২. সভ্যতায় ধর্মের কি কোন কার্যকরী অবদান আছে?
ধর্ম সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি লুক্রেতিউসের মতো। আমি মনে করি এটা এমন একটা রোগ যা ভয় থেকে জন্মগ্রহণ করে থাকে এবং যা মানবজাতির শোচনীয় দুর্দশার উৎস। যদিও, আমি একথা অস্বীকার করতে পারি না যে মানবসভ্যতায় এর কিছু অবদান আছে। প্রাচীন যুগে একটি ক্যালেন্ডার তৈরিতে সাহায্য করেছে। এটি ইজিন্সীয় পুরোহিতকে এমন সযত্নে সূর্যগ্রহণের সময় নির্ধারণ করতে শিখিয়েছিল যাতে তারা তার সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম হয়। এর এই দুটি অবদানের কথা জানাতে আমি সর্বদাই প্রস্তুত, কিন্তু অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আমি বেশি কিছু জানি না।
ধর্ম শব্দটি বর্তমানে খুব হাল্কা অর্থে ব্যবহৃত হয়। চরম প্রোটেস্টান্টবাদের প্রভাবে কিছু মানুষ ধর্ম শব্দটিকে খুব ব্যক্তিগত দৃঢ়বিশ্বাস, যেমন নৈতিক আদর্শ প্রভৃতি অর্থে ব্যবহার করে থাকে অথবা তারা ধর্ম বলতে মহাবিশ্বের প্রকৃতিকে বোঝে। শব্দটির এই ধরনের ব্যবহার সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক। প্রাথমিকভাবে ধর্ম হল একটি সামাজিক ঘটনা। বহু আচার্যের নিজ নিজ দৃঢ়বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেই গীর্জাগুলির উদ্ভব ঘটেছে, কিন্তু যে-সব আচার্য এই গীর্জাগুলিকে প্রতিষ্ঠা করেছিল, তারা কদাচিৎ গীর্জাগুলির উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে। অথচ যে মনুষ্য-গোষ্ঠীগুলোর উপর গীর্জাগুলি বেড়ে ওঠে সেখানে তাদের প্রভাব অপরিসীম। পাশ্চাত্য সভ্যতার সদস্যদের ব্যাপারে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা বলা যাক। সুসমাচারে খ্রীষ্টের যে উপদেশগুলো দেখা যায় তা সেখানকার খ্রীষ্টীয় নীতিশিক্ষার থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবেই স্বতন্ত্র। খ্রীষ্টীয়বাদের যেটা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেটি হল, সামাজিক ও ঐতিহাসিক দিক দিয়ে খ্ৰীষ্টীয়বাদ খ্রীষ্টের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে গীর্জার উপর এবং যদি আমরা সামাজিক শক্তি হিসাবে খ্রীষ্টীয় শক্তি বা ধর্মকে বিচার করবার চেষ্টা করি তবে তার উপাদান খুঁজতে আমরা কখনই সুসমাচারের দ্বারস্থ হব না। খ্রীষ্ট শিক্ষা দিয়েছেন যে আপনার উচিত আপনার সম্পদ গরীবকে দেওয়া, এর জন্য আপনাকে যুদ্ধ করতে হবে না। আপনাকে গীর্জার দ্বারস্থ হতে হবে না এবং ভেজাল বস্তু বিক্রয়ের জন্য কাউকে আপনাকে শাস্তিও দিতে হবে না। কিন্তু এই ব্যাপারে প্রোটেস্টান্ট বা ক্যাথলিক কোন সম্প্রদায়ই খ্রীষ্টের উপদেশ অনুসরণ করার কোন ইচ্ছাই পোষণ করে না। এটা সত্য যে কিছু ফ্রানসিসকীয় সদস্যরা খ্রীষ্টের বারজন শিষ্যের আদর্শমণ্ডিত ও কষ্টসহিষ্ণু জীবনের নীতি দর্শিয়ে মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পোপ এই ধরনের নীতি প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধ-আদর্শ বলে নিন্দা করেছেন। আমরা যদি খ্রীষ্টের এই উপদেশটিকে নিয়ে পর্যালোচনা করি, যেমন, ‘নিজেকে বিচার না করে অপরকে বিচার করতে যেও না তাহলে আপনারা নিজেদেরকেই জিজ্ঞাসা করুন যে এই উপদেশটি অনুসরণ করলে প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধ-মতো দমনের জন্য ঐ বিচারালয়ের কি অবস্থা হবে এবং কু কুক্স-ক্ল্যান (Ku-Klux-klan)-এর কি পরিণতি দাঁড়াবে।
খ্রীষ্টধর্মের বেলায় যে ব্যাপারটি সত্য তা বৌদ্ধধর্মের বেলাতেও একইভাবে প্রযোজ্য। বুদ্ধ ছিলেন অমায়িক ও আলোকিত। মৃত্যুশয্যায় বুদ্ধকে শুয়ে থাকতে দেখেও তাঁর শিষ্য তাকে অমর ভাবাতে তিনি তার দিকে তাকিয়ে হেসেছিলেন। কিন্তু বৌদ্ধ পৌরোহিত্য, এখন যা বিদ্যমান, উদাহরণস্বরূপ তিব্বতের কথাই ধরা যাক সেখানে–অজ্ঞেয়বাদীদের স্বৈরাচার ও নিষ্ঠুরতা এক চরম আকার ধারণ করেছে।
গীর্জা ও তার স্থপতির মধ্যে এই স্বতন্ত্রতা কোন দৈবাৎ ঘটনা নয়। যখন কোন মানুষ পরম সত্য সম্পর্কে কিছু বলে, তখন কিছু পারদর্শী মানুষ তা ব্যাখ্যা করতে বসে এবং অব্যর্থ ভাবে তারা অর্জন করে ক্ষমতা, কেননা তারা সত্যের চাবিকাঠি সম্পর্কে জানে। সমাজের যে-কোন কুলীন জাতের মতোই তারা তাদের স্বার্থে সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা কুলীন জাতের থেকেও একটি বিষয়ে এগিয়ে থাকে, আর তা হল অপরিবর্তনীয় সত্যের ব্যাখ্যা করার ব্যবসা করা। তারা যা প্রকাশ করে তা সবার ক্ষেত্রে ও সব কিছুর ক্ষেত্রে যথার্থ ধরা হয়। ফলে, অনিবার্যরূপে তা সমস্ত বুদ্ধিদীপ্ত ও নৈতিক অগ্রগতির প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। গীর্জা গ্যালিলিও ও ডারউইনের বিরুদ্ধাচরণ করেছে, আমাদের যুগে ফ্রয়েডের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। যে সময়টাতে গীর্জা তার চরম ক্ষমতায় আসীন ছিল সেই সময়টাতে সে সমস্ত বুদ্ধিদীপ্ত জীবনের বিরুদ্ধাচরণ করবার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছেছিল। পোপ গ্রেগরী দ্য গ্রেট কোন এক বিশপকে একটি চিঠি লেখেন, যে চিঠিটি তিন শুরু করেন এই ভাবে যে আমাদের কাছে এমন একটি সংবাদ এসে পৌঁছেছে যে সম্বন্ধে কথা বলতে গেলে লজ্জায় লাল হয়ে উঠতে হয়। আর তা হল, আপনি আপনার কিছু বন্ধুর কাছে ব্যাকরণের ব্যাখ্যা করেছেন। এই বিশপকে প্রধান ধর্মগুরুর কর্তৃত্বের ফলে ঐ রকম নীচ শ্রম থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হতে হয়েছিল, ফলস্বরূপ নবজাগরণের আগে পর্যন্ত ল্যাটিন সাহিত্যের উদ্ধার সম্ভব হয়ে ওঠেনি। শুধুমাত্র বুদ্ধিগত বিষয়ের জন্যই নয়, দৈনিক বিষয়ের জন্যও ধর্ম অনিষ্টকর (it is not only intellectuallly, but also nor mally, that religion is permicious)। আমি বলতে চাইছি যে, ধর্ম যে নৈতিক শিক্ষার তালিকা প্রদান করে থাকে তাকে অনুসরণ করে মানুষ কখনই সুখী হতে পারে না। কিছু বছর আগে, যখন জার্মানীর রাজপরিবার তাদের ব্যক্তিগত জমিকে আগের মতোই ব্যবহার করতে পারবে কিনা সেই মতের উপর নির্বাচন করা হয়েছিল, তখন সেখানকার গীর্জা এই মর্মে ঘোষণা করেছিল যে এই ধরনের ব্যবস্থা যার দ্বারা রাজ-পরিবার বঞ্চিত হবে তা খ্রীষ্টীয় শিক্ষার বিরোধী। একথা সবাই জানে যে যখন তারা দাসত্ব প্রথা বিলোপ করতে চেয়েছিল তখন গীর্জাগুলো তার বিরুদ্ধাচরণ করেছিল এবং বর্তমানে কিছু কিছু বহুল বিজ্ঞাপিত ব্যতিক্রম ছাড়া গীর্জাগুলো অর্থনৈতিক সুবিচারের প্রতিটি পদক্ষেপে বিরুদ্ধাচরণ করে আসছে। পোপ সর্বতোভাবে সমাজতন্ত্রের নিন্দা করেছেন।
খ্রীষ্টীয়বাদ ও যৌনতা
খ্রীষ্টানধর্মের সব থেকে জঘন্য বৈশিষ্ট্যটি হল, যৌনতার প্রতি এর আচরণ এতই ব্যাধিগ্রস্ত ও অপ্রাকৃতিক যে তা একমাত্র রোম সাম্রাজ্যের পতনের সময় সভ্য জগতের যে অবস্থা দাঁড়িয়েছিল তার সঙ্গে তুলনীয়। সেই সময়ের আঙ্গিকে উক্ত আচরণকে বিচার করলে তবেই তার স্বরূপ বোঝা যাবে। আমরা অনেক সময় শুনে থাকি বা বলে থাকি যে খ্রীষ্টীয়বাদ মহিলাদের মর্যাদাকে উন্নত করেছে। কিন্তু এর থেকে স্কুল ঐতিহাসিক বিকৃতি আর কখনও সম্ভব হয়েছে বলে মনে হয় না। আমাদের সমাজে মহিলারা কখনও একটা সহনীয় অবস্থা ভোগ করতে পারে না। তাদের ক্ষেত্রে এটাকে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়ে থাকে যে কঠোর নৈতিক আদর্শগুলো কখনই মহিলাদের লজ্জন করা উচিত নয়। মঠের সাধুদের কাছে প্রাথমিকভাবে মহিলারা চিরকালই প্রলোভনের যন্ত্র হিসাবে পরিগণিত। তারা মহিলাদের প্রধানত অশুদ্ধ লালসার প্রেরণা বলে ভাবে। গীর্জার শিক্ষানুযায়ী এখনো কৌমার্য উত্তম বলে বিবেচিত, কিন্তু যারা এই অবস্থাটাকে অসম্ভব বলে মনে করবে তাদের জন্য বিবাহকে অনুমোদন করা হয়েছে। জ্বলে-পুড়ে মরার থেকে বিবাহ করা ভাল, সেন্ট পল নিষ্ঠুরভাবে কথাটি বলেছেন। বিবাহ-নীতিকে তাচ্ছিল্য করে, এবং বেছে বেছে সৌন্দর্য ও কলা বিষয়ক সমস্তরকম জ্ঞানকে বাদ দিয়ে, গীর্জাগুলো যেটুকু যৌনাচারকে বিবাহিত জীবনের জন্য নিশ্চিত করে অনুমোদন দিয়েছে তাতে আনন্দ যৎকিঞ্চিৎ কিন্তু যন্ত্রণা অধিক। এই একই ধরনের অত্যাচার দেখা যায় জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরোধিতার ক্ষেত্রে। বছরের পর বছর শিশুর জন্ম দিয়ে শুকিয়ে না মরলে ধরে নেওয়া হয়ে থাকে যে সে তার বিবাহিত জীবনে খুব বেশি আনন্দ লাভ করতে পারেনি। এই কারণেই জন্মনিয়ন্ত্রণকে কোনভাবেই উৎসাহ দেওয়া হয়নি।
খ্রীষ্টীয়বাদের সঙ্গে পাপের যে ধারণা অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত তা অস্বাভাবিক ক্ষতি করে থাকে, যেহেতু এই ধারণা অন্য দিক দিয়ে তাকে সেই মর্ষকামী হতে বাধ্য করে যে মর্ষকামকে তারা আইনত, এমনকি মহান বলে মনে করে। উদাহরণস্বরূপ, সিফিলিস প্রতিরোধের প্রশ্নকেই নেওয়া যাক। এই রোগের বিরুদ্ধে আগের থেকে কোন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে এই ছোঁয়াচে রোগের প্রতিকারকে কোন আমলই দেওয়া হয়নি। যদিও এই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে খ্ৰীষ্টীয়রা তাদের ব্যাপ্ত জ্ঞানের পরিচয় দিয়ে ঘটনাটিকে মঙ্গলময় বলে থাকে এই কারণে যে তারা মনে করে পাপীর শাস্তি পাওয়া উচিত। এই ব্যাপারটিকে মঙ্গলময় মনে করে তারা এই ইচ্ছাও পোষণ করে থাকে যে এই শাস্তিটি পাপীর স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যেও যেন বিস্তৃত হয়। বর্তমান পৃথিবীতে এই মুহূর্তে বহু শিশু এই ছোঁয়াচে মারাত্মক সিফিলিস রোগে জীবনমরণ লড়াই করে চলেছে, কিন্তু তাদের এমনভাবে জন্মানোর কথা ছিল না যদি না খ্রীষ্টীয়রা পাপীদের শাস্তি দিতে চাইত। আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না যে শাস্ত্রীয় নীতি এই ধরনের শয়তানি নিষ্ঠুরতার দিকে মানুষকে ঠেলে দেয় তা নৈতিক চরিত্রের উপর কোনরকম শুভ প্রভাব ফেলতে পারে।
এই বিষয়টি কেবলমাত্র যৌন আচরণের ক্ষেত্রেই সত্য নয়, যৌন বিষয়ের ক্ষেত্রেও একইভাবে সত্য। এর ফলে, একথা বলা যেতে পারে যে খ্ৰীষ্টীয়দের আচরণ মানবকল্যাণের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক। নিরপেক্ষভাবে যখনই কেউ এই বিষয়টি ভাবতে চায় তখন তাকে এই দেখে কষ্ট পেতে হয় যে যৌন বিষয়ের উপর কৃত্রিম নির্বুদ্ধিতা যা গোঁড়া খ্রীষ্টীয়দের পরিচালিত করে ও যুবক-যুবতীদের শিক্ষার ব্যাপারে তা তাদের শারীরিক ও মানসিক দু-দিকের জন্যই মারাত্মক বিপজ্জনক এবং এই ক্ষতি তাদের উপর বর্তায় যারা উক্ত বিষয়ের উপর তাদের অযথার্থ (Improper) আলোচনা শুনে জ্ঞান অর্জন করে থাকে। যেমন শিশুদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি প্রায়শই ঘটে, এর ফলে তারা যৌনতাকে কুৎসিত ও হাস্যাস্পদ বলে মনে করে। জ্ঞান চির-অনাকাঙ্ক্ষিত এই দৃষ্টিভঙ্গীর বিরুদ্ধে কোন প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে বলে আমি মনে করি না। জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা আমি পছন্দ করি না, তা যে-কোন মানুষের ক্ষেত্রেই হক। বিশেষত যৌন জ্ঞানের বিষয়ের স্বপক্ষে বহু ওজনদার যুক্তি পাওয়া যাবে যা অন্যান্য জ্ঞানের ক্ষেত্রের চেয়েও বেশি। কোন বিষয়ের উপর অনুশীলনকারী ব্যক্তি যতটা বুদ্ধির পরিচয় দিতে পারে ততটা কোন অনুশীলনহীন নির্বোধ ব্যক্তির দ্বারা সম্ভব নয়। তাই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে পাপের ধারণা গড়ে তোলাটা একটা হাস্যাস্পদ ব্যাপার কেননা যে-কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের স্বতঃস্ফুর্ত কৌতূহল থাকবেই।
প্রত্যেক বালকই ট্রেনের ব্যাপারে আগ্রহান্বিত। ধরা যাক আমরা তাকে বললাম ট্রেনের ব্যাপারে আগ্রহ থাকাটা একধরনের পাপ। মনে করা যাক, ট্রেনে থাকাকালীন আমরা তার চোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে দিলাম, অথবা যখন সে কোন রেল স্টেশনে তখন ঐ একই কাজ করলাম। মনে করা যাক, তার উপস্থিতিতে আমরা কখনও ‘ট্রেন’ শব্দটি তার সামনে উচ্চারণ করলাম না এবং সেটি কিভাবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয় সে বিষয়ে আমরা তার কাছে এক অভেদ্য রহস্য বজায় রাখলাম। এর ফলে এই দাঁড়াবে না যে সে ট্রেনের ব্যাপারে তার আগ্রহকে কমিয়ে দেবে, উপরন্তু দেখা যাবে ট্রেনের ব্যাপারে আগের তুলনায় তার আগ্রহ আরও বেড়ে যাবে, কিন্তু এক বিষণ্ণ পাপের চেতনায় সে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠবে। কেননা এই ধরনের আগ্রহকে অন্যায় বলে তার কাছে। বর্ণনা করা হয়েছে। সক্রিয়ভাবে বুদ্ধিমান যে-কোন বালক এই কারণেই কমবেশি স্নায়ুরোগের শিকার হয়ে পড়ে। সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে, যৌনতা সম্বন্ধে এই ধরনের ঘটনাই ঘটে এবং যেহেতু যৌনতা ট্রেনের থেকেও অনেক বেশি আগ্রহোদ্দীপক তাই ফল আরও অনেক খারাপ হয়। এর ফলেই খ্রীষ্টীয় গোষ্ঠীতে বহু মানুষই স্নায়ুরোগের শিকার। এর কারণ ছোট বয়সে তাদের যৌন জ্ঞানের উপর ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা। এই পাপবোধ যা কৃত্রিমভাবে তাদের উপর আরোপ করা হয়েছিল তা পরবর্তীকালে তাদের ভীরু, নিষ্ঠুর, নির্বোধ করে তোলে। ছোট বয়সে বালক-বালিকারা যা জানতে চায় তাকে তা না জানানোটা কোন যুক্তিসংগত ব্যাপার নয়– সেটা যৌন সংক্রান্ত জিজ্ঞাসাও হতে পারে অথবা অন্য কিছু। আমরা যতক্ষণ প্রাথমিক পড়াশুনোর সময়টাতে ছেলেমেয়েদের এই বিষয়ে জানাতে না পারবো ততদিন পর্যন্ত আমরা সুস্থ জনসাধারণ সৃষ্টি করতে পারবো না। যতদিন গীর্জাগুলোর হাতে শিক্ষাগত রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত এটা সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না।
যদি এই সব আপত্তির সঙ্গে তুলনীয় বর্ণনাগুলোকে পাশে সরিয়ে রাখি, তবে এটা পরিষ্কার যে খ্রীষ্টীয়বাদের মৌল শাস্ত্রীয় নীতিগুলিকে মেনে নেওয়ার আগেই তা লোকের মনে এক ধরনের নৈতিক বিকৃতির দাবি করে থাকে। আমাদের বলা হয়ে থাকে যে এই জগৎ সেই ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্ট যিনি একাধারে মঙ্গলময় ও সর্বশক্তিমান। জগৎ সৃষ্টি করার আগেই তিনি তাঁর দিব্য দৃষ্টিতে সেই সব যন্ত্রণা ও কৃপণতাকে আগেই দেখতে পেয়েছিলেন যার দ্বারা জগৎ পূর্ণ হবে। তাই এই সমস্ত কিছুর জন্য তিনিই দায়ী। এই তর্ক করাটা একেবারেই অনর্থক, যে পাপের জন্যেই জগতে এত যন্ত্রণা। প্রথমেই বলতে হয় যে এটা সত্য নয়। নদীতে বন্যা আসার ফলে কূল উপচে পড়া বা আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ অবশ্যই কোন পাপের ফলে ঘটে না। কিন্তু যদিও তা সত্য হত, তাতে কোন কিছু যেত-আসত না। যদি আমি জেনেশুনে এমন একটি শিশুর জন্ম দিতাম যার মাথায় অবশ্যই ভ্রাতৃহত্যার পাগলামী আছে তবে সেই অপরাধের জন্য আমিই দায়ী হতাম। যদি ঈশ্বর আগেভাগেই সেই পাপের কথা জানতেন যে পাপের ফলে সে দোষী হবে, তবে এই সমস্ত পাপের ঘটনার জন্য তখন থেকে তিনিই পরিষ্কারভাবে দায়ী যখন থেকে তিনি মানুষ সৃষ্টি করবার পরিকল্পনা করেছিলেন। খ্রীষ্টীয়দের যুক্তিতে জগৎকে পাপ থেকে মুক্ত করে তাকে শুদ্ধ করতেই এই ধরনের দুঃখ-কষ্ট। এই জন্য দুঃখ কষ্ট-যাতনা মঙ্গলময়। মর্ষকামকে সংগতিকর করে তোলার জন্য এ এক ভালো যুক্তি, কিন্তু সর্বতোভাবে এই যুক্তি খুবই দুর্বল। আমি যে-কোন খ্রীষ্টীয়কে হাসপাতালের শিশু-বিভাগে আমার সঙ্গে ঘুরে আসার আমন্ত্রণ জানাই তাদের এটি দেখাতে যে সেখানে কি পরিমাণ কষ্ট সহ্য করা হচ্ছে। তা দেখার পর তাদেরকে ভাবতে বলব যে সেই সব শিশুরা নৈতিকভাবে পরিত্যক্ত এবং তারা যে যন্ত্রণা পাচ্ছে, তারা তার যোগ্য। এই অনুভব জাগাতেই তাকে এই জায়গায় নিয়ে আসা যে, মানুষ তার অন্তরেই সমস্ত দয়া-মায়া-করুণার অনুভূতিকে অবশ্যই ধ্বংস করে। যে ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে সেই ঈশ্বরের মতোই সে নিজেকে নিষ্ঠুর করে তোলে। যেসব মানুষ বিশ্বাস করে যে এই যন্ত্রণাকাতর জগতের সবকিছুই উত্তম তারা তাদের নৈতিক মূল্যকে অবিকৃত রাখতে পারে না, কেননা তারা সর্বদাই সমস্ত দুঃখ-কষ্টের পেছনে ওজর খুঁজে বার করে।
ধর্ম সম্পর্কে আপত্তি
ধর্ম সম্পর্কে দু’ধরণের আপত্তি দেখা যায়–বৌদ্ধিক এবং নৈতিক। বৌদ্ধিক আপত্তি অনুসারে বলা যায় যে কোন ধর্মকেই সত্য বলে মেনে নেওয়ার কোন কারণ নেই এবং নৈতিক আপত্তি অনুসারে বলা যায় ধর্মের উপদেশগুলি এমন এক সময় থেকে উঠে এসেছিল যখন মানুষ বর্তমান যুগের থেকেও অনেক বেশি নিষ্ঠুর ছিল। ফলে দেখা যাচ্ছে যে এই উপদেশগুলি অমানবিকতাকে চিরন্তন করবার জন্যই তৈরি এবং যদি এমন না হত তবে মানুষের নৈতিক বিবেকবোধ বর্তমানে আরো অনেক উন্নত হত।
প্রথমে বৌদ্ধিক আপত্তির কথাই ধরা যাক। বর্তমান বাস্তব যুগে এই প্রবণতাটি দেখা যায় যে ধর্ম সত্য না অসত্য তা নিয়ে কারুর কোন মাথাব্যথা নেই, কেননা ধর্ম সম্পর্কে যে প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ তা হল ধর্ম কার্যকরী কি না। একটি বিষয়ের উপর প্রশ্ন অন্য বিষয়ের উত্তর হতে পারে না। যদি আমরা খ্রীস্টধর্মকে বিশ্বাস করি তা হলে আমাদের উদ্দেশ্য হবে তার মধ্যে মঙ্গলময় কি আছে তা দেখা। আর যদি আমরা বিশ্বাস করব না এই রকম ভাবি তবে প্রশ্নটা হবে সেই মঙ্গলময় দিকগুলো কতটা মঙ্গলময় হয়ে দাঁড়াবে তার উপর ফলে, এই দু’ক্ষেত্রের প্রেক্ষাপট অবশ্যই স্বতন্ত্র। খ্ৰীষ্টীয়দের কাছে খ্রীষ্টধর্ম ভালো মনে হতেই পারে, যখন অবিশ্বাসীদের কাছে তা মন্দ বলে বিবেচিত। অধিকন্তু ঐ ব্যাপারে প্রত্যেকের বিশ্বাসের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র সব সিদ্ধান্ত থাকে এবং তাদের প্রশ্নগুলি তাদের প্রমাণের স্বপক্ষে তৈরি হয়ে থাকে। এর ফলে প্রকৃত প্রমাণের বিপক্ষে শত্রুতার সৃষ্টি হয় এবং ঘটনার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আমরা মনকে সেই বিষয়ে আর খাটাতে চাই না। কেননা পক্ষপাতশূন্য অবস্থায় আমাদের মন খাটতে অভ্যস্ত নয়।
একটি সরল বা পক্ষপাতশূন্য বৈজ্ঞানিক ভাবনা আছে যা গুণগত দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এবং এই সরল বৈজ্ঞানিক ভাবনা কদাচিৎ কোন মানুষের মধ্যে দেখা যায়, যে জগতের সমস্ত বস্তুগুলোকে বিশ্বাস করাটা তার কর্তব্য। এইজন্য ধর্ম প্রকৃতপক্ষে সত্য কিনা সে সম্পর্কে কোন রকম অনুসন্ধান না করে আমরা এই সিদ্ধান্তে বাস্তবপক্ষে পৌঁছাতে পারি না যে ধর্ম যা করে তা মঙ্গলের জন্যই করে। মহম্মদীয় ধর্ম এবং ইহুদি ধর্ম প্রভৃতি প্রতিটি ধর্মের সত্য সম্পর্কে মৌলিক প্রশ্নটি জড়িয়ে আছে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সঙ্গে। সেই সব যুগগুলোতে যখন ধর্ম বলতে যে শব্দটির জয়ঢাক বাজতো তা ঈশ্বর এবং যথার্থভাবে তার একটি নির্দিষ্ট অর্থ থাকত। কিন্তু যুক্তিবাদীদের কঠোর আক্রমণে তা ক্রমশই ম্লান হয়ে এসেছে। এই ব্যাপারটা বোঝা ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের পক্ষে সহজ হবে না যতক্ষণ আমরা বুঝতে না পারবো যে বর্তমানে যখন মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে এমন কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলে ঠিক কি বোঝাতে চাইছে, তা না বুঝলে। এ বিষয়ে ম্যাথিউ আর্নল্ড প্রদত্ত সংজ্ঞার যুক্তিপ্রসূত উদ্দেশ্যকে ধরা যাক, আমাদের মধ্যে এমন কোন ক্ষমতা নেই যা আমাদের পুণ্যবান করে তোলে। আমরা এই ব্যাপারটাকে আগের থেকেও অনেক বেশি অস্পষ্ট করে তুলি এবং নিজেদের কাছে বারবার এই প্রশ্ন করি যে এই পৃথিবী নামক গ্রহের পৃষ্ঠে জীবিত সত্তার উদ্দেশ্য ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য আছে এমন প্রমাণ আমাদের হাতে আছে কি না।
এই বিষয়ে ধার্মিক মানুষদের সচরাচর যে যুক্তি হয় তা মোটামুটি এই রকম, ‘ধরুন, আমি এবং আমার বন্ধু দুজনেই অসাধারণ বুদ্ধি ও নৈতিক উৎকর্ষের অধিকারী। কিন্তু এটা ভেবে নেওয়া খুব কঠিন যে অতি বুদ্ধিমান ও অতি পুণ্যবান হঠাৎই আসতে পারে। এইজন্য বলা যেতে পারে যে এখানে আমাদের মতো জীবন্ত অন্তত এমন একজন কেউ অবশ্যই থাকবে যে অতি বুদ্ধিমান ও নৈতিক উৎকর্ষের অধিকারী এবং যে তার অতি জাগতিক যন্ত্র ঘোরাতে শুরু করেছে আমাদের উৎপাদনের জন্য। আমি এ কথা বলতে দুঃখবোধ করছি যে যারা এই ধরণের যুক্তিকে খুব হৃদয়গ্রাহী বলে মনে করে তাদের মতো করে আমি মানতে পারি না। বিশ্বটা বিরাট, অতএব যদি আমরা এডিংটনকে বিশ্বাস করি, দেখবো যে এই বিরাট বিশ্বের কোন জায়গাতেই মানুষের মতো বুদ্ধিমান কেউ নেই। সেই তুলনায় বুদ্ধিমান প্রাণীর শরীর গঠন করতে কতটা বস্তু খরচ হয়েছে তা যদি মেপে দেখেন তবে বুঝতে পারবেন পূর্বের তুলনার পর। যদি আপনি জগতের সমুদয় বস্তুকে আপনার বিবেচনার অধীনে নিয়ে আসেন এবং সেই তুলনায় বুদ্ধিমান প্রাণীর শরীর গঠনের পরিমাপটি লক্ষ্য করতে চান তবে দেখবেন আগে যা ছিল তার অনন্ত গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলস্বরূপ, এটাও যদি অসম্ভব বলে মনে হয় যে আকস্মিকতার আইন তৈরি করবে জীবন্ত প্রাণী যারা বহু পরমাণুর সাধারণ নির্বাচনের ফলে বুদ্ধিমান হবে, তবে এটাও সম্ভব নয় যে এই বিশ্বে আমাদের মতো অতি অল্প পরিমাণ বুদ্ধিমান প্রাণী থাকবে যা বাস্তবে আমরা দেখতে পাই। এই ব্যাপারে আমাদের আবার বলতে হয় যে এই বিশদ পদ্ধতিটিকে নাটকের চরম দৃশ্যের মতো বিবেচনা করলে, আমরা দেখতে পাব যে আমরা প্রকৃতপক্ষে কোন অতি অদ্ভুত সুন্দর জিনিস মনে করিনি। যদিও আমি এ বিষয়ে যথেষ্ট সজাগ যে এমন বহু স্বর্গীয় জিনিস আছে যা আমার থেকেও অদ্ভুত সুন্দর। এই কারণে আমার যোগ্যতা যত দূরেই সমাধিস্থ হ’ক না কেন আমি তাকে খুব একটা যোগ্য বলে মনে করি না। অধিকন্তু আমার মস্তিষ্ক থেকে সাড়া পেলেও আমি একথা চিন্তা করতে পারি না। সমগ্র অনন্তের সর্বময় ঈশ্বর সর্বত্র এমনভাবে কাজ করতে পারেন যা, অপেক্ষাকৃত উত্তম বলে বিবেচিত হতে পারে। অবশ্য এ সম্পর্কে আমাদেব মস্তিষ্কের হঠাৎ ঝলকে-ওঠা সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করতে হবে। পৃথিবী সর্বদাই ব্যবহারযোগ্য থাকবে না। মানবজাতি অবলুপ্ত হবে। যদি মহাজাগতিক পদ্ধতিটি নিজেকেই নিজে মূল্যায়ন করে থাকে তাহলে তা আমাদের এই গ্রহকে ছেড়ে অন্য কোনো জায়গায় অবশ্যই কিছু কাজ করতে বাধ্য হবে। তাপ গতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী বিশ্ব ক্রমশ ফুরিয়ে যাচ্ছে এ কথাটা একপ্রকার অসম্ভব এবং বিশ্বের কোন জায়গার পরিপ্রেক্ষিতেই এই ধরনের সামান্য আগ্রহ বজায় রাখাও একেবারেই অসম্ভব। যদিও আমরা এই ধরনের কথা শুনে অভ্যস্ত যে যখন সময় আসবে তখন ঈশ্বর তাঁর চাকা, ঘোরাবেন। কিন্তু যদি আমরা এই ধরণের কথা বলি তাহলে আমাদের নিশ্চয়তাকে কেবলমাত্র বিশ্বাসের উপর নির্ভর করাতে হবে, তা কখনই একটুকরো বৈজ্ঞানিক প্রমাণের উপর নির্ভর করবে না। বৈজ্ঞানিক প্রমাণের উপর নির্ভর করে যতদূর বলা যায় তাতে খুব ধীরগতিতে বিশ্ব এমনভাবে এগোচ্ছে যা পৃথিবীর উপর এক করুণ অবস্থার সৃষ্টি করবে, এবং এটি ক্রমশ ধীরগতিতে দৃঢ়ভাবে চিরন্তন মৃত্যুগত কারণের আরও করুণ পর্যায়ে পৌঁছাবে। যদি বিশ্বের গতিপ্রকৃতির প্রমাণ হিসাবে এই ধারণাকে নেওয়া হয়, তাহলে আমি শুধুমাত্র এই বলতে পারি যে বিশ্বের এই ধরনের গতিপ্রকৃতি আমার কাছে কোন আবেদন রাখতে পারে না। এই জন্যে আমি পরিষ্কারভাবে মনে করি যে, ঈশ্বর বিশ্বাসের কোনরকম কারণ নেই, সেই বিশ্বাস যতই অস্পষ্ট হোক এবং যতই সূক্ষ্ম হোক। আমি পুরোনো অধিবিদ্যাগত যুক্তিগুলিকে একপাশে ফেলে রাখলাম যেহেতু ধর্মীয় আত্মপক্ষ-সমর্থনকারীরা নিজেদেরকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে।
আত্মা এবং অমরত্ব
খ্রীষ্টীয় ধর্মাবলম্বীরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলে থাকেন যে, খ্রীষ্টীয় গোষ্ঠীগুলির ক্ষেত্রে ব্যক্তি আত্মার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বর্তমান। এই ধরণের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা মৌলিকভাবে স্টোয়িকদের সঙ্গে সাদৃশ্য রাখে। যা গোষ্ঠীগুলির মধ্যে তাদের কার্যকলাপের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল এবং তার ফলে গোষ্ঠীগুলির মধ্যে রাজনৈতিক অধিকার প্রাপ্তির আশা একেবারেই বিলীন হয়ে গিয়েছিল। একজন অসাধারণ সুন্দর চরিত্রের মহান ব্যক্তি যে মঙ্গলময় কাজ করবেন সে সম্পর্কে একটি স্বাভাবিক ভাবনা আমাদের মধ্যে কাজ করে, কিন্তু, যদি সেই ব্যক্তিটিকে সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং সেই ধরণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয় যে সুযোগগুলি ঘটনাসমূহকে প্রভাবিত করে, তবে অবশ্যই সেই ব্যক্তি তাঁর স্বাভাবিক গতি থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বেন। ব্যক্তির স্বাভাবিক গতি থেকে এই ধরনের বিচ্যুতিকেই মঙ্গলময় হয়ে ওঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়। পূর্বের খ্ৰীষ্টীয় ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে এই ধরণের ঘটনাই ঘটত। এই ধারণা এমন একটি ব্যক্তিগত পবিত্রতার দিকে তাদের চালিত করত যা সম্পূর্ণভাবে তাদের স্বনির্ভর শুভকার্যের উপর নির্ভর করত, যেহেতু পবিত্রতা এমন একটি বস্তু যে বস্তুটি সেই সব মানুষরাই অর্জন করতে পারে যারা যে কোন কাজে একেবারেই নপুংসক (……. holyness had to be something that could be achieved by people who were impotent in action.)। এই কারণেই সামাজিক ধর্মগুলি খ্ৰীষ্টীয় নৈতিক আদশের বহির্ভূত। এমনকি আজকের দিনেও সাধারণ খ্রীষ্টীয় ভক্তরা এই কথা ভাবেন যে, একজন ঘুষখোর রাজনৈতিক নেতার চেয়ে অনেক বেশি বদমাশ একজন ব্যভিচারী ব্যক্তি। যদিও ঘুষখোর রাজনৈতিক ব্যক্তি সম্ভবত ব্যভিচারী ব্যক্তির চেয়ে সহস্রগুণে ক্ষতিকারক। ধর্ম ও নৈতিক উৎকর্ষতা সম্পর্কে মধ্যযুগীয় কল্পনা যা তৎকালীন সাধুসন্তদের ছবিগুলির মধ্যে দেখা যায় তা হল তাদের দেখতে অনেকটা জ্ঞান-ধোয়া মুখসম্পন্ন, দুর্বল এবং অভিমানী। সব থেকে নৈতিক উৎকর্ষের অধিকারী মানুষ সেই ধরণের মানুষ যে জগৎ থেকে অবসর গ্রহণ করেছে। সক্রিয় মানুষ কেবলমাত্র তাদের বলা হয় যারা সাধুসন্ত নামে সাধারণত সম্মানিত। এই ধরণের মানুষ সর্বদাই তাদের জীবনটাকে বাজে খরচা করে এবং সেন্ট লুই-এর তুর্ক-এর বিরুদ্ধে আমরণযুদ্ধে অংশগ্রহণ করাটাকেই তাদের জীবনের সার সত্য মনে করে। গীর্জাগুলো কখনই সাধুসন্তদের সম্মান প্রদর্শন করেনি, কেননা তারা আর্থিক বিষয়গুলিতে অথবা অপরাধীর জন্য নির্মিত আইনকে অথবা বিচার-ব্যবস্থাকে সংস্কার করে থাকেন। এই ধরনের মানবকল্যাণমূলক অবদানকে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে দেখা হয়নি। আমি মনে করি না মানব-ইতিহাসে এমন কোন একজন সাধু আছেন যার সাধুত্ব জনগণের উপযযাগিতার জন্য গড়ে উঠেছিল। সামাজিক এবং নৈতিক ব্যক্তির মধ্যে এই ধরণের বিচ্ছেদের ফলেই আত্মা এবং শরীরের মধ্যে বিচ্ছেদ ক্রমশই বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এই বিচ্ছেদের প্রমাণ আমরা খ্রীষ্টীয় অধিবিদ্যায় দেখতে পাই এবং সেই সমস্ত ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে দেখতে পাই যে ব্যবস্থাগুলো দেকার্তের দর্শন থেকে নিঃসৃত। খুব খোলাখুলিভাবে বলতে গেলে একজন একথা বলতেই পারে যে, মানুষের শরীর মানুষের সামাজিক এবং তার জাতিগত দিকের প্রতিনিধিত্ব করে যেখানে আত্মা তার ব্যক্তিগত দিকের প্রতিনিধিত্ব করে। আত্মার উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদান করে খ্রীষ্টীয় নীতিবিদ্যা নিজেকে পূর্ণভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে তুলেছে। আমি মনে করি, এটা একেবারেই পরিষ্কার যে শত শত বছরের খ্রীষ্টীয় মতবাদের মোট ফলাফল মানুষকে অধিক অহংকারী করে তুলতে সমর্থ হয়েছে এবং প্রকৃতি তাদের যতটা আবদ্ধ করে থাকে তার তুলনায় তারা নিজেদের মধ্যে অনেক বেশি আবদ্ধ। যে ধরণের সক্রিয় অনুভূতি মানুষকে তার অহংকারের চৌহদ্দির বাইরে নিয়ে যেতে পারে তা হল তার যৌনতা, তার পিতৃত্ব, মাতৃত্ব এবং স্বদেশিকতা অথবা তার ইতর প্রবৃত্তি। যৌনতাকে দোষারোপ করতে এবং তাকে পদাবনত করতে গীর্জা সব ধরণের কাজ করেছে। খ্রীষ্ট নিজেই পারিবারিক স্নেহ ভালবাসাকে নিন্দা করেছেন এবং তার বেশিরভাগ অনুগামীরা এমনই মনে করে থাকে এবং রোম সাম্রাজ্যের জনগণের মধ্যে স্বাদেশিকতা কোন স্থানই পায়নি। গসপেল-এ বর্ণিত পারিবারিক বিষয়গুলির বিরুদ্ধে পোলেমীয় ধারণা যতটা মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারত ততটা করতে অক্ষম হয়েছে। গীর্জা খ্রীষ্টের মাতাকে যথেষ্টই সম্মান প্রদর্শন করে কিন্তু যীশু নিজে সে ব্যাপারে খুব সামান্য আচরণই প্রদর্শন করেছেন। নারী, আমি তোমার সঙ্গে কি-ই বা করব?’ (জন, II, ৪) তাঁর মায়ের সঙ্গে কথা বলার ধরন এরকমই ছিল। তিনি এ-ও বলেছেন যে, তিনি এসেছেন তার বাবার বিপক্ষে একজন মানুষকে প্রতিষ্ঠা করতে এবং মায়ের বিপক্ষে কন্যাকে প্রতিষ্ঠা করতে এবং শাশুড়ির বিপক্ষে শ্যালিকাকে প্রতিষ্ঠা করতে এবং যে তার চেয়ে তার নিজের বাবা-মাকে বেশি ভালবাসে তার কাছে সে যোগ্য নয় (ম্যাথু, X, 35-7)। এই সমস্ত কিছুর অর্থ হল শাস্ত্রীয় নীতির জন্য পরিবারগুলির মধ্যে জৈবিক বন্ধনকে নষ্ট করে ফেলা জগতে বেশিরভাগ অসহিষ্ণুতার সৃষ্টি করছে এবং খ্রীষ্টীয়ধর্মের বৃদ্ধির সঙ্গে তা চারদিকে বিস্তৃতি লাভ করেছে।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ তার চরমত্ব লাভ করেছে ব্যক্তি আত্মা অমরত্ব প্রসূত শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার মধ্যে, যা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনন্ত আনন্দ অথবা অনন্ত দুঃখ ভোগ করে থাকে। এই গুরুত্বপূর্ণ স্বতন্ত্রতা যে ঘটনার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে তা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। উদাহরণস্বরূপ, পুরোহিত নিজের মনে বিড়বিড় করে মন্ত্র বলতে বলতে ঠিক যখন আপনার উপর জল ছেটাচ্ছে তখনি যদি আপনি মারা যান তবে আনন্দের উত্তরাধিকারী হবেন, অন্যথায় জুতোর গোড়ালি ভেঙে যাবার জন্য যখন বিরক্তির চোটে আপনি বাজে ভাষা ব্যবহার করছেন ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ বজ্রপাতে আপনার মৃত্যু হল, আর সঙ্গে সঙ্গে আপনি অনন্ত নরকের অধিকারী হলেন। আমি এমন কথা বলি না যে, আধুনিক প্রোটেস্টান্ট খ্রীষ্টীয়রা বিশ্বাস করেন, অথবা আধুনিক ক্যাথলিক খ্রীষ্টীয়রা এই ঘটনাকে যারা শাস্ত্রীয় তত্ত্বের দ্বারা খুব বেশি প্রভাবিত নয় তারা এ ঘটনা বিশ্বাস করে না, কিন্তু আমি অবশ্যই বলব যে এই ঘটনাটি এমন গোঁড়া শাস্ত্রীয় নীতির মধ্যে পড়ে যা এখনো পর্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করা হয়। মেসিকো ও পেরুর স্পেনীয়রা ইন্ডিয়ান শিশুদের খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করে সঙ্গে সঙ্গে তাদের মগজ-ধোলাই করত এবং এইভাবেই তারা এইসব শিশুদের স্বর্গে যাবার পথকে নিশ্চিত করে থাকত। তাদের এই ধরণের কাজকে নিন্দা করবার জন্য গোঁড়া খ্রীষ্টীয়রা কোন যৌক্তিক কারণ খুঁজে বার করতে পারে না, যদিও বর্তমানে সকলেই এরকম করে থাকে। বহু উপায়েই খ্রীষ্টীয় ধরণের ব্যক্তিগত অনৈতিকতাব নীতি নৈতিকতার উপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব সৃষ্টি করে, এবং আত্মা ও শরীরের উপর অধিবিদ্যাগত বিচ্ছেদ দর্শনের উপর বিপজ্জনক প্রভাব ফেলে থাকে।
অসহিষ্ণুতার উৎসসমূহ
খ্রীষ্টীয়ধর্মের এটাই সব থেকে কৌতূহলোদ্দীপক বৈশিষ্ট্য যে এই ধর্মের সূচনার সঙ্গে সঙ্গেই অসহিষ্ণুতা সারা জগতে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমি মনে করি ইহুদিদের ঈশ্বরের ন্যায্যতা এবং অতিবাস্তবতার উপর বিশ্বাসের কারণেই এই ধরণের ঘটনা ঘটেছিল। এই ধরণের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ইহুদিদের মধ্যে কেন গড়ে উঠেছিল সে সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। সম্ভবত তাদের এই ধরণের মনোভাব গড়ে উঠেছিল তাদের বন্দীদশার প্রতিক্রিয়ার সময়টাতে যখন ইহুদিদের বিদেশী জনসাধারণের সঙ্গে মিশিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছিল। যদিও এটাও হতে পারে যে, তাদের বহু পয়গম্বররা ব্যক্তিগত নৈতিক উৎকর্ষতার উপর জোর দেওয়ার ব্যাপারটি আবিষ্কার করেছিল এবং সেই ধরনের ধারণা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিল যে ধারণার ফলে মনে করা হত যে, একটি ধর্ম ছাড়া অন্যান্য যে কোন ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা এক ধরণের পাপ। এই দুই ধারণা পাশ্চাত্য ইতিহাসে অসাধারণ ধ্বংসাত্মক প্রভাবের সৃষ্টি করেছে। কনষ্টেনটাইনের যুগের আগেই গীর্জা রোমান রাষ্ট্রের দৌলতে খ্রীষ্টীয়দের যথেষ্ট হয়রান করেছিল। যদিও এই হয়রানি ছিল অল্প, এবং অন্তর্বর্তীকালীন এবং সবৈভাবে রাজনৈতিক। কনষ্টেনটাইনের যুগ থেকে সপ্তদশ শতকের শেষ পর্যন্ত সর্বদা খ্রীষ্টীয়রা অন্যান্য খ্রীষ্টীয়দের দ্বারা মারাত্মকভাবে হয়রান হয়েছিল, যে হয়রানি রোম সম্রাটের দ্বারা তারা কখনও হয়নি। খ্রীষ্টীয়ধর্মের উত্থানের আগে এই ধরণের হয়রানিকর আচরণ কেবলমাত্র ইহুদিদের মধ্যে ছাড়া প্রাচীন জগতে আর কোথাও জ্ঞাত ছিল না। উদাহরণস্বরূপ আপনি যদি হেরোডোটাস পড়েন, তাহলে দেখতে পাবেন যে বিদেশী রাজ্যগুলিতে তিনি ভ্রমণ করেছিলেন, তারা সবাই ছিল স্নিগ্ধ এবং সহিষ্ণু আচরণসম্পন্ন। তবে এটাও সত্য কখনও কখনও তাদের অদ্ভুত বর্বরোচিত প্রথা তার মনে আঘাত দিয়েছে, কিন্তু সাধারণভাবে তিনি বিদেশী প্রথাগুলি এবং দেবতাদের কাছ থেকে আতিথেয়তাপূর্ণ ব্যবহার পেয়েছেন। তিনি উদ্বিগ্নতার সঙ্গে এটি প্রমাণ করেননি যে, যে-সব মানুষদের ইহুদি বলে আখ্যায়িত করা হত তারা যদি অন্য কোন জাতির নামে অ্যাখ্যায়িত হত তবে অনন্ত শাস্তি ভোগ করত এবং তাদের শাস্তি শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত। এই ধরণের আচরণ কেবলমাত্র খ্রীষ্টানদের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। এটা সত্য যে আধুনিক খ্ৰীষ্টীয়রা এই ব্যাপারে অনেক কম বলবান, কিন্তু এর জন্য খ্রীষ্টীয় ধর্মকে কোন ধন্যবাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই, ধন্যবাদ দিতে হবে সেই সব মুক্ত চিন্তাবিদদের যারা নবজাগরণ থেকে বর্তমান দিন পর্যন্ত খ্রীষ্টীয়দের ঐতিহ্যবাহী বিশ্বাসকে যথেষ্ট পরিমাণ লজ্জিত করতে পেরেছে। বর্তমান খ্রীষ্টীয়দের মুখে এই ধরনের কথা শুনে খুব আনন্দ পাবেন যে, খ্রীষ্টীয়ধর্ম বাস্তবে খুব নমনীয় এবং যুক্তিসংগত। কিন্তু যারা একথা বলবেন তারা এই ঘটনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। এই ধর্মের সমগ্র নমনীয়তা ও যৌক্তিকতা সেইসব মানুষদের শিক্ষা প্রদানের ফলে সম্ভব হয়েছিল যারা প্রত্যেকে তাদের নিজেদের সময়ে গোঁড়া খ্রীষ্টীয়দের দ্বারা হয়রান হয়েছিল। বর্তমানে কেউই একথা বিশ্বাস করে না যে, এই জগৎ সৃষ্টি হয়েছিল ৪০০৪ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে, কিন্তু খুব। বেশি দিন আগে নয় যখন এই বিষয় সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করাটা ছিল এক জঘন্য অপরাধ। আমার প্রপিতামহ, এতনা-র (etna) ঢালে লাভার গভীরতা পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, গোঁড়া খ্ৰীষ্টীয়রা জগৎকে যতটা পুরোনো বলে মনে করে তার থেকেও জগৎ অনেক বেশি পুরানো এবং তাঁর এই মতামত তিনি একটি বইতে প্রকাশ করেন। এই অপরাধের ফলে তাঁকে সেখানকার কাউন্টির দ্বারা নিগৃহীত হতে হয়েছিল এবং অবশেষে সমাজ থেকে নির্বাসিত হতে হয়েছিল। যদি তিনি বাজে পরিস্থিতিসম্পন্ন মানুষ হতেন তাহলে নিঃসন্দেহে তার শাস্তি আরও গুরুতর হয়ে উঠত। সুতরাং গোঁড়া খ্রীষ্টীয়দের কাছে এটা বলা খুব একটা কৃতিত্বের নয় যে, তারা এখন সেই সমস্ত অসংগতিগুলোকে বিশ্বাস করে না যেগুলোকে তারা ১৫০ বছর আগে বিশ্বাস করত। প্রচণ্ড প্রতিরোধকে প্রতিহত করেই ক্রমশ এই সমস্ত খ্রীষ্টীয় মতবাদগুলিকে দুর্বল করা হচ্ছে এবং তা সম্ভব হয়েছে মুক্ত চিন্তাবিদদের প্রচণ্ড আক্রমণের ফলে।
স্বাধীন–ইচ্ছার মতবাদ
প্রাকৃতিক আইন সম্পর্কিত বিষয়ের উপর খ্রীষ্টীয়দের আচরণ কৌতূহলোদ্দীপকভাবে দ্বিধাগ্রস্ত ও অনিশ্চিত। একদিকে ছিল স্বাধীন-ইচ্ছার মতবাদ, যে মতবাদ বেশিরভাগ খ্ৰীষ্টীয়রা বিশ্বাস করত। এই মতবাদ অনুযায়ী মনে করা হত যে অন্তত মানবজাতির কর্মসমূহ প্রাকৃতিক আইনের বিষয় হওয়া উচিত নয়। অন্যদিকে, বিশেষত অষ্টাদশ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে, এই বিশ্বাস গড়ে ওঠে যে ঈশ্বর হলেন আইনপ্রণেতা। স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রধান প্রমাণ হিসাবে প্রাকৃতিক আইনের প্রতি বিশ্বাস গড়ে ওঠে। অধুনা স্বাধীন-ইচ্ছার খাতিরেই আইনের রাজত্বের বিরুদ্ধে আপত্তি গড়ে উঠেছে। পূর্বের আইনপ্রণেতা হিসেবে ঈশ্বরের অস্তিত্বজ্ঞাপক প্রাকৃতিক আইনকে বিশ্বাস করার চেয়ে সেই আপত্তিকে অনেক দৃঢ়তার সঙ্গে বোঝাবার চেষ্টা শুরু করা হয়েছে। বস্তুবাদীরা পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রগুলির দ্বারা দেখাতে চেয়েছেন, বা দেখাবার চেষ্টা করেছেন, যে মানবশরীরের গতিপ্রকৃতি যান্ত্রিকভাবে নির্ধারিত। ফলস্বরূপ সেই সব বস্তু যাদের সম্পর্কে আমরা আলোচনা করি এবং প্রতিটি অবস্থার পরিবর্তন যাকে আমরা প্রভাবিত করে থাকি, তা সম্ভাব্য স্বাধীন ইচ্ছার পরিধির বাইরেই ঘটে। যদি এরকমই হয়, তবে আমাদের শৃঙ্খলমুক্ত ইচ্ছার মূল্য নিতান্তই কম। যদি একটি মানুষের কবিতা রচনা ও খুন করার ক্ষেত্রে তার দৈহিক সঞ্চালন তার সেই ধরনের কার্য নিযুক্তি থেকে নিষ্পন্ন হয় যা কেবলমাত্র পদার্থগত কারণনির্ভর, তবে তাকে একদিকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিয়ে আর একদিকে তার মর্মর মূর্তি নির্মাণ করাটা একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অধিবিদ্যার কোন ব্যবস্থায় মুক্ত চিন্তার রাজত্ব থাকলেও থাকতে পারে যেখানে ইচ্ছাগুলো স্বাধীন হবে। কিন্তু যেহেতু এই সব স্বাধীন ইচ্ছা অন্যান্যদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে থাকে কেবলমাত্র দৈহিক সঞ্চালনের মাধ্যমে, তাই সেখানকার স্বাধীনতার রাজত্ব ঠিক সেই ধরনের কিছু একটা হয়ে উঠবে যা কখনও সংযোগের বিষয় হয়ে উঠতে পারবে না এবং কখনও সামাজিক গুরুত্ব লাভ করতে পারবে না।
এই প্রসঙ্গে বলতে গেলে আবার বলতে হয়, যে-সব খ্ৰীষ্টীয়রা এই মতবাদকে গ্রহণ করেছিল তাদের উপর ক্রমবিবর্তন উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। তারা এটা দেখেছে যে বিবর্তন কেবলমাত্র মানুষের ক্ষেত্রেই পরিবর্তন দাবি করেনি, মানুষের থেকে একেবারে স্বতন্ত্র প্রাণীদের গঠনেও সে পরিবর্তন এনেছিল। এই জন্য, মানুষের মধ্যে স্বাধীন ইচ্ছাকে বাঁচিয়ে রাখতে তারা জীবন্ত বস্তুর আচরণ সম্পর্কে পদার্থগত ও রসায়নতগত প্রক্রিয়ার ব্যাপারে যতবার নতুন নতুনভাবে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা হয়েছে ততবার বাধা দিয়েছে। সমস্তরকম নিম্ন শ্রেণীর প্রাণীকে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র হিসাবে মনে করার জন্য দেকার্তের যে অবস্থা দাঁড়িয়েছিল তা হল তিনি উদার ধর্মশাস্ত্রবিদদের সমর্থন হারিয়েছিলেন। নিরবচ্ছিন্নতার মতবাদ তাদের আরও অনেক দূর নিয়ে গিয়েছিল এবং এখনো তাদের এই ধারণায় ভাবিত করে যে যাকে মৃত বস্তু বলে সেই সব বস্তু অপরিবর্তনীয় আইনের দ্বারা তাদের আচরণগত দিক দিয়ে দৃঢ়ভাবে পরিচালিত হয় না। তারা ঘটনাটি এড়িয়ে চলে, কেননা, যদি আপনি আইনের শাসনকে বিলুপ্ত করে দেন তবে ভোজবাজির সম্ভাবনাকেও আপনাকে বিলুপ্ত করতে হবে, যেহেতু ভোজবাজি ঈশ্বরের কার্য যা সেই সব আইনের বিপরীত এবং যা সাধারণ ঘটনাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও আমি জানি যে আধুনিক উদার ধর্মতত্ত্ববিদরা সুগভীরতার ভাব দেখিয়ে প্রমাণ করতে চায় যে সমস্ত সৃষ্টিই এক আশ্চর্যজনক ঘটনা। সুতরাং তারা কোন একটি বিশেষ ঘটনাকে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের প্রমাণ বলে প্রচার করতে চায় না।
প্রাকৃতিক আইনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার এই প্রভাবে, কোন কোন খ্রীষ্টীয় আত্মপক্ষ-সমর্থনকারী পরমাণু সম্পর্কিত সাম্প্রতিক মতবাদকে আক্রমণ করে বসেছিল। তারা এটা দেখতে চাইল যে এতদিন পর্যন্ত যে-সব পদার্থগত আইনগুলো আমরা বিশ্বাস করে এসেছি তা বহুসংখ্যক পরমাণু সম্পর্কে গড়ে আপাত সত্য হলেও, প্রতিটি স্বতন্ত্র ইলেকট্রন তার ইচ্ছা অনুসারেই আচরণ করে থাকে। আমার নিজের বিশ্বাস যে এটা একটা অস্থায়ী অবস্থা। পদার্থবিজ্ঞানীরা অবশ্যই ঠিক সময়মত মুহূর্ত-ঘটনাগুলি (Minute phenomena) কেমনভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় তার সূত্র আবিষ্কার করে ফেলবেন, যদিও সেই সব সূত্রগুলি ঐতিহ্যবাহী পদার্থবিজ্ঞানের থেকে স্বতন্ত্র হতে পারে। যদিও, এটাও ঘটতে পারে যে, দেখা গেল আধুনিক মতবাদগুলি, যেমন মুহূর্ত-ঘটনাগুলির সম্পর্কে যে মতবাদগুলি আছে, সেগুলি যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও কোন কিছুকে প্রভাবিত করার অসমর্থতার দরুন কোন রকম বাস্তবিক গুরুত্বসম্পন্ন হয়ে উঠবে না। যে কোন বস্তুর নিজ নিজ গতির ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার মতোই পরমাণুগুলি নিজ নিজ গতির ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র হওয়ার ফলে খুব সহজেই। তারা পুরানো সূত্রগুলির পরিধির সঙ্গে সংগতিকর হয়ে উঠল। আমাদের পূর্বের আলোচনাকে টেনে এনে আমরা আবার বলতে পারি যে, একটা কবিতা লিখতে বা একটা খুন করতে বেশ কিছু কালির পরমাণুকে অথবা সীসার পরমাণুকে গতিসম্পন্ন করে তুলতে হয়। যে-সব ইলেকট্রনগুলি দিয়ে কালিটা তৈরি সেই ইলেকট্রনগুলি অবশ্যই পেনের ডগায় নিজের খেয়ালে নাচতে পারে এবং এই পেনের ডগাটি পূর্ণ পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী গতিশীল, এবং এটাই একমাত্র সেই গতি যা কবি এবং প্রকাশকের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই কারণে বলা যায় যে, আধুনিক মতবাদগুলি মানবিক আগ্রহের সেই সমস্ত সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামায় না, যে সমস্যাগুলির সঙ্গে ধর্মতত্ত্ববিদরা সম্পর্কিত।
ফলস্বরূপ স্বাধীন ইচ্ছা ঠিক যেখানে ছিল সেখানেই থেকে গেল। অধিবিদ্যার চরম বিষয় হিসাবে যা কিছুই এর সম্পর্কে চিন্তা করা হোক না কেন, বাস্তবে কেউই এই মতবাদে বিশ্বাসী নয়। প্রত্যেকেই সর্বদা এটা বিশ্বাস করেছে যে, একটি চরিত্রকে বিশেষরূপে শিক্ষা দেওয়া সম্ভব। প্রত্যেকে এটাও বিশ্বাস করেছে যে, আফিম অথবা মদ আচরণের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। স্বাধীন ইচ্ছার বাণী এই মতামত পোষণ করে থাকে যে, মানুষ তার ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে মদের নেশা এড়াতে পারে, কিন্তু তারা এই মতবাদ পোষণ করে না যখন একটি লোক নেশাগ্রস্ত হয় তখন সে ছিচকাঁদুনি কাদার মতোই পরিষ্কার করে ব্রিটিশ সংবিধান’ কেও বলে যেতে পারে। যারা শিশুদের সম্পর্কে এসেছেন তারা প্রত্যেকেই এই কথা জানেন যে দুনিয়ার যে কোন বিরাট বাগ্মিতাপূর্ণ ধর্মপ্রচারের থেকে শিশুকে অনেক বেশি পুণ্যবান করে তোলে সুস্বাস্থ্যকর খাদ্য। স্বাধীন ইচ্ছার মতবাদ গুলিকে অভ্যাস করলে যে ফল লাভ হয় তা হল এই মতবাদ সাধারণ জ্ঞান থেকে মানুষকে সরিয়ে নিয়ে এসে তাকে যৌক্তিক সিদ্ধান্তের অধিকারী করে না। যখন কোন মানুষ সেই পথে কাজ করে যা আমাদের কাছে বিরক্তিকর তখন তাকে আমরা দুষ্টু বলে ভাবি। কিন্তু এটা করে আমরা আসল ঘটনাকে এড়িয়ে যাই যে, তার বিরক্তিকর আচরণগুলো সেইসব পূর্ববর্তী কারণের ফল, যে কারণগুলিকে আপনি ভাল করে দেখলে দেখতে পাবেন যে, সেগুলি সেই বিরক্তিকর আচরণকারী ব্যক্তির জন্মমুহূর্তের আগে আপনাকে নিয়ে যাবে এবং সেই সব কারণের পিছনে যেসব ঘটনাগুলো আপনাকে দেখাবে, তাতে আপনি দেখতে পাবেন যে, সেইসব ঘটনাগুলির জন্য সেই ব্যক্তি কোনভাবেই দায়ী নয় বা তাকে দায়ী করা কল্পনাতেও সম্ভব নয়।
কোন ব্যক্তি একজন মানুষের সঙ্গে যে রকম আচরণ করে ভুলক্রমেও একটি মোটরগাড়ির সঙ্গে সেরকম আচরণ করবে না। যখন একটি গাড়ি চলে না, তখন সেই গাড়িটির এই বিরক্তিকর আচরণকে সে পাপ বলে ভাবে না, এবং সে বলে না : তুমি একটা দুষ্টু মোটরগাড়ি, যতক্ষণ না তুমি চলবে ততক্ষণ আমি তোমায় পেট্রল দেব না। সে চেষ্টা করবে মোটরগাড়িটা কোন্ জায়গায় খারাপ হয়েছে তা বার করতে এবং তা ঠিক করতে। কিন্তু এই সাদৃশ্যমূলক ঘটনা যখন মানবশিশুর বেলায় ঘটানো হয় তখন তা পবিত্র ধর্মপ্রসূত সূত্রের বিপরীত হয়ে ওঠে এবং এই বিপরীত ধর্ম ছোট শিশুর শিক্ষার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়। অনেক ছোট শিশুরই নানান বাজে অভ্যাস থাকে কিন্তু সেই অভ্যাসগুলিকে চিরন্তন করে তোলা হয় শাস্তির দ্বারা। কিন্তু তাদের বদ অভ্যাসগুলিকে লক্ষ্য না করলে তার মধ্যে ঐ বাজে অভ্যাসকে চিরন্তন করে তোলার ঘটনাটিকে পাশ কাটানো যাবে। যে-সব সেবিকারা শিশুদের সেবা করে তারা কদাচিৎ শাস্তি ব্যাপারটাকে বেঠিক বলে মনে করে। এই রকম শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে তারা শিশুর মানসিক রোগের কারণ সৃষ্টির ঝুঁকি নিয়ে থাকে। যখনই মানসিক রোগ ঘটে যায় বিচারালয়গুলিতে তাকে আচরণগত দিক থেকে ক্ষতিকারক বলে প্রমাণ করা হয়, কিন্তু অতীতের শাস্তির প্রমাণ হিসাবে দেখা হয় না। (আমেরিকার নিউইয়র্ক রাজ্যে) মানসিক রোগগ্রস্ত ব্যক্তিদের উপর সাম্প্রতিক ফৌজদারী মোকদ্দমা সংক্রান্ত বিষয়ক আলোচনাকে আমি এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করেছি।
এই সব দুর্বল মানসিকতাসম্পন্ন ও স্নায়ুরোগগ্রস্ত শিশুদের পর্যবেক্ষণ করেই শিক্ষা ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সংস্কার সংঘটিত হয়েছে। এর কারণ ছিল এই সব শিশুরা তাদের ব্যর্থতার জন্য নৈতিক ভাবে দায়ী ছিল না। ফলস্বরূপ যে-কোন সুস্থ শিশুর থেকে এই সব শিশুদের জন্য অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক শিক্ষা প্রদানের প্রয়োজন ছিল। কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই নিয়ম বলবৎ ছিল যে, যদি কোন শিশু তার পড়া ঠিক মতো করতে না পারে, তবে তার জন্য সঠিক পন্থা ছিল তাকে বেত্রাঘাত করা, কিন্তু এই ধরনের শাস্তি অপরাধমূলক আইনে দেখা যায়। এটা সত্য যে অপরাধ প্রবণতাসম্পন্ন মানুষকে অবশ্যই থামানো উচিত, কিন্তু যে মানুষ জলাতঙ্করোগ হওয়ার ফলে তোক দেখলেই কামড়াতে আসছে, আমার মনে হয় তাকে কেউ নৈতিকভাবে দায়ী মনে করবে না। যে মানুষটি প্লেগ রোগাক্রান্ত তাকে অবশ্যই তার রোগ আরোগ্য পর্যন্ত একটা নির্দিষ্ট জায়গায় বন্দী করে রাখতে হবে, কিন্তু এর জন্য তাকে কেউ বদমাস বলে ভাববে না। এই একই রকম আচরণ করা উচিত সেইসব মানুষের সঙ্গে যারা দলিল কিংবা নোট জাল করার অপরাধমূলক রোগে ভুগছে। অপরাধ অপরাধই, তাই কোন অপরাধকে খুব বড় কিংবা ছোট বলে ভাবা উচিত নয়। কিন্তু এই ধরনের সাধারণ জ্ঞানগুলোকে খ্রীষ্টীয় নীতি বিদ্যায় ও অধিবিদ্যায় অস্বীকার করা হয় ।
কোন গোষ্ঠীর উপর যে-কোন প্রতিষ্ঠানের নৈতিক প্রভাবকে বিচার করে দেখতে গেলে, আমাদের বিবেচনা করে দেখতে হবে সেই সব ধরনের আবেগ গুলোকে যে আবেগগুলো এই প্রতিষ্ঠানের ভিতর মূর্ততা লাভ করেছে, এবং যে মাত্রায় এই প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পেয়েছে এই আবেগ ততটাই ভিত গাড়তে পেরেছে সেই গোষ্ঠীটির বুকে। কখনও কখনও এই ধরনের আবেগগুলিকে স্পষ্ট রূপে বোঝা যায়, আবার কখনও কখনও তা একেবারেই গুপ্ত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, আলপাইন ক্লাবের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই ধরনের মূর্ত আবেগ তার সদস্যদের দুঃসাহসিক অভিযানের দিকে উৎসাহিত করে, অন্যদিকে জ্ঞানীগুণী সমাজের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা আবেগ সদস্যদের জ্ঞানের দিকে তাড়িত করে। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানরূপে পরিবারগুলোতে যে আবেগ গড়ে ওঠে তা হিংসা ও বাবা মার অনুভবগত। একটি ফুটবল ক্লাব ও একটি রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা আবেগ সর্বদা তার সদস্যদের প্রতিযোগিতামূলক খেলায় অনুপ্রাণিত করে, কিন্তু দুটি বৃহৎ সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেমন গীর্জা ও রাষ্ট্র তাদের মনস্তাত্ত্বিক গতিপ্রকৃতির দিক থেকে অনেক বেশি জটিল। কোন রাষ্ট্রের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল অভ্যন্তরীণ অপরাধী ও বহিঃশত্রুদের বিরুদ্ধে নিশ্চয়তার বন্দোবস্ত করা। শিশুদের মানসিক প্রবণতায় এই ভাব শিকড় গেড়ে থাকে যে যখন তারা কোন কিছুতে ভয় পায় তখন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে এবং একটি বড়োসড়ো মানুষকে খোঁজে যে মানুষটি তাদের ভেতরে নিশ্চয়তার চেতনা সৃষ্টি করবে। গীর্জাগুলোর উৎস অনেক বেশি জটিল। নিঃসন্দে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ উৎসটি হ’ল ভয়। বর্তমানেও ব্যাপারটি দেখা যায় যে যখনই মানুষ কোন কিছুকে ভয় পায় তখনই তাদের চিন্তাভাবনা ঈশ্বরের দিকে ঘোরে। যুদ্ধক্ষেত্র, মহামারী, ধ্বংস, এই সমস্ত কিছু মানুষকে ধার্মিক করে তোলে। যদিও ভয়াবহ দিকগুলো ছাড়াও ধর্মের অন্যান্য আবেদন আছে। আমাদের মানবিক আত্ম-মূল্যায়নের দিকে ধর্মের আবেদন উল্লেখযোগ্য। যদি খ্রীষ্টীয়বাদ সত্য হয়, তবে মনুষ্যজাতি নিজেকে যতটা দুর্দশাগ্রস্ত কৃমিকীট মনে করে ততটা তারা নয়। তারা বিশ্ব-স্রষ্টা ঈশ্বরের স্বার্থের বিষয়, যে ঈশ্বর তাদের সাথে আনন্দে থাকতে গিয়ে সমস্যাকে গ্রহণ করেন, যখন তারা তার সাথে ভাল আচরণ করে তখন তিনি আনন্দিত হন কিন্তু যখন তারা তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে তখন নিরানন্দিত হন। এটা সত্যই একটি মহান প্রশংসাসূচক ঘটনা। একটি পিঁপড়ের বাসা পর্যবেক্ষণ করে আমাদের এই চিন্তা করা উচিত নয় যে আমাদের খুঁজে বার করতে হবে সেই ধরনের পিঁপড়েদের যারা নিজেদের ধরনের কর্তব্য গুলো করছে। এছাড়াও আমাদের এই ধরনের চিন্তাও করা উচিত নয় যে পিঁপড়ে গুলো নিজেদের ধরনের কর্ম থেকে বিরত তাদের বেছে বেছে তুলে আগুনে নিক্ষেপ করতে হবে। যদি ঈশ্বর আমাদের ক্ষেত্রে এই ধরনের কাজ করেন তবে তা আমাদের গুরুত্বের দিক থেকে প্রশংসাসূচক হবে। এটা আরও আনন্দময় প্রশংসাসূচক ব্যাপার হবে যদি ঈশ্বর আমাদের মধ্যে যারা ভাল তাদের চির-স্বর্গের সুখকে উপহার হিসেবে প্রদান করেন। এছাড়াও তুলনামূলক আধুনিক একটি ধারণা পেতে পারি যে ধারণা অনুসারে বলা যেতে পারে জাগতিক বিবর্তন এমনভাবে পরিকল্পিত হয়েছে যে তার ফলে যা কিছু ঘটে তাকেই আমরা মঙ্গল বলে থাকি–এর অর্থ হল, বিবর্তনের ফলে যা কিছু ঘটে তা আমাদের মনে এক রকম আনন্দের সৃষ্টি করে থাকে। তাই আবার বলতে হয় যে এটা মনে করাটা একটা বাতুলতায় দাঁড়াবে যে এই বিশ্বটি নিয়ন্ত্রিত হয় এমন একটি সত্তার দ্বারা যিনি আমাদের রুচি এবং সংস্কারের সঙ্গে সমান অংশগ্রহণ করে থাকেন।
ধার্মিকতার ধারণা
তৃতীয়ত, যে মনস্তাত্ত্বিক তাড়নাকে ধর্মের মধ্যে মূর্ত হতে দেখা যায় তা ধার্মিকতার কল্পনা গড়ে তোলে। আমি এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন যে বহু মুক্ত চিন্তাবিদরা এই কল্পনা বা ধারণাকে মহান শ্রদ্ধার চোখে দেখে থাকেন। গোঁড়া ধর্মের অবক্ষয়ের পরেও তারা মনে করেন এই ধরণের ধারণাকে সংরক্ষণ করা উচিত। কিন্তু আমি এই বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে একমত নই। ধার্মিকতার ধারণার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করলে আমার মনে হয় এই ধারণার শিকড় অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবাবেগ বা যৌনপ্রেমের মধ্যে নিহিত এবং যাকে যুক্তির অনুমোদন দিয়ে আরও বেশি শক্তিশালী করা উচিত নয়। ধার্মিকতা এবং অধার্মিকতা দুটোকে এক সাথেই আলোচনা করা আবশ্যক এবং একটিকে গুরুত্ব না দিয়ে আর একটিকে গুরুত্ব দেওয়া অসম্ভব। এখন আমাদের বুঝতে হবে, অধার্মিকতা বলতে বাস্তবে কি বোঝায়? বাস্তবে এটি এমন একটি ধরনের আচরণ যা সাধারণ মানুষ অপছন্দ করে থাকে। উক্ত ধরনের আচরণকে অধার্মিকতা বলে উল্লেখ করে এবং এই ধারণার চারপাশে বিশদ নৈতিক ব্যবস্থাকে সাজিয়ে তুলে জনতা তাদের আপন অপছন্দের ব্যাপারগুলোর প্রতিশোধমূলক শাস্তি প্রদান করে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকে। ধারণা অনুযায়ী সাধারণ জনতা ধার্মিক। তারা তাদের আত্ম-মূল্যায়নকে বর্ধিত করে থাকে ঠিক তখন যখন তারা তাড়নার বশে নিষ্ঠুরতার পর্যায়ে পৌঁছায়। এটা এক ধরনের অনৈতিক হত্যামূলক মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা এবং এক অন্য পথের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা যে পথের আশ্রয় নিয়ে অপরাধীদের শাস্তি প্রদান করা হয়ে থাকে। এইজন্য ধার্মিকতার ধারণার সারবস্তুটি হল বিচারের নামে নিষ্ঠুরতার বোরখা পরা ধর্ষকামের বহির্গমন (The essence of the conception of right eousness, therefore, is to afford an outlet for sadism by Cloaking cru elty as justice.) I
কিন্তু, আমরা বলতে পারি, ধার্মিকতার ব্যাপারে আপনারা যে ধারণা পোষণ করে থাকেন তা আপনাদের ধারণা অনুযায়ী সেইসব হিব্রু পয়গম্বরদের আবিষ্কার যা সর্বৈবভাবে তাদের নিজেদের কাছেই অবাস্তব। এই সত্য পরিলক্ষিত। হিব্রু পয়গম্বরদের মুখে ধার্মিকতার অর্থ ছিল তাই যা তাদের ও ইয়াহবে-র দ্বারা অনুমোদিত ছিল। যে-কেউ দেখতে পারেন যে খ্রীষ্টের দ্বাদশ শিষ্যের দ্বারা রচিত সংহিতায় এই ধরনের আচরণ প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে এই শব্দগুলি উচ্চারণ করে তাঁরা ঘোষণা করছেন : কারণ ইহা পবিত্র আত্মা ও আমাদের কাছে মঙ্গলময় বলে মনে করা হয়’ (অ্যাক্ট xv. 28)। ঈশ্বরের রুচি ও মতামতের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা এই ধরনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক নিশ্চয়তা কখনও কোন প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি হতে পারে না। এই ধরনের ধারণা সর্বদাই সমস্যাজনক হয়ে উঠেছে এবং প্রোটেস্টান্টবাদ এই ধরনের সমস্যাজনক ধারণাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। একজন নতুন পয়গম্বর সর্বদাই এই কথা বলে এসেছে যে তার মতবাদ তার পূর্বসূরীদের অপেক্ষা অনেক বেশি প্রমাণসিদ্ধ ও খাঁটি। প্রোটেস্টান্টবাদে এই রকম কাউকে পাওয়া যায় না যে এই দাবিকে অযোগ্য বলে প্রমাণ করতে সাহসী হয়ে উঠবে। ফলস্বরূপ, প্রোটেস্টান্টবাদ বহু সম্প্রদায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং তারা পরস্পরকে দুর্বল করে তুলেছে। এই কারণেই মনে করা যেতে পারে যে এখন থেকে একশ বছর পরে ক্যাথলিকবাদ খ্রীষ্টধর্মের একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে উঠবে। ক্যাথলিক গীর্জাগুলোতে এই অনুপ্রেরণা দেখা যায় যে পয়গম্বররা তাঁদের নিজেদের নিজেদের স্থানকে অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছেন। কিন্তু সেখানে তারা খাঁটি স্বর্গীয় অনুপ্রেরণা বজায় রাখতে গিয়ে যে ধরনের ঘটনাগুলো ঘটায় বা যে ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করে তাতে মনে হয় যে, সেইসব অনুপ্রেরণা শয়তানের অনুপ্রেরণার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে। কোনটা খাঁটি কোনটা নকল পার্থক্য করাটাই গীর্জার ব্যবসা হয়ে ওঠে, ঠিক যেমন ভাবে একজন শিল্পকলা-বিক্রেতার মূল ব্যবসা হল লিওনার্দোর ছবিটি খাঁটি না জাল তা ধরা। এইভাবেই একই সময় মতবাদগুলি প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে ওঠে। গীর্জা যাকে ধার্মিকতা বলে অনুমোদন দেয় তা ধার্মিক এবং যাকে অধার্মিকতা বলে অনুমোদন দেয় না তা অধার্মিক। এই জন্য বলা যেতে পারে যে ধার্মিকতার কার্যকরী ধারণাটি হল জনসাধারণের বিতৃষ্ণাপ্রসূত বিচার।
এইজন্য, বলা যেতে পারে যে, মানুষের তিনটি তাড়না বা আবেগ যা আমরা ধর্মের মধ্যে মূর্ত হতে দেখি, সেগুলি হল– ভয়, আত্মশ্লাঘা বা অহমিকা এবং বিদ্বেষ। যে-কেউ এখন এ কথা বলতে পারে যে, ধমেরে উদ্দেশ্য হল এই ধরনের ভাবাবেগের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে এই সব ভাবাবেগগুলো তাদের নির্দিষ্ট পথে চলতে পারে। এর কারণ হল, সব্বেভাবে এই ভাবাবেগগুলো মানুষের দুর্দশার জন্য তৈরি হয়েছে। ধর্ম হল অশুভ শক্তির বল, কেননা তা মানুষের এই ভাবাবেগগুলোকে প্রশ্রয় দেবার অনুমোদন দিয়ে থাকে তাকে রোধ করবার পরিবর্তে। কিন্তু, এটা সত্য, যখন তারা এ ধরণের ভাবাবেগগুলোর অনুমোদন দিতে পেরেছিল, তখন অন্তত কিছুটা পরিমাণে তারা তাদের নিয়ন্ত্রিত করতেও পারত।
উক্ত বিষয়ে আপত্তির স্বরূপ রিট (writ) সম্পর্কে আমি চিন্তা করতে পারি, যে আপত্তিটির সম্পর্কে গোড়া ধর্মবিশ্বাসীরা সম্ভবত যেমন আগ্রহ বোধ করতে পারেনি, তেমন সেই আপত্তিটিকে পরীক্ষা করার জন্য যোগ্য বলেও ভাবতে পারেনি। বিদ্বেষ এবং ভয়, বলা যেতে পারে এই দুটো মানবজাতির অতিপ্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য। মানব জাতি এ দুটিকে সর্বদাই অনুভব করেছে এবং আহ্বান জানিয়েছে। আমাকে এটা বলা হতেই পারে যে, এই দুটো বিষয় সম্পর্কে আপনি যে কাজ করতে পারেন তা হল তাদের এমন পথে পরিচালনা করা যে পথে গেলে তারা যতটা ক্ষতিকারক হয়ে উঠত তার থেকে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকারক হয়ে উঠবে। একজন খ্রীষ্টীয় ধর্মবেত্তা এ কথা বলতে পারেন যে গীর্জা এই দুটি বিষয়কে এমনভাবে পরিচালিত করে থাকে যা তাদের যৌনতা বিষয়ক আবেগ পরিচালনার সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত, অর্থাৎ তাদের বিলাপের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। বিবাহের চৌহদ্দির মধ্যে উদগ্র লালসাকে আবদ্ধ করে তারা তাকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। সুতরাং একথা বলা যেতে পারে, যদি মানবজাতি অনিবার্যভাবে বিদ্বেষ অনুভব করে, তাহলে এটা ভালো হবে যদি তাদের সেই বিদ্বেষকে তারা তাদেরই বিরুদ্ধে পরিচালিত করে যারা সত্যই ক্ষতিকারক। সংক্ষেপে ধার্মিকতার ধারণার দ্বারা গীর্জা ক্ষতিকারক কার্যই করে থাকে।
এই বিষয়ে দুটি প্রত্যুত্তর দেওয়া যায় একটি তুলনামূলকভাবে ভাসা-ভাসা এবং অন্যটির ক্ষেত্রে দেখা যাবে যে সেটি বিষয়ের উৎস সম্পর্কিত। ভাসা-ভাসা প্রত্যুত্তরটি হল, ধার্মিকতার সম্পর্কে গীর্জার ধারণা কখনও পরিষ্কার হয়ে ওঠে না
এবং মৌলিক প্রত্যুত্তরটি হল বিদ্বেষ ও ভয়। আমাদের বর্তমান মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞান ও আমাদের বর্তমান শিল্প-প্রযুক্তিগত জ্ঞানের দ্বারা মনুষ্যজাতির জীবন থেকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
প্রথমেই আমাদের প্রথম বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা দরকার। ধার্মিকতার বিষয়ে গীর্জার ধারণা সামাজিকতার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্নভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত–প্রথম ও সর্ব-প্রধান কারণ হল, বিষয়টি বুদ্ধিগত ও বিজ্ঞানগত দিক দিয়ে নিন্দনীয়। এই ধরনের দোষ সুসমাচারগুলোর থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। যীশু আমাদের একটি ছোট শিশুর মতো হতে বলেছেন, কিন্তু ছোট্ট শিশু ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস বুঝতে পারে না, অথবা কারেন্সির আদর্শকে বুঝতে পারে না, কিংবা সে রোগের প্রতিকারার্থে আধুনিক পদার্থগুলিকে বুঝতে পারে না। এই ধরনের জ্ঞান অর্জন করাটা আমাদের কর্তব্যবোধের কোন অংশ নয়, যেরকম গীর্জাগুলো উপদেশ দিয়ে থাকে। গীর্জাগুলো বেশিদিন এই ধরনের মত পোষণ করেনি যে জ্ঞান নিজেই একটি পাপগত বিষয়, কিন্তু পুরোনো যুগে তারা এমনই ধারণা পোষণ করত। জ্ঞান অর্জন ব্যাপারটা পাপগত না হলেও ভয়ঙ্কর অবশ্যই, কেননা এটি বুদ্ধিমানের অহংকারে পরিণত হয়। ফলে, খ্রীষ্টীয় গোঁড়া ধর্মাদর্শ সম্পর্কে সে প্রশ্ন তুলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, দুটি মানুষকে নেওয়া যাক, তাদের মধ্যে একজন কোন গ্রীষ্মপ্রধান বিরাট অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে ন্যাবারোগে আক্রান্ত রোগীকে খুঁজে বার করল, কিন্তু যখন সে এই কাজটি করছিল তখন তার সঙ্গে ঘটনাক্রমে এক মহিলার সম্পর্ক ঘটেছিল যাকে সে বিয়ে করেনি। অন্য মানুষটি ছিল কুঁড়ে এবং জড় প্রকৃতির। যতদিন পর্যন্ত তার স্ত্রী দেহের দিক থেকে সম্পূর্ণভাবে ফুরিয়ে গিয়ে মরে না গেল ততদিন পর্যন্ত বছরের পর বছর তার জন্য সন্তান প্রসব করল। সেই মানুষটি সেই সব শিশুদের এত কম নজর রাখলো যার জন্য তাদের অর্ধেক কেবলমাত্র দেখাশোনার অভাবে মরে গেল। কিন্তু সেই মানুষটি কখনও নিজেকে অবৈধ যৌনসঙ্গমে প্রশ্রয় দেয়নি। প্রতিটি সৎ খ্রীষ্টীয় ধর্মাবলম্বী অবশ্যই এই মত পোষণ করবে যে দ্বিতীয় ধরণের মানুষটি প্রথম ধরণের মানুষটির থেকে অনেক বেশি ধার্মিক। এই ধরনের আচরণ অবশ্যই কুসংস্কার এবং যুক্তির পরিপন্থী। এই ধরণের অসঙ্গতি থেকে অনিবার্যভাবে যে সিদ্ধান্তটি বেরিয়ে আসে তা হল কোন ধনাত্মক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বিষয়কে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে কেবলমাত্র পাপকে অগ্রাহ্য করা এবং যতদিন পর্যন্ত ব্যবহারযোগ্য জীবনের জন্য জ্ঞানকে গুরুত্ব দেওয়া না হবে ততদিন পর্যন্ত সেই জ্ঞানকে স্বীকৃতি না দেওয়া।
দ্বিতীয় মৌলিক আপত্তিটি হল বিদ্বেষ ও ভয় যাকে এতদিন পর্যন্ত গীর্জাগুলো ব্যবহার করে এবং বর্তমানে এমন একটি পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে এইসব আবেগগুলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত সংস্কারের ফলে মানুষের প্রকৃতি থেকে একেবারেই ঘেঁটে দেওয়া যেতে পারে। শিক্ষাগত সংস্কারকে ভিত্তিরূপে নেওয়া আবশ্যক। কেননা যে মানুষ ঘৃণা ও ভয় অনুভব করে তারাই আবার তাদের প্রশংসাও করে এবং তাদেরকে চিরন্তন করে তোলবার চেষ্টা করে থাকে। যদিও এই প্রশংসা ও ইচ্ছা সম্ভবত অবচেতন মনের ব্যাপার, যা সাধারণ খ্রীষ্টীয় ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে থাকে। যে ধরণের শিক্ষা ভয় দূর করতে পারে, সেই ধরণের শিক্ষাব্যবস্থা সৃষ্টি করা খুব একটা শক্ত নয়। এর জন্য প্রয়োজন শিশুকে ভালোবেসে শিক্ষা দেওয়া। তাকে এমন একটি পরিবেশের মধ্যে রাখা যেখানে সে কোন দুর্ভাগ্যজনক ফলাফল ছাড়াই পড়াশুনা চালাতে পারবে। তাকে বাঁচাতে হবে সেই পরিণত বয়স্কদের হাত থেকে যারা অযৌক্তিক ভয়ঙ্কর ভীতির দ্বারা ভোগে। সেই ভীতি ইঁদুরে ভীতি, অন্ধকার-ভীতি কিংবা সামাজিক বিপ্লব-ভীতিও হতে পারে। একটি শিশু অবশ্যই কঠিন শাস্তি, চোখ রাঙানি, গাম্ভীর্য প্রদর্শন এবং অসম্ভব নিন্দার বিষয় হতে পারে না। শিশুকে বিদ্বেষ থেকে রক্ষা করাটা সত্যই একটা বিরাট কাজ। যে অবস্থাগুলো হিংসা, স্পর্শকাতরতার জন্ম দেয় সেগুলোকে অবশ্যই যত্নসহকারে এড়িয়ে যাওয়া দরকার। বিভিন্ন ধরণের শিশুর মানসিকতা বুঝে অতি সূক্ষ্মতা ও সঠিক বিচারের সঙ্গে তা এড়িয়ে যেতে হবে। একটি শিশু নিজেকে উষ্ণ স্নেহের পাত্র বলে অনুভব করবে সেই বয়স্ক মানুষটির কাছে যে মানুষটির সঙ্গে সে থাকবে এবং যার কাছে পড়াশুনো করবে। শিশুটিকে অবশ্যই তার প্রাকৃতিক কাজ ও কৌতূহল থেকে জোর করে সরিয়ে রাখা হবে না, যদি না তা তার স্বাস্থ্য ও জীবনের পক্ষে মারাত্মক হয়। সঠিক ভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, যৌন জ্ঞানের ব্যাপারে কোন রকম কুসংস্কার থাকবে না, এবং সেই সব সংরক্ষণশীলতা থাকলে হবে না যেগুলিকে প্রথাগতভাবে সাধারণ মানুষ বেঠিক বলে মনে করে। যদি প্রথম থেকেই এই ধারণা দিয়ে শুরু করা যায় তবে শিশু ভয়হীন ও বন্ধুত্বপূর্ণ হবে। পূর্ণবয়স্ক জীবনে প্রবেশ করেই, উক্ত ধরণের শিক্ষিত যুবক ও যুবতী নিজেকে হঠাই এমন একটি জগতের মধ্যে দেখতে পাবে যে জগৎটি পূর্ণ অবিচার, নিষ্ঠুরতা ও প্রতিবন্ধকতামূলক দুর্দশায় পর্যবসিত। এই নিষ্ঠুরতা, অবিচার,দুর্দশা যা আধুনিক জগতে বিদ্যমান তা অতীত থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এবং তাদের মূল উৎস হল অর্থনীতি। যেহেতু পূর্বের যুগগুলো থেকেই অস্তিত্ব বজায় রাখতে জীবন-মৃত্যুর প্রতিযোগিতা অনিবার্য। কিন্তু আমাদের যুগে তা অনিবার্য নয়। আমাদের বর্তমান শিল্পগত কৌশলের দ্বারা, যদি আমরা ইচ্ছা করি, তবে আমরা প্রত্যেকের জন্য সহনীয় অস্তিত্বমূলক জীবনের বন্দোবস্ত করতে পারি । আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে পৃথিবীর জনসংখ্যার বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাবে যদি আমরা সেই গীর্জার রাজনীতির দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত না হই যে গীর্জা যুদ্ধ, মহামারী বেশি পছন্দ করে এবং গর্ভনিরোধের বিপক্ষে জেহাদ ঘোষণা করে। জ্ঞান হল সেই বস্তু যার দ্বারা চিরন্তন সুখকে নিশ্চিত করা যেতে পারে, কিন্তু সেই উদ্দেশ্যে তাকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সব থেকে বড় প্রতিবন্ধক হল ধর্মীয় শিক্ষা। ধর্ম আমাদের শিশুদের যৌক্তিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে। ধর্ম আমাদের বাধা দেয় যুদ্ধের মৌলিক কারণগুলোকে দূর করবার ক্ষেত্রে। ধর্ম আমাদের বাধা দেয় পাপ ও শাস্তি সম্পর্কে পুরোনো হিংসাত্মক মতবাদগুলোকে দূর করে তার পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক সহযোগিতাকে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে। এটা সম্ভবত সত্য যে মনুষ্য-জাতি স্বর্ণযুগের দোরগোড়ায়, কিন্তু যদি এটা সত্যই হয়, তবে প্রথম প্রয়োজন সেই ড্রাগনটিকে কেটে হত্যা করা যে দোরগোড়ায় পাহারা দিয়ে বসে আছে এবং এই ড্রাগনটি হল ধর্ম।