হুলিয়া লেগেছে। ইস্। শ্যামাদাসকাকার কাছে আরেকটু ঘেঁষে বসলাম। সে বললে, উঁ! উঁ! গিয়ার চিপকিয়ো না।
বিরিঞ্চিদা বললে, আমরা ফেরারি, ঘরবাড়ি ছেড়ে চিরকালের মতো চলে যাচ্ছি। হল এবার? ভোর-ইস্তক খালি বলে– কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি। কেমন, এবার খুশি তো?
ঠানদিদি ব্যস্ত হয়ে বললেন, না, না চিরদিনের জন্য নয় মোটেই। ডিসেম্বর মাসে ওর পরীক্ষা-না? তা ছাড়া মশলার কৌটো তো ফেলে এসেছি। তারজন্যও এক বার ফেরা দরকার।
তারপর সবাই চুপচাপ।
কে জানে হুলিয়ারা কামড়ায় কি না।
পথটা ক্রমে নির্জন হয়ে এসেছে। দুপাশের বড়ো বড়ো বট গাছ পথের ওপর ঝুঁকে পড়ে, পাতায় পাতায় মিলিয়ে, মাথার ওপর যেন ছাদ তৈরি করছে।
বিষম নিরিবিলি। এত নিঝুম যে দিনের বেলাতেও ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। শুনতে শুনতে কেমনধারা ঘুম এসে যায়। মনে হয় ঝিঁঝিরা কত দূরে চলে যাচ্ছে। আবার কাছে আসছে।
শ্যামাদাসকাকা হঠাৎ পথের ধারে গাছতলা ঘেঁষে গাড়ি থামিয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলতে লাগল।
অমনি আমিও সিটের পেছনে চড়ে বসে ঠানদিদির দিকে মুখ করে রেগে বললাম, কেন বললে কান্নাকাটি করে সঙ্গ নিয়েছি? তোমরা নিজেরা আমাকে জোর করে ধরে আননি? কাটলেট খাওয়াবার লোভ দেখিয়ে, চুইংগাম দেবে বলে আমাকে নিয়ে আসনি? পাছে। সেজোদাদুকে সব বলে দিই সেই ভয়ে।
ওরা তার কোনো উত্তর না দিয়ে, নিশ্বাস বন্ধ করে একসঙ্গে বলল, কী সব বলে দেবে? তুমি তার কী জানো?
কী আর করি, পকেট থেকে টিনের ব্যাং বের করে কট কট করতে লাগলাম। তাই দেখে ওরাও আবার সব আরাম করে বসল। রুমাল দিয়ে ঘাম মুছবে বলে শ্যামাদাসকাকা পকেটে হাত পুরে দিল। দিয়েই কিন্তু একহাত লাফিয়ে উঠে চাপা গলায় বিরিঞ্চিদাকে বলল, বিরিঞ্চি, দেখ তো পকেটে যা মনে হল, সত্যি সত্যি তাই কি না।
বিরিঞ্চিদা পেছনের সিট থেকে ঝুঁকে পড়ে সোজা শ্যামাদাসকাকার পকেটে হাত চালিয়ে দিল। টেন বের করল এক ছড়া মুক্তোর মালা। ঠিক যেমনটি গোপলার বইতে পড়েছিলাম, গোল গোল জমানো চোখের জলের মতো এক ছড়া মুক্তোর মালা। তাতে সকাল বেলার রোদ পড়ে লাল নীল সবুজ রং ঠিকরোচ্ছে। শুনেছি এসবের জন্য রক্তগঙ্গা বয়।
ঠানদিদি বললেন, ইস্ শ্যামাদাস, তোর পেটেও এত ছিল!
বিরিঞ্চিদা বলল, তুই সব পারিস রে শ্যামাদাস। কিন্তু কখন করলি তাই ভাবছি।
আমি বললাম, শ্যামাদাসকাকা করবে জমিদারগিন্নির মালা চুরি! আরশুলো দেখলে ওর দাঁতকপাটি লেগে যায়, ও করবে চুরি! কী হয়েছে বলব? ওই লুঙ্গিপরা লোকটি নির্ঘাত মালাটা ওর পকেটে চালান করেছে। ধরা পড়বার ভয়ে।
ঠানদিদি শিউরে উঠে বললেন, ওরে শ্যামাদাস, রুমাল দিয়ে ওটাকে মুছে ফেল রে। ছুঁয়েছিস ওটাকে, মুক্তোগুলোতে তোর আঙুলের ছাপ পড়েছে।
বিরিঞ্চিদাও বলল, এবার কে তোকে বাঁচায় দেখব। তোর পেছনে গোয়েন্দা লাগবে দেখিস। আর গোয়েন্দার হাত এড়ালেও ওই লুঙ্গিপরাটা রয়েছে। দেখিস ওই মালা উদ্ধারের জন্য কত রক্তপাত
এই অবধি শুনেই শ্যামাদাসকাকা মালাটা পকেটে পুরে কোনো কথা না বলে গাড়িতে স্টার্ট দিল।
দেখলাম ওর চেহারাটা কেমন বদলে গেছে। চোখ ছোটো হয়ে গেছে। গায়ের রং, কানের শেপ অন্যরকম লাগছে। মালাটা বোধ হয় ওর ছাড়বার ইচ্ছে নেই।
হঠাৎ বিরিঞ্চিদা বলে উঠল, এই রে শ্যামাদাস! পেছনে একটা গাড়ি লেগেছে!
ব্যস্, আর বলাকওয়া নেই, সটান শ্যামাদাসকাকা বড়ো রাস্তা ছেড়ে বনবাদাড়ে নেমে পড়ল। গাছ-গাছড়ার মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। তারই ওপর দিয়ে শ্যামাদাসকাকা দিব্যি গাড়ি চালিয়ে চলল।
কেউ কোনো আপত্তি করল না। যাকগে যেখানে খুশি, খিদের চোটে আমার কিছু ভালোও লাগছিল না। তবু দু-এক বার বললাম, তোমরা আজ খাবে না?
কী জ্বালা! কেউ কোনো উত্তর দেয় না।
পেছন ফিরে বললাম, তবে আমি খাই?
খড়খড়ে গলায় ঠানদিদি বললেন, সারাক্ষণ শুধু খাই খাই। বলছি পেছনে হুলিয়া লেগেছে।
–হুঁলিয়া আবার কী?
বিরিঞ্চিদা বিরক্ত হয়ে বলল, ন্যাকা! হুলিয়া আবার কী! ধরলে পর টেরটা পাবি।
চারদিকে ঝোপঝাপ, উঁচু উঁচু গাছের শেকড়, মাঝে মাঝে একটুখানি খোলা জায়গা, বড়ো বড়ো কালো পাথর, খানিকটা মাটি ভেঙে গেছে, পাথর আর ছিবড়ের মতো গাছের শেকড় বেরিয়ে রয়েছে। এসব জায়গায় হুণ্ডার থাকে। তারা ছোটো পাঁঠা-টাঠা ধরে তো নিয়ে যায়ই, মানুষদেরও খায়-টায়। আমার দিককার দরজাটা আবার লগবগ করে, একটু একটু করে ঘষটে ঘষটে শ্যামাদাসকাকার দিকে এগুচ্ছি, সে আবার খেঁকিয়ে উঠল, বলছি গিয়ার চিপকিয়ো না। সরে বোসা।
বললাম, দরজাটা যদি খুলে যায়? এত আস্তে চালাচ্ছ কেন? কিছুতে যদি লাফিয়ে পড়ে?
শ্যামাদাসকাকা বিরক্ত হয়ে তখুনি গাড়ি থামিয়ে বলল, বেশ তো, আমার চালানো পছন্দ না হয়, তুমিই চালাও-না। কী সুন্দর রাস্তা দেখছনা। তুমি এদিকে এসো, আমি ওধারে যাই।
ততক্ষণে রাস্তাটা সরু হতে হতে একটা পায়ে-চলা পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাছগুলোও ভিড় করে এসেছে। সত্যি বলছি ঝিঁঝির ডাকে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিল। ঝিঁঝির ডাকে কীরকম মনখারাপ লাগে; খিদেও পাচ্ছিল। পকেট থেকে টিনের ব্যাংটা বের করে আবার কটকট করতে লাগলাম।
আরও খানিক দূরে যাওয়া গেল। শেষটা একটা বট গাছের তলায় শ্যামাদাসকাকা গাড়ি থামাল।
চারদিক থমথমে চুপচাপ। ঝিঁঝির ডাক, পাতার শিরশির আর দূরে কোথায় জল পড়ার শব্দ। এইসব জায়গাতেই বোধ হয় হুণ্ডাররা জল খেতে আসে। ছোটো নদীর ধারে, বালির ওপর দিয়ে হেঁচড়ে কিছু নিয়ে গেলে, তার দাগ দেখা যায়। কিন্তু তখন আর কিছু করবার উপায় থাকে না। খিদে।
তখন শ্যামাদাসকাকা নিজে থেকেই বললে, খিদেয় পেটের এদিক-ওদিক জুড়ে গেছে।
যাক, বাঁচা গেল।
বিরিঞ্চিদা আমাকে বলল, ওঠ-না। আমার পায়ের কাছ থেকে টিফিন ক্যারিয়ারটি নামিয়ে খোল দিকিনি। কুঁজোয় জল আছে, বের-টের কর, আমার এখনও হাত-পা কাঁপছে, পেটের ভিতর কেমন যেন করছে। নে, বের কর।
টিফিন ক্যারিয়ার খুলে দেখি লুচি, পটোলভাজা, আলুরদম, মাংসের বড়া, জিবেগজা। যদিও ডিমের ডেভিল, শোনপাপড়ি মোটেই নেই। দরজার খোপে পুরোনো খবরের কাগজ ছিল, তাতে করে যত্ন করে ওদের খাওয়ালাম। শ্যামাদাসকাকা কুড়িটা লুচি খেল; বিরিঞ্চিদারও দেখলাম ভয়ের চোটে খিদে বেড়েছে। খালি ঠানদিদি নাক সিটকে একটু দূরে বসে ফলমূল খেলেন।
কিন্তু আমি ছাড়া আর কেউ খুশি হল বলে মনে হল না। খাবার পর জল খেয়ে, পকেট থেকে একটি লোমওয়ালা ল্যাবেঞ্চস বের করে মুখে পুরে, যেই বলেছি, আঃ! কী আরাম!
অমনি ওরা সব রুখে উঠল, আরাম? আরামটা কোথায় পেলি তাই বল! এখন কী উপায় হবে শুনি? সামনে অঘোর জঙ্গল, পেছনে শব্দুর, এখনি বিকেল হয়ে এসেছে, রাত হতে কতক্ষণ? কী উপায় হবে এবার বল!
বললাম, শ্যামাদাসকাকা যদি জঙ্গলের মধ্যে ইচ্ছে করে না ঢুকত, তাহলে এতক্ষণে আমরা
এমনি সময় ঠানদিদি হঠাৎ চেঁচিয়ে-মেচিয়ে এক লাফে গাড়িতে উঠে পড়ে বললেন, ওরে বাবা রে! বাঘ!
আমিও গাড়িতে উঠে, দরজা বন্ধ করে দিয়ে, তাকিয়ে দেখি একটি মোষ প্যাটার্নের জন্তু। বিরিঞ্চিদা তাড়া দিতেই চলে গেল। সত্যি, মেয়েরা যে কী দারুণ ভীতু হয়।
একটু পরেই একটা ব্যাং দেখলাম, থপ থপ করে কতকগুলো কালো পাথরের ফোকরের মধ্যে ঢুকে গেল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে ফোকরের মধ্যে ব্যাঙের চোখ জ্বলজ্বল করছে দেখতে পাচ্ছিলাম। কিছু ভয় পাইনি। ঠানদিদিকে কিছু বলিনি পর্যন্ত। কী জানি যদি শেষটা ওঁর হাত পা এলিয়ে যায়। মেয়েদের কিছু বলা যায় না।
খানিকবাদে বিরিঞ্চিদা বলল, কই, দেখি তো মালাটা। ই-স্! লাখ টাকার জিনিস রে শ্যামাদাস। ধরা না পড়িস যদি, রাতারাতি রাজা হয়ে যাবি। তবে যদি ধরা পড়িস– আর সেটারই চান্স বেশি– তা হলে বাকি জীবনটা ঘানি টেনে কাটাবি।
আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি দেখেছি, চোখে নারকোল মালার তৈরি চশমা বেঁধে দেয়। নইলে মাথা ঘোরে।
অমনি শ্যামাদাসকাকা ঠাস করে আমার গালে একটা চড় কষিয়ে, মালাটাকে টেনে ঘাসের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল।
সবুজ ঘাসের ওপর মুক্তোগুলো জ্বলতে লাগল, যেন কে সারি সারি বাতি দিয়েছে।
বিরিঞ্চিদা গিয়ে কুড়িয়ে আনল
দেখলাম মাঝখানে আবার একটা মস্ত হিরে ঝোলানো। শ্যামাদাসকাকাকে হুলিয়ায় ধরলে ঠিক হত! কিন্তু তাহলে গাড়ি কে চালাত?