০২. হাত কাটা রবিন

০২. হাত কাটা রবিন

আমি বাসায় গিয়ে সবাইকে হাত কাটা রবিনের গল্প বললাম। ছেলেটিকে যে আমার পছন্দ হয়েছে তা গল্প করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম। সত্যমিথ্যা এক গাদা জিনিস বলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলাম। আম্মা বললেন, নিয়ে আসিস তো ছেলেটাকে একদিন।

বিকেল হওয়ার অনেক আগে আমি আমাদের ডিটেকটিভ ক্লাবে পৌঁছে গেলাম। গিয়ে দেখি সবাই আগে পৌঁছে গেছে, এমন কি রবিনও। হীরা, নান্টু, মিশু, সলিল সবাই মিলে একটা মাঝারি সাইজের ফুটবল পাম্প করছে। বলটা রবিনের। রবিন কাটা হাতটা দিয়ে এমন চমৎকারভাবে পাম্পারটা ঠেসে ধরে পাম্প করে যাচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল হাত কাটা থাকলেই বুঝি এসব কাজ করতে সুবিধা।

দারুণ একটা ফুটবল টিম খুলব। বলের লেসিং লাগাতে লাগাতে রবিন বলল, পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে ভাল।

আমরা রোমাঞ্চিত হলাম। সলিল বলল, ঠাকুরপাড়ার টিমটা খুব শক্ত। গতবার চার গোল খেয়েছি, তার আগেরবার ছয় গোল।

রবিন তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোরা দিনরাত মেয়েদের মত বুড়ী-চি খেলিস, ফুটবল খেলায় তো গোল খাবিই।

ইহ। বুড়ী-চি খেলি কে বলল তোকে? মারব থাবড়া– হীরা বাতাসের মাঝে ঘুষি মারল।

ঐ হল। ফুটবল কেটে কেটে ভাগ করে নিস, ফুটবল খেলিস না! তার মানেই বুড়ী-চি খেলিস!

আবার? আবার? হীরা দাঁত কিড়মিড় করে।

ফুটবলটি মাটিতে তিন চারবার ড্রপ দিয়ে রবিন বলল, চল খেলি গিয়ে।

আমরা হৈ হৈ করে বেরিয়ে এলাম। মাঠের ধারে গোল হয়ে বসে টিম ভাগ করতে লাগলাম। আমাদের মাঝে সলিল আর মিশু দারুণ খেলতে পারে। হীরাটার পায়ে জোর বেশি, ল্যাং মেরে টেনে হিঁচড়ে বল নিয়ে যায়, আসলে বেশি ভাল খেলতে পারে না। রবিন কি রকম খেলে কে জানে, তবে ওর যে রকম উৎসাহ, নিশ্চয়ই ভাল খেলে।

.

আমাদের সর্দার হবার মারামারিটা তার আগে হয়ে যাক। রবিন বলের উপর এক পা তুলে কাটা হাতটা নাচাতে নাচাতে বলল। অনেকক্ষণ ধরেই অস্বস্তির সঙ্গে আমার একথাটা মনে হচ্ছিল। হীরা গোঁ গোঁ করে বলল, ঠিক আছে। তারপর হাতা গুটিয়ে ফেলল। আমরা গোল করে জায়গা করে দিলাম।

রবিন শার্ট খুলে গেঞ্জি বের করে নিল। তারপর হীরার দিকে এগিয়ে এল। বলল আয়।

হীরা তার জায়গায় দাঁড়িয়ে বলল, তুই আয়।

আমি দেখেছি যেসব মারামারি হঠাৎ করে কোন কারণে শুরু হয়ে যায় সেগুলি চমৎকার চলতে থাকে। কিন্তু সামনাসামনি দাঁড়িয়ে খুব ধীরে ধীরে মারামারি শুরু করা দারুণ শক্ত। হীরা আর রবিন খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে একজন আরেকজনের বুকে থাবা দিয়ে ফোঁসফোঁস করছিল। রবিন মাঝে মাঝে ঠেলে হীরাকে সরিয়ে দিচ্ছিল, হীরাও ঠেলে রবিনকে সরিয়ে দিচ্ছিল।

লেগে দেখ না! ছাতু বানিয়ে ফেলব। হীরা গরম হয়ে রবিনকে একটা মাপসই ধাক্কা দেয়।

ইহ! রবিন ঝটকা মেরে হীরার হাত সরিয়ে দেয়। বলে, কি করবি তুই? কাঁচকলা! তারপর কাটা হাতটা দিয়ে থুতনিতে টোকা মারে।

আরেকবার মার তো!

রবিন আরেকবার মারল, একই জায়গায় ঠিক একই ভাবে।

আরেকবার মেরে দ্যাখ তো। হীরার চোখ মুখ লাল হয়ে ওঠে। রবিন আবার ঠিক একই জায়গায় একই ভাবে মারল। সাথে সাথে হীরা রবিনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

আমি বুঝতে পারলাম রবিনের গায়ে দারুণ জোর। হাতটা কাটা থাকার পরও সে হীরাকে এমন বেকায়দাভাবে ল্যাং মেরে ফেলে দিল যে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। দুজন দুজনকে খামচে, ঝাপটে, ঘষটে ঘষটে ঘাসের উপর গড়াগড়ি দিতে লাগল। কখনও হীরা রবিনকে কাবু করে ফেলছিল কখনও রবিন হীরাকে। অনেকক্ষণ ধরে ওদের জাপটাজাপটি চলল, শেষ পর্যন্ত আমরাই বিরক্ত হয়ে ওদের ছাড়িয়ে দিলাম। দুজনকে ছাড়িয়ে দেবার পর ওরা দুজনেই দাবি করতে লাগল যে সে জিতেছে। হীরার সাথে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আমার সাথে মারামারি শুরু হতে পারে না তাই ওটা আগামীকাল পর্যন্ত স্থগিত থাকল। এখন ফুটবল খেলব।

কিন্তু ফুটবল কোথায়? খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে দেখি আমাদের ছোট ভাইয়ের দলটা ওটাকে দমাদম পিটিয়ে বাসার উঠনে খেলছে। রঞ্জুর কান মলে দিয়ে আমি বলটা নিয়ে এলাম। রঞ্জু, আমার ছোট ভাই, ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল। আজ বাসায় এ নিয়ে ভোগান্তি হবে!

আমি বল নিয়ে এলাম, দল ভাগ করা হল, এক দিকে সলিল ক্যাপ্টেন আরেক দিকে রবিন। রবিন বলল ওকে ক্যাপ্টেন না বানালে সে খেলবে না, বল নিয়ে চলে যাবে। এমন বিচ্ছু ছেলে আমি আর দেখিনি।

ওকেই ক্যাপ্টেন করা হল। বলের মালিককে সব সময় একটু সুবিধা দিতে হয়। আর মালিক যদি রবিনের মত নচ্ছাড় বান্দা হয় তাহলে তো বটেই।

খেলা শুরু হল। সবাই দমাদম কিক মেরে বলটাকে এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত ছোটাতে লাগল। সলিল আর হীরা মিলে আমাদের দুটো গোল দিয়ে দিল। আমি গোলকীপার। রবিন এসে আমাকে বলল, আরেকবার গোল হলে চোখ কানা করে দেব।

আমিও তেরিয়া হয়ে বললাম, যদি গোল শোধ করতে না পারিস বাকি হাতটাও কেটে নেব। রবিন আমার দিকে চোখ পাকিয়ে বলের পিছে পিছে ছুটল। নান্টুকে বলে কয়ে গোলকীপার তৈরি করে আমি মাঠের মাঝে চলে এলাম। দমাদম কিক মেরে বল কেটে বের করে নিয়ে এসে গোল পোস্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, রবিনও জায়গামত আছে এমন সময় হীরা পিছন থেকে এসে আমাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিল! বল নিয়ে ছুটে গিয়ে আমাদের আরেকটা গোল দিয়ে দিল। নান্টু গোলকীপার হিসেবে একেবারে যাচ্ছেতাই!

ঘেমে টেমে আমরা অস্থির। একেকজন লাল হয়ে হাঁপাচ্ছি। তিনটি গোল খেয়ে রবিনের চেহারা হয়েছে ভয়ঙ্কর। হীরাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে সলিলকে পাশ কাটিয়ে সে দারুণ ভাবে খেলতে লাগল। গোল পোস্টের কাছে এসে বলটাকে সামলানোর জন্যে তার কাটা হাতটা দিয়ে হঠাৎ করে বলটাকে থামিয়ে নিল, তারপর এক কিকে গোল।

ততক্ষণে সলিল, হীরা ওরা তুমুল হৈ চৈ শুরু করে দিয়েছে। হ্যাণ্ডবল হ্যাণ্ডবল করে চেঁচিয়ে দাপাদাপি শুরু করেছে।

রবিন মুখচোখ লাল করে বলল, হ্যাণ্ড নেই আবার হ্যাণ্ডবল কিসের?

যতটুকু আছে ততটুকুই হ্যাণ্ড।

ইশ! রবিন মুখ খিঁচিয়ে বলে, কনুই পর্যন্ত আছে, ওটাকে আর্ম বলে। ওখানে লাগলে হ্যাণ্ডবল হয় না।

আমি তারস্বরে চেঁচিয়ে রবিনকে সমর্থন করে যেতে লাগলাম। ভাব দেখে মনে হল বিকেলের অর্ধ সমাপ্ত মারামারিটা এবারে ব্যাপক ভাবে শুরু হয়ে যাবে। নান্টু তখন শফিক ভাইয়ের কাছে যাওয়ার বুদ্ধি দিল। কথাটা ঠিক, আমাদের এতক্ষণ মনে হয়নি। আমরা খেলা বন্ধ করে দল বেধে শফিক ভাইয়ের কাছে চললাম। হীরা আর রবিন তখনও ঝগড়া করে যাচ্ছে।

আমাদের সবার, বাসা পাশাপাশি। বাসার সামনে তখন মেয়েরা লুকোচুরি খেলছিল। আমাদের দলটাকে আসতে দেখে ওরা দাঁড়িয়ে গেল। একটু পরে বুঝতে পারলাম ওরা রবিনকে লক্ষ্য করছে। হাতটা কি চমৎকার ভাবে কাটা! আমার হিংসে হতে লাগল।

শফিক ভাই বাগানে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলেন। তার লুকিয়ে সিগারেট খাওয়ার একটা আলাদা জায়গা আছে। আমাদের দেখে বললেন, ব্ল্যাক মার্ডারের খবর কি?

আমাদের এত তীক্ষ্ণ গোপনীয়তার পরেও কিভাবে যে দলের নাম ফাঁস হয়ে গেছে বুঝতে পারলাম না। শফিক ভাইয়ের কথা না শোনার ভান করে আমরা আমাদের সমস্যাটা খুলে বললাম। তিনি রবিনকে খানিকক্ষণ লক্ষ্য করলেন। তারপর বললেন, ঠিক করে বল তো বলটা হঠাৎ এসে লেগেছে না ইচ্ছে করে লাগিয়েছ?

রবিন গাঁই ছুঁই করে পিছে সরে এল। এমন গাধা ছেলে, যখন একটু মিছে কথা বললেই ঝামেলা মিটে যায়, তখন মিছে বললেই হয়। হীরা উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠে বলল, ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে লাগিয়েছে।

তাতে কি হয়েছে? রবিন ফোঁস করে উঠল। আমার হাত তো কাটা, বল লাগলে হ্যাণ্ডবল হবে কেন?

কিন্তু তাই বলে তুমি ইচ্ছে করে বল হাত দিয়ে থামাবে? তোমার কাটা হাতের সুযোগ নেয়াটা তো অন্যায়।

শেষ পর্যন্ত দেখা গেল দোষ রবিনের। রবিন ফোঁসফোঁস করে দোষ মেনে নিল। আমরা বল নিয়ে ফিরে যেতে লাগলাম। দেখি মেয়েরা তখনো খেলা বাদ দিয়ে আবার ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। সত্যি এমন হাত কাটা ছেলে কয়টা পাওয়া যায়? রবিনের জন্যে তখন আমাদের গর্ব হতে লাগল।

এই ছেলেরা! শুনে যাও– হঠাৎ ডাক শুনে তাকিয়ে দেখি শিরি আপা। আমরা ছুটতে ছুটতে শিরি আপার কাছে হাজির হলাম। রবিন নতুন এসেছে জানে না শিরি আপা ডাক দেয়া মানেই চিনেবাদাম না হয় লজেন্স খাওয়ানোর জন্যে ডাক। তাই সে এল সবার পিছে পিছে হাঁটতে হাঁটতে। কিন্তু দেখা গেল শিরি আপার কৌতূহল রবিনকে নিয়েই।

তোমরা নতুন এসেছে বুঝি?

জ্বী।

নাম কি তোমার?

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম।

আমরা জানিয়ে দিলাম ওর আসল নাম হাকার-বিন ওরফে হাত কাটা রবিন।

কয় ভাইবোন তোমরা?

তিন।

কোন ক্লাসে পড়?

সেভেনে।

দেখা গেল রবিন আমাদের সাথেই ওরকম কাঠ গোঁয়ার, শিরি আপার সামনে দিব্যি ভদ্র ছেলেটি। একটু পরেই শিরি আপা জিজ্ঞেস করলেন, তোমার হাতে কি হয়েছিল?

রবিনকে একটু অসহিষ্ণু দেখা গেল। বলল, কেটে ফেলেছে।

কি ভাবে?

রবিন ঘটনাটা বর্ণনা করল অনেক কম কথায়। কাটা আঙুল দুটি যে টিকটিকির ল্যাজের মত লাফাচ্ছিল ঐ কথাটা পর্যন্ত বাদ দিয়ে গেল।

শিরি আপা শুনে জিহ্বা দিয়ে চুকচুক শব্দ করলেন। রবিন উসখুস করে উঠে আমাদের বলল, চল যাই।

আমরা শিরি আপার লজেন্সের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। দেখা গেল শিরি আপার সে রকম কোন পরিকল্পনা নেই। কেমন করে জানি রবিনের দিকে তাকিয়ে আছেন।

আমরা হৈ হৈ করে বেরিয়ে এলাম। তিন পা যেতে না যেতেই সলিলের আম্মা ডাকলেন, সলিল! তোরা শুনে যা —

আবার রবিনকে জিজ্ঞেস করা হল, তোমার নাম কি? কোন ক্লাসে পড় এই সব। তারপর তোমার হাত কি করে কাটল?

রবিন আবার গড়গড় করে বলে গেল। আহ উহ করার সময় আমরা বেরিয়ে এলাম। কিছুদূর না যেতেই আবার ডাক, এবার নান্টুর বড় ভাই!

.

আমরা নান্টুর ভাইয়ের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে এক ছুটে একেবারে মাঠে হাজির হলাম। এত তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসেছি যেন আর কেউ ডাকতে না পারে। রবিন হাঁপাতে হাঁপাতে মুখ খিঁচিয়ে বলল, আমি মোটমাট তিন লক্ষ বার বলেছি হাত কিভাবে কেটেছে! কারো সাথে দেখা হতেই … রবিন কাকে কি যেন একটা গালি দিল।

.

আবার খেলা শুরু হল। দমাদম কিক মারতে লাগলাম, দুদ্দাড় আছড়ে পড়তে লাগলাম, আর বল নিয়ে ছুটোছুটি করতে লাগলাম। রবিন দারুণ খেলে গেল। ওরা আর একটা গোলও দিতে পারল না-– উল্টো আমরা একটা গোল শোধ করে দিলাম।

খেলা শেষ হলে আমরা হাঁপাতে হাঁপাতে বলকে ঘিরে বসে রইলাম। গেঞ্জি খুলে বাতাস করতে করতে সলিল প্রস্তাব দিল, চল গোসল করে আসি।

রবিন জিজ্ঞেস করল, কোত্থেকে?

নদীতে। আমি রবিনকে বুঝিয়ে দিলাম, একটু দূরেই নদী, ঝকঝক করছে পানি। সাঁতার জানিস?

জানতাম।

ভুলে গেছিস? বলে আমরা খিলখিল করে হাসতে লাগলাম সাঁতার কেউ কখনও ভোলে?

দাঁত কিড়মিড় করে রবিন বলল, ভুলিনি, হাত কেটে ফেলার পর আর সাঁতরাইনি। কাটা হাত নিয়ে সাঁতরানো যায়?

আমরা অপ্রস্তুত হলাম! একথাটা আগে চিন্তা করিনি। এই প্রথম দেখা গেল হাত কাটা থাকার কিছু কিছু অসুবিধেও আছে।

বিকেলে গোসল করা ঘোরতর বেআইনী। তাই তোয়ালে সাবান এসব না নিয়ে যে যেভাবে আছি সে ভাবেই আমরা নদী তীরে রওনা দিলাম। ভোঁ ভোঁ করে আমাদের গাড়ি ছুটল, একজনের থেকে আরেকজনের গাড়ির জোর বেশি। হর্নের শব্দে কান পাতা দায়!

ঠাকুরপাড়া শুরু হতেই আমরা ভদ্র হয়ে গেলাম। এদের ফুটবল টিমটা দারুণ। ছেলে গুলোও ভীষণ মারপিট করনেওয়ালা। হীরা দুবার ওদের কাছে মার খেয়েছে।

দেখা গেল ভীষণ চেঁচিয়ে হৈ হল্লা করে ঠাকুরপাড়ার ছেলেরা কিংকুইন খেলছে। আমাদের দেখে দুই হাই করে কয়েকটা চিৎকার দিল। তারপর একজন টেনিস বলটা হাতে নিয়ে সাঁ করে সলিলের ঘাড়ে মেরে বসল।

আমরা তবু চলে এলাম। ভিন্ন পাড়া দিয়ে যেতে হলে একটু অত্যাচার সহ্য করতেই হয়। রবিন সলিলকে বলে, তুই কিছু বললি না? তোকে এভাবে মারল?

আসুক না আমাদের পাড়ায়! সলিল চোখ পাকিয়ে বলল, পুরো ফুটবলটা ওর পিঠে ফাটাব।

.

নদীর তীরে অনেক দূর বালুর চড়া। কিছু কিছু লোকেরা ছেলেমেয়ে নিয়ে বেড়াতে এসেছে, রঙিন কাপড় পরনে হাসিখুশি চেহারার লোক। কয়েকটা নৌকা ছাড়া ছাড়া ভাবে এদিকে সেদিকে বাঁধা আছে। মাঝিরা ভাত চড়িয়ে গলুইয়ে চুপচাপ বসে আছে। আমরা হৈ হৈ করতে করতে ছুটতে ছুটতে কাপড় খুলতে খুলতে নদীর তীরে পৌঁছালাম তারপর ঝপাং করে নদীতে লাফিয়ে পড়লাম। দুটো ডুবে নদীর মাঝামাঝি এসে দেখি রবিন মুখ শক্ত করে তীরে দাঁড়িয়ে আছে। নদীতে নামছে না। আমি চেঁচিয়ে বললাম, নেমে পড়। কিচ্ছু হবে না।

রবিন অন্যমনস্কভাবে মাথা নেড়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমার কেন জানি হঠাৎ করে ওর জন্যে ভীষণ মায়া হল। সাঁতরে তীরে এসে ওকে ডাকলাম, রবিন, এখানে নেমে আয় দ্যাখ, মাত্র বুক পানি। তুই নাম কিচ্ছু হবে না। আমরা পাহারা দিচ্ছি।

রবিন ওস্তাদ সাঁতারুর মত পানিতে নেমে এল। বোঝা গেল হাত কাটার আগে ও পানির পোকা ছিল। আমরা সবাই ওকে ঘিরে দাঁড়ালাম, আর সে সাঁতরাতে চেষ্টা করল। দেখা গেল সে এখনও সাঁতরাতে পারে ঠিকই কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি দম ফুরিয়ে যায়।

ঠিক হয়ে যাবে। রবিন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কয়েকদিন প্র্যাকটিস করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

.

বাসায় ফেরার সময় আমাদের সবার বুক দুরুদুরু করতে থাকে। ভিজে কাপড়ে বাসায় যাওয়া মানে আম্মার চড় কানমলা আর বকুনি। কাপড় যে খানিকক্ষণ ঘুরে শুকিয়ে নেব, তারও উপায় নেই – অন্ধকার হয়ে আসছে। রাস্তার বাতি এর মাঝে জ্বলে গেছে। রবিনের কিন্তু ওসব কোন দিকে খেয়াল নেই, ও শুধু খবর নিতে লাগল। আশেপাশে কোন্ ফুটবল টিম কতটুকু শক্ত, আমরা যদি ফুটবল ক্লাব খুলি তাহলে সবার সাথে জিততে পারব কি না। একটা ট্রফির দাম কত, ট্রফির খেলা দিলে খেলা কেমন জমবে, এই সব!

তখন দ্রুত সন্ধ্যা হয়ে আসছে আমরা শুকনো মুখে বাসায় ফিরে যেতে লাগলাম। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ঘরে ঘরে আলো জ্বলে গেছে। অর্থাৎ আজ শুধু বেআইনী গোসল করার অপরাধ নয় তার সাথে দেরি করে ফেরার মাশুলও দিতে হবে। আজ আর রক্ষে নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *