স্বপ্ন এবং বাস্তব
আমাদের বিশ্বাসসমূহে আমাদের আকাঙ্ক্ষার প্রভাব যদিও সধারণ জ্ঞান এবং পর্যবেক্ষণের বিষয়, তবু এ সকল বিশ্বাসের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করতে গিয়ে বিস্তর ভুল ধারণা পোষণ করা হয়েছে। রীতিগতভাবে আমরা ধরে নিই যে আমাদের বেশির ভাগ বিশ্বাসের পেছনে সত্যের অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে, যদিও আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো সাময়িক বিরোধসৃষ্টিকারী শক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু সোজাসুজি বিপরীত বিন্দুর কাছাকাছি কোথাও আসল সত্যের অবস্থিতি। যে সব বিশ্বাস আমাদের দৈনন্দিন জীবনধারণের প্রধান অবলম্বন, তাতে অনেক আকাক্ষা বিম্বিত হয়ে ওঠে, আবার সে আকাক্ষা সমূহই এখানে-সেখানে রূঢ় বাস্তবের কঠিন আঘাতে পরিশুদ্ধি লাভ করে। আদতে মানুষ স্বাপ্নিক, তবে বাইরের পৃথিবীর বিচিত্র সংঘাতে মাঝে মাঝে জেগে ওঠে, কিন্তু খুব শিগগীরই আবার কল্পনার সুখের জগতে স্বেচ্ছায় ঝাঁপ দেয়। ফ্রয়েড দেখিয়েছেন স্বপ্নের চিত্রায়নের মধ্যে আমাদের অপূর্ণ কামনারা পরিতৃপ্তি লাভ করে। দিবাস্বপ্ন সম্বন্ধেও তার কথা একইভাবে সত্য। তার উপসংহারে তিনি যেগুলোকে দিবাস্বপ্ন বলে আখ্যায়িত করেছেন, সেগুলোকে আমরা বিশ্বাস বলে ধরে নিতে পারি।
তিনটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে আমাদের মনের অচেতন স্তরের অন্বিষ্ট বিশ্বাসের বিশ্লেষণ সম্ভব। মনঃসমীক্ষণ (Psycho analysis) মনের উন্মাদ হিষ্টিরিয়াগ্রস্ত জটিল পরিস্থিতি বিশ্লেষেণ করে মনের ধ্রুব প্রকৃতির দিক দিয়ে সুস্থ ও রোগাক্রান্ত ব্যক্তির তফাৎ কত স্বল্প তাই দেখানো হয়। (Sceptical) সংশয়াত্মক পদ্ধতিতে দার্শনিকেরা আমাদের অন্তরলালিত বিশ্বাসসমূহের প্রমাণপঞ্জী যে কত দুর্বল তাই স্পষ্ট করে তোলেন। সর্বশেষ হলো সাধারণ পর্যবেক্ষণ (common observation) পদ্ধতি। এই সর্বশেষ পদ্ধতিটিই আমার বিবেচ্য বিষয় হিসেবে ধরে নিচ্ছি।
নৃতত্ত্ববিদদের পরিশ্রমের কল্যাণে আমরা সভ্যতার সৌরভবর্জিত আদিম অসভ্যদের সম্বন্ধেও জানতে পেরেছি। তারাও সজ্ঞানে অজ্ঞানতার অন্ধকারে বিচরণ করে না একথা সত্য; কিন্তু কোন কিছু সুস্পষ্টভাবে বুঝে ওঠার মতো তেমন প্রখরও নয় তাদের চেতনা। পক্ষান্তরে তাদের কাছে অসংখ্য সংস্কার, যা চেতনার গভীরে এত সুদৃঢ়ভাবে প্রোথিত যে জীবনের প্রায় সব প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত করে সে অন্ধবিশ্বাস। তাদের অনেকেরই ধারণা, কোন প্রাণী কিংবা যোদ্ধার মাংসভক্ষণ করলে ঐ প্রাণী বা যোদ্ধা জীবদ্দশায় যে-সকল গুণের অধিকারী ছিল তা আয়ত্ব করা যায়। আবার অনেকে দলপতির নাম মুখে আনাকে মৃত্যুদণ্ডনীয় পবিত্রতা হানিকর কাজ বলে মনে করত। এমনকি তারা রাজা বা দলপতির নামের কোন অংশের সংগে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাম উচ্চারণ করবার বেলায় ঐ অংশটির পরিবর্তন করে ফেলত। যেমন তাদের রাজার নাম জন, সুতরাং তারা জনকুইলকে উচ্চারণ করবে জর্জ কুইল ইত্যাদি ইত্যাদি। কৃষিভিত্তিক সমাজে পদার্পণ করার সঙ্গে সঙ্গে যখন তাদের খাদ্যের জন্য আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করতে হলো অত্যধিক পরিমাণে, তখন থেকে মন্ত্রোচ্চারণ এবং হোমাগ্নি জ্বালিয়ে রোদবৃষ্টির সঞ্চার করা যায় বলে তারা বিশ্বাস করতে থাকে। তারা আরো বিশ্বাস করত খুনী ব্যক্তির প্রেতাত্মা প্রতিশোধস্পৃহায় হত্যাকারিকে খুঁজে বেড়ায়। আবার অতি সহজ ছদ্মবেশে যেমন মুখ রাঙ্গিয়ে অথবা শোকের লেবাস পরে প্রতিশোধকামী প্রেতাত্মাকে ফাঁকি দেয়া যায়। খুনে ভীতুদের কাছ থেকে বিশ্বাসের অর্ধাংশের উৎপত্তি এবং বাকি অর্ধাংশের জন্ম দিয়েছে খুনীরা।
অযৌক্তিক বিশ্বাস শুধুমাত্র অসভ্যদের মধ্যে সীমিত নয়। মানব সমাজের অধিকাংশ মানুষ, যাদের ধর্মমত আমাদের মতো নয়, আমরা বলতে পারি ওগুলো অযৌক্তিক ভিত্তিহীন। রাজনীতিবিদ ছাড়া আর যারা রাজনীতিতে আগ্রহশীল, অসংখ্য প্রশ্নে তারা সংস্কারমুক্ত একজন মানুষ সম্পর্কে কোন যুক্তিসম্মত ধারণা পোষণ করতে পারে না। পরাজয়ের যতই ন্যায়সঙ্গত কারণ থাকুক না কেন, নির্বাচনের সময় স্বেচ্ছাসেবকেরা আশা পোষণ করে যে আপন পক্ষের জয় অবশ্যম্ভাবী। ১৯১৪ সনে জার্মানির অধিকাংশ নাগরিক বিন্দুমাত্র সন্দেহ না রেখে জার্মানির সর্বৈব বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত আশা পোষণ করেছিল, সে ক্ষেত্রে বাস্তব সত্যের সঙ্গে সংঘাতে স্বপ্ন মার খেয়েছে। অজার্মান ঐতিহাসিকেরা যদি কোনকারণে সে ইতিহাস রচনা থেকে বিরত থাকেন, তাহলে স্বপ্নের আবার পুনর্জাগরণ ঘটবে। প্রারম্ভিক বিজয়ের কাহিনী বারবার নিনাদিত হবে এবং অন্তিম পরাজয়ের কথা বেমালুম ভুলে যাবে।
শিষ্টাচার হলো মানুষের বিশ্বাসের সেই স্তরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা, বিশেষভাবে যা তার অথবা তার দলের অন্যান্যদের মেধার পরিচিতি বহন করে। যেখানেই থাকুক না কেননা বিশ্বাসের একটা বেষ্টনী প্রত্যেক মানুষকে ঘিরে থাকে। গ্রীষ্মের দিনে মাছির মতো এ সবও মানুষের সঙ্গে সঙ্গে গমন করে। এরই মধ্যে কতেক ব্যক্তিগত, তাতে ব্যক্তির গুণাবলী সূতাবোধ,বন্ধুপ্রীতি পরিচিতজনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ চরিত্রের গোলাপি সুষমা ইত্যাদি পরিচয় বিধৃত থাকে। তারপর আসে পারিবারিক সংস্কৃতিচেতনার কথা। ইদানীংকালে দুর্লভ তার বাবার ঋজু মনোভঙ্গী, ছেলেমেয়েদের মানুষ করার ব্যাপারে তারা অসম্ভব কড়াকড়ি, যা বর্তমানে পিতামাতার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হবে। স্কুলের খেলাধুলায় তার ছেলেরা কিভাবে আর সকলকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে এবং তার মেয়েরা যেমন যাকে তাকে বিয়ে করে না বসে ইত্যাদি, ইত্যাদি। তার ওপরে আসে তার শ্রেণীগত বিশ্বাসের কথা, যা তার সামর্থের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সামাজিক এবং অথবা সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান কিংবা নৈতিকতার দিক দিয়ে অন্যান্য সম্প্রদায়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি কাক্ষিত। যদিও সকলে একবাক্যে স্বীকার করে যে প্রথমটি দ্বিতীয়টির চেয়ে এবং দ্বিতীয়টি তৃতীয়টির চেয়ে অধিকতর কাম্য। জাতিগতভাবে মানুষ কতগুলো আনন্দিত কল্পনাকে বিশ্বাস বলে গ্রহণ করে। মানবমনের গভীর আকুতির ভাষারূপ দিতে গিয়ে একটি কথার মধ্যে মি. পডস্ন্যাপ (Mr. Podsnap) বলেছেন, ওহ্ বিদেশী জাতিগুলো, তাদের সম্পর্কে কিছু বলতে আমরা দুঃখিত, তারা এই করে, এই তাদের রীতি। নিরঙ্কুশ মানবিক অথবা পাশব সৃষ্টির তুলনায় সর্বনরের সাধারণ পরিচয়বিধৃত থিয়োরিসমূহে শেষপর্যন্ত আমাদের আসতে হয়। মানুষের আছে আত্মা, পশুর তা নেই। মানুষ বিবেচনাসম্পন্ন জীব বলেই তার কোন বিশেষ নির্দয় এবং প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজকেই পাশবিক বলা হয়, যদিও সেসকল কাজ আদতে মানবিক। স্রষ্টা তো আপন স্বরূপের প্রতিরূপেই যদিও মানুষ সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং মানুষের কল্যাণই হলো ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির চরম উদ্দেশ্য।
.
সুতরাং আনন্দদায়ক বিশ্বাসসমূহের অনুকূলে কাজ করে যাই আমরা। কারো সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক রাখতে হলে এ সকল বিশ্বাস যেগুলো তার নিজস্ব, পারিবারিক জাতীয় এবং যেগুলো সকল মানুষের জন্য সমানভাবে আনন্দদায়ক তার প্রতি অবশ্যই শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। কোন মানুষকে সামনে কিছু না বলতে পারলে তার পেছনেও কিছু বলা উচিত নয়। মনের সঙ্গে মনের দূরত্ব যত বেশি বাড়ছে মতের বিভিন্নতাও বাড়ছে তত বেশি। নিজের ভায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় তার পিতামাতার প্রতি সচেতন শ্রদ্ধাশীলতা পোষণ করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বিদেশীদের সঙ্গে কথা বলার সময় শিষ্টাচার প্রদর্শনের প্রয়োজন হয় সর্বাপেক্ষা বেশি, যা উগ্র স্বদেশীদের কাছে অসম্ভব, যেহেতু তারা তাতে অভ্যস্ত নয়। বাইরে ভ্রমণ করেনি, এমন একজন আমেরিকানের সঙ্গে একবার আমার দেখা হয়েছিল। সামান্য কয়েকটি বিষয় ছাড়া বৃটিশ সংবিধানের সঙ্গে আমেরিকান সংবিধানের কোন প্রভেদ নেই, একথা শুনে ভদ্রলোক ভয়ানক চটে গিয়েছিলেন। পূর্বে তিনি কখনো এরকম মতামত শোনেন নি এবং কেউ যে সে মতামত গ্রহণ করতে পারে তাও ছিল তার কল্পনার অতীত। আমরা দুজনেই শিষ্টতা দেখাতে অক্ষম হয়েছিলাম বলে ফল দাঁড়ালো মারাত্মক।
সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে শিষ্টাচার প্রদর্শনের অক্ষমতা খুবই খারাপ, কিন্তু প্রাচীন কুসংস্কারকে ছেদন করবার কারণে শিষ্টাচার প্রদর্শন না করাটা খুবই প্রশংসনীয়। দু’উপায়ে আমাদের স্বভাবজ বিশ্বাসই সমূহ পরিশুদ্ধি অর্জন করে। প্রথম হলো বস্তুর সঙ্গে বিশ্বাসকে যাচিয়ে নেয়ার পদ্ধতি, যেমন অনেকে বিছুটিকে ব্যাঙের ছাতা বলে মনে করে কষ্ট পেয়ে থাকে। দ্বিতীয়তঃ আমাদের বিশ্বাস সোজাসুজি বস্তুর সঙ্গে সংঘাত না বাধিয়ে ভিন্নমতের কারো সঙ্গে যখন সংঘাত বাধায় তা যাচাই করা। কেউ মনে করে শুকরের মাংস খাওয়া আইনানুগ আর কেউ গরুর মাংস খাওয়াকেই আইনানুগ মনে করে না। মতামতের এই বিভিন্নতার স্বাভাবিক পরিণতি হলো রক্তপাত। কিন্তু সে সঙ্গে বেরিয়ে আসবে একটি বিবেচনাপ্রসূত মাঝামাঝি পথ এবং তা অনেকটা এরকম, দুটোর কোনটাতেই দোষ নেই। শিষ্টাচারের সঙ্গে তার সম্বন্ধ হলো খুবই সুনিবিড়। তার মানে হলো যাদের সঙ্গে কথা বলছি তাদের চেয়ে নিজেদেরকে এবং নিজেদের ধনসম্পদকে নগণ্য দেখার ভান করা। একমাত্র চীনদেশেই এ নীতি সর্বত্র ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয়। আমাকে বলা হয়েছে যদি কোন চীনাকে তার স্ত্রী এবং সন্তানের স্বাস্থ্য পানের উদ্দেশ্যে কোন মান্দারিন যদি আক্রমণ করেন, তিনি বলবেন, আমার স্ত্রীর মতো একজন কৃপাকাঙ্খীনি রোগাক্রান্তা খর্বাঙ্গীনির স্বস্থ্যোলাসে আপনার মতো একজন মহানুভব ব্যক্তি আহবান করেছেন, সেহেতু আমার আনন্দের অবধি নেই। এ ধরণের লেহাজ দুরস্ত করে বলার জন্যে জীবনের আয়েশ এবং সম্মান দুইয়েরই প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান ব্যবসা আর রাজনীতির দ্রুত সংযোগের ব্যাপারে তা একেবারে অসম্ভব। ধাপে ধাপে অন্য মানুষের সঙ্গে সংসর্গের ফলে সবচেয়ে কার্যকরী ধারণা ছাড়া আর সবগুলো ধ্বংস হয়ে যায়, ব্যক্তিগত বিশ্বাস ভাইয়ের সঙ্গে মেলামেশার ফলে নষ্ট হয়ে যায়, পারিবারিক সংস্কার স্কুলের সতীর্থদের প্রভাবে নষ্ট হয়, শ্রেণীগত সংস্কার রাজনীতির প্রভাবে এবং জাতিগত সংস্কার যুদ্ধে পরাজয় অথবা অর্থনীতিতে মার খাওয়ার ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু মানবিক ধরণা সবসময়ে অটুট তাকে এবং মানুষের আদানপ্রদানের যে ক্ষেত্র তাতে নতুন সংস্কার জন্ম নেয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকে। এ ধরণের ভ্রান্তধারণার আংশিক পরিশুদ্ধি মিলে বিজ্ঞানে, কিন্তু তা কখন আংশিকের বেশি হতে পারে না। কিছু সংখ্যক বিশ্বাসের ভিত্তির উপর দাঁড় না করালে পরে বিজ্ঞান নিজের আঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।
.
০২.
মানুষের ব্যক্তিগত অথবা দলগত স্বপ্ন হাস্যাস্পদ হতে পারে, কিন্তু যারা সামগ্রিকভাবে মানবিকতার স্বপ্নে বিশ্বাসী তারাও মানবিকতার পরিমণ্ডলে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। জ্যোতির্বিদ্যার মাধ্যমে অন্তত ব্রহ্মাণ্ডের সম্বন্ধে আমাদের পরিচয় হয়েছে। টেলিস্কোপের মাধ্যমে যতটুকু দেখতে পারি তার বাইরে কি আছে কেউ বলতে পারে না। কিন্তু যেটুকু সম্বন্ধে আমরা জ্ঞান লাভ করতে পারি তা-ও অসীম অনন্ত। দৃশ্যমান ব্রহ্মাণ্ডের এক ভগ্নাংশ হলো ছায়াপথ, সৌরজগত হলো ছায়াপথের ক্ষুদ্রতর ভগ্নাংশ এবং এ সৌরজগতের ভগ্নাংশে আমাদের গ্রহটি হলো অনুবীক্ষণ। যন্ত্রের সাহায্যে প্রতীয়মান একটি কৃষ্ণকার বিন্দুমাত্র। এই ক্ষুদ্রবিন্দুতে একজাতীয় জলজ পদার্থের সঙ্গে পদার্থগত এবং রাসায়নিক গুণে সমৃদ্ধ অস্বাভাবিক গঠনের একজাতীয় কয়লার চাঙর নির্দিষ্ট কোন অবয়ব পরিগ্রহ করার আগ পর্যন্ত, কয়েক বছর ধরে নড়ে-চড়ে বেড়াত। তারা সময়কে বিভক্ত করে একদিকে নিজেরা অবয়ব রক্ষার এবং অপরদিকে সবকিছুকে তাদের মতো করে গড়ে তুলবার মানসে প্রচণ্ড সংগ্রাম পরিচালনা করতে থাকে। সাময়িক প্রাকৃতিক বিপর্যয় তাদেরকে হাজারে হাজারে ধ্বংস করে ফেলল। রোগ অকালে অনেককে ছিনয়ে নিয়ে গেল। এগুলোকে দুর্ভাগ্য বলে গণ্য করা হতো। কিন্তু মানুষ যখন নিজের চেষ্টায় সমপরিমাণ ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম হলো তখন তারা আনন্দিত হয়ে বিধাতাকে ধন্যবাদ দিল। সৌরজগতের বয়সের তুলনায় মানুষের যখন সশরীরে বসবাস সম্ভব হলো তা অকিঞ্চিৎকর। কিন্তু এমন বিশ্বাস করারও অবকাশ রয়েছে যে বর্তমানের আগেও মানুষ পৃথিবীতে বসবাস করে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ববিবাদের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। বাইরে থেকে দেখলে এভাবেই মনবজীবন সম্বন্ধে চিন্তা করা যায়।
আমাদের বলা হয়েছে যে জীবন সম্পর্কে এরকম দৃষ্টিভঙ্গি অসহনীয়, কেননা তার ফলে যে প্রবৃত্তির বলে মানুষ বেঁচে আছে, তারই ধ্বংসসাধন হবে। দর্শন এবং ধর্মের মধ্যে তারা এ প্রবৃত্তিকে এড়িয়ে যাবার পথ খুঁজতে চেষ্টা করেছেন। বাইরের পৃথিবীতে যথেষ্ট অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা থাকলেও তাদের কল্যাণে জানতে পেরেছি, পৃথিবীর মর্মমূলে একটা শৃঙ্খলাবোধ অবশ্যই আছে। আদি নিহারিকার যুগ থেকে প্রত্যেকটি দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের উন্নতি সাধিত হয়েছে একথা ধরে নেয়া হয়। ‘হ্যামলেট খুবই জনপ্রিয় নাটক, তাহলেও অল্পসংখ্যক পাঠকের মনেই প্রথম নাবিকের সংলাপ মনে থাকার কথা। যা মাত্র চারটি শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধঃ আল্লাহ্ আপনার মঙ্গল করুন। কিন্তু ধরুন একটা সমাজ, যেখানে প্রত্যেক মানুষের জীবনের একমাত্র কর্তব্য হলো এই ভূমিকায় অভিনয় করা, হোরেসিও কিংবা হ্যামলেটের সঙ্গে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দেখুন; তাহলে তারা কি বিশেষ ধরনের সাহিত্য সমালোচনা আবিষ্কার করবে না, যেখানে প্রথম নাবিকের চারটি শব্দই হবে নাটকের একমাত্র উপজীব্য বিষয়। তাদের সমাজে কোন লোক যে অন্যান্য অংশকেও সমান প্রয়োজনীয় মনে করে তাকে শাস্তি অথবা নির্বাসনদণ্ড কি দেবে না? হ্যামলেট নাটকে প্রথম নাবিকের উক্তি যেমন তেমনি ব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় মানুষের পরমায়ুও ততটুকু সংক্ষিপ্ত। আমরা নাটকের অন্যান্য দৃশ্য, চরিত্র এবং ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতে পারি না।
যখন আমরা মানুষের সম্পর্কে চিন্তা করি তখন প্রাথমিকভাবে নিজেদেরকে মানবজাতির প্রতিভূ হিসেবে ধরে নেই এবং তারপরে বিবেচনা করি যে তার নিরাপত্তার প্রয়োজন অপরিহার্য। ধরে নেয়া যাক, মি. জোনস হলেন এমন একজন মুদী দোকানদার, যিনি কোন গীর্জার শাসন মানেন না, কিন্তু তিনি তার অনন্ত জীবন সম্পর্কে একেবারে স্থির নিশ্চিত; তাই যে কেউ তার বিরোধিতা করলে তিনি তা মোটেই সহ্য করবেন না। কিন্তু তিনি যখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী এ্যাঙ্গলিকান গির্জার মি. রবিনসন, যিনি চিনিতে বালি মিশান, তার সম্পর্কে ভাবেন তখন তার অনুভূতিতে জেগে ওঠে যে ব্রহ্মাণ্ডের এখন সুবিচার পুরামাত্রায় বিরাজমান। তখন তার সুখের জন্য মি. রবিনকে আগুনে পোড়াবার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এভাবে মানুষের মহাজাগতিক প্রয়োজনসমূহকে রক্ষা করা হয়। কিন্তু বন্ধুত্ব এবং শত্রুতার মধ্যবর্তী প্রভেদগুলো দুর্বল এবং সার্বজনীন প্রীতির আবরণে ঢেকে রাখা যায় না। মি. রবিনসনও অংশতঃ বাদ দিয়ে মানুষের সুখ-সন্তুষ্টি মতবাদে বিশ্বাস করেন।
কোপার্নিকাসের পূর্ববর্তী সময়ে দর্শনে পৃথিবীর কেন্দ্রাভিমূখীতা রক্ষা করার কোন প্রয়োজন ছিল না। দৃশ্যমানভাবে জ্যোতিষ্কমণ্ডলী পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু পৃথিবী যখন কেন্দ্রীয় অবস্থান থেকে বিচ্যুত হলো মানুষও তার প্রাধান্য থেকে ছিটকে পড়ল। তাই বিজ্ঞানের স্থূলতা নিরসনের জন্য একধরনের মননশীল শক্তির প্রয়োজন দেখা দিল।
যারা এ মহৎ কর্তব্য করার গৌরব অর্জন করলেন, তাদেরকে বলা হয়ে থাকে আদর্শবাদী। বিশ্বে যা কিছু চোখে দেখা যায়, তাঁদের মতে সব কিছুই অলীক। পক্ষান্তরে, আমাকেই তারা একমাত্র সত্য হিসেবে ধরে নিলেন। এই আত্মিক শক্তিতে বলবানেরা সাধারণের উপর প্রভাব বিস্তার করলেন। গৃহের চেয়ে ভালো কোন স্থান খুঁজে না পেয়ে তারা শেখালেন সব জায়গা গৃহের মতো হেগেল পৃথিবীকে তার সমকালীন প্রাশ্যান সাম্রাজ্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন বেশি জোর দিয়ে। এসব মতবাদের স্বপক্ষে এত ফাপান-ফোলান যুক্তি প্রদান করা হয়েছে, স্বয়ং মতবাদ প্রণেতারা নিজেদেরকে মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা থেকে বিযুক্ত করে রেখেছেন। তর্কের নীরস কচকচি থেকে উপসংহার হিসেবে এসব মতবাদের সৃষ্টি। ভুলভ্রান্তি দিয়েই আকাঙ্খর ঐকান্তিকতাকে যাচাই করা হয়। হিসাবের বেলায় একজন মানুষ তার স্বার্থের বিপক্ষের বদলে স্বপক্ষেই ভুলটা করে বেশি। যখন একজন মানুষ যুক্তির মাধ্যমে অগ্রসর হয়, তখন তার আশা-আকাঙ্ক্ষা যে দিকে নাগাল পায় না, সে দিকে অগ্রসর হওয়ার চেয়ে আকাক্ষার স্বপক্ষে ভুলত্রুটির মধ্যে জড়িয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক।
অনেকে বলতে পারেন, আবিস্কৃত পদ্ধতিগুলো যদি অসত্য হয় তাহলেও সেগুলো তো কারও ক্ষতি করে না বরঞ্চ উপভোগ্য, সেজন্য ওসবের বিরোধিতা করা উচিত নয়। প্রকৃত ক্ষতিকারক না হয়ে আনন্দ দিতে সক্ষম হলে এর ঋণ শোধ করতে হয়। আংশিকভাবে নৈসর্গিক অবস্থা থেকে এবং আংশিকভাবে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষের ফলেই জীবনে দুঃখ বেদনার সৃষ্টি হয়। সাবেক যুগে মানুষকে খাবারের প্রতিযোগিতায় যুদ্ধে নামতে হতো এবং জয়ী হতে না পারলে তারা খাবার পেত না। বর্তমানে বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ফলে প্রকৃতি যা দিতে শুরু করেছে, একজন দু’জন না করে সামগ্রিকভাবে সকলে যদি একসঙ্গে বিজ্ঞানের সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, তাহলে মানবসমাজকে অধিকতর সুখী এবং সমৃদ্ধিশালী করে গড়ে তোলা যাবে। অন্য মানুষের সঙ্গে সংগ্রামে প্রকৃতিকে সহায় অথবা, শত্রু হিসেবে ব্যবহার করার মধ্যে পৃথিবীতে মানুষের আসল অধিকার সূচিত হয় না। তা হলে, শক্তির বৈজ্ঞানিক প্রতীতি থেকে তার দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ধাবিত হয়, অথচ বৈজ্ঞানিক সংগ্রামের মাধ্যমেই পৃথিবীতে স্থায়ী কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করা যায়।
ব্যবহারিক যুক্তিসমূহ বাদ দিলে সুখের সন্ধান করার যে প্রবৃত্তি তা অসত্য বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়, যা মহৎ গৌরবান্বিত দু’টার কোনটাই নয়। পৃথিবীতে মানুষের সত্যিকারের স্থান কোথায় তা চিন্তা করে যারা সংস্কারের দেয়ালে আত্মরক্ষা করে এটা তাদের কাজে দুর্লভ জীবনের বলিষ্ঠ আনন্দের আস্বাদ। পক্ষান্তরে যারা চিন্তা দুর্ণাব্য সমুদ্রে পাড়ি জমাতে সাহস করে, তারাই আপন শক্তিহীনতার মুখোমুখি নির্ভয়ে দাঁড়াতে পারে। সর্বোপরি এতে ভয়ের পীড়ন থেকে মুক্তি মেলে-যে ভয় দিনের আলোকে ঢেকে রাখে এবং মানুষকে অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর করে। যে মানুষ পৃথিবীতে তার স্থান কোথায় খুঁজে পায় না সে কখনও ভয় থেকে মুক্তি পায় না, সে কখনও সম্ভাব্য মহত্ব অর্জন করতে পারে না।