হলুদ কাদায় ঘোলা নোনা জলের নদী। হাঙ্গর কুমির আর নানাজাতীয় মাছে ভরা। ডাঙায় বন বাঘ ভালুক হায়না শেয়াল থেকে নিরীহ হরিণ এবং নানাজাতীয় সরীসৃপ, জোক বিছা আর পোকামাকড়ে ভরা।
সংখ্যার হিসাবে স্বজনতান্ত্রিক মশারাই অতুলনীয়–হিংসার হিসাবেও বটে। নদীর হাঙ্গর কুমির আর বনের বাঘ ভালুক সাপেরা বছরে যত মানুষের প্রাণ নেয়, মশারা দলে দলে হুল ফুটিয়ে তার চেয়ে কতগুণ বেশি মানুষকে যে আখেরে ঘায়েল করে!
নদী আর বনের এই পরিবেশে এলোমেলোভাবে ছড়ানো গ্রামগুলি কারখানাকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠা ছোট শহরটিকে ঘিরে আছে।
নদীর এপারের পাশাপাশি কয়েকটা গ্রামে কারখানাগুলি গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি মানে ঠিক নদীর ধারঘেঁষা পাশাপাশি গ্রাম বললে ভুল হবে ডাঙার দিকের পাশঘেঁষা গ্ৰামও আছে বটে।
নদীর এপারে ওপারে আদিম অরণ্য। এপারে দক্ষিণে মাইলতিনেক তফাতে বনের প্রান্ত, ওপারে বন খানিকটা উত্তরে এগিয়ে গিয়েছে। কারখানাগুলি যেন মায়ামন্ত্রে শহুরে ভাব এনে দিয়েছে। তারই একটা অংশে।
হাটের বদলে বাজার বসে। এপারে ওপারে কয়েকটা মুদিখানা মনিহারি দোকান আছে। একতালা বাড়ি হলেও পাকা ক্লাব-বাড়িতে প্রতিদিন চারটে পেট্রোম্যাক্স জ্বলে যেন মিথ্যা ঘোষণা করে দেয় ঘন বনের গাঢ় অন্ধকার আর বনের গায়ে এলোমেলোভাবে ছড়ানো গ্রামগুলি ডিবরি এবং দু-একটা ধোঁয়াপড়া লণ্ঠনের মিটমিটে আলোয় এখানে ওখানে ঈষৎ স্তিমিত ঘন গাঢ় কালো অন্ধকারকে!
প্রধানত কারখানাগুলির প্রয়োজনেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। বাড়িতে সরবরাহ করা হয় না, বড় বড় রাস্তাগুলিতে বিদ্যুতের আলো জ্বলে। ভবিষ্যতে বাড়িতে বাড়িতেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করার একটা পরিকল্পনা আছে কিন্তু কেন সেটা কার্যে পরিণত হয় না সে এক রহস্যময় ব্যাপার।
কিছু সায়েব আর কিছু গণ্যমান্য ধনী ও উচ্চপদস্থ বাবু মিলে প্ল্যান করে ক্লাব-বাড়িটা তৈরি করিয়েছিল। ইংরেজি তিরিশ সালের পর দু-তিন বছরের মধ্যে হুড়মুড় করে নতুন কয়েকটা কারখানা যখন গড়ে উঠেছিল।
সায়েব মানে খাঁটি ভেজাল ছোট বড় আসল নকল সব রকম সায়েব। পরস্পরের কুঁচকুঁচে কালো রঙের পাল্লা দিয়েছিল কড়া হাকিম গুপ্ত সায়েব আর টিম্বার প্লেট কোম্পানির লোকনাথম। কয়েকজনের রং কালো না হলেও ছিল ময়লা। কয়েকজনের রং ভেজাল সায়েবদের তুলনায় তেমন কিছু মলিন ছিল না। প্রভাসের রং অতুলনীয়, খাঁটি সায়েবদের সাদা রঙের হিসেবে না হোক, দুধে আলতার নিরিখে ক্লাবের সব খাঁটি খাঁটি সায়েবদের হার মানিয়ে দিচ্ছে।
তিনপুরুষ আগে প্রভাসের বংশগত রক্তধারায় ইরানী রক্ত সঞ্চারিত হওয়ার একটা সম্ভাবনা অবশ্য ঘটেছিল। কিন্তু যোগসূত্রটা গাঁয়ের মানুষ ঠিকভাবে ধরতে পারে নি, হারিয়ে ফেলেছে।
সকলে জানত কোনো বংশের রক্তধারায় নতুন কিছু ঢোকাতে পারে শুধু পুরুষ, প্রভাসের ঠাকুরদার বাপের আমলে অন্দরে ঠাঁই পেয়েছিল দুটি ইরানী স্ত্রীলোক, প্রৌঢ়া মা আর তার তরুণী মেয়ে।
কোথা থেকে কিভাবে কেন তারা আধা-রাজা আধা-জমিদারটির অন্দরে এসেছিল, কয়েক বছর পরে কেনই বা আবার একদিন রাতারাতি উধাও হয়ে গিয়েছিল, সে সব পুরোনো জটিল ব্যাপার এ কাহিনীতে অপ্রাসঙ্গিক। আশ্চর্য এই যে, পুরোনো রূপকথা উপকথায় ছেলে ছেলে করে পাগল রাজাদের নানা বিচিত্ৰ উপায়ে পুত্রলাভের গল্প-জানা মানুষগুলির কল্পনাতেও আসে না যে, ইরানী উপপত্নীর গর্ভজাত সন্তানকে নিজের ধৰ্মপত্নীর সন্তান বলে চালিয়ে দেওয়া মোটেই কঠিন বা অসম্ভব ছিল না।
গর্ভবতী উপপত্নীকে দূরে কোথাও সরিয়ে নিয়ে রেখে, যথাসময়ে তীর্থযাত্রার নাম করে ধৰ্মপত্নীকে নিয়ে কিছুকালের জন্য বিদেশে কাটিয়ে একেবারে ছেলে নিয়ে বাড়ি ফিরলেই ব্যাপার চুকে গেল।
ইরানী কোনো পুরুষ চাকর বাকর পাইক বরকন্দাজ যদি বহাল থাকত তবে সেই পূর্বপুরুষটির গায়ের রং নিয়ে প্রভাসের লজ্জা আর কেলেঙ্কারির অবধি থাকত কিনা সন্দেহ।
বিজ্ঞান কি বলে জানা না থাক, অনেক পুরুষের সঞ্চিত সাধারণ জ্ঞান দিয়েই গায়ের লোক ধরে ফেলত, এ বংশে কেন ইরানী সংস্করণের ছেলে জন্মায়।
সাদাসিধে কিন্তু ইট আর সিমেন্টে মোটা করে গড়া শক্ত পাকাপোক্ত একটা ক্লাব-বাড়ি গড়ার বুদ্ধি গজিয়েছিল বুড়ড়া উইলি জেনকিন্সের মগজে।
সে ছিল খাঁটি ইংরেজ।
মাঝবয়সী মোটাসোটা ফ্রেডারিক জনসনকে প্রধানের পদটা ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরে যাবার আগে তিনটি খাঁটি আর সাতটি মিশেল ইংরেজ পরিবারের নিরাপত্তার জন্য বড়ই ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল জেনকিন্স।
দেশে ফিরতেও সে ব্যাকুল হয়েছিল। তিরিশ বছর এদেশে কেটেছে। তবু এটা বিদেশ। দেশে ছাপানো বই ম্যাগাজিন পত্রপত্রিকা পড়ে, আত্মীয়বন্ধুর সঙ্গে নিয়মিত চিঠিপত্র লেখা বজায় রেখে, চার-পাঁচ বছর পরে পরে কয়েক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে ঘুরে আসে। প্রথমবার বৌ আর ছেলেমেয়ে দুটিকে সঙ্গে নিয়েছিল, তারপর থেকে একাই গিয়েছে এসেছে। বারে বাপ একলা যাওয়া আসার খরচটাই কি সোজা! এদিকে মাতৃত্বগর্বিনী পত্নী মিনার্ভার কল্যাণে ফেমিলি বেশ কেঁপে উঠেছে।
জেনকিনসের একা দেশে বেড়াতে যাওয়া নিয়ে তাদের দু-তিন সপ্তাহব্যাপী উগ্র করুণ বিরামহীন দাম্পত্য কলহ উতলার জানাচেনা মানুষ থেকে চাপরাসী দারোয়ান জমাদার মেথররা পর্যন্ত উপভোগ করত–সাময়িকভাবে ভাড়া করা শিক্ষিতা নার্স আড়ালে হাসাহাসি করত অশিক্ষিতা আয়ার সঙ্গে।
তার নিজের বাংলোয় শুধু বিলিতি আপনজনদের একটা টি-পার্টি ডাকিয়ে ছোট ঘরোয়া বৈঠকে সে তার প্ল্যানটা পেশ করেছিল। এইরকম বাংলো প্যাটার্নের বাড়িতে তাদের বসবাস। উত্তেজনার সময় নেটিভরা ক্ষেপে গিয়ে দল বেঁধে আক্রমণ করলে, সময়মতো সৈন্য পুলিশ হাজির না হলে, তাদের শুধু কয়েকটা বন্দুক ভরসা। কিন্তু উন্মত্ত জনতার জোয়ারের মতো আক্রমণ কি শুধু কয়েকটা শখের বন্দুক দিয়ে ঠেকানো যায়? এমন একটা আশ্রয়ও দরকার, দশ-বিশ হাজার মানুষ হুড়মুড় করে এসেও সহজে যে আশ্রয় ভাঙতে পারবে না, কটা বন্দুক নিয়েও তারা সৈন্য পুলিশ হাজির হওয়া পর্যন্ত আত্মরক্ষা করতে পারবে।
ক্লাবের জন্য বাড়ি তৈরি করার কথাবার্তা চলেছে সাধারণ বাড়ির বদলে ছোটাখাটো শক্ত। দুর্গের মতো ওইরকম একটা বাড়ি গড়া হোক।
তিনজন মিসেস একবাক্যে তাকে সমর্থন জানিয়েছিল, পৌঢ় বয়সে অতিরিক্ত বুড়িয়ে যাওয়া এবং একটু বাঁচালে পরিণত হওয়া ফিরিঙ্গি সমাজের ফস্টার বোস গাল চুলকাতে চুলকাতে বলেছিল, প্রস্তাব মন্দ কি!
কিন্তু অন্যেরা চুপ করে ছিল।
জেনকিন্সের এতদিনের প্রধানের আসনটা দখল করবে যে নবাগত জনসন, তার হাই তোলার ভঙ্গিটা জেনকিন্সের বড়ই বিশ্রী লেগেছিল।
তখন নিজেদের সেই ঘরোয়া বৈঠকে নাটক সৃষ্টি করেছিল তরুণ বয়সী রবার্টসন। সে পরিষ্কার স্পষ্ট ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছিল, মাপ করবেন, ইউ আর রং, ভেরি ভেরি রং।
মাথা ঘুরে গিয়েছিল জেনকিন্সের। বিশ বাইশ-বছরের একটা ছোকরা, বছর দেড়েক মোটে শিক্ষানবিসি করছে, বিদেশ থেকে এসে কি করে এদেশে কি করতে হয় সবে শিখতে শুরু করেছে–তার মুখে এমন স্পষ্ট বেয়াদবি ইউ আর রং ভেরি রং!
তবু জেনকিন্স তাকে ক্ষমা করেছিল। উদারভাবে তার দিকে তাকিয়ে স্মিতমুখে ইংরেজিতে বলেছিল, ইয়ং ম্যান, তুমি শুধু দেখবে শুনবে আর বুঝবার চেষ্টা করবে। আমাদের মতো বুড়ো ঘাগীদের কাছে শিখবে। নইলে জানবে বুঝবে চালাবে কি করে তোমরা?
কিন্তু দেখা গিয়েছিল অল্পবয়সী রবার্টসন একা নয়, আরো কয়েকজন তাকে সমর্থন করে না।
তার নিজের মেয়েও নয়!
ন্যান্সী পড়ত কলকাতার কলেজে। পরীক্ষায় ইংরেজি আর অঙ্কে বিশ্রীভাবে ফেল করবার খবর পেয়ে কদিন সে ভয়ানক মনমরা হয়ে ছিল।
হঠাৎ যেন তাজা হয়ে অতি বেশি উৎসাহের সঙ্গে রবার্টসনকে সমর্থন করে বলেছিল, ইউ আর রং পাপা, হি ইজ রাইট। এখন কি সেকাল আছে যে, একটা ইটের বাড়ির ফোর্ট হলেই সামলানো যাবে?
রবার্টসনের পায়া গিয়েছিল বেড়ে। সে জোর গলায় ঘোষণা করেছিল, আমি বলি কি, বাড়িটা খাঁটি ভারতীয় স্টাইলে তৈরি হোক। আমরা তো মোটে কজন–ক্লাব করে লাভ কী? কয়েকজন বাছা বাছা নেটিভ বাবুদেরও মেম্বার করা হোক। বিশেষ ব্যাপারে দরকার হলে আমরা তো এমনিভাবে আমাদেরই কারো বাড়িতে জড়ো হতে পারব। ক্লাবে খোলাখুলি মেলামেশা চলুক।
মতবিরোধের মীমাংসা করে দিয়েছিল কমিশনার সাদারল্যান্ড।
ক্লাব-বাড়ির দেয়াল হবে ইটের কিন্তু প্ল্যাস্টারিং ও রং করা হবে এমনভাবে যে, দেখলে মনে হবে ঠিক যেন মাটির দেয়াল। চালা তৈরি হবে শক্ত ধাতুর পাতা দিয়েই কিন্তু খড় বা শণ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে।
অর্থাৎ স্টাইলটা হবে খাঁটি দেশী কিন্তু বাড়িটা হবে যতদূর সম্ভব পোক্ত।
জেনকিন্স নাকি আজো বেঁচে আছে প্রায় নব্বই বছর বয়সে।
বছর পাঁচেক রবার্টসনের মেমসায়েবি করে, দুটি বাচ্চা বিইয়ে, আদালতী ডাইভোর্স-ব্যবস্থায় ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে ন্যান্সী কবে বিদায় নিয়েছিল সে নাকি এখন একজন বোম্বেওয়ালা লোহার কারবারির ঘর-সংসার করছে।
শাড়ি পরে। স্বামীর সঙ্গে ছাড়া কোনো নেমন্তনো যায় না, হোটেলে ঢোকে না।
বছর তিনেক আগে রবার্টসন হঠাৎ একটি তরুণী অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছিল।
মেয়েটি ছিল জনসনের টাইপিস্ট।
ইভা সত্যিই রূপসী। যেমন মুখের ছাদ, তেমনি ছিমছাম গড়ন। অনেকেই ভেবেছিল, মাঝবয়সী মাতাল রবার্টসনকে সে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে সেই চিরন্তন হিসাব কষেই যে, আরাম বিলাসের জন্য যেমন হোক একটা মানুষ হাতে ধরা থাকলে পছন্দসই তরুণের সাথে প্রেমের লীলা চালিয়ে যাওয়ার সুবিধা বাড়ে।
দু-একটা বিশ্রী কেলেঙ্কারি যে ঘটবে তাতে সন্দেহ ছিল না। কিন্তু তাদের সকলের হিসাব নিকাশ ভুল প্রমাণ করে ইভা দেখিয়ে এসেছে যে, একুশ বছর বয়সে তেতাল্লিশ বছরের একজন মাতালকে বিয়ে করলেও এবং গা বাঁচিয়ে কয়েকজন জোয়ানের লীলা খেলার মজা লুটবার সুযোগ থাকলেও, সে বিবাহিতা স্ত্রীলোকের সতীত্ব-ধর্মে একান্তভাবেই নিষ্ঠাবতী।
রূপযৌবনের যে মূল্য পেয়েছে তাতেই সে সন্তুষ্ট!
রবার্টসন বাঘ মেরে আনবে–তবু সেদিন কেন সে ক্লাবে যায় নি? এটা তো স্বামীর প্রতি হৃদয়গত বা নীতিগত আনুগত্যের প্রমাণ নয়!
দেহটা সেদিন কাবু হয়ে পড়েছিল ইভার।
লক্ষ্মণের দাওয়ায় বসে রবার্টসনেরা ওদিকে প্রতীক্ষা করছিল ভোর রাত্রে মেরে রেখে যাওয়া গরুটার টানে বাঘটার কখন শুভাগমন ঘটবে। এদিকে ইভা বিছানায় আছড়ে পিছড়ে কোকাতে কোকাতে ছটফট করছিল।
বেদনানাশক বড়ি ডবল ডোজে খাওয়ার পরেও দেড়ঘণ্টা পর্যন্ত।
প্রতি মাসের প্রাকৃতিক ঘটনা।
রবার্টসন ইতিমধ্যেই চিকিৎসার জন্য হাজার কয়েক টাকা খরচ করেছে।
বড় বড় ডাক্তার দেখিয়ে এত চিকিৎসার কোনো ফল হয় না দেখে তার মধ্যে বিরাগ ও বিতৃষ্ণার ভাব জাগছে টের পেয়ে ইভা গত কয়েক মাস থেকে তাকে বলে আসছে যে, সে আশ্চর্যরকম আরোগ্য লাভ করছে।
রোগ আর নেই বললেই হয়।
রবার্টসন চুটিয়ে কাজ করে। সে দু ঘন্টা দেরি করে কাজে গেলে, দু ঘন্টা আগে বেরিয়ে এলে, প্রশ্ন করার অন্য কেউ নেই। সবই তার খুশির ব্যাপার।
সে অবশ্য জানে যে, দু-চার দিন এরকম খেয়ালখুশির ব্যাপার চালিয়ে গেলে কিছুই আসবে যাবে না, কিন্তু এটাকে নিয়মে পরিণত করলে, কাজ করতে স্বাধীনভাবে যেমন খুশি অনিয়ম দু-চারটা মাস চালিয়ে গেলে, হঠাৎ একদিন তাকে প্রস্তুত হতে হবে অনেক দূরে এবং অনেক উপরে বসে আসলে যারা সবকিছু চালাচ্ছে তাদের কাছে কৈফিয়ত দেবার জন্যে। ওরা সব খবর পায়!
তার কৈফিয়ত গ্ৰহণযোগ্য কিনা সেটাও বিচার করবে ওরাই।
এফিসিয়েন্সির প্রশ্নে, ঠিকমতো কাজ চালিয়ে গিয়ে মুনাফা বাড়াতে না পারলেও অন্তত সেটা বজায় রেখে কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে, কোনোরকম কৈফিয়তের কিছুমাত্র দাম নেই ওদের কাছে।
কাজ নিয়ে, ক্লাব নিয়ে, শিকার-টিকারের ব্যাপার নিয়ে রবার্টসন সকাল থেকে অনেক রাত্রি পর্যন্ত বাইরে কাটায়।
ইভার পক্ষে জানিয়ে দেওয়া তাই সম্ভব হয়েছে যে, সে আর প্রতি মাসে বিছানা নেয় না, ব্যথায় কাতর হয়ে ছটফট করে না।
বাঘ শিকারের সব কাহিনীই ইভা সবিস্তারে শোনে মাঝরাত্রে ক্লাবে প্রভাস ও রবার্টসনের মারামারির কাহিনী পর্যন্ত।
বনানীর নিজে এসে প্রভাসকে সামলে-সুমলে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবার বিবরণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করে জেনে নেয়।
সকালে খাবার টেবিলে বসে রবার্টসনের প্রশ্নের জবাবে একটু রাগের ভান করে বলে, তোমার বড় বাড়াবাড়ি। অত খুঁটিনাটি জেনে তোমার কোনো দরকার নেই। মুখ শুকনো দেখাচ্ছে? জগৎসুদ্ধ মেয়েদের মুখ এ সময় শুকনো দেখায়।
সরি।
কয়েক মিনিট সাধারণ কথাবার্তা চালিয়ে যাবার পর ইভা জিজ্ঞাসা করে, বারটার পর গাড়িটা ঘণ্টাখানেকের জন্য পাঠাতে পারবে না? একটু ঘুরে আসব। দম যেন আটকে আসছে।
এই শরীর নিয়ে ঘুরতে যাবে?
আমার শরীর ঠিক আছে।
বারটা বেজে পাঁচ মিনিটের সময় দুলাল সিং গাড়িটা হাঁকিয়ে এনে গেটের সামনে দাঁড় করিয়ে মেমসাবকে সেলাম পাঠায়।
মিনিট পাঁচেক পরেই ইভা বেরিয়ে এসে জানায় যে, গাড়ি সে নিজেই চালিয়ে নিয়ে যাবে, একটা দেড়টার মধ্যে ফিরে আসবে।
দুলাল সিং বলে, বহুৎ আচ্ছা হুজুর।
চালকের আসনে বসে ইঞ্জিনে স্টার্ট দিয়ে গিয়ার বদলাতে গিয়ে ইভার বোধহয় খেয়াল হয়। যে, সে আজ তার বিবাহিত জীবনের এতদিনের নিয়মনীতি ভঙ্গ করছে।
মোটর হাকিয়ে এক বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে দেড় ঘণ্টা-দু ঘন্টার জন্য।
দুলাল সিংহ?
হুজুর?
ভিতরমে বৈঠো।
দুলাল সিংকে পিছনের সিটে বসিয়ে নিজে মোটর হাঁকিয়ে ইভা প্রভাসের প্রকাণ্ড বাগানওলা বাড়ির গেটে হাজির হয়।
নিয়মনীতি মানে না। সোজাসুজি জুতো পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় বনানীর রান্নাঘরের দরজায়।
বনানী স্নান সেরে গায়ে শুধু একটি শাড়ি জড়িয়ে মেঝেতে বসে তিতোর ডাল দিয়ে মাখা ভাতের গ্রাসটা সবে মুখে তুলছিল।
ইভা বলে, উঠ না ভাই, খাও। তুমি উঠলেই কিন্তু আমি চলে যাব, ওয়েট করব না।
পরিষ্কার বাংলা কথা। ছেলেবেলা থেকে সে বাঙালি পাড়ায় বাস করেছে, বাঙালি ছেলেমেয়ের সঙ্গে মিলেমিশে বড় হয়েছে।
তাই কি হয়? তুমি এসে দাঁড়িয়ে থাকবে–
আমি যদি বলি তোমার পাশে গিয়ে বসব, তোমার সঙ্গে বসে মাছ তরকারি দিয়ে ভাত খাব?–বলতে বলতে জুতো খুলে ঘরে ঢুকে ইভা বনানীর পাশে মেঝেতে বসে পড়েছিল।
তোমাদের কুলোবে তো? ওদের কম পড়বে না?
বনানী হেসে বলেছিল, তুমি জান না, তুমি বুঝবে না। কম পড়তেই পারে না। এ বাড়িতে কি নিয়মে রান্না হয় জান? ডিনারের সময় হঠাৎ দশজন আত্মীয়স্বজন হাজির হলে যেন বলতে পারি, নাইতে যান, খেতে আসুন।
আত্মীয়স্বজন রোজ আসে?
না, তা আসে না। তবু আসতে পারে ধরে নিয়ে ব্যবস্থা করে রাখা হয়। ওটাই নিয়ম।
বাড়তি রান্নাটা কি হয়?
বিলিয়ে দিই। উনি পছন্দ করেন না। বেশিদিন চালাতে পারব মনে হয় না।
দুরকম মাছ ছিল। ইভা শুধু মাছ দিয়ে সামান্য ভাত খায়।
বনানী বলে, দু টুকরো মাছ আর এইটুকু ভাত খাবার জন্য বসার কি দরকার ছিল? সঙ্কোচ বোধ করছ?
ইভা মাথা নেড়ে বলে, না না, শরীরটা খুব খারাপ। জানই তো আমার ব্যাপার।
ও, তাই বল। এই শরীর নিয়ে বেরিয়েছ?
ইভা বলে, বাঘ মারার ব্যাপারটা শুনে বড় খারাপ লাগছিল, তোমার সঙ্গে কথা বলতে এলাম। একটা বাঘ মারা নিয়ে দুজনে এরকম পাগলামি করবে? আমরা সামলাতে পারব না?
রাঁধুনীকে ডেকে মাছের পাত্ৰ আনিয়ে ইভার থালায় আরো কয়েক টুকরো মাছ তুলে দিতে দিতে বনানী বলে, খাও কিছু হবে না। বাঘ মারা নিয়ে কী কাণ্ড হয় দ্যাখ। শুনলাম নাকি ওদের কারো গুলি বাঘের গায়ে লাগে নি। ঈশ্বরের দেশী বন্দুকের গুলিতে বাঘ মরেছে।
ইভা আশ্চর্য হয়ে বলে, তাই নাকি। আর ওই বাঘ মারা নিয়ে এরা দুজনে ছেলেমানুষের মতো মারামারি করেছে!
বিকালে ক্লাবে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে হতে রবার্টসন ইভাকে বলে, কাল আমাদের মারামারি হল, আজ তুমি ওই রাস্কেলটার বাড়ি বেড়াতে গেলে?
তোমরা ছেলেমানুষের মতো মারামারি করবে, তাই বলে আমাকেও বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া করতে হবে?
ওর ওয়াইফ তোমার বন্ধু নাকি?
রবার্টসন পাইপ সাজাতে সাজাতে একটু বিস্ময়ের সঙ্গেই ইভাকে লক্ষ করে। তার সত্যই খেয়াল থাকে না যে ইভা আঁটি ইংরেজ মেয়ে নয়–সে এদেশে জন্মেছে এবং এদেশে মানুষ হয়েছে।