০২. হাজী একরামুল্লাহ অবাক

হাজী একরামুল্লাহ অবাক হয়ে বললেন, তোমার ঘটনা কী?

আলাউদ্দিন চুপ করে রইলেন। একরামুল্লাহ সাহেব তাকে দেখে এত বিস্মিত হচ্ছেন কেন তা বুঝতে পারলেন না। এক সপ্তাহ পরে এসেছেন— এই জন্যেই কি? তিনি মুক্তি প্রকাশনীর পোষা লেখক। তাই বলে প্রতিদিন আসতে হবে এমন তো কথা নেই।

হাজী সাহেব গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন, তুমি আগে প্রতিদিনই একবার বাংলাবাজার আসতে, এবারে ছয় দিন পরে আসলে। তাও আমি লোক পাঠিয়ে খবর দিয়েছিলাম বলে আসা। ঘটনা কী?

কোনো ঘটনা না।

অসুখ বিসুখ হয় নি তো?

আলাউদ্দিন না-সূচক মাথা নাড়লেন।

অসুখ বিসুখ যে হয় নি সেটা তো তোমাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। বরং ওজন বেড়েছে। তোমার শরীরে থলথলে ভাব চলে এসেছে। পাঞ্জাবির ভেতর দিয়ে ভুড়ি দেখা যাচ্ছে। ব্যাপার কী?

কোনো ব্যাপার না।

বিয়ে শাদি করেছ নাকি?

জ্বি না। এই বয়সে বিয়ে শাদি!

পুরুষ মানুষ যে-কোনো বয়সে বিয়ে করতে পারে। গোপনে বিয়ে করে থাকলে স্বীকার করতে অসুবিধা নাই।

বিয়ে করি নি।

চেহারা ফরসা হয়েছে। ইস্ত্রি কন্যা পায়জামা পাঞ্জাবি পরেছ। তোমাকে ইস্ত্রি করা কাপড়ে কোনোদিন দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

একটা কাজের লোক আছে। সেই কাপড় ধুয়ে দেয়। লন্দ্রি থেকে ইস্ত্রি করিয়ে আনে। রান্নাবান্না করে। ভালো রান্না। কুয়েতে বাবুর্চির কাজ করেছে।

বলো কী! একেবারে বিদেশী বাবুর্চি? ভালো হয়েছে। চিরকুমার লোকদের যে জিনিসটা প্রথম দরকার সেটা হলো একজন ভালো বাবুর্চি। খাওয়া দাওয়ার কষ্টটাই চিরকুমার লোকদের আসল কষ্ট। ভাত আর ডিম ভাজি কতদিন খাওয়া যায়।

ঠিক বলেছেন।

তোমাকে দুটা কাজের জন্যে ডেকেছি। দুইটাই জরুরি। একটা আমার জন্য জরুরি, আরেকটা তোমার সন্য জরুরি।

জ্বি বলুন।

হাত দেখার বই-এর অবস্থা কী? একটা বই শেষ করতে তো এতদিন লাগার কথা না।

আলাউদ্দিন ইতস্তত করে বললেন, আগে দিনে লিখতাম। রাতে ও লিখতাম। এখন রাতে লিখতে পারি না।

হাজী সাহেব বললেন, রাতে লিখতে পার না কেন? রাতকানা রোগ হয়েছে। রাতে চোখে দেখ না?

খাওয়া দাওয়ার পর আলসেমি লাগে।

কর কী? আটটা বাজতেই ঘুমিয়ে পড়?

ঘুমাতে ঘুমাতে এগারোটা বেজে যায়। খবরের কাগজ পড়ি, টিভি দেখি।

টিভি কিনেছ না-কি?

জি। একটা চৌদ্দ ইঞ্চি টিভি কিনে ফেলেছি। কালার।

লার টিভি?

ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট কেনার ইচ্ছা ছিল। কুটু বলল, কিনবেন যখন কালার কিনেন। দেখলাম কুটুর কথার মধ্যে বিবেচনা আছে।

কুট কে?

কুটু আমার বাবুর্চি।

হাজী সাহেব অবাক হয়ে বললেন, তোমার বাবুর্চি এখন বলে দিচ্ছে কী কিনবে কী কিনবে না?

আলাউদ্দিন মাথা নিচু করে বললেন, ওর বিবেচনা খারাপ না।

বেশি বিবেচনা হওয়াটা আবার ভালো না। শেষে দেখা যাবে তোমার বইপত্র সে লিখে দিচ্ছে। যাই হোক, সাত দিন সময়। এর মধ্যে বই শেষ করবে। আজ বুধার, আরেক বুধবারে পাণ্ডুলিপি নিয়ে চলে আসবে।

জি আচ্ছা, এখন উঠি।

হাজী সাহেব বললেন, তুমি এসেই যাই যাই করছ কেন? লক্ষ করেছি এর মধ্যে তিন চারবার ঘড়ি দেখেছ। চুপচাপ বস, দুপুরের খাওয়া দাওয়া করে তারপর যাবে। মোরগপোলাও আনতে বলেছি। মোরগপোলাও খেয়ে তারপর যাবে। অসুবিধা আছে?

জ্বি না।

উসখুস করছ কেন? বারবার পকেটে হাত দিচ্ছ, পকেটে কী? পিস্তল নাকি? চাঁদাবাজরা পিস্তল নিয়ে যখন আসে বারবার পকেটে হাত দেয়। কী আছে পকেটে?

কিছু না।

কিছু একটা তো পকেটে নিশ্চয়ই আছে। বের কর দেখি জিনিসটা কী?

আলাউদ্দিন পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট এবং ম্যাচ বের করলেন। তাকে খুবই ব্ৰিত মনে হলো। হাজী সাহেব বললেন, তুমি সিগারেট খাও তা তো জানতাম না। আগেও খেতে, না সম্প্রতি ধরেছ?

এখন একটা দুটা খাই।

খাও ভালো কথা। এত লজ্জা পাচ্ছ কেন? ধরাও একটা সিগারেট। উসখুস করার কারণ এখন স্পষ্ট হলো। নেশাখোররা সময়মতো নেশা করতে না পারলে উসখুস করে। ধরাও একটা সিগারেট।

থাক।

থাকবে কেন, খাও। নেশার জিনিস সময়মতো না খেলে মেজাজ খারাপ হয়। আমি চাই না আমার সামনে মেজাজ খারাপ করে কেউ বসে থাকবে। দেখি আমাকে একটা সিগারেট দাও। তোমার সামনে ধরিয়ে তোমার লজ্জা ভেঙে দেই। আমি যে সিগারেট একেবারে খাই না তা না। তোমার ভাবির সঙ্গে ঝগড়া হলে। খাই।

হাজী সাহেব সিগারেট ধরালেন আলাউদ্দিনও ধরালেন, তবে তিনি খানিকটা সংকুচিত হয়ে রইলেন। কারণ তিনি একজন হাজী এবং ধর্মপ্রাণ মানুষের সঙ্গে মিথ্যা কথা বলেছেন— এই জন্যেই সংকোচ। তিনি বলেছেন একটা দুটা খাই। ঘটনা সে-রকম না। গত কয়েকদিন হলো প্রচুর সিগারেট খাচ্ছেন। বিশেষ করে রাতে খাওয়ার পর মুখে একটা পানি দিয়ে যখন টিভির সামনে বসেন তখন সিগারেট খেতে বড় ভালো লাগে। টিভি দেখার ব্যবস্থাটাও কুটু মিয়া খুব আরামদায়ক করেছে। টিভিটা বসিয়েছে লেখালেখির টেবিলে। তিনি এখন খাটে আধশোয়া অবস্থায় থেকে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেন। টিভিতে বিশেষ কিছু যে দেখেন তা না। সিগারেট ধরিয়ে একটা চ্যানেল দেখতে থাকেন। সিগারেট শেষ হওয়া মাত্র অন্য একটা ধরিয়ে চ্যানেল বদলে দেন। ক্যাবল লাইন নেয়াতে এই সুবিধাটা হয়েছে। অনেকগুলি চ্যানেল।

আলাউদ্দিন?

জ্বি।

এখন আরেকটা জরুরি বিষয় নিয়ে তোমার সঙ্গে আলোচনা আছে। মন দিয়ে শুনতে হবে।

জ্বি আচ্ছা।

তোমাকে আমি স্নেহ করি। এই ব্যাপারটা আশা করি তুমি জানো।

জ্বি জানি।

তুমি নির্বিরোধী মানুষ। অহঙ্কার নাই। ভদ্র, বিনয়ী। কখনো মিথ্যা বলো না। এই জন্যেই পছন্দ। আমি যে তোমার মঙ্গল চাই এ বিষয়ে কি তোমার কোনো সন্দেহ আছে?

জ্বি না।

হামিদা নামের আমার দূর সম্পর্কের একজন আত্মীয়া আছে। দুঃখি মেয়ে। প্রায় কুড়ি বছর আগে তার স্বামী মারা যায়। মেয়েটা পড়ে যায় অকুল সমুদ্রে। মেয়েটা রূপবতী। তাকে বিয়ে করানোর জন্যে আমরা চেষ্টা করেছি। সে রাজি হয় না। তার প্রতিজ্ঞা জীবনে বিবাহ করবে না। সে একটা চাকরি নিল। দুই মেয়েকে মানুষ করতে লাগল। যাকে বলে জীবন সংগ্রাম।

আলাউদ্দিনের সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। তাঁর আরেকটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা করছে। হাজী সাহেব কী মনে করবে এই ভেবে ধরাতে পারছেন না।

আলাউদ্দিন?

জ্বি।

এরকম উসখুস করছ কেন? যা বলছি মন দিয়ে শোন।

মন দিয়ে শুনছি হাজী সাহেব।

হামিদার মেয়ে দুটাই মায়ের মতো সুন্দরী হওয়ায় দুজনেরই খুব ভালো বিয়ে হয়েছে। দুটা মেয়েই এখন আছে বিদেশে। একজন থাকে স্বামীর সঙ্গে সিংগাপুর, আরেকজন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে।

আলাউদ্দিন বলেন, খুব ভালো।

হাজী সাহেব বললেন, যতটা ভালো মনে হচ্ছে তত ভালো না। হামিদা। পড়েছে মহাবিপদে। একা বাস করতে হয়, নিঃসঙ্গ জীবন। আজেবাজে দুষ্ট লোক তাকে নানানভাবে তাক্ত করে। বিয়ে করলে এই সমস্যা থেকে সে বাচবে। তাকে অনেক বুঝানোর পর এখন সে বিয়ে করার ব্যাপারে নিমরাজি হয়েছে। মেয়ে দুটি চাচ্ছে মা বিয়ে করে সুখী হোক। বাংলাদেশী মেয়ের বিধবা মায়ের বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী হয় না। এরা যে হয়েছে সেটা আল্লাহর রহমত বলতে হবে।

আলাউদ্দিন আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললেন। হাজী সাহেব কিছু বললেন। বরং মুখ হাসি হাসি করে আলাউদ্দিনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে এলেন। নিচু গলায় বললেন— হামিদা বানুকে তুমি বিয়ে কর না কেন?

আলাউদিদন থতমত খেয়ে বললেন, আমি?

হ্যাঁ, তুমি। আমার ধারণা হামিদার পাত্র হিসেবে তুমি খুবই উপযুক্ত। মেয়েটা ভালো। তরুণী বয়সে সে অপূর্ব রূপবতী ছিল। সেই রূপের খানিকটা এখনো আছে। তাকে দেখে মনেই হয় না তার বয়স পঁয়তাল্লিশ। তুমি তার ছবি দেখেছ। সুন্দরী কি তুমিই বলো।

আমি ছবি কখন দেখলাম?

তোমার রান্নার বইয়ের ফ্ল্যাপে অধ্যাপিকা হামিদা বানুর ছবি আছে। এই হলো সেই হামিদা বানু।

উনি অধ্যাপিকা?

আরে না। বই চালাবার জন্যে লেখা। বিএ পড়ার সময় বিয়ে হয়ে গেল বলে আর পড়াশোনা হয় নি। এখন এজি অফিসে কাজ করে। জুনিয়ার অডিটর। মাসে সব মিলিয়ে ঝিলিয়ে ছয় সাত হাজার টাকার মতো বেতন পায়। তোমাদের দুজনের সংসার এই টাকায় চলে যাবার কথা। তোমার এই বিষয়ে মত কী?

আলাউদ্দিন ব্ৰিত গলায় বললেন, বিয়ের কথা কখনো ভাবি নি।

হাজী সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, কখনো ভাব নি বলে যে কোনোদিন ভাববে না তা তো না; এখন ভাব।

এখন ভাবব?

তুমি এমন ভাব করছ যেন এই মুহূর্তেই তোমাকে বিয়ে করতে হবে। তুমি হ্যাঁ বলাবে আর আমি কাজী ডেকে নিয়ে আসব। চিন্তা-ভাবনা কর। সময় নাও। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আলাপ করতে চাইলে আলাপ কর।

জি আচ্ছা।

তোমার বয়স কত?

এই নভেম্বরে ৫৩ হবে।

অনেক বয়স। বিয়ে করার বয়স না, কবরে চলে যাওয়ার বয়স। যাই হোক চিন্তা করে বলো।

জ্বি আচ্ছা।

মেয়েকে যদি দেখতে চাও, কথাবার্তা বলতে চাও, সেই ব্যবস্থাও করা যায়। একদিন বিকেলে বাসায় গিয়ে চা খেয়ে এলাম।

জি আচ্ছা।

কবে যাবে বলো?

আপনি যেদিন ঠিক করবেন সেদিনই যাব। আপনার বিবেচনা।

আমার বিবেচনা যদি হয় তাহলে আজই চল।

আলাউদ্দিন হতাশ গলায় বলল, আজ যাব?

হাজী সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, কথা শুনে চিমশা মেরে গেলে কেন? আজ যাওয়াই তো ভালো। কোনো কিছু ঝুলিয়ে রেখে লাভ নাই। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে, বিকালে কোনো খবর না দিয়ে চলে গেলাম। হামিদাকে বললাম, হামিদা আমার এক লেখককে নিয়ে এসেছি। ভালো করে চা খাওয়া। অসুবিধা আছে?

জি না।

অসুবিধা থাকলে বলো। তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমি জোর করে তোময় বিয়ে দিচ্ছি। এখানে জোর করার কিছু নাই। হায়াত, মউত, রিজিক, ধনদৌলত এবং বিবাহ— এই পাঁচটা জিনি আল্লাহপাক নিজে দেখেন। আল্লাহপাক চাইলে বিবাহ হবে না।

জি, তা তো ঠিকই।

আলাউদ্দিন আরেকটা সিগারেট ধরালেন। তবে তাঁর মন খুবই খারাপ হয়ে গেল। বিবাহ সংক্রান্ত কথাবার্তায় যে মন খারাপ হয়েছে তা না। মন খারাপের প্রধান কারণ আজ দুপুরে মোরাগপোলাও খেতে হবে। হাজী সাহেব যে দোকান থেকে মোরগপোলাও আনান সেই দোকানের মোরণপোলাও অত্যন্ত ভালো। কিন্তু যত ভালোই হোক কুটু মিয়ার রান্নার পাশে কিছুই না। আজ দুপুরে কুটু মিয়া বিশেষ আয়োজন করেছে। ইলিশ মাছের ডিম রাধছে। ইলিশ মাছের ডিমের ঝোল, ইলিশ মাছের ডিমের ভাজা। এই দুই জিনিস আগেও একদিন খেয়েছেন। মনে হয়েছে বেহেশতি কোনো খানা। আজ সেই দুই আইটেম আবার রাঁধতে বলে এসেছেন। কুটু এই দুটা তো রাধবেই, তার সঙ্গে বাড়তি এমন কোনো আইটেম করবে যে সম্পর্কে তিনি কোনো চিন্তাই করেন নি। কবে যেন পাতার একটা বাড়া খেয়েছেন— আহা কী জিনিস! বেসনে ভুবিয়ে গরম গরম ভেজে পাতে দিয়েছে। খাওয়ার সময় মনে হয়েছে বিশাল কোনো বটগাছের সব পাতা যদি এরকম বেসনে ভেজে দিয়ে দেয় তিনি খেয়ে ফেলতে পারবেন।

আলাউদ্দিন।

জ্বি।

তোমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হচ্ছে?

জ্বি না, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না।

তোমার মন না চাইলে থাকি যেতে হবে না। আমি আমার ভাগ্নিকে নিয়ে বিপদে পড়েছি তা কিন্তু না। হামিদার পত্র হিসাবে তোমাকে আমার পছন্দ। এটাই আমার আগ্রহের কারণ।

আমি আপনার সঙ্গে বিকালে যাব।

তোমার কথা শুনে ভালো লাগল। ভ্রামি নিশ্চিত আমার ভাগ্নির সঙ্গে কথা বলে তোমারও ভালো লাগবে। অতি বুদ্ধিমতী মেয়ে। তোমাদের দুইজনের মিলবেও ভালো। তোমার বুদ্ধি কিছু কম আছে। তোমার কম বুদ্ধি ঐ মেয়ে পুশিয়ে দিবে।

আলাউদ্দিন কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন। হাজী সাহেব বললেন, তোমার বুদ্ধি কম বলেছি এতে রাগ কর নি তো?

জ্বি না।

তোমাকে অত্যধিক স্নেহ করি বলেই বলেছি। স্নেহ না করলে বলতাম না।

দুপুরে মোরগপালাও খুবই ভালো ছিল। আলাউদ্দিন তেমন মজা পেলেন না। তার মন পড়ে রইল ইলিশ মাছের ডিমে। দুপুরের খাওয়ার পর তিনি হাজী সাহেবের বই-এর দোকানে কিছুক্ষণ ঘুমালেন। বিকেলে গেলেন হাজী সাহেবের সঙ্গে তার ভাগ্নির বাসায় চা খেতে। এই ঘটনায় তিনি যে কোনো উত্তেজনা অনুভব করলেন তা না। দায়িত্ব পালনের মতো যাওয়া। একা একা বাস করে তিনি অভ্যস্থ হয়ে গেছেন। বিয়ের মতো ঝামেলায় জড়ানো তার জন্যে বিরাট বোকামি হবে। জীবনে অনেক বোকামি তিনি করেছেন। হাজী সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে এই বোকামিটাও তিনি করে ফেলবেন বলে মনে হচ্ছে। তবে তা নিয়ে তিনি তেমন কোনো দুশ্চিন্তা বোধ করলেন না।

দরজা খুলে দিল হামিদা। সহজ দেশী বিদেশী ও চাইনিজ রান্নার বই-এর ম্যাপে যে মহিলার ছবি বাস্তবের মহিলা তার চেয়েও রুপবতী। দেখে মনে হচ্ছে পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের মেয়ে। মহিলার দুটি মেয়ে আছে এবং দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে— এই কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। হাজী সাহেব বললেন, হামিদা কেমন আছিস রে মা?

হামিদা খুশি খুশি গলায় বলল, খুব ভালো আছি। মামা তুমি এতদিন পরে কী মনে করে?

তোর বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম তোর এখানে এক কাপ চা! খেয়ে যাই। চায়ের পিপাসা হয়েছে।

তুমি আর দুই মিনিট পরে এলে আমাকে পেতে না। আমি বের হচ্ছিলাম, বেবিটেক্সি ডেকে এনেছি। বাসার সামনে বেবিটেক্সি দেখ নি?

যাচ্ছিস কোথায়?

ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে।

বেবিটেক্সি ফেরত পাঠিয়ে দে। আমি তোকে নামিয়ে দেব। আমি একজন লেখককে নিয়ে এসেছি। সহজ দেশী বিদেশী ও চাইনিজ রান্নার লেখক। প্রাইভেট কলেজে ইসলামিক ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। এখন হয়েছেন রান্নার বই-এর লেখক। সবই আল্লাহর ইচ্ছা।

হামিদা আলাউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে দেখে আমি খুবই লজ্জা পাচ্ছি। বই লিখেছেন আপনি, ছবি ছাপা হয়েছে অমির। মামা যে আমার ছবি নিয়ে এই কাজ করবেন আমি স্বপ্নেও ভাবি নি। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমাকে ক্ষমা না করে আপনি যেতে পারবেন না।

আলাউদ্দিন কী বলবেন ভেবে পেলেন না। মেয়েটা এত সুন্দর করে কথা বলছে? এত সুন্দর করে বলল আমাকে ক্ষমা না করে আপনি যেতে পারবেন। না। সেই কথার উত্তরে তারও সুন্দর করে কিছু বলা উচিত। মুখে কোনো কথাই আসছে না।

হাজী সাহেব বললেন, ক্ষমা করার কিছু নাই। আলাউদ্দিন বই লেখে নাই। অন্যের বই থেকে কপি করেছে। আলাউদ্দিন যদি সত্যি সত্যি বই-এর লেখক হতো তাহলে ক্ষমা করার প্রশ্ন আসত।

আলাউদ্দিন আগ্রহ নিয়ে বসার ঘর দেখছেন। কী সুন্দর ছিমছাম। ঘরে অনেক আসবাবপত্র। তারপরেও কেমন যেন ফাকা ফাকা লাগছে। দেয়ালে অতি রূপবতী দুই তরুণীর ছবি। এরা যে হামিদা বানুর মেয়ে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অবিকল মায়ের মতো চেহারী।

মেয়ে দুটির ছবির উপরে একজন যুবকের ছবি। সানগ্লাস পুরা যুবক। সে বেলুন ফুলাচ্ছে। এই যুবকের সঙ্গে মেয়ে দুটির চেহারার মিল নেই। তারপরেও বলে দেয়া যায় এই যুবক মেয়ে দুটির বাবা।

হামিদা চা নিয়ে এসেছে। চায়ের ট্রে নামিয়ে রাখতে রাখতে সে লজ্জিত গলায় বলল, চায়ের সঙ্গে যে দেব এমন কিছু নেই। অন্যদিন বাসি চানাচুর হলেও থাকে আজ তাও নেই।

হাজী সাহেব বললেন, কিছু লাগবে না। হামিদা বলল, মামা তোমার লাগবে না। কিন্তু তুমি মেহমান নিয়ে এসেছ।

হাজী সাহেব বললেন, আলাউদ্দিন মোহমান না! সে বলতে গেলে ঘরের মানুষ। তোর মেয়েরা কেমন আছে?

চিঠিতে তো সব সময় লেখে খুব ভালো। তবে যতটু! ভালো আছে বলে লেখে ততটা ভালো আছে বলে মনে হয় না। অসুখ বিসুখ যখন হয় আমি দুশ্চিন্তা করব বলে আমাকে কখনো জানায় না।

হাজী সাহেব বললেন, এটাই তো ভালো।

হামিদা বলল, এটা ভালো না। আমি সব সময় সত্যিটা জানতে চাই। মিথ্যা ভালো সংবাদের চেয়ে সত্যি খারাপ সংবাদ অনেক ভালো।

হাজী সাহেব আলাউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ঘটনা কী? বাড়িতে ঢোকার পর থেকে তুমি যে ঝিম ধরে বসে আছ। তোমার কিমা তো দেখি কাটছে না। কথা বলো।

আলাউদ্দিন ব্ৰিত গলায় বললেন, কী কথা বলব?

কিছু একটা বলো। কোনো কথাই যদি মনে না আসে হামিদাকে জিজ্ঞেস কর— আপনার দুই মেয়ের নাম কী?

আলাউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার দুই মেয়ের নাম কী?

হামিদা হেসে ফেলল। তবে অতি দ্রুত হাসি থামিয়ে বলল, আমার এক মেয়ের নাম রু আরেক মেয়ের নাম নু। দুজনের মিলিত নাম রুনু।

আলাউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ও আচ্ছা।

হামিদা বলল, মেয়েদের নাম এক অক্ষরের এটা শুনে আপনার অবাক লাগল?

আলাউদ্দিন বলল, সামান্য লেগেছে।

আপনার চেহারা দেখে সেটা বোঝা যায় নি। এক অক্ষরের নামের পেছনে সুন্দর। একটা গল্প আছে। গল্পটা বলি। এদের বাবার খুব শখ ছিল আমাদের প্রথম সন্তানটা মেয়ে হলে তার নাম হবে রুনু। মেয়ে হলো ঠিকই, জমজ মেয়ে হয়ে গেল। তার বাবা। রুনু নামটাকে ভেঙে একজনের নাম রাখল রু আরেকজনের নাম নু।

হাজী সাহেব অবাক হয়ে বললেন, কই এই গল্প তো আমি জানি না!

হামিদ বলল, মামা তুমি আমার কোনো গল্পই জানো না। আমি শুধু যে দুঃখি মেয়ে তা-না, আমার জীবনের অনেক মজার মজার গল্প আছে।

হাজী সাহেব হঠাৎ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে বললেন, দশ মিনিটের জন্যে আমি একটু ঘুরে আসি।

আলাউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। হাজী সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, তুমি যাচ্ছ কোথায়? তুমি বস, আমি দশ মিনিটের মধ্যেই চলে আসি। আমার একজন লেখক থাকে ১২১ নম্বর বাসায়। তাকে একটা তাগাদা দিয়ে আসি।

অলাউদ্দিন বললেন, আমিও সঙ্গে আসি।

হাজী সাহেব বললেন, তোমাকে নিয়ে যাব না। এক লেখক আরেক লেখককে পছন্দ করে না। তুমি হামিদার সঙ্গে গল্প কর। আরেক কাপ চা খাও। চা শেষ হতে হতে আমি চলে আসব।

হাজী সাহেব হন্তদন্ত হয়ে বের হলেন। আলাউদ্দিক অস্বস্তি নিয়ে বসে আছেন। মেয়েদের সঙ্গে এমনিতেই তার কথা বলার অভ্যাস নেই। তার উপর যে মেয়েটি তার সামনে বসে আছে তার সঙ্গেই বিয়ের কথা হচ্ছে। ভালো ঝামেলায় পড়া গেল।

হামিদা বলল, আপনি কি আরেক কাপ চা খাবেন?

আলাউদ্দিন বললেন, জ্বি না। চা খাব না।

হামিদা বলল, মামা দশ মিনিটের মধ্যে আসবেন না। দেরি করবেন। আপনি ধরে রাখুন মামার ফিরতে আশ ন্টার মতো লাগবে। উনি আধ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন যাতে আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে পারেন। পাত্র হিসেবে উনি যে আপনাকে এখানে এনেছেন আমি বুঝতে পারি নি। হঠাৎ উনার মাথায় ঢুকেছে আমাকে বিয়ে দিতে হবে। আমি কিছুতেই তাকে বুঝাতে পারছি না যে আমি বিয়ে করব না। আপনি সত্যি করে বলুন তো মামা কি আপনাকে পাত্রী দেখার কথা বলে এখানে আনেন নি?

আলাউদ্দিন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। হামিদা বলল, কী লজ্জার কথা চিন্তা করুন। আমার এত বড় বড় মেয়ে। স্বামীর সঙ্গে ঘর সংসার করছে। এখন কিসের বিয়ে? বিয়ে যদি করতাম আগেই করতাম।

তা তো ঠিকই।

হামিদা বিরত্ত গলায় বলল, আগে বিয়ের কথা বললে চিৎকার চেঁচামেচি করতাম। এখন বিরক্ত হয়ে চুপ করে থাকি। এর থেকে আমার ধারণা হয়েছে আমি নিম রাজি। ছিঃ।

আলাউদ্দিন বললেন, আপনি আমার উপর রাগ করবেন না।

হামিদা বলল, আপনার উপর কেন রাগ করব! কেউ যদি ভুলিয়ে ভালিয়ে আপনাকে নিয়ে আসে আপনি কী করবেন?

আলাউদ্দিন বললেন, আমার খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। আমি বারান্দা। থেকে একটা সিগারেট খেয়ে আসি।

বারান্দায় সিগারেট খেতে হবে না। এখানেই খান।

সবচে ভালো হয় আমি যদি চলে যাই। আজ সারাদিন বাইরে কাটিয়েছি। শরীর ঘামে চট চট করছে।

মামা এসে যদি দেখেন আপনি নেই তাহলে আপনার উপর খুব রাগ করবেন। আপনি মামার রাগকে ভয় করেন না?

জ্বি করি।

তাহলে চুপচাপ বসে থাকুন। আমি আবার চা নিয়ে আসছি। চা খান। গল্প করে আধা ঘণ্টা সময় পার করে দিন।

আমি আসলে গল্প করতে পারি না।

আপনার জীবনের মজার কোনো ঘটনার কথা বলুন।

আলাউদ্দিন হতাশ গলায় বললেন, আমার জীবনে আসলে মজার কোনো ঘটনা ঘটে নি।

কখনো ঘটে নি?

জ্বি না।

ঘটতেই হবে। আমার ধারণা আপনার জীবনে প্রচুর মজার ঘটনা ঘটছে। কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন না। যে পোকা মিষ্টি আমের ভেতর জন্মায় সে মিষ্টি রসের ব্যাপারটা ধরতে পারে না। সে মনে করে সে তার জীবনটা রসকষহীন অবস্থায় পার করে দিচ্ছে।

আলাউদ্দিন একটা সিগারেট ধরালেন। সিগারেট ধরাতে গিয়ে মনে হলো— রাতে হঠাৎ যে ভয় পেলেন সেই ঘটনা এই মহিলাকে কি বলা যায়। তার কাছে যে মনে হচ্ছিল কুটু তাঁর খাটের নিচে বসে আছে। তিনি কুটুর সঙ্গে কিছু কথাও বললেন। খাটের নিচের কাগজগুলি পাওয়া গেল ছেঁড়া। এই গল্প বলাটা কি ঠিক হবে? মনে হচ্ছে ঠিক হবে না।

হামিদা তাঁর দিকে ঝুঁকে এসে বলল, বলুন শুনি।

আলাউদ্দিন বললেন, কী বলব?

আপনার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আপনি একটা গল্প বলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, আবার দ্বিধায় পড়ে গেছেন। গল্প বলাটা ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছেন না। দ্বিধা দূর করে গল্পটা বলুন।

আলাউদ্দিন ব্ৰিত ভঙ্গিতে গল্প শুরু করলেন। হামিদা খুবই আগ্রহ নিয়ে গল্পটা শুনছে। এত আগ্রহ নিয়ে শোনার মতো কী গল্প? আলাউদ্দিন গল্প শেষ করলেন। হামিদা বলল, আপনি নিজে দেখলেন খাটের নিচের সব কাগজ ছেঁড়া?

জ্বি।

আপনার গল্পের খুব সহজ একটা ব্যাখ্যা আছে। ব্যাখ্যাটা দেই।

দিন।

যদিও আপনার জীবন কেটেছে একা একা তারপরেও আপনি খুব ভীতু টাইপ মানুষ। কারণ আপনি নিজেই বলেছেন আপনি অন্ধকার সহ্য করতে পারেন না। ঐ রাতে আপনি খুবই ভয় পেয়েছিলেন। অতিরিক্ত ভয় পেলে মানুষ মনগড়া জিনিস দেখে মনগড়া জিনিস কল্পনা করে। পুরোটাই আপনার কল্পনা।

আলাউদ্দিন বললেন, আমি যে দেখলাম আমার খাটের নিচের সব কাগজ ভেঁড়া।

আমার ধারণা আপনি কয়েকটা ছেঁড়া কাগজ দেখেছেন। আপনার উত্তপ্ত মস্তিষ্ক সেই কয়েক টুকরা কাগজ দেখে ভেবেছে সব কাগজ ছেঁড়া। আপনি নিশ্চয়ই সকালে ভেঁড়া কাগজের টুকরা দেখেন নি। দেখেছেন?

জি না। কুটু ঘর ঝাট দিয়ে পরিষ্কার করে রাখে।

আপনার বাবুর্চি কুটু মানুষটা কেমন?

ভালো। খুব ভালো রান্না করে। এর রান্না একবার খেলে অন্য কোনো কিছু আপনি মুখে দিতে পারবেন না। আজ দুপুরে তার ইলিশ মাছের ডিম রান্না করার কথা।

হামিদা হাসতে হাসতে বলল, আপনি বলেছিলেন আপনি গল্প করতে পারেন। এতক্ষণ খুব সুন্দর গল্প করলেন। ত্রিশ মিনিট কিন্তু পার করে দিয়েছেন। মামাও চলে এসেছেন। তার পায়ের শব্দ পাচ্ছি। আপনি পাচ্ছেন না?

জি না।

আপনার কান তীক্ষ্ণ না। পায়ের শব্দ না পেলেও কলিং বেল বাজার শব্দ শুনবেন।

হামিদার কথা শেষ হবার আগেই কলিং বেল বাজল। হামিদা দরজা খুলে দিল। হাজী সাহেব ঘরে ঢুকলেন না। তাঁর নাকি অনেক দেরি হয়ে গেছে।

হামিদার বাসা থেকে বের হয়ে হাজী সাহেব নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আলাদ্দিন, আমার ভাগ্নিকে পছন্দ হয়েছে?

আলাউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে বললেন, জি।

তাহলে বিয়ের কথাবার্তা শুরু করি? কথাবার্তার অবশ্যি তেমন কিছু নেইও। হামিদার যদি তোমাকে পছন্দ হয় তাহলে আগামীকালও বিয়ে হতে পারে। তোমার কি আত্মীয়স্বজন কারো সঙ্গে কথা বলার দরকার আছে?

আলাউদ্দিন জবাব দিলেন না।

তোমার নিকট আত্মীয়স্বজন কে আছে?

আমার এক বোন আছে। ছোট বোন।

সে কোথায় থাকে?

কুষ্টিয়ার ভেড়ামাড়ায় থাকত। এখন বদলি হয়ে চিটাগাং গিয়েছে। চিটাগং এর ঠিকানা জানি না।

ঢাকা শহরে তোমার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই?

আছে। তাদের ঠিকানা জানি না। যোগাযোগ নাই। এক ফুপু থাকেন যাত্রাবাড়িতে। তার বাসা চিনতাম। অনেক দিন যাওয়া হয় না। এখন চিনব কি না বুঝতে পারছি না।

যাই হোক তুমি সময় নাও। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ কর। আমিও হামিদাকে জিজ্ঞেস করে দেখি তার মতামত কী?

উনি বিবাহ করবেন না।

হামিদা বিয়ে করবে কি করবে না— সেটা তার বলার কথা। তুমি বলছ কেন? আগবাড়িয়ে কথা বলবে না।

জি আচ্ছা।

তোমার সঙ্গে তাহলে আগামী বুধবার আবার দেখা হবে।

জি।

লেখা শেষ করে নিয়ে আসবে।

জি আচ্ছা।

বলেই আলাউদ্দিন হাঁটা শুরু করলেন। যেন তাঁর বাড়ি ফেরার খুবই তাড়া। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর এক মুহূর্তও থাকা যাবে না।

 

বাসায় ঢুকে আলাউদ্দিনের মন ভালো হয়ে গেল। তিনি স্বস্তি ও আনন্দের নিঃশ্বাস ফেললেন। এতক্ষণ বুকের উপর পাথর চেপে ছিল। এখন পাথরটা নেই। নিজেকে খুবই হালকা লাগছে। নিজের বাসায় ফিরে এত আনন্দ এর আগে তিনি পেয়েছেন বলে মনে পড়ল না।

কুটু মিয়া?

জ্বি স্যার।

গোসল করব। গরম পানি দাও। শরীর ঘামে ভর্তি। আজ গরম পানি দিয়ে সাবান দিয়ে হুলুস্থুল করব।

গরম পানি দেওয়া আছে স্যার।

বলো কী! তুমি দেখি অন্তর্যামী হয়ে যাচ্ছ। অন্তর্যামী কি জানো? যে মনের কথা বলতে পারে সে অন্তর্যামী। রাতের খাবার কী কুটু মিয়া?

রাতে মাংস করেছি স্যার।

ইলিশ মাছের ডিমের কী হলো?

ডিমও আছে।

গুড ভেরি গুড। হিলসা ফিস, এগ কারি।

আলাউদ্দিন বাথরুমে ঢুকলেন। বালতি ভর্তি গরম পানি। সাবান তোয়ালে সব সাজানো। বাথরুমের দরজার ওপাশ থেকে কুটু বলল, চা খাইবেন স্যার?

আলাউদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, গোসল করতে করতে চা খাব কীভাবে?

আপনি চা খাইবেন, আমি গায়ে সাবানের ডলা দিব।

আলাউদ্দিন ইতস্তত করতে লাগলেন। হ্যাঁ বলবেন না-কি না বলবেন মনস্থির করতে পারছেন না। কুটু মিয়া ঘরদুয়ার ঝকঝকে করে রাখে কিন্তু তাকে দেখে। নোংরা মনে হয়। মনে হয় দীর্ঘ দিন এই লোক গোসল করে নি। গা থেকে সব সময় বাসি তরকারির গন্ধের মতো গন্ধ আসে। আলাউদ্দিন বললেন, আন দেখি এক কাপ চা। আর ইয়ে, পিঠে সাবান ডলে দাও সারা শরীরে সাবান ডলার দরকার নেই।

চা মনে হয় তৈরিই ছিল। নিমেষের মধ্যে কুটু মিয়া চা এনে দিল। আলাউদ্দিন। একটা সিগারেট ধরিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। কুটু মিয়া পিঠে সাবান ডলছে। গরম পানি ঢালছে। আলাউদ্দিনের কাছে মনে হচ্ছে তিনি এত আরাম তার সারা। জীবনে পান নি। আরামে বারবার তার চোখ বুজে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি ঘুমিয়ে পড়লেন। চা সিগারেট খেতে খেতে গোসলের এত আনন্দ কে জানত!

কুটু।

জ্বি স্যার।

দাও সারা শরীরেই সাবান মাখিয়ে দাও। যাহা বাহান্না তাহা তিপ্পান্ন।

জি আচ্ছা স্যার।

এত ভালো ম্যাসাজ শিখেছ কোথায়?

কোনো খানে শিখি নাই স্যার। পাইলট স্যারের শইল ম্যাসাজ করতাম।

উনিও কি চা সিগারেট খেতে খেতে গোসল করতেন?

জ্বি না। উনার বাড়িতে বাথটাব ছিল। বাথটাবে গরম পানি দিতাম। ফোম দিয়া ফেনা তুলতাম। উনি শুইয়া শুইয়া ব্লাডি মেরি খাইতেন আর আমি শইল টিপতাম।

ব্লাডিমরি কী জিনিস?

একটা মিকচার। খাইতে অতি সুস্বাদু।

তুমি বানাতে পার?

জ্বি পারি। পাইলট স্যারের কাছে শিখেছি।

বানাতে কী কী লাগে?

অনেক কিছু লাগে। তিন আংগুল ভদকার মধ্যে…

আলাউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, ভদকা মদ না?

কুটু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

থাক বলার দরকার নাই। আমি শিক্ষক মানুষ। মদ বিষয়ে কোনো কথা শোনাই আমার ঠিক না। আমার বাবা ছিলেন আমাদের অঞ্চলের জামে মসজিদের ইমাম। জীবনে কোনো ওয়াক্ত নামাজ কাজা করেন নাই। আছর ওয়াক্তে তাঁর মৃত্যু হয়। আছরের নামাজও তাঁর কাজ হয় নাই। নামাজ শেষ করে বিছানায় শুয়েছেন, কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যু।

কুটু মিয়া কথা বলছে না। নীরবে সাবান মাখিয়ে যাচ্ছে। গায়ে গরম পানি ঢালছে। শরীর ম্যাসাজ করছে। আলাউদ্দিন ভাবছেন এই আরামে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলে মন্দ হতো না।

কুটু মিয়া।

জি স্যার।

তোমার পাইলট স্যার খুব মদ খেতেন?

চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর খুব বেশি খাইতেন। একা মানুষ। কিছু করার নাই।

একা মানুষ কেন?

স্ত্রী মারা গেছিলেন। ছেলেমেয়েরা বড় হইয়া চইলা গেছে দেশে বিদেশে।

আমার মতো অবস্থা। সে ছিল নী আমি গরিব– বেশক এইটা, ঠিক না। প্রাইভেট কলেজের শিক্ষক ছিলাম। বেতনের কারবার নাই। ছাত্রই নাই বেতন কোত্থেকে আসবে। কলেজের বেশির ভাগ শিক্ষক এর তার বাড়িতে লজিং-এর মতো থাকত। নামেই কলেজের শিক্ষক। অসলে লবডঙ্কা। লবডঙ্কা মানে জানো?

জ্বি না।

মানে জানার দরকার নাই। শরীর টিপছ, শরীর টিপ।

জি আচ্ছা।

ব্লাডিমেরি জিনিসটা কীভাবে বানায় বলো তো শুনি। খাচ্ছি না যখন তখন তো আর দোষ হচ্ছে না। কীভাবে বানায় শুনে রাখি। তিন আঙুল ভদকা। তারপর কী?

ওয়েস্টার সস ছয় ফোঁটা, তাবাসসুম সাত ফোঁটা, গোল মরিচের গুঁড়া- লবণের চামচের আধা চামচ লেবুর রস চায়ের চামচে আধা চামচ, ট্রিপল সেক এক ফোঁটা। একটা কাচামরিচ মাঝখান দিয়া ছিইল্যা তার অর্ধেকটা। এইসব জিনিস এক সাখে মিশানোর পরে দিতে হইব টমেটো জুস। ডীপ ফ্রিজে রাখতে হইব দশ মিনিট। ডিপ ফ্রিজ থেইকা বাইর কইরা বরফের কুচি দিয়া খাইতে হইব।

বলো কী? এই জিনিস পাইলট সাহেব রোজ খেতেন?

জি। দিনে এই জিনিস, রাতে মার্গারিটা খাইতেন।

সেটা কী?

মার্গারিটা খাইতে খুবই সুস্বাদু।

যত সুস্বাদুই হোক আমি এর মধ্যে নেই। তাছাড়া তুমি যে সব জিনিসের কথা বললে বাংলাদেশে এইসব নিশ্চয়ই পাওয়া যায় না। ভদকা পাওয়া যায় রাশিয়াতে। রাশিয়া থেকে তোমার পাইলট সাহেবের পক্ষেই ভদকা আনা সম্বুল। আমার পক্ষে না।

কুটু গলা নামিয়ে বলল, ভদকা ঘরে আছে স্যার। ফ্রিজে এক বোতল আছে।

আলাউদ্দিন আঁতকে উঠে বললেন, ফ্রিজে ভদকা কোথেকে আসলো।

পাশের ফ্ল্যাটের সাইফুদ্দিন সাহেব রাইখা গেছেন। তার বন্ধুরা দেখলে খাইয়া ফেলবে এই জন্যে রাইখা গেছেন।

খবরদার তুমি ভদকা ফদকা দিয়ে কিছু বানাবে না। আমাদের পুরো পরিবার ইসলামিক লাইনের। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়কার কথা— এক রমজান মাসের শুক্রবার রোজা ভেঙ্গে ফেলেছিলাম বলে জুম্মা নামাজের পরে সকল মুসুল্লীর সামনে আমাকে একশৰার কানে ধরে উঠবোস করতে হয়েছে। এই ছিল আমাদের পরিবার। মনে থাকবে?

জ্বি।

গরম পানি তো শেষ হয়ে গেছে। আরেক বালতি গরম পানি থাকলে ভালো হত।

এখন ঠাণ্ডা পানি ঢালব? এতে আরাম বেশি পাইবেন।

দাঁড়াও, আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে নেই।

আলাউদ্দিন আরেকটা সিগারেট ধরালেন। কুটু তার মাথায় পানি ঢালছে। আরামে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *