দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
সমাজ-শাসন
“এইবার গোঁসাইজীকে দেখিয়া লইব। ধর্ম্ম আছেন, ব্রাহ্মণের উপরে অত্যাচার কখন সহ্য হয়? দর্পহারী মধুসূদন, তুমি সত্য। আমি ফুলের মুখুটী, বিষ্ণু ঠাকুরের সন্তান, আমার উপর অত্যাচার?”
ভাগীরথীর পশ্চিম পারে একখানি ক্ষুদ্র গ্রামে একটি প্রাচীন অশ্বখ বৃক্ষের নিম্নে ইষ্টকনির্ম্মিত বেদীর উপরে বসিয়া কতিপয় বৃদ্ধ ও প্রৌঢ় সমাজসংস্কারে ব্যাপৃত ছিলেন। তাহাদিগের মধ্যে একজন বক্তাকে কহিলেন, “ওহে হরিনাথ, এখন কি করা যায় বল দেখি?”
“আবার কি? গোঁসাই আমার যে ব্যবস্থা করিয়াছিল তাহারও সেই ব্যবস্থা; আজি হইতে রাধামোহন গোস্বামীর হুকা বন্ধ, নাপিত বন্ধ, রজক বন্ধ। গোঁসাই সপরিবারে বৈরাগী হউক না হয় বৃন্দাবনে যাউক। কি বল মাধব খুড়া?”
তৃতীয় বৃদ্ধ ধীরে ধীরে কহিল, “তাহাই ত ব্যবস্থা। রাধামোহন গোস্বামীর অবিবাহিত যুবতী কন্যাকে যখন ফিরিঙ্গিতে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, তখন দোষ পিতৃকুলকেই ম্পর্শ করিয়াছে।”
দ্বিতীয় বক্তা মাধব খুড়াকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “খুড়া, ইহাই কি শেষ সিদ্ধান্ত? ব্রাহ্মণের শাস্তি বড় কঠোর হইল না?”
“কঠোর কিসে? এই সকল বিষয়ে গুরুতর দণ্ড বিধান না করিলে কিছু দিন পরে রাধামোহন গোস্বামী সমাজের বক্ষে পদাঘাত করিয়া ফিরিঙ্গী জামাতা ঘরে লইয়া আসিবে।” “কিহে, কালিদাস, কি বল?” “তাই ত, কি করা যায়?”
হরি। দেখ কালিদাস, তোমরা যদি রাধামোহন গোস্বামীকে সমাজচ্যুত না কর, তাহা হইলে আমি আত্মহত্যা করিব, আর তোমাদের ব্রহ্মহত্যার পাপ হইবে।
মাধব। সে কি কথা হরি, তুমি আমার দশ রাত্রের জ্ঞাতি, তোমাকে ছাড়িয়া আমি কি সুবর্ণ বণিকের ব্রাহ্মণ রাধামোহন গোস্বামীর পক্ষ অবলম্বন করিতে যাইব?
হরি। তবে গোস্বামী সমাজচ্যুত হইল?
মাধব। হইল বৈ কি।
এই সময়ে জনৈক দীর্ঘাকার শ্যামবর্ণ ব্রাহ্মণ অশ্বত্থতলে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে দেখিয়া সমবেত ব্রাহ্মণগণ সকলেই অভিবাদন করিলেন। আগন্তুক জিজ্ঞাসা করিলেন-“কিহে মাধব, ব্যাপার কি?”
“তর্করত্ন মহাশয়, শুনিতে পাওয়া গেল রাধামোহন গোস্বামীর কন্যাকে ফিরিঙ্গীতে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে”—“বল কি? কখন লইয়া গেল?” “এই দণ্ড দুই পূর্ব্বে।” “রাধামোহন শুনিয়াছে?” “খুব শুনিয়াছে, আমি নিজে গিয়া শুনাইয়া আসিয়াছি।” “তোমরা বৃদ্ধের দল এখানে বসিয়া কি করিতেছ?” “কি আর করিব? সমাজরক্ষার ব্যবস্থা করিতেছি।” “তোমরা কি পুরুষ না রমণী, দস্যুতে ব্রাহ্মণকন্যাকে অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে, তোমরা তাহার উদ্ধারের চেষ্টা না করিয়া নিশ্চিন্ত মনে বসিয়া আছ? তোমরা না কুলীন সমাজের অগ্রণী, রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ সমাজের মুকুটমণি? মাধব, সমাজরক্ষার কি ব্যবস্থা করিতেছ?” “গোস্বামীর ধোপা নাপিত বন্ধ করিয়াছি।” “গোস্বামীর অপরাধ?” “বলেন কি তর্করত্ন মহাশয়, গোস্বামীর অবিবাহিত যুবতী কন্যাটাকে ফিরিঙ্গীতে ধরিয়া লইয়া গেল, সমাজ ইহার কোন প্রতিবিধান করিবে না? কঠোর শাস্তি বিধান না করিলে সমাজ অধঃপাতে যাইবে। দুইদিন পরে রাধামোহন গোস্বামী ফিরিঙ্গী জামাতাকে ঘরে আনিয়া সমাজ নিমন্ত্রণ করিবে।” “হরি, রাধামোহন কি ফিরিঙ্গীকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিয়া কন্যা সম্প্রদান করিয়াছে?” “না।” “তবে কি হইয়াছে?” “গোস্বামীর কন্যা গঙ্গাস্নানে গিয়াছিল, ফিরিঙ্গীরা তাহাকে ঘাট হইতে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।” “তাহাতে রাধামোহনের অপরাধ কি?” “অবিবাহিতা কন্যাকে স্লেচ্ছ ফিরিঙ্গী ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, তাহাতে পিতৃকুলের দোষ হইবে না?” “পিতৃকুলের অপরাধ? এই মাত্র বলিতে পার যে কন্যা গঙ্গাস্নানে যায় কেন? এই সমাজে কাহার মাতা, কাহার বনিতা, কাহার ভগিনী গঙ্গাস্নানে না গিয়া থাকে?” রাঢ়ীয় কুলীন সমাজ নিরুত্তর। কিয়ৎক্ষণ পরে হরিনাথ সাহসে ভর করিয়া কহিল, “কিন্তু সমাজ রক্ষার উপায় কি হইবে?”
“সমাজের ত কোন হানি হয় নাই। তোমার ভাগিনী যখন মুসলমানের সহিত কুলত্যাগ করিয়াছিল, তখন তুমি তাহাকে গৃহে ফিরাইয়া আনিবার চেষ্টা করিয়াছিলে, সেইজন্য তোমার প্রতি দণ্ডবিধান করিয়া সমাজ রক্ষার ব্যবস্থা করিয়াছিলাম। রাধামোহনের কন্যা কি ফিরিঙ্গীর ঔরসজাত পুত্র প্রসব করিয়াছে?”
হরিনাথ অগত্যা নীরব হইল। তর্করত্ন পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “সমাজের কোন হানি হয় নাই, তথাপি সমাজ রক্ষার ব্যবস্থা করিয়াছ; কিন্তু বৃদ্ধ অপুত্রক রাধামোহনের একমাত্র কন্যা দস্যুকর্ত্তৃক অপহৃত হইয়াছে, তাহার উদ্ধারের কি ব্যবস্থা করিয়াছ?”
“কি করব? ফিরিঙ্গী হার্ম্মাদ গোলা গুলি লইয়া লড়াই করে, একি যে সে দস্যু যে লাঠিয়াল পাঠাইয়া লড়াই করিব? ফৌজদার সুবাদার অবধি ফিরিঙ্গীর ভয়ে শঙ্কিত; সেখানে আমরা কি করিব?”
হরি। কিন্তু গোস্বামীকে জাতিচ্যুত করা উচিত।
তর্করত্ন। তোমরা মানুষ না পাষাণ? উপকার করিতে পার না, কিন্তু অপকার করিতে জান। অভাগিনীকে উদ্ধার না করিয়া তাহার পিতাকে জাতিচ্যুত করিতে বসিয়াছ? নারায়ণ! এই ব্রাহ্মণসমাজ রসাতলে যায়না কেন?
পশ্চাৎ হইতে গম্ভীরস্বরে উচ্চারিত হইল, “অনেক দিন গিয়াছে। তর্করত্ন, ইহা সমাজের কবন্ধ।” সকলে বিস্মিত হইয়া চাহিয়া দেখিলেন, বৃদ্ধ রাধামোহন গোস্বামী অর্দ্ধনগ্ন অবস্থায় দাঁডাইয়া আছেন। মুহূর্ত্তমধ্যে তর্করত্ন তাঁহাকে বাহুপাশে আবদ্ধ করিলেন, সহানুভূতি পাইয়া বৃদ্ধ ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিল। সেই অবসরে কুলীনকূলচূড়ামণি হরিনাথ মুখোপাধ্যায় পলায়ন করিল।
তর্করত্নের স্কন্ধে মস্তক রাখিয়া উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে করিতে বৃদ্ধ গোস্বামী কছিলেন, “ভাই, ললিতা আমার দুইদিন উপবাসী ছিল, ব্রত সাঙ্গ করিয়া গঙ্গাস্নান করিতে গিয়াছিল, সেই অবস্থায় দুর্ব্বৃত্ত ফিরিঙ্গী তাহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। আহা! মা আমার আর নাই! জগতে এমন কে আছে যে পরাক্রান্ত দস্যুর হস্ত হইতে তাহাকে উদ্ধার করিয়া আনিবে?”
পশ্চাৎ হইতে ধ্বনিত হইল, “আছে, যে প্রকৃত রাজা সে তোমার কন্যা উদ্ধার করিতে গিয়াছে।” সকলে ফিরিয়া দেখিলেন যে, দূরে পনস তরুতলে একজন দীর্ঘাকার গৈরিকবসন-পরিহিত সন্ন্যাসী দাঁড়াইয়া আছেন। সন্ন্যাসী পুনর্ব্বার কহিলেন, “গোস্বামী, গৃহে ফিরিয়া যাও, তোমার কন্যা ফিরিয়া আসিবে। আজ দেবেন্দ্রনারায়ণ নাই, কিন্তু তাহার পুত্র আছে; যে উত্তর রাঢ়ের প্রকৃত অধীশ্বর সে দস্যুর দণ্ডবিধান করিতে গিয়াছে। ফিরিয়া যাও, গৃহ-দেবতার নিকটে তাহার মঙ্গল কামনা কর।”
সন্ন্যাসী উত্তরের প্রতীক্ষা না করিয়া প্রস্থান করিলেন, গ্রামবাসিগণ স্তম্ভিত হইয়া রহিল। কিয়ৎক্ষণ পরে রুধিরাপ্লুতদেহ বৃদ্ধ ভূবন ধীরে ধীরে আসিয়া তর্করত্নকে প্রণাম করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ঠাকুর, আমাদের মহারাজকে দেখিয়াছেন?” তর্করত্ন বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “না। ভুবন, তুমি আঘাত পাইলে কোথায়?” “ফিরিঙ্গীর সহিত যুদ্ধে।” “কখন?” “দুই দণ্ড পূর্ব্বে, ঠাকুরের কন্যাকে উদ্ধার করিতে গিয়া।” “মহারাজ কোথায়?” “তিনিও আহত হইয়াছেন। ধনু ও তীর লইয়া যতক্ষণ বন্দুকের সহিত যুদ্ধ সম্ভব ততক্ষণ দুই জনে যুঝিয়া ছিলাম। তিনি অজ্ঞান হইয়া নৌকায় পড়িয়া গেলে, আমি নৌকা ভাসাইয়া দিয়া জলে পড়িয়াছিলাম আর নৌকার কাছি ধরিয়া সাঁতার দিয়া পলাইলাম। রাঙ্গামাটির নিকট নৌকা তীরে লাগাইলাম। মহারাজের জ্ঞান হইলে তাঁহাকে গঙ্গাতীরে বসাইয়া রাখিয়া গ্রামে লোক ডাকিতে গিয়াছিলাম, ফিরিয়া আসিয়া দেখি নৌকাও নাই মানুষও নাই। নদীর তীরে তীরে তাঁহার সন্ধান করিতে করিতে আসিয়াছি; কিন্তু কোথাও তাঁহার চিহ্ন পাই নাই।”
কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া তর্করত্ন কহিলেন—“ভুবন, মহারাজকে আমরা দেখি নাই। তিনি বোধ হয় তোমার নৌকা লইয়া হার্ম্মাদের নৌকার অনুসরণ করিয়াছেন। তুমি তোমার বড় নৌকা প্রস্তুত কর; দেবেন্দ্রনারায়ণের অন্নের ঋণ যে যে এখনও স্বীকার করে তাহাদিগকে প্রস্তুত হইতে বল। মহারাজ একাকী গিয়াছেন, কি হইবে বলিতে পারা যায় না। হয় ত আজি দেবেন্দ্রনারায়ণের বংশ লোপ হইবে। তুমি বিলম্ব করিও না। দুই দণ্ডের মধ্যে তোমার নৌকায় আমি সপ্তগ্রাম যাত্রা করিব। আমি রাজবাটীতে চলিলাম।”
তর্করত্ন দ্রুতপদে প্রস্থান করিলেন, ভুবনও অন্য দিকে চলিয়া গেল। কিয়ৎক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় দাঁড়াইয়া থাকিয়া গোস্বামীও গৃহে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন। তখন মাধব খুড়া কহিলেন—“কি হে কালিদাস, কি রকম বুঝিতেছ?” “গোস্বামীকে সমাজচ্যুত করা অসম্ভব।” “তর্করত্ন যখন বিরূপ তখন আর উপায় কি?” “তর্করত্নটী যেন ফৌজদারের সিপাহী—হরিনাথ কোথায়?” “গোস্বামীকে দেখিয়াই পলায়ন করিয়াছে।” “সন্ধ্যা হইল, চল ঘরে যাই।”