকালীন দাপক (এখন গ্রেস) সিনেমার দুপাশের দোকানগুলো থেকে রোজ দুপুরে, কলেজ পালিয়ে, জলের ট্যাঙ্কগুলো নামিয়ে এনে ব্যারিকেড তৈরি করা, সঙ্গে কলুটোলার গলি থেকে টেনে-আনা ঠেলা দু-চারটে। পুলিস তেড়ে এলে কমরেড সীতা মুখার্জি তীক্ষ্ণ চিৎকার করে হুকুম দিতেন, কমরেডস্, রেজিস্ট করুন। কদিন ধরে পাত্তা নেই বাদলের। পাশে নেই। গোলদিঘির জনসভায় গুরুতর আহত হয়েছিল কমরেড লতিকা মিত্র। লতিকার ডান হাত পুলিস পাকিয়ে ভেঙে দিয়েছিল। মেডিকেল কলেজের এমার্জেন্সিতে ঢুকে, তখন সন্ধেবেলা, সেকালের প্রবাদপ্রতিম অর্থোপেডিক্স ডাঃ পঞ্চানন চক্রবর্তী, কী হয়েছে মা তোমার, দেখি-দেখি বলে ফুলে-ঢোল কমরেড মিত্রর ফর্সা হাতখানা কব্জির কাছে তাঁর লোমশ পাঞ্জা দিয়ে চেপে ধরে প্রবল জোরে মারলেন এক হ্যাঁচকা টান, কটাং করে ভয়াবহ শব্দ এক, কমরেড লতিকা চিৎকার করে উঠল বাবা গো বলে আর ডাক্তার চক্রবর্তী বললেন, যান, সেট হয়ে গেছে বোনটা। ইউ আর কিওর্ড।
এমার্জেন্সিতে ডিউটি ছিল টেকো তপনের। সে বছরেই তপন আর রঞ্জন বেলুড় বিদ্যামন্দির থেকে ইন্টারমিডিয়েট করে মেডিকেলে ঢুকেছে। মেডিকেল কলেজের গেটে, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে, তপনই তাকে প্রথম জানায়, হিরুদা, শুনেছ, বাদলদা কাল ওয়েস্ট জার্মানি চলে গেছে?
ডানা-মেলার, না তো, পালতোলার সেই শুরু।
কিন্তু, বাদল! ওয়েস্ট জার্মানি! শুনে কী ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিল সে।
বলতে বলতেই তপনের বাস এসে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি ২নম্বর দোতলারফুটবোর্ডে লাফিয়ে উঠে, চলন্ত বাস থেকে হাত নেড়ে তপন চেঁচিয়ে বলেছিল, “রঞ্জনের কাছে সব শুনে নিও।
ওয়েলিংটনের দিকে শীত-কুয়াশার জন্য বেশিক্ষণ বাসটা দেখা যায়নি। যতক্ষণ যায়, তারপরেও বহু সময় সেদিকে তাকিয়ে ছিল হিরণ।
ছিপছিপে, মিষ্টি ও মাকুন্দ, মেয়েদের চেয়েও সুন্দর, গোটা স্কুলজীবন জুড়ে, আহা, কী অকথিত প্রেমেই যে সে পড়েছিল বাদলের। উত্তরা সিনেমায়, ক্লাস টেনে পড়তে, টেস্ট পরীক্ষা ও ম্যাট্রিকুলেশনের মাঝখানের সময়টা সিনেমার নেশায় পেয়ে বসে হিরণকে। সঙ্গে থাকত, সব সময়, ক্লাস নাইনের ছোটভাই রঞ্জন। বাদল বসত মাঝখানটিতে। কত ছবিই না তারা দেখেছে একসঙ্গে। মনে পড়ে ঝামাপুকুরের কীর্তি সিনেমায় (এখন জহর) প্রথম দেখা বাজি। সরমায়ে কাহে, ঘাবড়ায়ে কাহে, বা, সি. আই. ডি-র যাত্তা কাঁহা হ্যায় দিওয়ানে, কাকুর লিপে গীতা দত্তর কিন্নরীকণ্ঠ, ও. পি. নাইয়ারের সুর— যার মধ্যে ছিল, তেরা দিলমে ফিফটি, মেরা দিলমে ফিফটি-জমানা হত্যায় পুরা…ইত্যাদি। একটা গান খুব গাইত বাদল। হো, যারা ধোঁকে হ্যায়, ধোঁকে হ্যায় পিছলে জমিন/বাবুজি ধীরে চলনা/পেয়ারমে জারা সামহালনা.. এটা কোন ছবির কিছুতেই মনে পড়ে না আজ। মনে পড়ে গীতা দত্ত অনুকরণে কী অবিকল লচক-সহযোগেই না সে যাতা-কে যাত্তা আর সামালনা-কে সামহালনা করতে পারত।
স্কুলে পড়তে শ্রীতে কবি দেখতে দেখতে, বসন যখন ঢলে পড়ল মৃত্যুতে, তার মাথার কাছে প্রদীপটা শেষবার কেঁপে উঠে দপ্ করে নিভে গেল, তখন সেই বিপুল ট্র্যাজেডিতে কী উন্মথিত না হয়েছিল তারা তিনজনে একসঙ্গে, সে, বাদল আর রঞ্জন। বাদল তার ঘাড়ে মাথা রেখে বলেছিল, কীরে, কিছু বলবি? মানে, ইজন্ট ইট সুপার্ব?
মায়, একসঙ্গে ঘাটশিলা গিয়েছিল। তারা তিনমূর্তি।
সেই বাদল এই মুহূর্তে জার্মানিতে। সত্যি, এর চেয়ে রহস্যময় বুঝি আর কিছু হয় না। অন্তর্ধান ছাড়া একে আর কী বলা যায়, নেতাজির পরে। এ অপার রহস্যের বিস্তৃত বিবরণ সে আর রঞ্জনের কাছে বাড়ি ফিরে কী শুনবে।
পরে বুঝেছে, লাইনে থাকলে, সেও তখন চলে যেতে পারত। তার হাতের আজন্ম-অটুট বিদেশ-রেখাটি তখনই মাহাত্ম্য পেতে পারত এবং অনেক সহজেই। যুদ্ধোত্তর পূর্ব ইউরোপে তখন নারী-শিশু আর বালক-বালিকার ভিড়-পৃথিবীর সর্বত্র থেকে পশ্চিম জার্মানিতে ইমপোর্ট হচ্ছে সক্ষম ও সাবালক যুবকের পাল, বিশেষ করে ওয়েস্ট জার্মানিতে যেতে ভিসাটিসার বালাই তখন একদমই ছিল না। পরে জেনেছিল, বাদল আসলে ওখানে একটি পাঊরুটির কারখানায় ময়দার বস্তা তোলার কাজ পেয়েছে।
তুলুক বস্তা। তবু তো বিদেশ! স্টুটগার্ড। জার্মানি। ওক, বিচ, এলম, বার্চ। ব্ল্যাক ফরেস্ট। নদীর নাম রাইন। চারিদিকে ফুটফুটে সাদা দেবদেবী। ঝকঝকে রাস্তা। ঝকঝকে বাড়ি। বাড়ির চারচালায়, ফুটপাথের ধারে ধারে, গাছের পাতায় কোথায় নয়—নীল বরফ।
মেম। মেম মানেও সেই বরফ-ব্লু দিয়ে মাজা সাদা-সাদা পা, ঊরু পর্যন্ত উন্মুক্ত। সে সময় কলকাতায় ৬০ ভাগ লোক ধুতি পরত। তাই শুনে তার প্রথমেই মনে হয়েছিল, বাদল এখন সেই দেশে যে-দেশে পুরুষরা পা ঢেকে রাখে এবং মেয়েরা তা খুলে দেখায়।
সেই শুরু। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়-পর্বে ঢোকার আগে, পরে আশপাশ থেকে আরও অন্তর্ধান শুরু হল। ততদিন অবশ্য যাওয়া বেশ টাফ হয়েছে, ভিসা তো লাগেই, লাগেজব-ভাউচার… তবুযাওয়ার যেন বিরাম নেই। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। কেউ গেল কানাডায়, কেউ আমেরিকায়। অধিকাংশ ব্রিটেনে।
তা বলে, এম. বি. বি. এসের রেজাল্ট বেরনোমাত্র রেজিস্ট্রেশন হওয়ার আগে, রঞ্জন তাকে এসে বলবে, নদা, আমি বিলেত যাব, তুই কিছু টাকা স্ট্যান্ড করতে পারবি?–এ জন্যে হিরণ মোটই প্রস্তুত ছিল না।