০২. সভাপর্ব

সভাপর্ব

৷৷ সভাক্রিয়াপাধ্যায়৷৷

১। ময় দানবের সভানির্মাণ

কৃষ্ণ ও অর্জুন নদীতীরে উপবিষ্ট হলে ময় দানব কৃতাঞ্জলিপুটে সবিনয়ে অর্জুনকে। বললেন, কৌন্তেয়, আপনি কৃষ্ণের ক্রোধ আর অগ্নির দহন থেকে আমাকে রক্ষা করেছেন। আপনার প্রত্যুপকার কি করব বলুন। অর্জুন উত্তর দিলেন, তোমার কর্তব্য সবই তুমি করেছ, তোমার মঙ্গল হ’ক, তোমার আর আমার মধ্যে যেন সর্বদা প্রীতি থাকে; এখন তুমি যেতে পার। ময় বললেন, আমি দানবগণের বিশ্বকর্মা ও মহাশিল্পী, আপনাকে তুষ্ট করবার জন্য আমি কিছু করতে ইচ্ছা করি। অর্জুন বললেন, প্রাণরক্ষার জন্য তুমি কৃতজ্ঞ হয়েছ, এ অবস্থায় তোমাকে দিয়ে আমি কিছু করাতে চাই না। তোমার অভিলাষ ব্যর্থ করতেও চাই না, তুমি কৃষ্ণের জন্য কিছু কর, তাতেই আমার প্রত্যুপকার হবে।

ময় দানবের অনুরোধ শুনে কৃষ্ণ একটু ভেবে বললেন, শিল্পিশ্রেষ্ঠ, যদি তুমি আমাদের প্রিয়কার্য করতে চাও তবে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের জন্য এমন এক সভা নির্মাণ কর যার অনুকরণ মানুষের অসাধ্য। তার পর কৃষ্ণ ও অর্জুন ময়কে যুধিষ্ঠিরের কাছে নিয়ে গেলেন। কিছুকাল গত হলে সবিশেষ চিন্তার পর ময় সভানির্মাণে উদযোগী হলেন এবং পুণ্যদিনে মাঙ্গলিক কার্য সম্পন্ন করে ব্রাহ্মণগণকে সঘাত পায়স ও বহুবিধ ধনরত্ন দিয়ে তুষ্ট করলেন। তার পর তিনি চতুর্দিকে দশ হাজার হাত পরিমাপ করে সর্ব ঋতুর উপযুক্ত সভাস্থান নির্বাচন করলেন।

জনার্দন কৃষ্ণ এতদিন ইন্দ্রপ্রস্থে সুখে বাস করছিলেন, এখন তিনি পিতার কাছে যেতে ইচ্ছুক হলেন। তিনি পিতৃষ্বসা কুন্তীর চরণে প্রণাম করে ভগিনী সুভদ্রার কাছে সস্নেহে বিদায় নিলেন এবং দ্রৌপদীর সঙ্গে দেখা করে তার হাতে সুভদ্রাকে সমর্পণ করলেন। তার পর তিনি স্বস্তিবাচন করিয়ে ব্রাহ্মণদের দক্ষিণা দিলেন এবং শুভমুহূর্তে স্বর্ণভূষিত দ্রুতগামী রথে আরোহণ করলেন। কৃষ্ণের সারথি দারুককে সরিয়ে দিয়ে যুধিষ্ঠির নিজেই বৰ্গা হাতে নিলেন, অর্জুনও শ্বেত চামর নিয়ে রথে উঠলেন। ভীম, নকুল, সহদেব ও পুরবাসিগণ রথের পিছনে চললেন। এইরূপে অর্ধ যোজন গিয়ে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের পাদবন্দনা করে তাকে ফিরে যেতে বললেন। তিনি ভীমসেনকে অভিবাদন এবং অর্জুনকে গাঢ় আলিঙ্গন করলেন, নকুল-সহদেব কৃষ্ণকে প্রণাম করলেন, তার পর কৃষ্ণ পাণ্ডবগণের সকলকেই আলিঙ্গন করলেন অনন্তর যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে কৃষ্ণ দ্বারকার অভিমুখে যাত্রা করলেন। তাঁর রথ অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত পাণ্ডবগণ তাঁর দিকে চেয়ে রইলেন।

পাণ্ডবগণ ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে এলে ময় দানব অর্জুনকে বললেন, আমাকে অনুমতি দিন আমি একবার কৈলাসের উত্তরবর্তী মৈনাক পর্বতে যাব। পুরাকালে দানবগণ সেখানে যজ্ঞ করতে ইচ্ছা করেছিলেন, তার জন্য আমি বিন্দুসরোবরের নিকট কতকগুলি বিচিত্র ও মনোহর মণিময় দ্রব্য সংগ্রহ করেছিলাম যা দানবরাজ বৃষপর্বার সভায় দেওয়া হয়। যদি পাওয়া যায় তবে সেগুলি আমি আপনাদের সভার জন্য নিয়ে আসব। বিন্দুসরোবরের তীরে রাজা বৃষপর্বার গদা আছে, তা স্বর্ণবিন্দুতে অলংকৃত, ভারসহ, দৃঢ়, এবং লক্ষ গদার তুল্য শত্রুঘাতিনী। সেই গদা ভীমের, যোগ্য। সেখানে দেবদত্ত নামক বরুণের শঙ্খও আছে। এই সবই আমি আপনাদের জন্য আনব।

ঈশান কোণে যাত্রা করে ময় মৈনাক পর্বতে উপস্থিত হলেন। তিনি গদা, শঙ্খ, বৃষপর্বার স্ফটিকময় সভাদ্রব্য, এবং কিংকর নামক রাক্ষসগণ কর্তৃক রক্ষিত ধনরাশি সংগ্রহ করে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে এলেন এবং ভীমকে গদা আর অর্জুনকে দেবদত্ত শঙ্খ দিলেন। তার পর ময় ত্রিলোকবিখ্যাত দিব্য মণিময় সভা নির্মাণ করলেন ন্যায় দীপ্তিতে যেন সূর্যের প্রভাও পরাস্ত হল। এই বিশাল সভা নবোদিত মেঘের ন্যায় আকাশ ব্যাপ্ত করে রইল। তার প্রাচীর ও তোরণ রত্নময়, অভ্যন্তর বহুবিধ উত্তম দ্রব্যে ও চিত্রে সজ্জিত। কিংকর নামক আট হাজার আকাশচারী মহাকায় মহাবল রাক্ষস সেই সভা রক্ষা করত। ময় দানব সেখানে একটি অতুলনীয় সরোবর রচনা করলেন, তার সোপান স্ফটিকনির্মিত, জল অতি নির্মল, বিবিধ মণিরত্নে সমাকীর্ণ এবং স্বর্ণময় পদ্ম মৎস্য ও কূমে শোভিত। যে রাজারা দেখতে এলেন তাদের কেউ কেউ সরোবর বলে বুঝতে না পেরে জলে পড়ে গেলেন। সভাস্থানের সকল দিকেই পুষ্পিত বৃক্ষশোভিত উদ্যান ও হংসকারণ্ডবাদি-সমন্বিত পুষ্করিণী ছিল। চোদ্দ মাসে সকল কার্য সম্পন্ন করে ময় যুধিষ্ঠিরকে সংবাদ দিলেন যে সভা প্রস্তুত হয়েছে।

যুধিষ্ঠির ঘৃত ও মধু মিশ্রিত পায়স, ফলমূল, বরাহ ও হরিণের মাংস, তিলমিশ্রিত অন্ন প্রভৃতি বিবিধ ভোজ্য দিয়ে দশ হাজার ব্রাহ্মণ ভোজন করালেন এবং তাঁদের উত্তম বসন, মাল্য ও বহু সহস্র গাভী দান করলেন। তারপরগীত বাদ্য সহকারে দেবপূজা ও বিগ্রহস্থাপন করে সভায় প্রবেশ করলেন। সাত দিন ধরে মল ঝল্ল (১) সূত বৈতালিক প্রভৃতি যুধিষ্ঠিরাদির মনোরঞ্জন করলে। নানা দেশ থেকে আগত ঋষি ও নৃপতিদের সঙ্গে পাণ্ডবগণ সেই সভায় আনন্দে বাস করতে লাগলেন।

**

(১) লগুড় যোদ্ধা, লাঠিয়াল।

২। যুধিষ্ঠির-সকাশে নারদ

একদিন দেবর্ষি নারদ পারিজাত, রৈবত, সুমুখ ও সৌম্য এই চারজন ঋষির সঙ্গে পাণ্ডবদের সভায় উপস্থিত হলেন। যুধিষ্ঠির যথাবিধি আসন অর্ঘ্য গো মধুপর্ক ও রত্নাদি দিয়ে সংবর্ধনা করলে নারদ প্রশ্নচ্ছলে ধর্ম কাম ও অর্থ বিষয়ক এইপ্রকার বহু উপদেশ দিলেন।-মহারাজ, তুমি অর্থচিন্তার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মচিন্তাও কর তো ? কাল বিভাগ করে সমভাবে ধর্ম অর্থ ও কামের সেবা কর তো ? তোমার দুর্গসকল যেন ধনধান্য জল অস্ত্র যন্ত্র যোদ্ধা ও শিল্পিগণে পরিপূর্ণ থাকে। কঠোর দণ্ড দিয়ে। তুমি যেন প্রজাদের অবজ্ঞাভাজন হয়ো না। বীর, বুদ্ধিমান, পবিত্রস্বভাব, সংশজ ও অনুরক্ত ব্যক্তিকে সেনাপতি করবে। সৈন্যগণকে যথাকালে খাদ্য ও বেতন দেবে। শরণাগত শত্রুকে পুত্রবৎ রক্ষা করবে। পররাজ্য জয় করে যে ধনরত্ন পাওয়া যাবে তার ভাগ প্রধান প্রধান যোদ্ধাদের যোগ্যতা অনুসারে দেবে। তোমার যা আয় তার অর্ধে বা এক-তৃতীয়াংশে বা এক-চতুর্থাংশে নিজের ব্যয় নির্বাহ করবে। গণক (১) ও লেখক (২) গণ প্রত্যহ পূর্বাহে। তোমাকে আয়ব্যয়ের হিসাব দেবে। লোভী, চোর, বিদ্বেষী আর অল্পবয়স্ক লোককে কার্যের ভার দেবে না। তোমার রাজ্যে যেন। বড় বড় জলপূর্ণ তড়াগ থাকে, কৃষি যেন কেবল বৃষ্টির উপর নির্ভর না করে। কৃষকদের যেন বীজ আর খাদ্যের অভাব না হয়, তারা যেন অল্প সুদে ঋণ পায়। তুমি নারীদের সঙ্গে মিষ্টবাক্যে আলাপ করবে কিন্তু গোপনীয় বিষয় বলবে না। ধনী আর দরিদ্রের মধ্যে বিবাদ হলে তোমার অমাত্যরা যেন ঘুষ নিয়ে মিথ্যা বিচার না করে। অন্ধ মূক পঙ্গু অনাথ ও ভিক্ষুদের পিতার ন্যায় পালন করবে। নিদ্রা আলস্য ভয় ক্রোধ মৃদুতা ও দীর্ঘসূত্রতা এই ছয় দোষ পরিহার করবে।

নারদের চরণে প্রণত হয়ে যুধিষ্ঠির বললেন, আপনার উপদেশে আমার জ্ঞানবৃদ্ধি হল , যা বললেন তাই আমি করব। আপনি যে রাজধর্ম বিবৃত করলেন তা আমি যথাশক্তি পালন করে থাকি। আমি সৎপথেই চলতে ইচ্ছা করি, কিন্তু পূর্ববর্তী জিতেন্দ্রিয় নৃপতিগণ যে ভাবে কর্তব্যপালন করতেন তা আমি পারি না। তার পর যুধিষ্ঠির বললেন, ভগবান, আপনি বহু লোকে বিচরণ করে থাকনে, এই সভার তুল্য বা এর চেয়ে ভাল কোনও সভা দেখেছেন কি? নারদ সহাস্যে বললেন, তোমার এই সভার তুল্য অন্য সভা আমি মনুষ্যলোকে দেখি নি, শুনিও নি। তবে আমি ইন্দ্র যম বরুণ কুবের ও ব্রহ্মার সভার কথা বলছি শোন।-

ইন্দ্রের সভা শত যোজন দীর্ঘ, দেড় শ যোজন আয়ত, পাঁচ যোজন উচ্চ, তা ইচ্ছানুসারে আকাশে চালিত করা যায়। সেখানে জরা শোক ক্লান্তি নেই ইন্দ্রাণী শচী সেখানে শ্রী লক্ষ্মী শ্রী কীর্তি ও দ্যুতি দেবীর সঙ্গে বিরাজ করেন। দেবগণ, সিদ্ধ ও সাধ্যগণ, বহু মহর্যি, রাজা হরিশ্চন্দ্র, গন্ধর্ব ও অপ্সরা সকল সেখানে থাকেন। যমের সভা তৈজস উপাদানে নির্মিত, সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল, তার বিস্তার শত যোজন, দৈর্ঘ্য আরও বেশী। স্বগীয় ও পার্থিব সর্ববিধ ভোগ্য বস্তু সেখানে আছে। যযাতি, নহুষ, পুরু, মান্ধাতা, ধ্রুব, কাতবর্যিাজুন ভরত, নিষধপতি নল, ভগীরথ, রাম-লক্ষ্মন, তোমার পিতা পাণ্ডু প্রভৃতি সেখানে থাকেন। বরুণের সভা জলমধ্যে নির্মিত, দৈর্ঘ্যপ্রস্থে যমসভার সমান, তার প্রকার ও তোরণ শুভ্র। সেই সভা অধিক শীতলও নয় উষ্ণও নয়, সেখানে বাসুকি তক্ষক প্রভৃতি নাগগণ এবং বিরোচনপুত্র বলি প্রভৃতি দৈত্যদানবগণ থাকেন। চার সমুদ্র, গঙ্গা যমুনা প্রভৃতি নদী, তীর্থ-সরোবর, পর্বতসমূহ এবং জলচরগণ মূর্তিমান হয়ে সেখানে বরুণের উপাসন্য করে। কুবেরের সভা এক শ যোজন দীর্ঘ, সত্তর যোজন বিস্তৃত, কৈলাসশিখরের ন্যায় উচ্চ ও শুভ্রবর্ণ। যক্ষগণ সেই সভা আকাশে বহন করে। কুবের সেখানে বিচিত্র বসন ও আভরণে ভূষিত হয়ে সহস্র রমণীতে বেষ্টিত হয়ে বাস করেন, দেব ও গন্ধর্বগণ অপ্সরাদের সঙ্গে দিবাতালে গান করেন। মিশ্রকেশী মেনকা উর্বশী প্রভৃতি অপ্সরা, যক্ষ ও রাক্ষসগণ, বিশ্বাবসু হাহা হুহু প্রভৃতি গন্ধর্ব, এবং ধার্মিক বিভীষণ সেখানে থাকেন। পুলস্ত্যের পুত্র কুবের উমাপতি শিবকে নতশিরে প্রণাম করে সেই সভায় উপবেশন করেন।

মহারাজ, আমি সূর্যের আদেশে সহস্রবৎসরব্যাপী ব্রহ্মব্রত অনুষ্ঠান করি, তার পর তার সঙ্গে ব্রহ্মার সভায় যাই। সেই সভা অবর্ণনীয়, তার রূপ ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হয়। সেখানে ক্ষুৎপিপাসা বা গ্লানি নেই, তার প্রভা ভাস্করকে অতিক্রম করে। দক্ষ প্রচেতা কশ্যপ বশিষ্ঠ দুর্বাসা সনৎকুমার অসিতদেব প্রভৃতি মহাত্মা, আদিত্য বসু রুদ্র প্রভৃতি গণদেবতা, এবং শরীরী ও অশরীরী পিতৃগণ সেখানে ব্রহ্মার উপাসনা করেন। ভরতনন্দন যুধিষ্ঠির, দেবতাদের এইসকল সভা আমি দেখেছি, মনুষ্যলোকে সর্বশ্রেষ্ঠ তোমার সভাও এখন দেখলাম।

যুধিষ্ঠির বললেন, মহামুনি, ইন্দ্রসভার বর্ণনায় আপনি একমাত্র রাজর্ষি হরিশ্চন্দ্রের নামই বললেন। তিনি কোন্ কর্মের ফলে সেখানে গেলেন? আপনি যমের সভায় আমার পিতা পাণ্ডুকে দেখেছেন। তিনি কি বললেন তাও জানতে আমার পরম কৌতুহল হচ্ছে।

নারদ বললেন, রাজা হরিশ্চন্দ্র সকল নরপতির অধীশ্বর সম্রাট ছিলেন, তিনি রাজসূয় যজ্ঞে ব্রাহ্মণগণকে বিস্তর ধন দান করেছিলেন। যে রাজারা রাজসূয় যজ্ঞ করেন, যাঁরা পলায়ন না করে সংগ্রামে নিহত হন, এবং যাঁরা তীব্র তপস্যায় কলেবর ত্যাগ করেন, তারা ইন্দ্রসভায় নিত্য বিরাজ করেন। হরিশ্চন্দ্রের শ্রীবৃদ্ধি দেখে তোমার পিতা পাণ্ডু বিস্মিত হয়েছেন এবং আমাকে অনুরোধ করেছেন যেন মর্ত্যলোকে এসে তার এই কথা আমি তোমাকে বলি—পুত্র, তুমি পৃথিবী জয় করতে সমর্থ, ভ্রাতারা তোমার বশবর্তী, এখন তুমি শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ রাজসূয়ের অনুষ্ঠান কর, তা হলে আমি হরিশ্চন্দ্রের ন্যায় ইন্দ্রসভায় বহুকাল সুখভোগ করতে পারব। অতএব যুধিষ্ঠির, তুমি তোমার পিতার এই সংকল্প সিদ্ধ কর। এই উপদেশ দিয়ে নারদ তার সঙ্গী ঋষিদের নিয়ে দ্বারকার অভিমুখে যাত্রা করলেন।

** (১) হিসাবরক্ষক।

(২) কেরানী।

৷৷ মন্ত্রপর্বাধ্যায়৷৷

৩। কৃষ্ণ-যুধিষ্ঠিরাদির মন্ত্রণা

নারদের কথা শুনে যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞের বিষয় বার বার ভাবতে লাগলেন। তিনি ধর্মানুসারে অপক্ষপাতে সকলের হিতসাধনে প্রবৃত্ত হলেন এবং ক্রোধ ও গর্ব ত্যাগ করে কেবল এই কথাই বলতে লাগলেন—যার যা দেয় আছে তা দাও; ধর্মই সাধু, ধর্মই সাধু। প্রজারা যুধিষ্ঠিরকে পিতার তুল্য জ্ঞান করত, তার শত্রু ছিল না এজন্য তিনি অজাতশত্রু নামে খ্যাত হলেন। তিনি ভ্রাতাদের উপর বিভিন্ন কর্মের ভার দিয়ে তাদের সাহায্যে রাজ্য শাসন ও পালন করতে লাগলেন। তার রাজত্বকালে বাধুষী (তেজারতি), যজ্ঞকার্য, গোরক্ষা, কৃষি ও বাণিজ্যের সবিশেষ উন্নতি হল। রাজকরের অনাদায়, করের জন্য প্রজাপীড়ন, ব্যাধি ও অগ্নিভয় ছিল না, রাজকর্মচারীদের মিথ্যাচার শোনা যেত না।

যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ সম্বন্ধে তার মন্ত্রী ও ভ্রাতাদের মত জিজ্ঞাসা করলে তারা বললেন, আপনি সম্রাট হবার যোগ্য, আপনার সুহৃদগণ মনে করেন যে এখনই রাজসূয় যজ্ঞ করবার প্রকৃষ্ট সময়। পুরোহিত ও মুনিগণও এই প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন। সর্বলোকশ্রেষ্ঠ জনার্দন কৃষ্ণের মত জানা কর্তব্য এই ভেবে যুধিষ্ঠির একজন দূতকে দ্রুতগামী রথে দ্বারকায় পাঠালেন, কৃষ্ণও যুধিষ্ঠিরের ইচ্ছা জেনে সত্বর ইন্দ্রপ্রস্থে এলেন।

কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, রাজসূয় যজ্ঞ করবার সকল গুণই আপনার আছে, তথাপি কিছু বলছি শুনুন। পৃথিবীতে এখন যেসকল রাজা বা ক্ষত্রিয় আছেন তারা সকলেই পুরূরবা বা ইক্ষাকুরু বংশধর। যযাতি থেকে উৎপন্ন ভোজবংশীয়গণ চতুর্দিকে রাজত্ব করছেন, কিন্তু তাদের সকলকে অভিভূত করে জরাসন্ধ এখন শীর্ষস্থান অধিকার করেছেন। সমস্ত পৃথিবী যাঁর বশে থাকে তিনিই সম্রাটের পদ লাভ করেন।

প্রতাপশালী শিশুপাল সেই জরাসন্ধের সেনাপতি। করূষ দেশের রাজা মহাবল বক্র, করভ মেঘবাহন প্রভৃতি রাজা, এবং আপনার পিতার সখা মুর ও নরক দেশের অধিপতি বুদ্ধ যবনরাজ ভগদত্ত, এঁরা সকলেই জরাসন্ধের অনুগত। কেবল আপনার মাতুল পুরুজিৎ—যিনি পশ্চিম ও দক্ষিণ দেশের রাজা—স্নেহবশে আপনার পক্ষে আছেন। যে দুর্মতি নিজেকে পুরুষোত্তম ও বাসুদেব বলে প্রচার করে এবং আমার চিহ্ম ধারণ করে, সেই বঙ্গ-পু-কিরাতের রাজা পৌণ্ড্রকও জরাসন্ধের পক্ষে গেছে। ভোজবংশীয় মহাবল ভীষ্মকের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ (১) আছে, আমরা সর্বদা তার প্রিয় আচরণ করি, তথাপি তিনি জরাসন্ধের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। বহু দেশের রাজারা জরাসন্ধের ভয়ে নিজ রাজ্য ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। দুর্মতি কংস জরাসন্ধের দুই কন্যা অস্তি ও প্রাপ্তিকে বিবাহ করে শ্বশুরের সহায়তায় নিজ জ্ঞাতিদের উপর পীড়ন করেছিল, সেজন্য বলরাম ও আমি কংসকে বধ করি। তারপর আমরা আত্মীয়দের সঙ্গে মন্ত্রণা করে এই সিদ্ধান্তে এলাম যে তিন শ বৎসর নিরন্তর যুদ্ধ করেও আমরা জরাসন্ধের সেনা সংহার করতে পারব না।

হংস ও ডিম্ভক নামে দুই মহাবল রাজা জরাসন্ধের সহায় ছিলেন। বহু বার যুদ্ধ করবার পর বলরাম হংসকে বধ করেন, সেই সংবাদ শুনে মনের দুঃখে ডিম্ভকও জলমগ্ন হয়ে প্রাণত্যাগ করেন। জরাসন্ধ তখন তার সৈন্যদল নিয়ে নিজ রাজ্যে ফিরে যান, আমরাও আনন্দিত হয়ে মথুরায় বাস করতে লাগলাম। তারপর কংসের পত্নী অস্তি তার পিতা জরাসন্ধের কাছে গিয়ে বার বার বললেন, আমার পতিহন্তাকে বধ করুন। তখন আমরা ভয় পেয়ে জ্ঞাতি ও বন্ধুদের সঙ্গে পশ্চিম দিকে পালিয়ে গেলাম এবং রৈবতক পর্বতের কুশস্থলীতে দুৰ্গসংস্কার করে সেখানেই আশ্রয় নিলাম। সেই দুর্গম স্থানে দেবতারাও আসতে পারেন না এবং স্ত্রীলোকেও তা রক্ষা করতে পারে। রৈবতক পর্বত তিন যোজন দীর্ঘ, এক যোজন বিস্তৃত। আমাদের গিরিদুর্গে শত শত দ্বার আছে, আঠার জন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা তার প্রত্যেকটি রক্ষা করে। আমাদের কুলে আঠার হাজার ভ্রাতা আছেন। চারুদেষ্ণ, চক্রদেব, তার ভ্রাতা, সাত্যকি, আমি, বলরাম এবং শাম্ব—আমরা এই সপ্ত রথী যুদ্ধে বিষ্ণুর তুল্য। এ ছাড়া কৃতবর্মা, অনাবৃষ্টি, কঙ্ক, বৃদ্ধ অন্ধকভোজ রাজা এবং তার দুই পুত্র প্রভৃতি যোদ্ধারা আছেন। এঁরা সকলেই এখন বৃষ্ণি (১) গণের সঙ্গে বাস করছেন এবং পূর্ব বাসভূমি মথুরার কথা ভাবছেন। হে মহারাজ, জরাসন্ধ জীবিত থাকতে আপনি রাজসূয় যজ্ঞ করতে পারবেন না। তিনি মহাদেবের বরপ্রভাবে ছেয়াশি জন রাজাকে জয় করে তার রাজধানী গিরিব্রজে বন্দী করে রেখেছেন, আরও চোদ্দ জনকে পেলেই তিনি সকলকে বলি দেবেন। যদি আপনি যজ্ঞ করতে চান তবে সেই রাজাদের মুক্তি দেবার এবং জরাসন্ধকে বধ করবার চেষ্টা করুন।

ভীম বললেন, কৃষ্ণ অর্জুন আর আমি তিন জনে মিলে জরাসন্ধকে জয় করতে পারি। যুধিষ্ঠির বললেন, ভীমার্জুন আমার দুই চক্ষু; জনার্দন, তুমি আমার মন। তোমাদের বিসর্জন দিয়ে আমি কি করে জীবন ধারণ করব? স্বয়ং যমরাজও জরাসন্ধকে জয় করতে পারেন না। অতএব রাজসূয় যজ্ঞের সংকল্প ত্যাগ করাই উচিত মনে করি।

অর্জুন বললেন, মহারাজ, আমি দুর্লভ ধনু, শর, উৎসাহ, সহায় ও শক্তির অধিকারী, বলপ্রয়োগ করাই আমি উচিত মনে করি। যদি আপনি যজ্ঞের সংকল্প ত্যাগ করেন তবে আপনার গুণহীনতাই প্রকাশ পাবে। যদি শান্তিকামী মুনি হ’তে চান তবে এর পর কাষায় বস্ত্র ধারণ করবেন, কিন্তু এখন সাম্রাজ্যলাভ করুন, আমরা শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করব।

**

(১) ভীষ্মক রুক্মিণীর পিতা, কৃষ্ণের শ্বশুর।

৪। জরাসন্ধের পূর্ববৃত্তান্ত

কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন ভরতবংশের যোগ্য কথা বলেছেন। যুদ্ধ না করে কেউ অমর হয়েছে এমন আমরা শুনি নি। বুদ্ধিমানের নীতি এই, যে অতিপ্রবল শত্রুর সঙ্গে সংগ্রাম করবে না; জরাসন্ধ সম্বন্ধে আমার তাই মত। আমরা ছদ্মবেশে শত্রুগৃহে প্রবেশ করব এবং তাকে একাকী পেলেই অভীষ্ট সিদ্ধ করব। আমাদের আত্মীয় নৃপতিদের মুক্তির জন্য আমরা জরাসন্ধকে বধ করতে চাই, তার ফলে যদি মরি তবে আমাদের স্বর্গলাভ হবে।

যুধিষ্ঠির বললেন, কৃষ্ণ, এই জরাসন্ধ কে? তার কিরূপ পরাক্রম যে অগ্নিতুল্য তোমাকে স্পর্শ করে পতঙ্গের ন্যায় পুড়ে মরে নি? কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, জরাসন্ধ কে এবং আমরা কেন তার বহু উৎপীড়ন সহ্য করেছি তা বলছি শুনুন। বৃহদ্রথ নামে মগধদেশে এক রাজা ছিলেন, তিনি তিন অক্ষৌহিণী সেনার অধিপতি। কাশীরাজের দুই যমজ কন্যাকে তিনি বিবাহ করেন। বৃহদ্রথ তার দুই ভার্যাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, দুজনকেই সমদৃষ্টিতে দেখবেন। রাজার যৌবন গত হল তথাপি তিনি পুত্রলাভ করলেন না। উদারচেতা চণ্ডকৌশিক মুনি রাজাকে একটি মন্ত্রসিদ্ধ আম্রফল দেন, সেই ফল দুই খণ্ড করে দুই রাজপত্নী খেলেন এবং গর্ভবতী হয়ে দশম মাসে দুজনে দুই শরীরখণ্ড প্রসব করলেন। তার প্রত্যেকটির এক চক্ষু, এক বাহু, এক পদ এবং অর্ধ মুখ উদর নিতম্ব। রাজ্ঞীরা ভয়ে ও দুঃখে তাদের সন্তান পরিত্যাগ করলেন, দুজন ধাত্রী সেই দুই সজীব প্রাণিখণ্ড আবৃত করে বাইরে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিলে, সেই সময়ে জরা নামে এক রাক্ষসী সেখানে এল এবং খণ্ড দুটিকে দেখে সুদৃশ্য করবার ইচ্চায় সংযুক্ত করলে। তৎক্ষণাৎ একটি পূর্ণাঙ্গ বীর কুমার উৎপন্ন হল। রাক্ষসী বিস্ময়ে চক্ষু বিস্ফারিত করে দেখতে লাগল, বজ্রতুল্য গুরুভার শিশুকে সে তুলতে পারলে না। বালক তার তাম্রবর্ণ হাতের মুঠি মুখে পুরে সজল মেঘের ন্যায় গর্জন করে কাঁদতে লাগল। সেই শব্দ শুনে রাজা, তার দুই পত্নী, এবং অন্তঃপুরের অন্যান্য লোক সেখানে এলেন। জরা রাক্ষসী নারীমূর্তি ধারণ করে শিশুটিকে কোলে নিয়ে বললে, বৃহদ্রথ, তোমার পুত্রকে নাও, ধাত্রীরা একে ত্যাগ করেছিল, আমি রক্ষা করেছি। তখন দুই কাশীরাজকন্যা বালককে কোলে নিয়ে স্তনদুগ্ধধারায় স্নান করালেন।

রাজা বৃহদ্রথ জিজ্ঞাসা করলেন, আমার পুত্রপ্রদায়িনী কল্যাণী পদ্মকোষবর্ণা, তুমি কে? রাক্ষসী উত্তর দিলে, আমি কামরূপিণী জরা রাক্ষসী, তোমার গৃহে আমি সুখে বাস করছি। গৃহদেবী নামে রাক্ষসী প্রত্যেক মানুষের গৃহে বাস করে, দানববিনাশের। জন্য ব্রহ্মা তাদের সৃষ্টি করেছেন। যে লোক ভক্তি করে গৃহদেবীকে ঘরের দেওয়ালে চিত্রিত করে রাখে তার শ্রীবৃদ্ধি হয়। মহারাজ, আমি তোমার গৃহপ্রাচীরে চিত্রিত থেকে গন্ধ পুষ্প ভোজ্যাদির দ্বারা পূজিত হচ্ছি, সেজন্য তোমার প্রত্যুপকার করতে ইচ্ছা করি। এই বলে রাক্ষসী অন্তর্হিত হল। জরা রাক্ষসী সেই কুমারকে সন্ধিত অর্থাৎ যোজিত করেছিল সেজন্য তার নাম জরাসন্ধ হল।। ১ যথাকালে জরাসন্ধকে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করে বৃহদ্রথ তার দুই পত্নীর সঙ্গে তপোবনে চ’লে গেলেন। চণ্ডকৌশিকের আশীর্বাদে জরাসন্ধ সকল রাজার উপর প্রভুত্ব এবং ত্রিপুরারি মহাদেবকে সাক্ষাৎ দর্শনের শক্তি লাভ করলেন। কংস হংস ও ডিম্ভকের মৃত্যুর পর আমার সঙ্গে জরাসন্ধের প্রবল শত্রুতা হল। তিনি একটা গদা নিরানব্বই বার ঘুরিয়ে গিরিব্রজ থেকে মথুরার অভিমুখে নিক্ষেপ করেন, সেই গদ্য নিরানব্বই যোজন দূরে পতিত হয়। মথুরার নিকটবর্তী সেই স্থানের নাম গদাবসান।

৷৷ জরাসন্ধবধপর্বাধ্যায়৷৷

৫। জরাসন্ধবধ

তার পর কৃষ্ণ বললেন, জরাসন্ধের প্রধান দুই সহায় হংস আর ডিম্ভক মরেছে, কংসকেও আমি নিহত করেছি, অতএব জরাসন্ধবধের এই সময়। কিন্তু সুরাসুরও সম্মুখযুদ্ধে তাঁকে জয় করতে পারেন না, সেজন্য মল্লযুদ্ধেই তাকে মারতে হবে। আমি কৌশলজ্ঞ, ভীম বলবান, আর অর্জুন আমাদের রক্ষক, আমরা তিনজন মিলে মগধরাজকে জয় করতে পারব। আমরা যদি নির্জন স্থানে তাকে আহ্বান করি তবে তিনি নিশ্চয় আমাদের একজনের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। তিনি বাহুবলে দর্পিত সেজন্য আমার বা অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করা অপমানজনক মনে করবেন, ভীমসেনের প্রতিদ্বন্দ্বী হ’তেই তার লোভ হবে। মহাবল ভীম নিশ্চয় তাকে বধ করতে পারবেন। যদি আমার উপর আপনার বিশ্বাস থাকে, তবে ভীমার্জুনকে আমার সঙ্গে যেতে দিন।

যুধিষ্ঠির বললেন, অচ্যুত, তুমি পাণ্ডবদের প্রভু, আমরা তোমার আশ্রিত, তুমি যা বলবে তাই করব। যখন আমরা তোমার আজ্ঞাধীন তখন জরাসন্ধ নিশ্চয় নিহত হবেন, রাজারা মুক্তি পাবেন, আমার রাজসূয় যজ্ঞ সম্পন্ন হবে। জগন্নাথ, তুমি আমাদের কার্য শীঘ্র নির্বাহের জন্য মনোযোগী হও। কৃষ্ণ বিনা অর্জুন অথবা অর্জুন বিনা কৃষ্ণ থাকতে পারেন না, কৃষ্ণার্জুনের অজেয় কেউ নেই। আর, তোমাদের সঙ্গে মিলিত হলে বীরশ্রেষ্ঠ শ্রীমান বৃকোদর কি না করতে পারেন ?

কৃষ্ণ ভীম ও অর্জুন স্নাতক (১) ব্রাহ্মণের বেশ ধরে মগধযাত্রা করলেন। তারা কুরুজঙ্গলের মধ্য দিয়ে গিয়ে কালকূট দেশ অতিক্রম করে গণ্ডকী মহাশোণ সদানীরা, সরযু, চর্মন্বতী প্রভৃতি নদী পার হয়ে মিথিলায় এলেন। তার পর পূর্বমুখে গঙ্গা ও শোণ অতিক্রম করে মগধ দেশে প্রবেশ করলেন এবং গিরিব্রজ নগরের প্রান্তস্থ মনোরম চৈত্যক পর্বতে উপস্থিত হলেন। এই স্থানে রাজা বৃহদ্রথ এক বৃষরূপধারী মাংসাশী দৈত্যকে বধ করেন এবং তার চর্ম আর নাড়ী দিয়ে তিনটি ভেরী প্রস্তুত করিয়ে স্থাপন করেন। কৃষ্ণ ও ভীমার্জুন সেই ভেরী ভেঙে ফেলে পর্বতের এক বিশাল প্রাচীন শৃঙ্গ উৎপাটিত করে নগরে প্রবেশ করলেন।

তাঁরা নগরের সমৃদ্ধি দেখতে দেখতে রাজমাৰ্গ দিয়ে চললেন। এক মালাকারের কাছ থেকে মাল্য আর অঙ্গরাগ কেড়ে নিয়ে তারা নিজেদের বস্ত্র রঞ্জিত করলেন এবং মাল্যধারণ-করে অগুরুচন্দনে চর্চিত হলেন। তার পর জনাকীর্ণ তিনটি রক্ষা (মহল) অতিক্রম করে সগর্বে জরাসন্ধের কাছে এসে বললেন, রাজা, আপনার স্বস্তি ও কুশল হ’ক। জরাসন্ধ তখন একটি ব্ৰতাচরণের জন্য উপবাসী ছিলেন। তিনি আগন্তুকদের বেশ দেখে বিস্মিত হলেন এবং পাদ্য অর্থ্যাদি দিয়ে সম্মান করে বললেন, আপনারা বসুন। তিনজনে উপবিষ্ট হলে জরাসন্ধ বললেন, আপনারা মাল্যধারণ ও চন্দনাদি অনুলেপন করেছেন, রঞ্জিত বস্ত্র পরেছেন, আপনাদের বেশ ব্রাহ্মণের ন্যায় কিন্তু বাহুতে ধনুগুণের আঘাতচক্ষু দেখছি। সত্য বলুন আপনারা কে। চৈত্যক পর্বতের শৃঙ্গ ভগ্ন করে ছদ্মবেশে অদ্বার দিয়ে কেন এসেছেন? আমি যথাবিধি অর্থ্যাদি উপহার দিয়েছি, কিন্তু আপনারা তা নিলেন না কেন?

স্নিগ্ধগম্ভীর কণ্ঠে কৃষ্ণ উত্তর দিলেন, রাজা, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য তিন জাতিই স্নাতকের ব্রত নিয়ে মাল্যাদি ধারণ করতে পারে। আমরা ক্ষত্রিয় সেজন্য আমাদের বাক্যবল বেশী নেই, যদি চান তো বাহুবল দেখাতে পারি। বুদ্ধিমান লোকে অদ্বার দিয়ে শত্রুর গৃহে এবং দ্বার দিয়ে মিত্রের গৃহে যায়। আমরা কোনও প্রয়োজনে এখানে এসেছি, আপনি আমাদের শত্রু সেজন্য আপনার প্রদত্ত অর্ঘ্য আমরা নিতে পারি না। জরাসন্ধ বললেন, আপনাদের সঙ্গে কখনও শত্রুতা করেছি এমন মনে পড়ে না। আমি নিরপরাধ, তবে আমাকে শত্রু বলছেন কেন?

কৃষ্ণ উত্তর দিলেন, ক্ষত্রিয়কুলের নেতৃস্থানীয় কোনও এক ব্যক্তির আদেশে আমরা তোমাকে শাসন করতে এসেছি। তুমি বহু ক্ষত্রিয়কে অবরুদ্ধ করে রেখেছ, সৎস্বভাব রাজগণকে রুদ্রের নিকট বলি দেবার সঙ্কল্প করেছ। তোমার এই পাপকার্য নিবারণ না করলে আমাদেরও পাপ হবে। আমরা ধর্মচারী, ধর্মরক্ষায় সমর্থ। মনুষ্যবলি আমরা কখনও দেখি নি, তুমি স্বয়ং ক্ষত্রিয় হয়ে কোন্ বুদ্ধিতে ক্ষত্রিয়-গণকে মহাদেবের নিকট পশুরূপে বলি দিতে চাও? ক্ষত্রিয়দের রক্ষার নিমিত্ত আমরা তোমাকে বধ করতে এসেছি। আমরা ব্রাহ্মণ নই, আমি হৃষীকেশ কৃষ্ণ, এঁরা দুজন পাণ্ডুপুত্র। আমরা তোমাকে যুদ্ধে আহ্বান করছি, হয় বন্দী রাজাদের মুক্তি দাও, না হয় যমালয়ে যাও।

জরাসন্ধ বললেন, কৃষ্ণ, যাকে সবলে জয় করা হয় তাকে নিয়ে যা ইচ্ছা করা যেতে পারে—এই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। দেবতার জন্য যাদের এনেছি ভয় পেয়ে তাদের ছেড়ে দিতে পারি না। তোমরা কিপ্রকার যুদ্ধ চাও? ব্যহিত সৈন্য নিয়ে, না তোমাদের একজন বা দুজন বা তিনজনই আমার সঙ্গে যুদ্ধ করবে? কৃষ্ণ বললেন, আমাদের তিনজনের মধ্যে কার সঙ্গে তুমি যুদ্ধ করতে চাও? জরাসন্ধ ভীমসেনকে নির্বাচন করলেন।

পুরোহিত গোরোচনা মাল্য প্রভৃতি মাঈল্য দ্রব্য এবং বেদনা ও মূৰ্ছা নিবারক ঔষধ নিয়ে রাজার কাছে এলেন। স্বস্ত্যয়নের পর জরাসন্ধ কিরীট খুলে ফেলে দৃঢ়ভাবে কেশবন্ধন করে ভীমের সম্মুখীন হলেন। কৃষ্ণ ভীমের জন্য স্বস্ত্যয়ন করলে ভীমও যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হলেন। দুই যোদ্ধা বাহু ও চরণ দ্বারা পরস্পরকে বেষ্টন ও আঘাত করতে লাগলেন এবং ক্রুদ্ধ সিংহের ন্যায় স্তব্ধনয়নে মল্লযুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। তারা হস্তীর ন্যায় গর্জন করে পরস্পরের কটি স্কন্ধ পার্শ্ব ও অধোদেশে প্রহার করতে লাগলেন। বহু সহস্র ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়াদি স্ত্রীপুরুষ যুদ্ধ দেখবার জন্য সেখানে সমবেত হল।

কার্তিক মাসের প্রথম দিনে আরম্ভ হয়ে সেই যুদ্ধ অনাহারে অবিশ্রামে দিবারাত্র চলল। চতুর্দশ দিবসে রাত্রিকালে জরাসন্ধ ক্লান্ত হয়ে কিছুক্ষণ নিবৃত্ত হলেন। তখন কৃষ্ণ ভীমকে বললেন, যুদ্ধে ক্লান্ত শত্রুকে পীড়ন করা উচিত নয়, অধিক পীড়ন করলে প্রাণহানি হয়। অতএব তুমি মৃদুভাবে বাহুদ্বারা রাজার সঙ্গে যুদ্ধ কর। কৃষ্ণের কথায় ভীম জরাসন্ধের দুর্বলতা বুঝলেন এবং তাকে বধ করবার জন্য আরও সচেষ্ট হয়ে বললেন, কৃষ্ণ, এই পাপী তোমার অনেক স্বজন নিহত করেছে, এ অনুগ্রহের যোগ্য নয়। কৃষ্ণ বললেন, ভীম, তোমার পিতা পবনদেবের কাছে যে দৈববল পেয়েছ। সেই বল এখন দেখাও।

তখন ভীম জরাসন্ধকে দুই হাতে তুলে শতবার ঘূর্ণিত করে ভূমিতে ফেলে নিস্পিষ্ট করে গর্জন করতে লাগলেন এবং দুই পা ধরে টান দিয়ে তার দেহ দ্বিধা বিভক্ত করলেন। জরাসন্ধের আর্তনাদ ও ভীমের গর্জন শুনে মগধবাসীরা ত্রস্ত হল স্ত্রীদের গর্ভপাত হল। তার পর জরাসন্ধের মৃতদেহ রাজভবনের দ্বারে ফেলে দিয়ে কৃষ্ণ ভীম ও অর্জুন সেই রাত্রিতেই বন্দী রাজাদের মুক্ত করলেন।

জরাসন্ধের দিব্যরথে রাজাদের তুলে নিয়ে তারা গিরিব্রজ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। এই রথ ইন্দ্র উপরিচর বসুকে দিয়েছিলেন, উপরিচরের কাছ থেকে বৃহদ্রথ এবং তার তার পর জরাসন্ধ পান। কৃষ্ণ গরুড়কে স্মরণ করলে গরুড় সেই রথের ধ্বজে বসলেন, কৃষ্ণ স্বয়ং সারথি হলেন। কারামুক্ত কৃতজ্ঞ রাজারা সবিনয়ে বললেন দেবকীনন্দন, আমরা প্রণাম করছি, আজ্ঞা করুন আমাদের কি করতে হবে। যে কর্ম মানুষের পক্ষে দুষ্কর তাও আমরা করতে প্রস্তুত। কৃষ্ণ তাঁদের আশ্বস্ত করে বললেন, যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করে সম্রাট হ’তে ইচ্ছা করেন, আপনারা তাকে সাহায্য করবেন। রাজারা সানন্দে সম্মত হলেন।

এই সময়ে জরাসন্ধের পুত্র সহদেব তাঁর পুরোহিত অমাত্য ও স্বজনবর্গের সঙ্গে এসে বাসুদেবকে কৃতাঞ্জলিপুটে প্রণাম করলেন। কৃষ্ণ তাকে অভয় দিয়ে তার প্রদত্ত মহার্ঘ রত্নসমূহ নিলেন এবং তাঁকে মগধের রাজপদে অভিষিক্ত করলেন। অনন্তর কৃষ্ণ ও ভীমার্জুন ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে এসে যুধিষ্ঠিরকে সমস্ত বৃত্তান্ত জানালেন। যুধিষ্ঠির অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং রাজাদের যথাযোগ্য সম্মান করে তাদের স্বরাজ্যে যেতে আজ্ঞা দিলেন। কৃষ্ণও দ্বারকায় ফিরে গেলেন।

**

(১) যিনি ব্রহ্মচর্য সমাপনের পর স্নান করে গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করেছেন।

৷৷ দিগ্বিজয়পর্বাধ্যায়৷৷

৬। পাণ্ডবগণের দিগবিজয়

অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, ধনু অস্ত্র সহায় তুমি যশ সবই আমরা পেয়েছি, এখন রাজকোষে ধনবৃদ্ধি করা উচিত মনে করি। অতএব আমি সকল রাজার কাছ থেকে কর আদায় করব। যুধিষ্ঠির সম্মতি দিলে অর্জুন ভীম সহদেব নকুল বিভিন্ন দিকে দিগ্বিজয়ে যাত্রা করলেন। যুধিষ্ঠির সুহৃদগণের সঙ্গে ইন্দ্রপ্রস্থে রইলেন।

অর্জুন উত্তর দিকে গিয়ে কুলিন্দ, আনৰ্ত, শালদ্বীপ প্রভৃতি জয় করে প্ৰাগজ্যোতিষপুরে গেলেন। সেখানকার রাজা ভগদত্ত তার কিরাত চীন এবং সাগরতীরবাসী অন্যান্য সৈন্য নিয়ে অর্জুনের সঙ্গে ঘোর যুদ্ধ করলেন। আট দিন পরেও অর্জুনকে অক্লান্ত দেখে ভগদত্ত সহাস্যে বললেন, কুরুনন্দন, তোমার বল ইন্দ্রপুত্রেরই উপযুক্ত। আমি ইন্দ্রের সখা, তথাপি যুদ্ধে তোমার সঙ্গে পারছি না। পুত্র, তুমি কি চাও বল। অর্জুন বললেন, ধর্মপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির সম্রাট হ’তে ইচ্ছা করেন, আপনি প্রীতিপূর্বক তাকে কর দিন। ভগদত্ত সম্মত হলে অর্জুন কুবেররক্ষিত উত্তর পর্বতের রাজ্যসমূহ, কাশ্মীর, লোহিত দেশ, ত্রিগর্ত, সিংহপুর, সুহ্ম, চোল, দেশ, বাহ্বীক, কম্বোজ, দরদ প্রভৃতি জয় করলেন। তারপর তিনি শ্বেতপর্বত অতিক্রম করে কিশুরুষ, হাটক ও গন্ধর্ব দেশ জয় করে হরিবর্ষে এলেন। সেখানকার মহাবল মহাকায় দ্বারপালরা মিষ্টবাক্যে বললে, কল্যাণীয় পার্থ, নিবৃত্ত হও, এখানে প্রবেশ করলে কেউ জীবিত থাকে না। এই উত্তরকুরু দেশে যুদ্ধ হয় না, মানবদেহধারী এখানে এলে কিছুই দেখতে পায় না। যুদ্ধ ভিন্ন অন্য কিছু চাও তো বল। অর্জুন। সহাস্যে বললেন, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সম্রাট হবেন এই আমার ইচ্ছা। যদি এই দেশ মানুষের অগম্য হয় তবে আমি যেতে চাই না, তোমরা কিঞ্চিৎ কর দাও। দ্বারপালরা অর্জুনকে দিব্য বস্ত্র আভরণ মৃগচর্ম প্রভৃতি কর স্বরূপ দিলে। দিগ্বিজয় শেষ করে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের কাছে ফিরে এলেন।

ভীমলেন বিশাল সৈন্য নিয়ে পূর্বদিকে গিয়েছিলেন। তিনি পাঞ্চাল, গণ্ডকীয়, বিদেহ, দশর্ণ, পুলিন্দনগর প্রভৃতি জয় করে চেদি দেশে উপস্থিত হলেন। চেদিরাজ শিশুপাল ভীমের কাছে এসে কুশলপ্রশ্ন করে সহাস্যে বললেন, ব্যাপার কি? ভীম ধর্মরাজের অভীষ্ট জানালে শিশুপাল তখনই কর দিলেন। তের দিন শিশুপালের আতিথ্য ভোগ করে ভীম কুমার দেশের রাজা শ্রেণীমান ও কোশলপতি বৃহদ্বলকে পরাজিত করলেন। তার পর অযোধ্যা, গোপালকচ্ছ, উত্তর সোমক, মল্ল, মৎস্য দরদ, বৎস, সুহ্ম প্রভৃতি দেশ জয় করে গিরিব্রজপুরে গেলেন এবং জরাসন্ধপুত্র সহদেবের নিকট কর নিয়ে তার সঙ্গে কর্ণের রাজ্যে উপস্থিত হলেন। কর্ণ বশ্যতা স্বীকার করলেন। তার পর পুণ্ড্রদেশের রাজা মহাবল বাসুদেব এবং কৌশিকী নদীর তীরবাসী রাজাকে পরাস্ত করে বঙ্গ, তাম্রলিপ্ত, কট, সুহ্ম, এবং ব্রহ্মপুত্র নদ ও পূর্বসাগরের তীরবর্তী ম্লেচ্ছ দেশ জয় করে বহু ধনরত্ন নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে এলেন।

সহদেব দক্ষিণ দিকে শূরসেন ও মৎস্য দেশের রাজা, কুন্তিভোজ, অবন্তি ও ভোজকট দেশের রাজা দুর্ধর্য ভীষ্মক ও পাণ্ড্যরাজ প্রভৃতিকে পরাস্ত করে কিষ্কিন্ধ্যায় গেলেন এবং বানররাজ মৈন্দ ও দ্বিবিদকে বশীভূত করলেন। তার পর তিনি মাহিষ্মতী পুরীতে গেলেন। সেখানকার রাজা নীলকে স্বয়ং অগ্নিদেব সাহায্য করতেন সেজন্য সহদেবের প্রচুর সৈন্যক্ষয় এবং প্রাণসংশয় হল। মাহিষ্মতী-বাসীরা ভগবান অগ্নিকে পারদারিক বলত। একদিন ব্রাহ্মণের বেশে অগ্নি নীল রাজার সুন্দরী কন্যার সহিত বিহার করছিলেন, রাজা তা জানতে পেরে অগ্নিকে শাসন করলেন। অগ্নির কোপে রাজভবন জ্বলে উঠল, তখন রাজা অগ্নিকে প্রসন্ন করে কন্যাদান করলেন। সেই অবধি অগ্নিদেব রাজার সহায় হলেন। অগ্নির বরে মাহিষ্মতীর নারীরা স্বৈরিণী ছিল, তাদের বারণ করা যেত না। সহদেব বহু স্তুতি করলে অগ্নি তুষ্ট হলেন, তখন অগ্নির আদেশে নীল রাজা সহদেবকে কর দিলেন। সহদেব ত্রিপুর, পৌরব, সুরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ জয় করে ভোজকট নগরে গিয়ে কৃষ্ণের শ্বশুর ভীষ্মক রাজার নিকট কর আদায় করলেন। তার পর তিনি কর্ণপ্রাবরক (১) গণ, কালমুখ নামক নররাক্ষসগণ, একপাদ পুরুষগণ প্রভৃতিকে জয় করে কেবল দূত পাঠিয়ে পাণ্ড্য; দ্রবিড়, উড্র, কেরল, অন্ধ্র, কলিঙ্গ প্রভৃতি দেশ থেকে কর আদায় করলেন। ধর্মাত্মা বিভীষণও বশ্যতা স্বীকার করে বিবিধ রত্ন, চন্দন, অগুরু কাষ্ঠ, দিব্য আভরণ ও মহার্ঘ বস্ত্র উপহার পাঠালেন। এইরূপে বল ও সামনীতির প্রয়োগে সকল রাজাকে করদ করে সহদেব ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে এসে ধর্মরাজকে সমস্ত ধন নিবেদন করলেন।

নকুল পশ্চিম দিকে গিয়ে শৈরীষক, মহোথ, দশার্ণ, ত্রিগর্ত, মালব, পঞ্চনদ প্রদেশ, দ্বারপালপুর প্রভৃতি জয় করলেন। তিনি দূত পাঠালে যাদবগণসহ কৃষ্ণ বশ্যতা স্বীকার করলেন। তার পর নকুল মদ্ররাজপুর শাকলে গিয়ে মাতুল শল্যের নিকট প্রচুর ধনরত্ন আদায় করলেন এবং সাগরতীরবর্তী ম্লেচ্ছ পহুব ও বর্বরগণকে জয় করে দশ হাজার উষ্ট্রে ধন বোঝাই করে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে এলেন।

** (১) যাদের কান চামড়ার ঢাকা।

৷৷ রাজসূয়িকপর্বাধ্যায়৷৷

৭। রাজসূয় যজ্ঞের আরম্ভ

রাজা যুধিষ্ঠির ধনাগারে ও শস্যাগারে সঞ্চিত বস্তুর পরিমাণ জেনে রাজসূয় যজ্ঞে উদযোগী হলেন। সেই সময়ে কৃষ্ণ ইন্দ্রপ্রস্থে আসায় যুধিষ্ঠির তাকে সংবর্ধনা করে বললেন, কৃষ্ণ তোমার প্রসাদেই এই পৃথিবী আমার বশে এসেছে এবং আমি বহু ধনের অধিকারী হয়েছি। এখন আমি তোমার ও ভ্রাতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে যজ্ঞ করতে ইচ্ছা করি, তুমি অনুমতি দাও; অথবা তুমি নিজেই এই যজ্ঞে দীক্ষিত হও। কৃষ্ণ বললেন, নৃপশ্রেষ্ঠ, আপনিই সম্রাট হবার যোগ্য, অতএব নিজেই এই মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করুন, তাতেই আমরা কৃতার্থ হব। যজ্ঞের জন্য আপনি আমাকে যে কার্যে নিযুক্ত করবেন আমি তাই করব।

যুধিষ্ঠির তার ভ্রাতাদের সঙ্গে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করতে লাগলেন। ব্যাসদেব ঋত্বিকদের নিয়ে এলেন। সুসাম্য উদ্গাতা হলেন, যাজ্ঞবল্ক্য অধ্বর্য, ধৌম্য ও পৈল হোতা, এবং স্বয়ং ব্যাস ব্রহ্মা (১) হলেন। শিল্পিগণ বিশাল গৃহসমূহ নির্মাণ করলেন। সহদেব নিমন্ত্রণের জন্য সর্বদিকে দূত পাঠালেন। তার পর যথাকালে বিপ্রগণ যুধিষ্ঠিরকে যজ্ঞে দীক্ষিত করলেন। নানা দেশ থেকে আগত ব্রাহ্মণরা তাদের জন্য নির্মিত আবাসে রাজার অতিথি হয়ে রইলেন। তারা বহুপ্রকার আখ্যায়িকা বলে এবং নট-নর্তকদের নৃত্যগীত উপভোগ করে কালযাপন করতে লাগলেন। সর্বদাই দীয়তা ভুজ্যতাম্ ধ্বনি শোনা যেতে লাগল। যুধিষ্ঠির তাদের শতসহস্ৰ ধেনু, শয্যা স্বর্ণ ও দাসী দান করলেন।

ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্র বিদুর দুর্যোধনাদি দ্রোণ কৃপ অশ্বত্থামা, গান্ধার রাজ সুবল, তার পুত্র শকুনি, রথিশ্রেষ্ঠ কর্ণ, মদ্ররাজ শল্য, বাহ্রীকরাজ, সোমদত্ত, ভুরিশ্রবা, সিন্ধুরাজ জয়দ্ৰথ, সপুত্র দ্রুপদ, শাম্বরাজ, সাগরতীরবাসী ম্লেচ্ছগণের সহিত প্রাগজ্যোতিষরাজ ভগদত্ত, বৃহম্বল রাজা, পৌণ্ড্রক বাসুদেব, বঙ্গ কলিঙ্গ মালব অন্ধ্র দ্রবিড় সিংহল কাশ্মীর প্রভৃতি দেশের রাজা, কুন্তিভোজ, সপুত্র বিরাট রাজা, চেদিরাজ মহাবীর শিশুপাল, বলরাম অনিরুদ্ধ প্রদ্যুম্ন শাম্ব প্রভৃতি ** (১) ঋত্বিক বিশেষ।

বৃষ্ণিবংশীয় বীরগণ, সকলেই রাজসূয় যজ্ঞ দেখতে ইন্দ্রপ্রস্থে এলেন এবং তাদের জন্য নির্দিষ্ট গৃহে সুখে বাস করতে লাগলেন।

ভীষ্ম দ্রোণ প্রভৃতি গুরুজনকে অভিবাদন করে যুধিষ্ঠির বললেন, এই যজ্ঞে আপনারা সর্ববিষয়ে আমাকে অনুগ্রহ করুন। তার পর তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির যোগ্যতা অনুসারে এইপ্রকারে কার্যবিভাগ করে দিলেন।-দুঃশাসন খাদ্যদ্রব্যের ভার নেবেন, অশ্বত্থামা ব্রাহ্মণগণকে সংবর্ধনা করবেন, সঞ্জয় (১) রাজাদের সেবা করবেন, কোনও কার্য করা হবে কি হবে না তা ভীষ্ম ও দ্রোণ স্থির করবেন, কৃপ ধনরত্নের ভার নেবেন এবং দক্ষিণা দেবেন। বাহ্বীক, ধৃতরাষ্ট্র, সোমদত্ত ও জয়দ্রথ প্রভুর ন্যায় বিচরণ করতে লাগলেন। ধর্মজ্ঞ বিদুর ব্যয়ের ভার নিলেন, দুর্যোধন উপহার দ্রব্য (২) গ্রহণ করতে লাগলেন, উত্তম ফললাভের ইচ্ছায় কৃষ্ণ স্বয়ং ব্রাহ্মণদের চরণ প্রক্ষালনে নিযুক্ত হলেন। যাঁরা যুধিষ্ঠিরের সভায় এসেছিলেন তাঁদের কেউ সহস্র মুদ্রার কম উপঢৌকন আনেন নি। নিমন্ত্রিত রাজারা স্পর্ধা করে ধনদান করতে লাগলেন যাতে তাদের প্রদত্ত অর্থেই যজ্ঞের ব্যয়নিৰ্বাহ হয়।

** (১) ধৃতরাষ্ট্রের সারথি।

(২) উপহারের বিবরণ ১৩-পরিচ্ছেদে আছে।

৷৷ অর্থ্যাভিহরণপর্বাধ্যায৷৷

৮। কৃষ্ণকে অর্ঘ্য প্রদান

অভিষেকের দিনে অভ্যাগত ব্রাহ্মণ ও রাজাদের সঙ্গে নারদাদি মহর্ষিগণ যজ্ঞশালার অন্তগৃহে প্রবেশ করলেন। ঋষিগণ কার্যের অবকাশে গল্প করতে লাগলেন। বিতণ্ডাকারী দ্বিজগণ বলতে লাগলেন, এইরকম হবে, ও রকম নয়। কেউ কেউ শাস্ত্রের যুক্তি দিয়ে লঘু বিষয়কে গুরু এবং গুরু বিষয়কে লঘু প্রতিপাদিত করতে লাগলেন। আকাশে শ্যেনপক্ষীরা যেমন মাংসখণ্ড নিয়ে ছেঁড়াছিড়ি করে সেইরূপ কোনও কোনও বুদ্ধিমান অপরের উক্তির নানাপ্রকার অর্থ করতে লাগলেন। কয়েকজন সর্ববেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ধর্ম ও অর্থ বিষয়ক আলাপে সানন্দে নিরত হলেন।

যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞে সর্বদেশের ক্ষত্রিয়রাজগণ সমবেত হয়েছেন দেখে নারদ এইপ্রকার চিন্তা করলেন। সাক্ষাৎ নারায়ণ প্রতিজ্ঞাপালনের জন্য ক্ষত্ৰকুলে জন্মেছেন। তিনি পূর্বে দেবগণকে আদেশ দিয়েছিলেন-তোমরা পরস্পরকে বধ করে পুনর্বার স্বর্গালোকে আসবে। ইন্দ্রাদি দেবতা যাঁর বাহুবল আশ্রয় করেন তিনিই পৃথিবীতে অন্ধক-বৃষ্ণিদের বংশ উজ্জ্বল করেছেন। অহো, এই মহাবিস্তৃত বলশালী ক্ষত্রগণকে নারায়ণ নিজেই সংহার করবেন!

ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, এখন রাজগণকে যথাযোগ্য অর্ঘ্য দেবার ব্যবস্থা কর। গুরু, পুরোহিত, সম্বন্ধী, স্নাতক, সুহৃৎ ও রাজা এই ছ-জন অর্ঘ্যদানের যোগ্য। এঁরা বহুদিন পরে আমাদের কাছে এসেছেন। তুমি এঁদের প্রত্যেককেই অর্ঘ্য দিতে পার অথবা যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ তাকে দিতে পার। যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, আপনি এঁদের মধ্যে একজনের নাম করুন যিনি অর্ঘ্যদানের যোগ্য। ভীষ্ম বললেন, জ্যোতিষ্কগণের মধ্যে যেমন ভাস্কর, সেইরূপ সমাগত সকল জনের মধ্যে তেজ বল ও পরাক্রমে কৃষ্ণই শ্রেষ্ঠ।

অসূর্যমিব সূর্যের্ণ নির্বামিব বায়ুনা।

ভাসিতং হ্লাদিতঞ্চৈব কৃষ্ণেনেদং সদো হি নঃ ॥

-সূর্য যেমন অন্ধকারময় স্থান উদভাসিত করেন, বায়ু যেমন নিৰ্বাত স্থান আহ্লাদিত করেন, সেইরূপ কৃষ্ণ আমাদের এই সভা আলোকিত ও আহ্লাদিত করেছেন।

ভীষ্মের অনুমতিক্রমে সহদেব কৃষ্ণকে শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য যথাবিধি নিবেদন করলেন, কৃষ্ণও তা নিলেন। চেদিরাজ শিশুপাল কৃষ্ণের এই পূজা সইতে পারলেন না, তিনি সভামধ্যে ভীষ্ম ও যুধিষ্ঠিরকে ভৎর্সনা করে কৃষ্ণের নিন্দা করতে লাগলেন।

৯। শিশুপালের কৃষ্ণনিন্দা

শিশুপাল বললেন, যুধিষ্ঠির, এখানে মহামহিম রাজারা উপস্থিত থাকতে কৃষ্ণ রাজার যোগ্য পূজা পেতে পারেন না। তোমরা বালক, সূক্ষ্ম ধর্মতত্ত্ব জান না, ভীষ্মেরও বুদ্ধিলোপ হয়েছে। ভীষ্ম, তোমার ন্যায় ধর্মহীন লোক নিজের প্রিয়কার্য করতে গিয়ে সাধুজনের অবজ্ঞাভাজন হয়। কৃষ্ণ রাজা নন, তিনি তোমাদের পূজা কেন পাবেন? যদি বয়োবৃদ্ধকে অর্ঘ্য দিতে চাও তবে বসুদেব থাকতে তার পুত্রকে দেবে কেন? যদি কৃষ্ণকে পাণ্ডবদের হিতৈষী তার অনুগত মনে কর তবে দ্রুপদ অর্ঘ্য পাবেন না কেন ? যদি কৃষ্ণাকে আচার্য মনে কর তবে দ্রোণকে অর্ঘ্য দিলে কেন? যদি কৃষ্ণকে পুরোহিত ভেবে থাক তবে বৃদ্ধ দ্বৈপায়ন থাকতে কৃষ্ণকে পূজা করলে কেন? মহারাজ যুধিষ্ঠির, মৃত্যু যাঁর ইচ্ছাধীন সেই পুরুষশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম এখানে রয়েছেন; সর্বশাস্ত্রবিশারদ বীর অশ্বত্থামা, রাজেন্দ্র দুর্যোধন, ভরতকুলের আচার্য কৃপ, তোমার পিতা পাণ্ডুর ন্যায় গুণবান মহাবল ভীষ্মক, মদ্ৰাধিপ শল্য, এবং জামদগ্ন্যের প্রিয়শিষ্য বহুযুদ্ধজয়ী মহারথ কর্ণও এখানে আছেন—এঁদের কাকেও অর্ঘ্য দেওয়া হল না কেন? কৃষ্ণের অর্চনা করাই যদি তোমাদের উদ্দেশ্য হয় তবে অপমান করবার জন্য রাজাদের কেন ডেকে আনলে? আমরা যে কর দিয়েছি তা যুধিষ্ঠিরের ভয়ে বা অনুনয়ে নয়, লোভেও নয়। তিনি ধর্মকার্য করছেন, সম্রাট হ’তে চান, এই কারণেই দিয়েছি। কিন্তু এখন ইনি আমাদের গ্রাহ্য করছেন না। যে দুরাত্মা অন্যায় উপায়ে জরসন্ধকে নিহত করেছে সেই ধর্মচ্যুত কৃষ্ণকে অর্ঘ্য দিয়ে যুধিষ্ঠিরের ধর্মাত্মা-খ্যাতি নষ্ট হল। আর মাধব হীনবুদ্ধি পাণ্ডবরা অর্ঘ্য দিলেও তুমি অযোগ্য হয়ে কেন তা নিলে ? কুকুর যেমন নির্জন স্থানে ঘৃত পেয়ে ভোজন করে কৃতার্থ হয়, তুমিও সেইরূপ পূজা পেয়ে গৌরব বোধ করছ। কুরুবংশীয়গণ তোমাকে অর্ঘ্য দিয়ে উপহাস করেছে। নপুংসকের যেমন বিবাহ, অন্ধের যেমন রূপদর্শন, রাজা হয়েও রাজযোগ্য পূজা নেওয়া তোমার পক্ষে সেইরূপ। রাজা যুধিষ্ঠির কেমন, ভীষ্ম কেমন, আর এই বাসুদেবও কেমন তা আমরা আজ দেখলাম। এই কথা বলে শিশুপাল স্বপক্ষীয় রাজাদের আসন থেকে উঠিয়ে সদলে সভা থেকে চললেন।

যুধিষ্ঠির তখনই শিশুপালের পিছনে পিছনে গিয়ে মিষ্টবাক্যে বললেন, চেদিরাজ, তোমার কথা ন্যায়সংগত হয়নি, শান্তনুপুত্র ভীষ্মকে তুমি অবজ্ঞা করতে পার না। এখানে তোমার চেয়ে বৃদ্ধ বহু মহীপাল রয়েছেন, তারা যখন কৃষ্ণের পূজা মেনে নিয়েছেন তখন তোমার আপত্তি করা উচিত নয়। কৃষ্ণকে ভীষ্ম যেমন জানেন তুমি তেমন জান না।

ভীষ্ম বললেন, যিনি সর্বলোকের মধ্যে প্রবীণতম সেই কৃষ্ণের পূজায় যার সম্মতি নেই সে অনুনয় বা মিষ্টবাক্যের যোগ্য নয়। মহাবাহু কৃষ্ণ কেবল আমাদের অর্চনীয় নন, ইনি ত্রিলোকেরই অর্চনীয়। বহু ক্ষত্রিয়কে কৃষ্ণ যুদ্ধে জয় করেছেন, নিখিল জগৎ তাতে প্রতিষ্ঠিত, সেজন্য বৃদ্ধ রাজারা এখানে থাকলেও আমি কৃষ্ণকেই পূজনীয় মনে করি। জন্মাবধি ইনি যা করেছেন তা আমি বহুলোকের কাছে বহুবার শুনেছি। এই সভায় উপস্থিত বালক বৃদ্ধ সকলকে পরীক্ষার পর কৃষ্ণের যশ শৌর্য ও জয় জেনেই আমরা তাকে অর্ঘ্য দিয়েছি। ব্রাহ্মণদের মধ্যে যিনি জ্ঞানবৃদ্ধ, ক্ষত্রিয়দের মধ্যে যিনি সর্বাধিক বলশালী, বৈশ্যদের মধ্যে যিনি সর্বাধিক ধনী, এবং শূদ্রদের মধ্যে যিনি বয়োবৃদ্ধ, তিনিই বৃদ্ধ রূপে গণ্য হন। দুই কারণে গোবিন্দ সকলের পূজ্য—বেদ বেদাঙ্গের জ্ঞান এবং অমিত বিক্রম। নরলোকে কেশব অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কে আছে? দান দক্ষতা বেদজ্ঞান শৌর্য শালীনতা কীর্তি, উত্তম বুদ্ধি, বিনয় শ্রী ধৈর্য বৃদ্ধি তুষ্টি, সমস্তই কৃষ্ণে নিত্য বিদ্যমান। ইনি ঋত্বিক গুরু সম্বন্ধী স্নাতক নৃপতি সুহৃৎ—সবই, সেজন্য আমরা এঁর পূজা করেছি। কৃষ্ণই সর্বলোকের উৎপত্তি ও বিনাশের কারণ, ইনি সর্বদা সর্বত্র বিদ্যমান, এই অর্বাচীন শিশুপাল তা বোঝে না তাই অমন কথা বলেছে। সে যদি মনে করে যে কৃষ্ণের পূজা অন্যায়, তবে যা ইচ্ছা করুক।

সহদেব বললেন, যিনি কেশীকে নিহত করেছেন, যাঁর পরাক্রম অপ্রমেয়, সেই কেশবকে আমি পূজা করছি। ওহে নৃপগণ, আপনাদের মধ্যে যে তা সইতে পারবে তার মাথায় আমি পা রাখছি। সে আমার কথার উত্তর দিক, তাকে আমি নিশ্চয় বধ করব। রাজাদের মধ্যে যাঁরা বুদ্ধিমান আছেন তারা মানুন যে কৃষ্ণই অর্ঘ্যদানের যোগ্য। সহদেব তাঁর পা তুলে দেখালেও সুবুদ্ধি মানী বলশালী রাজারা কিছু বললেন না। সহদেবের মাথায় পুষ্পবৃষ্টি হল , ‘সাধু সাধু’ এই দৈববাপী শোনা গেল। ভূতভবিষ্যদ্বক্তা সর্বলোকজ্ঞ নারদ বললেন, কমলপত্রাক্ষ কৃষ্ণকে যারা অর্চনা করে না তারা জীবনমৃত তাদের সঙ্গে কখনও কথা বলা উচিত নয়।

তারপর সহদেব পূজাৰ্হ সকলকে পূজা করে অর্ঘ্যদান কার্য শেষ করলেন। কৃষ্ণের পূজা হয়ে গেলে শিশুপাল ক্রোধে রক্তলোচন হয়ে রাজাদের বললেন, আমি আপনাদের সেনাপতি, আদেশ দিন, আমি বৃষ্ণি আর পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। শিশুপাল-প্রমুখ সকল রাজাই ক্রোধে আরক্তবদন হয়ে বলতে লাগলেন, যুধিষ্ঠিরের অভিষেক আর বাসুদেবের পূজা যাতে পণ্ড হয় তাই আমাদের করতে হবে। তারা নিজেদের অপমানিত মনে করে ক্রোধে জ্ঞানশূন্য হলেন। সুহৃদ্গণ বারণ করলে তারা গর্জন করে উঠলেন, মাংসের কাছ থেকে সরিয়ে নিলে সিংহ যেমন করে। কৃষ্ণ বুঝলেন যে এই বিশাল নৃপতিসংঘ যুদ্ধের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছে।

৷৷ শিশুপালবধপাধ্যায়৷৷

১০। যজ্ঞসভায় বাগযুদ্ধ

যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে বললেন, পিতামহ, এই বিশাল রাজসমুদ্র ক্রোধে বিচলিত হয়েছে, যাতে যজ্ঞের বিঘ্ন না হয় এবং আমাদের মঙ্গল হয় তা বলুন। ভীষ্ম বললন, ভয় পেয়ো না, কুকুরের দল যেমন প্রসুপ্ত সিংহের নিকটে এসে ডাকে, এই রাজারাও তেমনি কৃষ্ণের নিকট চিৎকার করছে। অল্পবুদ্ধি শিশুপাল সকল রাজাকেই যমালয়ে পাঠাতে উদ্যত হয়েছে। নরব্যাঘ্ৰ কৃষ্ণ যাকে গ্রহণ করতে ইচ্ছা করেন তার এইপ্রকার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটে।

শিশুপাল বললেন, কুলাঙ্গার ভীষ্ম, তুমি বৃদ্ধ হয়ে রাজাদের বিভীষিকা দেখাচ্ছ, তোমার লজ্জা নেই? বদ্ধ নৌকা যেমন অন্য নৌকার অনুসরণ করে, এক অন্ধ যেমন অন্য অন্ধের পিছনে যায়, কৌরবগণও সেইরূপ তোমার অনুসরণ করছে। তুমি জ্ঞানবৃদ্ধ হয়ে একজন গোপের স্তব করতে চাও! বাল্যকালে কৃষ্ণ পুতনাকে বধ করেছিল, যুদ্ধে অক্ষম অশ্বাসুর আর বৃষভাসুরকে মেরেছিল, একটা অচেতন কাষ্ঠময় শকট পা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল—এতে আশ্চর্য কি আছে? সপ্তাহকাল গোবর্ধন ধারণ করেছিল যা একটা উইঢিবি মাত্র, তাও বিচিত্র নয়। একদিন কৃষ্ণ পর্বতের উপর খেলা করতে করতে প্রচুর অন্ন খেয়েছিল, তাও আশ্চর্য নয়; যে কংসের অন্ন কৃষ্ণ খেত তাকেই সে হত্যা করেছে এইটেই পরমাশ্চর্য। ধার্মিক সাধুরা বলেন, স্ত্রী গো ব্রাহ্মণ অন্নদাতা আর আশ্রয়দাতার উপর অস্ত্রাঘাত করবে না। এই কৃষ্ণ গগাহত্যা ও স্ত্রীহত্যা করেছে, আর তোমার উপদেশে তাকেই পূজা করা হয়েছে। তুমি বলেছ, কৃষ্ণ বুদ্ধিমানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, কৃষ্ণ জগতের প্রভু; কৃষ্ণও তাই ভাবে। ধর্মজ্ঞ ভীষ্ম, তুমি নিজেকে প্রাজ্ঞ মনে কর, তবে অন্য পুরুষে অনুরক্তা কাশীরাজকন্যা অম্বাকে হরণ করেছিলে কেন? তুমি প্রাজ্ঞ তাই তোমারই সম্মুখে অন্য একজন তোমার ভ্রাতৃজায়াদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করেছিলেন। তোমার কোন্ ধর্ম আছে? তোমার ব্রহ্মচর্যও মিথ্যা, মোহবশে বা ক্লীবত্বের জন্য তুমি ব্রহ্মচারী হয়েছ। নিঃসন্তানের যজ্ঞ দান উপবাস সবই ব্যর্থ। একটি প্রাচীন উপাখ্যান শোন।-এক বৃদ্ধ হংস সমুদ্রতীরে বাস করত, সে মুখে ধর্মকথা বলত কিন্তু তার স্বভাব অন্যবিধ ছিল। সেই সত্যবাদী হংস সর্বদা বলত, ধর্মাচরণ কর, অধর্মা ক’রো না। জলচর পক্ষীরা সমুদ্র থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে তাকে দিত এবং তার কাছে নিজেদের ডিম রেখে চরতে যেত। সেই পাপী হংস সুবিধা পেলেই ডিমগুলি খেয়ে ফেলত। অবশেষে জানতে পেরে পক্ষীরা সেই মিথ্যাচারী হংসকে মেরে ফেললে। ভীষ্ম, এই ক্রুদ্ধ রাজারা তোমাকেও সেই হংসের ন্যায় বধ করবেন।

তার পর শিশুপাল বললেন, মহাবল জরাসন্ধ রাজা আমার অতিশয় সম্মানের পাত্র ছিলেন, তিনি কৃষ্ণকে দাস গণ্য করতেন তাই তার সঙ্গে যুদ্ধ করেননি। কৃষ্ণ ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে অদ্বার দিয়ে গিরিব্রজপুরে প্রবেশ করেছিল। ব্রাহ্মণভক্ত জরাসন্ধ কৃষ্ণ আর ভীমার্জুনকে পাদ্য-অর্থ্যাদি দিয়েছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণ তা নেয়নি। মুখ ভীষ্ম, কৃষ্ণ যদি জগকর্তাই হয় তবে নিজেকে পূর্ণভাবে ব্রাহ্মণ মনে করে না কেন?

শিশুপালের কথা শুনে ভীষ্ম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন, তার স্বভাবত আয়ত পদ্মপলাশবর্ণ নয়ন রক্তবর্ণ হল। তিনি ওষ্ঠ দংশন করে সবেগে আসন থেকে উঠলেন, কিন্তু ভীষ্ম তাকে ধরে নিরস্ত করলেন। শিশুপাল হেসে বললেন, ভীষ্ম, ওকে ছেড়ে দাও, রাজারা দেখুন ও আমার তেজে পতঙ্গবৎ দগ্ধ হবে। ভীষ্ম বললেন, এই শিশুপাল তিন চক্ষু আর চার হাত নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল এবং জন্মকালে গর্দভের ন্যায় চিৎকার করেছিল। এর মাতা পিতা প্রভৃতি ভয় পেয়ে একে ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তখন দৈববাণী হল -রাজা, তোমার পুত্রটিকে পালন কর, এর মৃত্যুকাল এখনও আসে নি, যদিও এর হন্তা জন্মগ্রহণ করেছেন। শিশুপালের জননী নমস্কার করে বললেন, আপনি দেবতা বা অন্য যাই হ’ন, বলুন কার হাতে এর মৃত্যু হবে। পুনর্বার দৈববাণী হল —যিনি কোলে নিলে এর অতিরিক্ত দুই হাত খ’সে। যাবে এবং যাঁকে দেখে এর তৃতীয় নয়ন লুপ্ত হবে তিনিই এর মৃত্যুর কারণ হবেন। চেদিরাজের অনুরোধে বহু সহস্র রাজা শিশুকে কোলে নিলেন, কিন্তু কোনও পরিবর্তন দেখা গেল না। কিছুকাল পরে বলরাম ও কৃষ্ণ তাঁদের পিতৃম্বসা (চেদিরাজ দমঘোষের মহিষী) কে দেখতে এলেন। রাজমহিষী কুশলপ্রশ্নাদি করে শিশুটিকে কৃষ্ণের কোলে দিলেন, তৎক্ষণাৎ তার অতিরিক্ত দুই বাহু খসে গেল, তৃতীয় চক্ষু ললাটে নিমজ্জিত হল। মহিষী বললেন, কৃষ্ণ, আমি ভয়ার্ত হয়েছি, তুমি বর দাও যে শিশুপালের অপরাধ ক্ষমা করবে। কৃষ্ণ উত্তর দিলেন, দেবী, ভয় নেই, আমি এর একশত অপরাধ ক্ষমা করব। ভীম, এই মন্দগতি শিশুপাল গোবিন্দের বরে দর্পিত হয়েই তোমাকে যুদ্ধে আহ্বান করছে। এই বুদ্ধি এর নিজের নয়, জগৎস্বামী কৃষ্ণের প্রেরণাতেই এমন করছে।

শিশুপাল বললেন, ভীষ্ম, যদি স্তব করেই আনন্দ পাও তবে বাহ্মীকরাজ, মহাবীর কর্ণ, অশ্বত্থামা দ্রোণ জয়দ্রথ কৃপ ভীষ্মক শল্য প্রভৃতির স্তব কর না কেন? হিমালয়ের পরপারে কুলিঙ্গ পক্ষিণী থাকে, সে সতত এই শব্দ করে-‘মা সাহস’, সাহস ক’রো না, অথচ সে নিজে সিংহের দাঁতের ফাক থেকে মাংস খায়, সে জানে না যে সিংহের ইচ্ছাতেই সে বেঁচে আছে। তুমিও সেইরূপ এই ভূপতিদের ইচ্ছায় বেঁচে আছ।

ভীষ্ম বললেন, চেদিরাজ, যাদের ইচ্ছায় আমি বেঁচে আছি সেই রাজাদের আমি তৃণতুল্যও জ্ঞান করি না। ভীষ্মের কথায় কেউ হাসলেন, কেউ গালি দিলেন, কেউ বললেন, একে পুড়িয়ে মার। ভীষ্ম বললেন, উক্তি আর প্রত্যুক্তিতে বিবাদের শেষ হবে না। আমি তোমাদের মাথায় এই পা রাখছি। যে গোবিন্দকে আমরা পূজা করেছি তিনি এখানেই রয়েছেন, মরবার জন্য যে ব্যস্ত হয়েছে সে চক্রগদাধারী কৃষ্ণকে যুদ্ধে আহ্বান করুক।

১১। শিশুপাল বধ-রাজসূয় যজ্ঞের সমাপ্তি

শিশুপাল বললেন, জনার্দন, তোমাকে আহ্বান করছি, আমার সঙ্গে যুদ্ধ কর, সমস্ত পাণ্ডবদের সঙ্গে আজ তোমাকেও বধ করব। তুমি রাজা নও, কংসের দাস, পূজার অযোগ্য। যে পাণ্ডবরা বাল্যকাল থেকে তোমার অর্চনা করছে তারাও আমার বধ্য।

কৃষ্ণ মৃদুবাক্যে সমবেত নৃপতিবৃন্দকে বললেন, রাজগণ, যাদবরা এই শিশুপালের কোনও অপকার করেনি তথাপি এ আমাদের শত্রুতা করেছে। আমরা যখন প্ৰাগজ্যোতিষপুরে যাই তখন আমাদের পিতৃম্বসার পুত্র হয়েও এই নৃশংস দ্বারকা দগ্ধ করেছিল। ভোজরাজ রৈবতকে বিহার করছিলেন, তাঁর সহচরগণকে শিশুপাল হত্যা ও বন্ধন করে নিজ রাজ্যে চ’লে যায়। এই পাপাত্মা আমার পিতার অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব হরণ করেছিল। বর ভার্যা দ্বারকা থেকে সৌবীর দেশে যাচ্ছিলেন, সেই অকামা নারীকে এ হরণ করেছিল। এই নৃশংস ছদ্মবেশে মাতুলকন্যা ভদ্রাকে নিজ মিত্র করুষ রাজার জন্য হরণ করেছিল। আমার পিতৃম্বসার জন্য আমি সব সয়েছি, কিন্তু শিশুপাল আজ আপনাদের সমক্ষে আমার প্রতি যে আচরণ করলে তা আপনারা দেখলেন। এই অন্যায় আমি ক্ষমা করতে পারব না। এই মূঢ় রুক্ৰিণীকে প্রার্থনা করেছিল, কিন্তু শূদ্র যেমন বেদবাক্য শুনতে পায় না এও তেমনি রুক্মিণীকে পায়নি।

বাসুদেবের কথা শুনে রাজারা শিশুপালের নিন্দা করতে লাগলেন। শিশুপাল উচ্চ হাস্য করে বললেন, কৃষ্ণ, পূর্বে রুক্মিণীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ হয়েছিল এই কথা এখানে বলতে তোমার লজ্জা হল না ? নিজের স্ত্রী অন্যপূর্বা ছিল এই কথা তুমি ভিন্ন আর কে সভায় প্রকাশ করতে পারে? তুমি ক্ষমা কর বা না কর, ক্রুদ্ধ হও বা প্রসন্ন হও, তুমি আমার কি করতে পার?

তখন ভগবান মধুসূদন চক্র দ্বারা শিশুপালের দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করলেন, বজ্রাহত পর্বতের ন্যায় মহাবাহু শিশুপাল ভূপতিত হলেন। রাজারা দেখলেন, আকাশ থেকে সূর্যের ন্যায় একটি উজ্জ্বল তেজ শিশুপালের দেহ থেকে নির্গত হল এক কমলপত্রাক্ষ কৃষ্ণকে প্রণাম করে তাঁর দেহে প্রবেশ করলে। বিনা মেঘে বৃষ্টি ও বজ্রপাত হল , বসুন্ধরা কেঁপে উঠলেন, রাজারা কৃষ্ণকে দেখতে লাগলেন কিন্তু তাদের বাকস্ফূর্তি হল না। কেউ ক্রোধে হস্তপেষণ ও ওষ্ঠদংশন করলেন, কেউ নির্জন স্থানে গিয়ে কৃষ্ণের প্রশংসা করলেন, কেউ মধ্যস্থ হয়ে রইলেন। মহর্ষিগণ, মহাত্মা ব্রাহ্মণগণ এবং মহাবল নৃপতিগণ কৃষ্ণের স্তুতি করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের আজ্ঞা দিলেন যেন সত্বর শিশুপালের সৎকার করা হয়। তার পর যুধিষ্ঠির ও সমবেত রাজারা শিশুপালপুত্রকে চেদিরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন।

যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ সমাপ্ত হল ; ভগবান শৌরি (কৃষ্ণ) শাঈধনু চক্র ও গদা নিয়ে শেষ পর্যন্ত যজ্ঞ রক্ষা করলেন। যুধিষ্ঠির স্নান (যজ্ঞান্ত স্নান) করলে সমস্ত ক্ষত্রিয় রাজারা তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, মহারাজ, ভাগ্যক্রমে আপনি সাম্রাজ্য পেয়েছেন এবং অজমীঢ় বংশের যশোবৃদ্ধি করেছেন। এই যজ্ঞে সুমহৎ ধর্মকার্য করা হয়েছে, আমরাও সর্বপ্রকারে সৎকৃত হয়েছি। এখন আজ্ঞা করুন আমরা নিজ নিজ রাজ্যে যাব। যুধিষ্ঠিরের আদেশে তাঁর ভ্রাতারা, ধৃষ্টদ্যুম্ন, অভিমন্যু এবং দ্রৌপদীর পুত্রগণ প্রধান প্রধান রাজাদের অনুগমন করলেন। কৃষ্ণ বিদায় চাইলে যুধিষ্ঠির বললেন, গোবিন্দ, তোমার প্রসাদেই আমার যজ্ঞ সম্পন্ন হয়েছে, সমগ্র ক্ষত্রিয়মণ্ডল আমার বশে এসেছে। কি বলে তোমাকে বিদায় দেব? তোমার অভাবে আমি স্বস্তি পাব না। তার পর সুভদ্রা ও দ্রৌপদীকে মিষ্টবাক্যে তুষ্ট করে কৃষ্ণ মেঘবর্ণ গরুড়ধ্বজ রথে দ্বারকায় প্রস্থান করলেন।

৷৷ দূতপর্বাধ্যায়৷৷

১২। দুর্যোধনের দুঃখ-শকুনির মন্ত্রণা

ইন্দ্রপ্রস্থে বাসকালে শকুনির সঙ্গে দুর্যোধন পাণ্ডবসভার সমস্ত ঐশ্বর্য ক্রমে ক্রমে দেখলেন। স্ফটিকময় এক স্থানে জল আছে মনে করে তিনি পরিধেয় বস্ত্র টেনে তুললেন, পরে ভ্ৰম বুঝতে পেরে লজ্জায় বিষগ্ন হলেন। আর এক স্থানে পদ্মশোভিত সরোবর ছিল, স্ফটিকনির্মিত মনে করে দুর্যোধন চলতে গিয়ে তাতে পড়ে গেলেন, ভৃত্যরা হেসে তাকে অন্য বস্ত্র এনে দিলে। তিনি বস্ত্র পরিবর্তন করে এলে ভীমার্জুন প্রভৃতিও হাসলেন, দুর্যোধন ক্রোধে তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন না। অন্য এক স্থানে তিনি দ্বার আছে মনে করে স্ফটিকময় প্রাচীরের ভিতর দিয়ে যেতে গিয়ে মাথায় আঘাত পেলেন। আর এক স্থানে কপাট আছে ভেবে ঠেলতে গিয়ে সম্মুখে পড়ে গেলেন, এবং অন্যত্র দ্বার খোলা থাকলেও বদ্ধ আছে ভেবে ফিরে এলেন। এইরূপ নানা প্রকারে বিড়ম্বিত হয়ে তিনি অপ্রসন্নমনে হস্তিনাপুরে প্রস্থান করলেন।

শকুনি জিজ্ঞাসা করলেন, দুর্যোধন, দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছ কেন? দুর্যোধন বললেন, মাতুল, অর্জুনের অস্ত্রপ্রভাবে সমস্ত পৃথিবী যুধিষ্ঠিরের বশে এসেছে এবং তাঁর রাজসূয় যজ্ঞও সম্পন্ন হয়েছে দেখে আমি ঈর্ষায় দিবারাত্র দগ্ধ হচ্ছি। কৃষ্ণ শিশুপালকে বধ করলেন, কিন্তু এমন কোনও পুরুষ ছিল না যে তার শোধ নেয়। বৈশ্য যেমন কর দেয় সেইরূপ রাজারা বিবিধ রত্ন এনে যুধিষ্ঠিরকে উপহার দিয়েছেন। আমি অগ্নিপ্রবেশ করব, বিষ খাব, জলে ডুবব, জীবনধারণ করতে পারব না। যদি পাণ্ডবদের সমৃদ্ধি দেখে সহ্য করি তবে আমি পুরুষ নই, স্ত্রী নই, ক্লীবও নই। তাদের রাজশ্রী আমি একাকী আহরণ করতে পারব না, আমার সহায়ও দেখছি না, তাই মৃত্যুচিন্তা করছি। পাণ্ডবদের বিনাশের জন্য আমি পূর্বে বহু যত্ন করেছি, কিন্তু তারা সবই অতিক্রম করেছে। পুরুষকারের চেয়ে দৈবই প্রবল, তাই আমরা ক্রমশ হীন হচ্ছি আর পাণ্ডবরা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাতুল, আমাকে মরতে দিন, আমার দুঃখের কথা পিতাকে জানাবেন।

শকুনি বললেন, যুধিষ্ঠিরের প্রতি ক্রোধ করা তোমার উচিত নয়, পাণ্ডবরা নিজেদের ভাগ্যফলই ভোগ করছে। তারা পৈতৃক রাজ্যের অংশই পেয়েছে এবং নিজের শক্তিতে সমৃদ্ধ হয়েছে, তাতে তোমার দুঃখ হচ্ছে কেন? ধনঞ্জয় অগ্নিকে তুষ্ট করে গাণ্ডীব ধনু, দুই অক্ষয় তৃণীর আর ভয়ংকর অস্ত্র সকল পেয়েছে, সে তার কামুক আর বাহুর বলে রাজাদের বশে এনেছে, তাতে খেদের কি আছে? মর দানবকে দিয়ে সে সভা করিয়েছে, কিংকর নামক রাক্ষসরা সেই সভা রক্ষা করে, তাতেই বা তোমার দুঃখ হবে কেন? তুমি অসহায় নও, তোমার ভ্রাতারা আছেন, মহাধনুর্ধর দ্রোণ, অশ্বত্থামা, সূতপুত্র কর্ণ, কৃপাচার্য, আমি ও আমার ভ্রাতারা, আর রাজা সোমদত্ত-এঁদের সঙ্গে মিলে তুমি সমগ্র বসুন্ধরা জয় করতে পার।

দুর্যোধন বললেন, যদি অনুমতি দেন তবে আপনাদের সাহায্যে আমি পৃথিবী জয় করব, সকল রাজা আমার বশে আসবে, পাণ্ডবসভাও আমার হবে। শকুনি বললেন, পঞ্চপাণ্ডব, বাসুদেব এবং সপুত্র দ্রুপদ-দেবতারাও এঁদের হারাতে পারেন না। যুধিষ্ঠিরকে যে উপায়ে জয় করা যায় তা আমি বলছি শোন। সে দ্যূতক্রীড়া ভালবাসে কিন্তু খেলতে জানে না, তথাপি তাকে ডাকলে আসবেই। ন্যূতক্রীড়ায় আমার তুল্য নিপুণ ত্রিলোকে নেই। তুমি যুধিষ্ঠিরকে আহ্বান কর, আমি তার রাজ্য আর রাজলক্ষ্মী জয় করে নিশ্চয় তোমাকে দেব। এখন তুমি ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি নাও। দুর্যোধন বললেন, সুবলনন্দন, আপনিই তাঁকে বলুন, আমি পারব না।।

১৩। ধৃতরাষ্ট্র-শকুনি-দুর্যোধন-সংবাদ

হস্তিনাপুরে এসে শকুনি ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহারাজ, দুর্যোধন দুর্ভাবনায় পাণ্ডুবর্ণ ও কৃশ হয়ে যাচ্ছে, কোনও শত্রু তার এই শোকের কারণ। আপনি এ বিষয়ে অনুসন্ধান করেন না কেন?

ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনকে বললেন, পুত্র, তোমার শোকের কারণ কি? মহৎ ঐশ্বর্য আর রাজচ্ছত্র তোমাকে আমি দিয়েছি, তোমার ভ্রাতারা আর বন্ধুরা তোমার অহিত করেন না, তুমি উত্তম বসন পরছ, সমাংস অন্ন খাচ্ছ; উৎকৃষ্ট অশ্ব, মহার্ঘ শয্যা, মনোরমা নারীবৃন্দ, উত্তম বাসগৃহ ও বিহারস্থানও তোমার আছে; তবে তুমি দীনের ন্যায় শোক করছ কেন? দুর্যোধন উত্তর দিলেন, পিতা, আমি কাপুরুষের ন্যায় ভোজন করছি, পরিধান করছি, এবং কালের পরিবর্তন প্রতীক্ষা করে দারুণ ক্রোধ পোষণ করছি। আমাদের শত্রুরা সমৃদ্ধ হচ্ছে, আমরা হীন হয়ে যাচ্ছি, এই কারণেই আমি বিবর্ণ ও কৃশ হচ্ছি। অষ্টাশি হাজার স্নাতক গৃহস্থ এবং তাদের প্রত্যেকের ত্রিশটি দাসী যুধিষ্ঠির পালন করেন। তাঁর ভবনে প্রত্যহ দশ হাজার লোক স্বর্ণপাত্রে উত্তম অন্ন খায়। বহু রাজা তার কাছে কর নিয়ে এসেছিলেন এবং অনেক অশ্ব হস্তী উষ্ট্র স্ত্রী পট্টবস্ত্র কম্বল প্রভৃতি উপহার দিয়েছেন। শত শত ব্রাহ্মণ কর দেবার জন্য এসেছিলেন কিন্তু নিবারিত হয়ে দ্বারদেশেই অপেক্ষা করছিলেন, অবশেষে যুধিষ্ঠিরকে জানিয়ে সভায় প্রবেশ করতে পান। বহু রত্ন-ভূষিত স্বর্ণময় কলস এবং উৎকৃষ্ট শঙ্খ দিয়ে বাসুদেব যুধিষ্ঠিরকে অভিষিক্ত করেছেন, তা দেখে আমার যেন জ্বর এল। প্রত্যহ এক লক্ষ ব্রাহ্মণের ভোজন শেষ হলে একটি শঙ্খ বাজত, তার শব্দ শুনে। আমার রোমাঞ্চ হত। যুধিষ্ঠিরের তুল্য ঐশ্বর্য ইন্দ্র যম বরুণ বা কুবেরেরও নেই। পাণ্ডুপুত্রদের সমৃদ্ধি দেখে আমি মনে মনে দগ্ধ হচ্ছি, আমার শান্তি নেই। মহারাজ, আমার এই অক্ষবিৎ মাতুল দ্যূতক্রীড়ায় পাণ্ডবদের ঐশ্বর্য হরণ করতে চান, আপনি অনুমতি দিন।

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, মহাপ্রাজ্ঞ বিদুরের উপদেশে আমি চলি, তাঁর মত নিয়ে কর্তব্য স্থির করব। তিনি দূরদর্শী, ধর্মসংগত ও উভয় পক্ষের হিতকর উপদেশই তিনি দেবেন। দুর্যোধন বললেন, মহারাজ, বিদুর আপনাকে বারণ করবেন, তার ফলে আমি নিশ্চয় মরব, আপনি বিদুরকে নিয়ে সুখে থাকবেন। পুত্রের এই আর্ত বাক্য শুনে ধৃতরাষ্ট্র আদেশ দিলেন, শিল্পীরা শীঘ্র একটি মনোরম বিশাল সভা নির্মাণ করুক, তার সহস্র স্তম্ভ ও শত দ্বার থাকবে। তারপর ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, পুত্র, তুমি পৈতৃক রাজ্য পেয়েছ, ভ্রাতাদের জ্যেষ্ঠ বলে রাজার পদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছ, তবে শোক করছ কেন?

পাণ্ডবসভায় তিনি কিরূপ বিড়ম্বনা আর উপহাস ভোগ করেছিলেন তা জানিয়ে দুর্যোধন বললেন, মহারাজ, যুধিষ্ঠিরের জন্য বিভিন্ন দেশের রাজারা যে উপহার এনেছিলেন তার বিবরণ শুনুন। কাম্বোজরাজ স্বর্ণখচিত মেষলোম-নির্মিত এবং গর্তবাসী প্রাণী ও বিড়ালের লোমনির্মিত আবরণবস্ত্র এবং উত্তম চর্ম দিয়েছেন। ত্রিগর্তরাজ বহুশত অশ্ব, উষ্ট্র ও অশ্বতর দিয়েছেন। শূদ্রেরা কাপাসিকদেশবাসিনী শতদেশে তন্বী শ্যামা দীর্ঘকেশী দাসী দিয়েছে। ম্লেচ্ছরাজ ভগদত্ত বহু অশ্ব, শোধময় অলংকার, এবং হস্তিদন্তের মুষ্টিযুক্ত অসি দিয়েছেন। দ্বিচক্ষু, ত্রিচক্ষু (১), ললাটচক্ষু (১), উষ্ণীষধারী, বস্ত্রহীন, রোমশ, নরখাদক, একপাদ (১), চীন, শক, উড্র, বর্বর, বনবাসী, হারহুণ প্রভৃতি লোকেরা নানা দিক থেকে এসেছিল, তারা বহুক্ষণ দ্বারদেশে অপেক্ষা করে তবে প্রবেশ করতে পেয়েছিল। মেরু ও মন্দর পর্বতের মধ্যে শৈলোদা নদীর তীরে যারা থাকে, সেই খস পারদ কুলিঙ্গ প্রভৃতি জাতি রাশি রাশি পিপীলিক (১) স্বর্ণ এনেছিল, পিপীলিকারা যা ভূমি থেকে তোলে। কিরাত দরদ পারদ বাহ্মীক কেরল অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ পুণ্ড্রক এবং আরও বহু দেশের লোক নানাবিধ উপহার দিয়েছে। বাসুদেব কৃষ্ণ অর্জুনের সম্মানার্থে চোদ্দ হাজার উৎকৃষ্ট হস্তী দিয়েছেন। দ্রৌপদী প্রত্যহ অভুক্ত থেকে দেখতেন সভায় আগত কুজ-বামন পর্যন্ত সকলের ভোজন হয়েছে কিনা। রাজসূয় যজ্ঞ করে যুধিষ্ঠির হরিশ্চন্দ্রের ন্যায় সমৃদ্ধিলাভ করেছেন, তা দেখে আমার আর জীবনধারণের প্রয়োজন কি? | ধৃতরাষ্ট্র বললেন, পুত্র, যুধিষ্ঠির তোমার প্রতি বিদ্বেষ করে না, তার যেমন অর্থবল ও মিত্রবল আছে তোমারও তেমন আছে। তোমার আর পাণ্ডবদের একই পিতামহ। ভ্রাতার সম্পত্তি কেন হরণ করতে ইচ্ছা কর? যদি যজ্ঞ করে ঐশ্বর্য লাভ করতে চাও তবে ঋত্বিকরা তার আয়োজন করুন। তুমি যজ্ঞে ধনদান কর, কাম্যবস্তু ভোগ কর, স্ত্রীদের সঙ্গে বিহার কর, কিন্তু অধর্ম থেকে নিবৃত্ত হও।

দুর্যোধন বললেন, যার নিজের বুদ্ধি নেই, কেবল বহু শাস্ত্র শুনেছে, সে শাস্ত্রার্থ বোঝে না, দবী (হাতা) যেমন সুপের (দালের) স্বাদ বোঝে না। আপনি পরের বুদ্ধিতে চ’লে আমাকে ভোলাচ্ছেন কেন? বৃহস্পতি বলেছেন, রাজার আচরণ সাধারণের আচরণ থেকে ভিন্ন, রাজা সযত্নে স্বার্থচিন্তা করবেন। মহারাজ, জয়লাভই ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি, ধর্মাধর্ম বিচারের প্রয়োজন নেই। অমুক শত্রু, অমুক মিত্র, এরূপ কোনও লেখ্য প্রমাণ নাই, চিহ্নও নেই; যে লোক সন্তাপের কারণ সেই শত্রু। জাতি অনুসারে কেউ শত্রু হয় না, বৃত্তি সমান হলেই শত্রুতা হয়।

শকুনি বললেন, যুধিষ্ঠিরের যে সমৃদ্ধি দেখে তুমি সন্তপ্ত হচ্ছ তা আমি দ্যূতক্রীড়ায় হরণ করব, তাকে আহ্বান কর। আমি সুদক্ষ দূতজ্ঞ, সেনার সম্মুখীন না হয়ে পাশা খেলেই অজ্ঞ পাণ্ডবদের জয় করব তাতে সন্দেহ নেই। পণই আমার ধনু, অক্ষই আমার বাণ, ক্ষেপণের দক্ষতাই আমার ধনুগুণ, আসনই আমার রথ। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, আমি মহাত্মা বিদুরের মতে চ’লে থাকি, তার সঙ্গে কথা বলে কর্তব্য স্থির করব। পুত্র, প্রবলের সঙ্গে কলহ করা আমার মত নয়, কলহ অলৌহময় অস্ত্রস্বরূপ, তাতে বিপ্লব উৎপন্ন হয়। দুর্যোধন বললেন, বিদুর আপনার বুদ্ধিনাশ করবেন তাতে সংশয় নেই, তিনি পাণ্ডবদের হিত যেমন চান তেমন আমাদের চান না। প্রাচীন কালের লোকেরাও দ্যূতক্রীড়া করেছেন, তাতে বিপদ বা যুদ্ধের সম্ভাবনা নেই, দৈব যেমন আমাদের, তেমন পাণ্ডবদেরও সহায় হ’তে পারেন। আপনি মাতুল শকুনির বাক্যে সম্মত হবে পাণ্ডবদের দূতসভার আনবার জন্য আজ্ঞা দিন।

ধৃতরাষ্ট্র অবশেষে অনিচ্ছায় সম্মতি দিলেন এবং সংবাদ নিয়ে জানলেন যে দূতসভানির্মাণ সম্পূর্ণ হয়েছে। তখন তিনি তার মুখ্য মন্ত্রী বিদুরকে বললেন, তুমি শীঘ্র গিয়ে যুধিষ্ঠিরকে ডেকে আন, তিনি ভ্রাতাদের সঙ্গে এসে আমাদের সভা দেখুন এবং সুহৃদ্ভাবে দ্যূতক্রীড়া করুন। বিদুর বললেন, মহারাজ, আপনার আদেশের প্রশংসা করতে পারি না, দূতের ফলে বংশনাশ হবে, পুত্রদের মধ্যে কলহ হবে। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, বিদুর, দৈব যদি প্রতিকূল না হয় তবে কলহ আমাকে দুঃখ দিতে পারবে না, বিধাতা সর্বজগৎ দৈবের বশে রেখেছেন। তুমি আমার আজ্ঞা পালন কর।

** (১) মেগাস্থেনিসের ভারত বিবরণে এই সকলের উল্লেখ আছে।

১৪। যুধিষ্ঠিরাদির দূতসভায় আগমন

ধৃতরাষ্ট্রের আজ্ঞাবশে বিদুর ইন্দ্রপ্রস্থে গেলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, ক্ষত্তা (১), মনে হচ্ছে আপনার মনে সুখ নেই, আপনি কুশলে এসেছেন তো? বৃদ্ধ রাজার পুত্র ও প্রজারা বশে আছে তো? কুশল জ্ঞাপনের পর বিদুর বললেন, রাজা যুধিষ্ঠির, কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র তোমাকে এই বলেছেন। তোমার ভ্রাতারা এখানে যে সভা নির্মাণ করেছেন তা তোমাদের সভারই তুল্য, এসে দেখে যাও। তুমি তোমার ভ্রাতাদের সঙ্গে এখানে এসে সুহৃদভাবে দ্যূতক্রীড়া কর, আমোদ কর। তোমরা এলে আমরা সকলেই আনন্দিত হব।

যুধিষ্ঠির বললেন, দূত থেকে কলহ উৎপন্ন হয়, বুদ্ধিমান ব্যক্তির তা রুচিকর নয়। আপনার কি মত? বিদুর বললেন, আমি জানি যে দূত অনর্থের মূল, তার নিবারণের চেষ্টাও আমি করেছিলাম, তথাপি ধৃতরাষ্ট্র আমাকে পাঠিয়েছেন। যুধিষ্ঠির, তুমি বিদ্বান, যা শ্রেয় তাই কর। যুধিষ্ঠির বললেন, শকুনির সঙ্গে খেলতে আমার ইচ্ছা নেই, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র যখন ডেকেছেন তখন আমি নিবৃত্ত হ’তে পারি না।

পরদিন যুধিষ্ঠির দ্রৌপদী, ভ্রাতৃগণ ও পরিজনদের নিয়ে হস্তিনাপুরে যাত্রা করলেন। সেখানে উপস্থিত হয়ে ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ কৃপ দুর্যোধন শল্য শকুনি প্রভৃতির সঙ্গে দেখা করে ধৃতরাষ্ট্রের গৃহে গেলেন। গান্ধারী তাঁকে আশীর্বাদ করলেন, ধৃতরাষ্ট্রও পঞ্চপাণ্ডবের মস্তকাঘ্রাণ করলেন। দ্রৌপদীর অত্যুজ্জ্বল বেশভুষা দেখে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রবধূরা বিশেষ সন্তুষ্ট হলেন না। পাণ্ডবগণ সুখে রাত্রিযাপন করে পরদিন প্রাতঃকৃত্যের এর দূতসভায় প্রবেশ করলেন।

শকুনি বললেন, রাজা যুধিষ্ঠির, সভায় সকলে তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন, এখন খেলা আরম্ভ হ’ক। যুধিষ্ঠির বললেন, দ্যূতক্রীড়া শঠতাময় ও পাপজনক, তাতে ক্ষত্রোচিত পরাক্রম নেই, নাতিসংগতও নয়। শঠতায় গৌরব নেই, শকুনি, আপনি অন্যায়ভাবে আমাদের জয় করবেন না। শকুনি বললেন, যে পূর্বেই জানে পাশা ফেললে কোন্ সংখ্যা পড়বে, যে শঠতার প্রণালী বোঝে, এবং যে অক্ষ-ক্রীড়ায় নিপুণ সে সমস্তই সইতে পারে। যুধিষ্ঠির, নিপুণ দূতকারের হাতে বিপক্ষের পরাজয় হয়, সে কারণে আমাদেরই পরাজয়ের আশঙ্কা আছে, তথাপি আমরা খেলব। যুধিষ্ঠির বললেন, আমি শঠতার দ্বারা সুখ বা ধন লাভ করতে চাই না, ধূর্ত দূতকারের শঠতা প্রশংশনীয় নয়। শকুনি বললেন, যুধিষ্ঠির, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ও বিদ্বানরাও শঠতার দ্বারা পরস্পরকে জয় করতে চেষ্টা করেন, এপ্রকার শঠতা নিন্দনীয় নয়। তবে তোমার যদি আপত্তি বা ভয় থাকে তবে খেলো না। যুধিষ্ঠির বললেন, আহ্বান করলে আমি নিবৃত্ত হই না, এই আমার ব্রত। এই সভায় কার সঙ্গে আমার খেলা হবে? পণ কে দেবে? দুর্যোধন উত্তর দিলেন, মহারাজ, আমিই পণের জন্য ধনরত্ন দেব, আমার মাতুল শকুনি আমার হয়ে খেলবেন। যুধিষ্ঠির বললেন, একজনের পরিবর্তে অন্যের খেলা রীতিবিরুদ্ধ মনে করি। যাই হ’ক, যা ভাল বোঝ তাই কর।

** (১) দাসীপুত্র। বিদুরের উপাধি।

১৫৷ দ্যূতক্রীড়া

এই সময়ে ধৃতরাষ্ট্র এবং তার পশ্চাতে অপ্রসন্নমনে ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ ও বিদুর সভায় এসে আসন গ্রহণ করলেন। তার পর খেলা আরম্ভ হল। যুধিষ্ঠির বললেন, রাজা দুর্যোধন, সাগরের আবর্ত থেকে উৎপন্ন এই মহামূল্য মণি যা আমার স্বর্ণহারে আছে তাই আমার পণ। তোমার পণ কি? দুর্যোধন উত্তর দিলেন, আমার অনেক মণি আর ধন আছে, সে সমস্তই আমার পণ। তখন শকুনি তার পাশা ফেললেন এবং যুধিষ্ঠিরকে বললেন, এই জিতলাম।

যুধিষ্ঠির বললেন, শকুনি, আপনি কপট ক্রীড়ায় আমার পণ জিতে নিলেন। যাই হ’ক, সহস্র সুবর্ণে পূর্ণ আমার অনেক মঞ্জুষা আছে, এবারে তাই আমার পণ। শকুনি পুনর্বার পাশা ফেলে বললেন, জিতেছি। তার পর যুধিষ্ঠির বললেন, সহস্র রথের সমমূল্য ব্যাঘ্রচর্মাবৃত কিংকিণীজালমণ্ডিত সর্ব উপকরণসমেত ওই উত্তম রথ যাতে আমি এখানে এসেছি, এবং তার কুমুদশুভ্র আটটি অশ্ব আমার পণ। এই কথা শুনেই শকুনি পূর্ববৎ শঠতা অবলম্বন করে পাশা ফেলে বললেন, জিতেছি।

তার পর যুধিষ্ঠির পর পর এইসকল পণ রাখলেন।-সালংকারা নৃত্য-গীতাদিনিপুণা এক লক্ষ তরুণী দাসী; কর্মকুশল উষ্ণীবকুণ্ডলধারী নজস্বভাব এক লক্ষ যুবক দাস; এক হাজার উত্তম হস্তী; স্ববধ্বজ ও পতাকায় শোভিত এক হাজার রথ যার প্রত্যেক রথী যুদ্ধকালে এবং অন্য কালেও সহস্র মুদ্রা মাসিক বেতন পান; গন্ধর্বরাজ চিত্ররথ অর্জুনকে যেসকল বিচিত্রবর্ণ অশ্ব দিয়েছিলেন; দশ হাজার রথ ও দশ হাজার শকট; নাট হাজার বিশালবক্ষা বীর সৈনিক যারা দুগ্ধ পান করে এবং শালিতণ্ডুলের অন্ন খায়; স্বর্ণমুদ্রায় পূর্ণ চার শত ধনভাণ্ড। এ সমস্তই শকুনি শঠতার দ্বারা জয় করলেন।

দ্যূতক্রীড়ায় এইরূপে যুধিষ্ঠিরের সর্বনাশ হচ্ছে দেখে বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহারাজ, মুমূর্ষ ব্যক্তির ঔষধে রুচি হয় না, আমার বাক্যও হয়তো আপনার অপ্রিয় হবে, তথাপি বলছি শুনুন, এই দুর্যোধন জন্মগ্রহণ করেই শৃগালের ন্যায় রব করেছিল, এ ভরতবংশ ধ্বংস করবে। আপনি জানেন যে অন্ধক যাদব আর ভোজবংশীয়গণ তাদেরই আত্মীয় কংসকে ত্যাগ করেছিলেন, এবং তাদেরই নিয়োগে কৃষ্ণ কংসকে বধ করেছিলেন। আপনি আদেশ দিন, সব্যসাচী অর্জুন দুর্যোধনকে বধ করবেন, এই পাপী নিহত হলে কৌরবগণ সুখী হবে। আপনি শৃগালতুল্য দুর্যোধনের বিনিময়ে পাণ্ডবগণকে ক্রয় করুন। কুলরক্ষার প্রয়োজনে যদি একজনকে ত্যাগ করতে হয় তবে তাই করা উচিত; গ্রামরক্ষার জন্য কুল, জনপদ রক্ষার জন্য গ্রাম এবং আত্মরক্ষার জন্য পৃথিবীও ত্যাগ করা উচিত। দূত থেকে কলহ ভেদ ও দারুণ শত্রুতা হয়, দুর্যোধন তাই সৃষ্টি করছে। মত্ত বৃষ যেমন নিজের শৃঙ্গ ভগ্ন করে, দুর্যোধন তেমন নিজের রাজ্য থেকে মঙ্গল দূর করছে। মহারাজ, দুর্যোধনের জয়ে আপনার খুব আনন্দ হচ্ছে, কিন্তু এ থেকেই যুদ্ধ আর লোকক্ষয় হবে। ধনের প্রতি আপনার আকর্ষণ আছে এবং তার জন্য আপনি মন্ত্রণা করেছেন তা জানি। এখন আপনার ভ্রাতুস্পুত্র যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে এই যে কলহ সৃষ্ট হল এতে আমাদের মত নেই। হে প্রতীপ ও শান্তনুর বংশধরগণ, তোমরা আমার হিতবাক্য শোন, ঘোর অগ্নি প্রজ্বলিত হয়েছে, নির্বোধের অনুসরণ করে তাতে প্রবেশ ক’রো না। এই অজাতশত্রু যুধিষ্ঠির, বৃকোদর, সব্যসাচী এবং নকুল-সহদেব যখন ক্রোধ সংবরণ করতে পারবেন না তখন তুমুল যুদ্ধসাগরে দ্বীপ রূপে কোন পুরুষকে আশ্রয় করবে? এই পার্বতদেশবাসী শকুনি কপটত্বে পটু তা আমরা জানি, ও যেখান থেকে এসেছে চ’লে যাক, পাণ্ডবদের সঙ্গে তোমরা যুদ্ধ ক’রো না।

দুর্যোধন বললেন, ক্ষত্তা, আপনি সর্বদাই আমাদের নিন্দা আর মূর্খ ভেবে অবজ্ঞা করেন। আপনি নির্লজ্জ, যা ইচ্ছা তাই বলছেন। নিজেকে কর্তা ভাববেন না, আমার কিসে হিত হবে তা আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি না। আমরা অনেক সয়েছি, আমাদের উত্ত্যক্ত করবেন না। একজনই শাসনকর্তা আছেন, দ্বিতীয় নেই; যিনি গর্ভস্থ শিশুকে শাসন করেন তিনিই আমার শাসক; তার প্রেরণায় আমি জলস্রোতের ন্যায় চালিত হচ্ছি। যিনি পর্বত ও ভূমি বিদীর্ণ করেন তার বুদ্ধিই মানুষের কার্য নিয়ন্ত্রিত করে। বলপূর্বক অন্যকে শাসন করতে গেলেই শত্রু সৃষ্টি হয়। যে লোক শত্রুর দলভুক্ত তাকে গৃহে বাস করতে দেওয়া অনুচিত। বিদুর, আপনি যেখানে ইচ্ছা চ’লে যান।

বিদূর বললেন, রাজপুত্র, ষাট বৎসরের পতি যেমন কুমারীর কাম্য নয়, আমিও সেইরূপ তোমার অপ্রিয়। এর পরে যদি হিতাহিত সকল বিষয়ে নিজের মনোমত মন্ত্রণা চাও তবে স্ত্রী জড় পঙ্গু ও মূঢ়দের জিজ্ঞাসা ক’রো। প্রিয়ভাষী পাপী লোক অনেক আছে কিন্তু অপ্রিয় হিতবাক্যের বক্তা আর শ্রোতা দুইই দুর্লভ। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, আমি সর্বদাই বিচিত্রবীর্যের বংশধরদের যশ ও ধন কামনা করি। যা হবার তা হবে, আপনাকে নমস্কার করি, ব্রাহ্মণরা আমাকে আশীর্বাদ করুন।

শকুনি বললেন, যুধিষ্ঠির, তুমি পাণ্ডবদের বহু সম্পত্তি হেরেছ, আর যদি কিছু থাকে তো বল। যুধিষ্ঠির বললেন, সুবলনন্দন, আমার ধন অসংখ্য, তাই নিয়ে আমি খেলব। এই বলে তিনি পণ করলেন—অসংখ্য অশ্ব গো ছাগ মেষ এবং পর্ণাশা ও সিন্ধু নদীর পূর্বপারের সমস্ত সম্পত্তি; নগর, জনপদ, ব্রহ্মস্ব ভিন্ন সমস্ত ধন ও ভূমি, ব্রাহ্মণ ভিন্ন সমস্ত পুরুষ। শকুনি সবই জিতে নিলেন। তখন যুধিষ্ঠির রাজপুত্রগণের কুণ্ডলাদি ভূষণ পণ করলেন এবং তাও হারলেন। তার পর তিনি বললেন, এই শ্যামবর্ণ লোহিতাক্ষ সিংহস্কন্ধ মহাবাহু যুবা নকুল আমার পণ। শকুনি নকুলকে এবং তার পর সহদেবকেও জয় করে বললেন, যুধিষ্ঠির, তোমার প্রিয় দুই মাদ্রীপুত্রকে আমি জিতেছি, বোধ হয় ভীম আর অর্জুন তোমার আরও প্রিয়।

যুধিষ্ঠির বললেন, মূঢ়, তুমি আমাদের মধ্যে ভেদ জন্মাতে চাচ্ছ। শকুনি বললেন, মত্ত লোক গর্তে পড়ে, প্রমত্ত লোক বহুভাষী হয়। তুমি রাজা এবং বয়সে বড়, তোমাকে নমস্কার করি। লোকে জুয়াখেলার সময় অনেক উৎকট কথা বলে।

যুধিষ্ঠির বললেন, শকুনি, যিনি যুদ্ধে নৌকার ন্যায় আমাদের পার করেন, যিনি বিশ্বজয়ী ও বলিষ্ঠ, পণের অযোগ্য সেই রাজপুত্র অর্জুনকে পণ রাখছি। শকুনি পাশা ফেলে বললেন, জিতেছি। যুধিষ্ঠির বললেন, বজ্রধারী ইন্দ্রের ন্যায় যিনি যুদ্ধে আমাদের নেতা, যিনি 
সিংহস্কন্ধ ক্রুদ্ধস্বভাব, যাঁর তুল্য বলবান কেউ নেই, পণের অযোগ্য সেই ভীমসেনকে পণ রাখছি। শকুনি পাশা ফেলে বললেন, জিতেছি। অবশেষে যুধিষ্ঠির নিজেকেই পণ রাখলেন এবং হারলেন।

শকুনি বললেন, রাজা, কিছু ধন অবশিষ্ট থাকতে তুমি নিজেকে পণ রেখে হারলে, এতে পাপ হয়। তোমার প্রিয়া পাঞ্চালী এখনও বিজিত হননি, তাকে পণ রেখে নিজেকে মুক্ত কর। যুধিষ্ঠির বললেন, যিনি অতিখর্বা বা অতিকৃষ্ণা নন, কৃশা বা রক্তবর্ণা নন, যিনি কৃষ্ণকুঞ্চিতকেশী, পদ্মপলাশাক্ষী, পদ্মগন্ধা, রূপে 
লক্ষ্মীসমা, সর্বগুণান্বিতা, প্রিয়ংবদা, সেই

দ্রৌপদীকে পণ রাখছি।

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের এই কথা শুনে সভা বিক্ষুব্ধ হল , বৃদ্ধগণ ধিক ধিক বললেন, ভীষ্ম দ্রোণ প্রভৃতি ঘর্মাক্ত হলেন, বিদুর মাথায় হাত দিয়ে মোহগ্রস্তের ন্যায় অধোবদনে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন। ধৃতরাষ্ট্র মনোভাব গোপন করতে পারলেন না, হৃষ্ট হয়ে বার বার জিজ্ঞাসা করলেন, কি জিতলে, কি জিতলে ? কর্ণ দুঃশাসন প্রভৃতি আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলেন, অন্যান্য সদস্যগণের চক্ষু থেকে অশ্রুপাত হল। শকুনি পাশা ফেলে বললেন, জিতেছি।

দুর্যোধন বিদুরকে বললেন, পাণ্ডবপ্রিয়া দ্রৌপদীকে নিয়ে আসুন, সেই অপুণ্যশীলা অন্য দাসীদের সঙ্গে গৃহমার্জনা করুক। বিদুর বললেন, তোমার মতন লোকেই এমন কথা বলতে পারে। কৃষ্ণা দাসী হ’তে পারেন না, কারণ তাঁকে পণ রাখবার সময় যুধিষ্ঠিরের স্বামিত্ব ছিল না। মূর্খ, মহাবিষ ক্রুদ্ধ সর্প তোমার মাথার উপর রয়েছে, তাদের আরও কুপিত ক’রো না, যমালয়ে যেয়ো না। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র নরকের ভয়ংকর দ্বারে উপস্থিত হয়েও তা বুঝছে না, দুঃশাসন প্রভৃতিও তার অনুসরণ করছে।

১৬। দ্রৌপদীর নিগ্রহ-ভীমের শপথ—ধৃতরাষ্ট্রের বরদান

দুর্যোধন তার এক অনুচরকে বললেন, প্রতিকামী, তুমি দ্রৌপদীকে এখানে নিয়ে এস, তোমার কোনও ভয় নেই। সূতবংশীয় প্রাতিকামী দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে বললে, যাজ্ঞসেনী, যুধিষ্ঠির দূতসভায় ভীমার্জুন-নকুল-সহদেবকে এবং নিজেকে পণ রেখে হেরে গেছেন। আপনাকেও তিনি পণ রেখেছিলেন, দুর্যোধন আপনাকে জয় করেছেন। আপনি আমার সঙ্গে আসুন। দ্রৌপদী বললেন, সূতপুত্র, তুমি দূতকার যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করে এস-তিনি আগে নিজেকে না আমাকে হেরেছিলেন?

প্রাতিকামী সভায় এসে দ্রৌপদীর প্রশ্ন জানালে যুধিষ্ঠির প্রাণহীনের ন্যায় বসে রইলেন, কিছুই উত্তর দিলেন না। দুর্যোধন বললেন, পাঞ্চালী নিজেই এখানে এসে প্রশ্ন করুন। প্রতিকামী আবার গেলে দ্রৌপদী বললেন, তুমি ধর্মাত্মা নীতিমান সদস্যগণকে জিজ্ঞাসা কর, ধর্মানুসারে আমার কর্তব্য কি। তারা যা বলবেন আমি তাই করব। প্রাতিকামী সভায় ফিরে এসে দ্রৌপদীর প্রশ্ন জানালে সকলে অধোমুখে নীরবে রইলেন। এই সময়ে যুধিষ্ঠির একজন বিশ্বস্ত দূতকে দিয়ে দ্রৌপদীকে বলে পাঠালেন, পাঞ্চালী, তুমি এখন রজস্বলা একবস্ত্রা, এই অবস্থাতেই কাঁদতে কাঁদতে সভায় এসে শ্বশুরের সম্মুখে দাঁড়াও।।

দুর্যোধন পুনর্বার প্রাতিকামীকে বললেন, দ্রৌপদীকে নিয়ে এস। প্রাতিকামী ভীত হয়ে বললে, তাকে কি বলব? দুর্যোধন বললেন, এই সূতপুত্র ভীমের ভয়ে উদবিগ্ন হয়েছে। দুঃশাসন, তুমি নিজে দ্রৌপদীকে ধরে নিয়ে এস। দুঃশাসন দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে বললেন, পাঞ্চালী, তুমি বিজিত হয়েছে, লজ্জা ত্যাগ করে দুর্যোধনের সঙ্গে দেখা কর, কৌরবগণকে ভজনা কর। দ্রৌপদী ব্যাকুল হয়ে রেগে ধৃতরাষ্ট্রের পত্নীদের কাছে চললেন, কিন্তু দুঃশাসন অর্জুন করে তার কেশ ধরলেন যে কেশ রাজসূয় যজ্ঞের মন্ত্রপুত জলে সিক্ত হয়েছিল। দুঃশাসনের আকর্ষণে নতদেহ হয়ে দ্রৌপদী বললেন, মন্দবুদ্ধি অনার্য, আমি একবস্ত্রা রজস্বলা, আমাকে সভায় নিয়ে যেয়ো না। দুঃশাসন বললেন, তুমি রজস্বলা একবস্ত্রা বা বিবস্ত্রা যাই হও, দূতে বিজিত হয়ে দাসী হয়েছে, আমাদের ভজনা কর।

বিক্ষিপ্তকেশে অর্ধস্থলিতবসনে দ্রৌপদী সভায় আনীত হলেন। লজ্জায় ও ক্রোধে দগ্ধ হয়ে তিনি ধীরে ধীরে বললেন, দুঃশাসন, ইন্দ্রাদি দেবগণও যদি তোমার সহায় হন তথাপি পাণ্ডবগণ তোমাকে ক্ষমা করবেন না। এই কুরুবীরগণের মধ্যে আমাকে টেনে আনা হল কিন্তু কেউ তার নিন্দা করছেন না ! ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর আর রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কি প্রাণ নেই? কুরুবৃদ্ধগণ এই দারুণ অধর্মাচার কি দেখতে পাচ্ছেন? ধিক, ভরতবংশের ধর্ম আর চরিত্র নষ্ট হয়েছে, এই সভায় কৌরবগণ কুলধর্মের মর্যাদালঙ্ঘন নীরবে দেখছেন। দ্রৌপদী করুণস্বরে এইরূপে বিলাপ করে বক্রনয়নে পতিদের দিকে তাকাচ্ছেন দেখে দুঃশাসন তাকে ধাক্কা দিয়ে সশব্দে হেসে বললেন, দাসী! কর্ণও হৃষ্ট হয়ে অট্টহাস্য করলেন, শকুনিও অনুমোদন করলেন।

সভাস্থ আর সকলেই অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। ভীষ্ম বললেন, ভাগ্যবতী, ধর্মের তত্ত্ব অতি সূক্ষ্ম, আমি তোমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিতে পারছি না। যুধিষ্ঠির সব ত্যাগ করলেও সত্য ত্যাগ করেন না, তিনিই বলেছেন—আমি বিজিত হয়েছি। দ্যূতক্রীড়ায় শকুনি অদ্বিতীয়, তার জন্যই যুধিষ্ঠিরের খেলবার ইচ্ছা হয়েছিল। শকুনি শঠতা অবলম্বন করেছেন যুধিষ্ঠির এমন মনে করেন না। দ্রৌপদী বললেন, যুধিষ্ঠিরের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধূর্ত দুষ্ট শঠ লোকে তাকে এই সভায় আহ্বান করেছে। তার খেলতে ইচ্ছা হয়েছিল কেন বলছেন? তিনি শুদ্ধস্বভাব, প্রথমে শঠতা বুঝতে পারেননি তাই পরাজিত হয়েছেন, পরে বুঝতে পেরেছেন। এই সভায় কুরুবংশীয়গণ রয়েছেন, এঁরা কন্যা ও পুত্রবধূদের অভিভাবক, সুবিচার করে বলুন আমাকে জয় করা হয়েছে কি না?

দ্রৌপদীর অপমান দেখে ভীম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, দূতকাররা তাদের বেশ্যাকেও কখনও পণ রাখে না, তাদের দয়া আছে। শত্রুরা শঠতার দ্বারা ধন রাজ্য এবং আমাদেরও হরণ করেছে, তাতেও আমার ক্রোধ হয়নি, কারণ আপনি এই সমস্তের প্রভু। কিন্তু পাণ্ডবভার্যা দ্রৌপদী এই অপমানের যোগ্য নন, হীন নৃশংস কৌরবগণ আপনার দোষেই তাকে ক্লেশ দিচ্ছে। আমি আপনার হস্ত দগ্ধ করব-সহদেব, অগ্নি আন।

অর্জুন ভীমকে শান্ত করলেন। দুর্যোধনের এক ভ্রাতা বিকর্ণ সভাস্থ সকলকে বললেন, পাঞ্চালী যা বললেন আপনারা তার উত্তর দিন, যদি সুবিচার না করেন তবে আমাদের সদ্য নরকগতি হবে। কুরুগণের মধ্যে বৃদ্ধতম ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্র, মহামতি বিদুর, আচার্য দ্রোণ ও কৃপ, এঁরা দ্রৌপদীর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না কেন? যে সকল রাজারা এখানে আছেন তারাও বলুন। বিকর্ণ এইরূপে বহুবার বললেও কেউ উত্তর দিলেন না। তখন হাতে হাত ঘষে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বিকর্ণ বললেন, আপনারা কিছু বলুন বা না বলুন, আমি যা ন্যায্য মনে করি তা বলছি। মৃগয়া মদ্যপান অক্ষক্রীড়া এবং অধিক স্ত্রীসংসর্গ—এই চারটি রাজাদের ব্যসন। ব্যাসনাসক্ত ব্যক্তি ধর্ম থেকে চ্যুত হয়, তার কৃত কর্মকে লোকে অকৃত বলে মনে করে। যুধিষ্ঠির ব্যসনাসক্ত হয়ে দ্রৌপদীকে পণ রেখেছিলেন। কিন্তু সকল পাণ্ডবই দ্রৌপদীর স্বামী, আর যুধিষ্ঠির নিজে বিজিত হবার পর দ্রৌপদীকে পণ রেখছিলেন, অতএব দ্রৌপদী বিজিত হননি।

সভায় মহা কোলাহল উঠল, অনেকে বিকর্ণের প্রশংসা আর শকুনির নিন্দা করতে লাগলেন। কর্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, এই সভার সদস্যগণ যে কিছু বলছেন না তার কারণ এঁরা দ্রৌপদীকে বিজিত বলেই মনে করেন। বিকর্ণ, তুমি বালক হয়ে স্থবিরের ন্যায় কথা বলছ। নির্বোধ, তুমি ধর্ম জান না। যুধিষ্ঠির সর্বস্ব পণ করেছিলেন দ্রৌপদী তার অন্তর্গত; তিনি স্পষ্টবাক্যে দ্রৌপদীকেও পণ রেখেছিলেন, পাণ্ডবগণ তাতে আপত্তি করেননি। আরও শোন—স্ত্রীদের এক পতিই বেদবিহিত, দ্রৌপদীর অনেক পতি, অতএব এ বেশ্যা! শকুনি সমস্ত ধন ও দ্রৌপদী সমেত পঞ্চপাণ্ডবকে জয় করেছেন। দুঃশাসন, তুমি পাণ্ডবদের আর দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ কর।

পাণ্ডবগণ নিজ নিজ উত্তরীয় বসন ফেলে দিলেন। দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্র ধরে সবলে টেনে নেবার উপক্রম করলেন। লজ্জা থেকে ত্রাণ পাবার জন্য দ্রৌপদী কৃষ্ণ বিষ্ণু হরিকে ডাকতে লাগলেন। তখন স্বয়ং ধর্ম বস্ত্রের রূপ ধরে তাকে আবৃত করলেন। দুঃশাসন আকর্ষণ করলে নানা বর্ণে রঞ্জিত এবং শুভ্র শত শত বসন আবির্ভূত হ’তে লাগল। সভায় তুমুল কোলাহল কোলাহল হল , আশ্চর্য ঘটনা দেখে সভ্যস্থ রাজারা দ্রৌপদীর প্রশংসা আর দুঃশাসনের নিন্দা করতে লাগলেন।

ক্রোধে হস্ত নিষ্পিষ্ট করে কম্পিত ওষ্ঠে ভীম উচ্চস্বরে বললেন, ক্ষত্রিয়গণ, শোন, যদি আমি যুদ্ধক্ষেত্রে এই পাপী দুর্বুদ্ধি ভরতকুলকলঙ্ক দুঃশাসনের বক্ষ বিদীর্ণ করে রক্তপান না করি, তবে যেন পিতৃপুরুষগণের গতি না পাই। ভীমের এই লোমহর্ষকর শপথ শুনে রাজারা তার প্রশংসা এবং দুঃশাসনের নিন্দা করতে লাগলেন। সভায় দ্রৌপদীর বস্ত্র রাশীকৃত হল , দুঃশাসন শ্রান্ত ও লজ্জিত হয়ে বসে পড়লেন। বিদুর বললেন, সদস্যগণ, আপনারা রোরুদ্যমানা দ্রৌপদীর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না। তাতে ধর্মের হানি হচ্ছে। বিকর্ণ নিজের বুদ্ধি অনুসারে উত্তর দিয়েছে, আপনারাও দিন। সভাস্থ রাজারা উত্তর দিলেন না। কর্ণ দুঃশাসনকে বললেন, এই কৃষ্ণা দাসীকে গৃহে নিয়ে যাও।

দ্রৌপদী বিলাপ করতে লাগলেন। ভীষ্ম বললেন, কল্যাণী, আমি তোমাকে বলেছি যে ধর্মের গতি অতি দুর্বোধ্য সেজন্য আমি উত্তর দিতে পারছি না। কৌরবগণ লোভমোহপরায়ণ হয়েছে, শীঘ্রই এদের বিনাশ হবে। পাঞ্চালী, যুধিষ্ঠিরই বলুন তুমি অজিতা না জিতা। দুর্যোধন সহাস্যে বললেন, ভীম অর্জুন প্রভৃতি বলুন যে যুধিষ্ঠির তোমার স্বামী নন, তিনি মিথ্যাবাদী, তা হলে তুমি দাসীত্ব থেকে মুক্ত হবে। অথবা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির স্বয়ং বলুন তিনি তোমার স্বামী কি অস্বামী। ভীম তাঁর চন্দনচর্চিত বিশাল বাহু তুলে বললেন, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যদি আমাদের গুরু না হ’তেন তবে কখনই ক্ষমা করতাম না। উনি যদি আমাকে নিষ্কৃতি দেন তবে চপেটাঘাতে এই পাপী ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণকে নিষ্পিষ্ট করতে পারি।

অচেতনের ন্যায় নীরব যুধিষ্ঠিরকে দুর্যোধন বললেন, ভীমার্জুন প্রভৃতি আপনার আজ্ঞাধীন, আপনিই দ্রৌপদীর প্রশ্নের উত্তর দিন। এই বলে দুর্যোধন কর্ণের দিকে চেয়ে একটু হেসে বসন সরিয়ে কদলীকাণ্ডতুল্য তার বাম উরু দ্রৌপদীকে দেখালেন। বৃকোদর ভীম বিস্ফারিতনয়নে বললেন, মহাযুদ্ধে তোমার ওই উরু যদি গদাঘাতে না ভাঙি তবে যেন আমার পিতৃলোকে গতি না হয়।

বিদুর বললেন, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ, এই ভীমসেন থেকে তোমাদের মহাবিপদ হবে তা জেনে রাখ! তোমরা দূতের নিয়ম লঙ্ঘন করেছ, সভায় স্ত্রীলোক এনে বিবাদ করছ। ধর্ম নষ্ট হলে সভা দুষিত হয়। যুধিষ্ঠির নিজে বিজিত হবার পূর্বে দ্রৌপদীকে পণ রাখতে পারতেন, কিন্তু প্রভুত্ব হারাবার পর তা পারেন না।

ধৃতরাষ্ট্রের অগ্নিহোত্রগৃহে একটা শৃগাল চিৎকার করে উঠল, গর্দভ ও পক্ষীরাও ভয়ংকর রবে ডাকতে লাগল। অশুভ শব্দ শুনে বিদুর গান্ধারী ভীষ্ম দ্রোণ ও কৃপ ‘স্বস্তি স্বস্তি’ বললেন এবং ধৃতরাষ্ট্রকে জানালেন। তখন ধৃতরাষ্ট্র বললেন, মূর্খ দুর্যোধন, এই কৌরবসভায় তুমি পাণ্ডবগণের ধর্মপত্নীর সঙ্গে কথা বলেছ! তুমি মরেছ। তার পর তিনি দ্রৌপদীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, পাঞ্চালী, তুমি আমার বন্ধুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা এবং ধর্মশীলা সতী, আমার কাছে অভীষ্ট বর চাও।

দ্রৌপদী বললেন, ভরতর্ষভ, এই বর দিন যেন সর্বধর্মচারী যুধিষ্ঠির দাসত্ব থেকে মুক্ত হন, আমার পুত্র প্রতিবিন্ধ্যকে কেউ যেন দাসপুত্র বলে না ডাকে। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, কল্যাণী, যা বললে তাই হবে। তুমি দ্বিতীয় বর চাও, আমার মন বলছে একটিমাত্র বর তোমার যোগ্য নয়। দ্রৌপদী বললেন, মহারাজ, ভীমসেন ধনঞ্জয় আর নকুল-সহদেব দাসত্ব থেকে মুক্ত ও স্বাধীন হন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, পুত্রী, তাই হবে। দুটি বরও তোমার পক্ষে যথেষ্ট নয়, তৃতীয় বর চাও। দ্রৌপদী বললেন মহারাজ, লোভে ধর্মনাশ হয়, আমি আর বর চাই না। এই বিধান আছে যে বৈশ্য এক বর, ক্ষত্রিয়াশী দুই বর, রাজা তিন বর এবং ব্রাহ্মণ শত বর নিতে পারেন। আমার স্বামীরা দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে পুণ্যকর্মের বলেই শ্ৰেয়োলাভ করবেন।

কর্ণ বললেন, দ্রৌপদী যা করলেন কোনও নারী তা পূর্বে করেছেন এমন শুনি নি, দুঃখসাগরে নিমগ্ন পাণ্ডবগণকে ইনি নৌকার ন্যায় পার করেছেন। এই কথা শুনে ভীম দুঃখিত হয়ে বললেন, মহর্ষি দেবলের মতে পুরুষের তেজ তিনটি—অপত্য, কর্ম ও বিদ্যা। পত্নীর অপমানে আমাদের সন্তান দূষিত হল। অর্জুন বললেন, হীন লোকে কি বলে না বলে তা নিয়ে সজ্জনরা জল্পনা করেন না, তারা নিজ ক্ষমতায় নির্ভর করেন। ভীম যুধিষ্ঠিরকে বললেন বিতর্কে প্রয়োজন কি, মহারাজ, আমি আজই সমস্ত শত্রুকে বিনাশ করব, তার পর আপনি পৃথিবী শাসন করবেন।

যুধিষ্ঠির ভীমকে নিবৃত্ত করে বসিয়ে দিলেন এবং ধৃতরাষ্ট্রের কাছে গিয়ে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, মহারাজ, আমরা সর্বদাই আপনার অধীন, আদেশ করুন এখন কি করব। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, অজাতশত্ৰু, তোমার মঙ্গল হ’ক। সমস্ত ধন সমেত তোমরা নির্বিঘ্নে ফিরে যাও, নিজ রাজ্য শাসন কর। আমি বৃদ্ধ, তোমাদের হিতকর আদেশই দিচ্ছি। তুমি ধর্মের সূক্ষ্ম গতি জান, তুমি বিনীত, বৃদ্ধদের সেবক। যাঁরা উত্তম পুরুষ তারা কারও শত্রুতা করেন না, পরের দোষ না দেখে গুণই দেখেন। এই সভায় তুমি সাধুজনোচিত আচরণ করেছ। বৎস, দুর্যোধনের নিষ্ঠুরতা মনে রেখো না। আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী বৃদ্ধ অন্ধ পিতা, আমাকে আর তোমার মাতা গান্ধারীকে দেখো। তোমাদের দেখবার জন্য এবং এই দুই পক্ষের বলাবল জানবার জন্য আমি দূতসভায় মত দিয়েছিলাম। তোমার ন্যায় শাসনকর্তা এবং বিদুরের ন্যায় মন্ত্রী থাকতে কুরুবংশীয়গণের কোনও ভয় নেই। এখন তুমি ইন্দ্রপ্রস্থে যাও, ভ্রাতাদের সঙ্গে তোমার সম্প্রীতি এবং ধর্মে মতি থাকুক।

।। অনুতপর্বাধ্যায়।।

১৭। পূনর্বার দ্যূতক্রীড়া

পাণ্ডবগণ চ’লে গেলে দুঃশাসন বললেন, আমরা অতি কষ্টে যা হস্তগত করেছিলাম বৃদ্ধ তা নষ্ট করলেন। তার পর কর্ণ আর শকুনির সঙ্গে মন্ত্রণা করে দুর্যোধন তার পিতার কাছে গিয়ে বললেন, মহারাজ, বৃহস্পতি বলেছেন, যে শত্রুরা যুদ্ধে বা যুদ্ধ না করেই অনিষ্ট করে তাদের সকল উপায়ে বিনষ্ট করবে। দংশনে উদ্যত সর্পকে কণ্ঠে ও পৃষ্ঠে ধারণ করে কে পরিত্যাগ করে ? পিতা, ক্রুদ্ধ পাণ্ডবরা আমাদের নিঃশেষ করবে, আমরা তাদের নিগৃহীত করেছি, তারা ক্ষমা করবে না। আমরা আবার তাদের সঙ্গে খেলতে চাই। এবারে দ্যূতক্রীড়ায় এই পণ হবে—পরাজিত পক্ষ মৃগচর্ম ধারণ করে বার বৎসর মহারণ্যে বাস এবং তার পর এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করবে। আমরা দূত জয়ী হয়ে বার বৎসরে রাজ্যে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হব, মিত্র ও সৈন্য সংগ্রহ করব, তের বৎসর পরে পাণ্ডবরা ফিরে এলে আমরা তাদের পরাজিত করব। ধৃতরাষ্ট্র সম্মত হয়ে বললেন, পাণ্ডবদের শীঘ্র ফিরিয়ে আন।

জ্ঞানবতী গান্ধারী তার পতিকে বললেন, দুর্যোধন জন্মগ্রহণ করলে বিদুর সেই কুলাঙ্গারকে পরলোকে পাঠাতে বলেছিলেন। মহারাজ, তুমি নিজের দোষে দুঃখসাগরে মগ্ন হয়ো না, নির্বোধ অশিষ্ট পুত্রদের কথা শুনো না! পাণ্ডবরা শান্ত হয়েছে, আবার কেন তাদের ক্রুদ্ধ করছ? তুমি স্নেহবশে দুর্যোধনকে ত্যাগ করতে পারনি, এখন তার ফলে বংশনাশ হবে। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, আমাদের বংশ নষ্টই হবে, আমি তা নিবারণ করতে পারছি না। আমার পুত্রেরা যা ইচ্ছা হয় করুক।

দুর্যোধনের দূত প্রাতিকামী যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়ে জানালে যে ধৃতরাষ্ট্র আবার তাকে ন্যূতক্রীড়ায় আহ্বান করেছেন। যুধিষ্ঠির বললেন, বিধাতার নিয়োগ অনুসারেই জীবের শুভাশুভ ঘটে। বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র যখন ডেকেছেন তখন বিপদ হবে জেনেও আমাকে যেতে হবে। রাম জানতেন যে স্বর্ণময় জন্তু অসম্ভব, তথাপি তিনি স্বর্ণমৃগ দেখে লুব্ধ হয়েছিলেন। বিপদ আসন্ন হলে লোকের বুদ্ধির বিপর্যয় হয়।

যুধিষ্ঠির দূতসভায় উপস্থিত হলে শকুনি বললেন, বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র তোমাদের ধন ফিরিয়ে দিয়ে মহৎ কার্য করেছেন। এখন যে পণ রেখে আমরা খেলব তা শোন।-আমরা যদি হারি তবে মৃগচর্ম পরিধান করে দ্বাদশ বর্ষ মহারণ্যে বাস করব, তার পর এক বৎসর স্বজনবর্গের অজ্ঞাত হয়ে থাকব। যদি অজ্ঞাতবাসকালে কেউ আমাদের সন্ধান পায় তবে আবার দ্বাদশ বর্ষ বনবাস করব। যদি তোমরা হেরে যাও তবে তোমরাও এই নিয়মে বনবাস ও অজ্ঞাতবাস করবে, এবং ত্রয়োদশ বৎসরের শেষে স্বরাজ্য পাবে। এখন খেলবে এস।

সভাস্থ সকলে উদবিগ্ন হয়ে হাত তুলে বললেন, আত্মীয়দের ধিক, তারা পাণ্ডবদের সাবধান করে দিচ্ছেন না, পাণ্ডবরাও তাদের বিপদ বুঝছেন না। যুধিষ্ঠির বললেন, আমি স্বধর্মনিষ্ঠ, দ্যূতক্রীড়ায় আহূত হলে নিবৃত্ত হই না। শকুনি, আমি আপনার সঙ্গে খেলব। শকুনি তার পাশা ফেলে বললেন, জিতেছি।

পরাজিত পাণ্ডবগণ মৃগচর্মের উত্তরীয় ধারণ করে বনবাসের জন্য প্রস্তুত হলেন। দুঃশাসন বললেন, এখন দুর্যোধন রাজচক্রবর্তী হলেন, পাণ্ডবগণ সুদীর্ঘকালের জন্য নরকে পতিত হল। ক্লীব পাণ্ডবদের কন্যাদান করে দ্রুপদ ভাল করেন নি। দ্রৌপদী, এই পতিত স্বামীদের সেবা করে তোমার আর লাভ কি? ভীম বললেন, নিষ্ঠুর, তুমি এখন বাক্যবাণে আমাদের মর্মভেদ করছ, এই কথা যুদ্ধক্ষেত্রে তোমার মর্মস্থান ছিন্ন করে মনে করিয়ে দেব। নির্লজ্জ দুঃশাসন ‘গরু, গরু’ বলে ভীমের চারিদিকে নাচতে লাগলেন।

পাণ্ডবগণ সভা থেকে নির্গত হলেন। দুর্বুদ্ধি দুর্যোধন হর্ষে অধীর হয়ে ভীমের সিংহগতির অনুকরণ করতে লাগলেন। ভীম পিছন ফিরে বললেন, মূঢ় দুর্যোধন, দুঃশাসনের বিদীর্ণ বক্ষের শোণিত পান করলেই আমার কর্তব্য শেষ হবে না, তোমাকে সদলে নিহত করে প্রতিশোধ নেব। আমি গদাঘাতে তোমাকে মারব, পদাঘাতে তোমার মস্তক ভূলুণ্ঠিত করব। অর্জুন কর্ণকে আর সহদেব ধূর্ত শকুনিকে মারবেন, আর এই বাক্যবীর দুরাত্মা দুঃশাসনের রক্ত আমি সিংহের ন্যায় পান করব।

অর্জুন বললেন, কেবল বাক্য দ্বারা সংকল্প ব্যক্ত করা যায় না, চতুর্দশ বৎসরে যা হবে তা সকলেই দেখতে পাবেন। ভীমসেন, আপনার প্রিয়কামনায় আমি প্রতিজ্ঞা করছি—এই ঈর্ষাকারী কটুভাষী অহংকৃত কর্ণকে আমি যুদ্ধে শরাঘাতে বধ করব। যদি এই সত্য পালন করতে না পারি তবে হিমালয় বিচলিত হবে, দিবাকর নিষ্প্রভ হবে, চন্দ্রের শৈত্য নষ্ট হবে। সহদেব বললেন, গান্ধার-কুলাঙ্গার শকুনি, তোমার সম্বন্ধে ভীম যা বলেছেন তা আমি করব। নকুল বললেন, দুর্যোধনকে তুষ্ট করবার জন্য যারা এই সভায় দ্রৌপদীকে কটুকথা শুনিয়েছে সেই দুবৃত্তদের আমি যমালয়ে পাঠাব, ধর্মরাজ আর দ্রৌপদীর নির্দেশ অনুসারে আমি পৃথিবী থেকে ধার্তরাষ্ট্রগণকে লুপ্ত করব।

১৮। পাণ্ডবগণের বনযাত্রা

বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র, তাঁর পুত্রগণ, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, সোমদত্ত, 
বিদুর, যুযুৎসু, সঞ্জয় প্রভৃতিকে সম্বোধন করে যুধিষ্ঠির বললেন, আমি বনগমনের অনুমতি চাচ্ছি, ফিরে এসে আবার আপনাদের দর্শনলাভ করব। সভাসদ্গণ লজ্জায় কিছু বলতে পারলেন না, কেবল মনে মনে যুধিষ্ঠিরের কল্যাণ কামনা করলেন। বিদুর বললেন, আর্যা কুন্তী বৃদ্ধা এবং সুখভোগে অভ্যস্তা, তিনি সসম্মানে আমার গৃহেই বাস করবেন। পাণ্ডবগণ, তোমাদের সর্ববিষয়ে মঙ্গল হ’ক। যুধিষ্ঠিরাদি বললেন, নিস্পাপ পিতৃব্য, আপনি আমাদের পিতার সমান, যা আজ্ঞা করবেন তাই পালন করব।

বিদুর বললেন, যুধিষ্ঠির, অধর্ম দ্বারা বিজিত হলে পরাজয়ের দুঃখ হয় না। তুমি ধর্মজ্ঞ, অর্জুন যুদ্ধজ্ঞ, ভীম শক্ৰহন্তা, নকুল অর্থসংগ্রহী, সহদেব নিয়মপালক, ধৌম্য শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিৎ, দ্রৌপদী ধর্মচারিণী। তোমরা পরস্পরের প্রিয়, প্রিয়ভাষী, তোমাদের মধ্যে কেউ ভেদ জন্মাতে পারবে না। আপদকালে এবং সর্ব কার্যে তোমরা বিবেচনা করে চলো। তোমাদের মঙ্গল হ’ক, নির্বিঘ্নে ফিরে এস, আবার তোমাদের দেখব।

কুন্তী ও অন্যান্য নারীদের কাছে গিয়ে দ্রৌপদী বিদায় চাইলেন। অন্তঃপুরে ক্রন্দনধ্বনি উঠল। কুন্তী শোকাকুল হয়ে বললেন, বৎসে, তুমি সর্ব-গুণান্বিতা, আমার কোনও উপদেশ দেওয়া অনাবশ্যক। কৌরবগণ ভাগ্যবান তাই তারা তোমার কোপে দগ্ধ হয় নি। তুমি নির্বিঘ্নে যাত্রা কর, আমি সর্বদাই তোমার শুভচিন্তা করব। আমার পুত্র সহদেবকে দেখো, যেন সে এই বিপদে অবসন্ন না হয়।

দ্রৌপদী আলুলায়িত কেশে রক্তাক্ত একবস্ত্রে সরোদনে যাত্রা করলেন। নিরাভরণ পুত্রগণকে আলিঙ্গন করে কুন্তী বললেন, তোমরা ধার্মিক সচ্চরিত্র উদারপ্রকৃতি ভগবদ্ভক্ত ও যজ্ঞপরায়ণ, তোমাদের ভাগ্যে এই বিপর্যয় কেন হল? তোমাদের পিতা ধন্য, এই বিপদ তাকে দেখতে হল না, স্বর্গগতা মাদ্রীও ভাগ্যবতী। আমি তোমাদের ছেড়ে থাকতে পারব না, সঙ্গে যাব। হা কৃষ্ণ দ্বারকাবাসী, কোথায় আছ, আমাদের দুঃখ থেকে ত্রাণ করছ না কেন?

পাণ্ডবগণ কুন্তীকে সান্ত্বনা দিয়ে যাত্রা করলেন। দুর্যোধনাদির পত্নীরা দ্রৌপদীর অপমানের বিবরণ শুনে কৌরবগণের নিন্দা করে উচ্চকণ্ঠে রোদন করতে লাগলেন। পুত্রদের অন্যায়ের কথা ভেবে ধৃতরাষ্ট্র উদবেগ ও অশান্তি ভোগ করছিলেন। তিনি বিদুরকে ডাকিয়ে বললেন, পাণ্ডবগণ কিভাবে যাচ্ছেন তা আমি জানতে চাই, তুমি বর্ণনা কর। | বিদুর বললেন, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বস্ত্রে মুখ আবৃত করে চ’লেছেন। মহারাজ, আপনার পুত্রেরা কপট উপায়ে রাজ্য হরণ করলেও যুধিষ্ঠিরের ধর্মবুদ্ধি বিচলিত হয়নি। তিনি দয়ালু, তাই ক্রুদ্ধ হয়েও চক্ষু উন্মীলন করছেন না, পাছে আপনার পুত্রগণ দগ্ধ হয়। শত্রুদের উপর বাহুবল প্রয়োগ করবেন তা জানাবার জন্য ভীম তার বাহুদ্বয় প্রসারিত করে চ’লেছেন। বাণবর্ষণের পূর্বাভাষরূপে অর্জুন বালুকা বর্ষণ করতে করতে যাচ্ছেন। সহদেব মুখ ঢেকে এবং নকুল সর্বাঙ্গে ধূলি মেখে বিহ্বলচিত্তে চ’লেছেন। দ্রৌপদী তার কেশজালে মুখ আচ্ছাদিত করে সরোদনে অনুগমন করছেন। পুরোহিত ধৌম্য হাতে কুশ নিয়ে যমদেবতার সাম মন্ত্র গান করে পুরোভাগে চ’লেছেন। পুরবাসিগণ বিলাপ করছে-হায়, আমাদের রক্ষকগণ চ’লে যাচ্ছেন! মহারাজ, পাণ্ডবগণের যাত্রাকালে বিনা মেঘে বিদ্যুৎ, ভূমিকল্প, অকালে সূর্যগ্রহণ প্রভৃতি দুর্লক্ষণ দেখা দিয়েছে।

দেবর্ষি নারদ সভামধ্যে বললেন, দুর্যোধনের অপরাধে এবং ভীমার্জুনের বলে এখন থেকে চতুর্দশ বর্ষে.কৌরবগণ বিনষ্ট হবে। এই বলে তিনি অন্তর্হিত হলেন। বিপৎসাগরে দ্রোণাচার্যই দ্বীপস্বরূপ এই মনে করে দুর্যোধন কর্ণ ও শকুনি তাকেই রাজ্য নিবেদন করলেন। দ্রোণ বললেন, তোমরা আমার শরণাগত তাই তোমাদের ত্যাগ করতে পারব না। পাণ্ডবরা ফিরে এসে তোমাদের উপর প্রতিশোধ নেবে। বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুনের সঙ্গে আমার যুদ্ধ করতে হবে এর চেয়ে অধিক দুঃখ আর কি হ’তে পারে। যে ধৃষ্টদ্যুম্ন আমার মৃত্যুর কারণ বলে প্রসিদ্ধি আছে, সে পাণ্ডবপক্ষেই থাকবে। দুর্যোধন, তোমার সুখ হেমন্তকালে তালচ্ছায়ার ন্যায় ক্ষণস্থায়ী; অতএব যজ্ঞ দান আর ভাগ করে নাও, এখন থেকে চতুর্দশ বৎসরে তোমাদের মহাবিনাশ হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *