সেজদি বড় অভিমানী।
সে অভিমানের মূল্যও আছে অনামিকা দেবীর কাছে। অনেকখানি আছে। তবু সেজদির চিঠির উত্তর দেওয়া হয়ে ওঠে না। নিজে থেকেও একখানা চিঠি সেজদিকে দেওয়া হয়ে ওঠে কই! অথচ সেই না হয়ে ওঠার কাঁটাটা ফুটে থাকে মনের মধ্যে। আর সেই কাঁটা ফোটা মন নিয়েই হয়তো অন্য সাতখানা চিঠি লিখে ফেলেন। মানে লিখতে হয়।
বাংলা দেশের অসংখ্য পাঠক-পাঠিকা অনামিকা দেবীর লেখা ভালবাসে, তাই অনামিকা দেবীকেও ভালবাসে, সেই ভালবাসার একটা প্ৰকাশ চিঠি লিখে উত্তর পাবার প্রার্থনায়। সেই প্রার্থনায় থাকে কত বিনয়, কত আবেগ, কত সংশয়, কত আকুলতা!
অনামিকা দেবী তাদের বঞ্চিত করবেন?
তাদের সেই সংশয় ভঞ্জন করবেন না?
সামান্য একখানি চিঠি বৈ তো নয়!
চিঠিও নয়, চিঠির উত্তর।! কিঞ্চিৎ ভদ্রতা, কিঞ্চিৎ মমতা, কিঞ্চিৎ আন্তরিকতা, মাত্র এইটুকু। সেটুকু দিতে না পারলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন কি করে অনামিকা দেবী? তাছাড়া তাদের কাছেই বা অনামিকা দেবীর মূর্তিটা কোন ভাবে প্রকাশিত হবে?
হয়তো ওই কয়েক ছত্র লেখার অভাবে তাদের ক্যামেরায় অনামিকা দেবীর চেহারাটা হয়ে দাঁড়াবে উন্নাসিক অহঙ্কারী অভদ্র!
অনামিকা দেবী তা চান না।
অনামিকা দেবী নিজের বাইরের চেহারাটা ভিতরের মতই রাখতে চান। সামান্য অসতর্কতায়, ঈষৎ অবহেলায় তাতে ধুলো পড়তে দিতে চান না। এছাড়া প্রয়োজনীয় চিঠিপত্রের সংখ্যাও তো কম নয়? গতানুগতিক সাধারণ জীবনের বাইরে অন্য কোনো জীবনের মধ্যে এসে পড়লেই তার একটা আলাদা দায়িত্ব আছে।
সে সব দায়িত্ব সম্ভবমত পালন করতেই হয়। অস্তুতঃ তার চেষ্টাটাও করতে হয়। ব্যবহারটা যেন ত্রুটিহীন হয়।
অতএব কিছুই হয় না। শুধু একান্ত প্রিয়জনের ক্ষেত্রে।
সেখানে ত্রুটির পাহাড়।
সেখানে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ভারী হয়ে ওঠে অপরাধের বোঝা। তবু ‘হয়ে ওঠে না’।
কিন্তু কারণটা কি? ওই সাতখানার সঙ্গে আর একখানা যোগ করা কি এতই অসম্ভব?
হয়তো অসম্ভব নয়। কিন্তু আবার অসম্ভবও। প্রিয়জনের পত্র দায়সারা করে লেখা যায় না। অস্তুতঃ অনামিকা দেবী পারেন না। অনামিকা দেবী তার জন্যে চান একটুকরো নিভৃতি। একমুঠো অবকাশ। ‘অনামিকা দেবী’র খোলসের মধ্যে থেকে নিজেকে বার করে এনে খোলা মনের ছাদে এসে বসা।
কিন্তু কোথায় সেই নিভৃতি?
কোথায় সেই অবকাণ?
কোথায় সেই নিজেকে একান্তে নিয়ে বসবার খোলা ছাদ?
নেই। মাসের পর মাস সে অবস্থা অনুপস্থিত।
তাই ত্রুটির পাহাড় জমে। তাই প্রিয়জনের খামের চিঠি খোলার আগে বুকটা দুরু দুরু করে। মনে হয় খোলার সঙ্গে সঙ্গে ওর মধ্যে থেকে টুক করে যেটুকু খসে পড়বে, সে হচ্ছে একখণ্ড উদাসীন অভিমান।
কিন্তু প্রিয়জনের সংখ্যা অনামিকা দেবীর কত?
.
খামখানা খোলার আগে তার উপর মৃদু একটু হাত বোলালেন অনামিকা। যেন সেজদির অভিমানের আবরণটুকু মুছে ফেলতে চাইলেন, তারপর আস্তে খামের মুখটা খুললেন।
আর সেই সময় টেলিফোনটা আবার ঝনঝনিয়ে উঠলো।
অনামিকা দেবী আছেন?
কথা বলছি।
শুনুন আমি বাণীনগর বিদ্যামন্দির থেকে বলছি—
বললেন তিনি তাঁর বক্তব্য। অনামিকা দেবীর কথায় কানমাত্র না দিয়ে জোরালো গলায় যা জানালেন তা হচ্ছে, এই উচ্চ আদর্শপূত বিদ্যামন্দিরের পারিতোষিক বিতরণ উৎসবে ইতিপূর্বে অনেক মহা মহা ব্যক্তি এসে গেছেন, এবার অতঃপর অনামিকা দেবীর পালা।
অতএব ধরে নিতে হয় এই সূত্রে অনামিকা দেবী মহামহাদের তালিকায় উঠলেন। অথবা ইতিপূর্বে উঠেই বসেছিলেন, শুধু পালাটা আসতে বাকি ছিল।
অনামিকা দেবীর ক্ষীণ প্রতিবাদ মৃদু আপত্তি বানের জলে ভেসে গেল। ওপিঠ থেকে সবল ঘোষণা এল, কার্ড ছাপতে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
.
সেজদির চিঠিটা অনেকক্ষণ আর পড়তে ইচ্ছে হল না। যেন একটা কোমল সুরের রেশের উপর কে তবলা পিটিয়ে গেল।
তারপর খুলে পড়লেন।
সেজদি লিখেছে–
অনেক তো লিখেছে। কাগজ খুললেই অনামিকা দেবী, কিন্তু
সেটার কি হল? সেই বকুলের খাতাটার?
খাতাখানা
পোকায় কেটে শেষ করেছে? নাকি হারিয়ে গেছে? কিন্তু—
কিন্তু বলে ছেড়ে দিয়েছ। সেজদি।
আর কোনো কথা লেখেনি।
শুধু তলায় নাম সই—সেজদি।
চিঠি লেখার ধরনটা সেজদির বরাবরই এই রকম। চিঠির রীতিনীতি সম্পর্কে মোটেই নিষ্ঠা নেই তার। বাড়ির যাকেই চিঠি দাও, বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের যথাবিহিত সম্মান ও আশীৰ্ব্বাদ জানানো যে একান্ত অবশ্যক, চিঠিটা যে প্রধানত কুশল বিনিময়ের উদ্দেশ্যে, আর পরিচিত জগতের সব কিছু খবরের আদান-প্ৰদানটাই যে আসল প্রসঙ্গ হওয়া সঙ্গত, এ বোধ নেই সেজদির। চিঠিতে সেজদি হঠাৎ যেন কথা কয়ে ওঠে। আর কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যাওয়াটা যেমন স্বভাব তারা, তেমনিই হঠাৎ থেমে যায়। তাই কিন্তু বলে থেমে গেছে।
কিন্তু বক্তব্যটা শেষ করলে বুঝি অনামিকার মনের মধ্যে এমন একটা কণ্টক প্রবেশ করিয়ে দিয়ে রাখতে পারতো না সেজদি।
অনামিকা চিঠিটা শেষ করে তার সেই অশেষ বাণীটি চিন্তা করতে লাগলেন।
বকুলের খাতার কি হল?
অনামিকা দেবী কি সেটা হারিয়েই ফেলেছেন? না সত্যিই অবহেলায় ঔদাসীন্যে পোকায় কাটিয়ে শেষ করেছেন?
কোথায় সেই খাতা?
অনামিকা কি খুঁজতে বসবেন?
.
কিন্তু সেই অনেকদিনের আগের অনাদৃত খাতাটা খোঁজবার সময় কোথায় অনামিকার? আজই একটা সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে উত্তরবঙ্গে যেতে হচ্ছে না তাকে? গোটাতিনেক দিন সেখানে যাবে, তারপর ফিরে এসেই ওই বাণীনগর বিদ্যামন্দির, তার পরদিন বিশ্বনারী প্ৰগতি সংঘ, দুর্গার পরদিন যুব উৎসব, তারপর পর পর তিন দিন কোথায় কোথায় যেন। ডায়েরি খাতা দেখতে হবে।
বকুলের খাতা তবে কখন খোঁজা হবে? ধুলোর ন্তর সরিয়ে কখন খুলে দেখা হবে? দিন যাচ্ছে ঝড়ের মত, সেই ঝড়ের ধুলো গিয়ে জমছে সমন্ত পুরনোর উপর, সমন্ত তুলে রাখা সঞ্চয়ের উপর।
সেজদির সেই এখানে বাতাস নেই নামের কবিতায় লেখা চিঠিটার কথা মনে পড়লো। বরের উপর, অথবা জীবনের উপরই অভিমান করে সেজদি একদা কবিতা লেখা বন্ধ কয়ে দিয়েছিল। প্রেমের কবিতা আর লিখতে না।
সেজদির বর অমলবাবুর ধারণা ছিল, ভিতরে ভিতরে একটি প্রণয়কাণ্ড আর গোপন কোনো প্ৰেমাস্পদ না থাকলে এমন গভীর প্রেমের কবিতা লেখা সম্ভব নয়।
আদি অনন্তকালের সমন্ত মানুষের মধ্যেই যে অল্প বিন্তর একটি প্রণয়কাণ্ড থাকে, আর চিরন্তন এক প্ৰেমাস্পদও অবিনশ্বর মহিমায় বিরাজিত থাকে, হৃদয়ের সমন্ত আকূতি সেখানে গিয়েই আছাড় খায়, একথা বোঝবার মনটা ছিল না অমলবাবুর।
তাই অমলবাবু তার আপন হৃদয়ের অধীশ্বরীর হৃদয়ের উপর কড়া নজর রাখতেন, সে হৃদয়ের জানলা দরজার খিল ছিটিকিনি যেন কোনো সময় খোলা না থাকে। যেন বাইরের ধুলো জঞ্জাল এসে ঢুকে না পড়ে, অথবা ভিতরটাই ফসকে বেরিয়ে না পালায় কোনো ফাঁক দিয়ে।
খিলছিটিকিনিগুলো তাই নিজের হাতে বন্ধ করতে চেষ্টা করতেন।
সেজদিও চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খেয়েছিল। সেজদি প্রেমের কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর তো–
হ্যাঁ, তারপর তো অমলবাবু মারাই গেলেন।
.
কিন্তু তারপর সেই নিঃসঙ্গতার ভূমিতেও আর গভীর গভীর প্রেমের কবিতা লেখেনি সেজদি, বরং তলিয়ে গেছে আরো গভীরে। সেখানে বুদ্বুদ ওঠে না। অথবা হৃদয় নামক বস্তুটা একতলার ঘরটা থেকে উঠে গেছে। মস্তিষ্কের চিলেকোঠায়।
নামকরা লেখিকা অনামিকা দেবীও বলেন, তোর কবিতা এখন আর পড়ে বুঝতে পারিনে বাবা!
দেখা-সাক্ষাৎ প্ৰায় নেই, সেজদি জীবনে আর বাপের বাড়ি আসবো না প্ৰতিজ্ঞা নিয়ে বসে আছে দূরে, অথচ অনামিকা দেবীর সেই বাপের বাড়িটাই একমাত্র ভরসা। অনামিকার নিজের কোন বাড়ি নেই। সেজদির কাছে তাই কদাচ কখনো নিজেই যান। তা সে কদাচই-চিঠির মধ্যেই সব। নতুন কবিতা লিখলে লিখে পাঠায় সেজদি। মন্তব্য পাঠান অনামিকা দেবী।
তবে আবার মাঝে মাঝে খুব সরল ভাষায় আর সাদাসিধে ছন্দে কবিতায় চিঠি লেখে সেজদি, অনামিকাকে আর তার সেই ছোট্ট বন্ধু মোহনকে। অসমবয়সীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করবার আশ্চর্য একটা ক্ষমতা আছে সেজদির। আর সেই অসমরাও দিব্যি সহজে নির্দ্বিধায় সেজদির সঙ্গে সমান হয়ে গিয়ে মিশে যায়।
এ ক্ষমতা সকলের থাকে না, এ ক্ষমতা দুর্লভ। শিশুর বন্ধু হতে পারার ক্ষমতাটা ঈশ্বরপ্রদত্ত।
একদা নাকি সেজদিদের পাশের বাড়ির বাসিন্দা ছিল মোহনরা। অর্থাৎ তার মা বাবা। অবাঙালী সেই ভদ্রলোকদের সঙ্গে সেজদিদের পরিচয় স্বল্পই ছিল, কিন্তু তাদের বছর চারপাঁচের ছেলেটা সেজদির কাছেই পড়ে থাকতো। সেজদির সঙ্গে গল্প করে করে বাংলায় পোক্ত হয়ে গিয়েছিল সে।
কবেই তারা অন্যত্র চলে গেছে, মোহন স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়তো কলেজেই উঠে গেছে এখন, তবু আন্টির সঙ্গে সম্পর্কটা রেখেছে বজায়।
সেজদিকে নাকি তাকে মাঝে মাঝে ছন্দবদ্ধে পত্র লিখতে হয় সেই তার ছেলেবেলার মত। সেও নাকি আজকাল বাংলা কবিতায় হাত মকশ করছে। আর সেটা সেজদির উপর দিয়েই। অতএব ওটা চলে।
আর চলে অনামিকা দেবীর সঙ্গে।
এখানে বাতাস নেই লিখেছিল কবে যেন। একটু একটু মনে পড়ছে–
এখানে বাতাস নেই, দিন রাত্রি স্তব্ধ
হয়ে থাকে
ওখানে উন্মত্ত ঝড়
তোমারে আচ্ছন্ন করে রাখে।
তোমার কাজের ডানা
অবিশ্রাম পাখা ঝাপটায়,
আমার বিশ্রাম
সুখ সময়ের
সমুদ্রে হারায়।
এখানে
বাতাস নেই, দেয়ালের
ক্যালেণ্ডার চুপ,
তোমার তারিখ
পত্র ঝড়ে উড়ে পড়ে ঝুপঝুপ।
ঘন্টামিনিটেরা
যেন—
নাঃ, আর মনে পড়ছে না। আরো অনেকগুলো লাইন ছিল। অনামিকা দেবী সেই তুলনামূলক ভঙ্গীতে লেখা কবিতাপত্র পড়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন সেজদির সঙ্গে আমার কতদিন দেখা নেই, সেজদি আমার এই ঝড়টা তো চোখেও দেখেনি, তবু এত পরিষ্কার বুঝলো কি করে? শুধু নিজের বিপরীতে দেখে?
অথচ এই ঝড়ের গতিবেগটা সৰ্ব্বদা যারা দেখে, তারা তো তাকিয়েও দেখে না। বরং বলে, বেশ আছো বাবা! দিব্যি টেবিল চেয়ারে বসে বানিয়ে বানিয়ে যা ইচ্ছে লেখো, আর তার বদলে মোটা মোটা চেক–
যাক গে, থাক তাদের কথা, বকুলের খাতটা খুঁজতে হবে। কিন্তু কোথায় সেই খোঁজার ঠাঁইটা? বাক্স? আলমারি? পুরনো সিন্দুক? না আরো অন্য কোনোখানে?
সেই অন্য কোনো খানটা কি আছে এখনো অনামিকা দেবীর?
.
তিনতলা থেকে নেমে এলেন অনামিকা দেবী। কারা দেন দেখা করবার জন্যে অপেক্ষা করছে।
এমন অবস্থা সারাদিনে অনেকবার ঘটে, তিনতলা থেকে নেমে নেমে আসতে হয়। মেজদা বলে, তার থেকে বাবা তুই নীচের তলায় একটা ঘরেই পড়ে থাক। এতবার সিঁড়ি ভাঙার চেয়ে ভাল।
ভালবেসেই বলে, অন্য কোনো মতলবে নয়। তিনতলার লোভনীয় ঘরখানা বোন আগলে রেখেছে বলে কৌশলে তাকে নীচে নামাতে চাইবে, এমন নীচ ভাবা উচিত নয় দাদাদের। এটা ঠিক বাবার উইলের অধিকারেই আছেন তিনি, তথাপি দাদারা তেমন হলে টিকতে পারা সম্ভব ছিল কি?
না, অনামিকার প্রতি কোনো দুর্ব্যবহার হয় না। এই যে রাতদিন বাড়িতে লোকজন আসছে, এই যে যখন তখন মহিলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, বৌদিরা তাকে কিছু বলতে আসেন?
না। অনামিকা দেবীকে কেউ কিছু শোনাতে আসেন না। যে যা শোনান নিজ নিজ স্বামীপুত্রকে অথবা ভগবানের বাতাসকে।
বড় তরফের অবশ্য দাদা বেঁচে নেই, আর বড় বৌদি থেকেও নেই, তবে বড়র অংশটুকু আগলে বাস করছে তার ছেলে অপূর্ব। আছে, তবে অপূর্ব তার স্ত্রী-কন্যা নিয়ে বাড়ির মধ্যেই আলাদা।
অপুর্বর স্ত্রীর রুচিপছন্দ শৌখিন, মেয়েকে আধুনিক স্টাইলে মানুষ করতে চায়, খুড়শাশুড়ীদের সঙ্গে ভেড়ার গোয়ালে থাকতে রাজী নয় সে। তাই বাড়ির মধ্যেই কাঠের স্ক্রীন দিয়ে নিজের বিভাগ ভাগ করে নিয়েছে অপূর্ব।
দোতলার দক্ষিণের বারান্দাটা অপূর্বর ভাগে। বারান্দাটাকে অবশ্য আর বারান্দা রাখেনি অপূর্ব, কাঁচের জানলা আর গ্ৰীল বসিয়ে সুন্দর একখানি হল-এ পরিণত করে ফেলেছে। সেখানে তার খাবার টেবিল আর বসবার সোফাসেট দুভাগে সাজানো।
অপুর্বর স্ত্রী অলকার মাথাটা চমৎকার। তার মাথা থেকেই তো বেরিয়েছে এসব পরিকল্পনা। তা নইলে এই চিরকেলে সনাতনী বাড়িটি তো সেই সনাতন ধারাতেই চলে আসছিল।
সেই মাটিতে আসন পেতে খাওয়া, সেই মাটিতে সরঞ্জাম ছড়িয়ে এলোমেলো করে চা বানানো, কোথাও কোনো সৌকুমার্যের বালাই ছিল না।
বাড়িখানা নেহাৎ ছোট নয়, কিন্তু সবটাই কেমন একাকার। ফ্ল্যাটবাড়ির স্টাইল নেই কোনোখানে; ভাই বাড়ি থেকে কোনো আয়ের উপায়ও নেই। ভবিষ্যৎবুদ্ধি ছিল না আর কি বাড়ি-বানানেওয়ালার!
এসব দেখেশুনে অলকা হতাশ হয়ে নিজের এলাকাটুকু নিজের মনের মত করে সাজিয়ে নিয়েছে। তার মেয়ে অভিজাতদের স্কুলে পড়ে, তার চাকর বুশ শার্ট আয় পায়জামা পরে, চটি পায়ে রাঁধে।
অনামিকা দেবীর মেজ বৌদি আর সেজ বৌদি প্রথম দিকে ভাসুরপো-বৌয়ের অনেক সমালোচনা করেছিলেন, অনেক বিদ্রুপের ফুলঝুরি ছড়িয়েছিলেন, কিন্তু ক্রমশঃ নিজেরাই ওই আধুনিকতার সুবিধেগুলো অনুধাবন করেছেন এবং কখন অলক্ষ্যে সেগুলির প্রবর্তনও করেছেন। এখন ওরা পুরুষদের অন্ততঃ টেবিলে খেতে দেওয়াটা বেশ ভালো মনে করেন।
অনামিকা দেবী অবশ্য এসবের মধ্যে ঢোকেন না কখনো। না মন্তব্য, না মতপ্রকাশে। আজীবনের এই জায়গাটায় তিনি যেন আজীবনই অতিথি।
অতিথির সৌজন্য, অতিথির কুণ্ঠা এবং অতিথির নির্লিপ্ততা নিয়েই বিরাজিত তিনি।
.
নীচে নেমে এসে দেখলেন, জনা তিন-চার বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভদ্রলোক। অনামিকাকে দেখে সসম্ভ্রমে নমস্কার করলেন। প্রতি-নমস্কারের পালা চুকলো। তারপর কাজের কথায় এলেন তারা।
একটি আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করাতে এসেছেন। দেশের সমন্ত মান্যগণ্য, বিশিষ্ট চিন্তাবিদ শিক্ষাবিদ সমাজকল্যাণী আর শুভবুদ্ধি-সম্পন্নদের স্বাক্ষর সংগ্ৰহ করতে নেমেছেন তারা। অনামিকা দেবীকেও ফেলেছেন সেই দলে।
কিন্তু আবেদনটা কিসের?
আবেদনটা হচ্ছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে।
এই দুর্নীতিসাগরে নিমজ্জিত দেশের অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখে বিচলিত বিপর্যন্ত এরা সে সাগরে বাঁধ দিতে নেমেছেন।
ওজস্বিনী ভাষায় এবং বিক্ষুব্ধ গলায় বলেন তারা, ভাবতে পারেন কোথায় আজ নেমে গেছে দেশ? খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছে, ওষুধে ভেজাল দিচ্ছে, শিক্ষা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে–
এমন ভাবে বলেন, যেন এইমাত্র টের পেয়েছেন তারা দেশে এইসব ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটছে!
অনামিকা দেবী মনে মনে বলেন, খোকাবাবুরা এইমাত্ৰ বুঝি স্বৰ্গ হতে টসকে পড়েছ! এ মর্ত্যভূমে বিধাতার হাত ফসকে? কিন্তু সে তো মনে।
মুখে শান্ত সৌজন্যের পালিশে ঈষৎ দুঃখের নক্সা কেটে বলেন, সে তো করছেই।
করছেই বলে তো চুপ করে থাকলে চলবে না অনামিকা দেবী। সমাজের দুর্নীতিতে আপনাদের দায়িত্ব সর্বাধিক। শিল্পী-সাহিত্যিকরা যদি দায়িত্ব এড়িয়ে আপন উচ্চমানসের গজদন্তমিনারে বসে শুধু কল্পনার স্বৰ্গ গড়েন, তাহলে সেটা হবে দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা।
অনামিকা দেবী চমকিত হন।
না, ভয়ঙ্কর নতুন এই কথাটায় নয়, ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরে। ওঁর মনে হয় বাড়ির লোকেরা শুনলে ভাববে, কেউ আমাকে ধমক দিতে এসেছে।
চমকিত হলেও শান্ত স্বরেই বলেন, কিন্তু আবেদনটা কার কাছে?
কার কাছে?
ভদ্রলোক উদ্দীপ্ত হন, মানুষের শুভবুদ্ধির কাছে।
মানুষ? মানে ওই সব ভেজালদার চোরাকারবারীদের কাছে?
খুব আস্তে, খুব নরম করেই কথাটা বললেন অনামিকা দেবী, ভদ্রলোকরা যেন আহত হলেন, আর সেটা অপ্রকাশও রাখলেন না। ক্ষুব্ধ গলাতেই বললেন, আপনি হয়তো আমাদের প্রচেষ্টাকে লঘুচক্ষে দেখছেন, কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, মানুষের শুভবুদ্ধি কোনো সময় না কোনো সময় জাগ্রত হয়।
সে তো নিশ্চয়। অনামিকা দেবী নম্র গলায় বলেন, দেখি আপনাদের আবেদনপত্রের খসড়া।
ব্যাগ খুলে সন্তর্পণে বার করেন ভদ্রলোক।
জোরালো গলায় বলেন, দেশের এই দুর্দিনে আপনাদের উদাস থাকলে চলবে না অনামিকা দেবী। অন্ধকারে পথ দেখাবে কে? কল্যাণের বাতি জ্বেলে ধরবে কে? যুগে যুগে কালে কালে দুর্নীতিগ্রন্ত সমাজকে পঙ্কশয্যা থেকে আবার টেনে তুলেছে সাহিত্য আর শিল্প।
অনামিকা দেবী মৃদু হেসে বলেন, তাই কি ঠিক?
ঠিক নয়? বলেন কি?
তাহলে তো সম্ভবামি যুগে যুগে কথাটার অর্থই হয় না— বলে মৃদু হেসে কাগজটায় চোখ বুলোন অনামিকা দেবী।
ভাষা সেই একই। যা ভদ্রলোকরা আবেগদীপ্ত গলায় বলছেন।
দেশ পাপপঙ্কে নিমজ্জিত, মানুষের মধ্যে আর আদর্শ নেই, বিশ্বাস নেই, শ্রদ্ধা নেই, প্ৰেম নেই, পরার্থপরতা নেই, মানবিকতা বোধ নেই, সর্বস্ব হারিয়ে মানুষ ধ্বংসের পথে চলেছে। কিন্তু চলেছে বলেই কি চলতে দিতে হবে? বাঁধ দিতে হবে না?
অনামিকা দেবী মনে মনে হাসলেন। ভাবলেন আমার একটি স্বাক্ষরেই যদি এতগুলো নেই হয়ে যাওয়া দামী বস্তুকে ফিরিয়ে আনার সাহায্য হয় তো দেব বৈকি সেটা।
তবে বিশ্বাস জিনিসটা যে সত্যিই বড় বেশী চলে গেছে তাতে আর সন্দেহ কি? নচেৎ তোমাদের এই সব মহৎ চিন্তা আর মহৎ কথাগুলির মধ্যে কোনো আশার রস পাচ্ছি না কেন? কেন মনে হচ্ছে, কেবলমাত্র দুর্নীতিগ্রন্ত মানুষকে শুভবুদ্ধির শুভ্ৰ আলোক দেখাবার ব্ৰত নিয়েই তোমরা এই দুপুর রোদে গলদঘর্ম হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ, এ কি আর সত্যি? এটা বোধ হয় তোমাদের কোনো মতলবগ্রন্থের সুচারু মলাট!
তারপর ভাবলেন, মলাট নিয়েই তো কারবার আমাদের। এই যে সাহিত্য নিয়ে এত গালভরা কথা, সে-সাহিত্যও বিকোয় তো মলাটের জোরে। যার গেট আপ যতো জমকালো তার ততো বিক্রী।
কলামটা তুলে নিয়ে বসিয়ে দিলেন স্বাক্ষর।
ওঁরা প্ৰসন্ন মুখে ফিরে গেলেন।
অনামিকা দেবী তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ সেই চলে যাওয়া পথের দিকে। তারপর ভাবলেন, মতলবী যদি না হও তো তোমরা অবোধ। তাই চোরাকারবারীর শুভবুদ্ধির দরজায় হাত পাততে বসেছ।
যাক, যাইহোক, উদ্দেশ্যসিদ্ধির খুশি দেখা গেল ওদের মুখে। সেদিন দেখা যায়নি তাদের, সেই আর এক মানবকল্যাণ-ব্রতীদের।
.
তিন-চারটি রোগা রোগা কালো কালো ছেলে আর একটি মেয়ে এসেছিল সেদিন এই একই ব্যাপারে।
আবেদনপত্রে স্বাক্ষর!
তাদের চিন্তা শুধু দেশের গন্ডীতেই সীমাবদ্ধ নয়, সমগ্ৰ বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা তাদের। এই যুদ্ধোন্মাদ পৃথিবীকে শান্তির মন্ত্র দেবার জন্য স্বাক্ষর সংগ্রহ করে বেড়াচ্ছে তারা।
অনামিকা দেবী বলেছিলেন, আমার মনে হয় না যে এই পদ্ধতিতে সত্যকার কাজ হবে।
ওরা ক্ষুব্ধ হয়নি, আহত হয়নি, ফোঁস করে উঠেছিল।
বলেছিল, তবে কিসে সত্যকার কাজ হতে পারে বলে মনে হয় আপনার?
অনামিকা দেবী হেসে উঠেছিলেন, আমার এমন কি বুদ্ধি যে চট করে একটা অভিমত দিই! তবে মনে হচ্ছিল উন্মাদের কাছে শান্তির আবেদনপত্রের মূল্য কি?
ওরা যুক্তি ছেড়ে ক্রোধের শরণ নিয়েছিল। বলেছিল, তাহলে আপনি যুদ্ধই চান? শান্তি চান না?
তারপর দুএকটা বাক্য বিনিময়ের পরই, আচ্ছা ঠিক আছে। সই দেওয়া না দেওয়া আপনার ইচ্ছে। তবে এই থেকে আপনাদের সাহিত্যিকদের মনোভাব বোঝা যাচ্ছে। বলে ঠিকরে বেরিয়ে গিয়েছিল।
শান্তির জন্য দরজায় দরজায় আবেদন করে বেড়াচ্ছে ওরা, কিন্তু সহিষ্ণুতা শব্দটার বানান ভুলে গেছে।
সেদিন তারা রাগ করে চলে গিয়েছিল।
অনামিকা দেবী অস্বস্তি বোধ করেছিলেন।
আজ আর অস্বস্তি নেই। আজ এরা প্ৰসন্ন মুখে বিদায় নিয়েছেন। স্বস্তি কেনবার এই উপায়!
অন্যের বাসনা চরিতার্থের উপকরণ হও, অন্যের মতলবের শিকার হও, আর তাদের ওই উপরের মলাটটা দেখেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হও। ভিতর পৃষ্ঠায় কী আছে তা বুঝতে পেরেছ, একথা বুঝতে দিও না। ব্যাস, পাবে স্বস্তি। নচেৎ বিপদ, নচেৎ দুঃখের আশঙ্কা।
বাইরে এখনো রোদ ঝাঁ ঝাঁ করছে, গরমের দুপুর কেটেও কাটে না। কত কাজ জমানো রয়েছে, কত তাগাদার পাহাড় গড়ে উঠছে, তবু এই সময়টাকে যেন কাজে লাগানো যাচ্ছে না। সেজদিকে কি চিঠি লিখবেন এখন?
সেজদির চন্দননগরের সেই গঙ্গার ধারের বাড়িটা মনে পড়লো। অমলবাবু সেজদির জীবনে আর কোন সঞ্চয় রেখে গেছেন কিনা জানা নেই, তবু স্বীকার না করে উপায় নেই, এই এক পরম সঞ্চয় রেখে গেছেন তিনি সেজদির জীবনে। গঙ্গার ধারের সেই ছোট্ট বাড়িটি।
সেখানে একা থাকে সেজদি।
শুধু নিজেকে নিয়ে।
দুই-কৃতী ছেলে থাকে নিজ নিজ কাজের জায়গায়। তাদের মন্ত কোয়ার্টার, মন্ত বাগান, আরাম আয়েস স্বাচ্ছন্দ্য।
কিন্তু সেজদিকে সেখানে ধরে না।
সেজদির চাই আরো অনেকখানি আকাশ, আরো অনেকখানি বাতাস। তাই গঙ্গার ধারের বারান্দা দরকার তার।
তবু সেজদি লেখে-এখানে বাতাস নেই।
বাতাসের যোগানদার তবে কে?