০২. হাইপেশিয়া

০২. হাইপেশিয়া

আজ থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান পড়ি তখন আমাদের ক্লাসের অর্ধেকই ছিল মেয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রে পি.এইচ.ডি. করতে যাই তখন আমাদের ক্লাসে ছাত্রী ছিল মাত্র একজন। আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম–আমার ধারণা ছিল “উন্নত দেশে নিশ্চয়ই বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে অনেক বেশি ছাত্রী পড়ালেখা করবে। মজার কথা হচ্ছে সে দেশে গিয়ে আমি আরও বিচিত্র তথ্য আবিষ্কার করলাম, সেখানে মেয়েরা খুব ভাবনা-চিন্তা করে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি থেকে দূরে থাকে। সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিষয়গুলো মেয়েদের বিষয় নয়–এগুলো হচ্ছে কাঠখোট্টা ছেলেদের বিষয়! শুধু তাই নয়, কোনো মেয়ে যদি বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করে তাহলে ছেলেরা তার থেকে শত হস্ত দূরে থাকে, মেয়েটি যদি লেখাপড়ায় ভালো হয় তাহলে তো কথাই নেই, সেই মেয়েটি হয়তো বিয়ে করার জন্যে কোনো ছেলের দেখাই পাবে না!

কথাটা যদিও হালকা সুরে বলা হয়েছে কিন্তু এর মাঝে সত্যতা আছে। শুধু যে বর্তমানকালে এর সত্যতা আছে তা নয়, এটি সবসময়েই সত্যি। ছেলেরা আর মেয়েরা কখনোই সমান অবস্থায় থেকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি কিংবা সাধারণ শিক্ষা-দীক্ষাতে অংশগ্রহণ করতে পারল না। তাই পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা পুরুষ বিজ্ঞানী কিংবা প্রযুক্তিবিদ যেরকম পাই মেয়েদের সেভাবে পাই না, তুলনামূলকভাবে তাদের সংখ্যা অনেক কম। ইদানীং তবু চোখে পড়ার মতো মহিলা বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদ দেখা যায়, অতীতে বা মধ্যযুগে তাদের সংখ্যা ছিল একেবারেই হাতেগোনা।

সুদূর অতীতে–আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছরের আগে এরকম একজন মহিলা বিজ্ঞানী ছিলেন, তার নাম ছিল হাইপেশিয়া (Hypatia)। তিনি এমন একজন অসাধারণ মহিলা ছিলেন যাকে এতকাল পরেও অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সেই সময়ে মেয়েদের লেখাপড়া করার বা অন্য কিছু করার সুযোগ দূরে থাকুক তাদেরকে সামান্য সম্মানটুকুও দেয়া হতো না। সত্যি কথা বলতে কী সে সময়ে মেয়েরা ছিল পুরুষদের সম্পত্তি! সেই সময়ে হাইপেশিয়া শুধু যে একজন তুখোড় গণিতবিদ, সফল পদার্থবিজ্ঞানী, প্রতিভাময় জ্যোতির্বিদ আর নিউপ্লেটোনিক দর্শন ধারার প্রধান ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির শেষ গবেষক।

আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির গবেষক কথাটার মনে হয় আলাদা করে একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। আমরা পৃথিবীতে এখন যে সভ্যতাটুকু দেখছি সেটার পিছনে যেটা সবচেয়ে বেশি কাজ করছে সেটা হচ্ছে বিজ্ঞান। পৃথিবীতে আরো একবার সেই বিজ্ঞানভিত্তিক সভ্যতা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল এবং সেটা ঘটেছিল আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিকে ঘিরে। প্রায় দুই হাজার বছর আগে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে এই লাইব্রেরিটি গড়ে উঠেছিল। আলেকজান্দ্রিয়া শহরটি ছিল সত্যিকার অর্থে একটি কসমোপলিটান শহর। পৃথিবীর সব দেশের মানুষ এই শহরে থাকত। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর যে গ্রিক সম্রাটরা মিসর শাসন করত তারা সত্যিকার অর্থে জ্ঞানের সাধনা করত। সেই দুই হাজার বছর আগে তারা গবেষণার গুরুত্বটি ধরতে পেরেছিল, তাই আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিকে ঘিরে তারা গবেষণার একটা পরিবেশ তৈরি করেছিল, যেখানে গবেষকরা গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকে শুরু করে ভূগোল বা সাহিত্যে গবেষণা করতেন।

গবেষণা করার জন্যে দরকার বই, তাই আলেকজান্দ্রিয়ায় একটা বিশাল লাইব্রেরি গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। বলা যেতে পারে সেই যুগে আলেকজান্দ্রিয়া ছিল এই প্রকাশনার স্বর্গ। বই বলতে আমরা এখন যা বুঝি আজ থেকে দুই হাজার বছর আগে পৃথিবীতে বই মোটেও সে রকম ছিল না। প্রিন্টিং প্রেস ছিল না বলে সেগুলো ছিল হাতে লেখা। আসল কপিটি লেখক নিজে লিখতেন এবং অন্যেরা সেটা দেখে দেখে তার অন্য কপিগুলো আরেক জায়গায় লিখে রাখতেন। সে কারণে বইগুলো ছিল অসম্ভব মূল্যবান এবং যাদের কাছ সেই বইগুলো থাকত তারা যক্ষের মতো সেগুলো আগলে রাখত। মিসরের গ্রিক সম্রাটরা অনেক কষ্ট করে সারা পৃথিবী থেকে অমূল্য বইগুলো সংগ্রহ করেছিল। কেউই তাদের আসল বইটি হাতছাড়া করতে চাইত না–অনেক টাকা জামানত রেখে তারা বইগুলো কপি করার জন্যে আনত! সেই সময়কার গ্রিক সম্রাটরা বইগুলোকে এতই মূল্যবান মনে করত যে তারা জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত হতে দিয়ে সেই বইগুলো আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে রেখে দিত–ফেরৎ দিত কোনো একটা কপি! লাইব্রেরিতে ঠিক কতগুলো বই ছিল সঠিকভাবে কেউ জানে না, অনুমান করা হয় তার সংখ্যা দশ লক্ষেরও বেশি ছিল। এই বিশাল লাইব্রেরিকে ঘিরে গবেষকরা যেসব কাজ করেছেন সেগুলো ছিল যুগান্তকারী। যেমন ইরাতেস্থিনিস প্রথম বারের মতো নিখুঁতভাবে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ বের করে তার একটা ম্যাপ তৈরি করেছিলেন, হিপার্কাস নক্ষত্রের প্রকৃতির সঠিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তাদের নিখুঁত ক্যাটালগ তৈরি করেছিলেন। ইউক্লিড তার বিখ্যাত জ্যামিতির বই লিখেছিলেন, গেলেন লিখেছিলেন চিকিৎসা আর শারীরবিদ্যার বই। এরকম একটি-দুটি নয়, আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিভিত্তিক গবেষণার অজস্র উদাহরণ দেয়া যায়।

সেই লাইব্রেরির একজন গবেষক ছিলেন হাইপেশিয়া। তার জন্ম হয় 370 সালে। তার বাবাও ছিলেন বড় দার্শনিক, নাম থিওন। সেই যুগে মেয়েরা যখন পুরুষের সম্পত্তি হয়ে ঘরের ভেতর আটকা পড়ে থাকত তখন হাইপেশিয়া সদর্পে পুরুষদের জগতে ঘুরে বেড়াতেন। যে কোনো হিসেবে হাইপেশিয়া ছিলেন অনিন্দ্য সুন্দরী, তাকে বিয়ে করার জন্যে পুরুষরা পাগল ছিল কিন্তু তিনি কখনো বিয়ে করতে রাজি হন নি। কথিত আছে তার এক ছাত্র একবার তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল, সেই ছাত্রকে তিনি মেয়েলী বিড়ম্বনার একটা নমুনা দেখিয়ে মোহমুক্ত করে ছেড়ে দিয়েছিলেন! এই সুন্দরী মহিলা নিয়মিতভাবে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে বক্তৃতা দিতেন–তার বক্তৃতা শোনার জন্যে অনেক দূর থেকে জ্ঞানী-গুণী মানুষেরা আসত, রীতিমতো টিকেট কিনে তারা হাইপেশিয়ার বক্তৃতা শুনত! হাইপেশিয়া যে শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন তা নয়, আলেকজান্দ্রিয়া শহরের নগরপাল অরিস্টিসের সাথেও তার এক ধরনের ঘনিষ্ঠতা ছিল। তখন খ্রিস্টান ধর্মের প্রচার শুরু হয়েছে, খ্রিস্টান আর্চ বিশপের নাম সিরিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকে ধর্মান্ধ খ্রিস্টানরা ধর্মবিরোধী মনে করত তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারক হাইপেশিয়া ছিল তাদের চক্ষুশূল। বিশেষ করে নগরপাল অরিস্টিসের সাথে তার বন্ধুত্বকে সিরিল খুব খারাপ চোখে দেখতেন। হাইপেশিয়া খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন কিন্তু তার ধারণা ছিল ধর্ম হতে হবে যুক্তিনির্ভর আর জ্ঞানভিত্তিক। হাইপেশিয়া তার বক্তৃতায় সেটা প্রচারও করতেন, গোঁড়া আর ধর্মান্ধ খ্রিস্টানরা সেটা খুব অপছন্দ করত। একজন মেয়ে হয়ে তার এরকম সাহসী কথাবার্তায় মানুষগুলো খুব বিরক্ত হতো। তারা চেষ্টা করত যেন হাইপেশিয়ার বক্তৃতা শুনতে কেউ না আসে, তার বিজ্ঞানের উপর কথাবার্তা কেউ শুনতে না পারে। কিন্তু এই তেজস্বী আর সুন্দরী মহিলাকে তারা কোনোভাবে থামাতে পারল না, তাই তারা তাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল।

417 খ্রিস্টাব্দে একদিন হাইপেশিয়া ঘোড়ার গাড়িতে ঘর থেকে বের হয়েছেন কাজে যাবার জন্যে, পথে তাকে ধর্মান্ধ । মানুষেরা ঘিরে ধরল। মুহূর্তের মাঝে সেই মানুষগুলো তাকে গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে নেয়, তাকে বিবস্ত্র করে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় একটা গির্জায়, সেখানে শরীর থেকে তার মাংস খুবলে নেয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে, তারপর শরীর টুকরো টুকরো করে আগুনে ছুঁড়ে দেয় উন্মত্ত দানবের মতো। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নজির খুব বেশি আছে বলে জানা নেই। এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই আর্চ বিশপ সিরিলকে সাধারণ মানুষ থেকে উপরের স্তরে নিয়ে সেইন্ট বানিয়ে দেয়া হয়–জগতে এর চাইতে উৎকট রসিকতা কী আর কিছু হতে পারে?

হাইপেশিয়াকে হত্যা করার সাথে সাথে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিরও দিন শেষ হয়ে যায়। এই লাইব্রেরিকে ঘিরে যে সভ্যতার জন্ম হয়েছিল সেই সভ্যতার বিকাশ থমকে দাঁড়ায়–একদিন দু’দিন নয়, প্রায় এক হাজার বছরের জন্যে। হাইপেশিয়া যেন ছিলেন একটা আলোর শিখা, ফুঁ দিয়ে সেই আলোর শিখা নিভিয়ে দেবার পর যেন পুরো জগৎটি এক হাজার বছরের জন্যে অন্ধকারে ডুবে

গেল। কোপার্নিকাস, গ্যালেলিও, নিউটনরা এসে সেই অন্ধকারকে দূর করার চেষ্টা শুরু না করা পর্যন্ত পুরো পৃথিবী এক হাজার বছরের জন্যে অন্ধকারে ঢাকা পড়েছিল!

আলেকজান্দ্রিয়ার সেই লাইব্রেরি একদিন পুড়ে ছাই করে দেয়া হলো–ঠিক কারা সেটি করেছিল সেটা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। কথিত আছে লাইব্রেরির বইগুলো পুড়িয়ে গোসলখানার পানি গরম করা হয়েছে–দশ লক্ষের উপর বই পুড়িয়ে শেষ করতে সময় লেগেছে ছয় মাস থেকেও বেশি! পৃথিবীর ইতিহাসে এর থেকে হৃদয়বিদারক কোনো ঘটনা আছে বলে জানা নেই। হাইপেশিয়ার সব বই, গবেষণার সব নমুনা সেই লাইব্রেরির সাথে সাথে পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। তার কাজের নমুনার বিশেষ কিছু নূতন পৃথিবীর মানুষ খুঁজে পায় নি–ভাসা ভাসাভাবে নানা সূত্র থেকে কিছু তালিকা তৈরি করা হয়েছে, যে কোনো হিসেবে সেগুলো অসাধারণ।

মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্যে ধর্মান্ধ মানুষেরা এই অসাধারণ বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদকে কেটে টুকরো টুকরো করে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। ধর্মান্ধ মানুষেরা ইতিহাসের পাতা থেকে কিন্তু তাকে মুছে দিতে পারে নি। আধুনিক পৃথিবীর মানুষ চাঁদের একটি অঞ্চলের নাম রেখেছে হাইপেশিয়ার নামে।

যতদিন আকাশে চাঁদ উঠবে ততদিন হাইপেশিয়া পৃথিবীর মানুষের কাছে বেঁচে থাকবেন জ্ঞানের প্রতীক হয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *