০২. সকাল বেলা উঠেই আজ গোসল

সকাল বেলা উঠেই আজ গোসল করে নিয়েছে আনু। আজ তাকে স্কুলে ভর্তি করে দেবেন বাবা! বাবা ভোরে উঠেই থানায় গেছেন, মফস্বল থেকে নাকি খুনের আসামি ধরে এনেছে সেপাইরা, সেই কাজে। বলে গেছেন, দশটার সময় এসে আনুকে নিয়ে যাবেন, সে যেন তৈরি থাকে।

আনুর খুব খুশি লাগছে। এখানে এসে অবধি একটা বন্ধুও তার হয়নি। ছোট দারোগার কোনো ছেলেপুলে নেই; আর জমাদার সাহেব তার বৌ ছেলেমেয়েকে আগেই দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। বড় একা দিন কাটছিল আনুর—-পড়ার জন্যে যতটা নয়, তারচেয়ে বেশি বন্ধু পাবার লোভে স্কুলে যাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে সে।

ভোরে গোসল করে উঠেই মাকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে ভাতের জন্যে।

মা, শীগগীর ভাত দাও। দশটা বেজে গেছে।

কোথায় তোর দশটা?

মা বিরক্ত হয়ে ডালের পাতিলে ঘুটনি ঘোরাতে ঘোরাতে বলেন।

হ্যাঁ, তুমি জানো? কত দেরি হয়ে গেল!

আনু অভিমান করে রান্নাঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। বড় আপা তরকারি কুটছিলেন। তিনি মুখ তুলে বলেন, এখন তো মোটে সাড়ে আটটা রে! ইস্কুলে যাবার এত সখ!

বলে হাসেন আর ঘ্যাসঘ্যাস করে তরকারি কোটেন। আনু যে কেন অস্থির হয়েছে স্কুলে। যাবার জন্যে, সেইটে কাউকে বলা যাবে না। সেইটে লুকোবার জন্যে খুব মেজাজ করে আনু। বলে, তোমার মতো নাকি। খালি বাড়িতে বসে থাকব? লেখাপড়া করতে হবে না? এবার হেসে ফেলেন মা। মেয়েকে বলেন, আনুর আজকাল খুব মন হয়েছে লেখাপড়ায়।

হবে না? বড় আপা আবার হাসেন। জানো মা, আনু আমাকে বলেছে ও নাকি রেলের গার্ড হবে। তাই বোধ হয় এত ধুম পড়ার।

বলেছে তোমাকে। না মা মিথ্যে কথা! আমি বলিনি।

বলেই দৌড়ে পালিয়ে যায় আনু। রাগ হয় তার বড় আপার ওপর। কী যে, সব কথা মাকে। বলতে হয় নাকি? এই জন্যে সে রাতে চুপচুপ করে তাকে বলেছে? আর স্কুলে যাবার জন্যে যদি তাড়া করেই থাকে, তাতে এত হাসবার কী আছে?

এইজন্যে একেক সময় দেখতে ইচ্ছে করে না বড় আপাকে। বেশ, আমি গার্ড হবো তাতে ওর কি? গার্ডের চাকরি সবাইক দেয় বুঝি রেলের লোক? গার্ড হতে হলে কত বুদ্ধি, আর লেখাপড়া লাগে তার কী জানে বড় আপা?

সত্যি, মন্দ হয় না গার্ড হলে। কত দেশ যারা যেতআর কী সুন্দর চাকরি। বাবার মতো থানায় গিয়ে চোর–ডাকাতকে হাতকড়া লাগানো নয়, সাইকেল নিয়ে মফস্বলে যাওয়া নয়, ও–রকম বিশ্রী ঘরে কাগজপত্রে উপুড় হয়ে পড়ে লেখা নয়! গার্ডের চাকরি কত মজার! হাতে লাল আর সবুজ নিশান, মুখে বাঁশি, সাদা ধবধবে প্যান্ট, কোট, পেতলের বোতাম লাগানো, পকেটে ঢাকনা, মাথায় চকচকে বারান্দাওয়ালা টুপি। ফুরুর করে বাঁশিতে ফুঁ না। দিলে ড্রাইভারের কোন ক্ষমতাই নেই গাড়ি চালায় তার কাছে ইঞ্জিন থাকলে কী হবে? সারাদিন তাকে ইস্টিশানে ঠায় বসিয়ে রাখতে পারে গার্ড। আবার চলতে চলতে যদি লাল নিশান দেখায় তো থামাতে হবে গাড়ি। গার্ডের চাকরি কী সোজা! বড় আপা খালি হাসতেই পারে। গার্ড হয়ে তাক লাগিয়ে দেবে যেদিন আনু, সেদিন বুঝতে পারবে। বড় আপা, মেজ। আপা, সালু আপা, মিনু আপা, ছোটআপা, মা, বাবা, পানু ভাই সবার সামনে আনু গম্ভীর হয়ে বাঁশি বাজিয়ে নিশান দেখিয়ে চলন্ত গাড়িতে লাফিয়ে উঠবে। ওরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। আনু তাদের দেখবেই না। আনুর কত কাজ। আনু তখন শেষবারের মতো নিশানটা দুলিয়ে ভেতরে গিয়ে খাতা খুলে বসবে। আনু দেখেছে গার্ডেরা খাতা খুলে লেখে গাড়ির মধ্যে। হঠাৎ মন খারাপ হয়ে যায় আনুর। তার বড় হতে এখনো কত দেরি। গার্ড হতে তার দশ বিশ বছর লেগে যাবে। ততদিন তো আর কিছু করার উপায় নেই। ততদিন চুপ করেই থাকতে হবে আর সহ্য করতে হবে ওদের ঠাট্টা, হাসি।

পানু ভাই যদি গার্ড হতো, তাহলেও বেশ হতো। তাহলে আনু পানু ভাইর সঙ্গেই ঘুরে বেড়াতে পারতো। গার্ড না হোক, অন্তত গার্ডের ভাই বলে বাহাদুরি নিতে পারতো। আনু শুনেছে পানু ভাই নাকি আর লেখাপড়া করবে না, চাকুরি খুঁজছে। এবার আনু ঢাকায় পানু ভাইকে চিঠি লিখে দেবে—-ভাইয়া, তুমি গার্ডের চাকরি নিও।

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে আনু রাস্তায় দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে থেকে মানুষ দেখে। দেখে, গরুর গাড়ি কাঁচোর কাঁচোর করতে করতে বাজারের দিকে চলেছে। আবার উল্টো দিকে ট্রেন ধরবার জন্যে উলিপুরের বাসটা বুর বুর করে ছুটে চলেছে স্টেশনের দিকে। তাহলে তো এখন নটা বাজে! নটার সময় রোজ উলিপুরের বাসটা তাদের বাসার সামনে দিয়ে যায়।

তাড়াতাড়ি বাসার ভেতরে আসে আনু। কিন্তু আর রান্নাঘরে গিয়ে মাকে তাগাদা করতে সাহস হয় না। কেমন লজ্জাও করে। অথচ তার ইচ্ছা করছে এখুনি সে ছুটে ইস্কুলে গিয়ে বসে।

নিজের ছোট্ট সুটকেশটা খুলে ধোয়া প্যান্ট আর নতুন জামাটা বার করে আনু। জামাটা গেল হপ্তায় কিনে দিয়েছিলেন বাবা। নীল সরু ডোরা কাটা, টেনিস কফ শার্ট। কলারে এখনো কাগজের লেবেল সুতো দিয়ে আটকানো। লেবেলটা ছিঁড়ে ফেলে আনু গায়ে দিল শার্টটা। কাপড়ের নতুন গন্ধ ভুরভুর করে বেরুচ্ছে। ভারী মিষ্টি লাগছে। আর ইস্ত্রী করায় এত মসৃণ। লাগছে যে হাতের তেলো পিছলে যায়। প্যান্টটা খুলে দেখে একটা বোম ভাঙা। পাশের ঘরে সালু আপা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। রুমালের ফুল আঁকছিল। তাকে গিয়ে ধরলো আনু।

দেনা আপা বোতামটা লাগিয়ে।

যা, পারবো না।

সালু আপা তার দিকে না তাকিয়েই ধমক দিয়ে ওঠে। আনু আবার অনুনয় করে, একটা মোটে। দিবি না?

যা, ভাগ, গোলমাল করিস না।

বারে, আজ আমি ইস্কুলে যাবো, তুই জানিস না?

তবু সালু আপা শোনে না। গুন গুন করে আপন মনে সে পেন্সিল দিয়ে রুমালে ফুলের নকশা আঁকতে থাকে। আনু হঠাৎ তার হাত থেকে কাপড়টা টেনে ছুঁড়ে দেয় উঠোনে। বলে, দিবি না তো, দিবি না।

তার ডুকরে ওঠা কান্না শুনে বড় আপা ছুটে আসেন।

কিরে, কি হয়েছে?

সালু আপা আরো জোরে কেঁদে উঠলো তখন। যা মুখে এলো তাই মিথ্যে করে বলল, আনু আমার রুমাল ছিঁড়ে ফেলেছে, আমাকে মেরেছে।

আনু অবাক হয়ে গেল মিথ্যেটা শুনে। প্রতিবাদ করবার মতো বুদ্ধিও তার মাথায় জোগাল না। সে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলো বোতাম-ভাঙা প্যান্টটা হাতে নিয়ে। বড় আপা একবার তাকে দেখলেন, একবার সালুকে দেখলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ছিঃ সালু, আনু আজ ইস্কুলে যাবে। এখন কাঁদাকাটি করতে নেই।

আনু তখন সাহস পেয়ে বলল, আমার বোতামটা লাগিয়ে দিতে বলেছি

দে আমাকে, আমি দিচ্ছি।

বড় আপা আলমারি থেকে কৌটো বার করে তক্ষুণি সূঁচে সুতো পরাতে লাগলেন। লাগিয়ে দিলেন নতুন একটা বোতাম। বোতাম লাগানো শেষ হলে দাঁত দিয়ে সুতো কাটতে কাটতে বললেন, যা আনু, ভাত খেয়ে নে। ভাত হয়ে গেছে।

মা আজ ফেনা-ফেনা ভাত রেঁধেছেন। আনুর জন্যে বার করেছেন ফুল তোলা কাঁচের প্লেট। আনুর আজ খাতির আলাদা। আজ সে স্কুলে যাবে ভর্তি হতে। প্লেটে ভাত বেড়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে ভাতের মিষ্টি গন্ধে আর ধোঁয়ায় ভরে গেল আনুর মুখ। বড় আপা চামচে করে ঘি এনে ছড়িয়ে দিলেন ভাতের ওপর। মা শিল–আলুর ভর্তা করেছেন, এক দলা পাতে দিলেন তার। গরমে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। মা এক হাতে আঁচল দিয়ে বাতাস করতে লাগলেন। আনু ফুঁ দিয়ে দিয়ে মাখাতে লাগল। ভাতের সঙ্গে আলু। এক গ্রাস মুখে তুলল। মধুর মতো লাগল।

বড় আপা বললেন, আস্তে খা আনু, এখনো দেরি আছে। পেট ভরে খাবি।

দূর।

আনু আস্তে বলে। খেতে বসে দেখে তার বিশেষ খিদে নেই। আর গলার কাছে কেমন সব আটকে যাচ্ছে।

পেট ভরে না খেলে দেখবি হেড মাস্টারের সামনে গিয়ে সব হজম হয়ে গেছে ভয়ে।

যাঃ। আমার ভয় করে না।

পড়া ধরবে যে। পারবি?

ধরুক না। যা ইচ্ছা ধরুক, আমি সব উত্তর দিয়ে দেব।

মা খুশি হয়ে একবার আনুর দিকে একবার মেয়ের দিকে তাকান। বলেন, না। আনু পড়ায় কত ভালো।

বড় আপা পাবদা মাছের ঝোল বেড়ে দিলেন কাঁসার বাটিতে। নিজের হাতে তুলে দিলেন আনুর পাতে। কুচি কুচি করে কাটা পেঁয়াজ দিয়ে রাধা! সোনার মতো হলুদ রং হয়েছে। ঝাল ঝাল গন্ধ বেরুচ্ছে। জিভে পানি এসে যাচ্ছে। আনু ঢকঢক করে এক গ্লাশ পানি খেল।

এমন সময় বাইরে বাবার গলা শোনা গেল।

আনু, ও আনু।

বড় আপা তাড়াতাড়ি বাইরে গিয়ে বললেন, খেতে বসেছে বাবা।

তাড়াতাড়ি করতে বল। ওকে ইস্কুলে দিয়ে আমি আবার মফস্বলে যাবো।

বাবার গলা শুনে আনুর যেন আর এক মুঠো ভাতও গলা দিয়ে নামতে চায় না। বুকটা ধুকধুক করে ওঠে। কি এক অজানা আশঙ্কায় অস্থির লাগে। মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। মা প্রায় চিৎকার করে ওঠেন–কি, তোর খাওয়া হয়ে গেল?

আর খাবো না।

বলতে বলতে হাত ধুয়ে উঠে পড়ে অনু। উঠোনে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন, সাইকেলটা বের করে নিয়েছেন।

আনু এক দৌড়ে ঘরের ভেতর গিয়ে মুখ মোছে, খাতা আর ইংরেজি বাংলা বই নেয়, চট করে একবার আয়নায় মুখ দেখে, তারপর বেরিয়ে আসে। বাবা বলেন, বাহ, জামাটা আনুর গায়ে খুব মানিয়েছে তো? ভাত খেয়েছিস?

হ্যাঁ

মাকে সালাম করলি না?

আনুর লজ্জা লাগে তখন। ধুৎ সে পারবে না। স্কুলে ভর্তি হতে গেলেই বুঝি মাকে সালাম করতে হবে! মহাসংকটে পড়ে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। আওয়াজ শুনে মিনু আপাও এসে দাঁড়িয়েছেন বারান্দায়, সে খিলখিল করে হেসে ওঠে।

লজ্জা থেকে মা আনুকে বাঁচিয়ে দেন। ঘোমটা টেনে কাছে এসে আনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ভালো করে লেখাপড়া করিস। কারো সঙ্গে মারামারি করবি না, কেমন?

আনু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বাবার পেছনে বেরিয়ে আসে। সাইকেলের সামনে উঠে বসে এক লাফে। বাবা সাইকেল চালাতে থাকেন। আনু একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে দরোজা ধরে মা বড় আপা মিনু আপা দাঁড়িয়ে আছেন।

দুটো টানা লম্বা ঘর—- ব্যাস, এই হচ্ছে ইস্কুল। সামনে সবুজ ঘাসে ভরা বিরাট মাঠ, তার দুদিকে দুটো গোল পোস্ট রোদে বৃষ্টিতে ভিজে পুড়ে কেমন কালো আর এবড়ো–থেবড়ো হয়ে গেছে? স্কুল ঘরের মাথার ওপর জামরুল আমলকি আর লিচু গাছের বড় বড় ডালগুলো নেমে এসেছে রাশি রাশি পাতা-পত্তর নিয়ে। ছাদ একেবারে ছেয়ে গেছে, টিনগুলোয় সবুজ স্যাঁতলা পরে গেছে। আনু হা করে তাকিয়ে দেখে—এই স্কুল! ক্লাশ বসে গেছে, বড় বড় জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ছেলেদের সার সার মাথা। কেউ নিচু হয়ে বই দেখছে, লিখছে, কেউ সামনে তাকিয়ে আছে, আবার কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে লুকিয়ে। সবাই ক্লাশে, তাই খাঁখাঁ করছে যেন ইস্কুলের মাঠ, রাস্তা, বারান্দা। মাঠের মাঝখানে বাবা নেমে পড়লেন সাইকেল থেকে। আনুও নামলো। বাবা বললেন, অঙ্ক সব ভালো করে মনে করে এসেছিস তো?

আনুর বুকের মধ্যে ঢিব ঢিব করে ওঠে। ঘাড় কাৎ করে জানায়–হ্যাঁ। বাবা সাইকেলটা বারান্দায় ঠেস দিয়ে রাখেন।

বাবা আগে ঢোকেন হেড মাস্টারের কামরায়। আনু মাথা নিচু করে তার পেছনে পেছনে আসে। দরোজার ভেতরে পা দিয়েই এক হাত তুলে সালাম করে সে ভীত-চোখ তুলে, তারপর কাঠের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।

মাথায় টাক, গাল থোবড়ানো, জ্বলজ্বলে এক জোড়া চোখ আর গায়ে গেরুয়া রংয়ের চাপকান এ ছাড়া হেড মাস্টারের আর কিছুই চোখে পড়েনি আনুর। দেখেই কেমন ভয় করে। মনে হয়, এখুনি বুঝি ধমক লাগাবেন। কেমন গম্ভীর আর রেগে টং হয়ে আছেন যেন।

বাবা হেড মাস্টারকে কি বলতে লাগলেন তার একবর্ণ কানে গেল না আনুর। তার কান গরম হয়ে উঠেছে, ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে, পা কাঁপছে, প্রস্রাব পাচ্ছে খুব। এখন সদি এক দৌড়ে সে বাসায় চলে যেতে পারত আপাদের কাছে তাহলে যা মজা হতো।

আনু ভয়ে ভয়ে আবার চোখ তোলে। দেয়ালে পৃথিবীর ম্যাপ ঝোলানো। আলমারিতে খাতাপত্র বই সার সার সাজানো। ময়লা কাঁচের ভেতর দিয়েও দেখা যাচ্ছে। আবার দুটো কাঁচ ভাঙা সেখানে পিচবোর্ড কেটে লাগিয়ে দেওয়া। এদিকে একটা লম্বা টেবিলের চারদিকে কয়েকটা হাতাওলা চেয়ার। টেবিলের ওপর চক ন্যাকড়া আর একগোছা বেত রাখা। আমলকির ডাল ভেঙে একটা বেত করা হয়েছে। লিকলিক করছে। ইস্, এইটে দিয়ে মারে নাকি! যা লাগবে!

হেড মাস্টারের ভারী গলার আওয়াজ শুনে চমকেই উঠেছিল আনু।

কাম হিয়ার, মাই বয়।

এক পা এক পা করে কাছে এসে টেবিল ঘেঁষে দাঁড়াল আনু। এক পলক তাকিয়ে দেখল বাবা হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে! আনু ঘামতে লাগল, ইংরেজিতে পড়া ধরবে নাকি? হেড মাস্টার আস্তে আস্তে থেমে থেমে জিগ্যেস করলেন, হোয়াট ইজ ইওর নেম?

মাই নেম ইজ আনোয়ার হোসেন।

হোয়াট ইজ ইওর ফাদারস্ নেম?

মাই ফাদারস নেম ইজ মৌলবি গোলাম হোসেন।

ভেরি গুড।

আনুর ভেতরটা যেন হঠাৎ হালকা হয়ে গেল। না, সে একটিও ভুল করেনি। বাবা বললেন, ওকে আমি নিজে পড়াই দুবেলা। হঠাৎ ট্রান্সফার হয়ে আসতে হলো। এখন ভর্তি না হলে স্কুলে যাবার অভ্যেসটাই ছুটে যাবে। ওখানে ফোরে পড়ত। এখানে ফোরেই অ্যাডমিশন নিক–বইপত্র হয়ত মিলবে না, কিন্তু একটা বছর নষ্ট হয়ে যায় তাহলে।

হেড মাস্টার হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, একমণ চালের দাম ৩৫ টাকা হলে আট সেরের দাম কত?

আনু বিড়বিড় করে হিসেব করতে লাগল মনে মনে। কি যেন আর্যাটা ছিল, কিছুতেই এখন মনে পড়তে চাইছে না তার। ঠকঠক করে পা কাঁপতে লাগল, পিপাসা পেল, তবু মনে হলো না। মাথা নিচু করে সে দাঁড়িয়ে রইলো। বাবার দিকে একবার তাকালো। বাবা তার দিকে তাকিয়ে আছেন। পারল না সে।

হেডমাস্টার আবার জিজ্ঞেস করলেন, একমণ চালের দাম ৩৫ টাকা হলে আট সেরের দাম কত হয়?

পা দিয়ে মেঝে খুঁটতে লাগল আনু।

বাবা হেসে বললেন, অঙ্কে ও বরাবরই একটু কাঁচা। কিরে আনু? ৩৫ টাকা মণ। এক সেরের দাম কত?

তাকে আট দিয়ে গুণ দিলেই বেরিয়ে আসবে।

এক সেরের দাম?

হ্যাঁ।

আচ্ছা থাক।

হেডমাস্টার বাঁচিয়ে দিলেন তাকে। বললেন, এই কবিতাটা পড় দেখি।

আনুকে একটা বই খুলে দিলেন। আনু অঙ্কের হাত থেকে বেঁচে গিয়ে, অঙ্ক না পারার লজ্জা ঢাকবার জন্যে, খুব মন দিয়ে পড়তে লাগল জোরে জোরে

ধন–ধান্যে পুষ্পে ভরা
আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা।
ও সে স্বপ্ন দিয়ে গড়া সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।
চন্দ্র–সূর্য–গ্রহ–তারা
কোথায় উজল এমন ধারা
কোথায় এমন খেলে তড়িত এমন কালো মেঘে।
ও তার পাখির ডাকে ঘুমিয়ে উঠি পাখির ডাকে জেগে।
এমন স্নিগ্ধ নদী কাহার
কোথায় এমন ধূম্র পাহাড়
কোথায় এমন হরিৎ-ক্ষেত্র আকাশ তলে মেশে।
এমন ধানের উপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে।

থাক, থাক।

হেডমাস্টার হাত তুললেন। আনু তাকিয়ে দেখে বাবা খুব খুশি হয়েছেন। আনু অবাক হয়ে দেখে বাবার চোখে পানি এসে গিয়েছে। চকচক করছে। বড় দেখাচ্ছে তাঁর চোখের কালো তারা। আনু তখন বিহ্বলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে বইটা মুড়ে বুকের কাছে ধরে।

হেডমাস্টার জিগ্যেস করলেন, হরিৎ–ক্ষেত্র মানে কি?

হরিৎ–ক্ষেত্র?

আনু আবার অস্বস্তিবোধ করতে থাকে। হরিৎ–ক্ষেত্র মানে তাহলে কি? হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় পরের লাইনে ধানের কথা আছে। সে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, হরিৎ–ক্ষেত্র মানে ধানের ক্ষেত।

       বাবার মুখের হাসিটা নিভে যায়। আনু বুঝতে পারে সে নিশ্চয়ই ভুল করেছে। পরক্ষণে বলে, আমি জানি না।

তুমি খানিকটা ঠিক বলেছ। হেডমাস্টার আশ্বাস দেন তাকে। হরিৎ মানে সবুজ শ্যাম। ধানের ক্ষেতও সবুজ। তবে হরিৎ–ক্ষেত্র মানে সবুজ মাঠ। যখনই নতুন শব্দ পাবে, দেখবে তার মানে জানো না, বাবাকে বা স্কুলে মাস্টার সাহেবকে জিগ্যেস কর। জিগ্যেস করে মানেটা বারবার মুখস্ত করে রাখবে। বুঝলে?

জি।

     আর বানানটা খাতায় দশবার লিখে শিখে রাখবে।

     আনু ঘাড় কাৎ করে সায় দেয়। হেডমাস্টার বইটা ফেরৎ নেন। বাবাকে বলেন, আচ্ছা। আপনার ছেলে এখন ফোরেই ক্লাশ করতে থাকুক। পরে দেখা যাবে কী হয়। এমনিতে বেশ স্মার্ট বলে মনে হচ্ছে।

      আনু বুঝতে পারে তার প্রশংসা হচ্ছে। তার লজ্জা হয় অঙ্কটা তার পারা উচিত ছিল। এখন হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় আর্যাটা। মনে পড়ে যায় পঁয়ত্রিশ টাকা মণ হলে এক সেরের দাম হয় চৌদ্দ আনা—-আট সেরের দাম সাত টাকা। কিন্তু বলতে পারে না। ঘনঘন চারদিকে তাকায়। বলবে? না, থাক। ইস, তখন মনেই পড়ছিল না। বাবা খামকাই বলেন, অঙ্কে কাঁচা। বাসায় গিয়ে বলবে বাবাকে, আট সেরের দাম সাত টাকা।

        হঠাৎ হেডমাস্টার চিৎকার করে ডাক দেন, বিলটু, বিলটু।

         কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কুলের দারোয়ান এসে দাঁড়ায়!

একে ক্লাশ ফোরে নিয়ে বসিয়ে দাওগে।

বাবা পেছন থেকে বলেন, ছুটির পরে একা আসতে পারবি বাসায়? না ইয়াসিনকে পাঠিয়ে দেব?

আনু বলে, নাহ্।

 বিল্টুর পেছনে ক্লাশের দিকে যেতে থাকে আনু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *