২
সায়রার লেখা অটোবায়োগ্রাফির সরল বঙ্গানুবাদ
বাবা আমার নাম রেখেছিলেন মিথেন। আমার নাম মিথেন, আমার ছোট বোনের নাম ইথেন
ছোটবেলায় কেউ আমার নাম জিজ্ঞেস করলে মজার ব্যাপার হত। প্রশ্নকর্তা নাম শুনে অবাক হয়ে বলত—এমন নাম তো শুনি নি! এর অর্থ কী?
আমি বলতাম মিথেন হল হাইড্রোকার্বন। এর কেমিক্যাল ফর্মুলা CH4. আমার ছোট বোনের নাম ইথেন। ইথেনের কেমিক্যাল ফর্মুলা হল CH3 – CH3.
প্রশ্নকর্তা আরো অবাক হয়ে বলত, এমন অদ্ভুত নাম কে রেখেছে?
আমি বলতাম, বাবা। তিনি কেমিস্ট্রির টিচার।
আমার বাবার নাম হাবিবুর রহমান। ছোটখাটো মানুষ। কুঁজো হয়ে হাঁটতেন যখন তখন তাঁকে আরো ছোট দেখাত। কলেজের ছাত্ররা তাঁকে ডাকত ট্যাবলেট স্যার। আমার ছোট বোন ইথেন ছিল ফাজিল স্বভাবের মেয়ে। সে একদিন বাবাকে ট্যাবলেট বাবা ডেকে ফেলেছিল। বাবা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাঁর ছোট মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন—এটা কী বললা গো মা?
ইথেন বলল, আর কোনোদিন বলব না বাবা। এই বলেই সে কাঁদতে শুরু করল। বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না বন্ধ করলেন।
আমার ট্যাবলেট বাবা মানুষ হিসেবে ভালো ছিলেন। শুধু ভালো না একটু বেশিরকম ভালো। তিনি আমাদের দুই বোনকে খুবই আদর করতেন। কিছু-কিছু মানুষ আদর স্নেহ ভালবাসা এইসব মহৎ গুণ নিয়ে জন্মায় কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না। বাবা ছিলেন সেই দলের। মা’র মৃত্যুর পর বাবা আর বিয়ে করেন নি কারণ তাঁর ধারণা হয়েছিল সমায়ের সংসারে আমরা দুই বোন কষ্ট পাব।
ধর্মকর্মের প্রতি বাবার কোনো ঝোঁক আগে ছিল না। মা’র মৃত্যুর পর তিনি এইদিকে ঝুঁকে পড়েন। নামাজ, নফল রোজা, গভীর রাতে জিগির এইসব চলতে থাকে। তিনি দাড়ি রাখলেন, চোখে সুরমা দেওয়া শুরু করলেন। কলেজের ছাত্ররা তাঁর নতুন নামকরণ করল ট্যাবলেট হুজুর।
অতিরিক্ত ধর্মকর্মই সম্ভবত বাবার মধ্যে কিছু পরিবর্তন নিয়ে এল—তিনি শুচিবায়ু রোগে পড়লেন। অজু করার পরপরই তাঁর মনে হত যে-বদনায় তিনি অজু করেছেন সেই বদনা নাপাক। কাজেই বদনা ধুয়ে আবার নতুন করে অজু। শুচিবায়ু খুব খারাপ রোগ—এই রোগ কখনো স্থির থাকে না, বাড়তে থাকে। বাবার এই রোগ বাড়তে থাকল। তার সঙ্গে যুক্ত হল ইবলিশ শয়তান-দেখা রোগ। তিনি মাঝে মধ্যেই আমাদের বাড়ির আনাচে-কানাচে ইবলিশ শয়তানকে দেখতে শুরু করলেন। ইবলিশ শয়তান নাকি নিজ দায়িত্বে এই বাড়িতে এসে উঠেছে। তার একটাই কাজ—বাবাকে ধর্মের পথ থেকে সরিয়ে আনা।
একদিনের কথা। বাবা মাগরিবের নামাজের পর আমাদের দুই বোনকে ডেকে পাঠালেন। আমরা অবাকই হলাম, কারণ মাগরিব থেকে এশা পর্যন্ত বাবা কারোর সঙ্গে কথা বলতেন না। জায়নামাজে বসে তসবি টানতেন।
আমরা বাবার সামনে বসলাম। তিনি জায়নামাজে বসে আছেন। আমরা বসেছি জায়নামাজ থেকে একটু দূরের পাটিতে। দরজা-জানালা বন্ধ। ঘর অন্ধকার। বাবার সামনে আগরদানে আগরবাতি জ্বলছে। বাবা বললেন, মাগো তোমাদের একটা বিশেষ কারণে ডেকেছি। কারণটা মন দিয়ে শোন। ইবলিশ স্বয়ং এই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে, তার বিষয়ে সাবধান। আমি কয়েকবারই তার সাক্ষাৎ পেয়েছি। তোমরাও নিশ্চয়ই পাবে। যাতে তোমরা ভয় না পাও এইজন্য আগেভাগে সাবধান করলাম।
ইথেন বলল, বাবা, ইবলিশের দেখা যদি পাই তা হলে তাকে কী ডাকব? ইবলিশ ভাই?
বাবা হতভম্ব হয়ে ইথেনের দিকে তাকালেন। ইথেন সহজভাবে তাকিয়ে রইল। বাবা বললেন, মাগো, তুমি কোন ক্লাসে পড়?
ক্লাস টেনে উঠেছি।
যে-মেয়ে ক্লাস টেনে উঠেছে সে তো মাশাল্লা অনেক বড় মেয়ে। তার কি উচিত সব সময় ঠাট্টা-ফাজলামি ধরনের কথা বলা?
উচিত না বাবা।
বাবা বললেন, ইবলিশ শয়তান যে এই বাড়িতে আছে আমার এই কথাটা তোমরা গুরুত্বের সঙ্গে নাও। এর ক্ষমতা অনেক বেশি বলেই আল্লাহ্পাক স্বয়ং তার বিষয়ে বারবার সাবধান করেছেন। মা ইথেন তুমি কি জান ইবলিশ কে?
জানি। সে শুরুতে আল্লাহ্র প্রিয়পাত্র ছিল। একজন বড় ফেরেশতা।
তোমার জানায় সামান্য ভুল আছে। ইবলিশ ফেরেশতা না। সে জিন সম্প্রদায়ের। জিন সম্প্রদায় মানব সম্প্রদায়ের কাছাকাছি—এদের জন্ম-মৃত্যু আছে। তবে ইবলিশের মৃত্যু হবে কেয়ামতের সময়। তার আগে না।
ইথেন আবারো বেফাঁস কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমি তাকে ইশারায় থামালাম। বাবা বললেন, আমাদের সাবধান থাকতে হবে। আমাদের খুবই সাবধান থাকতে হবে। শয়তান চলে মানুষের শিরায় শিরায়। তারা মানুষের সবচেয়ে দুর্বল অংশে আঘাত করে। আমাকে শয়তান কিছু করতে পারছে না। কাজেই সে তোমাদের মাধ্যমে আমার ক্ষতি করতে চেষ্টা করবে। কারণ আমি তোমাদের অত্যন্ত স্নেহ করি। স্নেহ-ভালবাসা মানুষের দুর্বল স্থান। কাজেই ইবলিশ আঘাত করবে স্নেহ-ভালবাসার দুর্বল স্থানে।
বাবার কথা শেষ হবার আগেই ইথেন বলল, বাবা আমি উঠি? আমার একটা জরুরি কাজ আছে।
কী কাজ?
টিভিতে X-File নামে একটা শো হয়। আমি তার কোনোটাই মিস করি নি।
আজকেরটাও করব না।
X-File-এ কী দেখায়?
ভূতপ্রেত সুপার ন্যাচারাল এইসব হাবিজাবি।
হাবিজাবি দেখার দরকার কী?
হাবিজাবি আমার ভালো লাগে বাবা। কী করব বলো, আমি মেয়েটাই মনে হয় হাবিজাবি।
বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, আচ্ছা যাও।
ইথেন তৎক্ষণাৎ উঠে চলে গেল। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে মা, তুমিও যাও
হাবিজাবির দিকে ইথেন খুবই ঝুঁকে পড়েছিল। সে সিগারেট খাওয়া ধরেছিল। রাতে ঘুমাতে যাবার সময় সে তার ব্যাগ থেকে সিগারেট বের করে প্রথমেই আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলত—আপা খাবি? একটা টান দিয়ে দ্যাখ না? এমনভাবে তাকাচ্ছিস কেন? ছেলেরা যে জিনিস খেতে পারে মেয়েরাও পারে। তোর ইচ্ছা হলে বাবাকে বলে দে। যা, এখনই গিয়ে বল। আমি কোনোকিছু কেয়ার করি না। বাবা কী করবে, আমাকে মারবে? মারলে মারুক।
সে যে কোনো কিছুই কেয়ার করে না তার প্রমাণ কিছুদিনের মধ্যেই পাওয়া গেল। এক রাতে সে তার ব্যাগ থেকে কোকের ক্যানের মতো ক্যান বের করে বলল, আপা এক চুমুক খেয়ে দেখবি?
আমি বললাম, কী?
বিয়ার। সামান্য অ্যালকোহল আছে। সেটা না-থাকার মতো।
তুই বিয়ার খাচ্ছিস?
হুঁ। অসুবিধা কী? রোজ তো খাচ্ছি না। এক দিন একটু চেখে দেখব। ইউরোপ আমেরিকায় আমার বয়সি মেয়েরা পানি খায় না। বিয়ার খায়।
বিয়ার তোকে কে দিয়েছে?
দিয়েছে একজন। নাম দিয়ে কী করবি?
আমি অবাক হয়ে দেখলাম সে তার বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসেছে। বিয়ারের ক্যানে চুমুক দিচ্ছে, পা দোলাচ্ছে। তার মুখ হাসি-হাসি। আমি মনে-মনে ভাবলাম বাবার কথাই মনে হয় ঠিক। আমাদের দুই বোনের মধ্যে দিয়ে শয়তান কাজ করতে শুরু করেছে।
আমার উচিত ছিল ইথেনের কর্মকাণ্ড বাবাকে জানানো। আমি তা জানালাম না। এখানেও হয়তো শয়তানের কোনো হাত আছে।
এর মাসছয়েক পরের কথা। বর্ষাকাল। তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। আমরা দুই বোন ছাদে বৃষ্টির পানিতে গোসল সেরে ফিরেছি। ইথেন আমাকে বলল, আপা, আমার যদি কোনো মেয়ে হয় তার নাম কী হওয়া উচিত? কেমিস্ট্রি নাম। প্রপেন নামটা তোর পছন্দ হয়? ছেলে হলেই-বা কী নাম হবে? তুই যা তো, বাবার কাছ থেকে জেনে আয়।
আমি বললাম, বিয়ে হোক। ছেলেমেয়ে হোক তখন বাবার কাছ থেকে জানব।
আমার এখনই জানা উচিত।
এখনই জানা উচিত কেন?
ইথেন বলল, এখনই জানা উচিত কারণ আমার পেটে বাচ্চা।
আমি বললাম, ফাজলামি করিস না।
ইথেন বলল, ফাজলামি করছি না। যা বাবাকে গিয়ে বল। এক্ষুনি বল।
আমি বললাম, ইথেন সবকিছুর সীমা আছে।
ইথেন বলল, সবকিছুর সীমা আছে তোকে কে বলল? মহাকাশের সীমা
নেই। মানুষের ভালবাসার সীমা নেই। ঘৃণার সীমা নেই। অহংকারের সীমা নেই।
চুপ!
আমি চুপ করব না। আপা আমি নাম চাই। বাবা যদি নাম না দেন তা হলে আমি ইবলিশের কাছে নাম চাইব। সেটা কি ভালো হবে? ইবলিশ নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে যদি নাম দেয় কিবলিশ সেটা ভালো হবে? লোকে হাসবে না?