০২. সেদিন সকাল হইতে মেঘ করিয়াছিল

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

সেদিন সকাল হইতে মেঘ করিয়াছিল–কিন্তু বৃষ্টি হয় নাই। সুন্দর একটা ছায়াঘন আমেজে গ্রামটা ঝিমাইতেছিল। পাখির ডাক শোনা যাইতেছিল কম। কেবল বহু উঁচুতে প্রায় মেঘের গায়ে গায়ে কয়েকটা চিল উড়িতেছিল। কাদের মিঞার ক্ষেতের পাশে কাজল একবার থামিল। কাদের তাহার শালার সহিত নিড়ান দিতেছে ক্ষেতে। কাজলকে দেখিয়া কাদেরের শালা বলিল–বাড়ি চলে যাও কর্তবাবা-বিষ্টি হতে পারে। কাদের আপত্তি করিয়া বলিল—পানি হবে না মোট-দেখছো না চিল উড়ছে ওপরে। ডানায় পানি পালি নামি আসত। নিচপানে। আরহাওয়াতত্ত্ব সম্বন্ধে তাহদের আলাপ করিতে দিয়া কাজল হাটতে লাগিল মেঠোপথ ধরিয়া। ওই পথটা গিয়াছে আষাঢ়-এই পথটা ঘুরিয়া গিয়াছে নদীর দিকে। একটা বড়ো গাছ রহিয়াছে দুইটা পথের সঙ্গমস্থলে। জায়গাটা কাজলের বড়ো ভালো লাগে। গ্রামের যাবতীয় লোক এই পথ দিয়া আষাঢুব হাটে গিয়া থাকে। অচেনা লোকও যায় কত। ভিন-গাঁ হইতে মালপত্ৰ কাঁধে করিয়া আলের পথ মাঠের পথ ধরিয়া এখানে আসে। এখান হইতে কাঁচা পথ ধরিয়া চলিয়া যায় হাটে। পণ্যাদি কাঁধে হাটমুখী জনস্রোত দেখিতে কাজলের বেশ লাগে।

খানিকক্ষণ সেখানে বসিয়া কাজল একবার নদীর পথে কিছুদূর হাঁটিয়া আসিল। ফিরিয়া আসিতে আসিতে দেখিল একজন লোক আষাড়ুর পথ হইতে নামিয়া গ্রামের দিকে চলিয়া গেল। বুকটা তাহার একবার কেমন করিয়া উঠিল। দৌড়াইয়া আগাইযা গেল সে-এইবার লোকটার পিছনে আসিয়া পড়িয়াছে। বহুদিনের অনভ্যাসের ফলে শব্দটা যেন জিভ দিয়া আর বাহির হইতেছে না। মাথার মধ্যে কেমন করিতেছে। পথের পাশে জঙ্গল হইতে বাতাস অজস্র বন্যপুষ্পের গন্ধ বহিয়া আনিতেছে! একটা ধাক্কা দিয়া কাজল শব্দটা বাহির করিল–বাবা!

অপু বিদ্যুৎস্পষ্টের ন্যায় ফিরিযা তাকাইল। এই ডাকটার জন্য সে ছুটিযা আসিতেছে পৃথিবীর আর এক প্রান্ত হইতে। সমুদ্রের ফেনোচ্ছিল। উর্মিমালা, বিষুব-মণ্ডলীব দেশেব তারকাখচিত তমিত্ৰ বাত্ৰিব আকর্ষণ, উষ্ণ বালুকীয় শুইয়া উপরে নারিকেল পাতায় বাতাসেব মর্মরধ্বনি শুনিবার অদ্ভুত অনুভূতিসব সে ত্যাগ করিয়া আসিয়াছে। এই ডাকটা শুনিবার লোভেই তো। সে থাকিতে পাবে নাই।

অপুর হাত হইতে ব্যাগ আর বাক্স পড়িয়া গেল ধূলায়। পথের মধ্যে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া সে দুই হাত সামনে বাড়াইয়া দিয়া চোখ বুজিল। পরীক্ষণেই কাজল ঝাপাইয়া পড়িল অপুর বাহুবন্ধনে।

চিলগুলি ঘুরিয়া ঘুরিয়া নামিয়া আসিতেছিল নিচে। এইবার বৃষ্টি নামিবে।

সন্ধ্যান্য রানির রান্নাঘরের দরজায় পিঁড়ি পাতিয়া বসিয়া অপু গল্প করিতেছিল।

-আর পারলাম না থাকতে রানুদি! সে কী টান, তা যদি একবার বুঝতে! যা দেখি যা করি, সবই যেন কেমন ফাঁকা আর অর্থহীন লাগে। সেই বাড়িতে এনে তবে ছাড়ল।

রানি হাসিয়া বলে–আর আমরা বুঝি কেউ নই?

-কে বলেছে একথা রানুদি? তোমরা সবাই মিলে আমার জীবন সার্থক করে তুলেছি। কোথায় যেত আজ কাজল-তুমি না থাকলে? তোমার দান কি ভোলবোর? মায়ের স্নেহ দিয়ে আমাদের দুজনকেই ঘিরে রেখেছি তুমি।

রানির গলার কাছে হঠাৎ একটা কী কুণ্ডলী পাকাইয়া ওঠে! এত সুখের দিনও ভগবান তাহার কপালে লিখিয়াছিলেন। পরে সামলাইয়া বলে-এই নে, এ দুটো পরোটা আগে খা, তারপর গরম গরম ভেজে দিচ্ছি–

রাত্রে ছেলেকে লইয়া শোয় অপু। অনেক রাত্রি পর্যন্ত কাহারও ঘুম আসে না। বৈকালে একবার খুব ঝড় হইয়া বৃষ্টি নামিয়াছিল। তাই গরম নাই তত। জানালার পাশে শুইয়া আকাশে নক্ষত্রগুলি দেখা যায় স্পষ্ট। মধ্যপ্রদেশ হইতে ফিরিয়া একই নক্ষত্র কলিকাতার আকাশে দেখিয়া তাহার কেমন অবাক লাগিয়াছিল। আবার ফিজি ঘুরিয়া আসিয়া এই নক্ষত্রগুলিকে কেমন চেনা-চেনা অথচ অনেক দূরের বলিয়া মনে হইতেছে। বিদেশে ইহারাই ছিল তাহার সঙ্গী-এই নক্ষত্র, মুক্ত উদার আকাশ, প্রান্তরের বুকের উপর দিয়া বহিয়া যাওয়া ভবঘুরে বাতাস। সেও সুন্দর জীবন-সে যে জীবন চাহিয়াছিল, সেই জীবন। কিন্তু এখন কাজলের পাশে শুইয়া তাহার উদ্দাম জীবনের গতিবেগ কিছুটা প্রশমিত করিতে ইচ্ছা করিল। কোথায় ফেলিয়া যাইবে একে? একবার গিয়া তো মর্মে মর্মে অনুভব করিয়াছে নাড়ির টান। শৈশবে বাবা অনেকদিন বাড়ি না। আসিলে তাহার রাগ হইত-অভিমান হইত। বাড়ি ফিরিয়া অনেক চেষ্টা করিয়া হরিহরকে অপুর রাগ ভাঙাইতে হইত। এখন বড়ো মমতা হয়। হরিহরের প্রতি। বাবা কি আর ইচ্ছা করিয়া আসিত না! সংসার চালাইবার দুৰ্বহ প্ৰয়াসে বাবাকে কোথায় না ঘুরিতে হইয়াছে।–কী না করিতে হইয়াছে। বেচারী বাবা-তাহারও কত ইচ্ছা করিত অপুকে দেখিতে। আসিতে পারিত না শুধু কাজের চাপে। বই-খাতা বগলে তালিমারা ছাতা হাতে স্থান হইতে স্থানান্তরে বেড়াইত কাজেব সন্ধ্যানে। আজ অপু লেখক হইয়াছে।-বই বাজারে কাটিতেছে মন্দ নয়, তাহার চাইতে বেশি মিলিতেছে প্ৰশংসা। কত বৎসর পরে তাহদের বাড়ির লোক আজি সচ্ছলতার মুখ দেখিতেছে। কিন্তু বাবাকে দেখানো গেল না। এই সব দিন-বাবা বাঁচিয়া থাকিলে বৃদ্ধ হইয়া যাইত, তাহাকে অপু শিশুর মতো পরিচর্য কবিত। থোক-কাজলের মধ্য দিয়া সে তাহার শৈশবে হারাইয়া যাওয়া পিতাকে খুঁজিয়া পাইয়াছে। তাহাকে মনের মতো করিয়া মানুষ করিতে হইবে।–ঠিক যেমন করিয়া সে চায়, তেমনি করিয়া। ভাবিয়াছিল, গ্রামে না। রাখিয়া কাজলের প্রতি সে অন্যায় করিতেছে। গ্রামে হয়তো কাজলের শিশুমন পূর্ণভাবে বিকশিত হইয়া উঠিবার সুযোগ পাইবে। তাই ছেলেকে কলিকাতার অসুন্দর পরিবেশ হইতে আনিয়া একেবারে প্রকৃতির মধ্যে ছাড়িয়া দিয়াছিল। এখন ভাবিল, এইভাবে রাখিলে উহার পড়াশুনা কিছুই হইবে না। বরং কোন একটা ছোট শহরে লইয়া যাই। মাঝে মাঝে গ্রামে লইয়া আসিবা-মাঝে মাঝে বেড়াইতে লইয়া যাইব দূরে। তাহাতে উহার চোখ ভালো করিয়া ফুটিবে। সব দিক দিয়াই ছেলেকে চৌকস করিয়া তোলা প্রয়োজন।

পরের দিন। সারাবেলা অত্যন্ত গরম ছিল–কোথাও বাহির হওয়া যায় নাই। বিকালের দিকে বোদ একেবারে কমিয়া গেলে অপু ছেলেকে জিজ্ঞাসা করিল–বল দেখি কোথায় বেড়াতে যাওয়া। যায়? পরে নিজেই খানিকক্ষণ ভাবিয়া বলিল–চল, আগে বেরুই তো, তারপর দেখা যাবে। নে, হাতীমুখ ধুয়ে জামাটা পরে নে।

নিজের শার্টটা আনিবার জন্য ঘরে ঢুকিতে গিযা কী মনে করিয়া জেবে ডাকিল-রানুদি!

রানি ভিতরে ছিল, আসিয়া বলিল–কী? আবে, বেবুচিছস বলে মনে হচ্ছে।

–রানুদি, একটা জিনিস খেতে বড়ো ইচ্ছে করচে, খাওয়াবে?

–ও মা? সে আবার কী কথা। খাওয়াবো না কেন। বল না-

–গরম পড়েছে খুব, একটু আমপোড়া-শরবৎ খাওয়াবে?

—আমপোড়া-শরবৎ। সে আবার কী রে! কখনও শুনি নি।

–আমাদের এদিকে খায় না। বাবা পশ্চিম থেকে শিখে এসেছিলেন। পশ্চিমে খুব খায়। বাবা মাঝে মাঝে মাকে করতে বলতেন। তুমি বানাও রানুদি, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।

-করচি। এই সামান্য ব্যাপার, আমি ভুবি কী না কী খেতে চাইবি।

–এটা কিন্তু সামান্য ব্যাপার নয় রানুদি।। কতদিন খাইনি বলো তো? ছোটবেলায় মাঝে মাঝে মা করে দিতেন। আমাদের অবস্থা কী ছিল সে তো তুমি জানেই। নিজেদের বাগান ছিল না, ঘরে সব সময় চিনিও থাকত না–আমপোড়া-শরবৎ তখন একটা বিরাট বিলাসিত। কালেভদ্রে হলে খুব ভালো লাগতো। আজ বানাও তো রানুদি। খেয়ে দেখি, ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে কি না। খোকাকেও একটু দিয়ো–কাঁচা আম আছে তো?

–সে তোকে ভাবতে হবে না। কাল এক ঝুড়ি আম দিয়ে গিয়েছে তুলসীর মা।

কাজল আসিয়া বলিল–বাবা, তোমার হয়েচে? আমার এই বোতামটা লাগিয়ে দাও, আমি পারাচি নে–

অপু হাসিতে হাসিতে বলিল–দেখেচো কাণ্ড বানুদি? উলটো ঘরে বোতাম লাগিয়ে বসে আছে। হ্যাঁরে, তোর বুদ্ধিসুদ্ধি কবে হবে?

একটু পরে বারান্দায় বসিয়া শরবতে প্রথম চুমুক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেবেলাটা ফিরিয়া আসিল। অপু চোখ বুজিয়া আমপোড়ার সোদা গন্ধ উপভোগ করিতেছিল। এই গন্ধটা কেমন পুরাতন দিনগুলিকে মনে পড়াইয়া দেয়। সেই দাওয়ায় চাটাই পাতিয়া বসিয়া তালের বড়া খাওয়া, সেই মাটির দোয়াত হাতে প্ৰসন্ন গুরুমশায়ের কাছে পড়িতে যাওয়া। কত কথা মনে পড়ে। রাত্রে প্রদীপের আলোয় বসিয়া পড়িতে পড়িতে কানে আসিত মায়ের খুন্তি নাড়িবার শব্দ। বিদেশ হইতে বাবা আসিলে অপুর অত্যস্ত আনন্দ হইত। রাত্রে বিছানায় শুইয়া অনেক রাত্রি পর্যন্ত শুনিত বারান্দায় বসিয়া বাৰা গান করিতেছে।

আর একজনের কথা মনে পড়ে!

বাংলা দেশ হইতে বহুদূরে তারকাখচিত আকাশেব নিচে সমুদ্রবেলায় শুইয়া থাকিতে থাকিতে হঠাৎ একসময় তাহার। তন্দ্রার ঘোরে। মনে হইয়াছে, সে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। সে বদলায় নাই, বয়স বাড়ে নাই। তাহার চোখের দৃষ্টির পরিবর্তন হয় নাই। তাহার আঁচলে বাধা নাটাফলগুলির সংখ্যা একটিও কমে নাই। সে অপুর সামনে দাঁড়াইয়া হাসিতেছে।

তন্দ্ৰা ছুটিয়া গেলে অপু অবাক হইয়া আকাশের দিকে চাহিত। সমস্ত দুঃখের দিনে উদার আকাশ তাহকে শান্ত করিয়াছে। দেখিত, বাংলার আকাশের সহিত বিদেশের আকাশের কোন প্রভেদ নাই। দেখিত, তাহার দিদির দৃষ্টি যেন ক্ৰমশঃ আনীহারিকাসৌরচরাচরে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িতেছে। এইমাত্র এইখানে ছিল—তাহার ঘুম ভাঙিতে দেখিয়া দূরে সরিয়া গিয়াছে।

–বেড়াতে যাবে না। বাবা?

ছেলেকে কাছে টানিয়া লইয়া অপু বলিল–চলো বাবা, যাই।

পথে বাহির হইয়া বলিল–আমরা যদি এখান থেকে চলে গিয়ে অন্য জায়গায় থাকি, তবে তোর মন খারাপ হবে–না রে?

কাজল প্রথমে অবাক হইয়া গেল। চলিয়া যাইবাব কথা উঠিতেছে কেন? অবশ্য বাবা যেখানে আছে, এমন জায়গায় থাকিতে তাহার খারাপ লাগিবে না, কিন্তু পিসিকে ছাড়িয়া থাকা বড়ো কষ্টের।

–কোথায় যাবো বাবা?

কোথায় যাওয়া হইবে তাহা অপুও কিছু ভাবে নাই। গ্রাম ছাড়িয়া বেশিদূর যাওয়া হইবে না, আবার কলিকতাও কাছে হইবে–এমন স্থানের সন্ধান সে মনে মনে করিতেছিল। ছেলের প্রশ্নের জবারে সংক্ষেপে বলিল–আমিও তাই ভাবচি রে।

গ্রাম ছাড়িয়া বেশিদূর যাওয়া ঘটিবে না–সে যাইতে পরিবে না। বার যার তাহাকে ভিক্ষুকের মতো ফিরিয়া আসিতে হইয়াছে নিশ্চিন্দিপুরে। এ গ্রামের প্রকৃতি তাহার কাছে জীবনধারণের জন্য বাতাসের মতো প্রয়োজনীয়। তবুও ছেলের কল্যাণের জন্য যাইতেই হইবে বাইরে। ভালো স্কুলে না। পড়িলে কাজলের চোখ ফুটিবে না। দেওয়ানপুর স্কুলের মিঃ দত্ত-র কাছে সে নিজে ঋণী; বৃহত্তর জীবনে প্রবেশের মুখে তিনি তাহাকে প্রস্তুত করিয়া দিয়াছিলেন। কাজলকে সে নিজে তৈয়ারি করিয়া দিবে।

নদীর ধারে যাইবার পথে আধ্যবয়সী স্থূলবপু এক ভদ্রলোক ডাকিয়া নমস্কার করিলেন–আপনিই তো অপূর্ববাবু?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনাকে তো আগে এ গ্রামে দেখিনি বলেই বোধ হচ্ছে। নতুন এসেছেন বুঝি?

—নতুনই বটে। তাও ধরুন গিয়ে খুব নতুন আর কী! বছর কয়েক তো হয়ে গেল। আমার নাম রাধারমণ চাটুজ্যে। বরাবরের নিবাস ঝাপড়দহর কাছে, গ্রামে, তা সে মশাই এমন ম্যালেরিয়া যে কী বলব। দেখা দেখা করে একেবারে গ্রাম উজাড়–

–ও।

–হ্যাঁ। তারপর আর সে গ্রামে ভরসা করে বাস করা–বুঝলেন না? তাও গিন্নি বলেছিলেন, যেখানে যোচ্ছ সেখানে কি আর জুরজারি নেই? কথাটা অবশ্য মন্দ বলে নি, কী বলেন?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। ঠিক কথাই বলেছেন। উনি।

–মশাই শুনলাম দেশ-বিদেশ অনেক ঘুরেছেন, একদিন গল্প শুনতে যাবো। সেজন্যেই মশায়ের সঙ্গে আলাপ করা।

–দেশ-বিদেশ আর কী, সে এমন কিছু নয়। তবে যাবেন নিশ্চয়ই, তার জন্য আর বলার কী আছে?

এই শুরু হইল। রাধারমণ তো আসিলই, সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম হইতে অন্যান্যরাও একে দুয়ে আসিয়া হাজির হইল। ঘরে প্রায়ই নতুন মুখ দেখা যাইতেছে। অনেকেই যাচিয়া আলাপ করিতেছে। অপু যেখানে গিয়াছিল, তাহার ভৌগোলিক অবস্থান সম্বন্ধে জ্ঞান সকলেরই প্ৰায় একপ্রকার। সবাই জানিতে চায় দেশটা কেমন, পৌঁছাইলেই ধরিয়া তাহারা স্লেচ্ছ করিয়া দেয় শোনা গিয়াছে, এ কথা কতদূর সত্য? একদিন সন্ধ্যাবেলা একজন প্রতিবেশী আসিয়া হাজির হইল, সে কাহার কাছে শুনিয়াছে বিলাতে অমাবস্যার রাত্রে রামধনু দেখা যায়। অপু সদ্য বিদেশ হইতে আসিয়াছে–অতএব সত্যমিথ্যা যাচাই করিবার জন্য সে ছাড়া উপযুক্ততর লোক আর কই?

অপু শুনিয়া হাসিয়া বলিল–বিলেত যাকে বলে ঠিক সেখানে তো আমি যাই নি। আর তাছাড়া রাত্তিরে রামধনু, কী করে দেখা সম্ভব? রামধনু তৈরি হয় কী ভাবে? জলকণার ওপর আলো–

একঘণ্টা সময় লাগিল। অনেক পরিশ্রম করিয়া বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা দেওয়ার পর শ্রোতার মাথা নাড়ার ভাব দেখিয়া গত একঘণ্টার পরিশ্রমের সার্থকতা সম্বন্ধে অপুর কেমন একটা সন্দেহ জন্মিল। বুকুক আর নাই বুকুক, লোকটা ইহার মিনিট দুই পরে বিদায় লইল।

গ্রাম হইতে বিদায় লইতে হইবে বলিয়া অপু ছেলেকে লইয়া দুইবেলা পথে পথে বেড়ায়। রাস্তায় লোকে তাহার সহিত আলাপ করিয়া তাহার আশ্চর্য ভ্রমণবৃত্তান্ত শুনিতে চায়। অপু কাহাকেও নিরাশ করে না। সে জানে ইহাদের মধ্যে অনেকেই সারাজীবনে বাংলাদেশের বাহিরে পা দেওয়ার সুযোগ পাইবে না। ভাবিয়া তাহার দুঃখ হয়। এই সহজ মমত্ববোধের ফলে সে কয়েকশতবার। কথিত গল্প পুনরায় হাসিমুখে করিতে থাকে।

অপু বলি-বলি করিয়াও কথাটা রানিকে বলিতে পারিতেছিল না। চলিয়া যাইবার কথা শুনিলে রানি যে আদৌ সুখী হইবে না। ইহা অপুর জানা ছিল বলিয়াই কথাটা সে সাহস করিয়া রানির নিকট তুলিতে পারিতেছিল না। যাইবার সময় আচমকা না বলিয়া এখন হইতে আভাস দিয়া রাখা ভালো। অথচ সাহসের অভাব। দুই-চার দিন বলি বলি করিয়া অপু রান্নাঘরের সামনে ঘোরাফেরা করিল, তারপর, একসময় দুর্গানাম করিয়া কথা পাড়িয়া ফেলিল।

-একটা কথা ছিল রামুদি।

রানি তোরঙ্গ গোছাইতেছিল। অপুর গলার স্বরে এবং মুখভাগে বিস্মিত হইয়া তাকাইল।

-কী কথা রে?

অপু একটা ঢোঁক গিলিল–এই মানে-কাজলের পড়াশুনোটা এবার ভালোভাবে শুরু করে দেওয়ার দরকার।

–তাতে কী?

–না, বলছিলাম কী, ওকে এখন থেকে একটু-মানে একটু ভালো স্কুলে তো পড়াতে হবে। তাই রানুদি, ভাবছি কিছুদিনের জন্য শহর এলাকায় বাসাভাড়া করে থাকব। আগামী হণ্ডায় হয়তো রওনা দিতে হবে। বুঝতেই পারছি, ছেলেটার পড়াশুনো তো হওয়া দরকার।

রানি কোনো কথা বলিল না, তেরঙ্গের ডালা খোলাই রাখিয়া বিছানায় আসিয়া বসিল, মুখটা রহিল খোলা জানালার দিকে। তাহার অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গি দেখিয়া মনে হইতে পারিত অপুর কথা তাহার কানো যায় নাই, সে অন্যমনস্কভাবে বাহিরের কাঁঠালগাছটা দেখিতেছে মাত্র।

অপু জিজ্ঞাসা করিল–রাগ করলে রানুদি?

অপু ভাবিয়ছিল রানুদি কাঁদিয়া ভাসাঁইয়া দিবে, রানি মুখ ফিরাইলে দেখিল তাহার চোখে জল নাই।

হাত দিয়া বিছানার চাদরটা মসৃণ করিতে করিতে রানি বলিল–না রে, রাগ করিনি। রাগ করবো কেন? তুই কি পাগল হলি অপু? এতে তো কাজলেরই ভালো হবে, ওর লেখাপড়া কি কিছু হবে এখানে থাকলে?

একটু থামিয়া বলিল–তাছাড়া পরের জিনিস আর কতদিন নিজের কাছে রাখব? মায়া পড়ে গেলে ছাড়তে যে বড়ো কষ্ট হবে। তার চাইতে তুই এখনই নিয়ে যা–

এত সহজে ব্যাপার মিটিয়া যাইবে অপু আশা করে নাই। যাই হউক, রানুদি যে চলিয়া যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বুঝিতে পারিয়াছে তাহাই যথেষ্ট। অপু বলিল–মাঝে মাঝে এখানে নিয়ে আসবে রানুদি, প্রত্যেক ছুটিতে আসবো। আমারই বা কে আছে বলো তুমি ছাড়া? বরং তখন তুমি বিরক্ত হয়ে উঠবে দেখো–

একটু পরেই হাতপাখা চাহিবার জন্য ঘরে ঢুকিতে গিয়া অপু চৌকাঠেই দাঁড়াইয়া গেল। বিছানার ওপর উপুড় হইয়া রানি ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতেছে।

অনেক ভাবিয়া অপু মালতীনগরে যাওয়া স্থির করিয়াছিল। মালতীনগর জায়গাটা এখনও পুরা শহর হইয়া উঠিতে পারে নাই, তবে শহবের সুবিধা মোটামুটি প্রায় সমস্ত পাওয়া যায়। অনেক বাড়িঘর, মানুষ-জন ও হাট-বাজারের মধ্যে গ্রাম হইতে শহরের স্পৰ্শই বেশি। নিশ্চিন্দিপুর হইতে অবশ্য খুব কাছে হইল না। কিন্তু কী আর করা যায়। সব সুবিধা দেখিতে গেলে চলে না। কিছুদিন আগে অপু মালতীনগর স্কুলে গিয়া হেডমাস্টার মহাশয়ের সঙ্গে কথা বলিয়া আসিয়াছিল। সেখানকার ব্যবস্থা তাহার পছন্দ হইয়াছে। ভর্তি করাইবার যাবতীয় ব্যবস্থা করিয়া ফিরিতে ফিরিতে হঠাৎ একটা কথা ভাবিয়া তাহার খুব অবাক লাগিল। সে আজ ছেলেকে ভর্তি করাইবার জন্য ঘুরিতেছে, ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভাবিতেছে। আশ্চর্য, এই কিছুদিন আগে তাহার কথাই তাহার মা-বাবা চিন্তা করিয়াছে। সত্যই সে অনেক বড়ো হইয়া গিয়াছে। অথচ সন্তানের পিতার যতটা গভীর ও রাশভারী হওয়া উচিত, তাহা সে বিস্তর চেষ্টা করিয়াও হইতে পারিতেছে না। রাশভারী মুখ করিষ্কার চেষ্টা করিল, হইল না। খানিক পরে নিজেরই হাসি পাইল। আসলে সে বৃদ্ধ হয় নাই, তাহার পক্ষে বৃদ্ধ হওয়া সম্ভব নহে।

বিদায় লইবার পালা বেশ কয়েকদিন ধরিয়া চলিল। রানি ভালোমন্দ রান্না করিতে লাগিল, পাড়ার মানুষ এবং গল্প-পিপাসুরা দল বাঁধিয়া আসিয়া বিদায় লইয়া গেল। কড়ার রহিল, অপুকে প্রায়ই আসিতে হইবে। কাজল সকাল-বিকাল একবার করিয়া বন্ধুদের নিকট হইতে বিদায় লইতে লাগিল।

সময়কে যাইতে দিব না বলিলে সময় অধিকতর তাড়াতাড়ি চলিয়া যায়। ক্রমশ যাইবার দিন আসিয়া গেল। অপু মালতীনগরে একখানি বাসা ভাড়া করিয়াছে। সামান্য কিছু প্রয়োজনীয় আসবাব কিনিয়া সেখানে রাখা আছে। একসঙ্গে সমস্ত কেনা গেল না। দৈনন্দিন কাজে প্রয়োজন দেখা দিলে ক্রমশ কেনা হইবে। বহুকাল বাদে অপু সংসার পাতিতেছে-একা। কী কী জিনিস লাগিবে তাহা রানির সহিত পরমার্শ করিয়া কেনা হইয়াছে। অপুর একার উপর ভার থাকিলে হয়তো নূতন বাড়ি গিয়া প্রথম দিন উপবাস করিতে হইত।

যাইবার গোলমাল, বাক্স গোছানো, নানাবিধ উপদেশ এবং উত্তেজনায় কাজল কিছুটা দিশাহারা হইয়া পড়িয়ছিল, নতুবা রওনা হইবার সময় সে নিশ্চয়ই একবার কাঁদিয়া ফেলিত। পরে তাহার মনে হইয়াছিল–পিসি অত কাঁদলে আর আমি দিব্যি চলে এলাম। পিসি হয়তো ভাবলে ছেড়ে আসতে আমার মন খারাপ হয়নি।

মন খারাপ তাহার অবশ্যই হইয়াছে, কিন্তু সেই গোলমালে তাহার কান্না আসে নাই।

অপুর মনটা কেমন ঝিমাইয়া পড়িয়াছিল। রানির কাছে কাজলকে রাখিয়া তাহার যে সহজ নিশ্চিন্ততা ছিল, তাহা সে ফিরিয়া পাইতেছিল না। অনেক প্রতিজ্ঞা, অনেক পত্র লিখিবার প্রতিশ্রুতি, অনেক চোখের জলের মধ্য দিয়া তাহারা মাঝেরপাড়া স্টেশনে পৌঁছিয়া গেল।

ট্রেনে উঠিয়া কাজল বলিল–একটা কথা বলব বাবা?

-কী?

–আমবা মালতীনগরে যাচ্ছি, না?

–হ্যাঁ।

-সেখানে থাকতে কেমন লাগবে বাবা?

কঠিন প্রশ্ন। অপু জানালা দিয়া বাহিরে তাকাইয়া রৌদ্রদগ্ধ প্ৰান্তর দেখিতে দেখিতে উত্তর খুঁজিতে লাগিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *